চিড়িয়াখানা – ব্যোমকেশ বক্সী : 01
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরের ঘটনা। গ্ৰীষ্মকাল। ব্যোমকেশের শ্যালক সুকুমার সত্যবতীকে ও খোকাকে লইয়া দাৰ্জিলিং গিয়াছে। ব্যোমকেশ ও আমি হ্যারিসন রোডের বাসায় পড়িয়া চিংড়িপোড়া হইতেছি।
ব্যোমকেশের কাজকর্মে মন্দা যাইতেছিল। ইহা তাহার পক্ষে এমন কিছু নূতন কথা নয়; কিন্তু এবার নৈষ্কর্মের দৈর্ঘ্য ও নিরবচ্ছিন্নতা এতাই বেশি যে আমাদের অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল। উপরন্তু খোকা ও সত্যবতী গৃহে নাই। মরিয়া হইয়া আমরা শেষ পর্যন্ত দাবা খেলিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম।
আমি মোটামুটি দাবা খেলিতে জানিতাম, ব্যোমকেশকে শিখাইয়াছিলাম। প্রথম প্রথম সে সহজেই হারিয়া যাইত; ক্রমে তাহাকে মাত করা কঠিন হইল। অবশেষে একদিন আসিল যেদিন সে বড়ের কিস্তিতে আমাকে মাত করিয়া দিল।
পুত্ৰাৎ শিষ্যাৎ পরাজয়ে গৌরবের হানি হয় না জানি। কিন্তু যাহাকে মাত্র কয়েকদিন আগে হাতে ধরিয়া দাবার চাল দিতে শিখাইয়াছি, তাহার কাছে হারিয়া গেলে নিজের বুদ্ধিবৃত্তির উপর সন্দেহ হয়। আমার চিত্তে আর সুখ রহিল না।
তার উপর এবার গরমও পড়িয়াছে প্ৰচণ্ড। সেই যে চৈত্র মাসের মাঝামাঝি একদিন গলদঘর্ম হইয়া সকালে ঘুম ভাঙিয়াছিল, তারপর এই দেড় মাস ধরিয়া গরম উত্তরোত্তর বাড়িয়াই চলিয়াছে। মাঝে দু-এক পশলা বৃষ্টি যে হয় নাই এমন নয়, কিন্তু তাহা হবিষা কৃষ্ণবর্ক্সেব তাপের মাত্রা বর্ধিত করিয়াছিল। দিবারাত্র ফ্যান চালাইয়াও নিস্কৃতি ছিল না, মনে হইতেছিল। সারা গায়ে রসগোল্লার রস মাখিয়া বসিয়া আছি।
দেহমনের এইরূপ নিরাশাজনক অবস্থা লইয়া একদিন পূবাঁহুে তক্তপোশের উপর দাবার ছক পাতিয়া বসিয়াছিলাম। ব্যোমকেশ আমাকে গজ-চক্ৰ করিবার ব্যবস্থা প্রায় পাকা করিয়া শুনেিয়ছে, আমি অতিমাত্রায় বিচলিত হইয়া অনর্গল ঘৰ্মত্যাগ করতেছি, এমন সময় বাধা দরজায় খুঁটু খুঁটু কড়া নাড়ার শব্দ। ডাকপিয়ন নয়, তাহার কড়া নাড়ার ভঙ্গীতে একটা বেপরোয়া উগ্ৰতা আছে। তবে কে? আমরা ব্যগ্র আগ্রহে পরস্পর মুখের পানে চাহিলাম। এতদিন পরে সত্যই কি নূতন রহস্যের শুভাগমন হইল।
ব্যোমকেশ টপ করিয়া পাঞ্জাবিটা গলাইয়া লইয়া দ্রুত গিয়া দ্বার খুলিল। আমি ইতিমধ্যে নিরাবরণ দেহে একটা উড়ানি চাদর জড়াইয়া ভদ্র হইয়া বসিলাম।
দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া আছেন মধ্যবয়স্ক একটি ভদ্রলোক। আকৃতি মধ্যম, একটু নিরেট গোছের, চাঁচা-ছোলা ধারালো মুখ, চোখে ফ্রেমহীন ধূমল কাচের চশমা। পরিধানে মরাল-শুভ্র প্যান্টুলুন ও সিন্ধের হাতকটা কামিজ। পায়ে মোজা নাই, কেবল বিননি-করা চামড়ার গ্ৰীসান স্যান্ডাল। ছিমছাম চেহারা।
মার্জিত কণ্ঠে বলিলেন,–’ব্যোমকেশবাবু—?’
ব্যোমকেশ বলিল,–’আমিই। —আসুন!’
সে ভদ্রলোকটিকে আনিয়া চেয়ারে বসাইল, মাথার উপর পাখাটা জোর করিয়া দিল। ভদ্রলোক একটি কার্ড বাহির করিয়া ব্যোমকেশকে দিলেন।
কার্ডে ছাপা ছিল–
নিশানাথ সেন
গোলাপ কলোনী
মোহনপুর, ২৪ পরগনা
বি. এ. আর
কার্ডের অন্য পিঠে টেলিগ্রামের ঠিকানা ‘গোলাপ’ এবং ফোন নম্বর।
ব্যোমকেশ কার্ড হইতে চোখ তুলিয়া বলিল,–’গোলাপ কলোনী। নামটা নতুন ধরনের মনে হচ্ছে–’
নিশানাথবাবুর মুখে একটু হাসির ভাব দেখা দিল, তিনি বলিলেন,–’গোলাপ কলোনী আমার ফুলের বাগান। আমি ফুলের ব্যবসা করি। শাকসবজিও আছে, ডেয়ারি ফার্মও আছে। নাম দিয়েছি গোলাপ কলোনী।’
ব্যোমকেশ তাঁহাকে তীক্ষ্ণ চক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, —’ও।–মোহনপুর কলকাতা থেকে কত দূর?’
নিশানাথ বলিলেন,–’শিয়ালদা থেকে ঘন্টাখানেকের পথ–তবে রেলওয়ে লাইনের ওপর পড়ে না। স্টেশন থেকে মাইল দুই দূরে।’
নিশানাথবাবুর কথা বলিবার ভঙ্গীটি ত্বরাহীন, যেন আলস্যভরে কথা বলিতেছেন। কিন্তু এই মন্থরতা যে সত্যই আলস্য বা অবহেলা নয়, বরং তাঁহার সাবধানী মনের বাহ্য আবরণ মাত্র, তাহা তাঁহার সজাগ সতর্ক মুখ দেখিয়া বোঝা যায়। মনে হয় দীর্ঘকাল বাক-সংযমের ফলে তিনি এইরূপ বাচনভঙ্গীতে অভ্যস্ত হইয়াছেন।
ব্যোমকেশের বাকপ্ৰণালীও অতিথির প্রভাবে একটু চিন্তা-মন্থর হইয়া গিয়াছিল, সে ধীরে ধীরে বলিল,–’আপনি বলছেন ব্যবসা করেন। আপনাকে কিন্তু ব্যবসাদার বলে মনে হয় না, এমন কি বিলিতি সওদাগরি অফিসের ব্যবসাদারও নয়। আপনি কতদিন এই ব্যবসা করছেন?’
নিশানাথ বললেন–দশ বছরের কিছু বেশি। —আমাকে আপনার কী মনে হয়, বলুন দেহকি।
‘মনে হয় আপনি সিভিলিয়ান ছিলেন। জজ কিম্বা ম্যাজিস্ট্রেট।’
ধোঁয়াটে চশমার আড়ালে নিশানাথবাবুর চোখ দু’টি একবার চঞ্চল হইয়া উঠিল। কিন্তু তিনি শান্ত-মন্থর কঠেই বলিলেন,–’কি করে আন্দাজ করলেন জানি না। আমি সত্যিই বোম্বাই প্রদেশের বিচার বিভাগে ছিলাম, সেশন জজ পর্যন্ত হয়েছিলাম। তারপর অবসর নিয়ে এই দশ বছর ফুলের চাষ করছি।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’মাফ করবেন, আপনার এখন বয়স কত?’
‘সাতান্ন চলছে।’
‘তার মানে সাতচল্লিশ বছর বয়সে রিটায়ার করেছেন। যতদূর জানি সরকারী চাকরির মেয়াদ পঞ্চান্ন বছর পর্যন্ত।’
নিশানাথবাবু একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন,–’আমার ব্লাড-প্রেসার আছে। দশ বছর আগে তার সূত্রপাত হয়। ডাক্তারেরা বললেন মস্তিষ্কের কাজ বন্ধ করতে হবে, নইলে বাঁচব না। কাজ থেকে অবসর নিলাম। তারপর বাংলা দেশে এসে ফুলের ফসল ফলাচ্ছি। ভাবনা-চিন্তা কিছু নেই, কিন্তু রক্তের চাপ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই যাচ্ছে।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’ভাবনা-চিন্তা কিছু নেই বলছেন। কিন্তু সম্প্রতি আপনার ভাবনার বিশেষ কারণ ঘটেছে। নইলে আমার কাছে আসতেন না।’
নিশানাথ হাসিলেন; অধর প্রান্তে শুভ্র দন্তরেখা অল্প দেখা গেল। বলিলেন, —’হ্যাঁ—! এটা অবশ্য অনুমান করা শক্ত নয়। কিছুদিন থেকে আমার কলোনীতে একটা ব্যাপার ঘটছে–’ তিনি থামিয়া গিয়া আমার দিকে চোখ ফিরাইলেন,–’আপনি অজিতবাবু?’
ব্যোমকেশ বলিল,–‘হ্যাঁ, উনি আমার সহকারী। আমার কাছে যা বলবেন ওঁর কাছে তা গোপন থাকবে না।’
নিশানাথ বলিলেন,–’না না, আমার কথা গোপনীয় নয়। উনি সাহিত্যিক, তাই ওঁর কাছে একটা কথা জানবার ছিল। অজিতবাবু্, blackmail শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ কি?’
আকস্মিক প্রশ্নে অপ্ৰতিভ হইয়া পড়িলাম। বাংলা ভাষা লইয়া অনেকদিন নাড়াচাড়া করিতেছি, জানিতে বাকী নাই যে বঙ্গভারতী আধুনিক পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার সহিত তাল রাখিয়া চলিতে পারেন নাই; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদেশী ভাবকে বিদেশী শব্দ দ্বারা প্ৰকাশ করিতে হয়। আমি আমতা-আমতা করিয়া বলিলাম,–’Blackmail-গুপ্তকথা ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা। যতদূর জানি এককথায় এর বাংলা প্রতিশব্দ নেই।’
নিশানাথবাবু একটু অবজ্ঞার স্বরে বলিলেন,–’আমিও তাই ভেবেছিলাম। যা হোক, ওটা অবাস্তর কথা। এবার ঘটনাটা সংক্ষেপে বলি শুনুন।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’সংক্ষেপে বলবার দরকার নেই, বিস্তারিত করেই বলুন। তাতে আমাদের বোঝবার সুবিধে হবে।’
নিশানাথ বলিলেন,–’আমার গোলাপ কলোনীতে যারা আমার অধীনে কাজ করে, মালীদের বাদ দিলে তারা সকলেই ভদ্রশ্রেণীর মানুষ, কিন্তু সকলেই বিচিত্র ধরনের লোক। কাউকেই ঠিক সহজ। সাধারণ মানুষ বলা যায় না। স্বাভাবিক পথে জীবিকা অর্জন তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই তারা আমার কাছে এসে জুটেছে। আমি তাদের থাকবার জায়গা দিয়েছি, খেতে পরতে দিই, মাসে মাসে কিছু হাতখরচ দিই। এই শর্তে তারা কলোনীর কাজ করে। অনেকটা মঠের মত ব্যবস্থা। খুব আরামের জীবন না হতে পারে, কিন্তু না খেয়ে মরবার ভয় নেই।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’আর একটু পরিষ্কার করে বলুন। এদের পক্ষে স্বাভাবিক পথে জীবন নিবহি সম্ভব নয় কেন?’
নিশানাথ বলিলেন,–’এদের মধ্যে একদল আছে যারা শরীরের কোনও না কোনও খুঁতের জন্যে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাত্রা নিবাহ করতে পারে না। যেমন, পানুগোপাল। বেশ স্বাস্থ্যবান ছেলে, অথচ সে কানে ভাল শুনতে পায় না, কথা বলাও তার পক্ষে কষ্টকর। অ্যাডোনয়েডের দোষ আছে। লেখাপড়া শেখেনি। তাকে আমি গোশালার ভার দিয়েছি, সে গরু-মোষ নিয়ে আছে।’
‘আর অন্য দল?’
‘অন্য দলের অতীত জীবনে দাগ আছে। যেমন ধরুন, ভূজঙ্গধরবাবু। এমন তীক্ষ্ণবুদ্ধি লোক কম দেখা যায়। ডাক্তার ছিলেন, সাজারিতে অসাধারণ হাত ছিল; এমন কি প্ল্যাস্টিক সাজারি পর্যন্ত জানতেন। কিন্তু তিনি এমন একটি দুনৈতিক কাজ করেছিলেন যে তাঁর ডাক্তারির লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়। তিনি এখন কলোনীর ডাক্তারখানার কম্পাউন্ডার হয়ে আছেন।’
‘বুঝেছি। তারপর বলুন।’
ব্যোমকেশ অতিথির সম্মুখে সিগারেটের টিন খুলিয়া ধরিল, কিন্তু তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিলেন,–’ব্লাড-প্রেসার বাড়ার পর ছেড়ে দিয়েছি।’ তারপর তিনি ধীরে অত্বরিত কণ্ঠে বলিতে শুরু করিলেন,–’কলোনীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কোনও নূতনত্ব নেই, দিনের পর দিন একই কাজের পুনরাভিনয় হয়। ফুল ফোটে, শাকসবজি গজায়, মুগী ডিম পাড়ে, দুধ থেকে ঘি মাখন তৈরি হয়। কলোনীর একটা ঘোড়া-টানা ভ্যান আছে, তাতে বোঝাই হয়ে রোজ সকালে মাল স্টেশনে যায়। সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতায় আসে। মূনিসিপাল মার্কেটে আমাদের দুটো স্টল আছে, একটাতে ফুল বিক্রি হয়, অন্যটাতে শাকসবজি। এই ব্যবসা থেকে যা আয় হয় তাতে ভালভাবেই চলে যায়।
‘এইভাবে চলছিল, হঠাৎ মাস ছয়েক আগে একটা ব্যাপার ঘটল। রাত্রে নিজের ঘরে ঘুমচ্ছিলাম, জানালার কাচ ভাঙার ঝনঝনি শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে আলো জ্বেলে দেখি মেঝের ওপর পড়ে আছে—মোটরের একটি স্পার্কিং প্লাগ।’
আমি বলিয়া উঠিলাম্,–’স্পর্কিং প্লাগ।।’
নিশানাথ বলিলেন,–’হ্যাঁ। বাইরে থেকে কেউ ওটা ছুঁড়ে মেরে জানালার কাচ ভেঙেছে। শীতের অন্ধকার রাত্রি, কে এই দুষ্কার্য করেছে জানা গেল না। ভাবলাম, বাইরের কোনও দুষ্ট লোক নিরর্থক বজ্জাতি করেছে। গোলাপ কলোনীর কম্পাউন্ডের মধ্যে আসা-যাওয়ার কোনও অসুবিধা নেই, গরু-ছাগল আটকাবার জন্যে ফটকে আগড় আছে বটে, কিন্তু মানুষের যাতায়াতের পক্ষে সেটা গুরুতর বাধা নয়।
‘এই ঘটনার পর দশ-বারো দিন নিরুপদ্রবে কেটে গেল। তারপর একদিন সকালবেলা সদর দরজা খুলে দেখি দরজার বাইরে একটা ভাঙা কারবুরেটার পড়ে রয়েছে। তার দু’হগুী পরে এল একটা মোটর হর্ন। তারপর ছেড়া মোটরের টায়ার। এইভাবে চলেছে।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’মনে হচ্ছে টুকরো টুকরো ভাবে কেউ আপনাকে একখানি মোটর উপহার দেবার চেষ্টা করছে। এর মানে কি বুঝতে পেরেছেন?
এতক্ষণে নিশানাথবাবুর মুখে একটু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করিলাম। তিনি ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন,–’পাগলের রসিকতা হতে পারে।–কিন্তু আমার এ অনুমান আমার নিজের কাছেও সন্তোষজনক নয়। তাই আপনার কাছে এসেছি।’
ব্যোমকেশ কিয়াৎকাল ঊর্ধ্বমুখ হইয়া ঘুরন্তু পাখার দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর প্রশ্ন করিল,–’শেষবার মোটরের ভগ্নাংশ কবে পেয়েছেন?’
‘কাল সকালে। তবে এবার ভগ্নাংশ নয়, একটি আস্ত ছেলেখেলার মোটর।’
‘বাঃ! লোকটি সত্যিই রসিক মনে হচ্ছে। এ ব্যাপার অবশ্য কলোনীর সবাই জানে?’
‘জানে। এটা একটা হাসির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘আচ্ছা, আপনার মোটর আছে?’
‘না। আমাদের কোথাও যাতায়াত নেই, মেলামেশা নেই,–সামাজিক জীবন কলোনীর মধ্যেই আবদ্ধ। তাই ইচ্ছে করেই মোটর রাখিনি।’
‘কলোনীতে এমন কেউ আছে যার কোনকালে মোটরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল?’
নিশানাথবাবুর অধরপ্রান্ত সম্মিত ব্যঙ্গভরে একটু প্রসারিত হইল,–’আমাদের কোচম্যান মুস্কিল চিত্র আগে মোটর ড্রাইভার ছিল, বারবার স্নাশ ড্রাইভিং-এর জন্য তার লাইসেন্স কেড়ে নিয়েছে।’
‘কি নাম বললেন, মুস্কিল মিঞা?’
‘তার নাম নূরুদ্দিন কিম্বা ঐ রকম কিছু। সকলে ওকে মুস্কিল মিঞা বলে! মুস্কিল শব্দটা ওর কথার মাত্রা।’
‘ও–আর কেউ?’
‘আর আমার ভাইপো বিজয়ের একটা মোটর-বাইক ছিল, কখনও চলত, কখনও চলত না। গত বছর বিজয় সেটা বিক্রি করে দিয়েছে।’
‘আপনার ভাইপো। তিনিও কলোনীতে থাকেন?’
‘হ্যাঁ। মূনিসিপাল মার্কেটের ফুলের স্টল সেই দেখে। আমার ছেলেপুলে নেই, বিজয়কেই আমার স্ত্রী পনরো বছর বয়স থেকে নিজের ছেলের মত মানুষ করেছেন।’
ব্যোমকেশ আবার ফ্যানের দিকে চোখ তুলিয়া বসিয়া রহিল। তারপর বলিল,–’মিস্টার সেন, আপনার জীবনে কখনও-দশ বছর আগে হোক বিশ বছর আগে হোক-এমন কোনও লোকের সংস্পর্শে এসেছিলেন কি যার মোটর ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্ক আছে? ধরুন, মোটরের দালাল কিম্বা ঐরকম কিছু? মোটর মেকানিক-?’
এবার নিশানাথবাবু অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। তারপর যখন কথা কহিলেন তখন তাঁহার কণ্ঠস্বর আরও চাপা শুনাইল। বলিলেন,–’বারো বছর আগে আমি যখন সেশন জজ ছিলাম, তখন লাল সিং নামে একজন পাঞ্জাবী খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আমার এজলাসে এসেছিল। তার একটা ছোট মোটর মেরামতের কারখানা ছিল।’
‘তারপর?’
‘লাল সিং ভয়ানক ঝগড়াটে বদরাগী লোক ছিল, তার কারখানার একটা মিস্ক্রিকে মোটরের স্প্যানার দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে খুন করেছিল। বিচারে আমি তাকে ফাঁসির হুকুম দিই।’ একটু হাসিয়া বলিলেন,–’হুকুম শুনে লাল সিং আমাকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছিল।’
‘তারপর?’
‘তারপর আমার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল হল। আপীলে আমার রায় বহাল রইল বটে, কিন্তু ফাঁসি মকুব হয়ে চৌদ্দ বছর জেল হল।’
‘চৌদ্দ বছর জেল! তার মানে লাল সিং এখনও জেলে আছে।’
নিশানাথবাবু বলিলেন,–’জেলের কয়েদীরা শান্তশিষ্ট হয়ে থাকলে তাদের মেয়াদ কিছু মাফ হয়। লাল সিং হয়তো বেরিয়েছে।’
‘খোঁজ নিয়েছেন? জেল-বিভাগের দপ্তরে খোঁজ নিলেই জানা যেতে পারে।’
‘আমি খোঁজ নিইনি।’
নিশানাথবাবু উঠিলেন। বলিলেন,–’আর আপনাদের সময় নষ্ট করব না, আজ উঠি। আমার যা বলবার ছিল সবই বলেছি। দেখবেন যদি কিছু হদিস পান। কে এমন অনর্থক উৎপাত করছে জানা দরকার।’
ব্যোমকেশও দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল,–’অনৰ্থক উৎপাত নাও হতে পারে।’
নিশানাথ বলিলেন,–’তাহলে উৎপাতের অর্থ কি সেটা আরও বেশি জানা দরকার।’ প্যান্টুলুনের পকেট হইতে এক গোছা নোট লইয়া কয়েকটা গণিয়া টেবিলের উপর রাখিলেন,–’আপনার পারিশ্রমিক পঞ্চাশ টাকা আগাম দিয়ে গেলাম। যদি আরও লাগে পরে দেব।–আচ্ছা।’
নিশানাথবাবু দ্বারের দিকে চলিলেন। ব্যোমকেশ বলিল,–’ধন্যবাদ।’
দ্বার পর্যন্ত গিয়া নিশানাথবাবু দ্বিধাভরে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন,–’আর একটা কথা মনে পড়ল। সামান্য কাজ, ভাবছি সে কাজ আপনাকে করতে বলা উচিত হবে কিনা।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’বলুন না।’
নিশানাথ কয়েক পা ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন,–’একটি স্ত্রীলোকের সন্ধান করতে হবে। সিনেমার অভিনেত্রী ছিল, নাম সুনয়না। বছর দুই আগে কয়েকটা বাজে ছবিতে ছোট পার্ট করেছিল, তারপর হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। যদি তার সন্ধান পান ভালই, নচেৎ তার সম্বন্ধে যত কিছু খবর সংগ্ৰহ করা যায় সংগ্ৰহ করতে হবে। আর যদি সম্ভব হয়, তার একটা ফটোগ্রাফ যোগাড় করতে হবে।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’যখন সিনেমার অভিনেত্রী ছিল তখন ফটো যোগাড় করা শক্ত হবে না। দু’এক দিনের মধ্যেই আমি আপনাকে খবর দেব।’
‘ধন্যবাদ।’ নিশানাথবাবু প্ৰস্থান করিলে ব্যোমকেশ প্রথমেই পাঞ্জাবিটা খুলিয়া ফেলিল, তারপর নোটগুলি টেবিল হইতে তুলিয়া গণিয়া দেখিল। তাহার মুখে সকৌতুক হাসি ফুটিয়া উঠিল। নোটগুলি দেরাজের মধ্যে রাখিতে রাখিতে সে বলিল–’নিশানাথবাবু কেতাদুরস্ত সিভিলিয়ান হতে পারেন। কিন্তু তিনি বিষয়ী লোক নন।’
আমি উড়ানির খোলস ছাড়িয়া দাবার ঘুঁটিগুলি কৌটোয় তুলিয়া রাখিতেছিলাম, প্রশ্ন করিলাম,–’কোন?’
সিগারেট ধরাইয়া ব্যোমকেশ তক্তপোশে আসিয়া বসিল, বলিল–’পঞ্চাশ টাকা দিলাম বলে ষাট টাকার নোট রেখে গেছেন। লোকটি বুদ্ধিমান, কিন্তু টাকাকড়ি সম্বন্ধে ঢ়িলে প্রকৃতির।’
আমি বলিলাম,–’আচ্ছা ব্যোমকেশ, উনি যে সিভিলিয়ান ছিলেন, তুমি এত সহজে বুঝলে কি করে?’
সে বলিল,–’বোঝা সহজ বলেই সহজে বুঝলাম। উনি যে-বেশে এসেছিলেন, সাধারণ বাঙালী ভদ্রলোক ও-বেশে বেড়ায় না, নিজের পরিচয় দেবার জন্য কার্ডও বের করে না। ওটা বিশেষ ধরনের শিক্ষাদীক্ষার লক্ষণ।। ওঁর কথা বলার ভঙ্গীতেও একটা হাকিমী মন্থরতা আছে।–কিন্তু ও কিছু নয়, আসল কথা হচ্ছে উনি কি জন্যে আমার কাছে এসেছিলেন।’
‘তার মানে?’ ‘উনি দুটো সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন; এক হচ্ছে মোটরের ভগ্নাংশ লাভ; আর দ্বিতীয়, চিত্রাভিনেত্রী সুনয়না।–কোনটা প্রধান?’
‘আমার তো মনে হল মোটরের ব্যাপারটাই প্রধান–তোমার কি অন্যরকম মনে হচ্ছে?’
‘বুঝতে পারছি না। নিশানাথবাবু চাপা স্বভাবের লোক, হয়তো আমার কাছেও ওঁর প্রকৃত উদ্বেগের কারণ প্ৰকাশ করতে চান না।’
কথাটা ভাবিয়া দেখিয়া বলিলাম,–’কিন্তু যে-বয়সে মানুষ চিত্রাভিনেত্রীর পশ্চাদ্ধাবন করে ওঁর সে বয়স নয়।’
‘তার চেয়ে বড় কথা, ওঁর মনোবৃত্তি সে রকম নয়; নইলে বুড়ো লম্পট আমাদের দেশে দুষ্পপ্ৰাপ্য নয়। ওঁর পরিমার্জিত বাচনভঙ্গী থেকে মনোবৃত্তির যেটুকু ইঙ্গিত পেলাম তাতে মনে হয়। উনি মনুষ্য জাতিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না। ঘৃণাও করেন না; একটু তিক্ত কৌতুকমিশ্রিত অবজ্ঞার ভাব। উচ্ছের সঙ্গে তেঁতুল মেশালে যা হয় তাই।’
উচ্ছে ও তেঁতুলের কথায় মনে পড়িয়া গেল। আজ পুঁটিরামকে উক্ত দুইটি উপকরণ সহযোগে অম্বল রাঁধিবার ফরমাশ দিয়াছি। আমি স্নানাহারের জন্য উঠিয়া পড়িলাম। বলিলাম,–’তুমি এখন কি করবে?’
সে বলিল,–’মোটরের ব্যাপারে চিন্তা ছাড়া কিছু করবার নেই। আপাতত পলাতক অভিনেত্রী সুনয়নার পশ্চাদ্ধাবন করাই প্রধান কাজ।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ নীরবে সিগারেট টানিল, ভাবিতে ভাবিতে বলিল,–’Blackmaid কথাটা সম্বন্ধে নিশানাথবাবুর এত কৌতুহল কেন? বাংলা ভাষায় blackmail-এর প্রতিশব্দ আছে কিনা তা জেনে ওঁর কি লাভ?’
আমি মাথায় তেল ঘষিতে ঘষিতে বলিলাম,—’আমার বিশ্বাস ওটা অবচেতন মনের ক্রিয়া। হয়তো লাল সিং জেল থেকে বেরিয়েছে, সে-ই মোটরের টুকরো পাঠিয়ে ওঁকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে।’
‘লাল সিং যদি জেল থেকে বেরিয়েই থাকে, সে নিশানাথবাবুকে blackmaid করবার চেষ্টা করবে। কেন? উনি তো বে-আইনী কিছু করেননি; আসামীকে ফাঁসির হুকুম দেওয়া বে-আইনী কাজ নয়। তবে লাল সিং প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করতে পারে। হয়তো এই বারো বছর ধরে সে রাগ পুষে রেখেছে। কিন্তু নিশানাথবাবুর ভাব দেখে তা মনে হয় না। তিনি যদি লাল সিংকে সন্দেহ করতেন তাহলে অন্তত খোঁজ নিতেন সে জেল থেকে বেরিয়েছে কি না।’
ব্যোমকেশ সিগারেটের দগ্ধাবশেষ ফেলিয়া দিয়া তক্তপোশের উপর চিৎ হইয়া শুইল। নিজ মনেই বলিল,–’নিশানাথবাবুর স্মৃতিশক্তি বোধ হয় খুব প্রখর।’
‘এটা জানলে কি করে?’
‘তিনি হাকিম-জীবনে নিশ্চয় হাজার হাজার ফৌজদারী মোকদ্দমার বিচার করেছেন। সব আসামীর নাম মনে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি লাল সিংয়ের নাম ঠিক মনে করে রেখেছেন।’
‘লাল সিং তাঁকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছিল, হয়তো সেই কারণেই নামটা মনে আছে।’
‘তা হতে পারে’ বলিয়া সে আবার সিগারেট ধরাইবার উপক্ৰম করিল।
আমি বলিলাম,–’না না, আর সিগারেট নয়, ওঠে এবার। বেলা একটা বাজে।’