Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ছিন্নমস্তার অভিশাপ (১৯৭৮) – ফেলুদা || Satyajit Ray » Page 5

ছিন্নমস্তার অভিশাপ (১৯৭৮) – ফেলুদা || Satyajit Ray

রাজরাপ্পা হাজারিবাগ থেকে আশি কিলোমিটার। ৪৮ কিলোমিটার গিয়ে রামগড় পড়ে, সেখান থেকে বাঁয়ে রাস্তা ধরে গোলা বলে একটা জায়গা হয়ে ভেড়া নদী পর্যন্ত গাড়ি যায়। নদী হেঁটে পেরিয়ে খানিকদূর গিয়েই রাজরাপ্লা!

শঙ্করলাল মিশ্রের গাড়ি নেই। তিনি আমাদের গাড়িতেই এলেন। দুজন বেয়ারাকেও নেওয়া হয়েছে পিকনিকের দলে, তাদের একজন হল বুড়ো নূরমহম্মদ, যে মহেশবাবুর ওকালতির জীবনের শুরু থেকে আছে। অন্য জন হল ষণ্ডা মাক জগৎ সিং, যার জিম্মায় রয়েছে অরুণবাবুর বন্দুক আর টাটার বাক্স।

মিঃ মিশ্রকে দেখেই বেশ ভাল লেগেছিল, তার সঙ্গে কথা বলে আরও ভাল লাগল। ভদ্রলোকের জীবনের ঘটনাও শোনবার মতো। শঙ্করলালের বাবা দীনদয়াল মিশ্র ছিলেন মহেশবাবুর দারোয়ান। আজ থেকে পঁয়ত্ৰিশ বছর আগে, যখন শঙ্করলালের বয়স চার-দীনদয়াল নাকি এক’দিন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। দুদিন পরে এক কাঠুরে তার মৃতদেহ দেখতে পায় মহেশবাবুর বাড়ি থেকে প্রায় সাত-আট মাইল দূরে একটা জঙ্গলের মধ্যে। কোনও জানোয়ারের হাতে তার মৃত্যু হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু দীনদয়াল ওই জঙ্গলে কেন গিয়েছিল সেটা জানা যায়নি। একটা পুরনো শিবমন্দির আছে সেখানে, কিন্তু দীনদয়াল কোনওদিন সেখানে যেত না!

এই ঘটনার পর থেকে নাকি মহেশবাবুর ভীষণ মায়া পড়ে যায় বাপহারা চার বছরের শিশু শঙ্করলালের উপর। তিনি শঙ্করলালকে মানুষ করার ভার নেন। শঙ্করলালও খুব বুদ্ধিমান ছেলে ছিল; পরীক্ষায় বৃত্তি পায়, বি এ পাশ করে রাঁচিতে শঙ্কর বুক স্টোর্স নামে একটা বইয়ের দোকান খোলে। হাজারিবাগে ব্রাঞ্চ আছে, দু জায়গাতেই যাতায়াত আছে ভদ্রলোকের।

এই খবরটা শুনে অবিশ্যি লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করার লোভ সামলাতে পারলেন না। এই বইয়ের দোকানে বাংলা বইও পাওয়া যায় কি না।নিশ্চয়ই, বললেন শঙ্করলাল, আপনার বইও বিক্রি করেছি আমরা।

ফেলুদা সব শুনে বলল, মহেশবাবুর দ্বিতীয় ছেলে তা হলে আপনারই বয়সী ছিলেন?

বীরেন্দ্র ছিল আমার চেয়ে কয়েকমাসের ছাট, বলল। শঙ্করলাল। আমরা দুজন ইস্কুলে এক ক্লাসেই পড়েছি, যদিও কলেজের পড়াটা ওরা তিন ভাই-ই করেছে কলকাতায় ওদের এক জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে থেকে। বীরেনের পড়াশুনায় মন ছিল না। সে ছিল বেপরোয়া, রোম্যান্টিক প্রকৃতির ছেলে। উনিশ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।

ফেলুদা বলল, মহেশবাবুকি সাধুসংসর্গ-টর্গ করেন নাকি?

আগে করতেন না মোটেই, তবে ওঁর জীবনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমি যদিও দেখিনি, তবে শুনেছি। এককালে মিলিটারি মেজাজ ছিল, প্রচুর মদ্যপান করতেন। সব ছেড়ে দিয়েছেন। সাধুসঙ্গ না করলেও, আমার বিশ্বাস আজ রাজরাল্পায় পিকনিকের কারণ ছিন্নমস্তার মন্দির।

এটা কেন বলছেন?

উনি বাইরে বিশেষ প্রকাশ করেন না, কিন্তু আমি এর আগেও কয়েকবার রাজরাপ্পা গিয়েছি। ওঁর সঙ্গে। মন্দিরের সামনে এলে ওঁর মুখের ভাব বদলে যায় এটা লক্ষ করেছি।

অতীতে কি এমন কোনও ঘটনা ঘটে থাকতে পারে যার ফলে এটা হওয়া সম্ভব?

সেটা আমি বলতে পারব না। ভুলে যাবেন না, আমি ছিলাম ওঁর দারোয়ানের ছেলে।

সাড়ে দশটা নাগাত পরপর তিনখানা গাড়ি এসে থামল ভেড়া নদীর ধারে। আমাদের গাড়িটা ছিল সবচেয়ে পিছনে; আমাদের সামনে প্রীতীনবাবুর গাড়ি। তিনি প্ৰথমে নামলেন গাড়ি থেকে, হাতে টেপ রেকড়ার আর নেমেই চলে গেলেন বাঁয়ে জঙ্গলের দিকে। আমরা সবাই নামলাম। মহেশবাবু ছিলেন প্রথম গাড়িতে, তিনি আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, তাড়া নেই, নদী পেরিয়েই রাজরাল্পী, সঙ্গে ফ্লাস্কে কফি আছে, একটু রিল্যাক্স করে তবে ওপারে যাত্ৰা।

আমরা সবাই নদীর দিকে এগিয়ে গেলাম। পাহাড়ে নদী, যাকে বলে খরস্রোতা। বর্ষার ঠিক পরে এ নদী পেরোনো নাকি মুশকিল, কারণ তখন জল থাকে হাঁটু অবধি। ছোট বড় মেজ সোজো নানান সাইজের সাদা কালো খয়েরি পটাকিলে ছিটদার সব পাথর ডিঙিয়ে পাশ কাটিয়ে, যুগ যুগ ধরে সেগুলোকে মোলায়েম করে, পালিশ করে ব্যস্তবাগীশ ভেড়া নদী তড়িঘড়ি ছুটে চলেছে দামোদরে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। এই ঝাঁপের জায়গাই হল রাজরাপ্পা।

নীলিমা দেবী কফি ঢ়েলে দিলেন। কাগজের কাপে, আমরা সবাই একে একে গিয়ে নিয়ে নিলাম। প্রীতীনবাবুকে বোধহয় নদীর শব্দ বাঁচিয়ে পাখির ডাক রেকর্ড করতে হবে বলে। বনের একটু ভিতর দিকে যেতে হয়েছে। পাখি যে ডাকছে নানারকম সেটা ঠিকই।

এখানে এসে নতুন যাদের সঙ্গে আলাপ হল, ফেলুদার কায়দায় তাদের একটু স্টাডি করার চেষ্টা করলাম।

বয়সে যে সবচেয়ে ছোট, সে তার ডেলটাকে একটা পাথরের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল,চুপটি করে বসে থাকে। দুষ্টুমি করলেই ভেড়া নদীতে ফেলে দেব, তখন দেখবে মজা।

অরুণবাবু হাত থেকে কাগজের কাপ ফেলে দিয়ে একটু দূরে একটা ঝোপের পিছনে অদৃশ্য হলেন, আর তার পরেই ঝোপের মাথার উপর ধোঁয়া দেখে বুঝলাম। এই বয়সেও ভদ্রলোক বাপের সামনে সিগারেট খান না।

মহেশ চৌধুরী হাত দুটো পিছনে জড়ো করে নদীর কাছেই দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টে জলের দিকে চেয়ে আছেন।

ফেলুদা দুটো পাথর ঠোকাঠুকি করে সেগুলো চকমকি কি না পরীক্ষা করছিল, অখিলবাবু তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, আপনার রাশিটা কী জানা আছে? ফেলুদা বলল, কুম্ভ। সেটা গোয়েন্দার পক্ষে ভাল না খারাপ?

নীলিমা দেবী মাটি থেকে একটা বুনো হলদে ফুল তুলে সেটা খোঁপায় গুঁজে লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে গিয়ে কী একটা বলায় লালমোহনবাবু মাথাটা পিছনে হেলিয়ে স্মার্টলি হাসতে গিয়ে এক লাফে বাঁয়ে সরে গেলেন, আর নীলিমা দেবী খোলা হাসি হোসে বললেন, সে কী, আপনি গিরগিটি দেখে ভয় পাচ্ছেন?

শঙ্করলালকে খুঁজতে গিয়ে দেখি উনি ইতিমধ্যে কখন জানি নদী পেরিয়ে গিয়ে ওপরে একজন গেরুয়াধারী ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন। একটা বাসে কিছু যাত্রী এসেছিল, তারা একটুক্ষণ আগেই নদী পেরিয়েছে সেটা দেখেছিলাম।

কফি খাওয়া শেষ, প্রীতীনবাবুও এসে গেছেন, তাই আমরা ওপারে যাবার জন্য তৈরি হলাম। ধুতি, শাড়ি, প্যান্ট সবই একটু ওপরদিকে উঠে গেল, বিবি চড়ে বসল নূর মহম্মদের পিঠে, লালমোহনবাবু জলে নামবার আগে মনে হল চোখ বুজে কী জানি বিড়বিড় করে নিলেন, পেরোবার সময় বার তিনেক বেসামাল হতে হতে সামলে নিলেন, আর ওপারে পৌছিয়েই বললেন ব্যাপারটা যে এত সহজ সেটা উনি ভাবতেই পারেননি।

বাকি পথটার দু পাশে গাছপালা ছিল, যদিও সেটাকে জঙ্গল বলা চলে না। তাও লালমোহনবাবু সেদিকে বারবার আড়চোখে চাওয়াতে বুঝলাম উনি বাঘের কথা ভোলেননি।

একটা মোড়ে থিয়েটারের পদাৰ্থ সরে যাওয়ার মতো চোখের সামনে রাজরাল্পা বেরিয়ে পড়াতে লালমোহনবাবু এত জোরে বাঃ বললেন যে পাশের গাছ থেকে একসঙ্গে দুটো ঘুঘু উড়ে পালাল।

অবিশ্যি বাঃ বলার যথেষ্ট কারণ ছিল। আমরা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে দুটো নদীই দেখা যাচ্ছে। বট দিকে উত্তরে ভেড়া, আর ডাইনে নীচে দামোদর। জলপ্রপাতের জায়গাটা দেখতে হলে আরও এগিয়ে বাঁয়ে যেতে হবে, যদিও শব্দটা এখান থেকেই পাচ্ছি। সামনে আর নদীর ওপারে বিশাল বিশাল কচ্ছপের পিঠের মতো পাথর, দূরে বন, আর আরও দূরে আবছা পাহাড়ের লাইন।

মন্দির আমাদের বাঁয়ে বিশ হাতের মধ্যে। বাঝাই যায় অনেক’দিনের পুরনো, কিন্তু সেটাকে আবার নতুন করে সাজগোজ পরানো হয়েছে। এই ক’দিন আগেই কালীপুজোতে এখানে মোষ বলি হয়েছে বলে শুনলাম। লালমোহনবাবু বললেন এককালে নিঘাঁত নরবলি হত। অবিশ্যি সেটা যে খুব ভুল বলেছেন তা হয়তো না! বাসে যেসব যাত্রী এসেছে তাদের দেখার উৎসাহ নেই, তারা সবাই মন্দিরের সামনে জড়ো হয়েছে। শঙ্করলাল ঠিকই বলেছিলেন। মহেশ চৌধুরী প্রায় মিনিট খানেক ধরে মন্দিরের দরজার দিকে চেয়ে রইলেন, যদিও অন্ধকারে বিগ্রহটি দেখাই যায় না। তারপর ধীরে ধীরে চলে গেলেন অন্যরা যেদিকে গেছে সেইদিকে। আমরা তিনজনও সেইদিকেই এগিয়ে গেলাম।

খানিকটা যেতেই ফলসটা দেখতে পেলাম। যেখানে বালির উপর শতরঞ্চি পাতা হচ্ছে সেখান থেকে ওটা দেখা যাবে। লালমোহনবাবু বললেন, এটা কিন্তু ফাউ হয়ে গেল মশাই। হাজারিবাগ এসে সেকেন্ড দিনেই একজন রিটায়ার্ড অ্যাডভোকেটের জন্মদিনে পিকনিকে ইনভাইটেড হবেন, এটা কি ভাবতে পেরেছিলেন?

এ তো সবে শুরু, বলল ফেলুদা।

বলছেন?

দাবা খেলেছেন কখনও?

রক্ষে করুন মশাই।

তা হলে ব্যাপার বুঝতেন। দাবার শেষ দিকে যখন দুপক্ষের পাঁচটি কি সাতটি খুঁটি বোর্ডের এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন অনড় অবস্থাতেই তাদের পরস্পরের মধ্যে একটা বৈদ্যুতিক প্রবাহ চলতে থাকে। যারা খেলছে। তারা তাদের প্রত্যেকটি স্নায়ু দিয়ে ব্যাপারটা অনুভব করে। এই চৌধুরী পরিবারটিকে দেখে আমার দাবার খুঁটির কথা মনে হচ্ছে, যদিও কে সাদা কে কালো, কে রাজা কে মন্ত্রী, তা এখনও বুঝিনি।

আমরা মন্দির আর পিকনিকের জায়গার মাঝামাঝি একটা জায়গায় একটা অশ্বথগাছের তলায় পাথরের উপর বসলাম। এগারোটাও বাজেনি এখনও, খাবার তাড়া নেই, সবাইয়ের মধ্যে একটা নিশ্চিন্তু ঢিলেঢালা ভাব। অখিলবাবু বলিতে উবু হয়ে বসে বিবিকে হাত নেড়ে কী যেন বোঝাচ্ছেন; নীলিমা দেবী শতরঞ্চিাতে বসে তাঁর ব্যাগের ভিতর থেকে একটা ইংরেজি পেপারব্যাক বার করলেন, সেটা নিঘাত ডিটেকটিভ বই; প্রীতীনবাবু একটি টিবির উপর বসে তাঁর টেপ রেকর্ডারে একটা নতুন ক্যাসেট ভরলেন; অরুণবাবু জগৎ সিংয়ের কাছ থেকে তাঁর বন্দুকটা নিলেন, মহেশবাবু মাটি থেকে একটা পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে সেটা নেড়ে চড়ে দেখে আবিষ্কার ফেলে দিলেন। শঙ্করলালকে দেখছি না, বললেন। লালমোহনবাবু।

আছেন, তবে দূরে, বলল ফেলুদা

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম মন্দির ছাড়িয়ে আরও বেশ কিছুটা দক্ষিণে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে শঙ্করলাল কিছুক্ষণ আগে দেখা সেই গেরুয়াধারীটির সঙ্গে কথা বলছেন।একটু যে সাসপিশাস্‌ বলে মনে হচ্ছে, মন্তব্য করলেন লালমোহনবাবু।

ফেলুদারও স্যাসপিশাস মনে হচ্ছে কি না সেটা জানিবার আগেই আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন অরুণবাবু, তাঁর হাতে বন্দুক। ওটা দিয়ে কি বাঘ মারা যায়? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

সার্কাসের বাঘ এতদূর আসবে না, হেসে বললেন অরুণবাবু। সাম্বার মেরেছি এটা দিয়ে, তবে সাধারণত পাখিটখিই মারি। এটা টোয়েন্টি-টু।

তাই তো দেখছি।

আপনি শিকার করেন?

শুধু মানুষ!

আপনার কি কোনও এজেন্সি নাকি? না প্রাইভেট?

ফেলুদা তার প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর লেখা একটা কার্ড অরুণবাবুকে দিয়ে দিল ভদ্রলোক বললেন, থ্যাঙ্কস। কখন কাজে লেগে যায় বলা তো যায় না।

ভদ্রলোক যেদিক দিয়ে এসেছিলেন সেইদিকেই চলে গেলেন; ফেলুদা এই ফাঁকে কখন যে সেই সকলের কাগজটা পর্কেট থেকে বের করেছে সেটা দেখতেই পাইনি। লালমোহনবাবু কাগজটার দিকে ঝুকে পড়ে বললেন, বাংলা নামের কথা কী বলছিলেন মশাই?

এই দেখুন।

ফেলুদা পাশাপাশি লেখা চারটে ইংরেজি অক্ষরের দিকে দেখাল। লালমোহনবাবু ডুরু কুঁচকে বললেন, ওটা তো মনে হচ্ছে লক্‌ লিখতে গিয়ে বানান ভুল করে LOKC লিখেছে।

এলোকেশী। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। এরকম ভাবে ইংরিজি অক্ষরে বাংলা কথা আমিও লিখেছি ছেলেবেলায়।

বাঃ বললেন লালমোহনবাবু, সত্যিই তো। আর এই জাপানি নামটা?

ওকাহা? এটা একটা বাংলা সেনটেন্স। OKAHA।

ও, কে, এ, এইচ, এ? এটা একটা বাংলা সেনটেনস্! একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি?

ও, কে, এ, এইচ, এ–এটা তাড়াতাড়ি বলুন তো, না থেমে! দেখুন তো কী রকম শোনায়।

এবার লালমোহনবাবুর মুখে একটা বিস্ময় আর খুশি মেশানো ভাব দেখা দিল। ও কে এয়েচে! ওয়ান্ডারফুল!…বাঃ, বাঃ, এই তো, জলের মতো সোজা। –SO—এসো; DO–দিও; NADO—এনে দিও; NHE—এনেচি। –ও বাব্বা! এটা যে বিরাট সেনটেন্‌স; এর তো শেষ নেই মশাই!–AKLO ATBB BBSO ADK SO RO ADK SO AT KLO PC LO ROT OT DD OK OJT RO OG এ আমার সাধ্য নেই।

ধৈর্য নেই বলুন। তোপ্‌সে পড়। পাংচুয়েট করে নিলে জলের মতো সোজা।

খুব বেশি না ঠেকেই পড়ে গেলাম আমি। —

এ কে এল? এটি বিবি। বিবি এসে। এদিকে এসে। আরো এদিকে এসো। এটি কে এল? পিসি এল। আর ওটি? ওটি দিদি। ও কে? ও জেঠি। আর ও? ও ঝি।

ওটা কোথায় পেলেন। আপনারা? মহেশবাবু হাসিমুখে আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছেন।

আপনার বাগানের ধারে পড়ে ছিল, বলল ফেলুদা।

বিবিদিদিমণির সঙ্গে একটু খেলা করছিলাম আর কী।

সেটা আন্দাজ করেছি, বলল ফেলুদা। আমরা তিনজনেই উঠতে যাচ্ছিলাম, ভদ্রলোক বাধা দিয়ে আমাদের পাশেই পাথরের উপর বসে পড়লেন।

আরেকটি কাগজ দেখাব আপনাদের।

মহেশবাবুর মুখে আর হাসি নেই। পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে তার ভিতর থেকে একটা পুরনো ভাঁজ করা পোস্টকার্ড বার করলেন। —আমার দ্বিতীয় পুত্রের শেষ পোস্টকার্ড।

ফেলুদা পোস্টকার্ডটা নিয়ে ভাঁজ খুলল। একদিকে রঙিন ছবি। লেক সমেত জুরিখ শহরের দৃশ্য। উলটাদিকে শুধুই নাম ঠিকানা দেখে আমরা সকলেই বেশ অবাক।

মহেশবাবু বললেন, শেষের দিকে ও তাই করত। শুধু জানান দিয়ে দিত কোথায় আছে। আগেও দু-এক লাইনের বেশি লেখেনি কখনও।

ভদ্রলোক ফেলুদার হাত থেকে পোস্টকার্ডটা নিয়ে আবার ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দিলেন।

ফেলুদা বলল, বীরেনবাবু বিলেতে কী করতেন সেটা জানতে পেরেছিলেন?

মহেশবাবু মাথা নাড়লেন!মামুলি চাকরি করার ছেলে ছিল না বীরেন। সে ছিল যাকে বলে রেবেল। একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। গতানুগতিকের একেবারে বাইরে। তার আবার একটি হিরো ছিল। বাঙালি হিরো। একশো বছর আগে তিনিও নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে জাহাজের খালাসি হয়ে বিলেত যান। তারপর শেষ পর্যন্ত ব্ৰেজিল না মেক্সিকো কোথায় গিয়ে আর্মিতে ঢুকে কর্নেল হয়ে সেখানকার যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব দেখান।

সুরেশ বিশ্বাস কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। লালমোহনবাবুরও চোখ চকচক করে উঠেছে। বললেন, ইয়েস ইয়েস, সুরেশ বিশ্বাস। ব্ৰেজিলে মারা যান ভদ্রলোক। কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস।

মহেশবাবু বললেন, ঠিক বলেছেন। ওই নাম। কোথেকে তার একটা জীবনী জোগাড় করেছিল, আর সেটা পড়েই ওর অ্যাডভেঞ্চারের শখ হয়। আমি বাধা দিইনি। জানতাম দিলে কোনও ফল হবে না। উধাও হয়ে গেল। তারপর মাস দুয়েক পরে এল ইউরোপ থেকে এক চিঠি। হল্যান্ড, সুইডেন, জামানি, অস্ট্রিয়া.কী করছে কিছু বলে না, শুধু জানিয়ে দেয় সে আছে। চলে গেছে বলে যেমন দুঃখ হত, তেমনি নিজের চেষ্টায় নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে বলে গর্কও হত। তারপর সিক্সটি সেভানের পর আর চিঠি নেই।

মহেশবাবু কিছুক্ষণ উদাস চোখে দূরের গাছপালার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, সে আর আমার কাছে আসবে না। এত সুখ আমার কপালে নেই। আমার উপরে যে অভিশাপ লেগেছে!

সে কী হে, তুমি আবার অভিশাপ-টভিশাপে বিশ্বাস কর কবে থেকে?—অখিলবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। মহেশবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি আমার কোষ্ঠীই বিচার করেছি। অখিল, মানুষটাকে বিচার করনি।

ওইখানেই তো ভুল, বললেন অখিলবাবু, মানুষের কুষ্ঠি, মানুষের রাশি গ্ৰহ লগ্ন-এ সবের থেকে তো আলাদা নয় মানুষ। তোমায় বলেছিলুম। সেই ফটিটুতে, যে তোমার জীবনে একটা বড় চেঞ্জ আসছে—মনে আছে তোমার?-শুনুন মশাই— ফেলুদার দিকে ফিরলেন অখিলবাবু।–এই যে দেখছেন এঁকে এখন দেখলে বুঝতে পারছেন কি যে ইনি এককালে রাঁচি টু নেতারহাট যাবার পথে এঁর একটি পুরনো ফোর্ড গাড়ি বিকল হয়ে যাওয়ায় তার উপর রাগ করে সেটাকে পাহাড় থেকে হাজার ফুট নীচে ফেলে দিয়েছিলেন?

মহেশবাবু উঠে পড়েছিলেন। বললেন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলায় সেটা বলে দিতে কি জ্যোতিষীর দরকার হয়?

কথাটা বলে মহেশবাবু উত্তরদিকে চলে গেলেন, বোধহয় পাথরের সন্ধানে। অখিলবাবু বসলেন তাঁর জায়গায়। গল্প বলার মুড়ে ছিলেন ভদ্রলোক। বললেন, আশ্চর্য লোক এই মহেশ! আমি ওঁর পড়শি ছিলাম। যদিও অন্য দিক দিয়ে ব্যবধান বিস্তুর। আমি শিক্ষক, আর ও উদীয়মান অ্যাডভোকেট। ওর ছেলেদের টিউশনি করেছি। কিছুদিন, সেই থেকে আলাপ। অ্যালোপ্যাথিতে আস্থা ছিল না, তাই অসুখ-টসুখ করলে মাঝে মাঝে শিকড় বাকল চেয়ে নিত আমার কাছে। সামাজিক ব্যবধানটা কোনওদিন বুঝতে দিত না। আমার ছেলেকেও নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করত। কোনও স্নবরি ছিল না।

আপনার ছেলে কী করে?

কে, অধীর? অধীর ইঞ্জিনিয়ার। বোকারোয় আছে। খড়গপুরে পাশ করে ডুসেলডর্ফে চাকরি নিয়ে চলে গোসল। বিদেশেই ছিল বছর দশেক, তারপর–

একটা বিস্ফোরণের শব্দ অখিলবাবুর কথা থামিয়ে দিল। বন্দুক!–চেঁচিয়ে উঠল বিবি–জেঠু পাখি মেরেছে! আমরা রাত্তিরে তিতিরের মাংস খাব!

দেখি মহেশ আবার কোথায় গেল। অখিলবাবু যেন কিছুটা চিন্তিত ভাবেই উঠে পড়লেন।পাথর খুঁজতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে-টড়ে গেলে জন্মদিনটাই…

পিকনিক বলে মনে হচ্ছে না। প্রীতীনবাবুর স্ত্রী হাতের বইটা বন্ধ করে শতরঞ্চির উপর রেখে উঠে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। সবাই এমন ছড়িয়ে আছে কেন বলুন তো?

খিদে পেলেই সুড়সুড়ি করে এসে হাজির হবে, বলল ফেলুদা।

কিছু খেললে হত না?

তাস? বললেন লালমোহনবাবু, আমি কিন্তু স্কু ছাড়া আর কিছু জানি না।

তাও আবার টিলে, বলল ফেলুদা।

তাস তো আনিনি সঙ্গে, বললেন নীলিমা দেবী। এমনি মুখে মুখে কিছু খেলা যেতে পারে।

জল-মাটি-আকাশ হলে লালমোহনবাবু যোগ দিতে পারেন, বলল ফেলুদা।

সেটা আবার কী মশাই?

খুব সহজ, বললেন নীলিমা দেবী, ধরুন, আপনার দিকে তাকিয়ে আমি জল, মাটি, আকাশ এই তিনটের কোনও একটা বলে দশ গুনতে শুরু করব। জল বললে জলের, মাটি বললে মাটির, আর আকাশ বললে আকাশের একটা প্রাণীর নাম করতে হবে আপনাকে ওই দশ গোনার মধ্যে।

এটা খুব কঠিন খেলা বুঝি?

খেলে দেখুন একবার। আমি আপনাকেই প্রশ্ন করছি।

বেশ। রেডি। লালমোহনবাবু দম নিয়ে সোজা হয়ে যোগাসনে বসলেন। নীলিমা দেবী ভদ্রলোকের চোখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন–

আকাশ! এক দুই তিন চার পাঁচ—

এঁ—এঁ—এঁ–

ছয় সাত আট নয়–

বেঙুর।

ফেলুদা অবিশ্যি জানতে চাইল বেঙুরটা কোন গ্রহের আকাশে চরে বেড়ায়। তাতে লালমোহনবাবু বললেন যে ক্যাঙ, হাঙর। আর বেলুন-এই তিনটে তিনি ভেবে রেখেছিলেন, বলার সময় তালগোল পাকিয়ে গেছে। তাতে ফেলুদা বলল যে বেলুনকে প্রাণী বলা যায় কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে; কিন্তু লালমোহনবাবু কথাটা মানতে চাইলেন না। বললেন, বেলুনে অক্সিজেন লাগে, প্রাণীরও অক্সিজেন ছাড়া চলে না, সুতরাং প্রাণী বলব না কেন মশাই? ফেলুদা বলল যে সে হাওয়া, হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের বেলুনের কথা শুনেছে, এমন কী কয়লার গ্যাসের বেলুনের কথাও শুনেছে, কিন্তু অক্সিজেন বেলুনের কথা এই প্রথম শুনল।

নীলিমা দেবী তর্ক থামানোর জন্য হাত তুলেছিলেন, ঠিক সেই সময় এমন একটা ঘটনা ঘটল যে তর্ক আপনিই থেমে গেল।

প্রীতীন্দ্ৰবাবু।

মানুষে একসঙ্গে দুঃখ আর আতঙ্ক অনুভব করলে তার কীরকম ভাবভঙ্গি হতে পারে, লিওনাদোঁ দা ভিঞ্চির করা তার একটা ড্রইং ফেলুদা একবার আমাকে দেখিয়েছিল। প্রীতীনবাবুর চেহারা অবিকল সেই ছবির মতো।

ভদ্রলোক একটা ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়লেন।

নীলিমা দেবী ছুটে গেলেন স্বামীর দিকে, যদিও ফেলুদা তার আগেই পৌঁছে গেছে। কিন্তু ভদ্রলোকের মুখ দিয়ে কথা বেরোতে বেশ সময় লাগল।

বা…বা…বাবা! বললেন প্রীতীনবাবু, আর সঙ্গে সঙ্গে তার ডান হাতটা পিছন দিকে নির্দেশ করল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress