হরিনারায়ণবাবুর মেয়ে লীনা
শনিবার সকাল দশটায় বোসপুকুর গিয়ে প্রথমেই যার সঙ্গে কথা হল, সে হল হরিনারায়ণবাবুর মেয়ে লীনা। লীনার আজ ইস্কুল ছুটি, সে ক’দিন থেকেই শুনেছে বাড়িতে ডিটেকটিভ এসেছে। তাই উদগ্ৰীব হয়ে আছে। ফেলুদার ভক্ত হওয়াতে তার সঙ্গে কথা বলতে আরও সুবিধা হল।
তোমার ছোটকাকা তোমাকে খুব ভালবাসতেন, তাই না? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
শুধু ভালবাসতেন না, বলল লীনা, আমরা দুজনে বন্ধু ছিলাম। কাকার সব লেখা আগে আমাকে পড়ে শোনাতেন। আমার যদি কোনও জায়গা গোলমাল লাগত। তা হলে কাকা সেটা বদলে দিতেন।
আর গান?
আমাকে প্রথম শোনাতেন।
তুমি নিজে গান ভালবাস?
আমি পিয়ানো শিখছি।
তার মানে তো বিলিতি বাজনা।
হ্যাঁ, কিন্তু আমার রবীন্দ্রসংগীতও ভাল লাগে, আর কাকার গানও ভাল লাগত। আমি নিজেও গান করি একটু একটু।
তোমার কাকা কোনওদিন ভারত অপেরা ছেড়ে দেবার কথা বলেছিলেন তোমাকে?
বীণাপাণি অপেরা কাকাকে অনেক টাকা দিতে রাজি হয়েছিল, কিন্তু আমার মনে হয় না। কাকা কোনওদিন ভারত অপেরা ছাড়তেন। আমায় বলতেন, আমার শেকড় ভারত অপেরায়; শেকড় তুলে অন্য জায়গায় গেলে কি আর আমি বাঁচব?
কাকা একটা নতুন নাটক লিখছিলেন সেটা তুমি জান?
একটা কেন; সম্রাট অশোক তো শেষ হয়নি; তা ছাড়া কাকার চারটে নাটক লেখা ছিল। এছাড়া ওঁর প্রায় পনেরো-কুড়িটা খুব ভাল ভাল গান লেখা ছিল যেগুলো এখনও যাত্রায় ব্যবহার হয়নি। আর নাটকের খসড়া যেগুলো ছিল-সেও প্রায় আট-দশটা হবে।–সেগুলো তো খসড়াই রয়ে গেল!
লীনার সঙ্গে কথা বললাম। প্ৰদ্যুম্নবাবুর ঘরে। খুব সাদাসিধে। ঘর, লাইব্রেরির ঠিক পাশেই। ভদ্রলোক বললেন যে ওঁর রিসার্চের কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে, এর পর কাগজপত্র সব নিয়ে উনি বইটা লেখার জন্য শ্ৰীীরামপুরে ওঁর বাড়িতে চলে যাবেন! ওঁর আন্দাজ এক বছর লাগবে। বইটা লিখতে।
অবিশ্যি রহস্যের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে এখানে থাকতেই হবে সেটা বোধ হয় বুঝতেই পারছেন।
সে কথা পুলিশ আগেই বলে দিয়েছে।
আপনি চলে গেলে কীর্তিনারায়ণবাবুর সেক্রেটারির কী হবে?
সে আমি অন্য একটি ছেলেকে বদলি দিয়ে যাব। জীবনী একবার লিখতে আরম্ভ করলে অন্য কোনও দিকে মন দিতে পারব না।
ফেলুদা ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখছিল, আর ঘরের দরজা দিয়ে বাইরের কী অংশ দেখা যায় সেটাও দেখছিল। দেখলাম প্ৰদ্যুম্নবাবুর শোবার ঘর থেকে ইন্দ্রনারায়ণবাবুর কাজের ঘরের দরজাটা দেখা যায়, কিন্তু লাইব্রেরি থেকে দুটোর একটা ঘরও দেখা যায় না। ঘরের পিছনের জানালা দিয়ে বাইরে গলি দেখা যায়—যদু নস্কর লেন। বোসপুকুর রোডটা হল বাড়ির সামনে, অর্থাৎ দক্ষিণ দিকের বাগানের পরে।
লীনা ইতিমধ্যে তার বাবা হরিনারায়ণবাবুকে আমাদের কথা বলে রেখেছেঃ আমরা দোতলায় দক্ষিণ দিকের বারান্দার পাশে একটা বৈঠকখানায় গিয়ে হাজির হলাম। বেশ সুন্দর সাজানো ঘর, তাতে কিছু দামি পুরনো জিনিসও রয়েছে বলে মনে হল। যে সব জিনিস মানুষ কিউরিওর দোকান থেকে কেনে। ঘরের এক পাশে একটা বড় তাকে হাইফাই যন্ত্র রেকর্ড আর ক্যাসেট চালনার জন্য, আর তাকের উপরে দুদিকে দুটো স্টিরিও স্পিকার।
হরিনারায়ণবাবুকে দেখেই লীনার বাবা বলে বোঝা যায়। বেশ সুপুরুষ চেহারা, রং এ বাড়ির আর সকলের মতোই ফরাসা, খালি শরীরে মাংসটা একটু বেশি।
ভদ্রলোক ফেলুদা আর লালমোহনবাবুকে বললেন, আপনাদের দুজনের নামই শোনা বলে মনে হচ্ছে। এখন বলুন কীভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি।
ফেলুদা প্রথমেই কাজের কথায় গেল না। বলল, আপনার তো দেখছি বিরাট গান-বাজনার কালেকশন।
হ্যাঁ, তা বিশ বছর হল শুনছি। ওয়েস্টার্ন মিউজিক। ওটাতেই কান বসে গেছে, দিশি আর ভাল লাগে না।
আপনার কোনও ফেভারিট কম্পোজার আছে নেকি?
চিাইকোভস্কি খুব ভাল লাগে; সুমান, ব্রাম্স, শৌপ্যাঁ।
অর্থাৎ রোম্যান্টিক যুগটাই আপনার বেশি প্রিয়?
হ্যাঁ।
আপনার ছোট ভাই বেহালা বাজালেও বিলিতি সংগীতের দিকে ঝোঁকেননি বোধহয়।
না। ওর ব্যাপারটা ছিল একেবারে উলটো। শুনেছি। ওর নাকি ট্যালেন্ট ছিল, কিন্তু যাত্ৰা দেখার কোনও তাগিদ কোনওদিন অনুভব করিনি। আমার স্ত্রী আর মেয়ে গেছে কয়েকবার।
ইন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু সম্বন্ধে আপনার নিজের কোনও থিওরি আছে?
ব্যাপার কী জানেন, ও যে ক্লাসের লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করত তাদের তো আর ঠিক ভদ্রলোক বলা চলে না। যাত্রার পরিবেশটিাই খারাপ! কোথায় কার সঙ্গে কী গোলমাল পাকিয়ে রেখেছিল কে জানে? তারই একজন এসে বদলা নিয়েছে–এ ছাড়া আর কী? জিনিসপত্র যখন কিছুই চুরি যায়নি তখন আর কী কারণ থাকতে পারে তা তো আমি জানি না। ওর সঙ্গই ওর কাল হয়েছিল। আপনি এনকোয়ারি করতে চাইলে ওই যাত্রা পাটিগুলোতে গিয়েই করুন। এখানে বিশেষ সুবিধে করতে পারবেন না।
পুলিশে খবর কি আপনার দাদা দেন?
আমি, দাদা দুজনেই দিই! বাড়িতে খুন হলে সেটাই তো স্বাভাবিক। চন্টু করে কেউ প্রাইভেট ডিটেকটিভ ডাকে কি? বাবার তাই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বাবা চিরকালই ছিটগ্ৰস্ত। কী করে যে ব্যারিস্টারি করেছেন এতদিন তা জানি না!
আপনার বাবা বোধহয় আপনার ছোট ভাইকে খুব ভালবাসতেন।
সেটাও ওই ছিটেরই উদাহরণ। বাবা গতানুগতিকতা পছন্দ করেন না। এই ব্যাপারে বাবার সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষ কন্দৰ্পনারায়ণের মিল আছে।
ফেলুদা উঠে পড়ল। আমিও বুঝতে পারছিলাম যে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আর কথা বলে কোনও ফল হবে না।
বড় ভাই দেবনারায়ণ ছিলেন বাড়ির পশ্চিম দিকের বারান্দায়, বেতের চেয়ারে বসে। সামনে বেতের টেবিল, তার উপর কোল্ড বিয়ার রাখা। আমাদের অভিবাদন জানিয়ে ভদ্রলোক বিয়ার অফার করলেন, আমরা স্বভাবতই মাথা নেড়ে না জানালাম।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ এমপ্লয় করা বুঝি বাবার প্ল্যান?
ফেলুদা হেসে বলল, বোধহয় তাই, কারণ আর কারুরই শখের গোয়েন্দার উপর আস্থা নেই।
এ জিনিস উপন্যাসে চলে, রিয়েল লাইফে চলে না।
ভদ্রলোক কথাগুলো বলছেন একেবারে শুকনো মুখে। সত্যি বলতে কী, এত গভীর লোক কমই দেখেছি।
দেবনারায়ণবাবু বললেন, আমার ভাইয়ের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করবেন তো? সেটা অনুমান করেই বলছি, ইন্দ্রনারায়ণ ছিল আমাদের পরিবারের কলঙ্ক। আমাকে ক্লাবে অনেক সময়ই লোকে তার কথা জিজ্ঞেস করেছে; তার যাত্রা কেমন চলছে, গান পপুলার হচ্ছে কিনা, সে বেহালা কেমন বাজায়-ইত্যাদি। আমি মাথা হেঁট না করে কোনও কথার জবাব দিতে পারিনি। আমাদের আপনি ভাইয়ের এই দশা হবে এ আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। তার মৃত্যুর জন্যেও সে নিজেই দায়ী। তার উপর আমার কোনও সহানুভূতি নেই। আর আপনিও যে তদন্তের ভার নিয়েছেন, আপনার ওপরেও আমার কোনও সিমপ্যাথি নেই। ওকে খুন করেছে। যাত্রা দলের গুণ্ডা। দে আর অল পোটেনশিয়াল ক্রিমিন্যালস। আপনি কাকে ছেড়ে কাকে ধরবেন?
দেবনারায়ণবাবুর সঙ্গে কথাও এইখানেই শেষ হয়ে গেল।
নীচে আসার সময় ফেলুদা প্ৰদ্যুম্নবাবুকে বলল, একটা জিনিস দেখার বড় কৌতুহল হচ্ছে আমার; কন্দৰ্পনারায়ণের বিলেতের ডায়রি; কাটা খণ্ড আছে সবসুদ্ধ?
দুটো। উনি বিলেতে ছিলেন এক বছরের কিছু বেশি।
ওটা দিন-তিনেকের জন্য ধারা পাওয়া যাবে?
নিশ্চয়ই।
ফেলুদা তার থলিতে বই দুটো নিয়ে নিল, আমরা আবার বাড়িমুখে রওনা দিলাম।