Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কেবলই ছায়া || Sanjib Chattopadhyay

কেবলই ছায়া || Sanjib Chattopadhyay

আমার মা ছিলেন তিরিক্ষি স্বভাবের আর আমি ছিলুম ছিঁচকাঁদুনে। সব শিশুরই নানারকম বায়না থাকে। আমার একটু বেশি ছিল। বেশি ছিল এই কারণে, আমার যখন ন—মাস বয়েস, তখন আমার এঁড়ে লেগেছিল। এঁড়ে গোরু শুনেছি। এঁড়ে ছেলে, ছেলে তো এঁড়েই হবে, মেয়েরা বকনা, এঁড়ে লাগা আবার কী? জানি না বাবা। তবে এঁড়ে লাগার ফলে মাথাটা আমার কাতলা মাছের মতো ঢাউস হয়ে গিয়েছিল। চিপটেন কাটা আত্মীয়স্বজনরা বলত, ছেলে নয় তো যশুরে কই। আত্মীয় আর প্রতিবেশীদের স্বভাবই হল খুঁত বের করা। যে ট্যারা নয় তাকেও বলবে লক্ষ্মী ট্যারা। প্রতিবাদ করলে বলবে, স্কেল ফেলে মেপে দ্যাখো, বাঁ চোখের তারা এক সুতো কান্নিক মেরে কোণের দিকে কেতরে আছে। খুঁত পেলে তো কথাই নেই। সহানুভূতি জানাবার ছলে, ঘনঘন আসা—যাওয়া চলবে। কী হচ্ছে বউমা, রান্না হচ্ছে? আহা মাগো, তোমার সব ভালো মা, কেবল ছেলেটাই কেমন যেন হয়ে গেল। কেমন নাড়ুগোপালের মতো হবে, তা না মাথাটা হাঁড়ির মতো, হাত—পা ন্যাংলা ন্যাংলা। নজর লেগেছে মা। পুঁয়ে পেয়েছে।

আমার ইচ্ছে ছিল দুধের টিনের শিশুটির মতো হয়ে, দোলায় শুয়ে মোটা মোটা হাত—পা গদাম গদাম করে ছুঁড়ব। কেউ মুখের কাছে এসে টুসকি মারলে দেবশিশুর গলায় দুধেল হাসি হাসব। সে আর হল না। এমন কপাল, এঁড়ে লেগে গেল। যেই দ্যাখে সেই কোলে তুলে নেয় আদর করে। হাম হাম চুমু খায়, মেয়েদের কোল থেকে কোলে, কোল থেকে কোলে হতে হতে, অনন্তের কোলে চড়ে বসার সুযোগ এ জীবনে আর হল না। নিয়তি সিরাজউদ্দৌলা নাটকের শেষ দৃশ্যের মতো, আততায়ীর গলায় হেঁকে বলে দিলে, সে সুযোগ আর পাবি না শয়তান।

একপাশে অয়েল ক্লথে পড়ে পড়ে, জগতের চলার তালে তালে, সাধারণ গতির চেয়ে ধীর গতিতে বড়ো হতে লাগলুম। শরীর যত না বাড়ে, তার চেয়ে মাথা বাড়ে। গুপীগায়েন, বাঘাবায়েন—এর সেই হাল্লার রাজার পাগড়িবাঁধা মাথাটার মতো। এমন এক মাথাকে ধরে রাখার মতো মানানসই একটা ঘাড় পেলে আপসোসের কিছু ছিল না। বকের গলায় একটা হাঁড়ির মতো মাথা। কেউ হয়তো বললে, ন্যানচু খাবি? অ্যাঁএ বলে মাথাটা যেই ডাইনে কি বাঁয়ে কাত করলুম, কাতই হয়ে রইল। যিনি ন্যানচু খাবার প্রস্তাব এনেছিলেন, তাঁর চোখ ছানাবড়া। কী হল রে? ভারে লটকে পড়েছে। দু—হাত দিয়ে ধরে সোজা না করে দিলে, দুপুরের মৃণালের মতো মটকেই থাকবে। এ আমার শোনা কথা। শোনা কথায় মিথ্যার মাত্রা আধাআধি থাকবেই।

যাঁর প্রথম ভাগ দিয়ে বর্ণপরিচয় শুরু হত, তাঁর মাথাটিও দেহের তুলনায় বড়ো ছিল। ধরাধামে যাঁরা আমার আগমন পথ প্রশস্ত করেছিলেন, তাঁরা উৎসাহ দেবার জন্যে বলতেন, ঘাবড়াও মাত, বেটা, ঈশ্বরচন্দ্রের মাথাটিও বিরাট ছিল। বিরাট মাথায়, বিরাট ব্রেন, তুমিও বিদ্যাসাগর হবে। বলো বাবা, অ—এ অজগর আসছে তেড়ে, আ—এ আমটি খাব পেড়ে। এদিকে পড়ার ভয়ে ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে। ভয়ে মরলে তো চলবে না। এমন যার মাথা, তাকে বিদ্যাসাগর হতেই হবে। নয়তো মাথার অপমান, মহাপুরুষের অপমান।

বিদ্যাসাগর আরশোলা খেয়েছিলেন, আমি একদিন মুড়ি লজেঞ্চুস ভেবে টিকটিকির ডিম খেয়ে ফেললুম। চিবিয়ে যেই মনে হল লজেঞ্চুস নয়, পৃথিবীর অচেনা বস্তুভাণ্ডারের বিস্বাদ, বিষাক্ত কোনো পদার্থ সঙ্গে সঙ্গে পা ছড়িয়ে বসে, ওলে বাবালে বলে, এমন একটা কান্নার রব তুললুম, দক্ষিণ পাড়ায় দয়ারামবাবুর সেরেস্তা থেকে খড়ম পায়ে দাদু ছুটে এলেন।

মা তখন সবে প্রাথমিক জেরা শুরু করেছেন, কী খেয়ে মরেছিস, বল?

উত্তরে, থুথু করে ফিনফিনে ডিমের খোলার দু—এক কুচি মুখ থেকে বের করে দেবার চেষ্টা করলুম। দাদুদের মিষ্টি কথা বলতেই হবে। সম্পর্কের খাতিরে। আর সেইটাই প্রথা। অন্তত কেতাবে দাদুদের সেইভাবেই আঁকা হয়।

দাদু বললেন, কী খেয়েচো দাদু? বলে ফেলো তো?

একা দাদু থাকলে বলা যেত। পাশে মা। মাকে বড়ো ভয়। ভয়ে মা, আবার মাভয়। ভয়মা, মাভয়। মুখ, হাত, পা, সব সমান চলত। যাঁর দু—হাত সমান চলে, তিনি সব্যসাচী। যাঁর সবকিছু সমান চলে তিনি কী? ব্যাকরণে আজও খুঁজে পাইনি।

বার ছয়েক, কী খেয়েচো, কী খেয়েচো করে, উত্তর না পেয়ে, ধৈর্য হারিয়ে দাদু বললেন, বল শালা, কী খেয়েছিস?

দাদুরা নাতিকে শালা বলেন। সে শালা কিন্তু সত্যিই শালা ছিল। সেই বয়েসেই বুঝতে শিখেছিলুম, কোনটা আসল শালা আর কোনটা নকল শালা। দাদুর মারমুখী মূর্তি দেখে, ভয়ে ভয়ে কুলুঙ্গির দিকে আঙুল তুলে বললুম, ওই যে ওখানে।

অনুসন্ধানে আরও কয়েকটি ডিম পাওয়া গেল।

মা আমার কান ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারতেই মেঝে থেকে হাতখানেক ওপরে উঠে পড়লুম। আমার ওজনের তুলনায় টানটা একটু জোরেই হয়েছিল, মুখপোড়া, তুমি ওই খেয়ে মরেছ। খেতে পাস না, কাঙালি। ওরে, ও যে সাপের ডিম। ওরে, আমার কী হবে। ডাক এর বাবাকে।

সামান্য বিপদে আমার মায়ের মতো অমন নাচতে, আমি আর কাউকে দেখিনি। ডিম খেলুম আমি, লাফাতে লাগলেন মা। গুরুজনেরা বলতে লাগলেন, ও বউমা, তুমি অমন উতলা হয়ো না। কুলুঙ্গিতে সাপ আসবে কী করে? অন্যকিছুর ডিম। মনে হয় আরশোলার।

বিপদের সময় বাবাকে কোনো কালেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি সংসার করতেন দূর থেকে। ওখানকার কালের ‘রিমোট কনট্রোল’ প্রথায়। নিজের সংসারের চেয়ে পরের সংসারের জন্যেই আজীবন ব্যতিব্যস্ত। মায়ের মুখের বুলিই ছিল, ঘর জ্বালানে পর ভোলানে। খবরের কাগজে বাবার ছবি ছাপা হলে, তলায় লেখা হত ক্যাপসান, ঘর জ্বালানে পর ভোলানে। তাঁর একটি বড়ো নেশা ছিল, মাছ ধরা। খাল, বিল, ডোবা দেখলেই হল। ছিপ ফেলে বসে পড়লেন। মাছ খুব একটা জুটত না বরাতে। তা না জুটুক। ভদ্রলোকের উৎসাহ ছিল।

প্রথমে নিজেদের মধ্যেই খুব একচোট তর্কাতর্কি হয়ে গেল, ডিম আরশোলার না অন্যকিছুর। আরশোলার ডিম সাদা হয় না। তাহলে কীসের? ভট্টাচার্যমশাই নারায়ণ সেবায় এসেছিলেন। তিনি বললেন, এ হল টিকটিকির ডিম, অতীব বিষাক্ত।

ব্যস লেগে গেল দাদুর সঙ্গে। দাদু জানালেন টিকটিকি আর সাপের ডিম ছাড়া তিনি প্রায় সবরকমের ডিমই খেয়েছেন। ডিম খেলে স্বাস্থ্য ভালো হয়। হাফবয়েল ভালো, কাঁচা হলে তো কথাই নেই। ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত।

খেচরের ডিম যদিও চলে, স্তন্যপায়ীর ডিম বিষকুম্ভং পয়োমুখং।

টিকটিকি স্তন্যপায়ী। ম্যামাল?

ভয়ঙ্কর সন্দেহ উপস্থিত হল। সঙ্গে সঙ্গে খোঁজপাত করে ঝুলঝাড়ু দিয়ে একটি ডাগর টিকটিকিকে ভূপাতিত করা হল। সন্দেহবাদীরা সেটিকে চিৎ করে স্তন কোথায় খুঁজতে লাগলেন। পাওয়া গেল না।

ভট্টচার্যমশাই বললেন, এটি পুং। সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীয়ের খোঁজে পরম উৎসাহীরা বেরিয়ে পড়লেন। কে একজন বললেন, কোনো কোনো প্রাণীর স্তন লুক্কায়িত থাকে।

অবশেষে এই সিদ্ধান্ত হল, গিরগিটির মতো এই অলুক্ষণে ছেলেটি টিকটিকির ডিম্ব সেবন করে আজ না হোক কাল পটল তুলবেই। কারুর ক্ষমতা নেই বাঁচায়। মৃত্যুর কথায় অসংখ্য টিকটিকি ঘটিত মৃত্যুর নজির বেরোতে লাগল এক একজনের ঝুলি থেকে। ফুটন্ত ডালে টিকটিকি পড়ে মিত্তির পরিবার শেষ। দুধে পড়ে ঘোষ ফ্যামিলি ফিনিশ।

মুখে মুখে যখন শতাধিক পরিবার শেষ, সেই সময় দড়িতে বাঁধা একটি শিঙি মাছ ঝুলিয়ে বাড়ির কর্তা এলেন। ধুতি মালকোঁচা মারা, পায়ের হাঁটু পর্যন্ত ধুলোয় সাদা। বাতাসে চুল এলোমেলো। রোদ পোড়া মুখ। প্রচুর জনসমাগম দেখে তিনি একটু থতোমতো খেয়ে গেলেন।

শৈশবের কথা এত স্পষ্ট মনে থাকার কথা নয়। শৈশব হারায় না, মুখে মুখে ঘোরে, লোককাহিনির মতো। টুকরো টুকরো। অংশ জুড়তে জুড়তে জন্ম থেকে মৃত্যু, কিছু অজানা থাকে না। আমাদের জীবনকাহিনি লেখা হয় না তাই হারিয়ে যায়। মহাপুরুষদের নাড়িনক্ষত্র কীভাবে লেখা হয়। ওইভাবেই।

তবে এই ডিম্বপ্রসঙ্গ আমার বেশ ভালোই মনে আছে।

মা যখন শুনলেন ছেলেটা মরবেই কিন্তু এখনও মরেনি, তখন জীবনের শেষ চড়টি খাইয়ে দেবার জন্যে কোমর বেঁধে এগিয়ে এলেন। গালে সপাটে এক চড় কষিয়ে, দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, বল মুখপোড়া, কেন ডিম খেয়েছিস? খেতে পাস না?

বাবা মাছটাকে সকলের চোখের সামনে দোলাতে দোলাতে বললেন, ডিম যখন খেয়েছে, তখন আর মাছ পাবে না।

মায়ের হুঙ্কারে তিনি জড়োসড়ো হয়ে গেলেন, চুপ করো। মুরগির ডিম খায়নি, খেয়েছে টিকটিকির ডিম। এ ছেলে আমাদের খেতে এসেছে। জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে খাক করে দিলে, হাড়মাস কালিকালি হয়ে গেল। আমাকে খা না মুখপোড়া, আমায় খা।

ক্ষণে ক্ষণে আমার মায়ের ভাব পরিবর্তন হত। হাসিতে, কান্নাতে, রাগে, অভিমানে সংসার একেবারে মাত। হাউ হাউ করে মা কেঁদে উঠলেন, ওরে তুই নাকি বাঁচবি না।

বয়স্কা মহিলারা সঙ্গে সঙ্গে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন, কেঁদে আর কী করবে মা, যাওয়া আর আসা এই তো জগতের নিয়ম। বয়েস আছে মা, এখনও হবে। ডিমটিমগুলো হাতের কাছ থেকে সরিয়ে রাখলে এই বিপদ আর হয় না। ছেলেপুলের মাকে কত সাবধান হতে হয়।

সঙ্গে সঙ্গে একজন মন্তব্য করলেন, আজকালকার বউদের কথা আর বোলো না। ওই আমাদেরটিকে একবার দেখে এসো। সেদিন কুটনো কুটতে কুটতে বঁটি খাড়া রেখে রাস্তার দিকের জানলায় ছুটল সার্কাসের সং দেখতে। ব্যস ছেলে অমনি হামা টেনে টেনে এসে খাপ করে বঁটি চেপে ধরল। হাত দু—ফালা।

তুমি তখন কী করছিলে গা?

আমি আমার পরকালের কাজ করছিলুম। বসে বসে মালা জপ।

দেখলে যখন ধরলে না কেন?

ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার কী দরকার। যার ছেলে সে বুঝুক।

বাবা বীর দর্পে এগিয়ে এলেন। সরো, সরো। জমায়েতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ডিমটা বের করে দিতে হবে। তাই তো?

জমায়েত বললে, হ্যাঁ, তাহলেই ছেলেটা বেঁচে যাবে।

বাবা আকাশের দিকে মুখ তুলে, হাত জোড় করে, জয় মা বলে হুঙ্কার ছাড়লেন।

জমায়েত সমস্বরে, জয় মা করে উঠল। সিদ্ধেশ্বরী কালীতলায় যেন পাঁঠা বলি হচ্ছে।

কিছু বোঝার আগেই খপ করে আমার পা দুটো ধরে মাথার ওপর তুলে, হারোয়া লাঠির মতো বাঁই বাঁই করে ঘোরাতে লাগলেন। অমন ঘোরা আমি জীবনে আর দ্বিতীয়বার ঘুরিনি। অনেক ঘোরাঘুরি করেছি, অনেকে অনেক ভাবে ঘুরিয়েছে, ঠ্যাং ধরে নয়, বেশিরভাগই নাকে দড়ি দিয়ে।

সত্য মিথ্যা জানি না, আমার জীবনীকাররা বলেন, তারপর থেকে আমি চড়চড় করে বাড়তে লাগলুম। গায়ে সামান্য গত্তি লাগল। লেখাপড়ায় বেশ মন এল। ঘোরানোর ফলে পায়ের খিল খুলে গিয়েছিল। তার ফলে আমার হাঁটুর ধরনটা হয়ে গিয়েছিল শুঁড়ির দোকানের শেষ খদ্দেরের মতো। এক মাইল পথ হাঁটতে দু—মাইলের মতো সময় লাগত। তাতে অবশ্য আমি দীর্ঘায়ু হইনি। আমি ধীরে হাঁটলেও সময় আমার ওপর দিয়ে সময়ের গতিতেই হেঁটে গেছে।

বেশ প্রমাণ মাপের মানুষ অকারণে শিশুদের মতো নাঙ্গাবাবা হয়ে ঘোরে না। আমিও ঘুরি না। ভদ্রস্থ সাজপোশাক পরেই দিনের চরকায় তেল মারি। নিজের পশ্চাদ্দেশে অন্যেই লাথি মারে। আর পৃথিবীর সেইটাই নিয়ম। তোমার পাছা আমার পা। শরীরের এমন একটা স্থানের উল্লেখ অশাস্ত্রীয়। বলতে হচ্ছে এই কারণে, অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, তুমি একটু বাঁদিকে হেলে বসো কেন? তুমি কি বামপন্থী?

আজ্ঞে না। শারীরিক কারণেই হেলে বসতে হয়। আপনারা বাঁদর দেখেছেন? বেশ বড়োসড়ো লালমুখো বাঁদর? সামনে থেকে দেখলে হবে না। দেখতে হবে পেছন থেকে। বাঁদরের পেছনের দু—পাশ ভারি সুন্দর লাল। যখন ডাঁটে চলে, মনে হয় কাঁচা দুটো মাটির সরা কত্তালের কায়দায় বাজতে বাজতে চলেছে। অসাধারণ পৈছিক ছন্দ।

শৈশবে আমি বাঁদর ছিলুম। অল্পবিস্তর সব শিশুই তাই থাকে। বড়ো হয়ে মানুষ হয়। রান্নাঘরের সামনে আমার মা এক কড়া ক্ষার ফুটিয়ে রেখেছিলেন। সদ্য উনুন থেকে নেমেছে। তখনও সোডা আর সাবান ফাঁকে ফাঁকে বুজুকুড়ি কাটছে। আগেই বলেছি, আমি ভীষণ বায়নাদার ছিলুম। কোনো কিছু চেয়ে না পেলে, বুজুজুজু করে এমন কান্নার সুর তুলতুম পাশের বাড়ি থেকে রায়সাহেব হাতে হান্টার নিয়ে তেড়ে আসতেন। সেটা ছিল দোলের আগের দিন আর মায়ের কাছে আমার বায়না ছিল, বেশ বড়ো একটা নৈনিতালে আলু আধখানা করে কেটে, উলটো করে গাধা শব্দটা কুঁদে দিতে হবে। তেলকালিতে চুবিয়ে বাবার পিঠে গাধা স্ট্যাম্প মেরে দুধ গ্রহণ করব। এই ছিল আমার সেই সকালের ধনুক ভাঙা পণ। আমার মা তো তেমন সহজে টাল খাবার মতো মানুষ ছিলেন না। তাঁর জীবনটাই শুরু হয়েছিল, পারব না মন্ত্র দিয়ে। আর একবার পারব না বললে কারুর বাপের ক্ষমতা ছিল না তাঁকে দিয়ে কিছু পারায়। এক বগগা ঘুড়িকে কান্নিক মেরে সোজা ওড়ানো যায়, এক বগগা মানুষকে তো আর কিছু করা যায় না। মাথায় কান্নিক চলে না। গাঁট্টা চলতে পারে। সংসারে আমাদের এমন ইঁদুর ছিল না, যে সাহস করে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে। বাবা তো হাল ছেড়ে মাছের টাগরায় হুক পরানোকেই অনেক সহজ ভেবে নিয়েছিলেন।

তা সেদিন, আমার সঙ্গে মায়ের ভীষণ টানাপোড়েন চলছিল। মা পারবেন না, আর আমাকে পারাতেই হবে। মাও একগুঁয়ে, আমিও একগুঁয়ে। মা যেমন হবেন ছেলেও তো সেইরকম হবে। কাঠে কাঠে ঘষাঘষি চলেছে। একেবারে সাধন সমর, দেখি, মা হারে কী পুত্র হারে। আমার ভেতরটা তিড়বিড় করে জ্বলছে। হাতের কাছে যা পাচ্ছি, তাই ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছি। এক খাবলা নুন, গোটা হলুদ, দেশলাইয়ের খোল, মরিচ, শেষে এক খাবলা লঙ্কাবাটা। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্যভেদ। সোজা মায়ের চোখে।

মা শুধু মুখপোড়া বলে, বাঁ হাতে একটি ঠেলা মারলেন। আর আমি সেই ফুটন্ত ক্ষারের কড়ায় থেবড়ে বসে পড়লুম। এমনভাবে বসলুম, কড়াটা পেছনে খাপে খাপে সেঁটে গেল। পেছন দিকটা আমার চিরকালের মতো হাফবয়েল হয়ে গেল।

সেই বিপদে মা কেবল নাচতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, ওরে আমার এ কী সর্বনাশ হলো রে! ওরে, মুখপোড়া, তুই একী করলি রে? ঠাকুমা বলতে লাগলেন, ও বউমা, মুখ নয়, মুখ নয়, ওর পেছনটা পুড়ছে। যা হয় একটা ব্যবস্থা করো।

সেই শৈশবেই বুঝেছিলুম, বিপদে মেয়েরা কেবল নাচতেই পারে, আর হায় হায় করতে পারে। ব্যবস্থা হল বাবার হাতে। উপুড় হয়ে হাসপাতালে যেতে হল। অনেকেই বলতে লাগলেন, ছেলেটা মেয়ে হয়ে ফিরে না আসে।

মাসখানেক পরে জেলা হাসপাতাল থেকে ফিরে এলুম। পরে যখন পড়লুম, তাতল সৈকতে বারিবিন্দুসম, সুতমিত রমণী সমাজে, তখন মনে হল, শুধু থিয়োরি নয়, এই পাঠের প্র্যাকটিকালও আমার করা হয়ে গেছে। উত্তপ্ত সংসার কটাহে আমার পশ্চাদ্দেশ শৈশবেই আমি সেঁকে নিয়েছি। আর কী ভয় শমনে, অসুর দলনে।

শৈশব থেকে কৈশোরে গড়িয়ে যেতে মানুষের বিশেষ সময় লাগে না। আর কৈশোরই হল পেকে যাবার বয়স। সংসারে সবকিছুই পাকে। আম পাকে, কাঁঠাল পাকে, সম্পর্ক পাকে, চুল পাকে, ফোড়াও পাকে। পাকাবার লোকেরও অভাব হয় না। কে যে কাকে কীভাবে পাকায়? এ নিয়ে কখনো কোনো গবেষণা হয় না।

আমারের বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা পুকুর ছিল। চারপাশে গাছপালা। দীর্ঘ দীর্ঘ ছায়া ফেলে রেখেছে। দু—চারটে হাঁস সবসময়েই প্যাঁক প্যাঁক করছে। টুপটাপ ফুল খসে পড়ছে জলে। এখনকার ভাষায় পুকুরটার খুব সেক্স ছিল। ইচ্ছে করলে বিজ্ঞাপন কোম্পানি, ফিল্ম কোম্পানি খুব কাজে লাগাতে পারতেন। প্রায় সবসময়েই যৌবন জলে ডুবে থাকত। যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে।

সেসব বোঝার বয়েস আমার তখনও হয়নি। তবে দেখতুম, আমি যে দৃষ্টিতে মিষ্টির দোকানের লাল লাল পানতুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতুম, সেই দৃষ্টিতে পুকুরে ভাসমান বস্তুনিচয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন কোনো কোনো মহাপুরুষ। আর মনোহারীরা মুখ থেকে পিচিক করে কুলকুচোর জল ফেলে, একজন আর একজনকে বলছে, আ মর! তাকিয়ে আছে দেখ, যেন গিল খাবে। গিলে খাওয়াটা ডুরে শাড়ি পরা সেইসব মেয়েরা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত। চরিত্র একটু ছিঁড়েখুঁড়ে না গেলে তেমন খোলতাই হয় না। মা যেমন বলতেন, তরকারিতে একটু ঝাল না পড়লে স্বাদ হয় না। পাঁচফোড়ন দিয়ে সাঁতলাতে হয়। পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে চরিত্র সাঁতলানোর মতো। বড়ো হয়ে বুঝেছি। কৈশোরের সুড়সুড়ির মর্ম এখন বুঝি।

সেই পুকুর ধারে আমার আকর্ষণ ছিল একটি জামরুল গাছ, আর একটি চালাবাড়ি। সেই চালাবাড়িতে ছিল আমার বনদেবী। ফ্রকপরা একটি মেয়ে। মাঝে মাঝে লাল ডুরে শাড়ি পরে খুব পাকামি করত। তার একটা খরগোশ ছিল। এর চোখ, আর ওর চোখ, দু জোড়াই সমান উজ্জ্বল ছিল, সমান নিষ্পাপ।

আমার স্বপ্নে এসে বনদেবী খুব নাচানাচি করত। আর সেই বয়েসেই আমি তাকে বউ করার জন্যে এমন খেপে গেলুম যে কবিরাজ ডাকতে হল। বয়স্ক মহিলারা সময় পেলেই বোঝাতেন, ওরে তোর এখনও বিয়ের বয়েস হয়নি, গোড্ডিম ভাঙেনি।

গোড্ডিম কাকে বলে আজও জানা হয়নি।

বিয়ে কাকে বলে জানিস?

খুব জানি, বউ মানে বন্ধু। সারা দিনরাত যার সঙ্গে খেলা যায়, ঝগড়া করা যায়, মারামারি করা যায়। একবারও যে কাছছাড়া হয় না।

দাদু বললেন, শালা দই—এ মজেছে। এই বয়েসেই এই, বড়ো হলে ব্যাটা কলির কেষ্টা হবে। অতো গোপিনীর সাপ্লাই কে দেবে? এখনকার কালে তো সব গুঁপো গোপ। বিহারি গয়লারা বসে আছে খাটালে খাটালে। মোষের মতো সব চেহারা। কবিরাজ বললেন, এ একপ্রকার তড়কা জাতীয় ব্যাধি। তলপেটে লাগানো হোক মৃত্তিকার প্রলেপ। মাথার মাঝখানে গোল করে কামিয়ে একডালা ঘৃতকুমারী বসিয়ে রাখো। বাবাজীবন অচিরেই আরোগ্য লাভ করিবে।

কারুর মাথার মাঝখান কামাতে হবে শুনলে সে যুগের নরসুন্দরেরা বড়ো আনন্দ পেতেন। উৎসাহের আধিক্যে বিকচ্ছ হয়ে ছুটে আসতেন। তা ছাড়া সব মায়েরই সন্তানের উপর একটা জাতক্রোধ থাকে। স্বীকার না করলেও আচার—আচরণে বোঝা যায়। প্রহারেণ ধনঞ্জয় তো থাকেই, সেই সঙ্গে নির‍্যাতনের অন্য কোনো পথ খুলে গেলে আরও উল্লসিত হন। মাথা কামাবার বাক্স নিয়ে আমাদের বটতলার অক্ষয় নাচতে নাচতে এল। তার চলার ধরনটাই ছিল নাচের মতো। তার কানে বিড়ি তার ঠোঁটে বিড়ি।

উঠোনে থান ইট পেতে আমাকে বসানো হল। চারপাশে হিতাকাঙ্ক্ষী প্রতিবেশীরা। দু—হাঁটুর মাঝখানে মাথাটাকে চেপে ধরে ব্রহ্মতালুর চারপাশ গোল করে কামিয়ে দিলে। সকলেই রায় দিলেন, আমাদের অক্ষয়ের হাতটি বড়ো ভালো। কেমন সুন্দর গোল করে মাথার শাঁস বের করে দিয়েছে। এইবার যত পারো ঘৃতকুমারীর পুলটিস লাগাও।

সেই পুলটিসের তাড়সে মাথার মধ্যভূমির উর্বরতা দুর্বল হয়ে পড়ল। এখন টাকে হাত বুলোই আর ভাবি রোমান্স কী সর্বনেশে জিনিস। যার জন্যে এই দুর্ভোগ, জামরুলতলার সেই কিশোরী এখন কোথায়! কার ঘরের প্রবীণা গৃহকর্ত্রী। মধ্যরাতে এখনও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি, খরগোশ কোলে আমার বনদেবী জঙ্গলাপথে হরিণের মতো ছুটছে, পেছন পেছন নাচতে নাচতে চলেছে লোটালোটা কান, দুটো ছাগলছানা।

সে এক যুগ ছিল বটে। যত মান অপমান সব বড়োদের ছোটোরা মানুষ হলেও জন্তুবিশেষ। নিজের ছেলেকে বেইজ্জত করে গেরস্তরা বড়ো সুখী হতেন। অনেকটা সেই ‘পাপের বেতন মৃত্যু’ স্লোগানটার মতো। শিক্ষককে ডেকে বলে দিলেন, গাধার টুপি পরিয়ে এক চক্কর ঘুরিয়ে দিন। য্যায়সা বান্দার ত্যায়সা দাওয়াই। মেয়ে বেশ বড়ো, ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরলেই হয়। কাকে দেখে, হেসে, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলেছিল। দেখেছিল পাশের বাড়ির পিসি। পিসি থেকে মাসি, মাসি থেকে মেসো, মেসো থেকে মেয়ের জ্যাঠা, জ্যাঠা থেকে মেয়ের বাবা, বাবা থেকে মা। পুরুষরা সময় সময় ক্ষমাশীল হলেও মেয়েদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার উপায় ছিল না। কত ধানে কোথায় কত চাল হয় তাঁরা জানতেন। নাচতেও জানতেন, নাচাতেও জানতেন। মেয়েকে ন্যাড়া বোষ্টমি করে ছেড়ে দিলেন। মনে বসন্তের কোকিল ডেকেছিল ছুঁড়ির, মাথায় ট্র্যাকটার চালিয়ে দিলুম। আবার মেঘের ঢলে চুল নামতে তিনটি বছরের ধাক্কা। বাপের বাড়ির পাড়ায় আর মুখ দেখাতে হচ্ছে না ডেলাইলা। সেই যেদিন স্যামসন এনে চার হাত এক করে দেব, সেদিন যদি মনের খেতে প্রেম থাকে, তো কোকিলের কুহু ছেড়ো।

আমার সেই বনদেবীর অবশ্য কোনো শাস্তি হল না, কারণ সে ছিল আমার চেয়ে অনেক ছোটো। তা ছাড়া তার মা ছিল একটু বেপরোয়া ধরনের আর তার বাবাকে দেখা যেত না, ছিল, তবে কোথায় ছিল কেউ জানে না। বয়েস কম, তখন কি সংসারের মারপ্যাঁচ অতো বুঝতুম? বনদেবীর মায়ের যে অনেক দেবতা ছিল তা কি জানতুম?

বস্তুর ধর্মই হল, একদিকে চাপ দিলে আরেক দিক ঠেলে ওঠে। আমারও তাই হল। ঘৃতকুমারীতে ঊর্ধ্ব বায়ু তো শান্ত হলই না, রাগে অভিমানে স্বভাবটাই বদলে গেল। নাম হল, গোঁয়ার—গোবিন্দ। গোঁয়ার—গোবিন্দরা একটু লোমশ হয়। আমারও সারা শরীরে চড়চড় করে লোম গজিয়ে গেল। গোঁফের রেখা পড়ল ঠোঁটের ওপর। ছাগলদাড়ি বেরলো। নিচের ঠোঁট পুরু হল। ভট্টাচার্যমশাই একদিন পুজোয় এসে আসনে বসে আমার দিকে তাকিয়ে দৈববাণী করলেন, এর মধ্যে কামভাব প্রবল হবে।

মা নৈবেদ্য ঠিক করতে করতে ঘোমটার আড়াল থেকে বললেন, হাতটা একবার দেখুন তো!

পূজারি ডানহাতটা টেনে নিয়ে মেলে ধরলেন চোখের সামনে। বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়লেন, তারপর বললেন, এ ছেলে হাবিলদার হবে।

মা বললেন, তা তো হবেই। যেমন বাপ তার তেমনি ছেলে।

বাবার ওপর মায়ের ভীষণ রাগ। দুপুরে মাঝে মাঝে বাড়িতে রঙিন শাড়ি পরা এক ধরনের মেয়েরা দুই সতীন নাচাতে আসত। খ্যানখ্যানে গলা। লম্বা কৌটো খুলে নিচের ঠোঁটে দোক্তার গুঁড়ো ঠুসে পিচিক পিচিক থুতু ফেলত। তাদের চলার ধরন, বসার ধরন, কথা বলার ধরন সবই ছিল কেমন কেমন। পুরুষরা আড়ে আড়ে তাকালে, তারা বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলত, দূরে কেন গো, কাছে এসো না। আমার মনে হত, আমার বাবা, আমার মা, দুই সতীন ছিল। মুখোমুখি হলেই ঝটাপটি বাবা পালাতেন, যত তাল এসে পড়ত আমাদের ঘাড়ে।

ভট্টাচার্যমশাই হাত ফেলে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

মা প্রদীপ জ্বালতে জ্বালতে বললেন, বুঝেছি।

পূজারিমশাই তালুতে আচমনের জল নিয়ে ঠোঁটের কাছে তুলতে তুলতে বললেন, হ্যাঁ মা, বুঝলেই ভালো। এ ছেলে তোমার কুলনাশ করবে।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, সে আবার কী?

দুজনেই কটমট করে আমার দিকে তাকালেন। বুঝলুম না, কী অন্যায় করেছি। আমার হাত আমি প্রশ্ন করব না! উত্তরের বদলে মন্ত্র শুরু করে দিলেন, ওঁ বিষ্ণো, তদবিষ্ণো,পরমংপদং, সদাপশ্যন্তি।

উঠতি বয়েসের ছেলেদের বন্ধুবান্ধবের অভাব হয় না। আর বন্ধুরা চিরকালই খুব জ্ঞানী হয়। তাদের জ্ঞান নিয়েই আমরা জ্ঞানী। কুলনাশের ব্যাখ্যা তাদের কাছেই পাওয়া গেল। কুলনাশ মানে ধর্মত্যাগ। তুই মাইকেল মধুসূদনের মতো ক্রিশ্চান হয়ে যাবি, আর মেম বিয়ে করবি। বড়ো ভালো কথা। এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে? দিশি মেয়েরা বড়ো ঝগড়া করে। গাউন পরা মেমের কোনো তুলনা হয়। ইংরিজিটা তাহলে ভালো করে শিখতে হয়। গ্রামে বসে তো আর ইংরিজি শেখা যায় না। শহরে যেতে হয়।

মানুষের জীবনে কতভাবে যে সুযোগ আসে।

একদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতে চলল। চারপাশে থমথমে অন্ধকার নেমে আসছে। ঠাকুমা দাওয়ায় বসে টুসকি মেরে মেরে উদাস গলায় গান গাইছেন। আর থেকে থেকে বলছেন, খোকা তো এখনও ফিরল না। ছেলে যত বড়োই হোক মায়ের কাছে সারাজীবনই সে খোকা। মা মুখঝামটা দিচ্ছেন, আপনার ছেলের ফেরার কোনো ঠিক আছে।

মুখঝামটা খেয়ে ঠাকুমা আবার সুর তুলছেন। তবে মায়ের মন তো! গান থামিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, কই খোকা তো এখনও ফিরল না।

মা বলেছেন, আজ এত খোকা খোকা করছেন কেন বলুন তো। খোকা কী আপনাকে রাবড়ি খাওয়াবে।

মায়ের যেমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। সয়ে গেলে তেমন আর গায়ে লাগে না। লংকার ঝালের মতো। অভ্যাস হয়ে গেলে ঝাল তরকারি খেয়ে হুহা করতে হয় না। মায়ের মুখঝামটা ঠাকুমার অভ্যাস হয়ে গেছে। তিনি জানতেন, ছেলের বউয়ের শাসনেই ছেলের মাকে থাকতে হয়।

ঠাকুমা আমাকে ফিসফিস করে বললেন, বুড়ো আমার মনটা বড়ো উতলা হচ্ছে রে। অন্য দিন তো এমন হয় না। তুই একবার দ্যাখ না দাদু, তোর বাবা কোথায় গিয়ে বসে রইল!

দুপুরে খাবার সময়, বাবার সঙ্গে মায়ের এক হাত হয়ে গেছে। তুমি একটি অকর্মণ্য, ঢ্যাঁড়োস। রোজগারের মুরোদ নেই, বসে বসে ওড়াচ্ছে। কলসির জল গড়াতে গড়াতেই শেষ হয়ে যায়। যাবতীয় ভালো ভালো কথা খেতে বসে বাবাকে হজম করতে হয়েছে। খেয়ে উঠে আমার সঙ্গে দু—চার কথা বলেছিলেন। কথা কেমন যেন এলোমেলো মনে হয়েছিল। একটা থেকে আর একটা।

এই সন্ধের মুখে সেইসব কথাই একের পর এক মনে পড়তে লাগল।

আষাঢ়ে তলার শিবমন্দিরটা এবার ভেঙে পড়বে রে খোকা। এ বর্ষা আর সহ্য হবে না।

নগেন মুদি গোটা দশেক টাকা পাবে।

এবার পুজোয় তোকে একটা সিল্কের পাঞ্জাবি করিয়ে দোব।

রথের মেলা থেকে গোটাকতক ভালো জাতের আমের চারা কিনব।

পুরীর মন্দিরের ভোগ খেয়েছিস কখনও। খেলে কোনোদিন ভুলতে পারবি না।

এইসব বলতে বলতে, আলস্যে বাবার শরীর ভেঙে আসছিল। কিছুক্ষণ কাত হয়ে শুয়ে থেকে নাঃ যাই ঘুরে আসি, বলে, জামাটা গায়ে ফেলে দুপুর রোদে বেরিয়ে গেলেন।

কখন কোথায় যাবেন, কিছুই তো ঠিক নেই। কোনোরকমে বাড়ি থেকে একবার বেরোতে পারলেই হল। বাড়ির বাইরে বাবার বড়ো ফুর্তি তখন সবকিছুই বড়ো আনন্দের। টেলিগ্রাফের তারে ফিঙে দোল খাচ্ছে। গাছের নতুন পাতায় সূর্যের আলো ঝকঝক করছে। দুটো ছাগলছানা মাঠে নাচছে। ঈশ্বরের এইসব ছোটোখাটো তুচ্ছ ব্যাপারের একমাত্র দর্শক ছিলেন, আমার বাবা। বুদ্ধিমান লোকে নাম রেখেছিল, আমাদের সরোজ পাগলা। বাবাকে এই ডাকে ডাকলে, আমার ভীষণ রাগ হত, কিন্তু কিছু করার ছিল না। বুদ্ধিমান, পয়সাওলা, ক্ষমতাশালী লোকেদের দাপটই আলাদা। সব মানুষই হয়তো একইরকম দেখতে, সেটা হল, বাইরের চেহারা, ভেতরে একেকজন, একেকরকম। কেউ ছাগল, কেউ গাধা, কেউ ছুঁচো, কেউ বাঁদর, কেউ শুয়োর। কথা তো সবাই বলে, একমাত্র বোবা ছাড়া। সে হল কথার কথা। কথার মতো কথা তাঁরাই বলতে পারেন, যাঁরা জীবনে প্রতিষ্ঠিত। তখন তো এসব বুঝতুম না। তখন রাগ হত, অভিমান হত, প্রশ্ন আসত, কেন এসব হবে। জীবনটাকে প্রায় শেষ করে এনে, এখন বুঝছি, পৃথিবী ঈশ্বরের এক বিচিত্র সৃষ্টি। মানুষ আরও বিচিত্র।

আমি সেই সন্ধের কথা কোনোদিন ভুলতে পারিনি। সব মানুষের জীবনেই এমন এক একটা দিন আসে। মানুষ বাঁচে অনেক দিন। তার মধ্যে দিনের মতো দিন একটা দুটোই আসে। হারের মটরদানায় লকেট একটাই থাকে। হাজার হাজার দিনের মালায় গাঁথা একটি দিন।

ঠাকুমার কথায় বাবার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লুম। কিছু কিছু বাড়ি থাকে যার তুলনায় রাস্তা ভালো। আমি তখন শহর কলকাতার একজন নামী মানুষ। আমার সুউচ্চ বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে, একটা কথাই মনে পড়ত আর মনে পড়লেই হাসি পেত এই ভেবে, একটা সত্য আমি জেনে ফেলেছি, যা আর কেউ জানে না। ওই যে শহর, টোপোর টোপোর বাড়ি, সারি সারি আলোর মালা, খইয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে আছে চারপাশে, ওসব সুইট হোম নয়, অসংখ্য বিষফোঁড়া, যন্ত্রণার গুটি, ভেতরে শুধু পুঁজ আর রক্ত। যত রাত বাড়ে, তত ঝনঝন আর টনটন করে। শহর এপাশ আর ওপাশ করে। সাধক যাঁরা, তাঁরা নিশাকালে শোনেন, মাটির বুক থেকে আকাশের দিকে উঠছে, প্রণব মন্ত্র। আমি শুনি যন্ত্রণার অস্ফুট কাতরানি।

এ সত্যের উৎসভূমি আমার সেই শৈশবের বাড়ি। যে বাড়িতে সারাদিন শুধু চড়বড় করে কথাই খই ফুটত। উত্তপ্ত মানুষের অহরহ ঠোকাঠুকিতে আগুনই জ্বলত। সবসময় যেন হোম হচ্ছে, ওঁ স্বধা, ওঁ স্বধা করে। মানুষ ছবি বাঁধায়, আমি সেই দিনটিকে বাঁধিয়ে মনের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছি।

যেসব জায়গায় বাবার থাকা উচিত, একে একে সেই সেই জায়গায় গেলুম। সকলেরই এক কথা, অন্য দিন তো আসেন, আজ তো তোমার বাবা আসেননি বাবা। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা, আরেক জায়গা থেকে আরেক জায়গা, এইভাবে ঠ্যালা খেতে খেতে শেষে বটতলায় এসে হাত—পা ছড়িয়ে বসে পড়লুম। কোথায় কতদূর চলে গেছেন কে জানে? আকাশের আলো প্রায় মুছে এসেছে। পশ্চিম আকাশে সাঁঝের তারা ধকধক করছে।

বটতলা বেশ ঠান্ডা হয়। ডালে ডালে ঘরফেরা অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে কান ঝালাপালা। বেদিটা বাঁধানো। ইচ্ছে করলে শুয়েও পড়া যায়। হঠাৎ সামনে তাকাতেই দেখি, মাঠ ভেঙে বাবা চলেছেন। সাদা শার্ট গায়ে, একটু উঁচু করে তুলে পরা ধুতি। হন হন করে এগিয়ে চলেছেন।

বেদি থেকে লাফিয়ে নেমে, পেছন পেছন ছুটতে লাগলুম। এমন কিছু জোরে হাঁটছেন না, তবু আমি ধরতে পারছি না। এত ডাকছি, সাড়া নেই। মনে মনে খুব অবাক হচ্ছি, ভীষণ অভিমানও হচ্ছে। এত ডাকছি। থামছেন না, পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন না, সাড়াও দিচ্ছেন না। বাবার হাঁটার ধরন দেখে কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। মাটিতে যেন পা পড়ছে না, কেমন যেন বেলুনের মতো ভেসে ভেসে চলেছেন।

অনুসরণ করতে করতে মাঠ পেরিয়ে বড়ো দিঘির পাড়ে সেই ভাঙা শিবমন্দিরের কাছে এসে পড়লুম। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছি, মন্দিরের চাতালে সাদা মতো কে একজন শুয়ে রয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলুম, শিবুকাকা, বাবার দাবা খেলার সঙ্গী। বাবা তো আচ্ছা মানুষ। এখানে বসে অন্ধকারে দাবা খেলার লোভে আমার ডাকে সাড়া না দিয়ে সারাটা পথ কেমন এলেন। আমি কি ধরে নিয়ে যেতে এসেছি? আমি তো খুঁজতে এসেছি। আমি কি বাবার সব কাণ্ডকারখানা মাকে বলে দি?

অনেকটা দূরেই থেমে পড়েছিলুম। দেখি না, কী করেন? অস্পষ্ট অস্পষ্ট সবকিছু তেমন দেখতে পাচ্ছি না। বাবা ভাঙা চাতালে উঠে শিবুকাকার মাথার সামনে বসলেন। চাতালটা বেশ উঁচু, কিন্তু কী অদ্ভুত কায়দায় ওপর দিকে একটু ভেসে উঠে, মাথার কাছে চলে এলেন।

বাবার কোলে শিবুকাকার মাথা। শিবুকাকার কী অসুখ করেছে? বাবা কি তাহলে জল কিংবা ওষুধ আনতে গিয়েছিলেন? আমি এবার বেশ জোরে ডাকলুম, বাবা।

ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালেন। মুখ তেমন স্পষ্ট নয়। মুখ তুললেন, কিন্তু সাড়া দিলেন না। আবার ডাকলুম, বাবা। বাবা ধীরে ধীরে কেমন যেন ঝাপসা হতে হতে বাতাসে মিলিয়ে গেলেন। উঁচু ডালে বসে গোটাকতক প্যাঁচা চ্যাঁ চ্যাঁ করে ডেকে উঠল। জীবনে আর কখনো এমন ভয় পাইনি। ভয় দেখেছি, তবে ভীত হইনি। চোখের সামনে বটতলার ভাঙা ভাঙা বেদি। জোড়া শিবমন্দির, অন্ধকারে হাহা করছে। ছায়ার মতো দুটি শিবলিঙ্গ। একটি মানুষ হাত—পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। সেইদিন থেকেই আমার বিচারবুদ্ধি খুলে গেল। যে বুদ্ধির জোরে আজও আমি করে খাচ্ছি।

প্রথমে ভেবেছিলুম, ছুটে পালাই। তারপর মনে হল, কেন পালাব। এমনও তো হতে পারে আমি ভুল দেখেছি। কলাগাছের ছায়াকেও তো মানুষ ভূত ভাবে। কে শুয়ে আছেন, শিবুকাকা না বাবা? বেদির নিচে চটিজোড়া খোলা রয়েছে। একটা হাত আলগা হয়ে পাশে পড়ে আছে, আর একটা হাত বুকে। জায়গাটা ভয়ঙ্কর নির্জন। এত নির্জন যে নিজের শ্বাস—প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে গেলুম। গা ছমছম করছে, বুকে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। শুয়ে আছেন শিবুকাকা নয়, আমার বাবা। ফুরফুরে বাতাসে কী সুন্দর ঘুমোচ্ছেন! কোনো ভাবনা নেই চিন্তা নেই। মেঝের ফাটা ফুঁড়ে ঘাস উঠেছে। বটের ঝুরি নেমে চারপাশে হিল হিল করে দুলছে। এই গরম কাল। সাপখোপের আড্ডা। কামড়লে কী হবে?

বাবার পায়ে হাত রেখে আরেকবার চমকে উঠলুম। বরফের মতো ঠান্ডা। কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলুম, বাবা। একবার দুবার তিনবার। সাড়া নেই। গাছের পাতায় বাতাস মড়মড় করছে। একটি ছেলে ডেকে চলেছে, বাবা, বাবা। কোনো উত্তর নেই। বেদির ওপর উঠে মুখ দেখার চেষ্টা করলুম। রাত যত অন্ধকারই হোক, আকাশে একটু আলো থাকে। সেই আলোতে দেখলুম, বাবার চোখ দুটো উলটে গেছে। ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁকা হয়ে আছে। কোনো নিশ্বাস পড়ছে না। বাবা মারা গেছেন।

বেদি থেকে লাফিয়ে পড়ে মাঠ ভেঙে ছুটতে শুরু করলুম। সেইদিন বুঝেছিলুম,শোকের কী ভীষণ শক্তি। সুখে মানুষ জড়পিণ্ড হয়ে যায়। আমি যেন কাগজ বিলি করতে বেরিয়েছি, জোর খবর, জোর খবর। বাবা মারা গেছেন।

পেতলের সানকিতে চাল ধুয়ে, মা সবে হাঁড়িতে ঢালার জন্যে সামনে ঝুঁকছেন, ঝনঝন করে হাত থেকে সানকি পড়ে গেল। উনুনে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতেন, কোনোরকমে সামলে নিলেন। বিশ্বাস হয়নি, আমার কথা। কী বললি মুখপোড়া! কে বলেছে, তোর বাবা মারা গেছে? যে বলেছে, তার বাবা মরুক।

তাই তো হল। বলছি তো আমি, আমার বাবাই তো তাহলে মরবে। উঠোনে ভিড় জমে গেল। মৃত্যুর মতো কোনো জবরদস্ত জিনিস আছে? জীবনের চেয়েও বড়ো। এসেছে, এখন থাকবে বেশ কিছুদিন। বারেবারেই দেখা হবে। মৃত্যু হল—ফট। ছিল, নেই। আর ফিরবেও না, একেবারে শূন্য। সরোজপাগলা মারা গেছে শুনে এত ভিড় হল, যে সামলানোই দায়। ঠাকুমার কথাও আর কারুর মনে রইল না। কাকারা বেরিয়ে পড়লেন লণ্ঠন হাতে। দাদু চললেন আগে আগে। ডাক পড়ল রসিক ডাক্তারের।

অনেক দিন পরে বটতলার জোড়া শিবমন্দিরে সন্ধের আলো পড়ল। লণ্ঠনের আলোয় রসিক ডাক্তার সামনে ঝুঁকে পড়লেন। নাড়ি দেখলেন। বুকে যন্ত্র বসালেন। শেষে রায় দিলেন, না মরেই গেছে।

কী করে মরল?

একে বলে সন্ন্যাস রোগ। বড়ো বড়ো মহাপুরুষরা এই রোগেই মরেন।

সরোজ আমাদের মহাপুরুষ ছিল?

মৃত্যুই সে কথা প্রমাণ করছে।

বটতলা থেকে বাবা কাঁধে চড়ে বাড়ি গেলেন। এই প্রথম মৃত্যু দেখছি।

কেমন অবাক লাগছে। এই তো একটু আগে কত সব কথা হল। পুরীর জগন্নাথদেবের প্রসাদ। ভাঙা শিবমন্দির। পুজোয় সিল্কের পাঞ্জাবি।

ভেতরটা আমার রাগে কষকষ করছে। সেদিনের সেই রাগ আজও আমার ভেতর পোষা রয়েছে। মৃত্যুর কাছে মানুষ যদি এতই অসহায়, তাহলে জীবন নিয়ে এত কীসের বড়াই? যে আলো আমি নেবাই, সে আলো আমি আবার জ্বালাতে পারি। যে জীবন একবার নিবে যায়, তাকে জ্বালাবার ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বরেরও নেই। আহা, কী আমার ইঞ্জিনিয়ার রে!

বাবা, তুমি একবার আমার সঙ্গে কথা বলো। তুমি উঠে বোসো। চলো না, ঘোষালদের পুকুরে রাতে লণ্ঠন জ্বেলে মাছ ধরে আনি। কে বলেছে, শিশুর প্রার্থনা ঈশ্বর শোনেন! ঈশ্বর বলে কিছু নেই। আজও আমি নিঃসন্দেহ। সোজা ঊর্ধ্বে চলে যাও মাইলের পর মাইল, অধোদিকে চলো, মাইলের পর মাইল, পাশে চলো, শুধুই শূন্যতা। কেউ কোথাও নেই! কোথায় ইন্দ্রলোক, শিবলোক, ব্রহ্মলোক। অসীম শূন্যে ভাসছে সবুজ একটি গ্রহ। এইখানেই শুরু, এইখানেই শেষ।

বাবার বুকের ওপর আছড়ে পড়ে মা বলতে লাগলেন, এ তুমি কী করলে, আমাকে ফেলে চলে গেলে। এই তো তুমি ছিলে, এরই মধ্যে তুমি নেই।

মাকে কিছুতেই সরানো যায় না। এই যে এত ঝগড়া, কড়া কড়া কথা, সবই তাহলে মিথ্যে, সবই তামাশা। মানুষের বাইরেটা তাহলে সব নয়, ভেতরেরটাই আসল। প্রতিবেশী মহিলারা কাঁদতে লাগলেন, হায় হায় করতে লাগলেন। ঠাকুমা কোনোরকমে একপাশে দাঁড়িয়ে, খোকা বলে একবার কেবল ডেকেছিলেন। তারপরেই পাথর হয়ে গেছেন।

বাবাকে সিল্কের ধুতি পাঞ্জাবি পরানো হল। যে মানুষ হাঁটুর ওপর ধুতি পরে, ধুলোপায়ে ঘুরে বেড়াতেন, তাঁর হল রাজবেশ। রাজার মতোই নাকি যেতে হয়। কষ্ট দিয়েছ বেশ করেছ, দুঃখ দিয়েছ সহ্য করেছি, এখন যাবার বেলায় আমি প্রভু, তোমার দরবারে যাব মাথা উঁচু করে। চন্দন দিয়ে বাবাকে সাজানো হল। মালা আর ফুলে শরীর ঢাকা পড়ে গেল। ধূপ আর ফুলের সুবাসে মৃত্যুর সৌরভ ফুটে উঠল। বিশাল খাটে চেপে বাবা আমার চলে গেলেন। শেষ যাত্রা। গুপীদা গেয়ে উঠলেন, ভেবে দেখ, শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর, অন্যে কবে কথা, তুমি রবে নিরুত্তর।

সেদিনের সব কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। বেশি মনে আছে ওই গানের লাইন দুটো। এমন সময় এমন ভাবে শুনেছিলুম, প্রাইমারি ভ্যাকসিনের গোল কচ্ছপ—দাগের মতো দেগে গেছে। বিশ্বাসী স্ত্রীর মতো লাইন দুটো সবসময় আমার পাশে শুয়ে থাকে। ভেবে দেখ, শেষের সেদিন কী ভয়ঙ্কর, অন্যে কবে কথা, তুমি রবে নিরুত্তর। ভোগেও মনে পড়ে, দুর্ভোগেও মনে পড়ে।

বিশাল এক শ্মশানে কাছা গলায় দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে গোল করে ঘিরে আছে সারি সারি গাছ। বট, পাকুড়, অশ্বত্থ। গাছের কপালে আগুনের আভার ছোঁয়া লেগেছে। ঝুলেথাকা পাতা গুমোট লাল। মুখোশের মতো মুখ অগ্রদানী ব্রাহ্মণ হাতে জ্বলন্ত এক নুটি বিচিলি ধরিয়ে দিয়ে বলছেন, নাও বাবা, অগ্নিসৎকার করো। বলো, ওঁ কৃত্বা তু দুষ্কৃতং কর্ম্ম জানতা ব্যাপ্যজানতা। মৃত্যুকালবশং প্রাপ্য নরং পঞ্চত্বমাগতম।। নাও বাবা, ঠোঁটে লাগাও।

সন্দেশ নয়, রসগোল্লা নয়, আগুন। সিনেমার পর্দায়, অভিনেতার মুখ কেমন ক্রমশ বড়ো হতে হতে, সমস্ত পর্দা ছেয়ে ফেলে, স্বপ্নের আকাশে তেমনি, সবচেয়ে প্রিয়জনের মুখটি বিশাল হতে থাকে, লাল থেকে লাল, আরও লাল, তারপর হঠাৎ একসময় ফেটে যায়, সারা আকাশে লালের ফুলঝুরি। প্রথম প্রথম ভয়ের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যেত। এখন আর কিছু হয় না। খুব ফাইন নেটের মশারিতে এক প্রৌঢ় উঠে বসে। কোনোদিন এক চুমুক জল খায়। কোনোদিন তার প্রয়োজন হয় না। পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় স্বপ্নটা আরও অদ্ভুত। বিশাল এক খামারবাড়ি। মাঠ থেকে সবে ফসল উঠে গছে। চারপাশে বুরুশের মতো খোঁচা খোঁচা গোড়া জেগে আছে। সেই খামারে একা আমি ঘুরছি। সময় সকাল। হঠাৎ দেখলুম কে একজন উলটে পড়ে আছে। খাঁকি প্যান্ট, সাদা জামা। দোমড়ানো, মোচড়ানো বাঁখারির মতো লোকটি পড়ে আছে। আমি যেই বলছি খুন খুন মাটি ফুঁড়ে আমার সামনে অদ্ভুত চেহারার একটি মানুষ উঠে দাঁড়াল। রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করল, কী, সাতসকালেই খুন করে বসে আছো। কী যে করো, দাঁড়াও দেখি।

লোকটি পড়ে থাকা মানুষটিকে সোজা করতেই চমকে যাই, একী, এ তো আমি? আমার সামনে আমি মরে পড়ে আছি। লোকটি তখন সেই মৃতদেহটিকে খাড়া করে তুলে বসায়। নিজের পকেট থেকে একটা বিউগিল বের করে, মৃতদেহের জামা তুলে বুকের কাছে ভরে দেয়। তারপর কোমরে হাত রেখে মৃত মানুষটিকে পেছনে একটু বাঁকাতেই লোকটি খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়াল। চোখ দুটো ঢাকনা খোলার মতো খুলে গেল, কিন্তু মণিতে কোনো প্রাণ নেই। মৃতের দৃষ্টি। লোকটি দম দেওয়া পুতুলের মতো একপাশে কাত হয়ে, বুকটাকে সামনে চিতিয়ে, উদ্দেশ্যহীনভাবে এগিয়ে চলল। সরল রেখায় যেতে পারছে না। বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল সেই খামারে।

আমার ভয় কিছুটা কেটে গেলেও, সংশয় রইল, মৃত অথচ জীবিত এই মানুষটি কতক্ষণ সচল থাকবে। সেই অদ্ভুত মানুষটি আকাশবাতাস কাঁপানো হাসি হাসতে হাসতে চলে গেল। আর আমার সামনে আমি দম দেওয়া পুতুলের মতো বাঁপাশে কাত হয়ে সেই এবড়োখেবড়ো, শস্য কেটে নেওয়া খামারে গোল হয়ে ঘুরতে লাগলুম। প্রাণহীনের আবর্তন।

এই স্বপ্নের যে কী মানে! ভাবি, কোনো কূলকিনারা পাই না।

বাবার মৃত্যুর পর মা ভীষণ বদলে গেলেন। কথা কমে গেল। মেজাজ শান্ত হয়ে গেল। এমনটা যদি আগে হত! মানুষকে তো শুধু বোমা মেরেই মারা যায় না, কথা দিয়েও ঘায়েল করা যায়। এই কথাটাই তো সহজে কেউ বুঝতে চায় না। কেউ দেখে শেখে, কেউ ঠেকে শেখে। মা আমার ঠেকে শিখলেন।

সেই হা হা সংসারে, আমরা দুজন, মা আর ছেলে। চারপাশে বিষয়ের লোভে ঘুরঘুর করতে লাগলেন কাকার দল। জ্যাঠামশাই অনেক আগেই আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। মেয়েরা বিধবা হলেই হাঙরের দল দাঁত বের করে তেড়ে আসে। মানুষ আগে, না জীবন আগে, না বিষয়সম্পত্তি আগে। মানুষের সংসারে বিষয়টাই আগে।

সেজকা খুব ফিকিরে ছিলেন। গোলগাল, নাদুসনুদুস, মেয়েদের মতো সামনে সিঁথি করে আঁচড়ানো চুল। একপেট খেয়ে ঢেকুর তোলেন বাছুরের মতো। থালার চারপাশে গোল করে বাটি সাজিয়ে লাল মেঝেতে খেতে বসেন। মোটাসোটা কাকিমা ঝালর লাগানো পাখা দিয়ে পিঠে বাতাস করেন, আর কুটুস কুটুস কথা বলেন। সেই বয়েসে এটুকু বোঝার ক্ষমতা হয়েছিল, কুটুস কুটুস কথা কখনো ভালো কথা হতে পারে না।

খেতে খেতে সেজকা হাঁসফাঁস করে উঠতেন। পেট ফুলে উঠত। কাপড়ের কষি আলগা হয়ে নেমে যেত নিচের দিকে। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসত। আর পারছি না বলে খোসা ছাড়ানো হিমসাগরে বাঘের মতো খ্যাঁক করে কামড় বসাতেন।

মা ডাকতেন, খোকা আয়।

খোকার খাবার সময় হয়েছে। পোস্ত আর ভাত, ভাত আর পোস্ত। খেতে খেতে সেজকার খাওয়ার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠত। হাঁচোর—পাঁচোর করে আমের আঁটি পাকলাচ্ছেন। কনুই বেয়ে রস নেমে আসছে। হাত ঘুরিয়ে জিভ দিয়ে চেটে নিচ্ছেন।

সেজকা খেয়ে উঠলেন, বাঁ হাতে কাপড়ের কষি ধরে আছেন। সর্বাঙ্গ ঘামে ভেজা। নিচু হয়ে ঘটি তুলতে পারছেন না। কোনোরকমে হাত ধুয়ে, চৌকিতে চিৎ হয়ে পড়লেন। এ যাত্রা যদি বেঁচে যান, তাহলে, রাতে আবার গরম গরম ফুলকো লুচি।

গরিবের হঠাৎ পয়সা হলে, স্বভাব, হালচাল সবই খুব গরম হয়ে ওঠে। সেজকার তখন খুব সময় ভালো যাচ্ছিল। বাজারের কাছে, সাইকেল, সাইকেল রিকশা আর টায়ার টিউবের দোকান। দোকানের খুব বোলবোলা। আর কোনো দোকান তখন ছিল না। পাশাপাশি চলেছে ইনসিওরেন্সের দালালি। সেজকার ইচ্ছে পুরো বিষয়টা একা গ্রাস করেন। জ্যাঠামশাইয়েরটা কিনে নিয়েছেন। আর দুই কাকা বেকার। বললেই নিজেদের অংশ বেচে দেবে। আমাদের অংশটা খাবলাতে পারলেই গ্যাঁট হয়ে বোসো। পুরোনো ভেঙে ফেলে ইচ্ছেমতো তলার ওপর তলা তোলো।

ফিকিরে লোকের বিধবার সম্পত্তি মারতে কদিন সময় লাগে। বাঘ যদি মনে করে মানুষ খাবে, সে তো মারবে ঘাড়ে লাফ। টুক করে তুলে নিয়ে সরে পড়বে। সেজকা আসলে প্ল্যান ভাঁজছিলেন। শ্রাদ্ধশান্তি চুকেবুকে যাক, শোক একটু থিতোক, তারপর ফাঁস চালাব বিধবার গলায়। মরে গেলে মানুষের আর কী থাকে? অসহায় গোটাকতক প্রাণী পড়ে থাকে। তারা নিজেদের সামলাবে, না শত্রু সামলাবে।

সেজকা একদিন সন্ধের দিকে বললেন, বউদি, তোমার জন্যে বড়ো চিন্তা হয়। এই অল্পবয়সে বিধবা হলে। ছেলেটা নাবালক।

মা বললেন, তারপর?

সেজকা বেশ একটু ঘাবড়ে গেলেন। আর কথা খুঁজে পাচ্ছেন না।

মা তাড়া দিলেন, থামলে কেন ঠাকুরপো, বলে ফেলো।

না, ভাবছিলুম, তোমাদের কীভাবে চলবে?

তোমাকে ভাবতে হবে না। শরীর খারাপ হবে।

একটা কথা।

হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি, সেই কথাটায় এসে পড়ো।

দাদার কিছু ধার ছিল।

কার কাছে?

আমার কাছে। আমি চাইতুম না।

তাহলে চাইছ কেন?

ক—দিন হল, পরপর ক—দিন, বড়ো দুঃস্বপ্ন দেখছি। দাদার আত্মা কেঁদে কেঁদে ঘুরছে। বলছে বড়ো কষ্ট, বড়ো কষ্ট।

কীসের কষ্ট?

আমাকে উদ্ধার কর বিকাশ, আমাকে উদ্ধার কর। তোর বউদিকে বল, ধারটা শোধ করে দিক।

তুমি তোমার দাদাকে ধার দিয়েছিলে, এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে? যার হাত দিয়ে এক পয়সা গলে না!

আমি জানতুম তুমি এইসব বলে উড়িয়ে দেবে। তোমার মতো চালু মহিলা, এ শহরে আর দুটো নেই।

ঠিক ধরেছ ঠাকুরপো। ও টাকাটা তোমার গেল।

দাদা তাহলে ভূত হয়ে ঘুরবে।

ঘুরুক না। খারাপ কী? ভূতও যা ভগবানও তাই। এবার এলে বোলো, তোমার বউকে বলো।

আচ্ছা দজ্জাল মেয়েমানুষ তো?

সেজকাকিমা দরজার পাশে কান খাড়া করে লুকিয়েছিলেন, বললেন, তুমি আজ বুঝলে?

সেজকা বললেন, কী মেয়েমানুষ দ্যাখো মাইরি? বলে কিনা ভূত হয়ে ঘুরুক।

তুমি চলে এসো, আইনের সাহায্য নিতে হবে, আদালত ছাড়া আদায় হবে না।

হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।

সেদিনের মতো সেজকা চলে গেলেন। গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচির গন্ধ ভাসতে লাগল বাতাসে। মা বললেন, খোকা তৈরি হ। এরা খুব শিগগির আমাদের ভিটেছাড়া করবে।

বিপদের মধ্যে থাকলে, বিপদ আর তেমন করে ভয় দেখাতে পারে না। কোন মহাপুরুষ যেন বলেছিলেন, বিপদ আমার জীবনের শ্বাসপ্রশ্বাস। সেজকা আর আমাদের কী করবেন? বড়ো জোর ভিটেছাড়া করবেন। করুক না, এতবড়ো পৃথিবীতে আমাদের একটু ঠাঁই হবে না?

মা বলেছিলেন, খোকা, তুই আমাকে কথা দে, বাপ—মরা ছেলেরা ভেসে যায়, তুই আমার কথা শুনে চলবি? তুই আমাকে ভালোবাসিস কি না আগে বল।

বাবা মারা যাবার পর মাকে আমি ভালোবাসতে শিখেছি। বললুম, হ্যাঁ বাসি।

তাহলে কথা দে, জীবনে কখনো বিড়ি—সিগারেট খাবি না, কুসঙ্গে মিশবি না, আর আমি যা বলব তাই করবি। তথাস্তু।

আর একটা অনুরোধ, দয়া করে কোনো বাজে মেয়ের পাল্লায় পোড়ো না। সময় হলে, আমি নিজে পছন্দ করে, ভালো মেয়ের সঙ্গে তোর বিয়ে দোব।

বিয়ের কথা উঠছে কেন?

তোর একটু বিয়ের বাতিক আছে।

সে অনেক দিন কেটে গেছে মা। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

মায়ে ছেলেতে সেই যে বোঝাপড়া হয়েছিল, তা কিছু কিছু এখনও আমি মেনে চলি। চরিত্র যতটা খারাপ হবার কথা ততটা হয়নি। যখনই গেল গেল হয়েছে তখনই মা এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। ফিসফিস করে বলেছেন, খোকা ঠিক থাক, বেচাল হসনি বাবা।

এক সাধক আমার মুখ দেখে বলেছিলেন, ঘাবরাও মাৎ বেটা! তোমার ভেতর তোমার মা আছেন। মায়ের একটা বড়ো বাক্স ছিল। সেই বাক্সে আমাদের যাকিছু সম্পত্তি। মা মঝে মাঝে অল্প খুলতেন, আর একটা করে চুড়ি কী আংটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বলতেন, সাবধানে, পেট—কাপড়ে নিয়ে বিধু স্যাকরার দোকানে চলে যা।

আমাকে দেখলেই বিধুবাবুর মুখে হাসি ফুটত। এসো বাবা এসো। কত সোনা, কী যে তার দাম, তিনিই জানতেন। গুনে গুনে টাকা দিতেন। মনে হত খুব বড়োলোক হয়ে গেছি। নাচতে নাচতে এসে মাকে টাকাটা দিতুম। তাইতেই কিছুদিন, চাল ডাল তেল নুন হত।

এদিকে কাকার দল ভূতের নৃত্য শুরু করে দিলেন। মাকে বলতে লাগলেন মাগি। ওঁচা ওঁচা লোক জুটিয়ে উঠোনে বসে হইহল্লা, খিস্তি—খেউড় চলতে লাগল। কুয়োতলায় যাবার উপায় রইল না। মানুষের মাথা নয়তো শয়তানের কারখানা। একদিন আমাদের ঘরে চোর পড়ল। রাতে মায়ের ঘুম হত না।

আমাকে ফিসফিস করে ডাকলেন, খোকা ওঠ। খোকা ওঠ।

বাইরে অমাবস্যার অন্ধকার রাত। ভূতের মতো ছায়ামূর্তি জানলার গরাদ সরাচ্ছে। মশারির ভেতর বসে মা আর ছেলে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলুম, চোর চোর।

চোর ধমকে উঠল, চুপ কর মাগি।

গলাটা খুব চেনা। আমরা আরও জোরে চেঁচাতে লাগলুম, চোর চোর। বিধু স্যাকরার বরাত জোর, চোর পালাল। দুটো গরাদ দুপাশে বাঁকিয়ে ফেলেছে। মা জেগে না থাকলে সব ফাঁক হয়ে যেত। বাকি রাত জেগেই কেটে গেল। ভোরবেলা মা বললেন, না, আর এখানে থাকা যায় না।

সকালে সেজকা বলতে লাগলেন, কাল, মেজদা এসেছিলেন। ভূত অনাচার সহ্য করতে পারে না। যদ্দিন না ও মাগি ধার শোধ করছে, তদ্দিন এরকম চলতেই থাকবে।

সারা দিন ধরে, পিল পিল করে লোক আসতে লাগল। বাবার ভূত কীভাবে জানলার গরাদ বাঁকিয়েছে দেখবে। আমাদের রান্না খাওয়া বন্ধ। সেজকা কোমরে গামছা বেঁধে, তীর্থের পাণ্ডার মতো, উঠোনে ঘুরতে লাগল, আর দেখাতে লাগল, এই যে, এই যে এই জানলা। ওই খাণ্ডারি মাগি যদ্দিন না আমার টাকা শোধ করছে, তদ্দিন দাদা ভূত হয়েই থাকবে।

মা আমাকে বললেন, হাতের কাছে একটা খ্যাংরা পেলে লোকটাকে বেশ করে ঝেঁটাতুম। এমন শয়তান আর ফিকিরে মানুষ, খুব কম দেখা যায়।

আমাদের সামনে এখন দুটো পথ, হয় ছেড়ে চলে যাওয়া, নয় কামড়ে পড়ে থাকা। কী করব, তুই এখন বল?

সেই বয়সেই বুঝেছিলুম, সবরকম পশু একসঙ্গে করে ঈশ্বর মানুষ তৈরি করেছেন। সাপ, ব্যাঙ, বাঘ, সিংহ, ভেড়া, ছুঁচো, ইঁদুর। একই মানুষ, কেউ দেবতা, কেউ শয়তান। কেউ জ্ঞানী ব্রহ্মা, কেউ বোকা পাঁঠা।

এখানে আমার মন টিঁকছে না। চলো চলে যাই। এমন জায়গায় চলো যেখানে দুটো ভালো লোক আছে।

দাদু এসে সেজকাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী চাইছ বিকাশ? বিধবা আর এক নাবালককে পথে বসাতে চাও, ধর্মে সইবে?

সেজকা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, বিষয়ীর বিষয়ই ধর্ম মুকুজ্যে মশাই। বউদি সংসারে থাকবে, কাজ করবে, খাবেদাবে। অবশ্য যখন যেমন জুটবে। আর ছেলেটাকে আমি দোকানে রাখছি, কাজটাজ শিখুক। এ লাইনে কাজ শিখলে রোজগারের অভাব হবে না। কিন্তু হ্যাঁ, একটা কথা, দাদার অংশটা আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। কাগজে কলমে একটি না—দাবি—মুচলেকা লিখে দিতে হবে।

কী কারণে বিকাশ?

আমি চাইছি বলে। দেবতা যদি ভোগ চায়, মানুষের সাধ্য কী, না দিয়ে পালায়।

তুমি তো বাপু আইনের কিস্যুই বোঝো না।

আইন আবার কী? আইন তো আমাদের হাতে। আমরা না চাইলে, বউদির বাপের ক্ষমতা হবে, এখানে থাকার। বাপ বাপ বলে পালাতে হবে।

বাপ তো সামনে বসে আছে বিকাশ। লড়াই যদি চাও লড়াই—ই হবে।

তবে তুমি হারবে। আইনের কিছু বোঝো?

বললুম তো, আইনের আমি ধার ধারি না। আমিই আইন।

তাহলে শোনো, তোমাদের এটা যৌথ সম্পত্তি। এর ভাগবাঁটোয়ারা হবে আদালতের হুকুমে। পিতার অংশ পাবে পুত্র। পুত্র এখন নাবালক। সে আগে সাবালক হোক, তারপর তোমার সঙ্গে দেখা হবে আদালতে। তার আগে যতই তুমি লেখালেখি করাও আইনে ফাঁক থেকে যাবে।

আমাকে তাহলে অন্য রাস্তায় যেতে হবে। আর সে রাস্তাটা তেমন সুবিধের নয়।

যে রাস্তাতেই যাও, আইন বিধবার দিকে, নাবালকের দিকে।

এ বছর আমি পঞ্চায়েত ইলেকশানে নামছি।

নামো। পয়সা আছে নামবে। তবে হেরে ভূত হবে। মানুষ তো আর ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না।

দেখা যাক। মানুষ কীসে মুখ দিয়ে চলে তখন প্রমাণ হবে।

সেজকা যেন একেবারে অচেনা মানুষ। উঠে চলে গেলেন। দাদু বলে গেলেন, তোরা ভয় পাসনি। যারা অন্যায় করে তারা জানবি সবচেয়ে ভীরু আর কাপুরুষ হয়। এক ধমকেই তারা পিছিয়ে যায়।

মায়ের মুখে তেমন হাসি ফুটল না। মা বলছিলেন, ধর্মের যুগ শেষ হয়ে গেছে। এখন জোর যার মুল্লুক তার। তোকে নিয়েûই আমার ভয়। আদি খুনটুন করে। এরা সব পারে। এদের শরীরে ডাকাতের রক্ত। তুই এখন আর হুটহাট বাড়ির বাইরে যাবি না। যেতে হলে আমার সঙ্গে যাবি।

মানুষ মানুষকে খুব বেশিদিন সুস্থির থাকতে দেয় না। সংসারে মানুষের বেশিরভাগ পরিকল্পনায় ওই জ্বালিয়ে আর পুড়িয়ে মারার দিকটাই মাত্রায় বেশি। সেজকা যে কত শয়তান, বোঝা গেল সাতদিন পর। ভূষণকাকার বাড়িতে সত্যনারায়ণ ছিল। প্রসাদটসাদ খেয়ে, আমি আর মা দুজনে ফিরছি। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আকাশে। চারপাশে জোছনার ফিনিক ফুটছে। দুজনে গল্প করতে করতে ফিরছি। বক্সিদের ধানকলের সিমেন্ট বাঁধানো চাতাল চাঁদের আলোয় যেন হাসছে। চিমনিটা আকাশের গায়ে খাড়া সেপাই যেন। হাঁটতে হাঁটতে বুড়ো বটতলা রাস্তায় একঝাঁকা পাতার ছায়া উলটে পড়ে আছে।

হঠাৎ কোথা থেকে মুশকো মতো দুটো লোক এসে, দু—পাশ থেকে মায়ের দুটো হাত চেপে ধরল। সুন্দরী?

আমার মা সত্যিই সুন্দরী ছিলেন। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলুম। লোক দুটো অচেনা, ডাকাতের মতো দেখতে, মায়ের কিন্তু ভয় নেই।

মা ধীর শান্ত গলায় বললেন, ও ছেলে, বিকাশকে বলো, আমরা আজকালের মধ্যে চলে যাব বাবা। তোমাদের আর কষ্ট করতে হবে না। আমি কি সত্যিই সুন্দরী! না আমার সে বয়েস আছে। এই নে তোরা মায়ের আশীর্বাদ নে। তোদের মঙ্গল হবে। মেয়েছেলে অনেক পাবি, মা পাবি না রে।

সেই গুন্ডামার্কা লোক দুটো কেমন যেন হয়ে গেল। হাত ছেড়ে দিয়ে হাত জোড় করে মায়ের সামনে দাঁড়াল। দুই ভক্ত যেন মাকে পুজো করছে। মা আঁচলের গেরো খুলে গোটাকতক বাতাসা বের করে সেই অসুরদের হাতে দিয়ে বললেন, নে নে, প্রসাদ খা। প্রসাদ। তোদের মঙ্গল হবে।

শনশন করে বাতাস বইছে। পাতার সঙ্গে ছায়া কাঁপছে। লোক দুটো বাতাসা খেয়ে জয় মা, জয় মা বলে মাঠ ভেঙে পশ্চিমে হাঁটা দিল। ওরা চলে যেতেই আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলুম। কী হতে পারত, আর কী হয়ে গেল। পশু থেকে দেবতা?

তুমি কী করে দিলে মা?

কিছু না, আত্মসমর্পণ। এই বিশ্বচরাচরের যিনি মালিক, যিনি চাঁদের আলো, যিনি অমাবস্যার অন্ধকার, যিনি মানুষ, তিনিই আবার পশু, তাঁকেই ডেকে বললুম, ধর্ম রক্ষা করো। তুমি ছাড়া আমার কে আছে!

তুমি এসব শিখলে কোথা থেকে মা?

মা সেদিন বলেছিলেন, বিপদই মানুষের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষক।

দাদু এসে সব শুনলেন। শুনে বললেন, বড়ো বিপদ হল, তোরা এখন যাবি কোথায়! আমি তো পড়ে আছি, এক পড়তি জমিদারের সেরেস্তায়। সেখানে তোদের নিয়ে যাই কী করে!

সেই ছেলেবেলায় মা বলতেন, রাখে কেষ্ট মারে কে, মারে কেষ্ট রাখে কে। এই প্রবাদটি যে কত সত্য জীবনে বারেবারে টের পেয়েছি। হঠাৎ রাত দশটা নাগাদ, বলা নেই কওয়া নেই, কলকাতা থেকে আমার মামা এসে হাজির হলেন।

বন্ধ দরজায় টুকুস টুকুস করে টোকা শুনে মা বললেন, আগেই খুলো না।

জিজ্ঞেস করো, কে?

উত্তর এল, বি.টি.এম.।

বি.টি.এম. আবার কে?

গ্রেট ভবতারণ মুখার্জি?

আমার একমাত্র মামা, বড়ো অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ ছিলেন। জীবন নিয়ে তাঁর বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। অনেকটা সিংহের স্বভাব। পয়সা ফুরোলে তবেই রোজগারের চেষ্টা করতেন। নইলে পড়ে রইলেন অজগরের মতো চিৎপাত হয়ে।

গ্রেট ভবতারণ মুখার্জিকে পেয়ে মা আশার আলো দেখলেন। ঠিক হল, আমরা কলকাতায় মামার কাছে চলে যাব।

মামা বললেন, তোর এই আমবাগান লিচুবাগান, ভাঙা দালান, এর কোনো দাম নেই। পাঁচটা ভাগ হলে তোর ভাগে পড়বে, ছটাকখানেক। উড়ো খই গোবিন্দায় নম করে সরে পড়।

প্রায় মাঝরাত অবধি জল্পনা—কল্পনা চলল, সঙ্গে কী নেওয়া হবে। কিছু জামাকাপড়, অবশিষ্ট কিছু গহনা, বাবার একটা ছবি, ছিপ আর হুইল।

ছিপ নিয়ে তর্ক—বিতর্ক প্রায় শেষরাত পর্যন্ত চলল। মায়ের যুক্তি, যে মাঝধরার জন্যে সারাজীবন এত ঝগড়া, সেটা একটা বড়োরকমের স্মৃতি।

বাঙালিরা স্মৃতি স্মৃতি করেই গেল, বলে, গ্রেট বি.টি.এম. শেষে রাজি হলেন।

দশটা না এগারোটার সময় ট্রেন। বেরোবার সময় সেজকা বললেন, যাক শেষ পর্যন্ত বোধোদয় হল। ছেলেটাকে ভালো করে মানুষ করার চেষ্টা কোরো বউদি। আসল সম্পত্তি হল সন্তান। এখানে পড়ে থাকলে ও মানুষ হবে? কী রে প্যালা, কলকাতায় গিয়ে ভালো করে লেখাপড়া শিখে মানুষ হবি তো! বাবার মুখ রাখিস বাবা।

জ্ঞানের কথা সহজে বলতে পারে বলেই মানুষ মানুষ। সেজকা কত সহজে কত সহজ কথা বললেন। মুখে একটুও আটকাল না। মামা বললেন, ভাগনে, ডায়েরিতে পরে লিখে রাখিস। জ্ঞান আর পয়সার ধর্মই হল হারিয়ে যাওয়া। তোকে আমি সব শিখিয়ে দোব। মেরা চ্যালা বন যাও বেটা।

বিশাল বাক্সপ্যাঁটরা ঘাড়ে করে আমরা স্টেশনে এলুম। একই সঙ্গে আনন্দ আর দুঃখ হচ্ছে। কেবলই মনে হতে লাগল, যাবার আগে ভাঙা শিবতলাটা যদি একবার ঘুরে যেতে পারতুম। যেখানে বাবা আমার শেষ শয্যায় শুয়েছিলেন। যেখানে মৃত্যুর পরেও বাবা আমাকে দর্শন দিয়েছিলেন।

স্টেশনে লোক থইথই করছে। মা বললেন, কী হবে রে ভব? এতটা পথ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে?

মামা হাসলেন, দিদি, তুই যাচ্ছিস বি.টি.এমের সঙ্গে। তোদের আমি বসিয়ে যদি নিয়ে যেতে না পারি আমার নাম ভবতারণ নয়। ফিকিরে না হলে এ পৃথিবীতে বাঁচা যায় না। ভাগনে তোকে একটা কাজ করতে হবে।

বলো মামা!

আমি যেখানে গিয়ে দাঁড়াব, তুই সেখানে গিয়ে দাঁড়াবি, তারপর হঠাৎ ডান হাতটা সামনে পেতে দিয়ে বলবি, মামা, দেখ তো, যে কাজে যাচ্ছি, সে কাজটা হবে কি না! ব্যস, এইটুকু, বাকি খেল আমার।

ট্রেন এসে গেল। লোকে লোকারণ্য। হুটোপাটি করে আমরা ট্রেনে উঠলুম। কোনোরকমে দাঁড়ানো যায়। বসার জায়গা নেই। একটা লম্বা সিটে জনাচারেক বয়স্ক ভদ্রলোক বসেছিলেন। মামা আমাদের নিয়ে গম্ভীর মুখে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। মা ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। মাঝে মাঝে টাল খেয়ে পড়ে যাবার মতো হচ্ছে।

মামা চোখের ইশারা করলেন। তার মানে, বলে ফেল।

বেশ হেঁকে ডাকলুম, মামা!

বল।

হাতের তালুটা পেতে বললুম, একবার দেখবে, যে কাজে যাচ্ছি, সে কাজটা হবে কি না?

ধ্যার, ব্যাটা, এই ট্রেনে কেউ হাত দেখে! কলকাতায় গিয়ে দেখে দোব।

মনটা যে জানার জন্য বড়ো ছটফট করছে মামা!

করুক। বেঁধে রাখ। তোর এখন মঙ্গলের দশা চলছে। মন ছটরফটর করবেই। মায়ের নাম কর, মায়ের নাম।

লম্বা আসনে বসে থাকা এক ভদ্রলোক টোপটি গিললেন, আপনি, হাত দেখতে জানেন স্যার!

মামা গম্ভীর মুখে বললেন, ছ—বছর বিলেতে ছিলুম কি ঘাস কাটতে? আমার কথা শুনলে মহাত্মাজি কি আততায়ীর গুলিতে মরতেন!

আর তিনজন চোখ বুজিয়েছিলেন, তাঁরা চোখ খুললেন, একটু চেপে চেপে বসে ওকে বসতে দাও না।

একজন বললেন, ওনার ফাসক্লাসেই যাওয়া উচিত।

মামা হাসি হাসি মুখে বললেন, ফাসক্লাসে মানুষ কই। ভারত পড়ে থার্ড ক্লাসে। আমার গবেষণার জন্যে, আমাকে মানুষের কাছেই যে থাকতে হবে। গুরুর নির্দেশ।

আপনার গুরু কে স্যার?

আমার গুরু, জার্মানির এক যোগী, ভন পেপেন। আলপস পাহাড়ের এক গুহায় থাকেন। ওয়্যারলেসে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। গভীর রাতে।

দুপাশেই রব উঠল, সরে বোসো, সরে বোসো।

সব জায়গাতেই জায়গা থাকে। মানুষ সহজে কিছু দিতে চায় না। নিতে হয়। মামা বলতেন, ভালোভাবে বাঁচতে হলে, ভালো করে নিতে শেখ। একটাই শুধু শব্দ, আদায়।

আমরা তিনজনেই বসার জায়গা পেয়ে গেলুম। মামা বসলেন মহারাজার মতো। একটা পায়ের ওপর আর একটা পা। চোখ কপালে তুলে মেঘগর্জনের গলায় বললেন, জয় গুরু।

পাশের ভদ্রলোক উসখুস, উসখুস করে ডান হাতের পাতাটি মামার চোখের সামনে মেলে ধরলেন। এইবার মামা মরবেন। গুরুই নেই তো জয়গুরু। আড়চোখে হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, যা ভাবছেন, তা হবে না।

ভদ্রলোক বললেন, সে কী, আমি যে বড়ো আশা নিয়ে যাচ্ছি। না হলে যে বিপদে পড়ে যাব।

এখনও তিনটি বছর, তার আগে কিস্যু হবে না। যতই চেষ্টা করুন।

ভদ্রলোক কেমন যেন চুপসে গেলেন। আবার একটা কী প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, সামনের ভদ্রলোক ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজের হাতটি পেতে দিলেন।

মামা আড়চোখ চেয়ে বললেন, ফসকে যাবে। রাখতে পারবেন না বড়ো শক্ত জিনিস। আপনার সে মুরোদ নেই।

অ্যাঁ, সে কী! আমি যে আশায় আশায় আজ ছ—বছর ঘুরছি।

ওই তো বললুম, হবে না আপনার টিকি অন্য জায়গায় বাঁধা। এক বছর পরে টের পাবেন।

তৃতীয় ব্যক্তি মামার সামনে হাত ফেলতেই, মা আর্তচিৎকার করে উঠলেন, না, না। সকলেই চমকে উঠলেন। মামাও ভয় পেয়ে গেছেন।

বললেন, কী হল দিদি!

মা সামলে নিয়েছেন, না, কিছু না, এমনি।

ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। তিনি মামাকে ছেড়ে, মাকে ধরলেন। বলুন মা, কী আপনি দেখলেন?

কেন আপনি না না করে উঠলেন?

মা যত পাশ কাটাতে চান, ভদ্রলোক তত চেপে চেপে ধরেন। শেষে মা বললেন, আপনার রাগ বড়ো বেশি।

হ্যাঁ মা, ঠিক বলেছেন।

সেই রাগের বশে খুব শিগগিরি তুমি বাবা একজন কাউকে খুন করে ফেলবে। আমি যেন সেই দৃশ্যই দেখলুম।

কী যে বলেন, বলে ভদ্রলোক মুখ ভার করে একপাশে সরে গেলেন।

মায়ের এই ভবিষ্যদ্বাণীর পর আর কারুর হাত দেখাবার সাহস হল না।

ঘণ্টা ছয়েক পরেই বিরাট শহর কলকাতা আমাদের গ্রাস করে নিল। ট্রাম, বাস, লোকজন, হইহল্লা, ঠ্যালাঠেলি। জেলা শহরের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল।

মামা গাড়িতে বসে গেলেন, আমার ডেরাটা ঠিক প্রপার ক্যালকাটায় নয়, বুঝলি প্যালা। শহরের একপাশে, বেশ খোলামেলা, তোদের ভালো লাগবে। দিদি, তোর কাছে দু—একটা টাকা হবে তো।

মা বললেন, তা হবে।

তাহলে ধার হিসেবে দিয়ো। পরে শোধ করে দোব।

কত চাই?

এই গোটা দশেক। এ মাসটা টানাটানি যাচ্ছে।

আঁচলের গেরো খুলে মা দশটা টাকা দিলেন।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, মামা, তুমি কী করো?

ভ্যারাইটিজ, ভ্যারাইটিজ। যখন যেটা সুবিধে হয়। কলকাতায় টাকা ওড়ে জানিস তো, লাইক বাটারফ্লাই। ব্যাঙের মশা ধরার মতো কপাৎ কপাৎ করে ধরো আর নবাবী করো।

তুমি কি হাত দেখা জানো?

একেবারেই না।

তাহলে ট্রেনে ওসব বলছিলে কী করে?

কিছুই তো বলি না। যারা হাত পাতছিল, স্রেফ তাদের মুখ চোখ আর বয়েসটা দেখছিলুম। সবসময় জানবি, যারা হাত দেখায়, তাদের কিছু না কিছু একটা আটকে আছে। আর যা আটকে যায় তা সহজে খোলে না। শিশির ছিপির মতো। প্যাঁচ ঘুরে গেলে আর খোলা যায় না। কেটে খুলতে হয়। ভাগ্য তো আর কাটা যায় না। বেগোড়বাঁই হলে বেগোড়বাঁই—ই হয়ে থাকে। এই সহজ ব্যাপারটা বুঝিস না কেন? কিন্তু দিদি, তুই অমন, না না করে উঠলি কেন? তোর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো পাওয়ার এসেছে।

মা বললেন, তা জানি না, তবে আমি স্পষ্ট দেখলুম, লোকটি একটি মেয়েমানুষকে খুন করছে।

সত্যি দেখলে? কী করে দেখলে?

যেভাবে লোকে সিনেমা দেখে।

তোমার এই পাওয়ারটাকে কাজে লাগাতে পারলে, আমরা রাজা হয়ে যাব। আচ্ছা এখন তুমি ওইরকম কিছু দেখতে পাচ্ছ?

না। এখন তোরাও যা দেখছিস আমিও তাই দেখছি।

কোথা দিয়ে, কোথা দিয়ে যে গাড়িটা চলে এল! বেশ চওড়া মতো একটা রাস্তা দিয়ে এসে, গাড়ি ডাকদিকে বাঁক নিল। সে রাস্তাটা তেমন চওড়া নয়। ঢোকার মুখে একটা কাঠের গোলা। একটা টংঘর। ছবিতে দেখা শিকারিদের মাচার মতো। বড়ো বড়ো শালের গুড়ি, লম্বা লম্বা বাঁশ, আকাশের দিকে হাত তুলে যেন সংকীর্তন করছে।

সেই রাস্তাই আরও সরু হতে হতে বাড়ির উঠোনের মতো চওড়া তিনকোণা একটা জায়গায় আসতেই মামা বললেন, রোককে, রোককে। জলভাগ পরিবেষ্টিত ভূভাগকে দ্বীপ বলে। বাড়ি পরিবেষ্টিত ভূভাগকে কী বলে?

মামার বাড়িটা বেশ মজার। হলদে রঙের দোতলা বাড়ি। কম বড়ো নয়। ফলাও। নিচে ছ—খানা ঘর, ওপরে ছ—খানা ঘর। পেছন দিকে কিছুটা জায়গা। তার পরেই সীমানা পাঁচিল। বাড়িটা একটু লম্বাটের ধরনের। একপাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। নিচের তলায় মামার আস্তানা। ওপর তলায় বাড়িঅলা। ওপর তলায় কেউ থাকেন বলে মনেই হয় না। পায়ের শব্দ নেই। গলার শব্দ নেই।

মামা বললেন, আমাদের তিনজনের জন্যে অঢেল জায়গা, কী বলো দিদি?

মা বললেন, চমৎকার বাড়ি।

মামা বললেন, একটাই যা বিপদ হয়ে আছে, দু—মাস ভাড়া দিতে পারিনি। ঘাড় ধরে তুলে না দেয়।

তুই তাহলে কিছুই রোজগার করিস না ভব!

কলকাতার একটাই দোষ দিদি, যখন হয়, তখন খুব হয়, ভগবান একেবারে ছপ্পর ফুঁড়ে দেন। আবার যখন হল না তো একেবারে হল না। বৃষ্টির মতো। আর টাকার স্বভাবই হল, মানুষের চরিত্রের মতো, ধরে রাখা যায় না।

তুই যে শুনেছিলুম, কী একটা চাকরি করতিস।

ধুর, সে চাকরি মাস দুয়েকও টিকল না। ফাটাফাটি হয়ে গেল। আমাদের বংশে কেউ কখনো চাকরি করেছে! চাকরি করতে গেলে চতুষ্পদ হতে হয়।

আমাদের তাহলে চলবে কী করে ভব?

সে তুমি ভেবো না দিদি। বাণিজ্য করব, বাণিজ্য। বাণিজ্যে লক্ষ্মী লাভ হবে।

মামার কথায় মা খুব হতাশ হয়ে পড়লেন। দু—মাসের ভাড়া বাকি, রোজগার নেই। মা সেই কথায় কথায় বলতেন, টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে তেঁতুল তলায় বাসা। মায়ের মুখ দেখে সেই কথাই মনে পড়ল।

মা ভাবতে লাগলেন, আর মামা চৌকিদারের মতো বারান্দায় পায়চারি শুরু করলেন। যেন এদিক থেকে ওদিকে বীরের মতো পায়চারি করলেই, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

মা ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, এসব কথা তুই আগে বলিসনি কেন? তাহলে কখনো আমরা তোর ঘাড়ে এসে চাপতুম না।

মামা বললেন, ধীরে রজনি, ধীরে। বিপদে কখনো মাথা গরম করবে না। জটপাকানো সুতো কীভাবে খুলতে হয় জান? ঠান্ডা মাথায়, ধীরে ধীরে, একটু একটু করে।

এইসব কথা যখন চলছে, তখন খুব সুন্দরী এক মহিলা, বয়েস বেশি নয়, চুল এলো করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। ঠিক যেন পরির মতো। বেশ একটা চাঁপাফুল, চাঁপাফুল শাড়ি পরা। মহিলা আমাদের দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছেন। মা আর মামা নিজেদের কথায় ভীষণ ব্যস্ত।

আমাদের দিকে একনজরে চেয়ে আছেন। বেশ ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলুম, মা।

মহিলা খিলখিল করে হেসে উঠলেন, অ্যা মা, কী ভীতু ছেলে।

মামা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, তুমি আবার নেমে এলে কেন?

বাঃ, নামব না, আপনি কাদের নিয়ে এলেন দেখব না।

আমার দিদি আর ভাগনে।

ওমা, তাই নাকি! মহিলা প্রজাপতির মতো লাফিয়ে সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে নেমে এলেন।

মেয়েটিকে দেখে মায়ের চোখ কপালে উঠে যাবার জোগাড়। মন মনের সঙ্গে কথা বলে উঠল, ওরে প্যালা এ সেই সিনেমার মেয়েরে! গাছের ডাল ধরে, চাঁদিনি রাতে দুলে দুলে গান গেয়ে ওঠে, আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে, আমি বনফুল গো!

ঝুলনের মেলায় পুতুল দিয়ে মহাভারতের কথা সাজাত। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দৃশ্য। দুঃশাসন সামনে ঝুঁকে, দুদিকে দুহাত মেলে, দ্রৌপদীকে ধরতে যাচ্ছে। আর সব রাজারা হাঁ করে দেখছে। মামা এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, যেন সেই দুঃশাসন, দ্রৌপদী হাত ফসকে মায়ের দিকে পালিয়ে গেছেন।

মহিলা মায়ের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, বাঃ, আপনাকে ঠিক আমার মায়ের মতো দেখতে। ভালোই হল, মায়ে ঝিয়ে থাকব দুজন। ভবদাটা ভীষণ ভবঘুরে। এইবার তুমি মরবে। মায়ের হাতে টাইট হবে।

মায়ের কপালে উঠে যাওয়া চোখ নেমে এসেছে। চোখ চিরকালের মতো কপালে ওঠে সেই শেষ বায়ুটি বেরিয়ে যাবার পর। তার আগে ওঠে আর নামে। মা বললেন, তোমার নামটি কী মা?

আমার নাম রাধা।

মা কেমন যেন চমকে উঠলেন। সেই চমকে মা আবার কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। সেই উদাসভাবে দু—চারটে কথা বলে ঢুকে গেলেন। মামা চলে গেলেন রাধাকে ওপরে তুলে দিতে। রাতের দিকে মা মামাকে চেপে ধরলেন, ভব আর কেনোমতেই তোমার এখানে থাকা চলবে না।

আমার মামা ভীষণ ছটফটে। এক জায়গায় চুপ করে কিছুতেই বসতে পারেন না। সারা ঘরে ডিঙি মেরে ঘুরতে ঘুরতে বললেন, কারণ?

তুমি আইবুড়ো ছেলে। তোমার বদনাম হবে। তাছাড়া ওর নাম রাধা।

রাধা তো কী হয়েছে?

কী হয়েছে! রাধা আর কৃষ্ণ, ভুলে গেলি সে কাহিনি। মেয়েটি করে কী? ওপরে একলা থাকে?

না, ওর মা আছে।

কই একবারও তো সাড়াশব্দ পেলুম না।

পাবে কী করে? পক্ষাঘতে পঙ্গু।

সংসার চলে কী করে?

সে অনেক ব্যাপার। জানতে পারবে আস্তে আস্তে।

থাক আর আমার আর জেনে দরকার নেই।

শোন দিদি এর নাম শহর কলকাতা। এখানে থাকতে হলে সাধকের মতো থাকতে হয়। বেশি নাক সিঁটকোলে শহর লাথি মেরে দূর করে দেয়।

মা শুধু বললেন, হুঁ।

মামা বললেন, আজ আর রান্নার হাঙ্গামা করে কাজ নেই।

মা বললেন, তোর কিছুই তো নেই, হাঙ্গামা করতে চাইলেই কি করা যাবে? করলে করা যায়, তবে থাক, কাল থেকেই হবে। আজ কচুরি পথ্য হোক।

কলকাতার হিংয়ের কচুরি সেই প্রথম খেলুম। আহা কী জিনিস! মনে হল সারাজীবন কচুরি খেয়েই থাকব। জলটল খেয়ে দোর তাড়া দিয়ে শুয়ে পড়া গেল। মা জেগে বসে আছেন বিছানায়। আমার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। মামা মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। শহর যে কখন শান্ত হবে। চারপাশে শব্দের খই ফুটছে। আশেপাশের সবাই কি সারারাত জেগে থাকবে।

রাত তখন ক—টা হবে কে জানে? চেঁচামেচি, চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল।

মা ডাকছেন, ভব, ওঠ ওঠ। বোধহয় ডাকাত পড়েছে।

মেঘ গর্জনের মতো গলায় কে যেন ডাকছে, ভব, ভব, অ্যায় গাধা ভব, রাসকেল ভব।

মামা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন, যাবার সময়, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গেলেন। মা, আমাকে ফিসফিস করে বললেন, দরজাটা অল্প একটু ফাঁক করে দ্যাখ তো, কী হচ্ছে বাইরে।

একেবারে, অবিকল মহাদেবের মতো একজন মানুষ, যেমন তার বিশাল চেহারা, তেমনি তার রঙ। অন্ধকারেও যেন জ্বলছে। শরীর যেন অল্প অল্প টলছে। একহাতে একটা ব্যাগ ঝুলছে। বেশ ভারী। মনে হয় ব্যাগে অনেক কিছু আছে।

মামা বলছে, মহীদা, চ্যাঁচাচ্ছেন কেন, আস্তে আস্তে।

আস্তে, শালা, মহীতোষ বাঁড়ুয্যে কাউকে ভয় পায়! এই ত্রিভুবনে যতদূর চোখ যায়, সব আমার এলাকা। আমি এক নরপতি। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র ওগুলো তোকে দিয়ে দিলুম। যাঃ, কুড়িয়ে নে, কুড়িয়ে নে।

তুমি আজ বড়ো বেশি খেয়েছ।

বেশ করেছি শালা, কার তাতে কী? কার বাপের কী?

চলো, তোমাকে ওপরে নিয়ে যাই।

না খেয়ে শুয়ে পড়েছিস রে শালা!

খেয়েছি, খেয়েছি, দেশ থেকে আমার দিদি আর ভাগনেকে এনেছি। তুমি একটু সামলে কথা বলো দাদা।

দিদিকে এনেছিস! কী সৌভাগ্য, আহা কী সৌভাগ্য! অতিথি আজ এসেছে দুয়ারে! ওরে কে আছিস, সব ঝাড়লণ্ঠন জ্বেলে দে, ঝরোখা থেকে ফোয়ারা ছোটা। ফোয়ারা ছোটা। বন্দিগণ করো গান। কী সৌভাগ্য, কী সৌভাগ্য!

এখুনি উলটে পড়ে যাচ্ছিলেন, মামা ধরে ফেললেন। মা বললেন, সরে আয়। বেশ কিছুক্ষণ পরে মামা ফিরে এলেন। মা ডাকলেন, ভব?

মামা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, যা ভাবছ, তা নয়।

তার মানে?

রাধার দাদা। ডাকসাইটে অভিনেতা। ফিলম, স্টেজ, দাপটে ফেটে যাচ্ছে। তুমি এসেছ বলে কী খুশি! শুনলে না, বলছে, কী সৌভাগ্য, কী সৌভাগ্য!

সব শুনেছি। সব ভালো চাস তো এখান থেকে পালাবার ব্যবস্থা কর।

এ বাতাসে গাছ বাঁচে না, এ জমিতে মাটি নেই।

জামাইবাবু মারা যাবার পর থেকে, তুই যেন বিধাতাপুরুষের মতো কথা বলতে শুরু করেছিস। শুয়ে পড়, ঘুমিয়ে পড়।

মা কিন্তু শুনলেন না। গ্যাঁট হয়ে বসে রইলেন বিছানায়। মামা আবার দিব্যি শুয়ে পড়লেন। কে এলেন, কেন এলেন! কেন মামাকে গালাগাল দিলেন, কেন মামা ধরে ধরে ওপরে তুললেন! অনেক কিছুই জানার আছে, কিছুই এ রাতে জানা যাবে না। মামার নাক ডাকছে। মামা কি এ বাড়ির চাকর!

ওপরে কী একটা ভেঙে চুরমার হল। ভারী ভারী পায়ের শব্দ। প্রথমে এসে মনে হয়েছিল এ বাড়িতে মানুষ থাকে না। এখন মনে হচ্ছে বাড়িতে এক পল্টন গোরা সৈন্য ঢুকে পড়েছে। ওপরে কে যেন পায়চারি করছে। সেই গম্ভীর গলা আবার শোনা গেল। আকাশ—বাতাস কাঁপতে লাগল,

শুন সুলোচনে,
যদি ভালোবাস, ভালোবাসা রবে চিরদিন।
যদি ভালোবাস, ভালোবাসা রবে চিরদিন

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 1 of 7 ): 1 23 ... 7পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress