লালমোহনবাবু ডিনারে
লালমোহনবাবু ডিনারে বিশেষ সুবিধে করতে পারলেন না, কারণ ওঁর নাকি একদম খিদে নেই। ফেলুদা বলল তাতে কিছু এসে যাবে না, কারণ দুপুরে কপার চিমনিতৃ পেট পুজোঁটা ভালই হয়েছে। সত্যি বলতে কী, আমাদের মধ্যে লালমোহনবাবুই সবচেয়ে বেশি খেয়েছিলেন।
খাওয়ার পর গতকাল তিনজনেই বেরিয়ে গিয়ে পান। কিনেছিলাম। আজ লালমোহনবাবু কিছুতেই বেরোতে চাইলেন না। বললেন, ওই ভিড়ের মধ্যে কে যাচ্ছে মশাই? সান্যালের লোক নিৰ্ঘাত হোটেল ওয়াচ করচে, বেরোলেই চাক্কু।
শেষ পর্যন্ত ফেলুদাই বেরোল, লালমোহনবাবু আমাদের ঘরে আমার সঙ্গে বসে রইলেন, আর বার বার খালি বলতে লাগলেন, কী কুক্ষণেই বইয়ের প্যাকেটটা নিয়েছিলাম। ক্ৰমে বর্তমান সংকটের মূল কারণ খুঁজতে খুঁজতে কী কুক্ষণেই হিন্দি ছবির জন্য গল্প লিখেছিলাম, আর সব শেষে কী কুক্ষণেই রহস্য উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম পর্যন্ত চলে গেলেন।
আপনার একা শুতে ভয় করবে না তো? ফেলুদা পান বিলি করে জিজ্ঞেস করল। লালমোহনবাবু কোনও উচ্চবাচ্য করছেন না দেখে ফেলুদা আশ্বাস দিয়ে বলল, আমাদের ঘর। থেকে বেরিয়েই প্যাসেজের ধরে একটা ছোট্ট ঘর আছে দেখেছেন তো? ওখানে সব সময় বেয়ারা থাকে। হোটেলে সারা রাত কেউ না কেউ জেগে থাকে। এ তো আর শিবাজী কাসল না।
শিবাজী কাসল নামটা শুনে লালমোহনবাবু আরেকবার শিউরে উঠলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে সাহস এনে দশটা নাগাদ গুইেডনাইট করে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
সারা দিন বম্বে চষে বেড়ানোর চেয়েও পুলকবাবুর ছবির অর্ধেক দেখে অনেক বেশি। কহিল লাগছিল, তাই জটায়ু চলে যাবার মিনিট দিশেকের মধ্যেই শুয়ে পড়লাম! ফেলুদা যে এখন শোবে না, সেটা জানি। ওর নোটবুকটা খাটের পাশেই টেবিলের উপর রাখা রয়েছে, সারা দিন খেপে খেপে তাতে অনেক কিছু লেখা হয়েছে, হয়তো আরও কিছু লেখা হবে।
আমি অনেক দিন চেষ্টা করেছি। রাত্রে বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে খেয়াল রাখতে ঠিক কোন সময় ঘুমটা আসে, কিন্তু প্রতিবারই পরদিন সকালে উঠে বুঝেছি, ঘুমটা কখন জানি আমার অজান্তেই এসে গেছে। আজও কখন ঘুমিয়েছি সেটা টের পাইনি। ঘুমটা ভাঙলি দরজায় ঘন ঘন ধাক্কা, আর সেই সঙ্গে বোতাম টেপার চৰ্দা শব্দে। উঠে দেখি, ফেলুদার ল্যাম্প তখনও জ্বলছে আর বালিশের পাশে রাখা আমার ঘড়িতে বলছে পৌনে একটা। ফেলুদা দরজা খুলতেই হুমড়ি দিয়ে প্রবেশ করলেন জটায়ু।
লালমোহনবাবু হাঁপালেও তিনি যে খুব ভয় পেয়েছেন সেটা কিন্তু মনে হল না, আর যে-কথাটা বললেন ঘরে ঢুকেই, সেটাও ভয়ের কথা নয়।
কেলেঙ্কারিয়াস ব্যাপার মশাই।
আগে খাটে এসে বসুন, বলল ফেলুদা।
দুর মশাই, বসব কী—এই দেখুন-কাঠমাণ্ডুর কী মহামূল্য ধনরত্ন আমার হাত দিয়ে পাচার করা হচ্ছিল।
লালমোহনবাবু ফেলুদার সামনে যেটা এগিয়ে ধরলেন, সেটা একটা বই। ইংরেজি বই, আর নাম-করা বই; ল্যান্সডাউনের মোড়ের দোকানো একটা রাখা ছিল, সে দিনও দেখেছি।
বইটা হল শ্ৰীঅরবিন্দের লেখা দ্য লাইফ ডিভাইন।
ফেলুদারও চোখ কপালে উঠে গেছে।
তার উপর আবার বাঁধাইয়ের গণ্ডগোল, বললেন লালমোহনবাবু! প্রথম ত্ৰিশ পাতার পর কয়েকটা পাতা পরস্পরের সঙ্গে সেঁটে আছে। এ বই না দেখে কিনলে তো পুরো টাকাটা ডেড লস মশাই। পণ্ডিচেরীর বাইন্ডার এ রকম কাঁচা কাজ করবে ভাবতে পারেন?
তা হলে সে দিন কী দিলেন লালশার্টের হাতে? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
জানেন কী দিলুম, ভাবতে পারেন? আমার নিজের বই মশাই, নিজের বই! বোম্বাইয়ের বোম্বেটে! পুলককে তো পাণ্ডুলিপির কপি পাঠিয়েছিলুম, তাই এবার ভাবলুম এক কপি ছাপা বই দেব-উইথ মই ব্রেসিংস অ্যান্ড মাই অটোগ্রাফ। আরও তিন কপি রয়েছে এখনও আমার ব্যাগে, প্রত্যেকটি ব্রাউন কাগজে মোড়া; আমার ভক্ত তো সারা ইন্ডিয়াতে ছড়িয়ে রয়েছে—তাই ভাবলুম, বম্বে যাচ্ছি, যদি এক-আধজনের সঙ্গে আলাপ-টালাপ হয়ে যায়, তাই সঙ্গে এনেছিলুম, আর তারই একটা কপি-হেঃ হেঃ হেঃ হাঃ!
এত হালকা লালমোহনবাবুকে অনেক দিন দেখিনি।
বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে ফেলুদা বলল, কিন্তু সান্যাল যে টেলিফোনে হুমকি দিল, সেটা কী ব্যাপার? এর সঙ্গে লাইফ ডিভাইন খাপ খাচ্ছে কি?
লালমোহনবাবু এতেও দমলেন না।
কে বলল সানাল? টেলিফোনে অত গলা চেনা যায় নাকি? কোনও উটকে বদমাশ রসিকতা করছে। হয়তো; বোম্বাইতে যদি তীরন্দাজ ছবি হিট হতে পারে তো সবই হতে পারে।
আর গাড়িতে গুলবাহার সেন্ট?
ওটা ওই ড্রাইভারই মাখে। কী রকম টেরির বাহার দেখেছেন? শৌখিন লোক। ধরা পড়ে অপ্রস্তুত হয়ে স্বীকার করলে না।
তা হলে আর কী, নিশ্চিন্তে ঘুমোন গিয়ে।
সে আর বলতে। মাথাটা ধরেছিল বলে ব্যাগটা খুলেছিলুম কোডোপাইরিনের জন্য, আর তাতেই এই হাই-ভোলটেজ আবিষ্কার। যাক, রহস্য যখন মিটেই গেল, তখন আপনিও বরং একটু আধ্যাত্মিক বিষয় অধ্যয়নে মনোনিবেশ করুন। বইটা রেখে গেলুম! গুড নাইট।
লালমোহনবাবু চলে গেলেন, আর আমিও আবার নিজের জায়গায় এসে শুলাম।
যে লোক আরবিন্দের বইয়ের বদলে জটায়ুর বই পেল, তার মনের অবস্থা কী হবে ফেলুদা।
খেপচুরিয়াস, বালিশে মাথা দিয়ে বলল ফেলুদা। মাথার পিছনের বাতিটা ও জ্বলিয়েই রাখল। দেখে হাসি পেল, ফেলুদা তার সবুজ নোটবই সরিয়ে রেখে অরবিন্দের লাইফ ডিভাইনের পাতা ওলটাল।
আমার বিশ্বাস ঠিক ওই সময়টাতেই আমার চোখ ঘুমে বন্ধ হল।