Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রঘু ডাকাত : সংঘর্ষ—পুণ্য ও পাপে (প্ৰথম খণ্ড) || Panchkari Dey

রঘু ডাকাত : সংঘর্ষ—পুণ্য ও পাপে (প্ৰথম খণ্ড) || Panchkari Dey

“যদি আমি এখন একবার রায়মল্ল সাহেবকে দেখতে পেতেম, তা’ হ’লে দুই লক্ষ টাকার কাজ হ’ত।”—

রাজস্থানের পার্বত্য প্রদেশে বুঁদী নামক স্থানে একটি ক্ষুদ্র একতালা বাটীতে অশীতিপর এক বৃদ্ধের রোগশীর্ণ মুখ হইতে অতি কষ্টে এই কথাগুলি ধীরে ধীরে বাহির হইল। বৃদ্ধ রোগ-শয্যায় শায়িত। তাঁহার দেহ অতি ক্ষীণ—তিনি মৃত্যুমুখে অগ্রসর। তাঁহার নিকটেই ষোড়শবর্ষীয়া এক অপূর্ব্ব লাবণ্যবতী সুন্দরী নবীনা উপবিষ্টা। তাহার বেশ-ভূষা অতি সামান্য, কিন্তু তাহার অপরূপ রূপের ছটায় সমগ্র ঘরখানি আলো করিয়া রহিয়াছে। সে আপনার কোমল হাত দুইখানি দিয়া অতি যত্নে আসন্ন-মৃত্যু বৃদ্ধের গায়ে হাত বুলাইতেছিল। সেই কুসুমসুকুমার অঙ্গসৌষ্ঠব, সেই পরম রমণীয় লাবণ্য সন্দর্শনে মনে হয়, যেন কোন দেববালা বুদ্ধের সেবায় নিযুক্ত। সে বদনকমলে সাহসিকতা ও কোমলতা যেন একাধারে বর্ত্তমান।

নবীনা জিজ্ঞাসা করিল, “রায়মল্ল সাহেব কে, বাবা?”

বৃদ্ধ। রায়মল্ল সাহেবকে আমি নিজে কখনও দেখি নি, কিন্তু তাঁর নাম আমি অনেকবার শুনেছি। তিনি বিশ্বাসী, সাহসী, তীক্ষ্মদৃষ্টি, সদ্বিবেচক। তাঁর বাপের সঙ্গে আমার খুব আলাপ ছিল? না— আলাপ কেন, বন্ধুতাও ছিল। শুনেছি, তাঁর ছেলে রায়মল্ল এখন ইংরেজ-সরকারে চাকরী করেন। তাই লোকে তাকে বলে, রায়মল্ল সাহেব। তিনি একজন নামজাদা গোয়েন্দা। তাঁর মত আশ্চর্য্য ক্ষমতাবান্ গোয়েন্দা নাকি এ প্রদেশে আর নাই।

“তাঁকে একখানা চিঠি লিখলে কি হয় না, বাবা?“

বৃদ্ধ এই কথা শুনিয়া সেই নবীনার হাত দুইখানি ধরিয়া খুব কাছে টানিয়া আনিয়া উচ্ছসিত স্বরে বলিলেন, “তারা, মা! আর আমি তোমার কাছে সেই ভয়ানক গুপ্তকাহিনী প্রকাশ না ক’রে থাকতে পারছি না। আমার জীবন অবসান-প্রায়—এই যাত্রা আর বুঝি আমি রক্ষা পাব না। তারা! তারা! মা আমার! তোমার আমি কিছুই ক’রে যেতে পারলেম না। আমার শেষ-মুহূর্ত্ত আসন্ন প্রায়।”

তরুণীর নাম তারাবাই। বৃদ্ধের এই কথা শুনিয়া তারাবাই কাঁদিতে লাগিল; কিন্তু তখনও তাহার বদনে সেই পূর্ণজ্যোতিঃ বিরাজমান। সাহসে নির্ভর করিয়া তারা বলিল, “না বাবা! আপনি ভাববেন না—আপনি না বাঁচলে অভাগিনী তারাকে কে দেখবে—কে যত্ন করবে? বিধাতা আমার প্রতি কখনই এমন নিদয় ব্যবহার করবেন না—”

বৃদ্ধ। মা! আর তোমায় বৃথা প্রবোধ বাক্যে ভুলিয়ে রাখা অত্যন্ত অন্যায়—আর তোমায় প্রবঞ্চনা করাও মিছে! আমার প্রাণ-বায়ু প্রায় কণ্ঠাগত। তবু যদি আমি এখনও একবার রায়মল্ল সাহেবকে দেখতে পেতেম, তা’ হ’লেও তোমার একটা যা’ হয়, উপায় করতে পারতেম। যদি তাঁর হাতে তোমার রক্ষা-ভার দিয়ে যেতে পারতেম, তবু আমার মনে ভরসা থাকৃত, আর তোমার কোন বিঘ্ন ঘবে না। কিন্তু হায়! জীবনের বিন্দুমাত্র আশা থাকতে আমি সে চেষ্টা করি নাই, এখন আর দুঃখ করলে কি হবে? তোমার জন্য আমি এত চেষ্টা ক’রে কিছু ক’রে যেতে পারলেম না। যে কাজ তোমার জন্য আরম্ভ করেছিলেম, আর দিন-কতক বাঁচলে তা’ সিদ্ধ হ’ত—

বাকী কথা না শুনিয়াই তারা বলিল, “আমার জন্য কি কাজ, বাবা?”

বৃদ্ধ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “হাঁ মা! তোমারই জন্য। যখন দেখছি, আমার, বাঁচ্‌বার আশা নাই, তখন তোমায় সমস্ত সত্যকথা ব’লে যাওয়াই ভাল। তোমায় মানুষ করবার জন্য আমি এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত অকাতরে পরিশ্রম করেছি। মনে বড় আশা ছিল, তোমাকে তোমার যথার্থ প্রাপ্য অতুল সম্পত্তির অধিকারিণী হ’তে দেখে যাব; কিন্তু হায়! বিধাতা তাতে বাদ সাধলেন। বাণিজ্যের ভরা নৌকা কিনারায় এসে ডুবে গেল।”

তারা। আমি অতুল-সম্পত্তির অধিকারিণী! একি কথা, বাবা?

বৃদ্ধ। মা! তুমি আমার আশ্রয়ে থেকে কোন দিন দুটী খেতে পাও, কোন দিন পাও না; কিন্তু তোমার অতুল ঐশ্বর্য্য নিয়ে আর একজন স্বচ্ছন্দে খুব বড়-মানুষী করছে। অদৃষ্টের দোষে তুমি আমার পালিতা কন্যা; নইলে তোমার বিষয়-আশয় যা’ আছে, অনেক রাণীর তা’ নাই। অনেক জুয়াচোরে মিলে তোমায় তোমার যথার্থ প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে;এখনও কোন প্রকারে যাতে তুমি সে বিষয় জানতে না পার, তার জন্যই সম্পূর্ণ সচেষ্ট রয়েছে। যদি আমি এ-যাত্রা রক্ষা পেতাম, তা’ হ’লে রায়মল্ল সাহেবকে তোমার সহায়তায়, নিযুক্ত করতেম। পৃথিবীতে যদি কেউ তোমার যথার্থ প্রাপ্য সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারে, তা’ হ’লে কেবল তিনিই একমাত্র ব্যক্তি। যারা তোমায় প্রবঞ্চিত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হ’তে যদি কেউ সাহস করে, তবে তিনিই একমাত্র সাহসী বীর এ-কালে বর্ত্তমান। কেবল একজন বিচক্ষণ সাহসী ও মহানুভব গোয়েন্দার সাহায্যই আমি আপাততঃ বিশেষ আবশ্যক বিবেচনা করি। উকীল-মোক্তার পরে দরকার হবে।

তারা। তা’ এই রায়মল্ল সাহেবকে কি কোন রকমে এখানে আনা যায় না বাবা? একখানা চিঠি লিখলে কি হয় না?

বৃদ্ধ। না—তা” আর হয় না। সে সময় আর নাই। দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে যদি আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হ’ত, তা’ হ’লেও বোধ হয়, আমি তাঁকে সমস্ত কথা ব’লে যা’ হয় একটা উপায় ক’রে যেতে পারতেম।

তারা। তিনি এখান থেকে কত দূরে থাকেন?

বৃদ্ধ। বহুদূরে। কিন্তু আমি শুনেছি, তিনি এখন লালপাহাড়ে এসেছেন! বিশেষ কাৰ্য্যোপলক্ষে সেইখানেই নাকি এখন কিছুদিন থাকবেন।

তারা। লালপাহাড় এখান থেকে সাত আট ক্রোশের বেশি ত হ’বে না।

বৃদ্ধ। তা’ আমি জানি।

তারা। তবে আর কি? আমি অনায়াসে ঘোড়ায় চড়ে লালপাহাড়ে যেতে পারি। তিনি কি রামলালজীর বাড়ীর কাছে থাকেন?

বৃদ্ধ। তিনি রামলালজীর বাড়ীতেই না কি বাসা নিয়েছেন; কিন্তু তা’ হ’লে কি হয়? রাত্রি হয়ে এল—তুমি বালিকা, অসহায়া, একাকিনী। তোমায় কি আমি সাহস করে ছেড়ে দিতে পারি? বিশেষতঃ এদিককার পর্বতশ্রেণীতে কত দস্যু, কত বদমায়েস, কত খুনে বাস করে; তুমি কি তাদের অতিক্রম ক’রে যেতে পারবে? আমি কোন রকমেই সাহস ক’রে তোমায় যেতে বলতে পারি না

তারা। না বাবা, আমার জন্য আপনার কোন ভয় নাই। আমি আমার নিজের কাজের জন্য যাব না; তবে যদি আপনার এতে একটু ভাবনা কমে, যদি আপনি একটু শান্ত হ’ন, তাই আমি যাব।

বৃদ্ধ। না মা! আমি তোমায় যেতে দিতে পারি না, তোমায় পাঠাতে আমার সাহস হয় না। তারা অল্পবয়স্কা—কিন্তু সে রাজপুত-কুমারী। যে রাজপুত-কুল-মহিলার সাহসিকতার দৃষ্টান্তে ভারতের ইতিহাসবেত্তারা এখনও গৌরব করিয়া থাকেন; রাজস্থানের ইতিহাসের প্রতি ছত্ৰে, প্ৰতি শব্দে এখনও যাঁহাদের গৌরব জাজ্বল্যমান, তারা সেই রাজপুত-কুলোদ্ভবা। রাজপুত রমণী চিরকালই যুদ্ধ-ব্যবসায়ে অগ্রগামিনী—বীর-ভর্ত্তার উপযুক্ত বীরপত্নী। অস্ত্র-শস্ত্রাদি সঞ্চালন, অশ্বপৃষ্ঠে দেশ- দেশান্তর ভ্রমণ, আবশ্যক মতে স্বহস্তে কৃপাণ ধারণ করিয়া শত্রুদমন প্রভৃতি সকল প্রকার সামরিক কার্য্যে তাঁহারা বিশিষ্ট নিপুণ না হইলেও স্বার্থ সাধনার্থ কখনই ঐ সকল কার্য্যে ভীতি বা নারী-স্বভাব- সুলভ লজ্জার বশবর্তিনী হইয়া পরাজুখী হইতেন না। একে তার ধমনীতে রাজপুত-রক্ত প্রবহমান, তাহাতে আবার সে বাল্যকালে পালক-পিতার যত্নে অশ্বারোহণ, অশ্বচালনাদি এবং এমন কি বন্দুক, পিত্তল প্রভৃতি ব্যবহার করিতে রীতিমত শিক্ষা করিয়াছিল। যদিও তাহার শৈশবাবস্থা এইরূপ পুরুষোপযোগী কার্য্যে পরিবাপিত হইয়াছিল, তথাপি যৌবন-সমাগমে তাহার মাধুরী ঐরূপ করিবার জন্য কোন ক্রমেই হ্রাসপ্রাপ্ত হয় নাই। তাহার লাবণ্য পদ্মপত্রস্থ জলের ন্যায় ঢল ঢল যৌবনের প্রথম বিকাশের সহিত তাহার রীতিনীতির পরিবর্ত্তন হয় নাই।

তারা পাশ্ববর্ত্তী আট-দশ ক্রোশের মধ্যে প্রায় সকল স্থানই অবগত ছিল; সুতরাং ঘোড়ায় চড়িয়া সাত-আট ক্রোশ দূরে লালপাহাড়ে যাইতে উৎসুক হইবে, ইহা আর আশ্চর্য্যের বিষয় কি? উহা তাহার দৈনন্দিন ক্রীড়ার মধ্যে গণ্য—তাই তারা ধীর, গাম্ভীর্য্যপূর্ণস্বরে বলিল, “বাবা আপনার অবাধ্য কখনও হইনি, কিন্তু আজ আপনারই তুষ্টির নিমিত্ত আমি আপনার নিষেধ অবহেলা ক’রে লালপাহাড়ে যাব। আপনি ভাবিত হবেন না, আমি নিরাপদে উদ্দেশ্যসাধন করে অতি শীঘ্রই ফিরে আসব।”

মুমূর্ষু বৃদ্ধ কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধভাবে থাকিয়া বলিলেন, “মা! তুমি অসমসাহসিকের কার্য্যে অগ্রসর হচ্ছ, কিন্তু না গেলেও আর উপায় নাই—যেতেই হবে। দেখ, আমার মনে কেমন একটা ভীষণ আশঙ্কা আছে।”

তারা। বাবা আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন—আপনি ত জানেন, আমি ছেলেবেলা থেকে ঘোড়ায় চড়া অভ্যাস করেছি। ছেলেবেলা থেকেই আরাবল্লী পর্ব্বতে অশ্বারোহণ করে বেড়িয়েছি, কখনও ত কোন বিপদে পড়ি নি। পাহাড়ের আট-দশ ক্রোশ পৰ্য্যন্ত পথঘাট আমার এক রকম জানা আছে; পথ ভুলে যাবার ভয়ও নাই, তবে আর আপনার ভাবনা কিসের?

বৃদ্ধ। আচ্ছা মা, যদি রাস্তায় রঘুনাথের সামনে পড়িস?

এই কথায় তারার বদনকমল ক্রোধে ঈষৎ রক্তাভ হইল। নয়নদ্বয়, উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল। সে নির্ভীকস্বরে উত্তর করিল, “রঘুনাথকে ভয় কি, বাবা? তবে এ-সময়ে তার সঙ্গে দেখা না হওয়াই ভাল। তাকে আমি ঘৃণা করি—ভয় করি না।”

এ কথা রাজপুত-কুমারীর মুখেই শোভা পায়।

বৃদ্ধ যে রঘুনাথের কথা বলিলেন, তাহার প্রকৃত নাম রঘুনাথ সিংহ। রঘুনাথও রাজপুত-বংশজাত। বাল্যকাল হইতেই রঘু ‘ তারাকে জানিত। তারার পালক-পিতার বাটীর নিকটেই রঘুনাথের পিত্রালয়। তারা ও রঘুনাথ ছেলেবেলায় একত্রে খেলা করিত। প্রায়ই তাহারা একত্রে থাকিত, সন্ধ্যা হইলে আপন আপন আবাসে যাইত। তারা যত বড় হইতে লাগিল, ক্রমে যখন কৌমার্য্যসীমা অতিক্রম করিয়া যৌবনে পদার্পণ করিতে লাগিল, রঘুনাথের পাপপ্রবৃত্তি ততই প্রবল ভাব ধারণ করিতে লাগিল। রঘুনাথ তারাকে পত্নীরূপে পাইবার প্রয়াসী হইল। তারা যদিও রঘুনাথকে যত্ন করিত, তথাপি তাহার পত্নী হইবার ইচ্ছা তাহার কোন কালেই মনে উদিত হয় নাই। তাহাকে বিবাহ করিবার কথা সে কল্পনায়ও মনে স্থান দিত না। এইরূপে বিফল মনোরথ হইয়া রঘুনাথের অন্তরে, ঈর্ষাবহ্নি প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। সে ভাবিল, তারা তাহার অপমান করিয়াছে;এ-অপমানের প্রতিশোধ লইতে হইবে। তারার নিকটে সে তাহার অকৃত্রিম প্রণয়ের পরিবর্ত্তে কেবল ঘৃণা ও অপমান লাভ করিয়াছে প্রতিহিংসা তাহার উপযুক্ত। সে নিশ্চয়ই প্রতিহিংসা গ্রহণ করিবে। হিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করিতে সে সদসৎ জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িয়াছিল। তাহার প্রতিজ্ঞা অটল, অবশ্যই তাহাকে তাহা পূরণ করিতে হইবে। রঘুনাথ ভয়ানক কপটাচারী, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, নিৰ্দ্দয়। সহজ কথায় বলিতে গেলে বলিতে হয়, সে ‘মরিয়া’ গোছের লোকের মত। পরস্বাপহরণ, ডাকাতি, খুন—কোন প্রকার পাপ-কাৰ্য্যই তাহার অনায়ত্ত ছিল না। ভীষণ পাপাচারী হইলেও কিন্তু এই সকল দুষ্কর্ম্ম সে এতদূর সতর্কতার সহিত সম্পন্ন করিত যে, এ-পর্যন্ত কখনও কেহ তাহার দুষ্ক্রিয়ার কথা জানিতে পারে নাই। তবে রঘুনাথ সিংহ নামে একজন ঘোর দুবৃত্ত পাষণ্ড, নরঘাতী, ব্যক্তি সে-প্রদেশে আছে, সকলেই তাহা জানিত; কিন্তু সে যে কোন্ রঘুনাথ, তাহা কেহই জানিতে পারিত না। অনেকে তাহাকে সন্দেহ করিত; কিন্তু নিশ্চয় করিয়া কেহ কিছু বলিতে পারিত না।

তারার পালক-পিতার আরব-দেশী একটি অতি উৎকৃষ্ট ঘোটক ছিল;বৃদ্ধ তাঁহার অন্যান্য সমুদয় সম্পত্তি অপেক্ষা ঐ অশ্বটিকে মূল্যবান্ জ্ঞান করিতেন। সেই সময়ে সেই-প্রদেশে ঘোড়াচুরির বিশেষ প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল। বৃদ্ধ বিশেষ যত্নে, বহু অনায়াসে এই অপহারকদলের কবল হইতে নিজের সেই অশ্বটিকে রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

বৃদ্ধ যদিও তারাকে বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার অধিকক্ষণ বাঁচিবার সম্ভাবনা নাই, তথাপি সে কথায় তারার আদৌ বিশ্বাস হয় নাই। সে ভাবিয়াছিল, হয় ত তিনি আপনার শরীরের অবস্থা যথার্থরূপ অনুভব করিতে পারিতেছেন না! এক মুহূর্ত্তের জন্যও তারা ভাবে নাই; তাহার পরম দয়ালু পালক-পিতার আসন্নকাল উপস্থিত। তবে যে সে লালপাহাড়ে যাইতে ব্যগ্র হইয়াছিল সে কেবল বৃদ্ধের প্রীতির জন্য। যিনি তাহাকে কত যত্নে, বহু ক্লেশ সহ্য করিয়া পালন করিয়াছিলেন। তাঁহার তুষ্টিসাধনের জন্য চেষ্টা, তাহার সর্ব্বতোভাবে উচিত। এই কৰ্ত্তব্যবোধই এবং রমণীহৃদয়েও যে কৃতজ্ঞতার স্থান আছে, তাহাই দেখাইবার জন্য সে লালপাহাড়ে যাইতে আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছিল। বৃদ্ধ যে তাহাকে বিপুল সম্পত্তির অধিকারিণী বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন সে কথা সে আদৌ বিশ্বাস করে নাই। সে মনে ভাবিয়াছিল, সে কথাগুলি বিকারগ্রস্ত রোগীর প্রলাপ-বাক্য মাত্র। দারিদ্র্যদুঃখপীড়িতা পরান্নে প্রতিপালিতা কন্যার আবার বিষয় সম্পত্তি কি? এই সকল কথা মনে উদয় হওয়াতেই তারা স্থির করিয়াছিল, হয় ত রোগের প্রভাবে চিত্তবিকৃত বশতঃ বৃদ্ধ প্রলাপ বকিতেছেন।

পালক-পিতার নিকট কিয়ৎকাল বসিয়া তারা পথ-সম্বন্ধে আরও একটি সন্ধান লইল। পরে আস্তাবলে গিয়া কুমারকে (তারা আদর করিয়া ঘোড়ার নাম কুমার রাখিয়াছিল) জীন পরাইয়া সওয়ারের জন্য প্রস্তুত করিল। তারপর আপনার শয়নাগারে আসিয়া উপযুক্ত বেশে সজ্জিত হইল। সঙ্গে দুইটি পিস্তল লইতেও ত্রুটি করিল না। পিতাকে প্রণাম করিতে গেল। বৃদ্ধ কন্যার মস্তক আঘ্রান করিয়া আশীর্বাদ করিলেন। তারা নাম লইয়া, তারা অশ্বারোহণ করিয়া পাবতীর পথাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিল। পথে কত বিভীষিকা রাক্ষসী তাহার জন্য মুখব্যাদান করিয়া রহিয়াছে, সরলা তারা তাহার কি বুঝিবে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
Pages ( 1 of 14 ): 1 23 ... 14পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *