সিধু জ্যাঠার সঙ্গে
সিধু জ্যাঠার সঙ্গে আসলে আমাদের কোনও আত্মীয়তা নেই। বাবা যখন দেশের বাড়িতে থাকতেন—আমার জন্মের আগে–তখন পাশের বাড়িতে এই সিধুজ্যাঠা থাকতেন। তাই উনি বাবার দাদা আর আমার জ্যাঠা ফেলুদা বলে, সিধুজ্যাঠার মতো এত বিষয়ে এত জ্ঞান, আর এমন আশ্চর্য স্মরণশক্তি, খুব কম লোকের থাকে।
ফেলুদা যে কেন এসেছে সিধুজ্যাঠার কাছে সেটা তার প্রশ্ন শুনে প্রথম জানতে পারলাম—
আচ্ছা, শম্ভুচরণ বোস বলে বছর ষাটেক আগের কোনও ভ্রমণ-কাহিনী লেখকের কথা আপনি জানেন? ইংরিজিতে লিখতেন। তিনি।
সিধু জ্যাঠা চোখ কপালে তুলে বললেন, বিলো কী হে ফেলু-তার লেখা তেরাইয়ের কাহিনী পড়নি?
ঠিক ঠিক, ফেলুদা বলল, এখন মনে পড়ছে। ভদ্রলোকের নামটা চেনাচেন লাগছিল। কিন্তু বইটা হাতে আসেনি কখনও।
Terrors of Terai ছিল বইয়ের নাম। ১৯১৫ সালে লন্ডনের কীগ্যান পল কোম্পানি সে বই ছেপে বার করেছিল। দুর্দান্ত শিকারি ও পর্যটক ছিলেন শম্ভুচরণ। তবে পেশা ছিল ডাক্তারি। কাঠমুণ্ডুতে প্র্যাকটিশ করত। ওখানে তখন রাজ-টাজা হয়নি। রাণারাই ছিল সর্বেসর্বা। রাণী ফ্যামিলির অনেকের কঠিন রোগ সরিয়ে দিয়েছিল শম্ভুচরণ। ওর বইয়ে এক রাণার কথা আছে। বিজয়েন্দ্র শমশের জঙ্গ বাহাদুর। শিকারের খুব শখ, অথচ ঘোর মদ্যপ। এক হাতে বন্দুক, আর এক হাতে মদের বোতল নিয়ে মাচায় বসত। অথচ জানোয়ার সামনে পড়লেই হাত স্টেডি হয়ে যেত। কিন্তু একবার হয়নি। গুলি বাঘের গায়ে লাগেনি। বাঘ লাফিয়ে পড়েছিল মাচার উপর। পাশের মাচায় ছিলেন শম্ভুচরণ। তারই বন্দুকের অব্যৰ্থ গুলি শেষটায় রাণাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। অবিশ্যি রাণীও তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল একটি মহামূল্য রত্ন উপহার দিয়ে। খ্রিলিং গল্প। ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে এনে পড়ে দেখো! বাজারে চট করে পাবে না।
আচ্ছ উনি কি তিব্বতও গিয়েছিলেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
গিয়েছিল বইকী। মারা যায় টোয়েন্টিওয়ানে। আমি তখন সবে বি-এ পরীক্ষা দিয়েছি। কাগজে একটা অবিচুয়ারি বেরিয়েছিল। তাতে লিখেছিল, শম্ভুচরণ রিটায়ার করবার পর তিব্বত যায়। তবে মারা যায় কাঠমুণ্ডুতে।
হুঁ… ফেলুদা কিছুক্ষণ চুপ। তারপর কথাগুলো খুব স্পষ্ট উচ্চারণ করে ধীরে ধীরে বলল, আচ্ছা! ধরুন, আজ যদি হঠাৎ জানা যায় যে, তিব্বত ভ্ৰমণ সম্পর্কে তার একটা অপ্রকাশিত বড় লেখা রয়েছে, ইংরিজিতে, তা হলে সেটা দামি জিনিস হবে না কি?
ওরেব্বাবা! সিধুজ্যাঠার চকচকে টাকা উত্তেজনায় নেচে উঠল। কী বলছ ফেলু–টেরাই পড়ে লন্ডন টাইমস কী উচ্ছাস করেছিল সে তো মনে আছে আমার! আর শুধু কাহিনী নয়, শদ্ভুচরণের ইংরেজি ছিল যেমন স্বচ্ছ, তেমনি রংদার। একেবারে স্ফটিকের মতো। ম্যানুস্ক্রিপ্ট আছে নকি?
হয়তো আছে।
যদি তোমার হাতে আসে, আমাকে একবারটি দেখিয়ো, আর যদি অকশনে বিক্রি-টিক্রি হচ্ছে বলে খবর পাও, তা হলেও জানিয়ো। আমি হাজার পাঁচেক পৰ্যন্ত বিড করতে রাজি আছি।…
সিধুজ্যাঠার বাড়িতে গরম কোকো খেয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে ফেলুদাকে বললাম, মিস্টার লাহিড়ীর বাক্সে যে একটা এত দামি জিনিস রয়েছে সেটা তো উনি জানেনই না। ওকে জানাবে না?
ফেলুদা বলল, অত তাড়া কীসের? আগে দেখি না কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। আর কাজের ভারটা তো আমি এমনিতেই নিয়েছি, কেবল উৎসাহটা একটু বেশি পাচ্ছি, এই যা৷
নরেশচন্দ্ৰ পাকড়াশীর বাড়িটা হল ল্যানসডাউন রোডে। দেখলেই বোঝা যায় অন্তত চল্লিশ বছরের পুরনো বাড়ি। ফেলুদা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে একটা বাড়ির কোন কোন জিনিস থেকে তার বয়সটা আন্দাজ করা যায়। যেমন, পঞ্চাশ বছর আগে একরকম জানালী ছিল যেটা চল্লিশ৷ বছর আগের বাড়িতে আর দেখা যায় না। তা ছাড়া বারান্দার রেলিং-এর প্যাটার্ন, ছাতের পাঁচিল, গেটের নকশা, গাড়িবারান্দার থাম—এই সব থেকেও বাড়ির বয়স আন্দাজ করা যায়। এ বাড়িটা নির্ঘাত উনিশশো কুড়ি থেকে ত্ৰিশের মধ্যে তৈরি।
ট্যাক্সি থেকে নেমে বাড়ির সামনে প্রথমেই চোখে পড়ল গেটের উপর লটকানো কাঠের ফলক, কুকুর হইতে সাবধান!” ফেলুদা বলল, কুকুরের মালিক হইতে সাবধান কথাটাও লেখা উচিত ছিল। গেট দিয়ে ঢুকে এগিয়ে গিয়ে গাড়িবারান্দার নীচে পৌঁছতেই দারোয়নের দেখা পেলাম, আর ফেলুদা তার হাতে দিয়ে দিল তার ভিজিটিং কার্ড, যাতে লেখা আছে Pradosh C. Mitter, Private investigator, মিনিট খানেকের মধ্যেই দারোয়ান ফিরে এসে श्व्लाळ, भक्लिक আমাদের ভিতরে ডাকছেন।
মার্বেল পাথরে বাঁধানে ল্যান্ডিং পেরিয়ে প্রায় দশ ফুট উঁচু দরজার পর্দ ফাঁক করে আমরা যে ঘরটায় ঢুকলাম সেটা বৈঠকখানা। প্রকাণ্ড ঘরের তিনদিকে উঁচু উঁচু বইয়ের আলমারিতে ঠাসা বই। এ ছাড়া ফার্নিচার, কাৰ্পেট, দেয়ালে ছবি, আর মাথার উপরে ঝাড় লণ্ঠন—এসবও আছে। কিন্তু তার সঙ্গে রয়েছে একটা অগোছালো অপরিষ্কার ভাব। এ বাড়িতে ঝাড়পোঁছ জিনিসটার যে বিশেষ বালাই নেই সেটা সহজেই বোঝা যায়।
মিস্টার পাকড়শীকে পেলাম বৈঠকখানার পিছন দিকের ঘরটায়। দেখে বুঝলাম এটা তাঁর আপিস—বা যাকে বলে স্টাডি। টাইপ করার শব্দ আগেই পেয়েছিলাম, ঢুকে দেখলাম ভদ্রলোক একটা সবুজ রেক্সিনে ঢাকা প্ৰকাণ্ড টেবিলের পিছনে একটা মান্ধাতার আমলের প্ৰকাণ্ড টাইপরাইটার সামনে নিয়ে বসে আছেন। টেবিলটা রয়েছে। ঘরের ডান দিকে। বাঁ দিকে রয়েছে একটা আলাদা বসবার জায়গা। তিনটে কোঁচ, আর তার সামনে একটা নিচু গোল টেবিল। এই টেবিলের উপর আবার রয়েছে ঘুটি সাজানো একটা দাবার বোর্ড, আর তার পাশেই একটা দাবার বই। সব শেষে যেটা চোখে পড়ল সেটা হল টেবিলের পিছন দিকে কার্পেটের উপর কুণ্ডলী পাকিয়ে শোয়া একটা জাঁদরেল কুকুর।
ভদ্রলোকের নিজের চেহারা দীননাথবাবুর বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, কেবল একটা নতুন জিনিস হচ্ছে তার মুখে বাঁকানো পাইপটা।
আমরা ঘরে ঢুকতে টাইপিং বন্ধ করে ভদ্রলোক আমাদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ফেলুদাকে উদ্দেশ করে বললেন, কোনটি মিস্টার মিত্তির, আপনি না ইনি?
প্রশ্নটা হয়তো মিস্টার পাকড়াশী ঠাট্টা করেই করেছিলেন, কিন্তু ফেলুদা হাসল না। সে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল, আজ্ঞে আমি। এটি আমার কাজিন।
পাকড়াশী বললেন, কী করে জানব? গানবাজনা অ্যাকটিং ছবি-আঁকা মায় গুরুগিরিতে পর্যন্ত যদি বালকদের এত ট্যালেন্ট থাকতে পারে, তা হলে গোয়েন্দাগিরিতেই বা থাকবে না কেন? যাকগে, এবারে বলুন—এই সাতে-নেই-পাঁচে-নেই মানুষটিকে এভাবে জ্বালাতে এলেন কেন।
ফেলুদা টেলিফোনে কথা বলে বলেছিল লোকটার মেজাজ রুক্ষ। আমার মনে হল, খিটখিটেমোর জন্য কম্পিটিশন থাকলে ইনি ওয়ার্লড চ্যাম্পিয়ন হতেন।
কে আপনাকে পাঠিয়েছে বললেন? মিস্টার পাকড়াশী প্রশ্ন করলেন।।
মিস্টার লাহিড়ীর কাছ থেকে আপনার নামটা জানি। দিল্লি থেকে আপনার সঙ্গে একই কম্পার্টমেন্টে কলকাতায় এসেছেন তিনদিন আগে।
অ। তারই বাক্স হারিয়েছে বলছে?
আরেকজনের সঙ্গে বদল হয়ে গেছে।
কেয়ারলেস ফুল। তা সেই বাক্স উদ্ধারের জন্য ডিটেকটিভ লাগাতে হল কেন? কী এমন ধনদৌলত ছিল তার মধ্যে শুনি?
বিশেষ কিছু না। একটা পুরনো ম্যানুস্ক্রিপ্ট ছিল। ভ্রমণ-কাহিনী। সেটার আর কপি নেই।
আসল কারণটা বললে পাকড়শী মশাই মোটেই ইমপ্রেসড হতেন না বলেই বাধহয় ফেলুদা লেখার কথাটা বলল!
ম্যানুস্ক্রিপ্ট? পাকড়াশীর যেন কথাটা বিশ্বাস হল না।
হ্যাঁ। শম্ভুচরণ বাসের লেখা একটা ভ্রমণকাহিনী। ট্রেনে উনি লেখাটা পড়ছিলেন। সেটা ওই বাক্সতেই ছিল।
শুধু ফুল নয়–হি সীমস টু বি এ লায়ার টু। খবরের কাগজ আর বাংলা মাসিক পত্রিকা ছাড়া আর কিসু্য পড়েনি লোকটা। আমার সিট যদিও ছিল ওর ওপরের ব্যাঙ্কে, দিনের বেলাটা আমি নীচেই বসেছিলাম, ওর সিটেরই একটা পাশে। উনি কী পড়ছিলেন না-পড়ছিলেন সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট খেয়াল আছে।
ফেলুদা চুপ। ভদ্রলোক একটু দম নিয়ে বললেন, আপনি গোয়েন্দা হয়ে কী বুঝছেন জানি না; আপনার মুখে সামান্য যা শুনলাম তাতে ব্যাপারটা বেশ সাসপিশাস্ বলে মনে হচ্ছে। এনিওয়ে আপনি বুনো হাঁস ধাওয়া করতে চান করুন, কিন্তু আমার কাছ থেকে কোনও হেলপ পাবেন না। আপনাকে তো টেলিফোনেই বললুম, ওরকম এয়ার ইন্ডিয়ার ব্যাগ আমার বাড়িতে গোটা তিনেক পড়ে আছে কিন্তু এবারে সঙ্গে সে ব্যাগ ছিল না–সো আই কান্ট হেলপ ইউ।
যাত্রী চারজনের মধ্যে একজনের সঙ্গে বোধহয় আপনার চেনা বেরিয়ে গোসল–তাই না?
কে–বৃজমোহন? হ্যাঁ। তেজারতির কারবার আছে। আমার সঙ্গে এক কালে কিছু ডিলিংস হয়েছে।
তেজারাতির কারবার মানে সুদে টাকা খাটানোর ব্যবসা, সেটা ফেলুদা আমাকে পরে বলে দিয়েছিল।
ফেলুদা বলল, এই বৃজমোহনের কাছে কি ওইরকম একটা ব্যাগ থেকে থাকতে পারে?
সেটা আমি কী করে জানব, হ্যাঁ?
এর পর থেকে ভদ্রলোক ফেলুদাকে আপনি বলা বন্ধ করে তুমিতে চলে গেলেন। ফেলুদা বলল, এই ভদ্রলোকের হদিসটা দিতে পারেন?
ডিরেক্টরি দেখে নিয়ো, মিস্টার পাকড়াশী বললেন, এস এম কেন্দিয়া এন্ড কোম্পানি। এস এম হল বৃজমোহনের বাবা। ধরমতলায়—থুড়ি, লেনিন সরণিতে আপিস। তবে তুমি যে বলছি একজনের সঙ্গে আলাপ ছিল, তা নয়; আসলে তিনজনের মধ্যে দুজনকে চিনতুম আমি।
ফেলুদা যেন একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করল, অন্যজনটি কে?
দীননাথ লাহিড়ী। এককালে রেসের মাঠে দেখতুম ওকে। আলাপ হয়েছিল একবার। আগে খুব লায়েক ছিল। ইদানীং নাকি সভ্যভব্য হয়েছে। দিল্লিতে নাকি এক গুরু বাগিয়েছে। সত্যি কি মিথ্যে জানি না।
আর অন্য যে যাত্রীটি ছিলেন?
বুঝতে পারলাম ফেলুদা যতদূর পারে ইনফরমেশন সংগ্রহ করে নিচ্ছে ভদ্রলোকের কাছে। এটা কি জেরা হচ্ছে? ভদ্রলোক পাইপ কামড়ানা অবস্থাতেই তাঁর বত্ৰিশ পাটি দাঁত খিঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন।
আজ্ঞে না, ফেলুদা বলল, আপনি বাড়িতে বসে এক এক দাবা খেলেন, আপনার মাথা পরিষ্কার, আপনার স্মরণশক্তি ভাল–এই সব ভেবেই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।
পাকড়াশী মশাই বোধহয় একটু নরম হলেন। গলাটা একবার খাকরে নিয়ে বললেন, চেস্টা আমার একটা অদম্য নেশা! খেলার যে সঙ্গীটি ছিলেন তিনি গত হয়েছেন, তাই এখন একই খেলি।
রোজ?
ডেইলি। তার আরেকটা কারণ আমার ইনসমনিয়া। রাত তিনটে পর্যন্ত চলবে এই খেলা।
ঘুমের বড়ি খান না?
খাই-তবে বিশেষ কাজ দেয় না। তাতে যে শরীর কিছু খারাপ হচ্ছে তা নয়। তিনটেয় ঘুমোই, আটটায় উঠি। এ বয়সে পাঁচ ঘণ্টা ইজ এনাফ!
টাইপিংটাও কি আপনার একটা নেশা? ফেলুদা তার এক-পেশে হাসি হেসে বলল।
না। ওটা মাঝে মাঝে করি। সেক্রেটারি রেখে দেখেছি-এক ধার থেকে সব ফাঁকিবাজ। যাই হাক-আপনি অন্য যাত্রীটির কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না?–শার্প চেহারা, মাথায় টাক, বাঙালি নয়, ইংরিজি উচ্চারণ ভাল, আমায় একটা আপেল অফার করেছিলেন, খাইনি। আর কিছু? আমার বয়স তিল্পান্ন, আমার কুকুরের বয়স সাড়ে তিন। ওটা জাতে বক্সার হাউন্ড। বাইরের, লোক আমার ঘরে এসে আধঘণ্টার বেশি থাকে সেটা ও পছন্দ করে না। কাজেই—
ইন্টারেস্টিং লোক, ফেলুদা মন্তব্য করল।
আমরা ল্যানসডাউন রোডে বেরিয়ে এসে দক্ষিণে না গিয়ে উত্তর দিকে কেন চলেছি, আর পাশ দিয়ে দুটো খালি ট্যাক্সি বেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ফেলুদা কেন সেগুলোকে ডাকল না, তা আমি জানি না। আমার একটা কথা মনে হচ্ছিল, সেটা ফেলুদাকে না বলে পারলাম না–
আচ্ছা, দীননাথবাবু যে বলেছিলেন পাকড়াশীর বয়স ষাটের উপর, অথচ পাকড়াশী নিজে বললেন তিপ্পিান্ন। আর ভদ্রলোককে দেখেও পঞ্চাশের খুব বেশি বলে মনে হয় না! এটা কীরকম হল?
ফেলুদা বলল, তাতে শুধু এইটেই প্রমাণ হয় যে, দীননাথবাবুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা খুব তীক্ষ্ণ নয়।
আরও মিনিট দুয়েক হাঁটতেই আমরা লোয়ার সারকুলার রোডে পড়লাম। ফেলুদা বা দিকে ঘুরল। আমি বললাম, সেই ডাকাতির ব্যাপারে তদন্ত করতে যাচ্ছ বুঝি? তিনদিন আগেই খবরের কাগজে বেরিয়েছে যে, লোয়ার সারকুলার রোডে হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল হাটেলের কাছেই একটা গয়নার দোকানে তিনজন মুখোশ-পরা রিভলভারধারী লোক ঢুকে বেশ কিছু দামি পাথরটাথর নিয়ে বেয়াড়াভাবে দুমদাম রিভলভার ছুঁড়তে ছুড়তে একটা কালো অ্যাম্বাসাড়ার করে পালিয়েছে। ফেলুদা খবরটা পড়ে বলেছিল, এই ধরনের একটা বেপরোয়া ক্রাইমের তদন্ত করতে পারলে মন্দ হত না। কিন্তু দুঃখের বিষয় কেসটা ফেলুদার কাছে আসেনি। তাই আমি ভাবলাম, ও হয়তো নিজেই একটু খোঁজখবর করতে যাচ্ছে।
ফেলুদা কিন্তু আমার প্রশ্নটায় কানই দিল না। ওর ভাব দেখে মনে হল, ও ফেন ওয়াকিং এক্সারসাইজ করতে বেরিয়েছে, তাই হাঁটা ছাড়া কোনওদিকে মন নেই। কিন্তু মিনিটখানেক হাঁটার পরে ও হঠাৎ রাস্তা থেকে বাঁয়ে ঘুরে সোজা গিয়ে ঢুকল হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল হাটেলের গেটের ভিতর, আর আমিও ঢুকলাম তার পেছন পেছন।
সটান রিসেপশন কাউন্টারে গিয়ে ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, আপনার এখানে ৬ই মার্চ সকালে সিমলা থেকে কোনও গেস্ট এসেছিলেন কি–যার নামের প্রথম অক্ষর G?
প্রশ্নটা শুনে আমার এই প্রথম খেয়াল হল যে বৃজমোহন বা নরেশ পাকড়াশী কারুরই নামের প্রথম অক্ষর G নয়। কাজেই এখন বাকি রয়েছেন শুধু আপেলওয়ালা।
রিসেপশনের লোক খাতা দেখে বলল, দুজন সাহেবের নাম পাচ্ছি G দিয়ে—জেরাল্ড প্রাট্লি এবং জি আর হোমস। দুজনেই ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসেছিলেন।
থ্যাঙ্ক ইউ, বলে ফেলুদা বিদায় নিল।
বাইরে বেরিয়ে এসে একটা ট্যাক্সি নেওয়া হল। পার্ক হোটেল চলিয়ে বলে ড্রাইভারকে একটা হুকুম দিয়ে একটা চারমিনার ধরিয়ে ফেলুদা বলল, ম্যাপের উপর লাল দাগগুলো ভাল করে লক্ষ করলে –দেখতিস যে সেগুলো সব একেকটা হোটেলের জায়গায় দেওয়া হয়েছে। সুতরাং কলকাতায় এসে ভদ্রলোকের হাটেলে ওঠাই স্বাভাবিক। ভাল হোটেল বলতে এখন গ্র্যান্ড, হিন্দুস্থান ইনটারন্যাশনাল, পার্ক, গ্রেট ইস্টার্ন আর রিটজ কানটিনেন্টাল। দাগও ছিল ঠিক এই পাঁচ জায়গায়। আমাদের রাস্তায় প্রথম পড়ছে পার্ক হাটেল, কাজেই সেটা হবে। আমাদের গন্তব্যস্থল।
পার্ক হোটেলে ছ তারিখে নামের প্রথম অক্ষর G দিয়ে কেউ আসেনি, কিন্তু গ্র্যান্ড হাটেলে গিয়ে ভাল খবর পাওয়া গেল। একজন বাঙালি রিসেপশনিস্টের সঙ্গে দেখলাম ফেলুদার চেনাও রয়েছে। এই ভদ্রলোক-নাম দাশগুপ্ত-খাতা খুলে দেখিয়ে দিলেন যে ৬ই মার্চ সকালে পাঁচজন এ হোটেলে এসে উঠেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজনই ভারতীয়, আর তিনি সিমলা থেকে এসেছিলেন, আর তাঁর নাম জি সি ধমীজা।
এখনও আছেন কি ভদ্রলোক? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
নো স্যার। গতকাল সকালে তিনি চেক-আউট করে গেছেন।
আমার মনে একটা আশার আলো জ্বলেছিল, সেটা আবার দপ করে নিভে গেল।
ফেলুদার ভুরু কুঁচকে গেছে। কিন্তু সে তবু প্রশ্ন করতে ছাড়ল না।
কত নম্বর ঘরে ছিলেন?
দুশো ষোলো।
সে ঘর কি এখন খালি?
অজ্ঞে হ্যাঁ। আজি সন্ধ্যায়। একজন গেস্ট আসছেন, তবে এখন খালি।
সেই ঘরের বেয়ারার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?
সার্টেনলি। আমি সঙ্গে লোক দিয়ে দিচ্ছি, ও-ই আপনাকে রুম-বিয়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে।
লিফট দিয়ে দোতলায় উঠে লম্বা বারান্দা দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে গিয়ে তারপর দুশো ষোলো নম্বর ঘর। রুম-বয়ের দেখা পেয়ে তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল ফেলুদা। তারপর এদিক ওদিক দু-একবার পায়চারি করে, প্রশ্ন করল–
গতকাল সকালে যে ভদ্রলোক চলে গেছেন তাকে মনে পড়ছে?
হাঁ সাহাব।
ভাল করে মনে করে দেখ তো।–তার সঙ্গে জিনিসপত্তর কী কী ছিল।
একঠো বড় সুটকেশ থা, কালা, আউর এক ছোটা ব্যাগ।
নীল রঙের ব্যাগ কি?
হাঁ সাহাব। হাম্ যব্ ফিলাস্কমে পানি লেকর্ কামরেমে আয়া, তব্ সাহাবকে দেখা উয়ো ছোট ব্যাগ খোলকর্ সব চিজ বাহার নিকালকে বিস্তারে-পর রাখখা। মেরা মালুম হুয়া সাহাব কুছ্ ঢুঁড় রাহা।
ভেরি গুড। বাবুর সঙ্গে আপেল ছিল কি না মনে আছে?
হাঁ বাবু! তিন আপিল থা; বাহার নিকালকে পিলেটিমে রাখখা।
এর পরে বাবুর চেহারা কীরকম ছিল জিজ্ঞেস করাতে বয় যা বলল, সেরকম চেহারার লোক কলকাতায় অন্তত লাখখানেক আছে।
যাই হাক-গ্র্যান্ড হাটেলে এসে মস্ত কাজ হয়েছে। দীননাথবাবুর বাক্স যার সঙ্গে বদল হয়েছে তার নাম ঠিকানা দুটোই পাওয়া গেছে। ঠিকানাটা মিস্টার দাশগুপ্ত একটা কাগজে লিখে রেখেছিলেন। যাবার সময় সেটা ফেলুদার হাতে দিয়ে দিলেন। ফেলুদার সঙ্গে সঙ্গে আমিও পড়ে দেখলাম তাতে লেখা রয়েছে–
G. C. Dhameeja,
‘The Nook,’
Wild Flower Halt,
Simla.