উনি অন্য ধাতুর
বরুণ আন্দাজে বলেছিল, উনি অন্য ধাতুর। কথাটা ঠিক। অন্য ধাতুরই। নইলে যে লোকটা ওকে অত যাচ্ছেতাই করে গেল, তার জন্যেই ওর মন পোড়ে?
লোকটা যে রাগের চোটে ছাতা মাথায় দিতে ভুলে গেছে, আর ঝিরিঝরি বৃষ্টিটা যেন জোর জোর হয়ে আসছে, এই ভেবেই মন পোড়েনি। উমাশশীর। নিজেও যে ভিজছে, সে কথা মনে থাকে না, ভাঙাবাড়ির ওপারটা পর্যন্ত দেখতে থাকে।
আজ এখনও বেলা আছে, আজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অন্য দিন তো অনুমানে দেখা। লোকটা যে টার্চ ধরে ধরে যায়, প্রকৃতপক্ষে সেই আলোটাই দেখা। তবু কোনো কোনো দিন, যেদিন জোৎস্নায় ভরা রাত থাকে, সেদিন উমাশশীর স্মরণীয় দিন।
অথচ ওই লোকটাকেই একদিন পুরনো কাপড়ের মতো পরিত্যাগ করে চলে এসেছিল উমাশশী। উমাশশীকে একদিকে টেনেছিল দুরন্ত প্রলোভন, আর একদিকে ঠেলে দিয়েছিল দুরন্ত অভিমান। এই দুই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে উমাশশীর জীবনের বুনুনিটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে জট পাকিয়ে গিয়েছিল।
বৃষ্টিটা জোর হতেই উমাশশীকে ফিরে আসতে হল। এসে দাওয়ায় বসে সেই মেডেলগুলো হাতে তুলে নিল উমাশশী। আর অতখানি অপমানেও যা হয়নি, তাই হল হঠাৎ ৷ হঠাৎ প্রবল বর্ষণে ভেসে গেল তার চোখ গাল বুকের কাপড়।
উমাশশীর বিধাতা উমাশশীকে এত নিষ্ঠুর করে কেন গড়েছিল? কী হত, যদি উমাশশী ওই মেডেলের খবরে আহ্বাদ প্রকাশ করত! উমাশশীর কোন মুখটা আছে যে সেই তিন বছরের মেয়েটার দাবি তুলে, তার যাত্রার আসরে নাচায় ব্যঙ্গোক্তি করল?
উমাশশীর কি সত্যি মেয়ে বলে টান আছে তার ওপর? উমাশশী কি তাকে দেখলে চিনতে পারবে?
বহুবার তো বলেছিল ওই মহৎ মানুষটা, নিয়ে এসে দেখাই, নিয়ে এসে দেখাই। উমাশশীই তো নিষেধ করেছে। নিষেধ করেছে উমাশশী। পাষাণের মতো নিষ্ঠুর বলে। দেখলে নতুন করে মায়ায় জড়াব এটা যে সে ভেবেছিল মনে মনে, ওটা বাজে কথা। পাপের ফল বলে বিতেষ্টা, এটাও বাজে কথা। মনকে চোখ ঠারা! আসলে ভয় ছিল পাছে আবার মেয়েটার দায়িত্ব ঘাড়ে পড়ে। পাছে ও বলে বসে, মেয়ে তো বড়ো হচ্ছে, এবার মায়ের কাছে থাকাই ভালো।
এই, এই ভয়েই উমাশশী লিলি নামের সেই তিন বছরের মেয়েটাকে মা থাকতেও মা নাম ভুলিয়ে রেখেছে!
অবৈধ বলে মমতা নেই, এটা কি সত্যি? নিঃসন্তান নারীচিত্ত, প্রথম যে সন্তানকে কোলে পেল, তার উপর থেকে কি মান সরিয়ে নিতে পারে? তাছাড়া—তখন তো উমাশশী অমল মুখুজ্যের আদরে সমাদরে ভাসছে। কুঞ্জ নামের একটা বুনো-মানুষের জন্যে দুদণ্ড মন খারাপ করে বসে থাকবারও সময় নেই তার। তখন তাই সন্তানে ও ডগমগ।
অথচ সেই সন্তানকে সে দায়িত্ব নেবার ভয়ে বিলিয়ে দিয়ে রেখেছে। বিলিয়ে দিয়েছে না হয়। একটা মহান লোকের হাতে, কিন্তু তার পরিবেশটিা যে মহান নয়, তাতো উমাশশীর অজানা ছিল
যাত্রার দলে আছে মেয়ে, ছেলে সেজে পার্ট করছে। দরকার হলে সখী সাজিছে, এসব তো জানতই উমা। যাত্রার অধিকারী নিঃস্বাৰ্থ, তাই কোনোদিন বলেনি, দিন গুণছি কবে ওটা বড়ো হবে।
বললেই বলতে পারত। উমাশশীর কিছু বলবার ছিল না। যাত্রার দলে মানুষ হওয়া মেয়ে লায়েক হয়ে উঠে আসরে নাচবে, এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ এই স্বাভাবিক নিয়মটার বিরুদ্ধেই উমা এমন একখানা প্ৰতিবাদের আস্পর্ধা দেখাল, যা এখন ভেবে মরমে মরে যাচ্ছে সে।
এ আস্পর্ধার কারণ কি? না ভালো লোকটা উদার লোকটা একদা ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, ওকে আমি বিয়ে দিয়ে ঘর-সংসারী করে দেব।
ঘর-সংসার জিনিসটার ওপর কি তবে এত মোহ উমাশশীর যে, সেই আসা ভয়েস্ক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল? এটা তুলসী মন্দিরের মতো পবিত্র ঘর-সংসার পায়ে ঠেলে দিয়ে চলে এসে কি ঘরসংসারের মূল্য টের পেয়েছে উমাশশী?
দাওয়াতেও আর বসা চলল না। বৃষ্টি প্রবল হচ্ছে। উমাশশী ঘরে গিয়ে ততক্ষণে আছড়ে
ও যদি আর না আসে?—ও যদি সত্যিই মনিঅৰ্ডারে টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বসে থাকে?
হ্যাঁ, টাকা ও দেবেই তা জানে উমাশশী। উমাশশী কষ্টে পড়তে পারে, এমন কাজ ও করবে: না। কষ্ট দেওয়া কাজটা উমাশশীরই একচেটে।
উমাশশীর আর একটা ভয়ানক বর্ষার রাতের কথা মনে পড়ে আজ।…মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল, বাজ চমকাচ্ছিল।…অধিকারী কুঞ্জ দাস খাওয়া-দাওয়ার পর বলেছিল, যা দেখছি আজ তো আর যাওয়া হল না।
বলে দাওয়ার ভিতরের জলচৌকিটার উপর উঠে বসেছিল। তারপর নিজ মনে বাতাসকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছিল, দাওয়ায় একখানা তক্তপোষ-টক্তপোষ পাতিয়ে রাখতে হবে। এ রকম বেঘোরে পড়ে গেলে বসে রাত কাটাতে হবে না।
উমাশশী তখন কোনো কথা বলেনি। তারপর রাত বোধকরি বারোটা, বৃষ্টি একটু ধরেছিল। তখন উমাশশী ঘর থেকে বলে উঠেছিল, এখন তো বিষ্টি কমেছে, এইবেলা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলে হয়।
লোকটা অবাক হয়ে গিয়েছিল তাতে আর সন্দেহ কি? বোধহয় আশা করেনি এমন কথা শুনতে হবে। তাই বিস্ময়ের গলায় বলে উঠেছিল, এখন রওনা দেব?
তাতে কি? উমাশশী অভয় দিয়েছিল, শুধু এই হাঁটাটুকু! রাতভোর তো ইস্টিশনেই পড়ে থাকা হয়।
ঘরের ভিতরকার অভয়বাণী বৃষ্টির ছাঁট খেয়ে বসে থাকা মানুষটার প্রাণে শীতল বারি নিক্ষেপ করেনি। সে বলেছিল, ওঃ। তা যাচ্ছি। তবে এমন রাতে লোকে বেড়ালটা কুকুরটাকেও দূর দূর করে তাড়ায় না। বলে উঠে পড়েছিল।
আশ্চর্য, উমাশশী এত নিষ্ঠুরতার শিক্ষণ কোথায় পেয়েছিল? তাই উমাশশী ছুটে এসে পথ আটকে বলেনি, আমার ঘাট হয়েছে, মাপ করো। উমাশশী সেই ঘর থেকেই বলেছিল, বেড়ালটা। কুকুরটা হলে তাড়ায় না, মানুষ বলেই উল্টো নিয়ম।
মানুষই। বাঘ ভালুক নয়। কামড়ে দেবে না।
উমাশশী তথাপি টলেনি। বরং হেসে উঠে বলেছিল, বিশ্বাস কি? তাছাড়া পাড়াপড়শি তো বাঘ ভালুকের কাছাকাছি। সকালবেলা ছাতা জুতো দেখলে—
কুঞ্জ নিজস্ব ভঙ্গিতে চড়ে উঠেছিল, কেন, এ কথা বলা যায় না দেশের লোক খোঁজ নিতে এসেছিল, বৃষ্টিতে আটকা পড়ে—
উমাশশী আরও হেসে উঠেছিল। হেসে হেসে বলেছিল, জিগ্যেস করলে বলা যায়। জিগ্যেস না করলে? গায়ে পড়ে বলা যায় না তো?
ঠিক আছে, যাচ্ছি। বলে চলে গিয়েছিল অধিকারী কুঞ্জ দাস। কিন্তু ঠিক আছে, যাচ্ছি ভিন্ন কবে আর আচ্ছা, চললাম— অথবা আচ্ছা, আসি বলে কুঞ্জ? কুঞ্জর বিদায় নেবার ভঙ্গিটাই তো রাগ-রাগি! বিদায় যে নিতে হচ্ছে, সেটাই রাগের।
কিন্তু উমাশশী কী করবে? উমাশশী তো নিজেই নিজের সুখের পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে।
উমাশশী নিজেই নিজের সুখের পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে। কিন্তু উমাশশীর মেয়ে? তা সে নাকি বুদ্ধিমান, অন্তত তার পালক পিতা তাই বলত, তা সে বুদ্ধিমান বলেই বোধকরি * সুখের পথ প্রশস্ত করে নিয়েছে।
একটা মাটিকোঠার হোটেলের দোতলার ঘরে লোহার চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে উমাশশীর মেয়ে বলে, পোপাইটারের জন্যে একটু মন কেমন করছে বটে, তিন তিনটে মানুষ কেটে পড়ায় অসুবিধেতে পড়বে ও। তবে খুব চালাকি হল একখানা!
নিমাই বলে, সনার যা পার্ট, ও তো রাস্তা থেকে লোক ধরে এনে আসরে ছেড়ে দিলেও হয়। আমারটা ব্রজরাজ দেবে অখন যা হোক করে চালিয়ে, আর তোর? সে বিষয়ে নিশ্চিন্দে থাকিস, তোকে আর আসরে যেতে হত না। চারুহাসিনীর জ্বর ছেড়েছে, ওর হকের ধন মদনমোহন—ও ছাড়াত ভেবেছিস?…জোর করে ছাড়ালে ও তোর গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নিত! তোর ভাগ্যে ওই একটি রজনীই।
উমাশশীর মেয়েকে শাড়ি পরে মোহিনী দেখায়। উমাশশীর মেয়ের এক মুখ পান খাওয়া পানের রসটা ঠোঁটের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে, আর সে অতীতের এক উমাশশীর মতো ঠোঁট উল্টে বলে, ইস, তাই বৈকি। দেখো সাহসরো রজুনী হবে! তুমি একবার খোলো দল।
ওইভাবে ঠোঁট উল্টে বলত উমাশশী, আমার কপালে অশেষ দুঃখু আছে? ইস! কেন? দেখো পরে। বলত বুড়ি পিসশাশুড়িকে। যে নাকি বৌয়ের বেচাল দেখে গাল-মন্দ করতে বসত।
উমাশশীর মেয়ে সেই ভঙ্গিতে বলে, ইস, তাই বৈকি। তুমি আগে দল খোলো।
জ্ঞানাবধি দল দেখে আসছে, আর সেই বিরাট দলবল আর তাদের সাজ-সরঞ্জাম, বাক্স বিছানা নিয়ে নিতান্ত অনায়াসে আনাগোনা করতে দেখেছে। দল গড়া যে চারটিখানি কথা নয়, নিমাইয়ের বাবারও যে সে সাধ্য নেই, সে জ্ঞান হয় না লিলির।
লিলি সাজানো আসরে নিজেকে কল্পনা করে, আর বলে, দলটা গড়ে ফেল, জোগাড় যন্তর করো। দেরি কিসের?
আর এ বলে, বিয়েটারই বা দেরি কিসের, নিজেরা নিজেরাই তো করে নিতে হবে। জগাদা বলেছিল। সব ব্যবস্থা করে দেবে। সে তো বেইমানী করল, এলই না। সনাদাটা। তবু মায়ায় পড়ে এসেছে, তা সে তো বোকার ধাড়ি। কার পিত্যেশ?
নিমাই বলে, হবে হবে! সুবিধে হোক—
লিলিবালা ঝঙ্কার দেয়, হবে হবে? আমি মলে? বিয়ে কোথায় তার ঠিক নেই স্বামীসন্ত্রী সেজে বসে আছি, আর যা খুশি করে চলেছ তুমি। এ-সব আমার ভালো লাগছে না।
কিন্তু ভালো কি নিমাইয়ের লাগছে? ওই খুশিটা ছাড়া? প্রোপ্রাইটারের বাক্স থেকে লিলি যে টাকাটা সরিয়ে এনেছিল, সে টাকা তো ফুরিয়ে এল। লিলির গায়ের গহনাগুলো তো গিলটিব, নিজের আঙুলে একটা আংটি পর্যন্ত নেই, উপায়টা কি?
লিলিকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল নেহাত লোভের বশে। তা ছাড়া অধিকারীকে জব্দ করবার মনোভাবও একটু ছিল। যা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে নিমাইকে!
সেদিন অমন খপ করে বলে বসল, দেখলি? দেখলি লিলির অ্যাক্টো? ওর পায়ের নখের যুগ্য ক্ষ্যামতাও নেই তোদের! অথচ এই সাত বছর ধরে ঘষটাচ্ছিস!
নাও দেখো, যার পায়ের নখের যুগ্যিও ক্ষ্যামতা নেই, তাকে পায়ে বেঁধে নিয়ে চলে আসবার ক্ষ্যামতা আছে কি না নিমাইয়ের।
এত তাড়াতাড়ি হয়তো চলে আসত না নিমাই, সেদিনের অপমানটাও কাজ করেছে। তাছাড়া ভেবেছিল অজানা অচেনা জায়গা থেকে সরে পড়াই সুবিধে। কেউ বলে দেবে না, আরে তাদের তো দেখলাম পেয়ারাতলার বাসে উঠতে।..চলে এসেছে। খরচ চালাতে হাড়ে দুৰ্ব্বো গজাচ্ছে।
এদিকে সনাতন আর উচিত।মতো হোটেল খরচা পাচ্ছে না। অতএব সনাতন দুবেলা শাসাচ্ছে, চলে যাব। বলে দেব গিয়ে অধিকারীকে ৷
লিলিবালা বলে, বলে দিলে তো প্রেথম ফাঁসি তোমার! তুমিও সমান পাপে পাপী। জেরার সময় আমি বলব, তুমিই আমায় ফুসলে এনেছ, নিমাইদা তোমার সঙ্গী মাত্তর। মায়ার প্রাণ তাই এসেছে।
বলবি একথা? সনাতন বলে, মুখে বাধবে না?
বাধবে কেন? তুমি কি কম শয়তান? সেদিন ঝগড়ার মুখে বলনি ওকে, লিলির দায় আমি পোহাতে যাব কেন? তুই কি আমায় ওর ভাগ দিবি? তবে? শয়তান আবার কাকে বলে?…
খাটো স্কার্ট আর আঁটো জ্যাকেটের মধ্যে বন্দী থেকেও লিলি জগৎ-সংসারের কোনো কথা শিখতে বাকি রাখেনি, তাই নববালা বাসমতীদের ভাষার সঙ্গে লিলির ভাষার বিশেষ কোনো তারতম্য নেই।
তবে লিলি জানে নিমাই তার বিয়ে করা স্বামী, শুধু অনুষ্ঠানটা বাকি।-বাকিটা কেবলমাত্র নিমাইয়ের আলস্যের জন্যে হচ্ছে না।
কিন্তু নিমাই? সেও কি তাই জানে?
আহা, কুঞ্জ অধিকারীর কি হল? ভবানী অপেরার প্রোপ্রাইটার মিস্টার দাসের? সে কি আজও পাথর হয়ে বসে আছে? নাঃ, তা বসে থাকলে কি চলে? পৃথিবী বড়ো কঠিন জায়গা। বাস্তব বড়ো নির্মম!
যারা বায়নার টাকা দিয়েছে, দশদিন ধরে এককৗড়ি লোক পুষছে, তারা ছেড়ে কথা কইবে? পালা নামাতেই হয়েছে কুঞ্জকে। চারুহাসিনীকে দিয়েই চালাতে হয়েছে। রব তুলতে হয়েছে লিলিবালার দিদিমার হঠাৎ মরমর অসুখ, তাই চলে যেতে হয়েছে তাকে।।
তা যাক, সারা পালটা এমনিতেই জমজমাট! বিরুণের কলমের গুণেই মুহুর্মুহু হাততালি, আর চারুহাসিনীও একেবারে ফেলনা নয়। চালাচ্ছিল তো এতদিন।
পালা শেষে জাল গুটিয়ে চলেও আসতে হয়েছে বৈকি কুঞ্জকে কোমর তুলে।, বোলার দিদিমার মরণে লিলিবালা সেখানে আটকে পড়েছে বলে কি অধিকারী কুঞ্জ দাস ভেঙে পড়ে মাটিতে পড়ে থাকবে?
তবে হ্যাঁ, দুদুটো ছেলেকে লিলির সঙ্গী হিসেবে পাঠিয়ে অসুবিধে একটু হয়েছে, তারাও তো আটকে পড়েছে। তা কি আর করা যাবে? তেমনি, যে মানুষ পালা লেখা ছাড়া আর কখনও কিছু করে না, সেই মানুষই বুক দিয়ে করল!
ছড়ানো জাল গুটিয়ে আবার কাটোয়ায় এনে ফেলে সবে স্থির হয়ে আমতা লাইনের সেই গ্রামের পথটায় পাড়ি দেবে, হঠাৎ বাঁকুড়া থেকে এক তলব এসে হাজির।
নতুন কি এক পালা করেছেন না কি চোরাকারবারিদের ঠুকে, মেদনীপুরে জয়জয়কার করে। এসেছেন, বায়না করতে এসেছি তার।
কুঞ্জ গভীরভাবে বলে, ওইটি আজ্ঞে করবেন না বাবুমশায়, আর যেটা বলেন রাজী!
হ্যাঁ, বাইরের লোকের সঙ্গে কথা কইতে কুঞ্জ বাবুৰ্মশায় টশায় বলে।
এসেছেন বাঁকুড়ার নামকরা এক ডাক্তার বাড়ি থেকে, ডাক্তারের শালা জন্মাষ্টমী উৎসবে যাত্রাগান দেবেন। লোকটা একটু স্বদেশী স্বদেশী। ছেলেমেয়েরা নাকি চেয়েছিল জলসা হোক, তিনি বলেছেন না, দেশের পুরনো জিনিস হোক।
কথাটা ভালো লাগে কুঞ্জর। কিন্তু ওই পালটা? যেটার সঙ্গে কুঞ্জর জীবনের সব সর্বনাশ জড়িত। ওটা হবে না বাবুমশায়, আর যা বলেন।
বাবুমশায় সন্দেহের গলায় বলেন কেন ওটাতে পুলিশের কোপে-টোপে পড়েছিলেন নাকি?
না না! সে সব ভয় কুঞ্জ অধিকারী করে না। ওটার মানে, অ্যাকটার অ্যাকট্রেস নেই এখন।
নেই কি মশাই? এই কদিন আগেই তো মেদিনীপুরে কাটিয়ে এলেন।
দুতিনজন পালা সেরে দিয়েই দেশে গেছে।
আহা, এখনও তো দুচারদিন রয়েছে। দেশ থেকে আনান।
কুঞ্জ তবু ঘাড় নাড়ে, আসবে না, দেশে অসুখ।
বাবুমশাই কিন্তু নাছোড়বান্দা। এটা তিনি করিয়ে তবে যাবেন। টাকা নিয়ে এসেছেন বায়নার।
কুঞ্জ হতাশ গলায় বলে, আমার অসুবিধেটা বুঝছেন না বাবু, ওটা ছাড়া অন্য কিছু বলুন।
তা হয় না। ওটাই চাই। আপত্তির কোনো অর্থ নেই। দুটো মাত্র কারণ থাকতে পারে আপত্তির, এক আইনের দায়, দুই কম্পিটিশনে নামবার জন্যে নতুন নাটক তুলে রাখছে।
প্রথমটা যখন নয়, তখন দ্বিতীয়টা। কিন্তু ওটা অধিকারীর ভুল ধারণা। তাতে বরং নাম ছড়াবে। যুক্তির শরশয্যা।
হয়তো এই আপত্তিটাই বাবুমশাইকে এমন আগ্রহে উত্তেজিত করেছে। আপত্তি করেছে? নিশ্চয় তাহলে ভিতরে কোনো গৃঢ় কারণ আছে। তবে ওই আপত্তিটা ভাঙবার জন্যে গাইতি শাবল লাগাও।
অনেক কথা অন্তে নিরুপায়ে কুঞ্জ হতাশ গলায় বলে, আচ্ছা বাবু মশায়, আপনি একটা বেলা সময় দিন আমায়, চিন্তা করে বলব। বুঝতেই তো পাচ্ছেন, সাধ্যপক্ষে এত কথা কইতাম না। আমি।
বাবুমশাই বলেন, ঠিক আছে, এখানে আমার ভাইঝির বাড়ি, থাকব আজকের দিনটা। কোথাকার মানুষ কোথায় এসেছি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে, বিফল হয়ে ফিরে যাব? আপনার দলবলের আতিথ্যের কোনো ত্রুটি হবে না, দেখবেন।
বাবুমশাই চলে যাবার পর কুঞ্জ ভয়ানক একটা অস্থিরতা অনুভব করে। যা কাম্য, যা প্রাথিত, তাই এসে যাচ্ছে হাতের মুঠোয়, যথার্থ সম্মান। অথচ কুঞ্জ তা নিতে পারছে না। কেন? বাধাটা কোথায়? পালটা অপয়া? ওই মহাকালের খাতা থেকেই কুঞ্জর জীবনের হিসেবের খাতা এলোমেলো হয়ে গেল।
কিন্তু ওই কুসংস্কারটা যদি না মানা যায়? যদি কুঞ্জ ভাবে ওগুলো ঘটতই। সুখ-দুঃখ, বিপদসম্পদ সবই চন্দ্ৰ সূর্যের মতো অমোঘ নিয়মের অধীন, তারা যথাসময়ে আসবেই মানুষের জীবনে, যতটা আলোছায়া ফেলবার তা ফেলবেই। তা হলে? ঠিক তাই।
লিলি লক্ষ্মীছড়ির পালিয়ে যাওয়া কুঞ্জর কপালে ছিল। উমার সঙ্গে অকারণ বিচ্ছিন্নত কুঞ্জর কপালে ছিল। এসব অমোঘ অনিবার্য। কুঞ্জ সেই ব্যাপারটাকে কুসংস্কারে ফেলে অন্য চেহারা দিচ্ছে।
নাঃ, এসব দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া কিছু নয়। কুঞ্জ নেবে বায়না। লিলি মুছে যাচ্ছে চারুহাসিনী তো আছে। নিমাই চুলোয় যাক, বরুণকেই এবার আসরে নামিয়ে ছাড়বে কুঞ্জ।
হঠাৎ একটা নতুন উৎসাহে টগবগিয়ে ওঠে কুঞ্জ। আর সকালে যে সেই লোকটার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছে, তার জন্যে লজ্জাবোধ করে। ওকে না হয় বলে দেবে, মনস্থির করে ফেললাম বাবুমশায়! নিলাম বায়না।
বরুণ আপত্তি করবে? সে আপত্তি খণ্ডন করে ছাড়বে কুঞ্জ। বলবে নিজের ভাষা একবার নিজের মুখে বলে দেখেছ? দেখো হে কী উদ্দীপনা পাবে!
ভাবতে ভাবতে নিজেই উদ্দীপনা বোধ করে কুঞ্জ। নতুন শহরের নতুন আসর তার আলোকমালা নিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
কুঞ্জ সেখানে বুকভর্তি মেডেল নিয়ে দীপ্ত মহিমায় না।দীপাঠ করে…শুনুন বাবুসকলরা, এ এক ভেজালদার চোরাকারবারির কাহিনি। কিন্তু এ একের কাহিনি নয়। স* স্রের কাহিনি। মানুষ মারার কারবার খুলে বসেছেন। এরা!..কিন্তু বাবুমশায়, আজও চন্দ্ৰ সূৰ্য উঠছে। তাই এদের হিসেব লেখা হচ্ছে। লেখা হচ্ছে মহাকালের খাতায়। কুঞ্জর শিথিল মন খাড়া হয়ে ওঠে।
কুঞ্জ বরুণের কাছে আর্জি পেশ করতে যায়। ওই ভেজালদারের এক বন্ধু আছে, যে তার হিতৈষী যে সত্যব্রতী। তার মুখে অনেক উপদেশ বাণী আছে। সে পার্টটা নিমাই করে। নিমাইয়ের উচ্চারণ ভালো। গেলবারে ব্রজকে দিয়ে চালাতে হয়েছে। কিন্তু ব্ৰজর উচ্চারণ অস্পষ্ট। অমন চরিত্রটা, অমন ডায়লগ, ওই দোষে যেন ঝুলে পড়ল।—বরুণ যদি নিজে ওতে নামে, মারকাটারি হবে।
তা বরুণ বুঝি সত্যিই ওই মুখ কুঞ্জ দাসের কাছে সেই অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছে। যে বন্ধন স্বাধীন চিত্তের স্বাধীনতাটুকু হরণ করে নেয়। নইলে কুঞ্জর অনুরোধ রাখতে রাজী হয় বরুণ?
বলে, কিন্তু একদিনের জন্যে।
ঠিক আছে, তাই সই।
কুঞ্জ আবার নবীন বয়সের উদ্যম পায় যেন? কুঞ্জ চারুহাসিনীকে গিয়ে অবহিত করে। তারপ বাঁকুড়ার ডাক্তারবাবুর শালাকে জানায়, মনস্থির করেই ফেললাম। বাবু।
এই উত্তেজনার মাথায় পরদিনই বেরিয়ে পড়ল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। গিয়ে পড়ে বলতে তে৷ হবে, বড়োমুখ করে বলেছিলাম মেয়েকে দিয়ে যাব। মুখ থাকল না। মেয়ে সেই মুখে চুনকালি দিয়ে চলে গেছে!
দেওয়ালের ওপর থেকে নিশ্চয়ই ব্যঙ্গ হাসি উঠবে। মেয়ে আসরে নেচে মেডেল লোঠার খবর থেকেই যে এ খবরটাও পাওয়া গিয়েছিল, সেই উল্লেখ থাকবে সে হাসিতে। থাককু, তবু বলতে তো হবে। জানাতে তো হবে মুখে কুটো দিয়ে, তোমার গচ্ছিত ধন আমি রক্ষে করতে পারিনি!
কদিন ধরেই মনে মনে চালাচ্ছিল এ মহলা, কিন্তু ভয়ানক একটা ভয় যেন গ্ৰাস করে ফেলছিল। কুঞ্জকে। কুঞ্জ পেরে উঠছিল না।
নিজে পথ করে কাঠগড়ায় উঠতে কে যায়? নিজে দড়ি টেনে গলায় ফাঁসি কে লাগায়? কিন্তু আজি হঠাৎ উৎসাহের বেঁকে বল সংগ্রহ করে ফেলল। চলল মহলা করতে করতে। উমাকেও বলতে হবে, যা হবার তা হবেই। তাকে রোধ করা যায় না।
কিন্তু কুঞ্জর গ্ৰহ নক্ষত্র বোধহয় এখন প্রতিকুল, তাই কুঞ্জর আত মহলা বিফলে গেল। কুঞ্জ একটুর জন্যে ট্রেন ফেল করল। আজ আর সুবিধের ট্রেন নেই। অথচ আর সময়ও নেই। কাল বাদ পরশু বাঁকুড়ায় যাবার ব্যবস্থা।
এই দলবল, এই পাহাড় প্রমাণ সাজসরঞ্জাম! এসব গুছিয়ে নিয়ে যাওয়া সোজা নয়। ছেলে ছোকরাদের মধ্যে তো ছোট নেই। বিপিন থেকে শুরু করে সকলেই প্ৰায় বয়স্ক। তাদের আবার ধমক দেবার জো নেই। তোয়াজ করে করে নিয়ে যাওয়া। দুটো দিন হাতে রাখতেই হবে। ট্রেনের টাইম আছে, ট্রেনের ধকল আছে।
এ যাত্রায় আর হল না। ঘুরে এসে হবে। যাঁহা বাহান্ন তাহা পয়ষট্টি! ভাবছেই তো ঝগড়া করে চলে এসেছি, তাই যাচ্ছি না, আরও দুদিন ভাবুক!