হরি ঘোষের গোয়াল : ১
বড়বাবু পান চিবোচ্ছিলেন। শীত সবে শহরে পা রেখেছে। যাঁদের লিভার ভালো তাঁদের এই সময়টায় মুখের চামড়া বেশ টান টান, তেলা তেলা হয়। রঙের জেল্লা খোলে। বড়বাবুর লিভারটি ভালো। বেশ চকচক করছেন। গায়ে সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবির ওপর ঘি ঘি রঙের জহরকোট। মাথার সামনের দিকের চুল পাতলা হয়ে এলেও পেছন দিকে বর্ষার উপত্যকার মতো চুলের ভেড়া—কোঁচ। চোখে একটি সোনালি ফ্রেমের পাতলা চশমা। মুখ থেকে বাঁ হাতের তালুতে পানের ছিবড়ে নিয়ে পাশেই রাখা ভাঙা একটা বেতের ঝুড়িতে ফেলে বললেন, ‘সাত সকালে আবার কী চাই। এখনও অফিস তো ভালো করে বসেই নি।’
বুক পকেট থেকে পাতলা জিলজিলে কাগজে টাইপ করা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারখানা বের করে ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে মাথার ওপর দেওয়ালে টাঙানো মস্ত একটা গোল ঘড়ির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম। হাঁ করিয়ে দেবার মতোই ঘড়ি। পেন্ডুলাম না থাকায় চলছে কি চলছে না বোঝার উপায় নেই। কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বেজে বসে আছে। কাচের ওপর ক্যালেন্ডার থেকে স্যাটারডে শব্দটা কেটে নিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
বড়বাবু অতি কষ্টে চিঠিটা পড়লেন। কষ্ট হবারই কথা। কার্বন কপি। দুই কি তিন নম্বর কপি হলে পড়া যায়। সাত কি আট নম্বর কপি পড়ে কার বাপের সাধ্য। অস্পষ্ট কিছু শব্দ সমষ্টি।
‘হুঁ নিউ রিক্রুট। বোসো।’
সামনে একটা গায়েগতরে চেয়ার। মনে হয়, ইংরেজ আমলের লিগ্যাসি। নেটিভদের পেছন ঠেকাবার জন্যেই যেন তৈরি। টেবিলের তলা দিয়ে পা দুটো লম্বা করে বড়বাবু চেয়ারটাকে এতক্ষণ ফুট রেস্ট হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। পা দুটো টেনে শরীরের ঊর্ধ্বকাণ্ডটিকে সোজা করতে করতে বললেন, ‘মামাটি কে?’
‘আজ্ঞে মামা ত নেই।’
‘নো মামা, তবু চাকরি হল। তাজ্জব ব্যাপার। ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকসান। মনে হয় কোনো ভাগ্নেই বোধহয় এ চাকরিতে উৎসাহ পায়নি। যা মাইনে। হাওয়েভার তুমি এই হরি ঘোষের গোয়ালে মরতে এলে কেন?’
‘আজ্ঞে আর যে কিছু জুটল না।’
‘হিয়ার ফুল মেনি এ ফ্লাওয়ার ইজ বর্ন টু ব্রাশ আনসিল, অ্যান্ড ওয়েস্ট ইটস সুইটনেস অন্য দি ডেজার্ট এয়ার। কীসের লাইন?’
‘গ্রের, এলিজি।’
‘গুড, গুড, ভেরি গুড। ফুল মার্ক। তুমি ত দেখছি একেবারে আকাট নও হে। এই গর্দভের প্যারাডাইসে টিকবে কি করে! মরে যাবে, পচে যাবে, হেজে যাবে।’
এ সব কথার কোনো জবাব নেই। বিষণ্ণ এক চিলতে হাসি। একশো ইন্টারভিউ দিয়ে এই মড়াখেকো চাকরি জুটেছে। হাজার ক্যানডিডেটের সঙ্গে স্ট্রেট ফাইট করে। পেছন থেকে বিশাল কেউ সামনে ছায়া ফেলেনি। পুরুষকারে জয় করা এই চাকরি। সামান্য হলেও অসামান্য। রাজার চাকরি। পেনশন আছে বাবা। কাজ কর আর না কর মাস মাইনে বাধা। কথায় বলে, যেতে আসতে মাইনে পাই কাজের জন্য ওভার টাইম চাই।
‘তুমি তা হলে আজকেই জয়েন করছ?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘গুড ডিসিসান, সিনিয়ারিটির দিক থেকে এক ঘণ্টাও লস করা উচিত নয়। যদি কখনও প্রমোশানের সুযোগ আসে পনেরো মিনিটের সিনিয়ারিটি নিয়ে তোমাকে কেউ টপকে যেতে পারে। প্রোমোশান অবশ্য সেভাবে হয় না। এ বড় শক্ত ঠাই, গুরু—শিষ্যে দেখা নাই। দাও জয়নিং রিপোর্টটা দাও।’
‘জয়নিং রিপোর্ট!’
‘হ্যাঁ হে দাসখত, দাসখত। ইংরেজিতে যার নাম জয়নিং রিপোর্ট। আজ থেকে তুমি আর মানব নও ক্রীতদাস। কীভাবে লিখতে হয় জান কি?’
‘আজ্ঞে না।’
‘এই নাও কাগজ। যা বলি লিখে নাও। আই, শ্রীমানব মুখার্জি, জয়েন দিস অফিস অ্যাজ অ্যান ইনস্পেকটার ইন দি ফোরনুন অব ঘড়িটার দিকে তাকিও না, ওটাতে ইটরন্যাল বারোটা বেজে বসে আছে, লোয়েস্ট কোটেশানের জিনিস, ফোরনুন অব, দিন তারিখ সাল। পুরো নাম সই কর। ঠিকানা বসাও।’
সই করে কাগজটা বড়বাবুর হাতে দিলুম। বিশাল হল—ঘরের এক কোণে উদভ্রান্ত চেহারার এক ভদ্রলোক চোখের সামনে এক গেলাস জল ধরে অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছ দেখার মতো করে অনেকক্ষণ কী দেখছিলেন। বড়বাবু মৃত্যুঞ্জয়, মৃত্যুঞ্জয় বলে দুবার ডাকতেই ঢক ঢক করে জল খেতে খেতে বাঁ হাত আকাশে তুলে ইঙ্গিতে জানালেন, শুনেছি। বাঁ হাতে একটা স্টিলের বালা।
মৃত্যুঞ্জয়বাবুর দিকে তাকিয়ে বড়বাবু ভবিষ্যৎবাণী করলেন, ‘তোমরাও ওইরকম হবে। বেশি না গোটা দশেক বছর এখানে থেকে গেলেই তোমার চোখে একসঙ্গে মাইক্রোসকোপ, টেলিস্কোপ খেলা করবে। পেপসিয়া ধরবে। বড় ভালো জিনিস হে। কম খরচে সংসার চালাতে হলে ডিসপেপসিয়া যত তাড়াতাড়ি করতে পার ততই মঙ্গল। তখন জলই হবে পথ্য। দু—এক গাল মুড়ি সঙ্গে দুটো বাতাসা। ফুটপাতে ঢালাও ব্যবস্থা। রাজভবন আর কেরানি ভবন মাঝে এক ফার্লং রাস্তা পাশেই ত্রিতাপহারিণী মা গঙ্গা। আহা, কি চমৎকার।’
মৃত্যুঞ্জয়বাবু সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। গোঁফে গুঁড়ো গুঁড়ো কী লেগে আছে। বড়বাবু বললেন, ‘গোঁফটা একটু ব্রাশ করে নাও হে। গোঁফ আর গরমকোট বড় যত্নের জিনিস, রোজ ব্রাশিং দরকার। সায়েবের হাতে কেরানির থ্রাশিং—এর মতো। কী খেয়েছিলে?’
মৃত্যুঞ্জয়বাবু অনুসন্ধানী দৃষ্টি মেলে আমাকে দেখতে দেখতে বললেন, ‘সকাল থেকেই পেটটা আউট অফ টিউন, দু চামচে ভাস্কর লবণ মুখে ফেলে এলুম। আজ আবার বাজারে তেমন ভালো পেঁপে পেলুম না। কাঁচা বেলও নেই। কি যে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালাচ্ছে এরা! মাসে মাসে খালি চাঁদা। সপ্তাহে একবার করে মিছিল, চলবে ন, চলবে না। চলছে কি যে চলবে না? প্যারাডকসিক্যাল, হিপোক্রিটিক্যাল, ডেসট্রাকশনাল, মাইয়োপিক্যাল।’
মুখের সামনে আত্মরক্ষার মতো করে দুটো হাত তুলে বড়বাবু বললেন, ‘নাঃ, আজ তোমার পেটের অবস্থা খুব খারাপ হে। পেঁপের বদলে পেপসিন খাও না।’
‘পেপসিন? ন্যাচারাল ছেড়ে আনন্যাচারাল! ওর মধ্যে আমি নেই। অ্যালেপ্যাথিক সিসটেম হল কিলিং সিসটেম, আমাদের ডেমোক্র্যাসির মতো। ক্র্যাশ দি পেশেন্ট? বলুন কী বলছিলেন।’
‘এই নাও জয়েনিং রিপোর্ট। মানব মুখার্জি। সার্ভিস বুক খুলে ফেল। এখন কোয়াসি পার্মানেন্ট। পার্মানেন্ট কবে হবে ভাগ্যদেবতাই জানেন।’
‘স্কিম পার্মানেন্ট হলে স্টাফ পার্মানেন্ট হবে। স্যাংশান এলে মাইনে, না—এলে না মাইনে। গোলাপি ছবি এঁকে লাভ নেই। তবে ওই, বেকার বসে থাকার চেয়ে ভালো।’
মৃত্যুঞ্জয়বাবু জয়নিং রিপোর্ট হাতে নিয়ে তাঁর নিজের সিটের দিকে চলে গেলেন। দুজনে কি সব টেকনিক্যাল কথাবার্তা হল বোঝা গেল না। এটা চাকরি না তামাশা তাও ত জানি না। চাকরি পাওয়ার সাফল্যে সামনের শনিবার পূর্ণিমার দিন সত্যনারায়ণ পুজো হবে। মানবকে ঘিরে মানবের পিতার অ্যামবিশানের শেষ ছিল না। তিনি খুশি না হলেও, মৃদু হেসে বলেছিলেন, সামথিং ইজ বেটার দ্যান নাথিং। বড়বাবুকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলুম : ‘পার্মানেন্ট, মাইনে, স্কিম, স্যাংশান কি সব বললেন তেমন বোঝা গেল না। মাসে মাসে মাইনে পাব ত’?
‘আরে ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। দু’মাস একটানা মাইনে পাবার পর এক মাস একটু বিশ্রাম, তখন আমাদের লেখালিখি, হাঁটাহাঁটি, আবার ছ’মাস, এইভাবে ছক্কা মেরে মেরে ছক্কা মেরে মেরে তোমার ভবিষ্যৎ তৈরি হবে। ভয় নেই চাকরি যাবে না। সেই গানটা জান ত’ তরী করে টলমল, পাসরাতে ওঠে জল। যাও দুর্গা বলে ভেসে পড়।’
ঘাড় ঘুরিয়ে ভেসে পড়ার জায়গাটা আর একবার দেখতে ইচ্ছে করল। বেশ দু—চারজন কর্মী এসে গেছেন। টেবিলে টেবিলে ডাই করা ছেঁড়া ছেঁড়া ফাইল। অপরিষ্কার জলের গেলাস। একটা করে ইঙ্কস্ট্যান্ড। দুটো করে কলম পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে ফড়িংয়ের মতো পেছন উঁচু করে রেখেছে। সব বাবুই একটি করে ফোলিও ব্যাগের মালিক। সব ব্যাগই অন্তঃসত্ত্বা। পেট উলটে পাশে পাশে পড়ে আছে। সমভূমি থেকে চোখ ওপরে তুলতেই দেওয়ালে আটকে গেল। বিশাল একটা পোস্টার কাচের ফ্রেমে, ‘ডিগনিটি অফ দিস অফিস ইজ ইওরস, গার্ড ইট উইথ পার্সোন্যাল কেয়ার।’ চার পাশে ঝুলের ঝালর। ঠিক তলায় একটা বলিষ্ঠ টেবিল। দেওয়ালের দিকে পিঠ করে দৈত্যের মতো বিশাল একজন মানুষ বসে আছেন। সামনে একটা নিক্তি। কয়েকশ’ রবার স্ট্যাম্প। ছোট বড় কয়েক হাজার প্যাকেট, চিঠি, খাম, তাসের বাড়ির মতো ধসে ধসে পড়েছে। সেই ধ্বংসস্তূপে মোটা খদ্দরের হাফসার্ট পরে তিনি বসে আছেন, জাস্টিস, ফ্রেটারনিটি, ইকোয়ালিটির দেবতার মতো। বুক খোলা। সেই ভ্যালিতে কাঁচাপাকা চুলের রেন ফরেস্ট।
আমাকে চমকে দিয়ে বড়বাবু চিৎকার ছাড়লেন, ‘হরেন হরেন।’ ডাক শুনে নৈঋত কোণের চেয়ারে মটকা পাঞ্জাবিপরা ভদ্রলোক বসতে বসতেও উঠে পড়লেন। বেশ বড় মুখ। ভোলেবাবার মতো চেহারা। চোখের দৃষ্টিতে তৎপরতা মাখান। হটর—পটর করে এগিয়ে এলেন।
‘এই নাও। তোমার সেকসানে একে ফিট করে নাও।’
‘বড়বাবু, আমার আরও একজন স্টাফ চাই। ব্যানার্জি সাহেব তা না হলে তুলকালাম করবেন।’
‘হবে হবে। এই লটে আরও ত আসছে। তবে মিত্তির সাহেবও ত লোক চেয়েছেন। মিনিস্টারের সঙ্গে ডাইরেক্ট লিঙ্ক। পান থেকে চুন খসলেই দুর্বাসা।’
‘মিনিস্টার, হেঃ এ এ।’ মুখটা বড়বাবুর কানের কাছে নিয়ে গিয়ে চাপা সুরে বললেন, ‘ব্যানার্জি সাহেব, সি এমের পেয়ারের লোক।’
বড়বাবু নিজের মুখ হরেনবাবুর মুখ থেকে যতদূর সম্ভব দূরে সরিয়ে নিতে নিতে বললেন, ‘ছিলেন। সি এম ইজ ডেড, লং লিভ সি এম। চিরতার জল খাও, কুলেখাড়া দিয়ে। মুখে তোমার ভীষণ গন্ধ, ব্যাড ব্রেদ।’
হরেনবাবু কিছু মাত্র লজ্জিত না হয়ে বললেন, ‘ডিম। কাঁচা ডিম খেয়ে।’
‘খাও কেন?’
‘না খেলে বাঁচব না। বাঁ দিকের লাঙসে দুটো ফুটো। স্ট্রেপটো—মাইসিন, প্যাস, ডিম এই তিনে মেলে আমার জীবন।’
‘লবঙ্গ লাগাও, বউমাকে আর কষ্ট দিও না।’
হরেনবাবু হ্যা হ্যা করে হেসে বললেন, ‘চট্টগ্রামের মেয়ে, নাকে শুঁটকি মাছ পর্যন্ত যার সহ্য তার কাছে আমার নিশ্বাস ধূপের গন্ধ।’
‘মানব তুমি এঁর সঙ্গে যাও।’
‘চল হে ব্রাদার।’ হরেনবাবু আমার পিঠে একটা হাত রাখলেন স্নেহে ভারী।
হরেনবাবুর পাশের চেয়ারে বসলুম। এর নাম অফিস। পালিশ ওঠা টেবিলের সারি। হাতলঅলা, হাতল ভাঙা চেয়ার। পর্বত প্রমাণ ফাইল। সার সার টাইপ রাইটার। পাখা ঘুরছে পন পন করে। এক একটা পাখা চামচিকের মতো শব্দ করছে। বেলা যত বাড়ছে অফিসে তত নানা চেহারার মানুষ ভরে উঠছে। কোলাহলে কান পাতা দায়।
হরেনবাবু জল খেলেন। গেলাসটা তাঁর শরীরের মাপের। মিনিমাম এক সের জল ধরবে। জল খেয়ে শরীর শীতল হয়েছে। মুখে মাখনের মতো হাসি।
‘এটা হল রিসার্চ সেকসান। খুব ইমপরটেন্ট সেকসান। খুব সাবধানে কাজ সাবধানে কাজ করতে হবে। ব্যানার্জি সাহেব ভীষণ রাগী সাহেব। রেগে গেলে জ্ঞান থাকে না। তখন চড়চাপড়ও চালিয়ে দিতে পারেন। একবার মদনকে চ্যাঙদোলা করে নতলার জানলা গলিয়ে ফেলে দিতে গিয়েছিলেন। তুলতে পারলেন না বলে বেঁচে গেল। তোলাতুলিতে বেচারার কাছাটাই যা একবার খুলে গেল।’
‘তুলতে পারলেন না কেন?’
‘হাতি তোলা ত ব্যানার্জি সাহেবের অভ্যাস নেই। মদনের চেহারাখানা দেখলেই বুঝতে পারবে।’
‘মদনবাবু কে?’
‘টাইপিস্ট।’
হরেনবাবুর কথা শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গেলুম। ‘ব্যানার্জি সাহেব আর কী করেন।’
‘চাকরি খান। আদর্শবাদী মানুষ এই ঘুষ—ঘাস, টুস—টাস একেবারে সহ্য করতে পারেন না। এই ত দিন তিনেক আগে এক পিয়ন পার্টির কাছ থেকে আট আনা ঘুষ খেয়েছিল। ক্যাক করে ধরেই ফায়ার।’
‘মারা গেল।’
‘আর সে ফায়ার নয়। সঙ্গে সঙ্গে ডিসচার্জ। এ অফিসে বেশিরভাগই ত টেমপরারি। ছাঁটাই করতে এক মিনিট সময় লাগে। পার্মানেন্ট হলে সাসপেন্ড। যে কজন পার্মানেন্ট স্টাফ আছে তার একের চার ভাগই ত সাসপেন্ড হয়ে বসে আছে। এখানে চাকরি করতে হলে সব সময় মনে রাখতে হবে, রাখে কেষ্ট মারে কে, মারে কেষ্ট রাখে কে। ম্যারেড?’
‘কে আমি?’
‘ইয়েস।’
‘আজ্ঞে না।’
‘তবে আর ভয় কি! হ্যাঁ এখন তোমার বসার ব্যবস্থা করতে হবে।’
হরেনবাবু, পাঁচু পাঁচু বলে চিৎকার করে উঠলেন। কোণে দরজার পাশে একটি লোক পান সিগারেটের একটা বাক্স নিয়ে বসেছিল। ডাক শুনে চিৎকার করে বললে, ‘কাইচি না টেন?’
হরেনবাবু ধমকে উঠলেন, ‘ধ্যার ব্যাটা। স্টোরকিপারকে ডেকে আন।’
পাঁচু পান সাজছিল। হাতের কাজ শেষ করে দরজার কোণ থেকে উঠে গেল স্টোরকিপারকে ডাকতে।
স্টোরকিপার এলেন, বেঁটে গাট্টাগোট্টা চেহারা, লাফিয়ে লাফিয়ে চলেন। কথায় অসম্ভব পূর্ববাংলার টান। এই অফিসে সকলেরই মুখ চোখের চেহারা যেন কেমন কেমন। সব পোড়খাওয়া ঝানু মাল। সাপের মতো চোখের চাউনি। বড়বাবু বললেন, নিজের সিট থেকে হেঁকে, ‘বড্ড গোলমাল হচ্ছে হে।’ গোলমালে তাঁর শাসন কারুর কানে গেল বলে মনে হল না। হরেনবাবু স্টোরবাবুকে বললেন, ‘আমাদের ইন্সপেকটার এসে গেছে তুমি একটা সিট অ্যারেঞ্জমেন্ট করে ফেল।’
‘ইন্সপেকটারস রুমে সত্যেনবাবুর টেবিল খালি পড়ে আছে। তিনি ত সাসপেন্ডেড, কবে আসতে পারবেন কেউ জনে না, ওইখানেই বসিয়ে দিন।’
‘ওটা ত অপয়া চেয়ার হে, যে বসে সেই ফেঁসে যায়।’
‘অসাবধান হলেই ফাঁসবে। সাবধানে চোখ খুলে কাজ করলে কি আর হবে। দুর্গা বলে বসে পড়লে বলুন। সমঝে দিন চুরি বিদ্যে বড় বিদ্যে যদি না পড়ে ধরা।’
স্টোরকিপার লাফাতে লাফাতে চলে গেলেন। হরেনবাবু বললেন, ‘শালা চোর।’
হরেনবাবুর পেছনে যিনি বসেছিলেন, তিনি বললেন, ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।’
ভদ্রলোকের গলায় একটি তুলসীর মালা। হাতে একটা পকেট—বুক—সাইজের বই। মলাটে রথের ছবি। রথে খাড়া হয়ে যিনি লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি সেই সারথি শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কেউ নন। আসনে অধোবদনে যিনি বসে আছেন তিনি অবশ্যই অর্জুন। গীতা পড়ছেন, তাই বোধহয় এত সাহস। শ্রীকৃষ্ণের কাছে যিনি আত্মসমর্পণ করেছেন, তিনি ত অধর্ম আর অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেনই। হরেনবাবু বললেন, ‘যা করছেন তাই করুন। বেশি বাড়াবাড়ি করলে বিপদে পড়বেন।’
‘লাস্ট টেন ইয়ারস ধরে ওই একই কথা শুনে আসছি। আর একটা বছর আছে। কারুর পরোয়া করি না।’
‘পেনশন আটকে যাবে। তখন ঠেলার নাম বাবাজীবন।’
‘ও অ্যামনেও আটকাবে অমনেও আটকাবে। তোমাদের ব্যবস্থায় কে আর কবে বেঁচে থাকতে থাকতে পেনশন পেয়েছে।’
হরেনবাবু আমার পিঠে চাপড় মেরে বললেন, ‘উঠে পড় ব্রাদার। চলো তোমাকে বসিয়ে দিয়ে আসি।’ অফিস বেশ ভরে উঠেছে। মহিলার সংখ্যাও কম নয়। হলঘরের এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো কোনও ছিরিছাঁদ নেই। কত ভালোভাবে সাজানো যেত। সে সব চেষ্টার বালাই নেই। হট্টমন্দিরে অজস্র কাক যেন পাখা ঝাপটাচ্ছে আর খা খা করছে।
ঘরের বাইরে এসে হরেনবাবু বললেন, ‘সুযোগ আসুক এমন ঝাড়ব!’
‘কাকে?’
‘ওই গীতাভণ্ডকে। সারা জীবন গীতা পড়েই কাটিয়ে দিলে। ব্যাচেলার লোক ত, কোনো দায়দায়িত্ব নেই, থাকার মধ্যে ট্যাঁকট্যাঁক কথা। কবে কোন আমলে স্বদেশি করত সেই সুবাদেই চাকরি। মৌমাছির মতো চোখ। সারাদিন কে কী করছে চোখে চোখে রেখেছে। ব্যাটা যেন আমাদের মর্যাল গার্জেন।’
‘খুব ইনফ্লুয়েনসিয়াল, কি বলেন?’
‘এক সময় ছিল তাই। ধীরে ধীরে কমছে। একে একে খুঁটিরা সব বিদায় নিচ্ছে, এখন ওপর মহলে যে দু—চারজন আছে তাদেরও দিন ফুরিয়ে এসেছে। গেলেই ব্যাটা মরুভূমিতে জলের কষ্টে মরবে।’
করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা মাঝারি আকারের আর একটা ঘরের সামনে চলে এসেছি। ঢোকার দরজার মাথায় সাদা হরফে ইংরেজিতে লেখা সতেরো। রুম নাম্বার সেভেনটিন। এ ঘরের চেহারা সামান্য অন্যরকম। ওরই মধ্যে একটু ছিমছাম। লোকজন কম। টেবিল চেয়ার প্রায় নতুন। রেকসিনের টেবিল টপ।
একটা খালি টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হরেনবাবু বললেন, ‘এই হল তোমার আসন। টেবিলের মাথাটা তোমার, ড্রয়ারে সত্যেনের মাল। চাবি নিয়ে বাড়িতে বসে আছে সাসপেন্ড হয়ে। এখন এইতেই কাজ চালাও। নতুন টেবিল এলে পাবে। কবে আসবে। জানি না, বাট উইল কাম।’
জানালার দিকে বসে থাকা জনৈক স্বাস্থ্যবান যুবক হাঁক পাড়লেন ‘হরেনদা!’
‘হই।’ হরেনবাবু উত্তর দেবার ধরনটি বেশ।
‘কথা আছে।’
‘থামো আসছি।’
চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর কনুই রেখে বোকা বোকা মুখে সারা ঘরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। মনে হল এই এস্ট্যাবলিশমেন্ট আমাকে কুমিরের মতো একটু একটু করে গ্রাস করতে শুরু করেছে। একটা অদৃশ্য শেকল আমাকে বেঁধে ফেলেছে। এই সব মানুষ, এই পরিবেশ, এঁরাই দেশ চালাচ্ছেন, এঁদের হাতেই আমাদের জন্ম—মৃত্যু। ঘণ্টার শব্দে চেতনা ফিরে এল। স্যুট পরা এক ভদ্রলোক ঘাড় কাত করে বেড়ালের থাবা মেরে মেরে ইঁদুর শিকারের মতো ক্রমান্বয়ে টেবিলঘণ্টি বাজিয়ে চলছেন। ষোলো মাত্রার তালে। সব ফাঁক লয় সবই নির্ভুল। ঘণ্টা তিন চরণ বেজে থামল। ভদ্রলোক বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। মুখে একটা রাগ রাগ ভাব। নীচু হয়ে ড্রয়ারের শেষ তাক থেকে একটা কাচের গেলাস বের করে টেবিলে রাখতেই একটা অসুস্থ আরশোলা বেরিয়ে এসে ঘাড় কাত করে গেলাসের মালিককে শুঁড় নেড়ে নেড়ে গেলাসে সারা রাত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার জন্যে কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগল। মালিকের মেজাজ খারাপ, তার ওপর পৃথিবীর আদিতম প্রাণীটিকে ভয়ও প্রবল। একলাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে ভীষণ এক চিৎকার, ‘রাসকেল, দি ডেভিল, ইউ আর ইন মাই গেলাস। হরেনদা। হরেনদা।’ আরশোলাটা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে টেবিলের ধার বেয়ে মেঝেতে পড়ে একপাশে কান্নিক মেরে বেরসিক মানুষটির কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচল।
হরেনদা কথা বলছিলেন অন্য আর একজনের সঙ্গে। নিশ্চয়ই খুব প্রয়োজনীয় কথা, মুখের ভাব অসম্ভব গম্ভীর। ভাব অনুযায়ী গলায় উত্তর দিলেন, ‘কি বলছ ব্রাদার?’
‘ইজ দিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন? বেল বাজালে বেয়ারা আসে না। গেলাসে আরশোলা। ডু সামথিং।’
‘আমাদের গেলাসে আরশোলা ছাড়া আর কি থাকবে ব্রাদার। তুমি কি বিলিতি আশা কর।’
‘কিছু স্প্রে করার ব্যবস্থা ত করা যায়?’
‘কটা মারবে ব্রাদার? লাখ লাখ আছে। ও নিয়ে উত্তেজিত হয়ো না।’
‘অ্যান্ড হোয়ার ইজ দি পিয়ন?’
‘দ্যাখো বোধহয় সি এল নিয়ে বসে আছে।’
‘থার্ড ক্লাস।’
ভদ্রলোক গেলাসে হাতে ঘরের বাইরে গটগট করে চলে গেলেন। ঘরে একটা হাসির রোল উঠল। হরেনবাবু বললেন, ‘এই সব সায়েবদেরই মহাজ্বালা। বসা উচিত ছিল চেম্বারে এ ক্লাস অফিসার হয়ে।’
জল নিয়ে ফিরলেন তিনি। মুখে কেমন একটা অমসৃণ ভাব।
‘এই যে মিস্টার সিনহা, জল পেলেন।’
সিনহা সাহেব বক্তার দিকে রাগ রাগ মুখে তাকিয়ে বললেন, ‘কল্যাণ সিরিয়াস ব্যাপারে অত লাইট না হওয়াই ভালো। ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে।’
‘তা ঠিক, তবে কিছু গোবর গোবরই থেকে যায়, ঘুঁটে হবার সুযোগই পায় না।’
উত্তেজনা থিতিয়ে এল। জল চলে গেল সিনহা সায়েবের সিসটেমে। গেলাস ঢুকে গেল ড্রয়ারে। একটা ব্যাপার বোঝা গেল, এখানে ঘণ্টা বাজিয়ে কল্পনায় নিজেকে দুখণ্ড করতে হয়, একটা সায়েব খণ্ড যিনি হুকুম করার জন্যে বেল বাজাচ্ছেন, আর একটি আর্দালি খণ্ড, যিনি গেলাস বের করে জল নিয়ে আসছেন, দুয়ে মিলে এক। সেই গানে আছে না, শ্যাম শ্যামা একই সঙ্গে। মনে মনে হাসতে ইচ্ছে করছে, এঁরা সায়েব হবেন ভেবেই, রিয়েল সায়েবরা পালিয়ে বেঁচেছেন।
দরজার সামনে থেকে যেন নকিব হাঁকছে, ‘সিনহা সাহেব মিত্তির সায়েব ডাকছেন।’
‘এই যে আবদুল, আবদুল।’ তিন চারজন কোরাসে সেই পলাতক খাঁকির পোশাকপরা মানুষটিকে ধরার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। দ্বারপথে দাড়িশোভিত সেই মুখ যাত্রার নিয়তির মতো উঁকি দিল আবার। পুরো দেহটি দৃশ্যমান নয়। দূর থেকে দেখা দিয়ে যাই, ধরা নাহি দিতে চাই। ডজনখানেক বিভিন্ন মাপের, বিভিন্ন স্বভাবের মানুষ এখুনি গ্রোসখানেক আবদার নিয়ে ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এখন অবশ্য একটাই আবদার, ‘তুমি যাবার পথে গোবিন্দবাবুকে চা দিতে বলে যাবে?’
‘যাব।’ কাঠখোট্টা উত্তর। ইওর ওবিডিয়েন্ট সারভেন্ট দরখাস্তেই লেখা হয়, এখানে কোনো মিয়াই কারুর ওবিডিয়েন্ট বলে মনে হচ্ছে না। জুতোর হিলের খটাখট শব্দ তুলে সিনহা সায়েব মিত্তির সায়েবের তলবে চলে গেলেন। তার মানে এখানে আরও একদল সায়েব আছেন। এ যেন সোলার সিসটেম, সেন্টারে সূর্য, অরবিটে, অরবিটে ছোট বড় গ্রহ, গ্রহের উপগ্রহ। বাইরের মানুষেরা বলেন বিগ্রহ। সিংহাসনে শালগ্রাম। যাঁদের ওঠাও যা বসাও তা।
সিনহা চলে যেতেই ঘরে গুঞ্জন উঠল, ‘শ্যালক গেলেন ভগিনীপতি সকাশে।’
‘যেদ্দাও।’
‘ডেভালাপমেন্টে একটা পোস্ট খালি হয়েছে রে ভাই।’
‘সে পোস্ট সিনহার। বড়দিনে ইন ল’কে ভেট দিয়ে, ইন ল’র বোনের ফেভারিট হবার চেষ্টা।’
‘কি করে ইন ল’ হওয়া যায়।’
‘কোন ল?’ দেয়ার আর সেভারেল টাইপস অফ ল’জ। প্রথমে ফাদার ইন ল’, তারপর ব্রাদার ইন ল’, তারপর সান ইন ল’। ইন ল’দের ক্লোজড সার্কিট।’
‘এখানে সবরকমের ল’ই আছে। কেউ ফাদার ইন ল’কে ধরে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে, কেউ ব্রাদার ইন ল’কে ধরে লড়ে যাচ্ছে। আমরা এখন কাকে ধরি?’
‘ভাগ্যকে ধর ভাই।’
এই কথাটি যিনি বললেন, তাঁর চুল শ্রী অরবিন্দের মতো। গৌর বর্ণ। চোখ টানাটানা যেন সুরমা পরেছেন। গায়ে গেরুয়া পাঞ্জাবি। চেয়ারের পেছনে একটি চাদর পাট করা।
চা এসে গেল। আমি নতুন একটি প্রাণী। একপাশে বসে আছি হাঁদা গঙ্গারাম হয়ে। কী ধরনের কাজ আমাকে করতে হবে তাও জানি না। এতক্ষণ ধরে যা দেখলুম আর যা শুনলুম তাতে মনে হচ্ছে জীবিকা উপার্জনের এই ক্ষেত্রটিতে আর সার্কাসে খুব একটা তফাত নেই। ট্রাপিজের খেলা। রোপ ওয়াকিং। মগজ নয়, কসরতের কেরামতি।
চা বালককে কল্যাণবাবু বললেন, ‘ওইখানে একটা চা দাও।’ ওইখানে মানে আমাকে। বেশ অভিভূত হয়ে পড়ার মতোই ব্যাপার। হরেনদার ব্রাদার সম্বোধন আর এই চা দেওয়ার আদেশ এ ছাড়া এমন কিছুই চোখে পড়ল না যাতে মনে হতে পারে আমরা পরস্পরের আপন জন একটা লাজুক লাজুক ভাই মুখের বিব্রত ভাবের সঙ্গে মিশে বোধ হয় নববধূর মুখচ্ছবি কল্যাণবাবুর চোখের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। নিজের চায়ের কাপটা নিয়ে আমার টেবিলে এসে বসলেন। খুব স্মার্ট। অমনটি হতে আমার বহু সময় লাগবে। বেশ ভালো স্বাস্থ্য, বড়লোকের আদুরে ছেলের মতো। মৃদু মৃদু হাসি মুখে।
‘লজ্জা কীসের। চা খাও, চা খাও।’ একটু সুর করে কথা বলেন। অনেক সময় ব্যঙ্গ বলে মনে হতে পারে। প্যান্টের পকেট থেকে ছোট একটা শিশি বেরোল। এতটুকু একটা সাদা গোল বড়ি চায়ের কাপে ফেলে দিলেন। ডায়াবিটিস আছে না কি! এত কম বয়সেই সুগার?
‘কী করা হয়?’
প্রশ্নটা যেন কেমন। উত্তরে বলতে হয়, চাকরি। তাই বললুম।
‘আরে না। চাকরি ত করতে এলে। কত দূর গেছ? মানে বিদ্যে কতদূর?’
‘শেষ পর্যন্ত।’
‘সায়েনস না প্ল্যানটেন?’
‘প্ল্যানটেন মানে?’
‘বাংলা কর।’
‘কলা। না প্ল্যানটেন নয়।’
‘আমি জুট টেকনলজি করে এখানে পচে মরছি। এ জায়গাটা হল টাওয়ার অফ সাইলেনসের মতো। কবর না দিয়ে আমাদের মতো মড়াদের ফেলে রাখা হয়েছে। সারাদিন শকুনিরা এসে খাবলে খুবলে খেয়ে চলেছে। বিদ্যে বুদ্ধি সব পলাতক। যে যতবড় শয়তান সে তত বড় এফিসিয়েন্ট।’
কল্যাণদা হতাশার ওপর আর এক পোঁচ হতাশার ব্রাশ টেনে নিজের আসনে গিয়ে বসলেন। যাবার আগে আমাকে একটা লবঙ্গ দিয়ে গেছেন। ভদ্রলোকের পকেটে আর পোর্টফোলিওতে একটা সাজান সংসার ঘুরছে। সঙ্গে একটি মিলিটারি ওয়াটার বটল। অফিসের জলে লক্ষ লক্ষ রোগজীবাণু। ক্লোরিন ট্যাবলেট দেওয়া জল খেয়ে পেট সামলাচ্ছেন।
হরেনদা ছেঁড়া ছেঁড়া দুটি স্বাস্থ্যবান ফাইল বগলে ঘরে ঢুকলেন, ‘এই নাও ব্রাদার।’ ব্রাদারের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। এ ত মানবের কাজ হতে পারে না। ডোমেরই কাজ, পোস্টমর্টেম। দলিত, গলিত শব। নাকে রুমাল বাঁধতে হবে। ফাইলের সঙ্গে একটা মোটা খাতা। সঙ্গে আরও একটি লেজুড়, লাল নীল পেনসিল।
‘এই ফাইল দুটোয় হাজার খানেক চিঠি আছে। সরকারি চিঠির ওপর লালে, বেসরকারির ওপর নীলে সিরিয়্যাল নম্বর লাগাও, এক দুই তিন চার। এই খাতাটা হল ডায়েরি। ডায়েরিতে এনট্রি কর। সিরিয়্যাল নম্বর, চিঠি কে লিখছে, কাকে লিখেছে, চিঠির নম্বর, তারিখ, সাবজেক্ট। চিঠি পড়লেই সাবজেক্ট বুঝতে পারবে। নাও দুর্গা বলে লেগে পড়। দেড়টা থেকে দুটো টিফিন। ছুটি পাঁচটায়।’
হরেনদা হড় হড় করে ইনস্ট্রাকশান ছেড়ে চলে গেলেন। তা হলে এই হল আমার কাজ। এরই জন্যে ডিফারেনসিয়্যাল ক্যালকুলাস, ইনটেগরাল ক্যালকুলাস, ট্রিগনমেট্রি, কনিকস, এরই জন্যে শিখেছিলুম গ্লুকোজের ফর্মুলা, বেনজিনের স্ট্রাকচার। বড়বাবু হল ঘরে বসে বসে পান চিবোচ্ছেন। একদিকে ওজন—দাঁড়িতে চিঠি ওজন হচ্ছে, আর একদিকে গীতাপাঠ। প্রবীণ মানুষ ঠিকই বলেছিলেন, ফুল মেনি এ ফ্লাওয়ার ব্লাশ আনসিন। আমি ফ্লাওয়ার কিনা জানি না, তবে এফ এল ও ইউ আর হতে পারি। জন্মাবার পর থেকেই ময়দার মতোই ঠাসাই হচ্ছি ময়ান সহযোগে। ফুল তো বটেই। এফ ডবলও এল।
আমার অসহায় অবস্থা দেখে কল্যাণদা বললেন, ‘কি, হরেন হাতল ধরিয়ে দিয়েছে ত! এও এক ধরনের র্যাগিং। ওসব চোতা আসলে গ্যাঞ্জেস ডিসপোজালের। যেমন দিয়ে গেছে ঠিক তেমনই ফেলে রাখ। ফাইল আরও মোটা হোক। যাদের আর্জি তাদের বয়েস বাড়তে বাড়তে টেঁসে যাক। ভূত হয়ে এই অফিসের কার্নিসে পা ঝুলিয়ে কিছু দিন বসে থাকুক। তারপর কেউ না কেউ গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে এদের উদ্ধার করে দেবে।’
এটা যদি অকাজ হয়, তা হলে আসল কাজটা কী! ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে জানার। কল্যাণদা বলতে পারবেন প্রকৃত সহজ কাজ হে। পাকা ঘুঁটি কাঁচা করা। দেশের মানুষ যে যেখানে করে কম্মে খাচ্ছেন তাদের আছোলা বাঁশ দেওয়াই হল আমাদের কাজ আর একটা কাজ হল ইম্যাজিনারি প্ল্যানিং। কলমবাজি। চেয়ারে সবে চোখ বোজায়। মনে মনে দেশটাকে ভেবে নাও। তারপর লিখে যাও এই করলে ওই হয়, ওই করলে এই হয়। তাড়া তাড়া টাইপ করা কাগজ লাল ফিতে দিয়ে বেঁধে গাড্ডায় ফেলে দাও। কি, ঠিক বলেছি কিনা প্রভাতবাবু!’
ও, দাড়িঅলা ভদ্রলাকের নাম তাহলে প্রভাতবাবু। এই ঘরের এক ঋষি। যেন পথ ভোলা এক পথিক এসেছি। মুখে স্বর্গীয় হাসি। নিমীলিত নয়ন। পৃথিবীর বহু দূরে এক নভোচর। গলাটি বেশ ভরাট।
‘ঠিকই বলেছ কল্যাণ। তবে ছোকরাটিকে ট্রেনিং যখন দিচ্ছ একটু ভালো করেই দাও। অভিমন্যুর মতো করে দিও না। ব্যুহ ভেদ করার কৌশল যেমন শেখালে ব্যুহ ভেঙে বেরিয়ে আসার কৌশলটিও তেমনি শেখাও। নয়তো বেচারাকে সপ্তরথীতে মেরে ফেলবে। তোমার ত অনেক অভিজ্ঞতাই হয়েছে কল্যাণ। ছোকরার নামটি কী?’
‘আজ্ঞে মানব।’
‘বাঃ, তুমি ত রিফাইনড জেন্টলম্যান হে। মোলায়েম কথাবার্তা। শুরু কর আজ্ঞে দিয়ে। এ ত সেই সাহেব কালের গৃহ ভৃত্যদের মতো। আমাদের মতো ভৃত্যদের প্রথমেই হতে হবে থ্রি আর। থ্রি—আর জান কল্যাণ!’
হ্যাঁ, আগেও একবার আপনি বলেছেন, আমাদের, রাফ, রাফিয়ান, রোগ।’
‘দ্যাটস রাইট। সব সময় রুক্ষ, সমস্ত ম্যানারস ভুলে যাও। বি এ দামড়া। অ্যাজ দামড়া, অ্যাজ এ স্ট্রিট বুল। রাফিয়ান, এ ব্রুট্যাল ক্রুয়্যাল ফেলো। দয়া, মায়া, মমতা। থ্রো দেম ইন দ্যাট ফ্লোয়িং গ্যাঞ্জেস। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। রুবল ওয়াকিং। নুড়ি ফেলা পথের ওপর দিয়ে মশ মশ হেঁটে যাও। অলওয়েজ রিমেমবার হয় মারবে না হয় মরবে। কিল অর বি কিল্ড। নিজেকে বাঁচাবার জন্যে সব সময় সহকর্মীদের উৎসর্গ করে দেবে। এমন সব ঘটনা কর্মজীবনে প্রায়ই ঘটবে। তখন কী করতে হবে, এ চোখ কান বুজিয়ে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে। ট্রাই টু লার্ন দ্যাট আর্ট। একটা স্কেপগোট ফাইলে বেঁধে রেখে ঘাস খাবে। বি এ রোগ। বি এ স্কাউনড্রেল, এ মিসচিভাস পার্সন। সব সময় মনে রাখবে, তুমি অন্যের ক্ষতি করার জন্যে জন্মেছ। ইউ আর এ রোগ এলিফ্যান্ট। স্বপ্নেও কারুর উপকার করবে না। মনে মনে প্ল্যান ভাঁজবে কীভাবে কত বেশি লোকের অপকার করা যায়। এদিকে চালাবে ফাইভ ইয়ার প্ল্যান ওদিকে চালাবে ডেসট্রাকটিভ প্ল্যান। কখনও ভুলেও ভাববে না, দেশটা তোমার। দেশটা ভূতের। যেখানে যা কিছু হচ্ছে সবই ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ।’
কল্যাণদা বললেন, ‘আজ আপনি খুব রেগে আছেন।’
‘রাগ? রাগ নয় কল্যাণ, অক্ষমতার জ্বালা। বাঙালির রাগ বউয়ের ওপর। রাগতে পারলে ত রেভলিউশান হয়ে যেত। লাস্ট টোয়েন্টি ইয়ারস এই অফিসে বসে বসে আমি কী করেছি? স্রেফ ঝিমিয়েছি। এক একটা রেজিম এসেছে আর গেছে। ঘুম ঘুম চোখে দেখেছি আর চেয়ারে পাশ ফিরে বসেছি। ইংরেজির ফার্স্ট ক্লাস, গোল্ট মেডালিস্ট, প্রেসিডেনসির ব্লু বয়। আমাকে আনা হয়েছিল এই দপ্তর থেকে একটা বুলেটিন বের করার জন্যে। আজও তা বেরোল না। প্রোপোজালস আফটার প্রোপোজাল। কর্তৃপক্ষ হ্যাঁও বলে না, নাও বলে না। স্টেলমেট, রেড টেপ। আসি চেয়ারে বসি, বাড়ি যাই। গত বিশ বছরে আই হ্যাভ টার্নড ইনটু এ ফসিল। বুঝলে ইয়ংম্যান, দিস ইজ এ শানটিং গ্রাউন্ড। থ্রি—আর হয়ে বাঁ হাতে কামাই কর আর ম্যাকসিমাম লোককে বাম্বু দিয়ে যাও। তুমি জান এখানে একটু ছুটি স্যাংশন করাতেও ঘুস দিতে হয়। বাট আই টেল ইউ ওয়ান থিং, সাপের ন্যাজে পা দিও না। প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী লোকের আবদার ন্যায় হোক অন্যায় হোক সঙ্গে সঙ্গে তামিল করবে। তা না হলেই হবে নেগলিজেন্স অফ ডিউটি, চার্জসিট, সাসপেনসান কিংবা ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে ট্রান্সফার। এখনও চোখের সামনে বৃদ্ধ প্রমথ সোমের কেস ভাসছে।’
কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেললুম, ‘সে কেসটা কী?’
‘প্রমথ আমাদের হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। সাদামাটা ভালো মানুষ। ওপর মহলের খুব জানাশোনা একজনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফাইলে চাপা পড়েছিল। দোষ প্রমথর নয়, দোষ ডিলিং অ্যাসিটেন্টের। তারই নেগলিজেনস। সে কেন প্রমথর নোটিশে আনেনি। ওপর মহল ব্যাপারটার অন্য ব্যাখ্যা করলেন। তাঁরা বললেন, প্রমথ রেজিম মানছে না। বিরোধী দলের দিকে ঝুঁকে কেসটাকে চেপে রেখেছিল। সাব্বার্সিভ অ্যাকটিভিটি। ডিলিং অ্যাসিসট্যান্টের রাগ ছিল প্রমথর ওপর। কারণ প্রমথ ওল্ড ভ্যালুজকে সাপোর্ট করত। রিটায়ার করতে দু বছর মাত্র বাকি ছিল। ফোর্সড রিটায়ারমেন্টের অর্ডার হল। প্রমথ মাথা নীচু করে বাড়ি চলে গেল। মাথায় মাথায় তিনটি মেয়ে, বিয়ে হয়নি। ছেলেটার তখনও এডুকেশন বাকি। প্রমথ বাস্তবকে ফেস করতে চলে গেল। আমরা হাঁ করে বসে রইলুম, সেটানের দল। প্রতিবাদ নেই, বিক্ষোভ নেই। প্রমথ এখন কোথায় কে জানে। অনেস্ট সোল ডিজঅনেস্টির ফাঁদে পড়ে ফেঁসে গেল। তবে হ্যাঁ, হি হ্যাড গাটস। মাথা নোয়াননি। হাঁটু গেড়ে বসে পায়ে ধরেনি। ব্রেভ ওল্ড ম্যান হাসতে হাসতে চলে গেছে, কাম হোয়াট মে। তাই বলছি, রাম শ্যাম টম ডিক হ্যারি চুলোয় যাক, কচুকাটা কর, কেউ দেখতে আসবে না। বি কেয়ারফুল অ্যাবাউট ভিপস। আমরা হলুম দেশের থ্রি পার্সেন্ট তালেবর লোকের সেবা দা। এনাফ ফর দি ডে। যাও কাজে বসো। আমার একটু বেভারি শুরু হোক। বসে বসে ঝিমোই।’
টিফিনে গোবিন্দবাবুর ক্যানটিনে একটা ওমলেট আর দুটো টোস্ট খেয়ে দিবসের দ্বিতীয় যামের ধসটামো শুরু হল। এক একজনের এক একরকম টিফিন। মাইনের সামান্য উনিশ—বিশ কিন্তু টিফিনের সব আকাশ জমিন ফারাক। কারুর রাজকীয়, কারুর প্রজাকীয়, কারুর একেবারে হরিমটর। কারুর টিফিন কৌটো থেকে ছানা বেরোচ্ছে, ডিম বেরোচ্ছে, লাল আপেল আঙুরও আছে। শরীর নিয়ে মধ্যবিত্তের কি সাংঘাতিক মাথাব্যথা। হরেনদার ক্ষয়িষ্ণু শরীর, তাই আয়োজনও প্রচুর। রাধাবল্লভী, নলেন গুড়ের সন্দেশ, ক্ষীরের শিঙাড়া। পাশেই বসে আছে তাঁর সহকর্মী। সব চুল পেকে শনের মতো। গায়ে ইস্তিরি না করা ময়লা ময়লা জামা। হরেনদা বাঘের মতো গপাগপ খাচ্ছেন, ভদ্রলোক উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। চিল উড়ছে হাওড়ার ব্রিজের মাথার ওপর। শেষ শরতের মেঘ ভাসছে নীল আকাশে। ঘরে ঢুকে দৃশ্যটা দেখে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কি সোস্যালিজমই চলছে দেশে! উদাস মানুষটির সঙ্গে ভীষণ আলাপ করতে ইচ্ছে হল। নিঃসঙ্গ, দুঃখী মানুষদের যেন ভগবানের মতো দেখতে হয়।
ভদ্রলোকের নাম অমূল্যবাবু। পাশের চেয়ারটা খালি ছিল। বললেন, ‘বোসো।’
বসলুম। অমূল্যদর সামনে হাত সাতেক দূরে একজন মহিলা টাইপিস্ট বেঁকে বসে আছেন। বয়েস কম। চাপা ফুল রঙের শাড়ি। ফর্সা রং। চনমনে ভাব। তীক্ষ্ন দুটো খঞ্জন পাখির মতো চোখ। ধনুকের মতো ভুরু। আশা, আশা বলে কেউ ডাকলেই ডাইনে বায়ে চোখ নাচিয়ে ডাকিয়েদের ঠান্ডা করে দিচ্ছেন। পিঠের ওপর বিনুনি লটকে আছে। ফিতের ফুলবাধা। অমূল্যদা উদাস বৃদ্ধ তাই তার দৃষ্টি আকাশে উড়ে গেছে। আমার চোখ কিন্তু বার কতক ঠোক্কর খেল এবং প্রতিবারই ধরা পড়ে গেলুম। চোখে হাসি। আশা যেন বলতে চাইছেন, ছোকরা এইটাই আশা করেছিলুম।
অমূল্যদা বললেন, ‘আজ জয়েন করলে বুঝি।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘মন দিয়ে কাজ কর। ওপরে উঠতে হবে। এলে এলে আর একটু ওপর দিকে একেবারে অফিসার হয়ে এলে না কেন? নীচে থেকে ওপর দিকে ওঠা বড় শক্ত। উঠলেও কেউ মানতে চায় না। গায়ে নীচ—গন্ধ লেগে থাকে। ওই আমাদের বরেনের মতো। ক্লার্ক থেকে অফিসার হল। কিন্তু জাত অফিসাররা দলে নেয় না। ইংরেজরা দেশ থেকে এখনও যায়নি। ভূত হয়ে ঘাড়ে চেপে বসে আছে।’
হরেনদা হেউ করে একটা ঢেঁকুর তুললেন। চা বালক সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। অমূল্যদা বললেন, ‘চা খাবে?’
‘খেতে পারি যদি আমাকে খাওয়াতে দেন।’
‘তা কি হয়। আমি তোমার চেয়ে অনেক বড়। তুমি আমার ছেলের বয়সি। আমার ময়লা জামা দেখে তুমি বোধহয় আমার আর্থিক অবস্থা আঁচ করে নিয়েছ। আরে টুইল আর মটকা সব বাইরের, বাহ্য, বাহ্য, ভেতরে কার কী আছে কে জানে?’
বেফাঁস বলে বড় লজ্জা পেয়ে গেলুম, ‘আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি কিন্তু সেভাবে বলিনি। হ্যাঁ চা খাব।’
অমূল্যদা ছেলেটিকে চা দিতে বলে, বললেন, ‘সৎপথে থাকতে হলে মানুষ একটু অভাবীই হয় বাবা। রোগে না ধরলে ভোগ হয় না। অভাবের আগুনে মানুষ বড় শুদ্ধ হয়। তোমার মুখটি এখনও বড় সৎ আছে। সাবধানে থেকো। হাওয়া বইছে এলোমেলো। কুবাতাসে পাল তুলো না। বয়স অনেক হল। অনেক দেখলুম। শেষকালে হেসে হেসে যদি জগৎকে সেলাম জানাতে চাও তা হলে একটু কষ্টে থেকো।’
এতক্ষণ ধরে একদল সিনিক মানুষ আমাকে এক ছায়া ছায়া ভীষণ জগতে নিয়ে ফেলেছিলেন। এই মানুষটির কাছে এসে যেন একটু বল পেলুম। এত বল যে একবারও আশার দিকে তাকাইনি। এঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজের পিতাকে যেন দেখতে পাচ্ছিলুম। আমাদের পুরোনো বাড়ির বারান্দায় পায়চারি করতে করতে এই সব কথা বলতেন। বলতেন, লেট নট অ্যামবিশান মক দাই ইউজফুল টয়েল। বলতেন, ভোগ একপ্রকার রোগ বিশেষ। হরেনদা হঠাৎ বললেন, ‘আরে ব্রাদার তুমি এখানে বসে গল্প করছ, ওদিকে তোমার কাজ পড়ে আছে।’
ভেতরটা দপ করে জ্বলে উঠল। বড় দাস ছোট দাসের ওপর খবরদারি করছে। অমূল্যদা মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। চোখের ইশারায় বোধহয় এই কথাই বোঝাতে চাইলেন, উত্তেজিত হোয়ো না। জগতে অন্নদাস মানুষকে এইভাবে এ হাতে ও হাতে তাড়া খেতে হবে। এই লোকটি তোমার প্রভু নয়। এও একটি দাস। তাই দাসের মতোই মনোবৃত্তি।
নিজের আসনে ফিরে এলুম। তাড়া বাঁধা কাগজের স্তূপ অসংখ্য মানুষের ভাগ্যের মর্গ হয়ে টেবিলের দু পাশে জরদ্গবের মতো পড়ে আছে। শীত আসব আসব করছে। পাখা কিন্তু এখনও পুরোদমেই চলছে। কলকাতার মানুষ ভরা শীতেও লেপ মুড়ি দিয়ে পাখার বাতাস খান। শীত না এলেও বেলা ছোট হয়ে এসেছে। নীচের দিকে ছায়া নেমেছে, উঁচু উঁচু বাড়ির মাথায় মরা মরা রোদ। মন ভারী হয়ে আসছে। ঘর প্রায় খালি। শূন্য চেয়ার। খাওয়া সিগারেটের টুকরো। কে যে কোথায় চলে গছেন, কীসের ধান্দায়। পাট করা চাদর কাঁধে ফেলে প্রভাতদাও চলে গেলেন, যাবার সময় বলে গেলেন, ‘যাই হে, কমার্শিয়াল লাইব্রেরিতে গিয়ে একটু পড়াশোনা করি।’
মধ্যরাতে মানুষের যেমন আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে, এই বিষণ্ণ নির্জন ঘরে বসে আমারও তেমনি একটা ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠল। ধ্যার, এ চাকরি ছেড়ে দি। সারাদিন বসে বসে চোতা লেখা। আর একবার নেমে পড়ি রাস্তায়। নিজেকে নিলামে তুলি। দেখি কোনও ভালো বিডার জোটে কি না। এখানে থাকলে মরে যাব। আঁস্তাকুড়ের বেড়ালের মতো ময়লা খুঁটে আহার্য সংগ্রহ।
জয়নিং রিপোর্টের উলটোটাই ত রেজিগনেশান। দুটো চারটে শব্দের এদিক ওদিক। একটুকরো কাগজ টেনে নিয়ে লিখলুম, আই, শ্রীমানব মুখার্জি টেন্ডার মাই রেজিগনেশান ইন দি আফটারনুন অফ…। ফোর নুনে জয়েন করে আফটারনুনে রেজিগনেশান। ইতিহাস তৈরি হবে। ছেড়েই যখন দেব তখন ডাঁটে ছাড়াই ভালো। আর বড়বাবু, হরেনবাবু নয় সোজা সেই ব্যানার্জি সায়েবের নাকের ডগায় কাগজটা ছুঁড়ে দিয়ে গুডবাই। এরা যা মাইনে দেবে এসপ্ল্যানেডের ফুটপাতে বসে গামছা বেচলে তার চেয়ে বেশি রোজগার হবে। বরং মর্যালটা ঠিক থাকবে। সকলের সামনে মাথা উঁচু করে চলা যাবে। কেউ বলতে পারবে না, ব্যাটা করাপট, ফাঁকিবাজ, ঘুষখোর।
যে দিকটায় কেরানিবাবুরা বসেন তার উলটোদিকে সারি সারি ঘর সায়েবদের। এর নাম চেম্বার। নামের ফলক ঝুলছে। ইংরাজিতে লেখা। নাম ডেজিগনেশান। চেম্বারের বাইরে টুলে টুলে একজন করে পিয়ন। এদের বলা হয় অর্ডারলি। সাধারণ সকলের ফাইফরমাস খাটা পিয়ন নন।
সায়েবদের খোদ পিয়ন। সায়েব ছাড়া কারুর হুকুম মানবেন না। সায়েব টুরে গেলে সঙ্গে সঙ্গে থাকবেন। অফিসে এসে সকালবেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিড়ি খাবেন। গাড়ি থেকে সায়েবকে খালাস করা দিয়ে দিন শুরু। পেছন পেছন সাদা ঝাড়নে বাধা ফাইলের বোঝা বেতের বাসকেটে কেতরে থাকা জলের বোতল আর টফির বাক্সে ছানার ডেলা, ডিমের টুকরো নিয়ে ওপরে উঠে আসবে। সায়েবের গোপন কথার ভাণ্ডারী। কেরানিবাবুরাও তোয়াজ করে চলেন। বলেন, ওহে আবদুল তোমার সায়েবের খবর কী?
ব্যানার্জি সায়েবের ঘরের বাইরে যিনি বসেছিলেন, তিনি আমাকে দেখে গম্ভীর মুখে বললেন, ‘কোথায় যাবেন, সায়েব এখন ব্যস্ত আছেন। মিটিং হচ্ছে।’
‘কখন শেষ হবে ভাই।’ ভাই বলে ফেলে ঘাবড়ে গেলুম। কি জানি, সার্ভিস কনডাকট রুল ভাঙলুম কি না। এঁদের কী বলে সম্বোধন করতে হয় এত কম সময়ে শিখে উঠতে পারিনি।
‘এখুনি শেষ হতে পারে, আবার রাত আটটা পর্যন্ত হতে পারে।’
ভীষণ ঘাবড়ে গেলুম। বেশি দেরি হলে আমার উত্তেজনা কমে যেতে পারে। মত পালটে যেতে পারে। যাক ঈশ্বর সহায়। শুনেছি গলায় যে দড়ি দেবে ভূতে তাকে দড়ি এগিয়ে দেয়। সায়েবের দরজা খুলে গেল। ডাঁসা ডাঁসা চেহারার তিন চারজন সুটেড—বুটেড মানুষ গম্ভীর মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বোকার মতো একজনের পথ আটকে ফেলেছিলুম। তিনি আমাকে বাছুর সরাবার মতো দুই হাত দিয়ে ঠেলে, একপাশে ঝেঁটিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
অর্ডারলিদা ঘটনাটা দেখে ভীষণ আঁতকে উঠলেন, ‘করেন কি দেখতে পাচ্ছে না সায়েব যাচ্ছেন। একপাশে সরে দাঁড়াতে পারেন না।’ বরাতে ভীষণ তিরস্কার জুটল নিজের ভীষণ ভীষণ বেচালের জন্য।
‘ভুল হয়ে গেছে ভাই।’ আবার ভাই। ভাইয়ে ধরেছে আমাকে দরজার মাথার ওপর কি একটা যন্ত্র ক্যাঁক ক্যাঁক করে শব্দ কর উঠল। পাশে জ্বলে উঠল একটা আলো। লোকটি স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠলেন। হাত বাড়িয়ে একটা কি ঘুরিয়ে আলো নিবিয়ে সায়েবের খাস কামরায় ঢুকে পড়লেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলুম হাঁ করে। কী করব তা হলে। ভাবতে ভাবতেই লোকটি ছিটকে বাইরে চলে এলেন। হাতে একটা ফাইল। দরজার ফাঁক দিয়ে একটা গর্জন পেছনে তাড়া করে এল, ‘ইডিয়েট, বুদ্ধ।’
বুঝতে পেরেছেন, আমি বিশেষণটা বিশেষ কানখাড়া করে শুনে ফেলেছি। তাই বোধহয় আর একবার তিরস্কার হল আমাকে, ‘দাঁড়িয়ে কেন এখানে?’
বলে ফেললুম, ‘এমনি।’
লোকটি হন হন করে করিডর ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এই হল আমার সুযোগ। সায়েব রেগে আছেন। রেগে আছেন তো কি হয়েছে। আমি তো রেজিগনেশন দিতে এসেছি। স্ট্রাইক দি আয়রটন হোয়াইট হট। দরজা ফাঁক করে ঢুকে পড়লুম। ভেতরে এলাহি ব্যাপার। কার্পেট। চকচকে বাদামি টেবল। বসে বোঁ বোঁ করে ঘোরা যায় এমন চেয়ার। এক লহমার দেখা। যতই হোক দাস—মনোভাবে ভুগছি তো। দুপুরুষ আগে আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ দাসত্ব করেনি। সবাই স্বাধীন জীবিকায় কপালে অহমিকার ফোঁটা কেটে রাজসিক মানুষের মতো এসেছেন রাজত্ব করেছেন, উত্তরাধিকারীদের রেখে চলে গেছেন। কিন্তু গত দু পুরুষের দাসত্বের বীজ রক্তে ঘুরছে। প্রভু দেখলেই ন্যাজ নেতিয়ে পড়ে পায়ের ফাঁকে। চেয়ারে যিনি বসে আছেন তাঁর রাজসিক চেহারা। লম্বা, চওড়া টকটকে গৌরবর্ণ। মাথায় কাঁচাপাকা ইনটেলেকচ্যুয়াল চুল। চোখে গেরুয়া রঙের চশমা। গায়ে তসরের বুশ শার্ট; গলা শুকিয়ে এসেছে। মিঁউ মিঁউ করে বললুম, ‘মে আই কাম ইন স্যার।’
মুখ না তুলেই জলদগম্ভীর গলায় উত্তর এল, ‘ইয়েস।’
পায়ে পায়ে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। পেছনের পার্টিশান ওয়ালে পশ্চিমবাংলার দেয়াল জোড়া ম্যাপ। দুপাশে বুক কেসে সারি সারি বই। পণ্ডিত মানুষ পড়ুয়া মানুষ। একটু হকচকিয়ে গেছি। মুখ দিয়ে কথা সরছে না। ফাইল থেকে চোখ তুলে বললেন, ‘কী চাই?’
‘আজ্ঞে আমার নাম মানব মুখার্জি। আজ সকালে চাকরি পেয়ে আপনার সেকসানে জয়েন করেছিলুম।’
‘করেছিলুম মানে? এখন আর করে নেই।’
আজ্ঞে না। এই আমার রেজিগনেশান।’
কলমটা ইঙ্কস্ট্যান্ডে গুঁজে রেখে ব্যানার্জি সাহেব আমার দিকে পুরোপুরি তাকালেন। ফাইলের ওপর দুটো হাত। আঙুলে আঙুলে জড়াজড়ি। বেশ অবাক হয়েছেন মনে হল। উজ্জ্বল চোখ। কোণ দুটো ঈষৎ লালচে। মনে হয় একটু আগের রাগ কেটে যেতে যেতে কোণের দিকে জড় হয়েছে।
‘বোসো।’ গলাটা অস্বাভাবিক গম্ভীর। কৃত্রিমে না অকৃত্রিম বলা শক্ত। সিংহনাদ।
বসে পড়লুম। তেমন আর ভয় লাগছে না। শীতকালের স্নানের মতো। প্রথমটা ভয় ভয় লাগে। জল ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে।
‘আজই জয়েন করেছ।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘আজই ছাড়ছ?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘কী কারণ?’
‘এ কাজ আমি পারব না। এ আমার কাজ নয়।’
‘কোন পোস্টে এসেছিলে?’
‘চিঠিতে লেখা আছে ইনস্পেকটার।’
‘কোয়ালিফিকেশান?’
‘সায়েন্স, কেমিস্ট্রি।’
‘আমারই লাইন। হরেন তোমাকে কী কাজ দিয়েছে।’
‘একগাদা পুরোনো, পুরোনো চিঠি দিয়ে বললেন ডায়েরি কর। সারাদিন বসে বসে করেছি। আমার আত্মদর্শন হয়ে গেছে স্যার। আমি বেকার থাকব সেও ভালো তবু দিনের পর দিন হাজার হাজার দেহি দেহি চিঠি পড়ে পড়ে খাতায় নাম, ঠিকানা, বিষয় লিখতে পারব না।’
একগাদা কথা বেশ ফিলিংসে বলে গেলুম। ভাব এসে গেছে। যে চিঠির ওপর কোনও অ্যাকশানই নেওয়া হবে না সেই চিঠি নিয়ে ছেনালিপনা। রাবিশ।
‘বাদর?’
চমকে ব্যানার্জি সাহেবের দিকে তাকালুম। কে বাঁদর? আমি। ব্যানার্জি সায়েব বললেন, ‘নট ইউ। হরেন। হি ইজ এ স্কাউনড্রেল। কল হিম।’
ব্যানার্জি সায়েব বোতাম টিপলেন জোরে জোরে। সেই অর্ডারলি পিয়ন ত্র্যস্তপদে, প্রায় তালগোল পাকিয়ে ঘরে এলেন। একটু আগে ধাঁতানি খেয়েছে। আমাকে ব্যানার্জি সায়েবের সামনে বসে থাকতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছেন। হাউমাউ করে বলে উঠলেন, ‘আমি স্যার একে স্যার আসতে দিইনি স্যার। পালিয়ে এসেছে।’
‘শাট আপ।’ এক ধমকে লোকটি ঘাবড়ে গেল। ‘হরেনবাবুকে ডেকে আন।’
‘ইয়েস স্যার।’
হরেনবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে এলেন। ‘ইয়েস স্যার।’ কণ্ঠে এত আবেগ, গলা এতই খাটো, শোনাল ‘ইয়েজার।’
‘এই ছেলেটিকে কী করেছ?’
‘আজ্ঞে না স্যার কিছু করিনি ত স্যার। অ্যায় কী করেছি তোমাকে হে।’
হরেনদার দু চোখে দু রকম দৃষ্টি। যে চোখটা ব্যানার্জি সায়েবের দিকে সেটা শূকরের মতো। যেটা আমার দিকে সেটা নরখাদকের মতো।
ব্যানার্জি সায়েব বললেন, ‘স্কাউনড্রেল। তোমার ওই পুরোনো চিঠি ডায়েরি করার জন্যে ও এখানে এসেছে। ইজ ইট ইন্সপেকটারস জব। তুমি অত চিঠি পেলে কী করে? এই অ্যাকুমুলেশান হল কী করে। হু ওয়াজ সিটিং ওভার দি লেটারস? আমি রোজ ডাক রিলিজ করছি। চিঠির ওপর সাজেসটেড অ্যাকশান লিখে দিচ্ছি। আর তোমরা! তোমরা, স্কাউনড্রেলস, বসে বসে রাধাবল্লভি আর অমৃতি খাচ্ছ জনসাধারণের পয়সায়।’
‘আজ্ঞে না স্যার, না স্যার।’
‘হোয়াট? তুমি অস্বীকার করছ। হোয়াট অ্যান অড্যাসিটি? মানব?
‘আজ্ঞে স্যার।’
আমার বেশ মজা লাগছে। খেলা বেশ জমিয়ে দিয়েছি।
‘ব্রিং দোজ লেটারস। আই উইল সি।’
দুটো গন্ধমাদন ঘাড়ে করে ফিরে এলুম। অনেকটা হনুমানের মতো অবস্থা। হরেনদার মুখ ব্লটিং পেপারের মতো হয়ে গেছে। ব্যানার্জি সায়েব চিঠির তাড়া দেখে অবাক হয়ে গেলেন। ‘সো মেনি লেটারস ফর ডিজপোজাল। আই উইল চিউ দেম আপ।’
চিঠি খুব সুস্বাদু জিনিস নয়। চিবিয়ে খেয়ে হজম হবে ত? ও, না ব্যানার্জি সাহেব চিঠি চিবোতে চাইচ্ছেন না। নিজের সেকসানকে চিবিয়ে খেতে চাইছেন।
‘হোয়াট ইজ দিস?’ একটা লালচে রঙের চিঠি হাতে কাঁপছে ‘ডক্টর দত্তর এই চিঠিটা তুমি চেপে রেখে দিয়েছ। স্কাউনড্রেল।’
‘কত টাকা চেয়েছিলে?’
হরেনদা হাত কচলে বললেন, ‘টাকা স্যার, কীসের টাকা?’
‘ঘুষ, ঘুষ। কত টাকা ঘুষ চেয়েছিলে?’
‘আজ্ঞে এক পয়সাও না।’
‘বল কী? তোমার ত হিমালয়ে যাবার সময় হয়েছে। গেরুয়া—ধারণ করে এক লাখ টাকার ইমপোর্ট লাইসেন্স কেস, হাজারখানেক তো চাইতেই হবে। রাধাবল্লভি, অমৃতি, ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবার খরচ। কোথা থেকে আসবে হরেনবাবু। হু ওয়াজ সিটিং ওভার দিস? ব্যানার্জি সায়েবের হুঙ্কারে আমরা দু জনেই চমকে উঠেছি। ঠক ঠক করে কাঁপছেন। চোখের দু কোণে সরে যাওয়া লাল আবির সারা চোখে ছড়িয়ে পড়েছে! পাশে আর একটা ঘর আছে, এই ঘরের লাগোয়া এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। সুইংডোর ঠেলে ধুতি পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক দৌড়ে এলেন। মাথাটি চকচকে করে কামান।
‘স্যার আপনার হাই ব্লাড প্রেসার। চিৎকার ইজ ডেনজারাস। মুখে নয় কাগজে কলমে অ্যাকসান নিন।
‘রাইট ইউ আর নারায়ণ। টেক ডাউন এ চার্জশিট। তার আগে তোমরা দু জনে এই সব চিঠি শর্ট আউট করে দেখ কতজন এই তাবড়ার মধ্যে পচছে।’
হরেনদা হাউমাউ করে বললেন, ‘এর জন্যে অমূল্যদা রেসপনসিবল স্যার।’
‘অমূল্যবাবু। হি ইজ এ ডেডম্যান। পাকা চাকরি আমি খাব না। এক বছর পরে সে রিটায়ার করবে। তোমার এখনও তেরো বছর বাকি। খেলে ডাসা চাকরিই খাব। নারায়ণ টেক ডাউন।’
হরেনদা হঠাৎ কাটা কলাগাছের মতো ব্যানার্জি সায়েবের পায়ের কাছে কার্পেটের ওপর ধড়াস করে বসে পড়লেন। অত বড় একটা মানুষ এইভাবে হামা দিচ্ছেন।
‘স্যার এবারকার মতো মাপ করে দিন।’ হরেনদা একবার করে পা ধরার জন্যে হাত বাড়াচ্ছেন, ব্যানার্জি সায়েব সঙ্গে সঙ্গে পা ওপর দিকে তুলে নিয়ে বলছেন, ‘ডোন্ট টাচ, ইমবেসাইল রোগ।’
এ খেলা কতক্ষণ চলত কে জানে? ঘরে ঢুকলেন সৌম্য চেহারার এক মানুষ।
‘হোয়াই ইজ দি গেম অফিসার?’
ব্যানার্জি সাহেব তড়াক করে ঘুরঘুরে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। চেয়ারটা সামনে পেছনে মেলা থেকে কেনা তুলোর দাড়ি লাগান বুড়োর মতো ঘাড় দোলাতে লাগল।
‘আসুন হরিদা, আসুন হরিদা। না কোনও গেম নয়, দ্যাট সেম ওলড টাসেল বিটুইন গুড অ্যান্ড ইভিল। ক্লিয়ার আউট।’
শেষ কথাটা হরেনদাকে। তিনি মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেলেন। ব্যানার্জি সায়েবের চেয়ারে হরিদা বসলেন। আমিও যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিলুম। কাল চাকরি রইল কি গেল জানি না।
‘মানব?’
‘ইয়েস স্যার।’
‘ইউ হ্যাভ ডান এ গ্রেট জব। আমার ঘরে ঢোকার সাহস তোমার কী করে হল?’
‘আজ্ঞে নতুন বলে স্যার, ফুলস রাশ ইন হোয়্যার এঞ্জেলস ফিয়ার।’ দুম করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
‘ইয়েস। এই সব বদমায়েশের দল ভয়ের কভার তৈরি করে যতরকমের অন্যায় সারাজীবন ধরে করে চলেছে। স্লাই ফকসেস। ভেবেছিল তুমিও এক মোরগ। আই সি ইউ আর এ টাইগার ইন দি ডিসগাইস অফ এ হেন।’
ব্যানার্জি সায়েব কোন রাস্তায় যাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। ভয় ভয় করছে আবার করছেও না। মরার বাড়া তো আর কিছু নেই। অনেক আগেই নিজেকে মেরে রেখেছি। ওই তো আমার রেজিগনেশান লেটার।
‘তুমি কোথায় থাক মানব?’
‘আজ্ঞে, উত্তরপাড়ায়।’
‘তোমার বাবা?’
‘তিনি রিটায়ার করেছেন সম্প্রতি। দিল্লিতে ছিলেন। সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েটে।’
‘কী নাম?’ প্রশ্ন করলেন হরিদা।
‘শ্রীবিভূতি মুখার্জি।’
‘বিভূতি? তুমি বিভূতির ছেলে কি আশ্চর্য?’
এতে আশ্চর্য হবার কি আছে কে জানে। আমি বিভূতিবাবুর ছেলে হতে পারি না।
‘বুঝলে অরুণ বিভূতি ইজ এ গ্রেট ম্যান। আমার জীবনে অমন অনেস্ট মানুষ আর দুটি দেখিনি। যে পোজিশানে চাকরি করত সেই পোজিশানে থাকলে যে কোনও লোকের এই কলকাতায় সাতখানা বাড়ি হয়ে যেত। কাঁচা পয়সার ছড়াছড়ি। বাট বিভূতি ইজ বিভূতি। স্কুল মাস্টারের ছেলে। লোকে বলে আইডিয়ালেস্ট ফুল। কেমন আছে তোমার বাবা? অনেকদিন দেখা হয়নি।’
‘ভালো আছেন।’
‘কী করছে এখন?’
‘ফুল গাছ।’
হরিদা হেসে উঠলেন। ‘ইউরোপিয়ান মডেল গুলে খেয়েছে উইথ এ লার্জ ডোজ অফ বেদান্ত।’
ব্যানার্জি সাহেব বললেন, ‘আপনি চেনেন হরিদা?’
‘খুব চিনি। তোমার বাবাকে বোলো হরিদাস চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বুঝলে অরুণ বিভূতির জীবন কাহিনি বলে শেষ করা যাবে না। দিল্লিতে এক চড়ে এক পাঠানকে ফ্ল্যাট করে দিয়ে ইতিহাস করে ফেলেছিল। সেই চড়খাওয়া পাঠান বিভূতিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ঝাপড়কা এতনা জোর হাম কভি নেহি দেখা।’
‘তা হলে এই ছেলেটি ভালো গাছের ফল?’
‘অফ কোর্স।’
‘এখানে বেশিরভাগই মিন মাইন্ডেড,
শয়তাদের দল। আই নিড অ্যা গুড সোল, অ্যা গুড ওয়ার্কার। কি মানব পারবে তো নিজেকে ঠিক রাখতে?’
‘আমি তো স্যার রেজিগনেশান দিয়ে দিয়েছি।’
‘ও হ্যাঁ রে রেজিগনেশান।’ ব্যানার্জি সাহেব চিঠিটা কুচোকুচো করে ওয়েস্ট পেপার বাসকেটে ফেলে দিলেন। ‘দ্যাট ইজ দি ফেট অফ ইওর লেটার। কাল থেকে তুমি আমার ঘরে বসবে। আমার সঙ্গে বসবে। আই উইল ট্রাই টু ক্লিন দিস আজিয়ান স্টেবল।’
‘পারবে না। দেশে নেগেটিভ স্রোত বইছে। মানুষের গতি এখন নীচের দিকে।’
‘টিল আই উইল ট্রাই।’
‘অ্যান্ড লুজ ইওর জব।’
‘এইটা আমার বাইশতম চাকরি। আই অ্যাম প্রিপেয়ার্ড টু গো ইন ফর দি টোয়েন্টি থার্ড।’
ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। চারপাশ ফাঁকা ভূতুড়ে। বহু দূরে করিডরের শেষ প্রান্তে একজন সুইপার কুঁজো হয়ে ঝাঁট দিচ্ছে। অফিস ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ব্যানার্জি সায়েব বেল টিপছেন। নিস্তব্ধ অফিসে সেই কোঁ কোঁ আওয়াজ অ্যাডমিনসট্রেশানের আর্তনাদের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। লাল আলো মুমূর্ষু রোগীর জীবনের মতো জ্বলছে আর নিভছে। সব ভোঁ ভোঁ।
হলঘরে একবার উঁকি মেরে দেখলুম। দূর কোণে চারজন তাস খেলছেন সিগারেট মুখে। বড়বাবু গভীর মনোযোগে কি একটা ফাইল দেখছেন। হরেনবাবু নিজের চেয়ারে বসে আছেন উদাস মুখে। বাইরে অন্ধকার নেমেছে। সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হরেনবাবু কী খুঁজছেন? জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো। এমন কোনও প্রার্থনা কি তাঁর মনে ভাসছে। বাসনা, যখন বিপুল ধুলায়, অন্ধ করিয়া আবোধ ভুলায়। আর একবার ব্যানার্জি সায়েবের ঘর ঢুকতে হয়। এবার অন্য আর্জি।
‘কী হল মানব?’
‘একটা অনুরোধ জানাতে এলুম স্যার। হরেনদাকে আপনি ক্ষমা করে দিন।’
‘আমি ওকে লাস্ট টেন ইয়ারস ধরে বারে বারে ক্ষমা করেই আসছি। ওর ফ্যামিলি ছেলের এডুকেশান, ওর নিজের শরীর। ওকে আমি ভাসিয়ে রেখেছি। গলায় যে পাথর বেঁধে ডুবতে চায় তাকে আর কতকাল ভাসিয়ে রাখব বল? আমার নিজেরই যে বদনাম হয়ে গেছে। হাওয়েভার মোর চানস।’
ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। ওপর থেকে নেমে আসছে নীচে। ইনডিকেটার প্যানেলে টুক টুক করে আলো জ্বলছে আর নিবছে। ছোট ছোট সংখ্যা ভেসে উঠেই হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।