পুলকবাবু আর সংলাপ-লেখক ত্ৰিভুবন গুপ্ত
দুটো নাগাদ পুলকবাবু আর সংলাপ-লেখক ত্ৰিভুবন গুপ্তের সঙ্গে আমরা ওয়ারলির কপার চিমনি রেস্ট্যোর্যান্টে লাঞ্চ খেতে ঢুকলাম। দেখে মনে হয়। তিলধরার জায়গা নেই, কিন্তু পুলকবাবু আমাদের জন্য একটা টেবিল আগে থেকেই রিজার্ভ করে রেখেছেন।
লালমোহনবাবু বললেন, আমাদের ছবির নামটা কী হচ্ছে ভাই পুলক?
নামের কথাটা অবিশ্যি আমারও অনেকবার মনে হয়েছে, কিন্তু জিজ্ঞেস করার সুযোগটা আসেনি। বোম্বাইয়ের বোম্বেটে নাম যে থাকবে না সেটা আমিও আন্দাজ করেছিলাম।
আর বলবেন না লালুদা, বললেন পুলকবাবু; নাম নিয়ে কি কম হুজ্জত গেছে? যা ভাবি, তাই দেখি হয় হয়ে গেছে, না হয়। অন্য কোনও পার্টি রেজিস্ট্রি করে বসে আছে। গুপ্তেজিকে জিজ্ঞেস করুন না, কত বিনিদ্র রজনী গেছে। ওঁর নাম ভেবে বার করতে? শেষটায় এই তিনদিন আগে-যা হয়। আর কী-হাই-ভোল্টেজ স্পার্ক।
হাই-ভোল্টেজ স্পার্ক? ছবির নাম হাই-ভোল্টেজ স্পার্ক? লো-ভোল্টেজ গলার স্বরে জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।
পুলকবাবু হা-হা করে হেসে চারিদিকের টেবিলের লোকদের মাথা আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, মাথা খারাপ লালুদা? ও নামে ছবি চলে? আমি ইনস্পিরেশনের কথা বলছি। জেট বাহাদুর।
অ্যাঁ?
জেট বাহাদুর। রাস্তায় হার্ডিং পড়ে যাবে আপনারা থাকতে থাকতেই। ভেবে দেখুন–আপনার গল্পের এর চেয়ে ভাল নাম আর খুঁজে পাবেন না। অ্যাকশন, স্পিড, থ্রিল-জেট কথাটার মধ্যে আপনি সব পাবেন। প্লাস বাহাদুর। নাম আর কাস্টিং-এর জোরেই আল সার্কিটস সোল্ড।
লালমোহনবাবুর হাসির ভোল্টেজটা যেন বাড়তে গিয়ে কমে গেল। বোধহয় ভাবছেন-শুধুই নাম আর কাস্টিং? গল্পের কি তা হলে কোনও দামই নেই?
আমার কোনও ছবি আপনার দেখেছেন, লালুদা? বললেন পুলকবাবু। তীরন্দাজটা হচ্ছে লোটাসে। আজ ইভনিং শো-এ দেখে আসুন। আমি ম্যানেজারকে বলে দেব-তিনখানা সার্কলের টিকিট রেখে দেবে। ভাল ছবি-জুবিলি করেছিল।
আমরা পুলকবাবুর কোনও ছবি দেখিনি। লালমোহনবাবুর স্বাভাবিক কারণেই কৌতুহল ছিল, তাই যাব বলেই বলে দিলাম। বম্বেতে চেনাশোনা না থাকলে সন্ধে কাটানো ভারী মুশকিল। গাড়িটা আমাদের কাছেই থাকবে-তাকে বললেই লোটাসে নিয়ে যাবে।
খাবার মাঝখানে রেস্টোর্যান্টের একজন লোক পুলকবাবুকে এসে কী যেন বলল। পুলকবাবুর যে এখানে যাতায়াত আছে, সেটা ঢোকার সময় ওয়েটারদের মুখে হাসি দেখেই বুঝেছি। হিট ডিরেক্টরের এ শহরে খুব খাতির।
পুলকবাবু কথাটা শুনেই লালমোহনবাবুর দিকে ফিরলেন।
আপনার টেলিফোন, লালুদা।
লালমোহনবাবু ভাগ্যিস পোলাওয়ের চামচটা মুখে পোরেননি, তা হলো নিঘাত বিষম খেতেন। এ অবস্থায় চমকানোটা কেবল খানিকটা পোলাও চামচ থেকে ছিটকে টেবিলের চাদরে পড়ার উপর দিয়ে গেল।
মিস্টার গোরে ডাকছেন, বললেন পুলকবাবু। হয়তো কিছু গুড নিউজ থাকতে পারে।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে টেলিফোন সেরে এসে লালমোহনবাবু আবার কাঁটাচামচ হাতে তুলে নিয়ে বললেন, চারটের সময় ভদ্রলোকের বাড়িতে যেতে বললেন। কিছু অর্থপ্ৰাপ্তি আছে বলে মনে হচ্ছে-হে হে।
তার মানে আজ বিকেলের মধ্যে লালমোহনবাবুর পকেটে দশ হাজার টাকা এসে যাবে। ফেলুদা বলল, এর পরের দিন লাঞ্চটা আপনার ঘাড়ে। আর কপার-স্টপার নয়, একেবারে গোলেণ্ডন চিমনি।
রুমালি রুটি, পোলাও, নাবিগিসি কোফুতা আর কুলপি খেয়ে যখন রেস্টোর্যান্ট থেকে বেরেলাম, তখন প্রায় পৌনে তিনটে। পুলকবাবু আর মিস্টার গুপ্তে স্টুডিয়ে চলে গেলেন। সংলাপ এখনও কিছু লিখতে বাকি আছে। প্রত্যেকটা সংলাপ, শানিয়ে লিখতে হয়। তো, তাই নাকি সময় লাগে, বললেন, পুলকবাবু; গুপ্তেজি চুরুটের ফাঁক দিয়ে একটু হাসলেন। ভদ্রলোক সংলাপ লিখলেও নিজে সংলাপ খুবই কম বলেন, সেটা লক্ষ করলাম।
আমরা পান কিনে গাড়িতে উঠলাম। শালিমার? ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল।
ফেলুদা বলল, বন্ধে এসে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া না দেখে যাওয়া যায় না। —চলিয়ে তাজমহল হোটেলক পাস।
বহুৎ আচ্ছা।
ড্রাইভার বুঝেছিল আমাদের কোনও কাজ নেই, কেবল শহর দেখার ইচ্ছে, তাই সে দিব্যি ঘুরিয়ে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস, ফ্লোরা ফাউনটেন, টেলিভিশন স্টেশন, প্রিন্স অফ ওয়েলস মিউজিয়াম ইত্যাদি দেখিয়ে সাড়ে তিনটে নাগাদ গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার সামনে পৌঁছল। আমরা গাড়ি থেকে মামলাম।
পিছনে আরব্য সাগর, তাতে গুনে দেখলা এগারোটা ছোট-বড় জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। এখানে রাস্তাটা পোল্লায় চওড়া। বাঁ দিকে গেটওয়ের দিকে মুখ করে ঘোড়ার পিঠে বসে আছেন। ছত্রপতি শিবাজী। ডান পাশে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবী-বিখ্যাত তাজমহল হোটেল, যার ভিতরটা একবার দেখে না যাওয়ার কোনও মানে হয় না, কারণ বাইরেটা দেখেই আমাদের চক্ষু চড়কগাছ।
ঠাণ্ডা লবিতে ঢুকে চোখ একেবারে টেরিয়ে গেল! এ কোন দেশে এলাম রে বাবা! এত রকম জাতের এত লোক একসঙ্গে কখনও দেখিনি। সাহেবদের চেয়েও দেখলাম আরবদের সংখ্যা বেশি। এটা কেন হল? ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করতে বলল, এবার বেরুটি যাওয়া নিষেধ বলে আরবরা সব বোম্বাই এসেছে ছুটি ভোগ করতে। পেট্রোলের দৌলতে এদের তো আর পয়সার অভাব নেই।
মিনিট পাঁচেক পায়চারি করে আমরা আবার গাড়িতে এসে উঠলাম। যখন শিবাজী কাসূলের লিফটের বেল টিপছি, তখন ঘড়িতে চারটে বেজে দু মিনিট।
টুয়েলফথ ফ্লোর বা তেরোতলায় পৌঁছে লিফট থেকে বেরিয়ে দেখি, তিন দিকে তিনটে দরজা। মাঝেরটার উপর লেখা জি গোরে। বেল টিপতে উদি-পরা বেয়ারা এসে দরজা খুলে দিল।
অন্দর আইয়ে।
বুঝলাম, গোরে সাহেব চাকরকে আগেই বলে রেখেছিলেন আমাদের কথা।
ভিতরে ঢুকে ভদ্রলোককে চোখে দেখার আগে তার গলা পেলাম—আসুন, আসুন!
এই বার দেখা গেল একটা সরু প্যাসেজের ভিতর দিয়ে তিনি হাসিমুখে এগিয়ে আসছেন। আমাদের দিকে।
হাউ ওয়জ দি লাঞ্চ?
ভেরি ভেরি গুড, বললেন জটায়ু।
ভদ্রলোকের বৈঠকখানা দেখে তাক লেগে গেল! আমাদের কলকাতার বাড়ির প্রায় পুরো একতলাটাই এই ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। পশ্চিম দিকটায় সারবাঁধা কাচের জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। ঘরের আসবাবপত্রের এক একটারই দাম হয়তো দু-তিন হাজার টাকা, তা ছাড়া মেঞ্চে-জোড়া কর্পেট, দেওয়ালে পেন্টিং, সিলিং-এ ঝাড়-লিষ্ঠান-এ সব তো আছেই। এক দিকে দেওয়ালজোড়া বুকশেলফে দামি দামি বইগুলো এত ঝকঝকে যে, দেখলে মনে হয় বুঝি এইমাত্র কেনা।
আমি আর ফেলুদা একটা পুরু গদিওয়ালা সোফাতে পাশাপাশি বসলাম, আর আমাদের ডান পাশে আর একটা গদিওয়ালা চেয়ারে বসলেন লালমোহনবাবু। বাসার সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিশাল কুকুর এসে ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাদের তিনজনের দিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। লালমোহনবাবু দেখলাম ফ্যাকাসে হয়ে গেছেন। ফেলুদা হাত বাড়িয়ে তুড়ি দিতে কুকুরটা ওর দিকে এগিয়ে এল। ও পরে বলেছিল যে, কুকুরটা জাতে হল গ্রেট ডেন।
ডিউক, ডিউক।
কুকুরটা এবার ফেলুদাকে ছেড়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মিঃ গোরে আমাদের বসিয়ে দিয়ে একটু ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন, এবার হাতে একটা খাম নিয়ে ঢুকে লালমোহনবাবুর অন্য পাশের চেয়ারে বসলেন।
আমি আপনার বেপারটা রেডি করে রাখব ভেবেছিলাম, বললেন মিঃ গোরে, কিন্তু তিনটা ট্রাঙ্ক কল এসে গেল।
ভদ্রলোক খামটা লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন। মনের জোরে হাত কাঁপা বন্ধ করে লালমোহনবাবু সেটা নিয়ে তার ভিতর থেকে টেনে বার করলেন একতাড়া একশো টাকার নোট।
গিনিতি করিয়ে লিন, বললেন মিঃ গোরে।
গিনব?
আবার ভাষার গণ্ডগোল।
গিনিবেন আলবৎ। দেয়ার শুড বি ওয়ান হান্ড্রেড নোটস দেয়ার।
যে সময়ে লালমোহনবাবু গোনা শেষ করলেন, তার মধ্যে রুপোর টি-সেটে আমাদের জন্য চা এসে গেছে। খেয়ে বুঝলাম একেবারে সেরা দাৰ্জিলিং টি।
আপনার পরিচয় আভি তক মিলল না, গোরে বললেন ফেলুদার দিকে চেয়ে।
নো স্যার, বললেন গোরে, দ্যাট ইজ নট এনাফ। ইউ আর নো অর্ডিনারি পারসন—আপনার চোখ, আপনার ভয়েস, আপনার হাইট, ওয়ক, বডি-নাথিং ইজ অর্ডিনারি। আপনি হামাকে যদি নাই বলবেন তো ঠিক আছে। লেকিন স্রিফ মিস্টার গাঙ্গুলীর দোস্ত যদি বলেন, উ তো হামি বিসোয়াস করব না।
ফেলুদা অল্প হেসে চায়ে চুমুক দিয়ে প্রসঙ্গটা চেঞ্জ করে ফেলল।
আপনার অনেক বই আছে দেখছি।
হাঁ—বাট আই ভেন্ট রিড দেম! উ সব কিতাব ওনলি ফর শো। তারাপোরওয়ালা দুকনে রেগুলার অডার—এনি গুড বুক দ্যাট কামস আউট—এক কপি হামাকে পাঠিয়ে দেয়।
একটা বাংলা বইও চলে এসেছে দেখছি।
চোখ বটে ফেলুদার! ওই সারি সারি বিলিতি বইয়ের মধ্যে পনেরো হাত দূর থেকে ধরে ফেলেছে যে, একটা বই বাংলা।
মিঃ গোরে হেসে উঠলেন। শুধু বাংলা কেন মিঃ মিটার, হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি, সব আছে। আমার এক আদমি আছে—বাংলা হিন্দি গুজরাটি তিন ভাষা জানে; ও-ই তিন ভাষায় নভেল পড়ে হামাকে সিনপসিস করে দেয়। মিঃ গাঙ্গুলীর কিতাব কে ভি আউটলাইন পঢ়িয়েছি আমি। ইউ সি, মিস্টার মিটার, ফিল্ম বানানেকে লিয়ে তো—
ঘরে টেলিফোন বেজে উঠেছে। মিঃ গারে উঠে গেলেন। দরজার পাশে একটা তেপায়া টেবিলে রাখা সাদা টেলিফোন।
হ্যালো…হাঁ.. হাল্ড অন। —আপনার টেলিফোন, মিস্টার গাঙ্গুলী।
লালমোহনবাবুকে বার বার এভাবে চমকাতে হচ্ছে—আশা করি তাতে ওঁর হার্ট-টার্টের কোনও ক্ষতি হচ্ছে না।
পুলকবাবু কি? টেলিফোনের দিকে যাবার পথে ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।
নো স্যার, বললেন মিঃ গোরে। আই ডোন্ট নো দিস পারসন।
হ্যালো।
ফেলুদা আড়চোখে দেখছে লালমোহনবাবুর দিকে।
হ্যালো…হ্যালো…
লালমোহনবাবু ভ্যাবাচ্যাক ভাব করে আমাদের দিকে চাইলেন।
কেউ বলছে না কিছু।
লাইন কাট গিয়া হোগা, বললেন মিস্টার গোরে।
লালমোহনবাবু মাথা নাড়লেন! অন্য সব শব্দ পাচ্ছি টেলিফোনে।
এবার ফেলুদা উঠে গিয়ে লালমোহনবাবুর হাত থেকে টেলিফোনটা নিয়ে নিল।
হ্যালো, হ্যালো…
ফেলুদা মাথা নেড়ে ফোন রেখে বলল, ছেড়ে দিয়েছে।
আশ্চর্য, বললেন লালমোহনবাবু, কে হতে পারে, বলুন তো?
ও নিয়ে চিন্তা করবেন না, মিস্টার গাঙ্গুলী, বললেন মিঃ গোরে। বাম্বাই শহরে এই রকম হামেশা হয়।
ফেলুদার দেখাদেখি আমরাও চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। লালমোহনবাবুর পকেটে এত টাকা বলেই বোধহয় রহস্যজনক ফোনের ব্যাপারটা ওঁকে ততটা ভাবাল না। বেশ নিশ্চিন্তভাবেই ভদ্রলোক পরের কথাটা বললেন মিঃ গোরেকে।
হাঁ, হাঁ যাবেন বইকী। ভেরি গুড ডিরেক্টর পুলকবাবু। জেট বাহাদুর ভি বকস অফিস হিট হোগা জরুর।
দরজার, মুখ পর্যন্ত এলেন মিঃ গোরে। ডোন্ট ফরগেট অ্যাবাউট লাঞ্চ টুমরো। ট্রানসপোর্ট আছে তো আপনাদের সঙ্গে?
আমরা আশ্বাস দিলাম যে, সকাল থেকে রাত অবধি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন পুলকবাবু।
বাইরে বেরিয়ে এসে লিফটের বোতাম টিপে ফেলুদা বলল, মানি কাকে বলে দেখলেন তো লালমোহনবাবু?
দেখলাম কি মশাই, তার খানিকটা তো আমার পকেটেই রয়েছে।
নস্যি, নাস্যি। লাখ টাকাও এদের কাছে নস্যি। টাকাটা দিয়ে রসিদ লিখিয়ে নিল না, সেটা দেখলেন তো? তার মানে আপনার পকেটটা কালো হয়ে গেছে। কিন্তু। অৰ্থাৎ এই আপনার অন্ধকারে পদার্পণ শুরু।
ঘড়াং শব্দে লিফটটা উপরের কোনও ফ্লোর থেকে নেমে এসে আমাদের সামনে থামল।
সে আপনি যাই বলুন ফেলুবাবু, পকেটে টাকা এলে তা সে কালোই হাক, আর—
ফেলুদা লিফটে ঢোকার জন্য দরজা খুলেছিল, আর তার ফলেই জটায়ুর কথা বন্ধ।
লিফটের ভিতর থেকে এক ঝলক উগ্ৰ গন্ধ। গুলবাহার সেন্ট। এ গন্ধ আমরা তিনজনেই চিনি; বিশেষ করে লালমোহনবাবু।
টিপু টিপ বুকে ফেলুদার পিছন পিছন লিফটে ঢুকে গেলাম।
আমি একটা কথা না বলে পারলাম না।
গুলবাহার সেন্ট মিঃ সান্যাল ছাড়াও ভারতবর্ষের অনেকেই নিশ্চয়ই ব্যবহার করে।
ফেলুদা কথাটার জবাবের বদলে গভীরভাবে সতেরো নম্বর বাতাম টিপল। আমরা আরও পাঁচতলা ওপরে উঠে গেলাম।
অন্যান্য তলার মতোই সতেরো নম্বরেও তিনখানা ঘর। বাঁ দিকের দরজায় লেখা এইচ হেক্রথা। ফেলুদা বলল, জামান নাম। ডান দিকের দরজায় লেখা এন সি মানসুখানি। নিঘাত সিন্ধি নাম। মাঝখানের দরজায় কোনও নাম নেই।
ফ্ল্যাট খালি, বললেন লালমোহনবাবু।
নাও হতে পারে, বলল ফেলুদা।সবাই দরজায় নাম লাগায় না। ইন ফ্যাক্ট, আমার বিশ্বাস এ ফ্ল্যাটে লোক রয়েছে।
আমরা দুজনেই ফেলুদার দিকে চাইলাম।
যে কলিং বেলের বোতাম ব্যবহার হয় না, তাতে ধুলো জমে থাকা উচিত। অথচ এটা ভাল করে কাছ থেকে দেখুন, আর অন্য দুটোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন।
কাছে গিয়ে দেখেই বুঝলাম, ফেলুদা ঠিক বলেছে। দিব্যি চকচক করছে বোতাম, ধুলোর লেশমাত্র নেই।
টিপবেন নাকি? কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু।
ফেলুদা অবিশ্যি বোতাম টিপল না। তার বদলে যেটা করল, সেটা আরও অনেক বেশি তাজ্জব ব্যাপার। —মাটিতে উপুড় হয়ে সটান শুয়ে নাকটা লাগিয়ে দিল দরজার নীচে আধ ইঞ্চি ফাঁকাটাতে। তারপর বার দুয়েক জোরে নিশ্বাস টেনে উঠে পড়ে বলল, কড়া কফির গন্ধ।
তারপর যেটা করল, সেটাও অদ্ভুত। লিফট ব্যবহার না করে আঠারো তলা থেকে সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করল। প্রত্যেক তলাতেই থেমে প্রায় আধ মিনিট ধরে ঘুরে ঘুরে কী যে দেখল, তা ওই জানে।
সব সেরে নীচে যখন নামলাম, তখন ঘড়িতে পাঁচটা বেজে দশ।
বেশ বুঝতে পারছি যে, বম্বে এসে আমরা একটা প্যাঁচালো রহস্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি।