Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বোসপুকুরে খুনখারাপি (১৯৮৫) – ফেলুদা || Satyajit Ray » Page 2

বোসপুকুরে খুনখারাপি (১৯৮৫) – ফেলুদা || Satyajit Ray

আমাদের বন্ধু রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ুর পাল্লায় পড়ে শেষটায় যাত্রা দেখতে হল। এখনকার সবচেয়ে নামকরা যাত্রার দল ভারত অপেরার হিট নাটক সূৰ্যতোরণ। এটা বলতেই হবে যে যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ জমে যেতে হয়। কোথাও কোনও টিলেঢালা ব্যাপার নেই; অ্যাকটিং একটু রং চড়া হলেও কাউকেই কাঁচা বলা যায় না। লালমোহনবাবু ফেরার পথে বললেন, আমার গল্পের যা গুণ, এরও তাই! মনকে টানবার শক্তি আছে পুরোপুরি। অথচ তলিয়ে দেখুন, দেখবেন অনেক ফাঁক, অনেক ফাঁকি।

কথাটা বড়াই-এর মতো শোনালেও, অস্বীকার করা যায় না। লালমোহনবাবুর লেখাও তলিয়ে দেখলে তাতে তেমন কিছু পাওয়া যাবে না। অথচ ভদ্রলোকের পপুলারিটি কিন্তু একটা চমক লাগার মতো ব্যাপার। নতুন বই বেরোনোর পরদিন থেকে একটানা তিন মাস বেস্ট সেলর লিস্টে নাম থাকে। অথচ উনি বেশি লেখেন না; বছরে দুটো উপন্যাস-একটা বৈশাখে, একটা পুজোয়। আজকাল তথ্যের ভুল আগের চেয়ে অনেক কম থাকে। কারণ শুধু যে ফেলুদাকে পাণ্ডুলিপি –দেখিয়ে নেন তা নয়, সম্প্রতি নিজেও অনেক রকম এনসাইক্লোপিডিয়া ইত্যাদি কিনেছেন। সেগুলোর যে সদ্ব্যবহার হচ্ছে সেটা বইগুলো পড়লেই বোঝা যায়।

সূৰ্যতোরণ যাত্রা নামটা প্রথমেই করার কারণ হল, এই যাত্রার সঙ্গে যুক্ত এক ভদ্রলোককে নিয়েই আমাদের এবারের তদন্ত। ভদ্রলোকের নাম ইন্দ্রনারায়ণ আচার্য। এরই লেখা নাটক, গানও এর লেখা, অর্থাৎ নিজেই গীতিকার—আর ইনি নিজেই অর্কেস্ট্রায় বেহালা বাজান। মোট কথা গুণী লোক। তাঁকে নিয়ে যে গোলমালটা হল সেটা অবিশ্যি খুবই প্যাঁচালো ব্যাপার, আর ফেলুদাকে তার বুদ্ধির শেষ কণাটুকু খরচ করে এই রহস্যের সমাধান করতে হয়েছিল।

আমরা যাত্রা দেখবার দিন দশেক পরেই এক’দিন টেলিফোনে অ্যাপিয়েন্টমেন্ট করে ইন্দ্রনারায়ণবাবু নিজেই আমাদের লালমোহনবাবু যথারীতি নটার মধ্যেই আড়া মারতে চলে এসেছেন, দশটা নাগাত ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন। যাকে বলে ক্লিন শোভন চেহারা, বয়স আন্দাজ চল্লিশ-বেয়াল্লিশ, রং ফরসা। হাইট মাঝারির চেয়ে একটু বেশি, মাথার চুল প্রায় সবই কাঁচা। ফেলুদা প্রথমেই সূৰ্যতোরণের প্ৰশংসা করে বলল, আপনি তো মশাই ম্যান অফ মেনি পার্টস, এত রকম শিখলেন। কী করে? ভদ্রলোক হালকা হেসে বললেন, আমার লাইফ হিস্ট্রিটা একটু বেয়াড়া ধরনের। আমার ফ্যামিলির কথা জানলে পরে বুঝবেন যে আমার যাত্রার সঙ্গে কানেকশনটা কত অস্বাভাবিক। আপনি কি বোসপুকুরের আচার্য পরিবারের কথা জানেন?

হ্যাঁ হ্যাঁ, ফেলুদা বলল, সে তো অতি নামকরা ফ্যামিলি মশাই। আপনাদেরই এক পূৰ্বপুরুষ ছিলেন না। কন্দৰ্পনারায়ণ আচাৰ্য? যিনি বিলেত গিয়ে প্রিন্স দ্বারকানাথের মতো নবাবি মেজাজে থাকতেন?

আপনি ঠিকই বলেছেন, বললেন ইন্দ্রনারায়ণবাবু। কিন্দৰ্পনারায়ণ ছিলেন আমার ঠাকুরদার বাবা। আঠারো শো পচাত্তরে বিলেত যান। অত্যন্ত শৌখিন লোক ছিলেন। গান-বাজনার শখ ছিল। তাঁর কিনে আনা বেহালাই আমি বাজাই। আমাদের পরিবারে এক আমার মেজো দাদা হরিনারায়ণ ছাড়া গান-বাজনার দিকে আর কেউ যায়নি। সে অবিশ্যি কিছু বাজায়-টাজায় না; তার উচ্চাঙ্গ সংগীতের শখ। সে রেকর্ড আর ক্যাসেট শোনে। যাই হোক, পরিবার যে খানদানি সে তো বুঝতেই পারছেন। আমরা তিন ভাই-আমি, হরিনারায়ণ আর দেবনারায়ণ। আমি ছোট, দেবনারায়ণ বড়। দেব ব্যবসায়ী আর হরি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। আমাদের বাবা বেঁচে আছেন। নাম কীর্তিনারায়ণ, বয়স উনআশি; উনি ব্যারিস্টার, যদিও এখন আর কোর্ট-কাছারি করার সামৰ্থ্য নেই। বুঝতেই পারছেন, এই অবস্থায় আমার যাত্রার সঙ্গে যোগটা কত অস্বাভাবিক। কিন্তু আমার ছেলেবেলা থেকেই ওই দিকে শাখা। আই. এ. পাশ করে আর পড়িনি। বেহালা শিখেছি মাস্টার রেখে, গান করতাম, গান লিখতাম খুব কম বয়স থেকেই। বাবাকে সোজাসুজি বলি যে আমি যাত্রায় জয়েন করব। বাবার আবার কেন জানি আমার উপর একটা দুর্বলতা ছিল, তাই আমার আবদারটা মেনে নিলেন। এখন অবিশ্যি আমি আমার অন্য দু ভাইয়ের চেয়ে কম কিছু রোজগার করি না। যাত্রার আর্থিক সচ্ছলতার কথাটা জানেন তো?

তা আর জানি না, বললেন লালমোহনবাবু। হিরো-হিরোইন মাইনে পায় পঁচিশ-ত্রিশ হাজার টাকা করে।

আমার নিজের কথাটা নিজেই বলছি বলে কিছু মনে করবেন না, বললেন ইন্দ্রনারায়ণবাবু, কিন্তু আজি ভারত অপেরার যে এত নাম-ডাক সেটা প্ৰায় অনেকটাই আমার জন্য। আমার নাটক, আমার গান, আমার বাজনা-এগুলো ভারত অপেরার বড় অ্যাট্রাকশন, এবং আমার গোলমালটাও এর থেকেই।

কথাটা বলে ভদ্রলোক থামলেন। তার একটা কারণ অবিশ্যি শ্ৰীনাথ চা এনেছে তাই। ফেলুদা বলল, আপনি কি অন্য দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন। আমাকে বেশি টাকার প্রলোভন দেখিয়ে ভাঙিয়ে নেবার চেষ্টা তো অনেক দিন থেকেই চলছে। টাকা জিনিসটাকে তো আর অগ্রাহ্য করা চলে না, তবে ভারত অপেরার সঙ্গে আমি আছি আজি সতেরো বছর ধরে। এরা আমাকে যথেষ্ট যত্ন-আত্তি করে, আমার গুণের মর‍্যাদা দেয়। কাজেই এ দল ছেড়ে অন্য দলে যাবার আগে অনেকবার ভাবতে হয়। আমি তাই এদের সবাইকে ঠেকিয়ে রেখেছি। কিন্তু সেদিন যেটা হল এবং যেটার জন্য আমি আপনার কাছে আসতে বাধ্য হলাম।–সেটা হল আমাকে হটিয়ে ভারত অপেরাকে পঙ্গু করার চেষ্টা।

হটিয়ে মানে?

সোজা কথায় খুন করে।

এটার প্রমাণ কী?

প্রমাণ একেবারে শারীরিক আক্রমণ। তিন দিন আগের ঘটনা। এখনও কাঁধে ব্যথা রয়েছে।

কোথায় হল আক্রমণটা?

বিডন স্ট্রিট থেকে বেরিয়েছে মহম্মদ শফি লেন। সেখানে একটা বাড়িতে আমাদের আপিস আর রিহাসালের ঘর। গলিটো অন্ধকার এবং নিরিবিলি। সেদিন আবার ছিল লোডশেডিং। ডিসি অফ। আমি যাচ্ছি। আপিসে, এমন সময় পিছন থেকে এসে মারাল রড জাতীয় একটা কিছু দিয়ে। মাথায় মারতে চেয়েছিল বোধহয়; অল্পের জন্য পারেনি। সৌভাগ্যক্রমে ঠিক সেইসময় আমাদের দলের দুজন অভিনেতা আসছিল গলি দিয়ে আপিসেই। আমি তখন মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। তারা আমাকে তুলে আপিসে নিয়ে গিয়ে সব ব্যবস্থা করে। আমার হাতে বাক্সে বেহালা ছিল, সেটা পড়ে যায় রাস্তায়। আমার সবচেয়ে ভয় ছিল সেটার বুঝি কোনও ক্ষতি হয়েছে–কিন্তু দেখলাম তা হয়নি! এখন, আমি আপনার কাছে এসেছি আমার কী করা উচিত সে বিষয়ে পরামর্শ নিতে।

ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, এই অবস্থায় তো আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। আর যে লোক আপনাকে আক্ৰমণ করেছে সে যে বিরুদ্ধ পার্টির লোক এমনও ভাবার কোনও কারণ দেখছি না। সে সাধারণ চোর ছ্যাঁচড় হতে পারে।–হয়তো আপনার মানিব্যাগ হাতানোর তালে ছিল। আপনি বরং পুলিশে খবর দিতে পারেন। এর বেশি আর আমার দিকে থেকে কিছু বলা সম্ভব নয়, মিঃ আচাৰ্য। তবে আর যদি কোনও ঘটনা ঘটে তা হলে আপনি আমাকে জানাবেন। কিন্তু এ ব্যাপারে পুলিশ আপনাকে আরও বেশি সাহায্য করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। এটুকু বলতে পারি যে আপনার পরিবারিক ইতিহাস আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগল। এ রকম পরিবার থেকে কেউ কোনওদিন যাত্রায় যোগ দিয়েছে বলে আমার জানা নেই।

আমাকে বলা হত আচাৰ্য ফ্যামিলির ব্ল্যাক শিপ, বললেন ইন্দ্রনারায়ণবাবু, অন্তত আমার ভাইরা তাই বলতেন।

ইন্দ্রনারায়ণবাবু আর বসলেন না। উনি চলে যাবার পর ফেলুদা দুটো ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বলল, ভাবতে অবাক লাগে যে মাত্র একশো বছর আগে এই আচাৰ্য ফ্যামিলির কন্দৰ্পনারায়ণ বিলেত গিয়ে চুটিয়ে নবাবি করেছে, আর আজ সেই ফ্যামিলিরই ছেলে মহম্মদ শফি লেনে যাত্রার রিহার্সাল দিতে গিয়ে গুণ্ডার হাতে ব্লডের বাড়ি খাচ্ছে। মাত্র তিন জেনারেশনে এই পরিবর্তন কল্পনা করা যায় না।

অবিশ্যি পরিবর্তনটা হয়েছে শুধু এরই ক্ষেত্রে, বললেন লালমোহনবাবু। অন্য ভাইদের কথা যা শুনলুম তাতে তো মনে হয় তাঁরা দিব্যি আচাৰ্য ফ্যামিলির ট্র্যাডিশন চালিয়ে যাচ্ছেন। যাই হোক, বলল ফেলুদা, ফ্যামিলিটাকে ইন্টারেস্টিং লাগছে! বোসপুকুরে একবার গিয়ে পড়তে পারলে মন্দ হত না।

সেই বোসপুকুরের আচার্য বাড়িতে যাবার সুযোগ যে কয়েক’দিনের মধ্যেই এসে পড়বে তা কে জানত?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress