Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্বীকারোক্তি || Rashmita Das

স্বীকারোক্তি || Rashmita Das

দিনের আলো ফুটল।প্রাসাদতুল্য বাংলোবাড়ির অন্দরমহলের প্রতিটি কামরা বহুমূল্য আসবাব প্রাতঃকিরণের উষ্ণ আদর গায়ে মাখতে শুরু করল।ক্রমে অ্যাড্রিয়ান শোবার ঘরের গালিচাকে রাঙিয়ে, দুধসাদা মখমলে পরদার গায়ে মাখামাখি করে একটি নতুন দিনের উষ্ণ আমন্ত্রণে আধোঘুমে নিমজ্জিত অ্যাড্রিয়ানকে যেন হাতছানি দিয়ে বলতে থাকল…জাগো…
হঠাৎ তার ঘরের অ্যালার্ম ঘড়িটি সশব্দে ঢং ঢং করে তাকে জানান দিল,ভোর ছটা বেজে গেছে। এরপর আর বিছানা আঁকড়ে আহ্লাদী শিশুর মতো গড়াগড়ি খাওয়া চলে না…
অগত্যা…আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে পড়ল সে।হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল।মেরী এসে চা আর ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল।সে তাড়াহুড়ো করে সেটা শেষ করে স্নান সেরে নিল।তারপর ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল সর্বজন নন্দিত তৈলচিত্রটির সামনে।রংতুলির অপূর্ব ভাস্কর্যের লাবণ্য মেখে যে আবক্ষ নারীমূর্তিটি সহাস্যে রাজ করছে ক্যানভাস জুড়ে তার সামনাসামনি একবার দাঁড়াল অ্যাড্রিয়ান।বিশ্ববন্দিত চিত্রশিল্পী অ্যাড্রিয়ানের আজ বিশেষ দিন।দীর্ঘদিন পর আজ সে নিজের দেশের কোনো মানু‌ষের সামনাসামনি হতে যাচ্ছে এই ভাবনাটাই তাকে বিহ্বলিত করে তুলল।ক্যানভাস বন্দিনীর কাছে এই খুশির বহিঃপ্রকাশ করার সময় আলগোছে কিঞ্চিৎ জল ভিজিয়ে দিল অ্যাড্রিয়ানের চোখের কোল।মনে ভেসে উঠতে লাগল সূদুরে ফেলে আসা স্মৃতি…কথা…
হঠাৎ মোহভঙ্গ হল।মেরী এসে জানাল,অতিথি চলে এসেছে।তাকে বৈঠকখানায় বসানো হয়েছে। শুনে অ্যাড্রিয়ান মেরীকে অতিথির জন্য চা জলখাবার আনার নির্দেশ দিয়ে শশব্যস্ত হয়ে নীচে নেমে এল।আগত অতিথির সাথে করমর্দন ও সৌজন্য বিনিময় করে তাকে আসন গ্রহণ করতে বলল অ্যাড্রিয়ান।

—বাড়ি চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি তো?

—না না কোনো অসুবিধা হয়নি।আপনার মতো খ্যাতনামা মানুষের বাড়ি চিনে আসা টা এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়।

—এতদিন বাদে নিজের দেশের কোনো একজন মানুষকে সামনে থেকে দেখার আনন্দটাই আলাদা।বাই দ্য ওয়ে…আপনি বাঙালি তাই তো?

—হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন।আমি কলকাতার ছেলে। চাকুরীসূত্রে আমেরিকায় প্রবাসী।

—একজন প্রবাসী যখন আরেকজন প্রবাসীর সাথে বিদেশবিঁভুইতে একসাথে হয়,তখন আর আলাদা কোনো ইন্টারভিউএর দরকার হয় না।ভিতরের কথা আপনা থেকেই বেরিয়ে আসে।

—একদম খাঁটি কথা বলেছেন।আপনার মতো শিল্পী মানুষের সামনে দেখা পাওয়াটাই আসলে সৌভাগ্যের ব্যাপার।ইন্টারভিউটা তাহলে শুরু করা যাক…কি বলেন?

—হ্যাঁ একদম।ইন্টারভিউ শুরু করুন।

সাংবাদিক ছেলেটি ব্যাগ থেকে একটা রেকর্ডার বার করে সেটা অন করল।তারপর জিজ্ঞাসা করল,

—ছবি আঁকার প্রতি আপনার আগ্রহটা ছেলেবেলা থেকেই ছিল?

—একদমই না।বরং উল্টোটাই।ছেলেবেলায় আমি আঁকাটাকা একেবারেই পছন্দ করতাম না।গ্রামের ছেলেদের সাথে ডাংগুলি খেলা,মাছ ধরা এইসব নিয়ে থাকতাম।

—তাহলে আঁকার প্রতি আগ্রহ এল কিভাবে?

—ছবি আঁকার প্রতি আমার সেদিন কেন,আজও কোনো আগ্রহ নেই।

—পৃথিবীর সনামধন্য চিত্রশিল্পীর মুখে এমন কৌতুকের অর্থ জানতে পারি কি?

—কৌতুক নয়।এটাই বাস্তব।ছবি আঁকার প্রতি আমার যে কোনো কোনোরকম আগ্রহ নেই তাই শুধু নয়,আমি ছবি আঁকতে পারি না।

একটা অদ্ভুত কৌতুকমাখা রহস্যের জট ছাড়ানোর আকাঙ্ক্ষায় সাংবাদিক ছেলেটির দুচোখ তখন অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠেছে।

—আপনি যা বলতে চাইছেন একটু খুলে বললে ভালো হয়…

—তাহলে পুরো ব্যাপারটা একদম গোড়া থেকেই বলি।বিশ্বাস করা বা না করাটা সম্পূর্ণই আপনার হাতে।আমার জন্ম ভারতের বাংলায়।এক প্রত্যন্ত গ্রামে।এক হিন্দু বাঙালি চাষির পরিবারে। চিত্রশিল্পী হওয়ার আগে আমার নাম ছিল আদিত্য। আদিত্য ঘোষ। বাইশ বছর বয়সে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা নেওয়ার আদিত্য থেকে হই অ্যাড্রিয়ান।বাবা,মা আমার বছর পাঁচেকের বড় দিদি আর আমাকে নিয়ে সেই ছোট্ট সংসারটায় অভাব অনটন থাকলেও খুব হাসিখুশি ছিল।কিন্তু আমাকে নিয়ে…বিশেষত আমার ভবিষ্যত নিয়ে মা বাবা বেশ চিন্তায় ছিলেন।কারণ না ছিল আমার পড়াশোনায় কোনোরকম আগ্রহ,আর না ছিল চাষবাসের কাজে কোনো উৎসাহ। আমি পাড়ার বিচ্ছু ছেলেপিলেদের মধ্যমণি ছিলাম।দিনরাত ওদের সাথে টইটই করে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর কোনো কিছুইপছন্দ ছিল না আমার।এদিকে দিদি পড়াশুনায় ছিল তুখোড়।ওর পড়াশুনা,রান্নাবান্না,আঁকা,সেলাই এইসবে খুব উৎসাহ ছিল।সবার চোখের মণি ছিল ও।”খুব ভালো ঘরে বিয়ে হবে” এই বলে সবাই ওকে আশীর্বাদ করত।কারণ আমাদের গ্রামে পড়াশোনায় সেরার যদি কোনো মেয়ে হয় তাহলে তার প্রতি সকলের উচ্চাকাঙ্ক্ষার মাপকাঠি এমনটাই হয়ে থাকে।যাক গে…আসল কথায় আসি।দিদি আমাকে খুব ভালোবাসলেও ওকে নিয়ে সকলের এই মাতামাতি দেখে আমার ভীষণ রাগ হত।হিংসা হত খুব।আমি নানারকম ভাবে ফন্দিফিকির করে ওকে উত্যক্ত করতাম।কিন্তু প্রতিবারই ও আমাকে ক্ষমা করে বুকে টেনে নিত।সেদিন ঘরে লক্ষীপূজো ছিল।মায়ের কাছে রীতিমতো বায়না করে…কেঁদে আমি ঘরে আলপনা দেওয়ার দায়িত্বটা দিদির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পেরেছিলাম।কিন্তু সকাল থেকে ডাংগুলি খেলায় এমন মগ্ন ছিলাম,যে আলপনা দেওয়ার দায়িত্বের কথাটা বেমালুম ভুলে গেলাম।পূজোর ভোগ প্রসাদ কতদূর কি তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার জন্য দুপুর বারোটা নাগাদ ঘরে ফেরার কথা মনে হতেই সাথে সাথে নিজের ভুলের কথাটা মনে পড়ে গেল।নিজের মনে জিভ কেটে একছুটে বাড়ি পৌঁছোলাম।গিয়ে দেখি,আলপনা প্রায় শেষের মুখে।দরজার সামনেটায় বসে কাজটা একদম সম্পূর্ণ করছে দিদি।দেখে আামার মাথায় খুন চেপে গেল।সঙ্গে সঙ্গে পা দিয়ে ওর আলপনার খড়ি ধরা হাতিটিকে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে পিষে দিলাম।মুখে আমার ছুটতে থাকল অশ্রাব্য যত গালি আমি জানি…সব।যন্ত্রনাক্লিষ্ট কন্ঠে হাত ছাড়ানোর জন্য কাতর স্বরে দিদি চ্যাঁচাতে লাগল।মা ছুটে এলেন ঘটনাস্হলে।পুরো ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখে এবার মা পুরো অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন। সেদিন আমি মায়ের হাতে এমন মার খেলাম যে প্রতিশোধস্পৃহায় আমার দুইচোখ ধিকিধিকি জ্বলতে লাগল।দিদি বাধা দেওয়ার পরেও আমার মার খাওয়া কমেনি।ফলপ্রসূ আমার ঘাড়ের দুই জায়গায় কালশিটের দাগ পড়ে গেল।কিন্তু সে দাগ নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না।হিংসা আর প্রতিশোধের আগুনে আমার অন্তরাত্মা দগ্ধ হচ্ছিল।
সেদিন সন্ধ্যায় দিদি একটি ব্যথার মলম নিয়ে আমার আহত স্হানে মালিশ করে দেওয়ার জন্য যেই আমাকে স্পর্শ করল আমার মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল।আমি ওর গলা টিপে ধরে শ্বাসরোধ হয়ে ওর অন্তিম মুহুর্তের জন্য স্হিরদৃষ্টিতে অপেক্ষা করতে লাগলাম।নিঃশব্দ ঘরটিতে ঘড়ির কাঁটা যেন সশব্দে আমার বুকে হাতুড়ি পিটছিল।ওকে আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখলাম আমি।ওর দেহটা আমি শুইয়ে দিলাম ঘরের মেঝেতে।তারপর ঠান্ডা মাথায় একটু ভেবে নিয়ে একটা দড়ি যোগাড় করে খাটের ওপর মই রেখে তাতে ঠিকভাবে ব্যালেন্স করে উঠে সিলিং ফ্যানের সাথে এমনভাবে ওর দেহটা ঝুলিয়ে দিলাম যে এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়াটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা এমন কিছু কঠিন বলে মনে হল না।একটু রাত করে বাবা মা ফিরলেন মাসির বাড়ি থেকে। মেয়ের মৃতদেহ দেখে মা শোকে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশীদের মধ্যে নেমে আসে বিরাট শোকের ছায়া।ঘটনাটিকে আত্মহত্যা হিসেবে চালানোটা খুব কঠিন ছিল না কারণ পড়াশোনা বন্ধ করে এবার দিদির বিয়ে দেবার জন্য বাবা মা উঠে পড়ে লেগেছিলেন।ও আরও পড়াশোনা করতে চাইত।তাই এই নিয়ে প্রায়ই বাবা মা’র সাথে ওর অশান্তি হত।আগের দিন রাতেই শুতে যাবার আগে অশান্তি তুঙ্গে ওঠার সময়ে ও বলেছিল,ওকে যদি বিয়ে নিয়ে কেউ আর একটা কথাও বলে বা পড়াশোনা বন্ধ করে দেয় ও তাহলে আত্মহত্যা করবে।তাই ঘটনাটা যে আদতে একটা খুন,এটা কারোরই মাথায় আসল না।ব্যাস, “গুণবতী দিদির অপদার্থ ভাই”এই বদনাম প্রতিনিয়ত শোনার হাত থেকে আমি রেহাই পেয়ে গেলাম চিরতরে।দিন ভালোই কাটছিল।কিন্তু যত দিন যেতে লাগল আমায় নিয়ে বাবা মায়ের দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়তে শুরু করে দিল।আমার বইখাতার প্রতি চূড়ান্ত বিতৃষ্ণা,পরীক্ষার প্রতিটি বিষয়ে নম্বরের নীচে লাল কালির দাগ,দিনরাত পাড়ার বখাটে ছেলেছোকরাদের সাথে লাফিয়ে বেড়ানো এইসব দেখে ভাড়া করা একটি ঘর আগলে কোনোরকমে সংসার গোছানো বিষয়আশয় বিহীন বাপ মা দুশ্চিন্তায় দুচোখের পাতা এক করতে পারতেন না।চাষবাস তো দূর,কোনো কাজেই তাঁরা আমাকে ঢোকাতে পর্যন্ত পারতেন না।মদ খেয়ে,বিড়ি ফুঁকে স্ফূর্তি করে রাত করে ঘরে ঢোকাটা আমার রুটিন হয়ে দাঁড়াল।মা দিনরাত ঠাকুরকে ডাকতেন আমার যাতে সুবুদ্ধি হয়।তাঁর গুণী মেয়েকে তিনি নিলেন কিন্তু তাঁর কোলের ছেলেটাকে তিনি যেন একটু দেখেন…
সেই সময়কারই ঘটনা।একদিন আমি ঘরের দাওয়ায় বসে একমনে বিড়ি ফুঁকছিলাম।এমন সময় হঠাৎ অনুভব করি আমার ডানহাতে একটি অতিপ্রাকৃতিক স্পর্শ। আমি তাকিয়ে দেখি,কাছাকাছি কেউ কোথাও নেই।ভয়ে বিস্ময়ে আমার মুখ থেকে শব্দ বেরোনো যেন বন্ধ হয়ে গেল।ওই স্পর্শ যে আসলে একটা শীতল হাতের স্পর্শ সেটা বুঝতে আমার অসুবিধা হল না।ওই হাত আমায় এক অপার্থিব আসুরিক শক্তিতে এমনভাবে টানতে আরম্ভ করল যে আমি বিড়িফিড়ি ফেলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিভোর হয়ে হাত আমায় যেদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে,আমি চলতে থাকলাম।থামলাম সেইখানে,যেখানে দিদির ট্রাঙ্কটি রয়েছে। ওই স্পর্শ আমায় হাতে ধরে ওই ট্রাঙ্কের চাবি হাতে ধরিয়ে তালাটা খুলিয়ে নিল।আমার হাত দিয়ে বার করিয়ে নিল দিদির রংতুলি আর আঁকার কাগজ।তারপর আমার হাত ধরে আঁকাতে আরম্ভ করে দিল একটি আলপনার নক্সা।সেই শুরু। দিনের মধ্যে যখন তখন যে কোনো সময়ে অতর্কিতে সেই হিমশীতল স্পর্শ আমায় টেনে এনে রংতুলি নিয়ে বসিয়ে এক অপার্থিব শক্তির যাদুকরী সঞ্চালনের দ্বারা আমার এই হাত দিয়ে আঁকিয়ে তুলতে আরম্ভ করে এক একটি দুনিয়া কাঁপানো চিত্রশিল্প।ক্রমে আমার খ্যাতি আত্মীয়স্বজন,পাড়া প্রতিবেশী ছাড়িয়ে গোটা বাংলা,জেলা,রাজ্য এমনকি দেশ পার করে গোটা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এই হল আমার বিড়ি ফোঁকা অদক্ষ হাতের আসল শক্তি,আসল রহস্য।

প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথা শেষ করে দম নিল অ্যাড্রিয়ান। একটু জল খেয়ে নিল।

বিস্ময়ে হতবাক সাংবাদিক তখন ঢোঁক গিলে বললেন,

—স্ট্রেঞ্জ…কিন্তু এটা তো একটা খুনের ঘটনা।আমি এই ইন্টারভিউএর বয়ান প্রেস আর মিডিয়াকে দেওয়ার পর আপনার কি অবস্থা হবে সেটা একবারও ভেবে দেখেছেন?

—হ্যাঁ। এটা আমার স্বীকারোক্তি। আমার এতদিনের পাপের বোঝা আজ আমি হাল্কা করলাম।আজ আমার জেল হোক…কি ফাঁসি…পরিণতি নিয়ে আজ আমি আর ভাবি না।

অ্যাড্রিয়ানের চোখের কোণা চিকচিক করছে জলে।চোখ মুছে অ্যাড্রিয়ান বলল,আপনি আমার দেশের মানুষ।তায় বাঙালি।আমার কোনো মুখ নেই এই সত্য নিয়ে বাবা মায়ের মুখোমুখি হওয়ার।আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?

—বলুন

—আমার এই স্বীকারোক্তি যে আমার পরিবারের কাছে পৌঁছে গেছে এই বিষয়ে একটি নিশ্চিত খবর নিয়ে সেই বার্তা আমায় দিতে পারবেন?

সাংবাদিক ছেলেটির হাতদুটি চেপে ধরল অ্যাড্রিয়ানের আবেগক্লিষ্ট হাত।
সে হাতে আলতো অস্বস্তি মাখানো অভিব্যক্তি অনুভব করল অ্যাড্রিয়ান। পরিবেশ এতটাই নিঃশব্দ হয়ে উঠল যে আর কোনো প্রশ্নোত্তর পর্ব চালানোর মতো পরিস্থিতি আর রইল না।তা সত্ত্বেও সাংবাদিক ছেলেটি তার কাজ কোনোমতে শেষ করে ফাইলপত্র গুছিয়ে নিয়ে থমথমে মুখে বিদায় নিল।

ধীর পায়ে অ্যাড্রিয়ান প্রায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল ক্যানভাসটির সামনে।তার মনে পড়তে লাগল,সেই ধূসর মন কেমন করা সন্ধ্যাটি, যখন অ্যাড্রিয়ান “দিদি…তুই কোথায় চলে গেলি…একবার দেখা দে দিদি…একবার দেখা দে…বলে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিল,তখনই সে হাতে অনুভব করেছিল প্রতিবারের মতো সেই অপার্থিব হিমশীতল আঙুলের স্পর্শ। সেই স্পর্শ তার ডানহাত দ্বারা ধরে ধরে আঁকিয়ে দিল একটি মানুষের অবয়ব।অবয়বটি তার হাত দিয়ে অঙ্কিত হচ্ছিল আর অ্যাড্রিয়ান অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করে চলেছিল তার আপন আঙুলের স্পর্শে রংতুলির মাধ্যমে কেমন জীবন্ত হয়ে উঠছে তার হারিয়ে যাওয়া দিদি।
হঠাৎ দুইচোখে দুইহাত চাপা দিয়ে অবোধ শিশুর মতো ঘর কাঁপিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল অ্যাড্রিয়ান।

—আমি পেরেছি দিদি…আমি পেরেছি হাল্কা করতে এই পাপের বোঝা…।বাবা মা…গোটা দুনিয়া আজকে জানুক আমি আসলে গুণবতী দিদির অপদার্থ ভাই ছাড়া আর কিচ্ছু নই…সবাই আজকে জানুক…

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল অ্যাড্রিয়ান। হঠাৎ সে আবার অনুভব করল সেই চিরপরিচিত হিমশীতল অঙ্গুলিস্পর্শ।কিন্তু এবার তা আর তার হাতে নয়।তার দুই চোখে।বন্ধ দরজার অন্তরালে সেই অতিপ্রাকৃতিক শিহরণ জাগানো হিমাঙ্কের শতকোটি নীচে অবস্থান করা উষ্ণতার অধিকারী ওই অপার্থিব অঙ্গুলিলেহনের দ্বারা এখন কে তার দুচোখের বাহিত অশ্রুধারা পরম মমতায় মুছিয়ে দিচ্ছে সেটা বুঝতে পেরে দুচোখ যেন দ্বিগুণ অশ্রুসিক্ত হল অ্যাড্রিয়ানের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *