গোয়েন্দা এসিজি (Goyenda ACG) : দরজা বন্ধ ছিল
…কিন্তু তবুও নিলয় মজুমদার খুন হয়ে গেলেন।
যেভাবে তিনি খুন হলেন তাতে খুনির নাম যে কিছুতেই ‘করুণাসিন্ধু’ হতে পারে না সেটা হলফ করে বলা যায়। কারণ, নিলয়ের মাথার পিছনে ভারী কোনও জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, এবং তার ওপরে গলায় চেপে বসেছিল রবারের মোটা ‘দড়ি’-র ফাঁস। চুয়াত্তর বছরের একজন বৃদ্ধকে খুন করার জন্য কখনওই এত আয়োজনের প্রয়োজন হয় না।
রঘুপতির মুখে খুনের ঘটনার বিবরণ শুনতে-শুনতে এসিজি-র অন্তত সেরকমই মনে হল।
মাথার পিছনে ঝুলে থাকা ধবধবে সাদা চুলের গোছায় কয়েকবার টান মারলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে যাঁর নাম এসিজি। তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ঠোঁটে ঝোলালেন। সামনের টেবিলের ওপরে দেশলাইয়ের বাক্স পড়ে ছিল। সেটা তুলে নিয়ে সিগারেট ধরালেন।
আর তখনই ঊর্মিলার কথা মনে পড়ল। ও সামনে থাকলে কিছুতেই বাবাকে সিগারেট ধরাতে দিত না। ভাগ্যিস তিনবছর আগে ওর বিয়ে হয়ে গেছে!
সিগারেট খাওয়া নিয়ে এখন অশোকচন্দ্রকে বকাঝকা করার কেউ নেই। স্ত্রী মালিনী প্রায় এগারো বছর হল অসুস্থ কিডনির কাছে ইনিংসে হেরে গিয়ে আকাশের তারা হয়ে গেছে। মালিনী সিগারেট খাওয়া নিয়ে ছোট্ট-ছোট্ট কিন্তু মিষ্টি আপত্তি জানাত। এসিজি ওকে খুশি করতে বহুবার সিগারেটের নেশা ছাড়তে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ওই—যা হয়!
মালিনীর তুলনায় ঊর্মিলা ছিল একেবারে জঙ্গি সিগারেটবিরোধী। নেহাত অশোকচন্দ্র ওর বাবা বলে ঊর্মি শারীরিক শাস্তি দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে পারেনি। নইলে কী যে হত কে জানে!
একেবারে ছাড়তে না পারলেও অশোকচন্দ্র সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা পঁচাত্তর পার্সেন্ট কমিয়ে দিয়েছেন। একসময় দিনে তিনি আট প্যাকেট সিগারেট খেতেন, এখন মাত্র দু-প্যাকেট।
সিগারেট ধরিয়ে মনের সুখে গভীর টান দিলেন। ধোঁয়া ছাড়লেন এবং বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিলেন। চশমার কাচের ফাঁক দিয়ে রঘুপতি যাদবের মুখের দিকে ভাবনা-বিভোর চোখে দেখলেন একবার। চোখের চশমাটা একটু নেড়েচেড়ে নাকের গোড়ায় ঠিকঠাক করে বসালেন। তারপর তাকালেন খোলা জানলার দিকে। সেই সকাল থেকেই বৃষ্টি চলছে তো চলছেই। এখন বেলা এগারোটা দশ। বৃষ্টি আজ বারোটা বাজাবেই!
নিলয় মজুমদারের খুনের ঘটনাটা বেশ ইন্টারেস্টিং আর অন্যরকম। এতক্ষণ ধরে ইনস্পেকটর রঘুপতি যাদবের কাছে শোনা বিবরণ আর বর্ণনার কথাগুলো মনে-মনে রিক্যাপ করছিলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। এই মার্ডার মিস্ট্রিটা এমন যে, লোকাল থানার পুলিশ বারবার হোঁচট খেয়ে আটকে গেছে। সেইজন্যই ব্যাপারটা গড়িয়ে গেছে লালবাজার পর্যন্ত—মানে, লালবাজারের হোমিসাইড স্কোয়াড পর্যন্ত। এবং সবশেষে এই খুনের সমস্যাটা এসে আশ্রয় নিয়েছে রঘুপতি যাদবের কোলে।
নিজের কোল থেকে সমস্যাটা এসিজি স্যারের কোলে ট্রান্সফার করবে বলে রঘুপতি আজ সকাল সাড়ে ন’টার পরপরই এসে হাজির হয়েছে ওর প্রাক্তন স্যারের শ্যামবাজারের ফ্ল্যাটে।
বৃদ্ধ নিলয় মজুমদার খুন হয়েছেন পঁচিশ দিন আগে—গত মাসের বাইশ তারিখে। কিন্তু পুলিশ এই খুনের কিনারা করা তো দূর অস্ত কাউকে অ্যারেস্ট পর্যন্ত করতে পারেনি।
রঘুপতির কোলে খোলা রয়েছে একটা মোটা ফাইল—নিলয় মজুমদারের কেস ফাইল। এতক্ষণ ধরে সেটা কনসাল্ট করেই গোটা কেস হিস্ট্রিটা ও এসিজি স্যারকে শুনিয়েছে।
ফাইলটা পড়ার জন্য রঘুপতি চোখে রিডিং গ্লাস লাগিয়েছে। বয়েসটা চল্লিশ পেরোলেও চেহারা ভীষণ শক্তপোক্ত। চোয়ালের রেখা এবং চোখ বলে দিচ্ছে, নিজের শারীরিক শক্তির ওপরে ওর আস্থা নেহাত কম নয়।
রঘুপতির ঠোঁটের ওপরে কাঁচাপাকা গোঁফ। মুখে বসন্তের দাগ। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ফিজিক্স নিয়ে এম. এসসি. পড়ার সময় ও ‘স্যার’ হিসেবে এসিজিকে পেয়েছিল। তখন থেকেই স্যারের অ্যানালিটিক্যাল বুদ্ধির সঙ্গে ওর সরাসরি পরিচয়।
এখন স্যারের ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে ওরা দুজনে দুটো সোফায় মুখোমুখি বসে রয়েছে। ওদের মাঝখানে নীচু টি-টেবিল। টেবিলে দুটো খালি কফির কাপ আর স্ন্যাক্সের প্লেট। প্লেটে কয়েকটা লেফট ওভার বিস্কুট পড়ে রয়েছে।
রঘুপতির গায়ে সাধারণ পোশাক—তাতে কোনও পুলিশি ছাপ নেই। ওর প্যান্টের নীচের দিকটা ভেজা। গাড়ি থেকে নেমে স্যারের বিল্ডিং-এ ঢোকার সময় বৃষ্টির ছাট এই কাণ্ডটা করেছে। হাতের ছাতা মাথা বাঁচালেও পা পুরোপুরি বাঁচাতে পারেনি।
রঘুপতি যাদব ওর প্রাক্তন স্যারের দিকে তাকাল। স্যার এখন পুরোদস্তুর ‘মিস্টার হোয়াইট’। গায়ে সাদা রঙের পাঞ্জাবি-পাজামা। মাথায় লম্বা-লম্বা সাদা চুল। আর স্যারের মাথা ঘিরে ভেসে বেড়াচ্ছে সিগারেটের সাদা ধোঁয়া।
অশোকচন্দ্র রঘুপতি যাদবের দিকে চোখ খুলে এক-একবার দেখছেন, আবার কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে আপনমনে কী ভাবছেন।
এসিজি রঘুপতির বর্ণনা আর বিবরণের কথাই ভাবছিলেন। শুরু থেকে শুরু করে কেস হিস্ট্রিটা মনে-মনে খতিয়ে দেখছিলেন। রঘুপতি যাদবের কথাগুলো যেন আবার শুনতে পাচ্ছিলেন।
কলকাতার নিউ আলিপুর অঞ্চলে নিলয় মজুমদারের তিনতলা বাড়ি। জায়গাটা নিউ আলিপুর হলেও অঞ্চলটা নিতান্তই মধ্যবিত্ত এলাকা।
নিলয় মজুমদার সেলফ মেড ম্যান। ছোটবেলায় বাবা-মা-কে হারিয়েছেন। কাকার কাছে মানুষ। অনেক কষ্ট সহ্য করে, পরিশ্রম করে, পড়াশোনা করে বড় হয়েছেন। যাদবপুর ইউনিভারসিটি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন সসম্মানে, ভালো রেজাল্ট করে। প্রথম জীবনে আট বছর মতন চাকরি করার পর ‘নিলয় কনস্ট্রাকশনস’ নামে নিজের কনস্ট্রাকশন কোম্পানির শুরুওয়াত করেন। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর কোম্পানি ধাপে-ধাপে বড় হয়েছে। অনেক বড়-বড় টাউনশিপ তৈরি করেছেন। রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ নানান প্রজেক্টের দায়িত্ব পেয়েছেন। প্রায় তিরিশ বছর ধরে রাজ্য সরকারের কনট্রাক্টরদের তালিকায় ‘নিলয় কনস্ট্রাকশনস’ একজন নামিদামি বিল্ডার।
চৌষট্টি বছর বয়েসে নিলয়বাবুর হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়। তখন তিনি একটু ভয় পেয়ে যান। তাই স্ত্রীর পরামর্শে ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়ান। ওঁদের একমাত্র ছেলে তনয় মজুমদার—তাঁর কোনও বোন-টোন নেই। তনয় সাধারণ বি. কম. পাশ। কিন্তু পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েস থেকেই নিলয় ওঁকে ব্যবসায় টেনে নেন। তনয়ের ব্যবসাবুদ্ধি নিয়ে নিলয়বাবুর সিরিয়াস অভিযোগ ছিল, বাট উপায় কী—হাজার হলেও ছেলে এবং ওনলি চাইল্ড!
তনয় মজুমদারের বয়েস এখন সাঁইতিরিশ-আটতিরিশ মতন। বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর নাম টুনি মজুমদার। বিয়ের আগে মডেলিং করতেন। এখনও সেই অভ্যাস ধরে রেখেছেন। ফ্যাশান নিয়ে বেশ ইন্টারেস্ট আছে। বড়লোকের বউ-টউ হলে যা হয়! রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে একটা বুটিক আছে। সেখানে প্রিমিয়াম প্রাইস ট্যাগ লাগানো সব প্রিমিয়াম আইটেম বিক্রি হয়।
একটাই ফাঁকা জায়গা রয়েছে টুনি আর তনয়ের লাইফে—ওঁদের কোনও ছেলেমেয়ে নেই। যদিও দশবছর হল বিয়ে হয়েছে।
নিলয়বাবুর পার্সোনাল দেখাশোনার জন্য কাজের মেয়ে রয়েছে সাবি—মানে, সাবিত্রী। বিয়ে হয়ে গেছে বাট হাজব্যান্ড চারবছর ধরে লাপাতা। সাবির বয়েস তিরিশ-টিরিশ হলেও আরও ইয়াং দেখায়। তা ছাড়া দেখতেও বেশ সুন্দরী—মানে, কাজের মেয়ের পক্ষে। সাবি রাতে নিলয়বাবুর বাড়িতেই থাকে। নিলয় মজুমদারের ঘরের লাগোয়া লম্বা-চওড়া বারান্দা আছে। বারান্দাটা ওয়েল প্রোটেক্টেড—মোটা গ্রিল দিয়ে ঘেরা। সাবি রাতে সেখানেই শোয়।
নিলয়ের বাড়িটা তিনতলা। একতলায় রয়েছে দুটো গেস্টরুম আর কমন বাথরুম, তার সঙ্গে কলতলা।
দোতলায় নিলয়বাবুর দুটো ঘর—বেডরুম আর স্টাডি—পাশাপাশি। দুটো ঘরের মাঝে যাতায়াতের দরজা রয়েছে। স্টাডিতে ঢুকতে হলে নিলয়বাবুর বেডরুম দিয়ে ঢুকতে হয়। এ ছাড়া দোতলায় ছোট্ট একটা ড্রয়িংরুম মতন রয়েছে—সেটা কমন, সবাই ইউজ করে। ব্যস, দোতলায় নিলয়বাবু ছাড়া আর কেউ থাকে না। তনয়বাবু অনেকবার এই একা থাকা নিয়ে খিচিরখিচির করলেও নিলয় মজুমদার সেসব কথা কানে ঢোকাননি। তনয় এ নিয়ে কখনও জোরজবরদস্তি করতে পারেননি কারণ, নিলয় মজুমদার ওয়াজ দ্য বস। বয়েস চুয়াত্তর হলেও তাঁর কথাতেই সবাই চলত—মানে, চলতে হত। কারণ, বাড়ির মালিক তিনি, কোম্পানির মালিক তিনি। বরাবরই ওঁর বিহেভিয়ার একটু রুক্ষ, বস টাইপের—তার ওপর বছর দেড়েক আগে ওঁর ওয়াইফ এক্সপায়ার করার পর থেকে উনি আরও বেশি খিটখিটে হয়ে পড়েন। এ-কথা তনয় মজুমদার, টুনি মজুমদার যেমন জানিয়েছেন, তেমনই সাবিত্রীর কাছ থেকেও একই টাইপের কমেন্ট পাওয়া গেছে। মানে, বেসিক্যালি নিলয়বাবু বদমেজাজি ছিলেন। তাই সবাই ওঁকে খুব সমঝে চলত।
এরপর আসছে ও-বাড়ির লাস্ট মেম্বারের কথা। প্রজেন বসু রায়। বয়েস তেতাল্লিশ। ভেরি ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার। উনি নিলয়বাবুদের কোনও ব্লাড রিলেশান নন, বাট ও-বাড়িতে পারমানেন্টলি থাকতেন—আই মিন, থাকেন।
তিনতলায় তনয় মজুমদার আর টুনি মজুমদার থাকেন। প্রজেন থাকেন ওঁদের পাশের ঘরেই। আর উনি হলেন ‘নিলয় কনস্ট্রাকশনস’-এর ম্যানেজার এবং টুয়েন্টি পারসেন্টের পার্টনার। প্রজেনের বাবা-মা নেই। অরফ্যান। ওঁর বাবা ব্রজেন বসু রায় যাদবপুর ইউনিভারসিটিতে নিলয় মজুমদারের ক্লাস মেট ছিলেন। শুধু ক্লাসমেট নয়, খুব বন্ধু ছিলেন দুজনে।
এ রকম সময়ে রঘুপতি যাদবের কাহিনির স্রোতকে বাধা দিয়েছিলেন অশোকচন্দ্র।
‘এই ব্যাপারটা কি ভীষণ আনইউশুয়াল নয়, রঘুপতি?’ রঘুপতির দিকে প্রশ্নভরা চোখে তাকালেন এসিজি। ভুরু উঁচিয়ে সেরকম ইশারাও করলেন : ‘যতই বন্ধুর ছেলে হোক, যতই অনাথ হোক, তাকে সরাসরি নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে পারমানেন্টলি থাকতে দেওয়াটা বেশ বেসুরো লাগছে…।’
রঘুপতি হেসে বলল, ‘গুপ্তাসাব, এই কাহানিটাই আপনাকে বলতে যাচ্ছিলাম। নিলয় মজুমদার যখন নিজের কোম্পানি খোলেন তখন ব্রজেন বসু রায়কে ডেকে নিয়ে এসে এইটি-টুয়েন্টির পার্টনার করে নেন। ওঁদের কাজকর্ম ভালোই চলছিল। কিন্তু বাইশ-তেইশ সাল পহেলে একটা হাদসা হয়। তখন ওঁরা কাশীপুর এরিয়ায় একটা ছোট ফ্লাইওভার বানাচ্ছিলেন। কনস্ট্রাকশন যখন ফিফটি কি সিক্সটি পার্সেন্ট মতন হয়েছে তখন একদিন লগভগ রাত এগারোটার সময় ওটা সাডেনলি ভেঙে পড়ে। ওই অ্যাক্সিডেন্টে তিনজন মারা গিয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ব্রজেন বসু রায়। তিনি সেসময়ে সাইটে ছিলেন। ব্যাড লাক। তখন ওঁর ছেলে প্রজেনের বয়েস অ্যাবাউট টুয়েন্টি ইয়ার্স।
‘ওই অ্যাক্সিডেন্টটা নিয়ে এফ. আই. আর. হয়েছিল। পুলিশ-কেসও হয়েছিল। কিন্তু নিলয় মজুমদার শেষ পর্যন্ত রিহা হয়ে যান। ইনভেস্টিগেশানে এটা জানা গিয়েছিল যে, ফ্লাইওভার কনস্ট্রাকশনের মেটিরিয়াল ”বি” গ্রেডের ছিল। বাট সেটার জন্যে নিলয়বাবুর কোম্পানি যে ডিরেক্টলি রেসপনসিবল সেটা প্রূভ করা যায়নি। কারণ, বিল্ডিং মেটিরিয়াল পারচেজের যেসব পারচেজ বিল উনি দেখিয়েছিলেন সেগুলো সবই ছিল ”এ” গ্রেড মেটিরিয়ালের বিল। কিন্তু পাবলিকের সন্দেহ যায়নি। এর পরেও নিলয় মজুমদারের কোম্পানির নামে কখনও-কখনও কনস্ট্রাকশনে চিটিং-এর রিপোর্ট হয়েছে…।’
‘তার মানে, প্রজেন বসু রায়কে এরকম একটা ফেভার দেওয়া হয়েছে অ্যাজ কমপেনসেশান?’
‘শুধু কমপেনসেশান নয়, স্যার—তার সাথ-সাথ গিল্ট কমপ্লেক্সও হয়তো আছে। সেটা এখন আর আমরা প্রূভ করতে পারব না। আওয়ার ব্যাড লাক।’
আরও অনেকক্ষণ ধরে রঘুপতির সঙ্গে কথা বললেন এসিজি। রঘুপতি বারবার যেটা ইমপ্রেস করতে চাইল সেটা হল, এই মার্ডার মিস্ট্রিটা বেশ কমপ্লেক্স আর ইন্টারেস্টিং।
‘আপনার মতো ”থিংকিং মেশিন”-এর এটা ক্র্যাক করতে বেশ মজা লাগবে, স্যার।’ সবকিছুর শেষে রঘুপতি যাদব মন্তব্য করল। তারপর : ‘আমার সঙ্গে একদিন চলুন, স্যার। স্পটটা একটু ঘুরেফিরে দেখবেন, ক্যারেকটারগুলোর সঙ্গে বাতচিত করবেন, ওদের নেড়েচেড়ে দেখবেন…।’
‘হ্যাঁ, তোমার কাছে সব শুনে-টুনে ইন্টারেস্টিং বলেই মনে হচ্ছে। তবে স্পট তো এখন আর হট নেই, ক্রাইমের এতদিন পর কোল্ড স্পট হয়ে গেছে।’
‘কী করব স্যার—ম্যাটারটা আমার হাতে এলই তো অনেক দেরি করে! এ ছাড়া…।’ কথার মাঝে থেমে গেল রঘুপতি।
‘এ ছাড়া কী?’ প্রশ্ন করলেন এসিজি।
‘এ ছাড়া মার্ডারটার মধ্যে একটা ”লকড রুম প্রবলেম” টাইপের ডায়মেনশন আছে…।’
‘বলো কী হে?’ অশোকচন্দ্রের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল আগ্রহে।
রঘুপতি জানে, কোন বিষয়ে ওর স্যারের স্পেশাল ইন্টারেস্ট।
‘স্যার, এবারে বলুন, কবে আপনার সময় হবে। সেইমতো লোকাল থানার ও. সি-কে আমি ইন্টিমেট করে রাখব।’
এসিজি ঘরের সিলিং-এর দিকে দেখলেন। ঘাড়ের পিছনে হাত নিয়ে ঝুলে পড়া চুলের গোছায় কয়েকবার টান মারলেন।
নিলয় মজুমদার হয়তো খিলখিটে দাপুটে অসৎ ব্যবসায়ী ছিলেন, কিন্তু ওঁর বেঁচে থাকার অধিকার ছিল। বরং মার্ডারারের ওঁর লাইফ টার্মিনেট করার অধিকার ছিল না। খুনের পদ্ধতি আর রঘুপতির বর্ণনা শুনে এসিজির মনে হয়েছে, খুনি যেন অহংকারে মদমত্ত হয়ে পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলছে, ‘কাম অন। সলভ দ্য মিস্ট্রি অ্যান্ড ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান।’
এসিজি রঘুপতিকে বললেন, ‘রঘুপতি, সামনের রোববার সকাল ন’টা কি সাড়ে ন’টা নাগাদ আমরা মজুমদারদের বাড়িতে যাব। তুমি একটু আগাম খবর দিয়ে রেখো। সবাই যেন বাড়িতে থাকে। অবশ্য সানডেতে সবারই বাড়িতে থাকার কথা…।’
‘ও. কে., গুপ্তাসাব। তা হলে সেরকমই অ্যারেঞ্জমেন্ট করছি।’
রঘুপতি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ফাইলটা হাতে নিল।
সেটা দেখে বৃদ্ধ হুনুর বললেন, ‘উঁহু, উঁহু—ওই ফাইলটা রেখে যাও, রঘুপতি। ওটা উলটেপালটে দেখে আমি একটু হোমওয়ার্ক সেরে নেব। আমার কাজ হয়ে গেলে তোমাকে ফোন করে দেব। তুমি কাউকে পাঠিয়ে ফাইলটা নিয়ে যেয়ো—।’
‘ও. কে., স্যার।’ ফাইলটা টেবিলে আবার নামিয়ে রাখল রঘুপতি।
‘ওতে মজুমদার-বাড়ির সবার স্টেটমেন্ট আছে তো?’
‘বিলকুল হ্যায়, স্যার। সঙ্গে ইচ অ্যান্ড এভরিবডির ফোটোগ্রাফভি আছে।’
‘আর ক্রাইম সিনের ফোটো…?’
‘সেও আছে, স্যার। একটা-দুটো ফোটো নয়, অনেক ফোটোগ্রাফ। ক্রাইম সিনের নানান অ্যাঙ্গেল থেকে ফোটো। এভিডেন্সের ফোটো। বাড়ির নানান পোরশানের ফোটো। প্রত্যেকটা রুমের পিকচার—সব আছে, স্যার।’
‘গুড—ভেরি গুড।’
‘তা হলে ওই কথাই রইল, স্যার। নেক্সট সানডে।’
‘ইয়েস—নেক্সট সানডে।’
‘এই চিড়িয়াটাকে যে করে হোক খাঁচায় ঢোকাতে হবে, স্যার।’
এসিজি খুনি কিংবা অপরাধীকে প্রায়ই পাখির সঙ্গে তুলনা করেন। সেইজন্যই রঘুপতি পাখিকে খাঁচায় ঢোকানোর কথা বলল।
অশোকচন্দ্র হেসে বললেন, ‘সিনসিয়ার চেষ্টা তো করব, রঘুপতি। কিন্তু জানো তো, খুন অতি জঘন্য কাজ—বাট খুনি ধরার কাজটা আরও জঘন্য…।’
নিলয় মজুমদারের বাড়ির নাম যদি ‘নিলয় নিবাস’ হয় তা হলে টেকনিক্যালি আপত্তি করার কিছু না থাকলেও গ্র্যামাটিক্যালি বোধহয় আছে। তা ছাড়া নামকরণের প্রবণতা দেখে এটা মনে হওয়াটা কিছু অস্বাভাবিক নয় যে, নিলয় মজুমদার আত্মপ্রচার ভালোবাসতেন। সেইজন্যই ওঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ‘নিলয় কনস্ট্রাকশনস’ এবং বাড়ির নাম ‘নিলয় নিবাস’। ভদ্রলোক বোধহয় কম-বেশি মেগালোম্যানিয়াক ছিলেন।
রং চটে যাওয়া লালচে-গোলাপি তিনতলা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে এসিজি মনে-মনে এইসব কথাই ভাবছিলেন।
বেশ উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা বনেদি ঢং-এর বাড়ি। বাড়ির লাগোয়া মাঝারি মাপের বাগান। বাগানে কয়েকটা বড়-বড় গাছ অগোছালোভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ ছাড়া ছোট-ছোট দু-চারখানা ফুলগাছ। লাস্ট একমাস ধরে বলতে গেলে রোজই এক-দু পশলা বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বাগানের মাটি ভিজে স্যাঁতসেতে। বাগান পেরিয়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার যে-সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা সেটা বেশ সরু এবং বাটিক প্রিন্টের মতো ফাটল ধরা।
বাগানের একপাশে পাঁচিল ঘেঁষে তিনটে ছাতারে পাখি চঞ্চলভাবে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল। এসিজিদের চারজনকে ঢুকতে দেখে চট করে উড়ে পালাল। সেখানে অনেকগুলো গাছের ডাল কেটে লম্বালম্বিভাবে স্তূপের মতো করে সাজিয়ে রাখা ছিল। ছাতারে পাখিগুলোর লাফালাফিতে দুটো ডাল গড়িয়ে পড়ল নীচে। এই ডালগুলো দিয়ে হয়তো বেড়া দেওয়া হবে অথবা ওগুলোকে জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগানো হবে।
বাড়িটাকে দেখে বেশ শান্ত স্নিগ্ধ মনে হচ্ছিল। রোববারের সকালে যেন ছুটির দিনের আলসেমি গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বাউন্ডারি ওয়ালে গাঁথা প্রমাণ মাপের লোহার মেন গেট। তার একদিকের পিলারে সাদা পাথরের ফলক বসানো। তাতে কালো হরফে লেখা ‘নিলয় নিবাস’।
মেন গেট পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজা। সদর দরজা ভেজানো থাকলেও খোলাই ছিল। তা ছাড়া সেখানে কোনও দারোয়ান বা সিকিয়োরিটি গার্ড মোতায়েন ছিল না। হয়তো সেরকম প্রয়োজন নেই বলেই।
সবার প্রথমে রঘুপতি যাদব দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ওর পিছন-পিছন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তারপর ঢুকলেন নিউ আলিপুর থানার ও. সি. নিজামুল হক। আর তাঁর সঙ্গী থানার একজন কনস্টেবল ভগবান মিস্ত্রি।
ভগবান উর্দি পরে থাকলেও রঘুপতি এবং নিজামুল হক সাদা পোশাকে এসেছেন। রঘুপতির হাতে একটা প্লাস্টিকের ফোল্ডার—তার মধ্যে নিলয় মজুমদারের মার্ডার ইনভেস্টিগেশানের জরুরি কাগজপত্র আর ফোটোগ্রাফ। তবে ও. সি. হকসাহেবের হাত খালি, কারণ, তাঁর কাগজপত্রের ফাইলটি ভগবান মিস্ত্রি বহন করছেন। সেটা দেখে এসিজির মনে হয়েছে, সত্যিই ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়!
গাড়িতে করে আসার সময় নিজামুল হক তাঁর ভিউপয়েন্ট থেকে গোটা কেসটার একটা সংক্ষিপ্ত রিক্যাপ অশোকচন্দ্র গুপ্তকে শুনিয়ে দিয়েছেন। এও বলেছেন, সরাসরি প্রমাণ-টমান না পেলেও তাঁর বিশ্বাস, এই মার্ডারের পিছনে প্রজেন বসু রায়ের ইনভলভমেন্ট আছে।
এ-কথায় অশোকচন্দ্র হেসে মাথা নেড়েছেন, বলেছেন, ‘পুলিশের ইনস্টিংট একটা ইমপরট্যান্ট ফ্যাক্টর। আপনার সন্দেহটা আমি মাথায় রাখলাম।’ মনে-মনে ভাবলেন, প্রজেন মজুমদার ফ্যামিলির ব্লাডকিন নয়—সেইজন্যই কি এই সন্দেহ?
এসিজিদের রিসিভ করার জন্য তনয় বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। রঘুপতি ওঁকে এই স্পেশাল ভিজিটের দিনক্ষণ আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছিল। তা ছাড়া আজ গাড়ি থেকে নেমেই ওঁকে ফোন করে জানিয়েছে, ‘আমরা এসে গেছি—।’
টুকটাক পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। অশোকচন্দ্র মুখ তুলে গাছের পাতা আর ডালপালার দিকে তাকিয়ে পাখিগুলোকে খুঁজছিলেন। ডাক শুনে অবশ্য কয়েকটাকে চিনতে পেরেছেন তিনি। শালিখ, বসন্তবৌরী আর বুলবুলি।
অশোকচন্দ্রের পাখি খোঁজার আগ্রহ দেখে নিজামুল হক একটু অবাক হচ্ছিলেন। সেটা লক্ষ করে রঘুপতি বলল, ‘চিড়িয়া স্টাডি করা স্যারের হবি। ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা না করলে উনি অবশ্যই অরনিথোলজিস্ট হতেন…।’
হকসাহেব ভদ্রতার হাসি হেসে বললেন, ‘ভালো, ভালো। ডিটেকটিভদের দু-একটা স্পেশাল হবি থাকা দরকার।’
অশোকচন্দ্র হকসাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জানেন তো, কোনও-কোনও হবি ইনভেস্টিগেশানে খুব হেলপ করে…।’
তনয় মজুমদার এইসব টুকরো কথা চুপ করে শুনছিলেন। ঠোঁটে একচিলতে হাসি। একটু ফাঁক পেতেই নিজের পরিচয় দিয়ে সৌজন্য বিনিময় করলেন। ও. সি. নিজামুল হকের দিকে তাকিয়ে পরিচিতের হাসি হাসলেন। হকসাহেবও পালটা হাসিতে জবাব দিলেন। বোঝা গেল, হকসাহেব তদন্তের খাতিরে এ-বাড়িতে বেশ কয়েকবার আসা-যাওয়া করেছেন।
নিজামুল হক উচ্চতায় খাটো গোলগাল মানুষ। মাথায় টাক, গালে কাঁচাপাকা চাপদাড়ি। গায়ের রং বেশ ময়লা। মুখে সবসময় হাসি লেগে আছে। ফলে ময়লা রঙের অন্ধকার হাসির আলো দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছেন।
অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে তনয় বললেন, ‘আপনার কথা ইনস্পেকটর যাদবের কাছে অনেক শুনেছি। আপনি তো ফিজিক্সের প্রফেসার…রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ছিলেন…।’
‘হ্যাঁ—’ সায় দিয়ে বললেন এসিজি, ‘কয়েকবছর হল রিটায়ার করেছি।’
‘ফিজিক্স খুব কঠিন সাবজেক্ট।’
এসিজি মোটেই বিনয় করে বললেন না, ‘না, না, কী আর এমন কঠিন!’ বরং বললেন, ‘হ্যাঁ, একটু কঠিন তো বটেই!’ তারপর মনে-মনে ভাবলেন, ‘যে কমার্স নিয়ে পড়াশোনা করে বি. কম. পাশ করেছে, তার কাছে ফিজিক্স তো লোহা কিংবা পাথরের মতো কঠিন হবেই!’
এসিজি তনয়কে লক্ষ করছিলেন।
ফরসা। একটু থলথলে চেহারা। বয়েস সাঁইতিরিশ কি আটতিরিশ। চোখে কালো ফ্রেমের আধুনিক চশমা। চশমার কাচের পিছনে থাকা চোখজোড়া যেন কিছু বলতে চায়। রঘুপতির ফাইলে তনয়ের ফোটোগ্রাফ দেখেও এসিজির ঠিক একই কথা মনে হয়েছিল।
তনয়ের পরনে সাদা পাজামা আর গাঢ় নীল রঙের টি-শার্ট। টি-শার্টের বুকের ওপরে বড়-বড় করে লেখা ‘Being Human’।
তনয়ের গা থেকে সিগারেটের হালকা গন্ধ পাচ্ছিলেন এসিজি। মনে-মনে হেসে ভাবলেন, ‘তনয় তা হলে আমারই মতো—স্মোকার। কিন্তু ও কোন ব্র্যান্ড খায়?’
এসিজি রঘুপতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রঘুপতি, আমি নিলয়বাবুর বেডরুমে প্রথমে যেতে চাই। শুধু তুমি আর আমি। বাকিরা অন্য কোথাও ওয়েট করতে পারে…।’
নিজামুল হেসে বললেন, ‘মিস্টার গুপ্ত, আমাকে একটু আপনাদের সঙ্গে দোতলায় যেতে হবে—নিলয়বাবুর ঘরের দরজার সিলটা খুলে দেওয়ার জন্যে।’
‘অবশ্যই। চলুন।’ নিজামুলকে কথাগুলো বলে তনয়ের দিকে তাকালেন এসিজি : ‘আপনি আপনার রুমে গিয়ে ওয়েট করুন, তনয়বাবু—আমি দরকার মতো আপনাকে ডেকে নেব…।’
তনয় ‘থ্যাংক ইউ’ বলে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিল।
হকসাহেব ভগবানকে সদর দরজায় মোতায়েন থাকতে বললেন। ওঁর হাত থেকে ফাইলটা চেয়ে নিলেন। রঘুপতির দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘এটা আমার কাছে থাক। জাস্ট ইন কেস…।’
নিলয়বাবুর ঘরটা থেকে খুনের গন্ধ বেরোচ্ছিল। অন্তত অশোকচন্দ্রের তাই মনে হল।
বেশ বড় মাপের সাজানো-গোছানো ঘর। একদিকের দেওয়াল ঘেঁষে খাট। তার ওপরে বিছানা। এই বিছানাতেই নিলয়বাবুর বডি পড়ে ছিল। বৃদ্ধের পরনে ছিল সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর ডোরাকাটা নীলচে পাজামা।
বিছানার চাদর ছিল রক্তমাখা। নিলয়ের গেঞ্জিতেও রক্ত লেগে ছিল। ওঁর মাথার পিছনে ভারী কোনও জিনিস দিয়ে আঘাত করেছিল খুনি। পরিভাষায় যাকে বলে ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট। সেটার আঘাতে ওঁর মাথার পিছন থেকে এবং মুখ দিয়ে যথেষ্ট ব্লিডিং হয়েছে।
এ ছাড়া খুনি নিলয়ের গলায় রবারের ফিতের ফাঁস এঁটে মরণটান দিয়েছিল—স্লাইডিং উইন্ডোয় যে-রবারের ফিতের লাইনিং দেওয়া হয়, সেই ফিতে। তার টানে কোনও মানুষের দমবদ্ধ হয়ে মারা যাওয়াই স্বাভাবিক।
ফোরেনসিক অ্যানালিসিস আর পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টে যা পাওয়া গেছে তাতে মাথার পিছনের আঘাত, নাকি গলার ফাঁস—ঠিক কোনটার জন্য নিলয় মজুমদার মারা গেছেন সেটা শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিতভাবে বোঝা যায়নি। দুটোর যে-কোনও একটার জন্যই কোনও মানুষের মৃত্যু হতে পারে। যেমন, স্ট্র্যাংগুলেশানের জন্য হাইঅয়েড বোন ভেঙে গেছে, ল্যারিংস ড্যামেজ হয়েছে। অবশ্য বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে হাইঅয়েড ব্রিটল হয়ে যায় বলে মডারেট প্রেশারেই ভেঙে যায়।
নিলয় খুন হয়েছেন রাত সাড়ে দশটা থেকে একটার মধ্যে। সেই সময় সাবি ঘুমিয়ে ছিল। আর তনয় মজুমদার, ওঁর স্ত্রী এবং প্রজেন বসু রায় তিনতলায় তাস খেলছিলেন। যেদিন নিলয় খুন হন তার পরদিন ভোর ছ’টা নাগাদ সাবি জানলার কাচের মধ্যে দিয়ে দেখতে পায় যে, নিলয় রক্তাক্ত অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছেন। তখন ওর চেঁচামেচিতে তনয়, টুনি আর প্রজেন তিনতলা থেকে ছুটে আসেন। ওঁদের চেঁচামেচিতে তার পরপরই দু-চারজন প্রতিবেশী এসে জড়ো হন।
অশোকচন্দ্র নিলয়ের ঘরটা ঘুরে-ঘুরে দেখছিলেন। ঘরে একটা টেবিল, তিনটে চেয়ার। আর একটা ছোট্ট শো-কেস। সবই মামুলি স্ট্যান্ডার্ডের। রঘুপতি হাতের ফোল্ডারটা টেবিলে রেখে ওর স্যারের পাশে-পাশে ঘুরছিল আর খুনের বিষয়ে বকবক করে যাচ্ছিল।
এসিজি প্রথমে বিছানা পরীক্ষা করার পর জানলাগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলেন।
ঘরে মোট তিনটে জানলা—দুটো বারান্দার দিকে, একটা বাইরের বাগানের দিকে। তিনটে জানলাই একরকম দেখতে। প্রতিটি জানলায় ঘরের ভেতরদিকটায় স্লাইডিং দুটো কাচের পাল্লা, আর তার বাইরে মোটা লোহার গ্রিল।
ঘরের বাগানের দিকের দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো চারটে রঙিন ফোটো ঝুলছে। ফোটোগুলো বেশ পুরোনো, আর তাদের বিষয় একই : মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিলয় মজুমদার পুরস্কার জাতীয় কিছু একটা নিচ্ছেন।
নিলয় মজুমদার জানলা-দরজা সব বন্ধ করে ঘুমোতেন। ঘরে দশ বাই দশ ইঞ্চির তিনটে ভেন্টিলেটর বসানো থাকায় সাফোকেশানের কোনও ভয়-টয় ছিল না।
খুনের পরদিন ভোরবেলা তনয়বাবুরা দরজা ভেঙে নিলয়ের ঘরে ঢোকেন। তনয়, টুনি, প্রজেন এবং সাবিত্রী সবাই এটা কমফার্ম করেছে যে, ঘরের সব জানলা এবং দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
নিলয়বাবুর ঘরের দুটো দরজা। একইরকম দেখতে। শক্তপোক্ত। তার মধ্যে একটা দরজা ভাঙা। সেটা বাইরে থেকে ফিতে দিয়ে সিল করে দিয়েছে পুলিশ। অন্য দরজাটা দিয়ে এসিজি আর রঘুপতি যাদব নিলয় মজুমদারের ঘরে ঢুকেছেন।
রঘুপতি এবার ওর স্যারকে দরজা নিয়ে বলতে শুরু করল।
‘জানলার ডেসক্রিপশান তো আপনাকে আগেই দিয়েছি, স্যার।’ ভাঙা দরজাটার কাছে এগিয়ে যেতে-যেতে রঘুপতি বলল, ‘এবারে দরজার কেসটা দেখুন। যে-দরজাটা ভাঙা হয়েছে সেটা দিয়েই নিলয়বাবু অন্দর-বাহার করতেন। দেখুন, স্যার, এটার ছিটকিনিটা ভাঙা। মানে, রাতে শোয়ার সময় মিস্টার মজুমদার ছিটকিনি দিয়ে শুয়েছিলেন। বাইরে থেকে দরজা ভাঙার সময়ে এই ছিটকিনিটাও ভেঙে গিয়েছে।
‘অন্য দরজাটা—মানে, যেটা দিয়ে আমরা এ-ঘরে ঢুকলাম—সেটা মিস্টার মজুমদার ইউজ করতেন না। ওটা সবসময় বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকত। আর সেই তালার চাবি থাকত মিস্টার মজুমদারের কাছে। তো সেকেন্ড দরজাটা অ্যাজ ইউশুয়াল তালা দেওয়া অবস্থাতেই পাওয়া গিয়েছিল। ওটার চাবি পাওয়া গেছে বিছানায়, ডেডবডির পাশে।’
রঘুপতির কথায় সামান্য ফাঁক পেতেই এসিজি জানতে চাইলেন, ‘চাবিটা ভিকটিমের পাশে বিছানায় কেন পাওয়া গেল বলতে পারো? পুলিশ কি এর কোনও এক্সপ্ল্যানেশান খুঁজে পেয়েছে?’
‘না, স্যার—পায়নি।’ ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নড়ল রঘুপতি।
ঘরে ঢোকার সময় অশোকচন্দ্র দেখেছেন, দ্বিতীয় দরজাটার বাইরে হাঁসকল লাগানো। তাতেই সবসময় ভারী তালা ঝোলানো থাকে। এখনও তাই ছিল। তবে সেই বন্ধ তালাটা কাপড় জড়িয়ে গালা দিয়ে সিল করা ছিল। ও. সি. নিজামুল হক একটু আগে সেই সিল ভেঙে দরজাটা এসিজিদের জন্য খুলে দিয়ে গেছেন। এখানকার তদন্তের পাট চুকে গেলে আবার সিল করে দেবেন।
‘তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?’ এসিজি মনে-মনে নিজেকে প্রশ্ন করলেন।
একটা দরজা ভেতর থেকে বন্ধ—যেটা ভেঙে সবাই ঘরে ঢুকেছে এবং নিলয়বাবুর মৃতদেহের মুখোমুখি হয়েছে।
দ্বিতীয় দরজাটা বাইরে থেকে বরাবর যেরকম হাঁসকল এঁটে তালা ঝোলানো থাকে সেরকমই ছিল। চাবি ছিল নিলয়বাবুর কাছে।
ঘরের তিনটে জানলারই স্লাইডিং কাচের পাল্লা আটকানো ছিল। শুধুমাত্র ঘরের ভেতর থেকে সেগুলো খোলা-বন্ধ করা যায়।
এই অবস্থায় মার্ডারার ঘরে ঢুকল কেমন করে? যদি নিলয়বাবু তাকে দরজা খুলে ঘরে ঢুকিয়ে থাকেন তা হলে ওঁকে খুন করার পর খুনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কেমন করে? সব জানলা-দরজা ভেতর থেকে বন্ধ রেখে?
এইজন্যই রঘুপতি বলেছিল, খুনটাতে একটা ‘লকড রুম প্রবলেম’-এর ডায়মেনশন আছে।
এসিজি মনে-মনে ধাঁধাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন আর একইসঙ্গে ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্র খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।
ঘরে একটা বড়সড় স্টিলের আলমারি। তার পাল্লা দুটো সামান্য খোলা। নিলয় মজুমদার মার্ডার হওয়ার পর এই আলমারিটা খোলা অবস্থায় পাওয়া গেছে। ইচ্ছে করে সেই অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয়েছে—যাতে ক্রাইম সিন ডিসটার্বড না হয়। এই আলমারি থেকে কিছু খোয়া গেছে বলে বাড়ির লোকেরা দাবি করেননি।
এসিজি পকেট থেকে একটা পেন নিয়ে সেটা দিয়ে খুব সাবধানে আলমারির একটা পাল্লা আরও একটু ফাঁক করলেন।
সেটা দেখে রঘুপতি হেসে বলল, ‘অত কেয়ার নেওয়ার দরকার নেই, স্যার। ফোরেনসিকের লোকজন অনেকদিন আগেই ওদের ডাস্টিং আর ফিঙ্গারপ্রিন্টের কাজ শেষ করে গেছে।’
পেন পকেটে রেখে দু-হাতে আলমারির দুটো পাল্লাই হাট করে খুলে দিলেন বৃদ্ধ গোয়েন্দা।
ভেতরের দৃশ্য অতি সাধারণ এবং স্বাভাবিক। আর-পাঁচটা আলমারি যেমন হয়! সবক’টা তাকে জামাকাপড় আর কাগজপত্র ঠাসা। তবে একটা তাকে দুটো সাহেবি হ্যাট চোখে পড়ল। নিলয় মজুমদারের হ্যাটের শখ ছিল।
এসিজি একটা সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে খোলা আলমারির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। এরকমই তিনটে হ্যাট বাইরের বাগানে পাওয়া গেছে। হয়তো মার্ডারার ও-দুটো ছুড়ে দিয়েছে ওখানে। দোতলার বারান্দার মুখ থেকে টুপিগুলো ফ্রিসবির মতো ছুড়ে দিলে ওগুলো বাতাসে ভেসে ওই জায়গায় গিয়ে পড়তে পারে।
এসিজি আলমারির লকের কাছটা একবার দেখলেন। না, আলমারিটা মোটেই জোরজবরদস্তি করে খোলা হয়নি। যে খুলেছে সে চাবি দিয়েই খুলেছে। হয় খুনি, নয়তো নিলয়বাবু নিজেই। খুনি যদি খুলে থাকে তা হলে কেন খুলেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না—কারণ, বাড়ির লোকের কথামতো আলমারি থেকে কিছুই খোয়া যায়নি। তা ছাড়া খুনি যে সেখানে কিছু খুঁজেছে আলমারির তাকগুলোর চেহারা দেখে সেরকমটাও মনে হচ্ছে না।
আলমারি ছাড়া ঘরে রয়েছে তিনটে কাঠের চেয়ার, একটা টেবিল, আর একটা শো-কেস। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে সেগুলো বেশ খুঁটিয়ে দেখলেন অশোকচন্দ্র।
রঘুপতির দেওয়া ফাইলের কাগজ ঘেঁটেঘুঁটে আর সব দেখেশুনে বৃদ্ধ গোয়েন্দার মনে হল, নিলয় মজুমদার বেশ ভালোরকম বড়লোক ছিলেন এবং ভালোরকম কিপটে ছিলেন। তার সঙ্গে ছিল খিটখিটে মেজাজ এবং বসগিরির দাপট। এসব মানুষকে খুন করার মোটিভ অনেক সময় স্রেফ বিরক্তি আর ঘেন্না থেকে দানা বাঁধে। ফলে যাঁরা ওঁর ক্লোজ এবং সাফারার তাদেরই কেউ হয়তো এই জঘন্য কাজটা করেছে।
খুনি বাইরের লোক হওয়ার পসিবিলিটি যে একেবারে নেই তা নয়। কারণ, এ-বাড়ির চৌহদ্দির পাঁচিল যথেষ্ট খাটো। সেটা টপকে কারও পক্ষে ভেতরে ঢোকা মোটেই কঠিন নয়। কিন্তু তারপর? তাকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, বারান্দা, নিলয়বাবুর ঘর সবকিছু ঠিকঠাক চিনতে হবে। তারপর…তারপর…।
আবার সেই ‘লকড রুম পাজল’-এ এসে ঠোক্কর খেলেন অশোকচন্দ্র।
একটা জানলার শার্সি সরিয়ে বাইরে বাগানের দিকে দেখলেন। বাউন্ডারি গেটের খানিকটা অংশ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে। গাছের ডালে দুটো কাঠবিড়ালি ছুটোছুটি করছে।
এসিজি আপনমনে বললেন, ‘নিলয়বাবু যে মারা গেছেন সে ব্যাপারে কনফার্মড হওয়ার জন্যে ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট আর গ্যারোটিং। বুঝলে, রঘুপতি—’ রঘুপতির দিকে ফিরে তাকালেন এসিজি। ছোট হয়ে আসা সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বললেন, ‘এই খুন শুধু বিরক্তি আর ঘেন্না থেকে নয়—তার সঙ্গে হয়তো রাগও মিশে ছিল। যদি দেখা যায় যে, এই খুনটার পেছনে মোটিভ শুধু টাকাপয়সা বা বিষয়আশয়, তা হলে আমরা সেই মোটিভটাকে বলি ”মার্ডার ফর গেইন”। কিন্তু আমি সবদিক অ্যানালিসিস করে দেখলাম, তার সঙ্গে ”মার্ডার ফর রিভেঞ্জ” অ্যাঙ্গেলটাও জড়িয়ে আছে—।’
সিগারেটের টুকরোটা নিভে গিয়েছিল। ঘরে কোনও অ্যাশট্রে না থাকায় সেটা জানলা দিয়ে নীচের বাগানে ফেলে দিলেন এসিজি।
রঘুপতি বলল, ‘সবই তো বুঝলাম, স্যার, বাট মার্ডারার?’
‘হুঁ—মার্ডারার।’ এসিজি জানলার ফ্রেমের দিকে তাকালেন : ‘আচ্ছা, গলায় ফাঁস দেওয়া হয়েছে এই রাবার দিয়ে, তাই না?’ প্রশ্নটা করার সময় স্লাইডিং উইন্ডোর ফ্রেমের কিনারায় লাগানো রবারের ফিতের গায়ে আঙুল ছোঁয়ালেন।
‘হ্যাঁ, স্যার। মার্ডারের ব্যাপারটা হওয়ার রাফলি ফিফটিন ডেজ আগে এ-ঘরের তিনটে খিড়কিতে স্লাইডিং উইন্ডো লাগানোর হুকুম দেন মিস্টার মজুমদার। তো মিস্তিরিরা এসে সেই কাজ করে যায়। তারই স্পেয়ার রাবার টেপ হয়তো এ-ঘরে কোথাও পড়ে-টরে ছিল। তারই একটাকে মার্ডারার ইউজ করেছে…।’
এরপর স্টাডিরুমটা ঘুরেফিরে দেখলেন অশোকচন্দ্র।
ঘরটা মাপে ছোট। একটামাত্র জানলা—বাগানের দিকে। বাইরে বেরোনোর আর কোনও দরজা নেই।
ঘরে তিনটে বুক কেস। তাতে ভরতি বই। বেশিরভাগই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বই—কংক্রিট, স্ট্রাকচার, কনস্ট্রাকশন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লেখা। তবে একটা বুক কেস নানান ধর্মগ্রন্থে ঠাসা। তার মধ্যে ভারতের সাধক, কৃত্তিবাসি রামায়ণ, কাশীদাসি মহাভারত ইত্যাদি বই রয়েছে।
রঘুপতির ফাইল থেকে জানা গেছে, নিলয় মজুমদার রোজ রাতে নিয়ম করে রামায়ণ অথবা মহাভারত সুর করে পাঠ করতেন। খুন হওয়ার দিনও তিনি মহাভারত পাঠ করেছিলেন। সাবিত্রী সেটা শুনেছে। ও তখন সারাদিনের কাজ সেরে বারান্দায় বিশ্রাম করছিল। আলো নিভিয়ে নিজের মোবাইল নিয়ে খুটুরখাটুর করছিল, এক তুতো বোনকে ফোন করছিল, এ-কথা সে-কথা বলছিল। তারই মধ্যে ও সেই সুর তুলে পাঠ করা শুনেছে। দাদুবাবা তখন পাশা খেলার জায়গাটা পড়ছিলেন। মাঝখানে পড়া থামিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে আবার পড়ছিলেন। নিলয় মজুমদারকে সাবিত্রী ‘দাদুবাবা’ বলে ডাকত।
‘চলো, রঘুপতি—এ-ঘরে আর দেখার কিছু নেই।’ হাতে হাত ঘষতে-ঘষতে নিলয় মজুমদারের বেডরুমে ফিরে এলেন বৃদ্ধ হুনুর। তারপর বললেন, ‘এবারে এ-বাড়ির চার বাসিন্দার সঙ্গে একটু কথা বলা যাক…।’
রঘুপতি বলল, ‘লেকিন গুপ্তাসাব, পুলিশ তো চারজনকে ভালোমতন ইনটারোগেট করেছে। সেসব ইনটারোগেশানের হার্ড কপি তো আমার ফাইলে ছিল—আপনি পড়িয়েছেন ভি…।’
‘আঃ, রঘুপতি, ডোন্ট বি ইমপেশেন্ট। আমি বুড়ো মানুষ। ওঁদের সঙ্গে একটু বকবক করতে ইচ্ছে হয়েছে তো করি না কেন?’
স্যারের কথায় রঘুপতি তিনটে চেয়ার আর একটা টেবিলকে বেডরুমের একদিকে সাজিয়ে নিল। তারই একটা চেয়ারে বসে স্যার প্রাক্তন ছাত্রকে জিগ্যেস করলেন, ‘আচ্ছা, মার্ডার ওয়েপন—মানে, ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্টটা পুলিশ এখনও ট্রেস করতে পারেনি, না?’
‘না, স্যার—উও আভি তক মিলা নেহি।’ রঘুপতির গলায় হেরে যাওয়া সুর। ও একটু আনমনাভাবে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে স্যারের পাশে বসে পড়ল।
‘অদ্ভুত ব্যাপার!’ আপনমনেই বললেন এসিজি, ‘রাবারের ফিতেটা নিলয়বাবুর গলায় এঁটে বসে রইল, অথচ মাথা ক্রাশ করার অস্ত্রটা খুনি সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেল…!’ বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন এদিক-ওদিক।
‘কিন্তু নিয়ে গিয়ে ওয়েপনটা সে লুকোবে কোথায়?’
‘গাছের পাতা লুকোনোর সেরা জায়গা হল বাগান অথবা জঙ্গল।’ এসিজি হেসে বললেন, ‘বই লুকোনোর সেরা জায়গা হল লাইব্রেরি অথবা বইয়ের দোকান। একটা লোহার রড লুকোনোর ভালো জায়গা হল কনস্ট্রাকশন সাইট।’
‘আপনি কি বলতে চাইছেন ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্টটা একটা লোহার রড? আর তনয় মজুমদার, প্রজেন বসু রায় এঁরা তো কনস্ট্রাকশনের কাজ করে…!’
‘আমি কিছুই বলতে চাইছি না, মাই ডিয়ার, রঘুপতি। আই অ্যাম ওনলি থিংকিং লাউডলি। যাকগে, তুমি মিস্টার তনয় মজুমদারকে একবার এ-ঘরে আসতে বলো—একটু কথা-টথা বলি…।’
রঘুপতি যাদব চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল, এমন সময় সাবিত্রী একটা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল। ট্রে-তে দু-কাপ কফি, আর দুটো প্লেটে বিস্কুট, সিঙ্গাড়া আর সন্দেশ।
কাপ-প্লেটগুলো ট্রে থেকে নামিয়ে টেবিলে সাজিয়ে দিল সাবিত্রী।
‘এগুলো আপনারা খেয়ে নেবেন, স্যার।’
এসিজি সাবিত্রীকে দেখছিলেন।
বেশ সুন্দর দেখতে। দেখে ‘কাজের মেয়ে’ বলে মনেই হয় না। মাঝারি গায়ের রং। চামড়া বেশ সজীব, তেলেতেলে। গোল মুখ। সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর। চোখ দুটো জ্যান্ত—যেন কথা বলছে।
সাবিত্রী একটা হলদে চুড়িদার পরেছে—তার ওপরে ছাপা রয়েছে ছোট-ছোট সাদা আর কালো ফুল। ওর মাথার চুল বেশ ঘন আর কোঁকড়ানো। তাতে একটা লাল রঙের ‘বো’ লাগানো রয়েছে।
‘তুমি সাবিত্রী?’ এসিজি ওকে জিগ্যেস করলেন। রঘুপতির ফাইলে ওর ফোটো আগেই দেখেছিলেন। সত্যিই ছবির মতো মুখ।
‘হ্যাঁ, স্যার—’ সাবিত্রী এসিজির দিকে সরাসরি তাকিয়ে জবাব দিল। ওর মধ্যে সংকোচের কোনও ছায়া খুঁজে পাওয়া গেল না।
রঘুপতি ওকে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে যে আরও দুজন এসেছেন…।’
‘হ্যাঁ, ওনাদেরকেও কফি, সিঙ্গাড়া এসব দিয়েছি। ওনারা ড্রয়িং-এ বসেছেন।’
‘সাবিত্রী, তুমি একটু বোসো—তোমার সঙ্গেই আগে কথা বলি।’
এসিজির কথায় সাবিত্রী সহজভাবে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।
অশোকচন্দ্র সিঙ্গাড়ায় কামড় দিলেন এবং চুমুক দিলেন কফির কাপে।
রঘুপতিও ‘স্যার’-কে অনুসরণ করল। বিড়বিড় করে বলল, ‘পেট মে চুহা দওড় রহা থা…।’
খুনের দিন সন্ধে থেকে রাত্রি পর্যন্ত ঠিক কী-কী হয়েছিল সেটা এসিজি জানতে চাইলেন সাবিত্রীর কাছে।
উত্তরে সাবিত্রী যা-যা বলে গেল সেসব ইনস্পেকটর যাদবের ফাইলে আগেই পেয়েছেন অশোকচন্দ্র। তবুও ওর প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।
সাবিত্রী বারান্দায় শুয়েছিল। খুন নিশ্চয়ই হয়েছে অনেক রাতে। তখন ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। একবার ঘুমিয়ে পড়লে তারপর ওর আর কোনও হুঁশ থাকে না। সকালে উঠে দাদুবাবাকে ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে ও জানলার শার্সি দিয়ে উঁকি মারে। তখনই ওই ভয়ংকর দৃশ্য ও দেখতে পায়। বিছানায় একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড।
সাবিত্রী কথা বলতে-বলতে শিউরে উঠল।
‘তুমি কি এখনও ওই বারান্দাতেই শুচ্ছ?’ এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার ভূতের ভয় নেই?’
সাবি ঘাড় নেড়ে যেন লজ্জা পেয়ে হাসল : ‘হ্যাঁ, স্যার—ওখানেই শুই। আমার কোনওদিনই ভূত-পেতনির ভয়-টয় নেই। তা ছাড়া দাদুবাবা আমাকে খুব ভালোবাসত। আমি আগে বারান্দায় যেমন শুতাম, ওই মার্ডারের পর ছ’দিন শুইনি। পুলিশ বারণ করেছিল। তারপর থেকে আবার ওখানে শুই।’
‘আচ্ছা, সাবি, তুমি তো পুলিশকে সবই বলেছ…’ স্নেহময় বাবা যেভাবে মেয়ের সঙ্গে কথা বলে ঠিক সেই সুরে বলতে শুরু করলেন অশোকচন্দ্র, ‘এমন কিছু কি তোমার মনে পড়ছে যেটা তোমার একটু অদ্ভুত মনে হয়েছে? ভালো করে ভেবে দ্যাখো। এমন কোনও ব্যাপার যেটা স্রেফ এলেবেলে মনে হতে পারে, বাট পিকিউলিয়ার…।’
সাবি হেসে বলল, ‘ভালো করে ভাবতে হবে না, এমনিই মনে আছে। ব্যাপারটা তেমন কিছু নয় ভেবে পুলিশকে আর বলিনি। আপনি, স্যার, যখন জানতে চাইছেন তখন বলছি…।’
রাত্রি তখন ন’টা কি সওয়া ন’টা হবে। সাবি বারান্দায় শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিল। হঠাৎ ও শুনতে পায় দাদুবাবা মহাভারত থেকে সুর করে পাঠ করছেন। চুপচাপ শুয়ে সেই পাঠ শুনতে বেশ লাগছিল। তারপর, যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীকে পাশা খেলায় বাজি ধরলেন তখন হঠাৎই দাদুবাবা পাঠ থামিয়ে দুবার হাঁচলেন, তারপর আবার পড়তে শুরু করলেন।
‘এবারে, স্যার, পিকুলিয়ার ব্যাপারটার কথা বলি…।’
একটা সময়ে দাদুবাবা মহাভারত পড়া শেষ করেছিলেন। তার পরপরই সাবি ছোটদাদাবাবুকে—মানে, তনয়কে—দাদুবাবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দ্যাখে। সাবির দিকে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুতভাবে তনয় বলেন, ‘বাবা এখন ব্যস্ত। মহাভারত পড়ছেন। তার মাঝে ডিসটার্ব করলেই তো আবার খেপে যাবেন! যা-তা বলতে শুরু করবেন। যাকগে, পরে আসব’খন।’
মহাভারত পড়া শেষ হয়ে গেলে সাবিত্রী বারান্দার আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। তখন ও তিনতলা থেকে কথাবার্তা হইচই শুনতে পাচ্ছিল। ছোটদাদাবাবুরা তিনজনে মিলে তাস খেলছিলেন। রোজ রাতে ওঁরা তাসের আসর বসান। কল ব্রে না কী যেন খেলেন। খেলা অনেক রাত পর্যন্ত চলে।
হয়তো এভাবে ঘণ্টাখানেক বড়জোর কেটেছিল, তারপরই সাবির হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। ওর মনে হল কে যেন ওকে ডাকল। ঘুম চটে গিয়ে ও শুনতে পায়, দাদুবাবা মহাভারত পড়ছেন এবং ওই পাশা খেলার জায়গাটাই আবার পড়ছেন।
সাবিত্রীর ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগে। কিন্তু ও ধরে নেয় যে, ওটা খিটখিটে বুড়োর অদ্ভুত খেয়াল। ও আধোঘুমে মহাভারত শুনতে থাকে।
আলো নেভালেও বারান্দাটা কখনও তেমন অন্ধকার হয় না, কারণ, এদিক-সেদিক থেকে রাস্তার কমলা রঙের আলো ছিটকে এসে দেওয়ালে পড়ে। সেই আবছা আলোয় সাবিত্রী হঠাৎ খেয়াল করে, ‘নতুন দাদাবাবু’—মানে, প্রজেন বসু রায়—দাদুবাবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন, দরজায় নক করবেন কি না ভাবছেন।
সাবি যে জেগে গেছে সেটা বুঝতে পেরে তিনি আপনমনেই বলেন, ‘না বাবা, এখন স্যারকে ডিসটার্ব করে লাভ নেই। হয়তো ব্যাপক চটে গিয়ে চেঁচামেচি করে বাড়ি একেবারে মাথায় তুলবেন…। যাই, তাস খেলায় বসি গিয়ে। যা বলার কাল বলব’খন…।’
এই কথা বলতে-বলতে প্রজেন বসু রায় চলে যান।
তখনও মহাভারত পড়া চলছিল। একটু পরেই হাঁচির শব্দ শুনতে পায় সাবি। ও ভাবছিল, দাদুবাবা এই বোধহয় ওকে ডাকবেন, হাঁচি-কাশির ওষুধ দিতে বলবেন।
কিন্তু না, দাদুবাবা ওকে ডাকেননি।
এরপর সাবিত্রী ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর সকালবেলা…।
প্রজেন বা তনয় ব্যবসার নানান কাজে প্রায়ই নিলয়বাবুর ঘরে আসতেন। কারণ, ওঁকে জিগ্যেস না করে কোনও ডিসিশন নিলে উনি ভীষণ রেগে যেতেন। মুখে যা আসে তাই বলে অপমান করতেন। তাই প্রজেন এবং তনয় সবসময় খুব চাপে থাকতেন।
সেদিন রাতে ওঁরা দুজনে যে দাদুবাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন সেটা সাবি পুলিশকে প্রথমেই জানিয়েছিল। পুলিশের রিপোর্টে সে-কথা লেখা আছে। যেটা নেই সেটা হল দুবার মহাভারত পড়ার পিকিউলিয়ার ব্যাপারটা।
এসিজি সেটা নিয়েই একটু ভাবছিলেন।
রঘুপতি আড়চোখে স্যারের দিকে তাকাল। লক্ষ করল, স্যারের ভুরু কুঁচকে গেছে। শূন্য নজরে তাকিয়ে আছেন একটা জানলার দিকে।
সাবিত্রীর আর কিছু বলার ছিল না। তাই এসিজি ওকে বললেন, ‘এবারে তুমি এসো, সাবি—।’
সাবিত্রী চলে গেল। যাওয়ার আগে প্লেটগুলোর দিকে ইশারা করে বলে গেল, ‘সব খেতে হবে কিন্তু—।’
‘গুপ্তাসাব, কিছু বোঝা গেল?’ রঘুপতি আলতো গলায় জিগ্যেস করল।
‘হুঁ..’ আনমনাভাবে বললেন এসিজি, ‘কিছু-কিছু তো বোঝা গেল অবশ্যই।’
একটু পরে বললেন, ‘আচ্ছা, রঘুপতি, একটা ব্যাপার তুমি নোট করেছ?’
‘কী, স্যার?’
‘এই মার্ডার কেসটায় বড্ড বেশি ক্লু। আর তার সঙ্গে আনন্যাচারাল সব কাণ্ড।’
‘মতলব?’
‘মতলব, রঘুপতি, টু মেনি ক্লুজ। টু মেনি পয়েন্টার্স। দ্যাখো, প্রথমেই হচ্ছে, মালটিপল মার্ডার মিনস : গলায় ফাঁস দেওয়া, আর তার সঙ্গে মাথার পেছনে ভারী কিছু দিয়ে জোরে হিট করা। অথচ নিলয়বাবু ওয়জ অ্যান ওল্ড ম্যান—চুয়াত্তর বছর বয়েস ছিল ওঁর। তারপর, রাবার স্ট্রিপটা ডেডবডির গলায় শক্ত করে এঁটে রইল, বাট ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্টটা মার্ডারার সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। নেক্সট হচ্ছে, লকড রুম মিস্ট্রি। একটা দরজা ভেতর থেকে ছিটকিনি আঁটা, আর অন্য দরজাটা বাইরে থেকে হাঁসকল এঁটে তাতে প্যাডলক ঝোলানো—সেই প্যাডলকের চাবি আবার নিলয়বাবুর বিছানায়। ঘরের তিনটে জানলাতেই গ্রিল দেওয়া এবং জানলার স্লাইডিং গ্লাস উইন্ডো ঘরের ভেতর দিকে থেকে আটকানো। নিলয় মজুমদারের আলমারি খোলা, কিন্তু কিছু খোয়া যায়নি। শুধু আলমারি থেকে তিনটে টুপি নিয়ে খুনি বাইরের বাগানে ছুড়ে ফেলে গেছে।
‘এসবের মানে কী, রঘুপতি? এতগুলো ব্যাপারকে আমরা যুক্তি দিয়ে সাজিয়ে কোরিলেট করব কেমন করে? তার ওপর তো সাবিত্রীর বলা পিকিউলিয়ার ব্যাপারটা আছেই। নাঃ, কিছু একটা উত্তর বের করতেই হবে।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এসিজি। মাথার পিছনের সাদা চুলের গোছা ধরে কয়েকবার টান মারলেন। মাথা ঝুঁকিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন।
রঘুপতি ওর প্রাক্তন স্যারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হাতঘড়ির দিকে একপলক চোখ রেখে স্যারকে জিগ্যেস করল, ‘স্যার, তনয় মজুমদারকো বুলায়ে কেয়া?’
‘হ্যাঁ, ডাকো—।’
তনয় মজুমদার নিলয়ের ঘরে এলেন মিনিট-পাঁচেক পরেই। সকালে যে-পোশাক পরে তিনি এসিজিদের মুখোমুখি হয়েছেন এখনও সেই পোশাকই পরে আছেন।
তনয় থিতু হয়ে বসার পর এসিজি বললেন, ‘সবকথাই তো পুলিশকে আপনি বলেছেন। সেসব রিপোর্ট আমি দেখেছি। আপনার নতুন কিছু বলার থাকলে বলুন…।’
‘নতুন কথা আর কী বলব!’ একটা লম্বা শ্বাস ফেলে তনয় বললেন। ওঁর কিছু জানা নেই, আর কে ওঁর বাবাকে খুন করতে পারে সে-বিষয়ে ওঁর কোনওরকম ধারণাও নেই। খুনটা যে-সময়ে হয়েছে বলে পুলিশের আইডিয়া, সেসময়ে তিনি তাস খেলায় বিজি ছিলেন। ওই তাসই ওঁর একমাত্র নেশা।
বাইরে থেকে কেউ এসে নিলয়বাবুকে খুন করতে পারে কি না, এ-প্রশ্নের জবাবে তনয় বলেছেন, এ-বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালটা খাটো। বাইরে থেকে কোনও আততায়ী সহজেই পাঁচিল ডিঙিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারে। না, নিলয়ের কোনও শত্রু ছিল বলে ওঁর জানা নেই। তবে নিলয় খুব মাথাগরম রগচটা মানুষ ছিলেন। হয়তো নিজের ব্যবহারের জন্য কোনও শত্রুর জন্ম দিয়ে থাকতে পারেন।
তনয় আর প্রজেন মিলে ‘নিলয় কনস্ট্রাকশনস’-এর কাজ দেখত। তবে নিলয়ের কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল না নিয়ে কোম্পানির একটি কাজও করা যেত না।
‘বাবা ব্যবসা ছেড়েও দেবেন, আবার ছেড়েও দেবেন না।’
এটা একটা দম আটকানো অবস্থা ছিল। প্রজেন আর তনয় বলতে গেলে রোজ পালা করে নিলয়ের হাতে অপমানিত হতেন।
না, খুনি ধরা পড়ল কি পড়ল না এ নিয়ে তনয়ের কোনও ইন্টারেস্ট নেই। তনয়ের কথার ভঙ্গিতে ওঁকে বেশ বিরক্ত বলে মনে হল।
খুনের দিন রাতে নিলয় মজুমদার দুবার মহাভারত পড়েছিলেন কেন সে ব্যাপারে তনয়ের কোনও আইডিয়া নেই। তবে একই অংশ দুবার পড়েছেন শুনে তনয় একটু অবাক হল। তারপর তেতো হেসে বলল, ‘বাবার খেয়াল! এ নিয়ে কোনও কথা বলা যাবে না। হি ওয়জ দ্য বস।’
তনয় মজুমদার চলে যাওয়ার পর রঘুপতি প্রজেন বসু রায়কে খবর পাঠাল।
এমন সময় রঘুপতির মোবাইল ফোনে সুরেলা মিউজিক বেজে উঠল : ফোন এসেছে। রঘুপতি পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। ওর এক জুনিয়ার সহকর্মীর ফোন। বসুমিত্র জানা।
রঘুপতি কলটা রিসিভ করে বলল, ‘হ্যালো, জানা—আমি আজ একটা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশানের কাজে নিউ আলিপুরে এসেছি। একটু বিজি আছি। কাল অফিসে গিয়ে তোমার সঙ্গে ডিসকাস করি?’
ওপাশ থেকে বসুমিত্র জানা কী বললেন সেটা শোনা গেল না। তবে রঘুপতি বারদুয়েক মাথা নাড়ল। শেষে ‘ও. কে.’ বলে রিসেট বোতাম টিপে দিল।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত রঘুপতির মোবাইল ফোনটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আধুনিক ডিজাইনের স্মার্টফোন। রঘুপতি অল্পসল্প শৌখিন মানুষ।
হঠাৎই এসিজি উত্তেজিত হয়ে রঘুপতিকে কী একটা বলতে গেলেন, কিন্তু প্রজেন বসু রায় ঘরে ঢুকে পড়ায় নিজেকে সামলে নিলেন।
প্রজেনের চেহারা লম্বা-চওড়া, রোদে জলে পোড় খাওয়া। বয়েস চল্লিশের খারাপ দিকে। রগের কাছে চুলে পাক ধরেছে। মাথায় কোঁকড়া চুল, চোখা নাক, চোখে চশমা, হাতে বেশ বড় মাপের মোবাইল ফোন। সেটা থেকে একটা তার বেরিয়ে ওঁর ডানকানে গিয়ে ঢুকেছে। অন্য কানের ফুটোটা দয়া করে খোলা রয়েছে এসিজিদের কথা শোনার জন্য।
প্রজেনের গায়ে গোলাপি রঙের একটা রাউন্ড নেক টি-শার্ট, পায়ে পাজামা আর প্যান্টের মাঝামাঝি একটা ক্যাজুয়াল উইয়্যার।
ওঁর হাবভাব অথবা চোখের দৃষ্টিতে কেমন যেন একটা উদ্ধত মাত্রা আছে।
এসিজি প্রজেনকে বসতে বললেন। আড়চোখে খেয়াল করলেন, রঘুপতির চোখে-মুখে একটা অপছন্দ অথবা বিরক্তির ছাপ।
ফাইলে দেখা ফোটোগ্রাফের সঙ্গে প্রজেন বসু রায়ের চেহারা মিলে গেলেও এই উদ্ধত ভাবভঙ্গিটা ফোটোগ্রাফে ধরা পড়েনি।
প্রজেন চেয়ারে বসে বললেন; ‘এতদিন পরে আবার পুলিশ! বলুন কী বলবেন।’
রঘুপতি বলল, ‘পহেলে কান কা তার খোল লিজিয়ে…।’
প্রজেন একটু অবাক হয়ে রঘুপতির দিকে তাকালেন। ভুরু কুঁচকে গেছে। প্রশ্ন জেগে উঠেছে ওঁর চোখে, যার অর্থ ‘হু দ্য হেল আর ইউ?’
রঘুপতি অশোকচন্দ্র গুপ্তর পরিচয় দিল। তারপর নিজের পরিচয় দিল : ‘ইনস্পেকটর রঘুপতি যাদব। হোমিসাইড স্কোয়াড, লালবাজার। নাউ টেক দ্য ব্লাডি ইয়ার প্লাগ অফ।’
কথার সুরে এসিজি বুঝলেন, রিখটার স্কেলে রঘুপতির টেম্পার চড়ছে।
এসিজি তাড়াতাড়ি প্রজেনকে বললেন, ‘ইনস্পেকটর যাদবের ধৈর্য খুব কম। কানের ছিপিটা জলদি খুলে ফেলুন…নইলে রঘুপতি ওটা টান মেরে খুলে দেবে। সেটা আপনার ভালো লাগবে না।’
এ-কথায় প্রজেন কেমন যেন ঘাবড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি ইয়ার প্লাগটা খুলে ফেললেন।
প্রজেনের স্টেটমেন্ট এবং ইনটারোগেশানের ট্রানস্ক্রিপশান এসিজি রঘুপতির দেওয়া ফাইল থেকে পড়েছেন। খুনের দিন রাতে প্রজেনও সেরকম কিছু দেখেননি বা শোনেননি।
সত্যি, এঁদের সবারই অবস্থা সেই বিখ্যাত তিনটি বানরের মতো : একজনের চোখে হাত চাপা দেওয়া, একজনের ঠোঁটের ওপরে, আর একজনের দু-কানে আঙুল গোঁজা।
এসিজি প্রজেনকে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি তো ”নিলয় কনস্ট্রাকশনস”-এর ম্যানেজার এবং টুয়েন্টি পারসেন্টের পার্টনার…?’
প্রজেন চুপ করে রইলেন।
‘কী, কিছু বলুন…।’
‘এটা কি কনফার্ম করতে হবে নাকি? আগে তো বহুবার বলেছি যে, হ্যাঁ।’
‘আপনি যে এই মজুমদার বাড়িতে থাকেন তাতে আপনার অস্বস্তি হয় না, খারাপ লাগে না?’
‘কেন? খারাপ লাগবে কেন? এটা তো আমার রাইট—অধিকার। কেন, আপনারা জানেন না, আমার বাবা ব্রজেন বসু রায় কী ভাবে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন? এবং হু ওয়জ রেসপনসিবল ফর দ্যাট ব্লাডি অ্যাক্সিডেন্ট?’
‘এখন তো নিলয় মজুমদার মারা গেছেন। হি ডায়েড ভায়োলেন্টলি।’ একটু চুপ করে রইলেন এসিজি। তারপর : ‘এখন আপনি কী করবেন ভাবছেন? এ-বাড়িতে থাকার ব্যাপারটা কনটিনিউ করবেন, নাকি অন্য কোনও অ্যারেঞ্জমেন্টের কথা ভাবছেন?’
‘হঠাৎ এ-কথা জিগ্যেস করছেন? অন্য কোনও অ্যারেঞ্জমেন্টের কথা ভাবতে যাব কেন? এখন তো এ-বাড়িটা অনেক বেশি পিসফুল। সবচেয়ে বাজে লোকটাই তো চলে গেছে।’
‘এভাবে কথা বলাটা কি ঠিক হচ্ছে? একজন বয়স্ক রেসপেক্টেবল মানুষ…ওরকম ব্রুটালি খুন হয়ে গেলেন…।’
‘অনেক আগেই ওঁর ব্রুটালি খুন হওয়া উচিত ছিল। আর রেসপেক্টেবল! রেসপেক্ট মাই ফুট! আপনি জানেন, নিলয়বাবু ডেইলি বেসিসে আমাকে কী রেটে ইনসাল্ট করতেন? ছোট-বড় যে-কোনও কাজ করতে গেলেই ওঁর কাছ থেকে আগে পারমিশান নিতে হত!’
রঘুপতি প্রজেনের হাতের দিকে দেখছিল। শিরা বের করা শক্তসমর্থ হাত। এ-হাতে শক্তির কোনও ঘাটতি নেই।
এসিজি প্রজেনকে জিগ্যেস করলেন, ‘খুনের দিন রাতে আপনি মিস্টার মজুমদারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন তিনি মহাভারত পড়ছিলেন…।’
‘হ্যাঁ, আমাকে উনি দেখা করতে বসেছিলেন। তনয়ের ঘরে বসে আমরা তখন কল ব্রে খেলছিলাম। খেলার মাঝেই আমি দশ মিনিট সময় চেয়ে উঠে যাই। বাট উনি তখন বিজি ছিলেন—ওই রামায়ণ বা মহাভারত কিছু একটা পড়ছিলেন। তাই আমি আর ডিসটার্ব করিনি। যা খ্যাঁচখেঁচে পাবলিক!’
প্রজেনকে আর কিছু জিগ্যেস করার ছিল না। এসিজি ওঁর দিকে তাকিয়ে মনে-মনে কিছু একটা হিসেব কষছিলেন।
‘আমি কি এবার যেতে পারি?’ প্রজেন জিগ্যেস করলেন।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—অবশ্যই যেতে পারেন।’
‘থ্যাংক ইউ—’ বলে প্রজেন উঠে দাঁড়ালেন। রঘুপতি যাদবের দিকে একবার ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যেতে-যেতে ডানকানে ইয়ার প্লাগটা আবার গুঁজে নিলেন।
বেলা যে অনেক বেড়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না মেঘের জন্য। এখন জানলার বাইরে তাকালে ঝিরঝিরে বৃষ্টিও চোখে পড়ছে।
রঘুপতি মাথার ওপরে ঘুরে চলা সিলিং ফ্যানটার দিকে একবার তাকাল। ‘ওর বোধহয় গরম লাগছে,’ এসিজি ভাবলেন।
নিজামুল হকসাহেব দরজায় এসে উঁকি দিলেন। জিগ্যেস করলেন, ‘কী, সার, কতদূর? বসে-বসে তো বোর হয়ে গেলাম—।’
এসিজি পালটা হেসে বললেন, ‘মনে হয় ব্যাপারটা একটু-একটু ধরতে পেরেছি। আসলে লকড রুম পাজলটা সলভ করার পরই আসল সলিউশানটা আবছাভাবে সামনে চলে এসেছে।’
রঘুপতি উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইল, ‘সচমুচ, স্যার?’
এসিজি পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘টুনি মজুমদারের সঙ্গে একটু কথা সেরে নিই, তারপর তোমাদের বলব বন্ধ ঘরের পাজলের সলিউশান। তারপর মার্ডারারকে জালে তোলা তোমার আর ও. সি.-সাহেবের কাজ।’
নিজামুল হক হেসে বললেন, ‘শয়তানটার দিকে একবার ইশারা করেই দেখুন না, সার। জালে তুলে এমন মেডিসিন দেব যে, গড়গড় করে সব উগরে দেবে। তার ওপরে ইনস্পেকটর যাদববাবুও তো রয়েছেন…।’
রঘুপতি বলল, ‘স্যার, একটু জলদি করুন—অলরেডি দুটো বেজে গেছে। খিদেয় পেট চোঁচোঁ করছে।’
‘বুঝতে পারছি, রঘুপতি। বাট আর-একটু—বড়জোর হাফ অ্যান আওয়ার কি ওয়ান আওয়ার…প্লিজ!’
সিগারেটে পরপর তিনটে টান দিয়ে সেটা টেবিলের পায়ায় ঘষে নিভিয়ে দিলেন এসিজি। কারণ, টুনি মজুমদার এখুনি আসবেন। কোনও মহিলার সামনে স্মোক করাটা শিষ্টাচার নয়।
নিভে যাওয়া সিগারেটটা নিয়ে এসিজি উঠে গেলেন জানলার কাছে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ফেলে দিলেন বাগানে।
রঘুপতি মিসেস মজুমদারকে খবর দেওয়ার জন্য নিজামুলকে রিকোয়েস্ট করল। হকসাহেব চোখ মটকে হেসে চলে গেলেন।
একটু পরে টুনি মজুমদার যখন এলেন তখন হকসাহেবের চাউনি এবং হাসির মানে বোঝা গেল।
টুনি মজুমদার লাল, সবুজ এবং হলুদ রঙের গডি কম্বিনেশনের একটা পাতিয়ালা চুড়িদার পরেছেন। তার সঙ্গে চড়া দাগের সাজগোজ। সব মিলিয়ে আপাদমস্তক মেকাপ এবং ফ্যাশনের চলমান বিজ্ঞাপন। এই ঘোর দুপুরে যে এরকম উৎকট সাজগোজ করে বাড়িতে ঘোরাঘুরি করা যায় সেটা এসিজি কিংবা রঘুপতির আগে জানা ছিল না। অবশ্য এও হতে পারে যে, এ-ঘরে ডাক পাওয়ার জন্য উনি সাজগোজ করে তৈরি হচ্ছিলেন। সাজগোজ ছাড়াও পারফিউমের উৎকট গন্ধে এসিজিদের দম বন্ধ হয়ে এল।
টুনির আবির্ভাবের প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়ে এসিজি ওঁকে বসতে বললেন। লক্ষ করলেন, রঘুপতির ভুরু কুঁচকে গেছে। এবং সেই অবস্থাতেই ও ফ্রিজ শট হয়ে আছে।
রঘুপতি টুনিকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
টুনি মজুমদারের বয়েস বত্তিরিশ কি তেত্তিরিশ হবে। কিন্তু সাজগোজ আর হাবভাবে কচি সেজে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা বেশ নজরে পড়ছে।
রঘুপতির দেওয়া ফাইল খুঁটিয়ে পড়ে এসিজি টুনি মজুমদার সম্পর্কে যেটুকু বুঝেছেন সেটা হল, এই ফ্যাশনদুরস্ত মহিলা মজুমদারবাড়ির সাতেও নেই, পাঁচেও নেই, এমনকী সাত আর পাঁচের যোগফল বারোতেও নেই।
পুলিশের যে-কোনও কোশ্চেনের উত্তরে ওঁর স্ট্যান্ডার্ড রেসপন্সগুলো হল : ‘জানি না’, ‘দেখিনি’, ‘শুনিনি’ আর ‘মনে নেই’। সত্যি, তিন বানরকে হার মানানোর মতো।
ভদ্রমহিলা অকারণে নিজের বুটিক নিয়ে বকবক করে যাচ্ছিলেন। এ-বাড়ির মালিক নিলয় মজুমদার নামের মানুষটা যে বাইশ দিন আগে ব্রুটালি মার্ডারড হয়ে গেছে সেটা যেন ওঁর মাথাতেই কখনও ঢোকেনি। এই ভদ্রমহিলাকেই এসিজির সবার সেরা ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট বলে মনে হল। তনয় মজুমদার এই অদ্ভুত ‘জিনিস’-টিকে নিয়ে কী করে দিনের পর দিন কাটাচ্ছেন সেটা ভেবে এসিজি শিউরে উঠলেন।
টুনি মজুমদারের কাছ থেকে সেরকম কোনও তথ্য পাওয়া গেল না। শুধু এটুকু জানা গেল যে, দিনের বেশিরভাগ সময়টাই তিনি বাইরে ব্যস্ত থাকেন। এত ব্যস্ত যে, তনয়ের সঙ্গে ওঁর দেখা-সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা খুবই কম হয়। নেহাত একই বাড়িতে থাকেন বলে দেখা হয়। আর রোজ রাতে তিনি তনয় এবং প্রজেনবাবুর সঙ্গে তাস খেলতে বসেন। তখনই যেটুকু আড্ডা, হুল্লোড় কিংবা কথাবার্তা হয়।
এসিজি জানতে চাইলেন, নিলয় মজুমদার শ্বশুর হিসেবে কেমন ছিলেন।
উত্তরে এসিজির দিকে কয়েকসেকেন্ড স্থির নজরে তাকিয়ে রইলেন টুনি।
এসিজি হঠাৎই ভাবলেন, টুনি ওর চার্মের স্পেল দিয়ে এসিজিকে হিপনোটাইজ করতে চাইছেন কি না। সন্দেহ নেই, অশোকচন্দ্র যথেষ্ট বৃদ্ধ এবং এসব চার্ম-টার্ম-এর রিং-এর বাইরে চলে গেছেন বহুবছর। কিন্তু তবুও ওঁর নজরটা যেন কেমন-কেমন—কোথাও যেন একটা গোপন নষ্টামির ছোঁয়া লেগে আছে।
‘শ্বশুর হিসেবে কেমন ছিলেন জানতে চাইছেন?’ চোখ সরু করলেন টুনি : ‘উনি শ্বশুর ছিলেন না—উনি ছিলেন মহা-শ্বশুর।’
ওঁর কথা বলার ঢঙে যথেষ্ট ঘেন্না এবং বিরক্তির উপাদান টের পেলেন বৃদ্ধ গোয়েন্দা। ওর মনে হল, নিলয় মজুমদারের জন্য এঁদের কারও মনেই বোধহয় একফোঁটা ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধা ছিল না।
‘মহা-শ্বশুর মানে?’ এসিজি শব্দটার মর্মার্থ বুঝতে চাইলেন।
‘যা মানে, তাই…।’ একটু বাঁকা সুরে মন্তব্য করলেন টুনি।
রঘুপতি এসিজির দিকে তাকাল। যার মানে, ভদ্রমহিলার এই বাঁকা কথার স্টাইলকে সবক শেখাতে রঘুপতি ওর নিজস্ব স্টাইলে কোনও স্টেপ নেবে কি না।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত চোখের ইশারায় রঘুপতিকে শান্ত থাকতে বললেন। তারপর টুনির দিকে সরাসরি চোখ রেখে জানতে চাইলেন, ‘শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে আপনার রিলেশান কেমন ছিল?’
‘ভালো—বিকজ সেরকম কোনও রিলেশানই তো ছিল না যে খারাপ-টারাপ হবে। আমার বুটিক দেখতে আসার জন্যে বহুবার ওঁকে ইনভাইট করেছিলাম, কিন্তু ওঁর টাইম হয়নি। আমার বুটিকে যেসব ড্রেস আমি ডিসপ্লে করি সেগুলোর মেটিরিয়াল আর ডিজাইন দেখলে আপনি স্টানড হয়ে যাবেন। বড়-বড় ব্র্যান্ডের ডিজাইনার ড্রেসও আমার বুটিকের আইটেমের কাছে হার মেনে যাবে। আমাদের ইউ. এস. পি. কী জানেন? আমরা…।’
এসিজি আর বাধা না দিয়ে পারলেন না। বললেন, ‘প্লিজ, ম্যাডাম, এখন আমার ”শিবের গীত” শোনার সময় নেই। পরে কখনও শুনব…।’
‘ ”শিবের গীত” মানে?’ টুনির ভুরু কুঁচকে গেল।
‘ও আপনি বুঝবেন না—’ এসিজি হাসলেন। তারপর : ‘আচ্ছা, বলুন তো, নিলয়বাবুকে কে বা কারা এরকম নৃশংভাবে মার্ডার করতে পারে?’
টুনি মজুমদার উত্তরটা ভাবার জন্য এতটুকুও সময় নিলেন না। ফস করে বলে উঠলেন, ‘যে-কেউ খুন করতে পারে। ওনার বিহেভিয়ার এত খারাপ ছিল যে আর বলার নয়। মানুষকে মানুষ বলে মনে করতেন না—বলতে গেলে জন্তুর মতো ব্যবহার করতেন। শাশুড়ি-মা চলে যাওয়ার পর থেকে ওনার ব্যবহার একেবারে যা-তা হয়ে গেছে…।’
এসিজি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। ঘরের দেওয়ালে টাঙানো নিলয় মজুমদারের ফোটোগুলোর ওপরে চোখ বোলালেন একবার। তারপর : ‘আচ্ছা, মিসেস মজুমদার, নিলয়বাবুর মার্ডারার কি বাইরে থেকে পাঁচিল ডিঙিয়ে আসতে পারে বলে আপনার মনে হয়?’
টুনি পোশাকের ভাঁজ ঠিক করতে-করতে নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলেন, ‘আসতে পারে—অবশ্যই আসতে পারে। আমাদের বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালটা যেরকম শর্ট হাইটের! আমার তো মনে হয় এটা একটা স্ট্রং পসিবিলিটি…।’
একটু থেমে টুনি আবার মুখ খুললেন, ‘স্যার, আপনার নামটা কী যেন বললেন?’
অশোকচন্দ্র একটা বিরক্তির শ্বাস ফেলে বললেন, ‘অশোকচন্দ্র গুপ্ত…।’
‘তো হ্যাঁ, অশোকস্যার, এই যে-ড্রেসটা আমি পরে আছি, এটা আমার নিজের ডিজাইন করা। দারুণ হয়েছে না? এটা আসলে…।’
ওঁর বকবকানি চলতেই লাগল।
এসিজির ধৈর্যের জন্য রঘুপতি ওঁকে খুব শ্রদ্ধা করে। কিন্তু সেই এসিজি টুনি মজুমদারের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে হঠাৎই ধৈর্য হারালেন এবং কথাবার্তার চ্যাপ্টার আচমকাই ক্লোজ করলেন।
টুনি চলে যাওয়ার পর রঘুপতি ঠাট্টার সুরে ওর প্রাক্তন স্যারকে বলল, ‘স্যার, ইয়ে আনোখা এক্সপিরিয়েন্স আপকো ক্যায়সা লগা?’
এসিজি হেসে বললেন, ‘লাজবাব।’ তারপরই মাথা পিছনে হেলিয়ে ঘাড়ের কাছে ঝুলে পড়া চুলের গোছায় টান মেরে বললেন, ‘রঘুপতি, এবারে লাস্ট চ্যাপ্টারের জন্যে তৈরি হও। ও. সি. সাহেবকে এ-ঘরে ডেকে নাও। আমরা তিনজন এই মার্ডার মিস্ট্রির সলিউশান নিয়ে ডিসকাস করব। তারপর ঠিক করব কী করে মার্ডারারকে ট্র্যাপ করব…আর সবার শেষে এই ঘরে ডেকে নেব চারজন সাসপেক্টকে—তনয় মজুমদার, টুনি মজুমদার, প্রজেন বসু রায় আর সাবি, মানে সাবিত্রীকে।’
‘সাবিত্রীও সাসপেক্ট, স্যার?’
‘অবশ্যই। ও কারও সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ-কাজটা করে থাকতে পারে। এ দুনিয়ায় ইমপসিবল বলে কিছু নেই, রঘুপতি…।’
‘ও. কে., স্যার—আমি হকসাহেবকে ডেকে নিয়ে আসছি। বাট সত্যিই কি এটা লাস্ট চ্যাপ্টার?’
‘আমরা তো তাই মনে হচ্ছে…।’
একটু হেসে রঘুপতি যাদব ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটের ঘর ছাড়িয়ে পাঁচটার দিকে গড়িয়ে চলেছে। আকাশে এত মেঘ জমেছে যে, সূর্যের আলো এর মধ্যেই মলিন হয়ে চারপাশে সন্ধ্যার আঁধার নেমে এসেছে। এর আগে দু-একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, তবে এখন মনে হয় মুষলধারে বৃষ্টির আয়োজন চলছে। একবার শুরু হলেই সবকিছু ভাসিয়ে দেবে।
রঘুপতি বেশ কয়েকবার তাড়া দিলেও অশোকচন্দ্র কাজ সেভাবে সংক্ষেপ করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত বাড়ির লোকের তদারকিতে এসিজিরা চারজন স্যান্ডউইচ ইত্যাদি দিয়ে ‘ওয়ার্কিং লাঞ্চ’ জাতীয় ব্যাপারটা সেরে নিয়েছেন।
নিলয়বাবুর বেডরুমের সবক’টা আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। ঘরের একমাত্র টেবিলকে ঘিরে তিনটে চেয়ারে বসে আছেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত, নিজামুল হক, আর রঘুপতি যাদব। এসিজি বসেছেন মাঝখানের চেয়ারে, বাকি দুজন ওঁর দুপাশে। এসিজি শান্ত দৃষ্টিতে ঘরের বাকি চারজনকে পালা করে লক্ষ করছিলেন।
ঘরের একমাত্র দরজার কাছে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কনস্টেবল ভগবান মিস্ত্রি।
নিলয় মজুমদারের বিছানায় পাশাপাশি বসে আছেন তিনজন : তনয় মজুমদার, টুনি মজুমদার, আর প্রজেন বসু রায়। চতুর্থজন সাবিত্রী। ওকে বসতে বলা হলেও ও বসেনি। স্টাডিরুমের দরজার কাছে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শাড়ির আঁচলে কী কারণে যেন আঁচড় কাটছে।
চারজনের হাতেই মোবাইল ফোন। অশোকচন্দ্র কিছু বলা শুরু করবেন তারই অপেক্ষায় রয়েছেন চারজন। মোবাইল ফোন নাড়াচাড়া করে ওরা সেই অপেক্ষার সময়টুকু পার করছেন।
রঘুপতি যখন চারজনকে এ-ঘরে আসার জন্য বলেছে, তখন জানিয়েছে, ‘আপনারা আপনাদের পারসোনাল মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে আসবেন—মানে, যে-ফোনটা আপনারা রেগুলার ইউজ করেন। আমি আপনাদের ফোনের কল হিস্ট্রি চেক করে দেখব যে, সেখানে কারেন্ট আউটগোয়িং আর ইনকামিং কলের ঠিকঠাক লিস্ট আছে কি না…।’
রঘুপতি যাদবের এই ইনস্ট্রাকশনের আড়ালে একটা চাপা থ্রেট ছিল। সেই কারণেই কেউ নির্দেশ অমান্য করতে ভরসা পায়নি।
প্রজেন একবার শুধু প্রোটেস্ট করে বলেছিলেন, ‘মোবাইল ফোন আমাদের প্রাইভেট প্রপার্টি—আমাদের পারসোনাল ব্যাপার। আমাদের প্রাইভেসি আপনি এভাবে ডিসটার্ব করতে পারেন না, অফিসার। আপনাকে আপনার হায়ার অথরিটির কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে আসতে হবে।’
‘তাই নাকি?’ প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসেছে রঘুপতি : ‘মিস্টার প্রজেন বসু রায়, পুলিশ আপনাকে কতরকমভাবে ডিসটার্ব করতে পারে তার কোনও আইডিয়া আপনার নেই। আর এই রঘুপতি যাদব আরও কতরকমভাবে আপনাকে সুপারডিসটার্ব করতে পারে তার থোড়াবহত আইডিয়া দিলে আপনার হাওয়া বেরিয়ে যাবে। ছিবড়েটা মেঝেতে পড়ে থাকবে। আর আপনি আমাকে হায়ার অথরিটি দেখাচ্ছেন? এই কেসের ইনভেস্টিগেশানে আমিই হায়ার অথরিটি, আমিই লোয়ার অথরিটি। অ্যাট লিস্ট আজ, এই স্পটে। সো ডু অ্যাজ ইউ আর ইনস্ট্রাকটেড। ডোন্ট ফোর্স মি টু ফোর্স ইউ।’
রঘুপতির এই হুমকির পর আর কোনও সমস্যা হয়নি।
নিজামুল হক দাড়িতে আলতো করে হাত বুলিয়ে এসিজির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নিন, গুপ্তসাহেব, এবারে স্টার্ট করেন…।’
এসিজি একবার ওঁর দিকে দেখলেন। নিজামুলের কপালে দু-চারফোঁটা ঘাম। তেলতেলে মুখ আর কপাল আলো পড়ে চকচক করছে। ভদ্রলোক রীতিমতো উৎসুক মুখে অশোকচন্দ্রের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
বাড়ির সকলের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করার পর এসিজির মাথায় বয়ে চলেছে চিন্তা, যুক্তি আর বিশ্লেষণের স্রোত। এ ছাড়া এসিজি নিলয় মজুমদারের বেডরুম এবং স্টাডি আবার খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন। তারপর বাইরের বারান্দায় গেছেন। বারান্দার এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘুরে-ঘুরে দেখেছেন। বারান্দায় লাগানো লোহার জাল পরীক্ষা করেছেন বারবার—বিশেষ করে কাটা জায়গাটা।
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, খুনি যদি বাইরের কেউ হয় তা হলে সে ওই লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এসেছিল। তারপর কাতুরি জাতীয় কোনও জিনিস দিয়ে লোহার জাল কাটতে চেষ্টা করে। জাল খানিকটা কাটলেও শেষ পর্যন্ত সুবিধে করতে না পেরে সে সিঁড়ি দিয়ে আবার নেমে যায়। বারান্দার অন্য প্রান্তের একটা ছোট ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢোকে। এভাবে কসরত করে ঢুকে থাকলে খুনির গা-হাত-পা ছড়ে যাওয়ার কথা।
এসিজি খুনির অ্যাক্টিভিটি মনে-মনে রিকনস্ট্রাকট করার চেষ্টা করছিলেন।
খুনি চুপিসাড়ে এসে নিলয় মজুমদারের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বারান্দার একপ্রান্তে সাবিত্রী গভীর ঘুমে ডুবে আছে। খুনি আলতো করে দরজায় টোকা দিল। নিলয়বাবু যখন তার পরিচয় জিগ্যেস করলেন তখন খুনি চাপা গলায় নিজের নাম বলল, কিংবা নিলয়বাবুর চেনা অন্য কারও নাম বলল—যাতে উনি দরজা খুলে দেন। কিন্তু তারপর?
নিলয় মজুমদারকে নৃশংসভাবে খুন করার পর খুনি আবার চুপিসাড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিন্তু তারপর ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করল কে? সে যদি খুনির সহকারী হয়, তা হলে সে বেরোল কোথা দিয়ে? সবাই শুরু থেকে দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকা বা বেরোনোর কথা ভাবছে, কিন্তু দরজা না হয়ে ব্যাপারটা যদি জানলা হয়? যদি জানলা দিয়ে খুনি ঘরের বাইরে বেরিয়ে থাকে? স্লাইডিং গ্লাস উইন্ডো কিংবা লোহার গ্রিলের মধ্যে যদি কোনও কারসাজি থাকে?
সেইজন্যই এসিজি দরজার পাশাপাশি জানলাগুলোও চুলচেরা পরীক্ষা করেছেন। কিন্তু না, ওগুলোর মধ্যে কোনও ফাঁক বা ফাঁকি পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, নিলয় মজুমদারের ঘরের দরজা এবং জানলা অর্থোডক্স এবং ট্যাম্পারফ্রি।
সুতরাং, চিন্তা, যুক্তি আর বিশ্লেষণ এই নিয়েই ‘থিংকিং মেশিন’ বহুক্ষণ ব্যস্ত থেকেছেন। চোখ বুজে সিগারেটে টান দিয়ে গেছেন একের পর এক।
আচ্ছা, খুনি যদি ভেতরের লোক হয় তা হলে ‘অপারেশান’-টা হয়েছে কীভাবে? বাইরের খুনি যেভাবে কাজ সেরেছে সেই একইরকমভাবে—এক্ষেত্রে শুধু পাঁচিল ডিঙিয়ে জাল কেটে বাইরে থেকে বাড়িতে ঢোকার ব্যাপারটুকু বাদ দিতে হবে।
তবে খুনি বাইরের লোক হোক কিংবা ভেতরের লোক, নিলয় মজুমদারের মাথায় বসানোর জন্য ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্টটা সে সঙ্গে করে নিয়েই নিলয়বাবুর ঘরে ঢুকেছিল। কারণ, ঘরের মধ্যে ওরকম কোনও হাতিয়ার পাওয়া যাবে কি না সে-বিষয়ে সে নিশ্চিত ছিল না।
মনে-মনে টুকরো চিন্তাগুলোকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তারপর বলতে শুরু করলেন।
‘নিলয় মজুমদারের মার্ডারটা একটা প্রিমেডিটেটেড মার্ডার—মানে, খুনি আগে থেকে পরিকল্পনা করে তারপর কাজে নেমেছে।’ এসিজি মাথা ঝুঁকিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। সরু সুতোর মতো ধোঁয়ার কয়েকটা রেখা বাতাসে ভাসিয়ে ধীরে-ধীরে বললেন, ‘মোটিভের দিকটা চিন্তা করে বলা যায়, এই মার্ডারটা হচ্ছে মার্ডার ফর গেইন। তবে তার সঙ্গে আলতো করে জড়িয়ে আছে প্রতিশোধের একটা ডায়মেনশান। হয়তো এই প্রতিশোধের ডায়মেনশানটা থাকার দরুণই খুনি অমন নৃশংসভাবে চুয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ মানুষটিকে খুন করেছে। প্রথমে ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট, মানে, শক্তপোক্ত একটা হাতিয়ার দিয়ে নিলয়বাবুর মাথায় প্রচণ্ড জোরে হিট করেছে। তারপর দু-পাঁচমিনিটের মধ্যেই ওঁর গলায় রবারের ফাঁস এটে দিয়েছে। অতিরিক্ত রক্তপাত, আর দমবন্ধ হওয়াতে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের হার্ট জবাব দিয়ে দিয়েছে। পুলিশের পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এই তথ্যই জানিয়েছে।
‘এই মার্ডারটার একটা বিচিত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে টু মেনি ক্লুজ—বড্ড বেশি সূত্র। ইনস্পেকটর রঘুপতি যাদবের কাছে আমি এই মন্তব্য আগে করেছি। আর একইসঙ্গে আমার মনে হয়েছে, খুনি যেন ইচ্ছে করে অনেকগুলো ধাঁধা ছড়িয়ে গেছে পুলিশের জন্যে। আর এতরকম ধাঁধা ছড়ানো আছে বলেই খুনের এক্সিকিউশানের প্যাটার্নটা আমাদের চোখে পড়ছে না।’ এসিজি একবার রঘুপতির দিকে তাকালেন, তারপর নিজামুল হকের দিকে। সবশেষে চোখ বুলিয়ে নিলেন মজুমদার বাড়ির চারজনের দিকে—তনয়, টুনি, প্রজেন এবং সাবিত্রী। বিনীত গলায় অনুমতি চাইলেন, ‘আপনাদের সবার কাছে একটা অনুরোধ রাখছি : কাইন্ডলি আমাকে স্মোক করার পারমিশান দিন। সিগারেটের এসেন্স মগজে না গেলে আমার মগজ কেমন যেন ঝিমিয়ে থাকে। এই বদ অভ্যেসটা আমি ছাড়ব-ছাড়ব করেও ঠিক ছাড়তে পারছি না…।’
তনয় আর টুনি মজুমদার সৌজন্যের গলায় বললেন, ‘আপনি স্মোক করতে পারেন, মিস্টার গুপ্ত। এত বড় ঘর…জোরে ফ্যান চলছে…মনে হয় না আমাদের কোনও অসুবিধে হবে…।’ তনয় কথাটা শুরু করেছিলেন, টুনি মজুমদার কথাটা শেষ করলেন।
এসিজি পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করলেন। মাথা ঝুঁকিয়ে এমন মনোযোগে সিগারেট ধরালেন যেন সিগারেটের ডগায় আগুন ঠিকঠাকভাবে না ধরলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।
আনমনা চোখে ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন এসিজি। শূন্যে তৈরি হওয়া ধোঁয়ার নকশার দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বিড়বিড় করলেন, ‘প্যাটার্ন, প্যাটার্ন…।’
এবার পাজামার পকেটে হাত ঢোকালেন বৃদ্ধ হুনুর। টু বাই টু বাই টু রুবিক কিউব বের করে নিয়ে এলেন। রংচঙে কিউব। বেশ কিউট।
কিউবটা ডানহাতে চোখের সামনে ধরে সেটার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকালেন।
রঘুপতি জানে, রুবিক কিউব সলভ করা ওর স্যারের নেশা। প্রথমে স্যারের কাছে ও থ্রি বাই থ্রি বাই থ্রি কিউব দেখেছে। পরে এসিজি ফোর-কিউব এবং ফাইভ-কিউব কিনেছেন। সেগুলো সলভ করার ব্যাপারটাও আয়ত্ত করে নিয়েছেন। এখন, এই প্রথম, স্যারের হাতে দেখছে টু-কিউব। যে-মানুষটা ফাইভ-কিউব সলভ করতে পারে তার হাতে হঠাৎ মোস্ট সিম্পল টু-কিউব কেন?
অশোকচন্দ্র যেন টেলিপ্যাথিতে রঘুপতির প্রশ্নটা টের পেলেন এবং সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে ধীরে-ধীরে সেই প্রশ্নের জবাব দিলেন, ‘এটা হচ্ছে সবচেয়ে সিম্পল রুবিক কিউব। টু বাই টু বাই টু। এতে থ্রি বাই থ্রি বাই থ্রি কিউবের মিডল লেয়ারগুলো নেই। তাই পড়ে আছে থ্রি-কিউবের শুধুই আটটা কর্নার কিউব। এই কিউবটা দেখতে যতটা সিম্পল এটা সলভ করা কিন্তু ততটা সিম্পল নয়। অর্থাৎ, এটা একদিক থেকে দেখতে গেলে সিম্পল, আবার আর-একদিক থেকে দেখতে গেলে কমপ্লেক্স—ঠিক নিলয় মজুমদারের মার্ডার মিস্ট্রির মতো। সিম্পল অথচ কমপ্লেক্স, আবার কমপ্লেক্স অথচ সিম্পল।’
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন এসিজি। সিগারেটে ঘন-ঘন কয়েকটা লম্বা টান দিয়ে বাগানের দিকের জানলার কাছে গেলেন। সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিলেন বাইরে। তারপর রুবিক কিউবটা উঁচিয়ে ধরে বললেন, ‘দেখুন, এই ছোট-ছোট আটটা কিউবের রংগুলো কেমন এলেমেলো হয়ে রয়েছে। রেগুলার প্যাটার্নটা বোঝা যাচ্ছে না। এই খুনের কেসটার মতো। এবার এটা আমি সলভ করব…।’ অশোকচন্দ্র দু-হাতে কিউবটা ধরে তার বিভিন্ন লেয়ার চটপট ঘোরাতে লাগলেন। ঘোরানোর সময় মাঝে-মাঝে থামছিলেন, কিউবটার প্যাটর্নটা একঝলক দেখছিলেন।
কয়েকমিনিটের মধ্যেই কিউবটা সলভ করে ফেললেন। কিউবটার ছ’পিঠ ছ’রঙের হয়ে গেল।
এসিজি হেসে বললেন, ‘এই দেখুন, রেগুলার প্যাটার্ন। আর এটা সলভ করতে আমাকে দুটো হাত ব্যবহার করতে হয়েছে। সিম্বলিক্যালি বলতে গেলে, নিলয়বাবুর খুনের এক্সিকিউশানটাও অনেকটা একইরকম…।’
প্রজেন বসু রায় বেশ কিছুক্ষণ ধরেই উসখুস করছিলেন। হঠাৎই অধৈর্য হয়ে ঠোঁট বেকিয়ে মন্তব্য করলেন, ‘কতক্ষণ এইসব ভ্যানতাড়া চলবে বলতে পারেন? কোথায় একটা মার্ডার কেস সলভ করার চেষ্টা চলছে, আর কোথায় রুবিক কিউব! যত্ত সব বুলশিট!’
রঘুপতি উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু এসিজি চোখের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলেন। হাসিমুখে প্রজেন বসু রায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ধৈর্য, ধৈর্য, এবং ধৈর্য। কোনও খুনের পরিকল্পনার কাজে ধৈর্য হচ্ছে মেইন কি-ওয়ার্ড। তাই আমার আর্নেস্ট রিকোয়েস্ট, প্লিজ একটু ধৈর্য ধরুন…।’
‘আমি কি খুনের প্ল্যান করতে বসেছি নাকি যে ধৈর্য ধরব!’ প্রজেনের গলার সুর একেবারে উগ্রপন্থী।
এসিজি রুবিক কিউবটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে শান্ত গলায় বললেন, ‘আপনি কীসের প্ল্যান করতে বসেছেন বা কীসের প্ল্যান করতে ভালোবাসেন সেটা একটু পরেই বোঝা যাবে। তবে আপনাকে একটা অ্যাডভাইস দিই : ইনস্পেকটর যাদবের ধৈর্য নষ্ট করবেন না। কারণ, তা হলে আপনার স্বাস্থ্য নষ্ট হতে পারে…।’
‘মানে…মানে!’ প্রজেনের গলায় সতর্ক উত্তেজনা। এসিজির দিক থেকে চোখ সরিয়ে রঘুপতি যাদবের দিকে একবার তাকালেন। রঘুপতি ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে প্রজেনকে চুপ করতে ইশারা করল।
এসিজি প্রজেনের দিকে তাকিয়ে সামান্য মুচকি হাসলেন। তারপর চেয়ারে এসে বসলেন। দুবার গলাখাঁকারি দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন।
‘আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, নিলয় মজুমদার খুব সুবিধের মানুষ ছিলেন না। উনি একজন অসৎ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ওঁর কনস্ট্রাকশনে অনেক ফাঁকফোকর থাকত—যদিও কখনও ওঁর ফার্মের গায়ে কালি লাগেনি। এ ছাড়া নিলয়বাবুর ব্যবহার খুব খারাপ ছিল। রেগে গেলে লোকজনকে অত্যন্ত খারাপ-খারাপ কথা বলতেন। ওঁর কোম্পানির কর্মী হোক কি এ-বাড়ির কেউ হোক—উনি কাউকেই রেয়াত করতেন না। ইনস্পেকটর যাদবের দেওয়া ফাইল খুব খুঁটিয়ে পড়ে আর আজ এ-বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আমার সেরকমই মনে হয়েছে…।’
তনয় নীচু গলায় বললেন, ‘মাথা গরম হয়ে গেলে বাবার আর কোনওরকম জ্ঞানগম্যি থাকত না। ওঁর মেজাজের আঁচ থেকে কেউই রেহাই পায়নি।’
টুনি মজুমদার ফস করে বলে উঠলেন, ‘আমাকে তো একবার বলেছিলেন, ”তুমি র্যাম্পে অত হাঁটাহাঁটি না করে ওখানেই একটা কোঠা বানিয়ে নাও—তোমার বুটিকের বিক্রিবাটা বাড়বে।” ভাবুন তো, কীরকম নোংরা লোক!’
‘টুনি! কী হচ্ছে!’ তনয় চাপা গলায় স্ত্রীকে যেন ধমক দিলেন।
‘হ্যাঁ—এটাই তো নিলয়বাবুর সবচেয়ে খারাপ দিক ছিল…’ এসিজি বলে চললেন, ‘তবে এইরকম খারাপ ব্যবহারের জন্যে খুনি ওঁকে খুন করেনি। খুনের আর-একটা প্যারালাল মোটিভ হচ্ছে, মার্ডার ফর গেইন। কারণ, নিলয়বাবু মারা গেলে ওঁর সমস্ত সম্পত্তির ফিফটি-ফিফটি মালিক হয়ে যাবেন তনয় মজুমদার আর প্রজেন বসু রায়। নিলয় মজুমদারের লিগাল অ্যাডভাইসরের কাছ থেকে রঘুপতি এই ইনফরমেশান কালেক্ট করেছে…।
‘কিন্তু বন্ধ ঘরের ভেতরে খুনটা হল কীভাবে? এবার সে-কথাতেই আসছি। অনেক ব্রেইন স্টর্মিং করে যে-মেথডটা আমি খুঁজে পেয়েছি সেটা এইরকম।
‘খুনি রাতে কোনও একটা সময়ে নিলয় মজুমদারের ঘরে এল। বন্ধ দরজায় টোকা দিল, ডাকল। নিলয়বাবু হয়তো খাটে বসে কোনও বই-টই পড়ছিলেন। সেটা মুলতুবি রেখে দরজার কাছে গেলেন। হয়তো জিগ্যেস করলেন, ”কে?” উত্তরে খুনি নিজের নাম বলল।
‘চেনা মানুষের গলা, তাই নিলয়বাবু দরজা খুলে দিলেন। খুনি ঘরে ঢুকল। নিলয়বাবু দরজা আবার বন্ধ করে দিলেন—ছিটকিনি এঁটে দিলেন ভেতর থেকে। কারণ, উনি সবসময় ওঁর ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধই রাখতেন। তারপর খাটে গিয়ে বসলেন আবার। হয়তো ভুরু কুঁচকে আগন্তুককে জিগ্যেস করলেন, ”কী ব্যাপার, কী চাই?”
‘খুনি তার উত্তরে ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্টটা বৃদ্ধের মাথার পেছনে বসিয়ে দিল। মাথার খুলি ফাটল। রক্ত বেরোতে লাগল গলগল করে। বৃদ্ধ উপুড় হয়ে পড়লেন বিছানায়। খুনির জামাকাপড়ে রক্ত লেগে গেল।
‘খুনি হাতিয়ারটা খাটের ওপরে রাখল। খাটের নীচে পড়ে ছিল দু-চারটে রবারের ফিতে। মানে, স্লাইডিং গ্লাস উইন্ডোর এজগুলো সিল করতে যে-ধরনের ফিতে লাগে। ফিতেগুলো ঘরে পড়ে ছিল, কারণ, কিছুদিন আগেই নিলয় মজুমদারের নির্দেশে ওঁর ঘরের জানলায় স্লাইডিং কাচের জানলা লাগানো হয়।
‘তো সেইরকমই একটা ফিতে কুড়িয়ে নিয়ে খুনি নিলয়বাবুর গলায় পেঁচিয়ে ফাঁস দেয়। তারপর দু-হাতে রবারের ফিতেটা দু-পাশ থেকে টানতে থাকে। খুনির সেই টানের মধ্যে মিশে ছিল রাগ আর ঘেন্না। মানে, একটা মার্ডার ফর গেইন—বাট উইথ শেডস অফ অ্যাঙ্গার অ্যান্ড হেট্রেড।
‘ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়ে হিট করার পর নিলয়ের মাথার খুলি কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছিল। সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার আর অকসিপিটাল লোব ভীষণভাবে চোট পেয়েছিল। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট সেরকম কথাই লিখেছে। তার সঙ্গে অ্যাসোসিয়েটেড প্রোফিউজ ব্লিডিং। ডেথ ওয়জ ইনএভিটেবল। আর তার ওপরে গ্যারোটিং।
‘অর্থাৎ, মিস্টার মজুমদার ডায়েড ভায়োলেন্টলি।’
একটু থামলেন এসিজি। প্রজেন, তনয়, টুনি এবং সাবিত্রীর দিকে তাকালেন। প্রথম তিনজন নির্বিকার। শুধু সাবিত্রীকে দেখে মনে হল, খুনের দৃশ্যটা কল্পনা করে ও কেমন যেন শিউরে ওঠা কাঁচুমাচু মুখে বসে আছে।
‘কিন্তু তারপর? তারপর খুনি বারান্দার দিকের একটা জানলার কাচের পাল্লা সামান্য সরিয়ে একটু ফাঁক করে দিল। নিলয়বাবুর বালিশের নীচ থেকে ওঁর চাবির গোছাটা বের করে নিল। খুনি জানত যে, নিলয়বাবু চাবির গোছা বালিশের নীছে রাখতেন। তারপর…প্রথমে আলমারি খুলে তার দরজা দুটো হাট করে দিল। আলমারি থেকে চটপট তিনটে হ্যাট বের করে নিল। সেগুলো দুমড়ে-মুচড়ে পকেটে গুঁজে নিল। ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে চাবি দিয়ে হাঁসকলের তালা খুলল। তারপর খুব সাবধানে হাঁসকল খুলে আবার ঘরে ঢুকল।
‘এবার তার কাজ হল প্রথম দরজাটা বন্ধ করে সেটা ভেতর থেকে ছিটকিনি এঁটে দেওয়া। খুনের হাতিয়ারটা বিছানা থেকে তুলে নিয়ে নিজের জামাকাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে নেওয়া। তারপর ঘরের নানান জায়গার হাতের ছাপ-টাপ মুছে দ্বিতীয় দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে খুব সাবধানে হাঁসকল লাগিয়ে আবার তালা দিয়ে দেওয়া।
‘এভাবেই তৈরি হল লকড রুম। কিন্তু পাজলটা তৈরি হচ্ছে লাস্টে—একেবারে শেষ ধাপে। অর্থাৎ, যে-জানলাটার কাচ কিছুটা খোলা ছিল সেই জানলার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে নিলয়বাবুর চাবির গোছাটা বিছানা তাক করে ছুড়ে দেওয়া। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল লকড রুম পাজল—বন্ধ ঘরের রহস্য।
‘এরপর যেসব কাজ খুনির বাকি রইল সেগুলো হল, নিলয় মজুমদারের ঘরের দুটো দরজার বাইরের দিকের হাতের ছাপ মুছে ফেলা, হাঁসকল আর তালার গায়ের ছাপ মোছা, দোতলার স্পাইরাল সিঁড়ির কাছে লোহার জাল কাতুরি দিয়ে বেশ খানিকটা কেটে ফেলা, খুনের হাতিয়ারটা লুকিয়ে ফেলা, হ্যাট তিনটে বাগানে ছুড়ে ফেলা, এবং রক্তমাখা জামাকাপড়ের একটা জুতসই বন্দোবস্ত করা…।’
নিজামুল হক হঠাৎই লাফিয়ে উঠলেন : ‘অসম্ভব, গুপ্তসাহেব, অসম্ভব! এতসব কাজ খুনির একার পক্ষে অসম্ভব! ইমপসিবল! কী বলেন, ইনস্পেকটার যাদব?’ প্রশ্নটা করতে রঘুপতি যাদবের দিকে ফিরে তাকালেন হকসাহেব।
এসিজি হাসলেন। বললেন, ‘মিস্টার হক ঠিকই বলেছেন, রঘুপতি। এই খুনের ক্ষেত্রে কাজের পরিমাণটা বড্ড বেশি। অনেকগুলো কাজ। আমার মনে হয়, জাল কাটার কাজটা মার্ডারার আগেই সেরে রেখেছিল। সেটা সন্ধের অন্ধকারে কারও নজরে পড়েনি। তা ছাড়া বারান্দার জাল কাটার ব্যাপারটা সাবিত্রী ছাড়া আর দেখারই বা কে আছে! কিন্তু সাবিত্রী বলেছে, জাল যে কাটা হয়েছে সেটা পুলিশ ওকে বলার আগে ও খেয়ালই করেনি। কী, সাবিত্রী, তাই তো?’ প্রশ্নটা সাবিত্রীকে ছুড়ে দিলেন এসিজি।
সাবিত্রী তাড়াতাড়ি মাথা নোয়াল : ‘হ্যাঁ, স্যার—।’
‘গুড। নাউ, রঘুপতি, এবার আমার মোবাইল ফোনগুলো চাই—চারজনেরটাই।’ রঘুপতির দিকে তাকালেন অশোকচন্দ্র। তারপর তনয়, প্রজেনদের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করলেন।
রঘুপতি যাদব চট করে উঠে দাঁড়াল। তিনটে লম্বা স্টেপ ফেলে তনয়দের খুব কাছে পৌঁছে গেল। কোনও কথা না বলে ডানহাতটা সামনে বাড়িয়ে ধরল।
সত্যিই কোনও কথা বলার দরকার ছিল না। কারণ, তনয়, প্রজেন, আর টুনি একটুও দেরি না করে নিজেদের মোবাইল ফোন রঘুপতির খসখসে হাতের চেটোয় জমা দিলেন।
সাবিত্রী স্টাডিরুমের দরজার কাছ থেকে রঘুপতির কাছে এগিয়ে এল। নিজের ফোনটা রঘুপতিকে দিল।
রঘুপতি লক্ষ করল, তনয়দের ফোনগুলো নামি ব্র্যান্ডের দামি স্মার্টফোন হলেও সাবিত্রীর ফোনটা সস্তার বারফোন। তা ছাড়া ফোনটা ঘামে ভেজা। বোধহয় সাবি এতক্ষণ ফোনটাকে শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে ছিল।
রঘুপতি ফোনগুলো নিয়ে এসিজির কাছে গেল। ওগুলো টেবিলে নামিয়ে রেখে কোনটা কার ফোন সেটা বলার সঙ্গে-সঙ্গে ফোনগুলো পাশাপাশি সাজিয়ে দিল। এসিজির রেফারেন্সে বাঁ-দিক থেকে তনয়, টুনি, প্রজেন ও সাবিত্রী।
প্রজেনের ফোনটা হাতে তুলে নিলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন ফোনটা।
প্রজেন চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ডক্টর গুপ্ত, আশা করি আপনি প্রাইভেসি রাইটের ব্যাপারটা ভুলে যাবেন না।’
এসিজি হাসলেন, একটা হাত তুলে ইশারায় ওঁকে আশ্বস্ত করলেন : ‘আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে বসুন, মিস্টার বসু রায়। প্রাইভেসি রাইটের কথা আমার ভালো করেই মনে আছে। আমি আপনার ফোনের মেসেজ বা অন্য কোনও পারসোনাল ব্যাপার পড়ে দেখার জন্যে এতটুকুও ইন্টারেস্টেড নই। আমি বরং আই. এম. ই. আই. নাম্বারটা সম্পর্কে কয়েকটা কথা আপনাদের বলব…।
‘আপনারা হয়তো জানেন, মোবাইল ফোনে ”*#06#” পাঞ্চ করলেই আই. এম. ই. আই. নাম্বারটা ফোনের পরদায় ভেসে ওঠে—স্মার্ট ফোনে তার সঙ্গে থাকে বারকোড। আই. এম. ই. আই.-এর ফুল ফর্মটা হল, ”ইনটারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি”। এটা একটা ইউনিক ফিফটিন ডিজিট নাম্বার। মোবাইল ফোন হারিয়ে-টারিয়ে গেলে এই নাম্বারটার হেলপ নিয়ে সেটাকে লোকেট করা যায়। তা ছাড়া এই নাম্বারটা ইউজ করে মোবাইলের সার্ভিস প্রোভাইডাররা হ্যান্ডসেট থেকে যে-কোনও ডেটা অ্যাকসেস করতে পারে—যেমন, কনট্যাক্ট লিস্ট, এস. এম. এস. এবং আরও অনেক কিছু। কেউ যদি ফোন থেকে কোনও কনট্যাক্ট কিংবা মেসেজ ডিলিট করে দেয় তা হলে সেই ডেটা মোটেই চিরকালের জন্য উধাও হয়ে যায় না—থেকে যায় ডিভাইসের ভেতরে একটা হিডন ফাইলে। সার্ভিস প্রোভাইডার যদি চায় তা হলে আই. এম. ই. আই. নাম্বারটা ইউজ করে সেই হিডন ফাইল সহজেই অ্যাকসেস করতে পারে…।’
‘এটা তো ইনভেশান অফ প্রাইভেসি…’ টুনি মজুমদার বললেন এবং প্রজেনের দিকে একপলক তাকালেন।
‘হ্যাঁ, ম্যাডাম—ঠিক বলেছেন। ইট ইজ ডেফিনিটলি ইনভেশান অফ প্রাইভেসি। তবে এই ইনভেশানের ব্যাপারটা পুলিশ করে থাকে কোনও সিরিয়াস ইনভেস্টিগেশানের সময়…যেমন, এই নিলয়বাবুর মার্ডার কেস। তবে এটা ঠিক যে, পুলিশ সাসপেক্টের হ্যান্ডসেট থেকে কিংবা সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছ থেকে যা কিছু জানতে পারে সেগুলো তারা সিক্রেট রাখে। শুধুমাত্র যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু ক্রিমিনালের কনভিকশানের কাজে কোর্টে ব্যবহার করে। আশা করি পুরো ব্যাপারটা আপনাদের কাছে এখন ক্লিয়ার?’
তনয় ছোট্ট করে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝালেন। বাকিরা চুপ করে রইল।
এসিজি একটু দম দিয়ে মাথার চুলে হাত বোলালেন। রঘুপতি ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা টেবিলে আলতো করে ঘষছিল। আর নিজামুল হক দাঁত দিয়ে নখ কাটছিলেন।
এসিজি সবাইকে একপলক করে দেখে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন।
‘আপনাদের মোবাইলের সার্ভিস প্রোভাইডারদের সঙ্গে পুলিশ অনেকদিন আগেই কথা বলেছে। আপনাদের সবার কল রেকর্ডস এবং এস. এম. এস. ইত্যাদি খতিয়ে দেখেছে। তাতে পুলিশের তদন্ত বিশেষ এগোয়নি। আমি এখন আপনাদের ফোনের হিডন ফাইলগুলো চেক করে দেখব। যেসব ডেটা আপনারা স্টোর করেছেন, কিন্তু পরে আবার ডিলিট করে দিয়েছেন—সেগুলো আমি একটু খুঁটিয়ে দেখব। রঘুপতি—’ রঘুপতি যাদবের দিকে তাকালেন এসিজি : ‘তুমি প্লিজ সার্ভিস প্রোভাইডারদের এক-এক করে ফোন করো—বলো, আমরা এগজ্যাক্টলি কী চাইছি। তোমাকে আমি কিছুক্ষণ আগে সেটা বলেওছি। ওদের বলো, আমরা খুব তাড়াতাড়ি ইনফরমেশানগুলো চাই…।’
‘ও. কে., ডক্টর গুপ্তা—।’ বলে রঘুপতি টেবিলে রাখা ওর ফোল্ডারটা হাতে তুলে নিল। তারপর চেয়ার ছেড়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। এসিজিও চট করে উঠে পড়লেন। রঘুপতির সঙ্গে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঘাড় নীচু করে চাপা গলায় রঘুপতির সঙ্গে কীসব কথা বললেন। বড়জোর দশমিনিট—তারপরই এসিজি ফিরে এলেন ঘরে। নিজের চেয়ারে বসে ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
রঘুপতি ফোল্ডার খুলে বিশেষ একটা পৃষ্ঠা বের করে নিল। সেই পৃষ্ঠায় তনয় মজুমদার ও বাকি তিনজনের মোবাইল নম্বর এবং সার্ভিস প্রোভাইডার সম্পর্কে নানান তথ্য লেখা। রঘুপতি নিজের মোবাইল ফোন বের করে সেই পৃষ্ঠাটার দিকে চোখ রেখে ফোনের বোতাম টিপতে শুরু করল। তারপর ফোনটা ডানকানে চেপে ধরল। এবং একটু পরেই ফোনে কথা বলতে শুরু করল।
কী কথা যে বলছে সেটা ঘর থেকে ঠিকঠাক বোঝা না গেলেও রঘুপতি যাদব যে বেশ এক্সাইটেড হয়ে কথা বলছে সেটা দিব্যি বোঝা গেল।
ঘরের ভেতরে একটা থমথমে উৎকণ্ঠা। খোলা দরজা দিয়ে রঘুপতির পিঠ দেখা যাচ্ছিল।
প্রজেন বসু রায় এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছিলেন। একবার তনয়, আর-একবার টুনিকে দেখছিলেন। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, প্রজেন বেশ উসখুস করছেন।
এসিজি সন্দেহভাজন চারজনকেই খুঁটিয়ে দেখছিলেন।
তনয় বেশ শান্তভাবে বসে আছেন।
প্রজেন এখন রঘুপতির দিকে তাকিয়ে আছেন।
টুনি জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছেন।
সাবিত্রী এসিজিকে তোলমোলের নজরে দেখছে। ওর মুখে ঘামের বিন্দু। শাড়ির আঁচল দিয়ে চট করে একবার ঘাম মুছে নিল।
দরজার কাছ থেকে রঘুপতির টুকরো-টুকরো কথা শোনা যাচ্ছিল।
‘হ্যাঁ, আমি হোল্ড করছি…কিন্তু ইনফরমেশানগুলো খুব জরুরি।…হাঁ, হাঁ—ওহি কোড হমে চাহিয়ে। প্লিজ, হোয়াটসঅ্যাপ করে আমার ফোনে পাঠিয়ে দিন। এই কোডটা ইউজ করলেই হিডন ফাইলগুলো সব দেখা যাবে তো? লাস্ট ওয়ান মান্থে কী-কী ফাইল ডিলিট হয়েছে সেগুলো পাওয়া যাবে?…গুড। থ্যাংক ইউ…।’
একটু পরেই রঘুপতি যাদব দরজার কাছ থেকে চলে এল ঘরের ভেতরে। ফোল্ডারটা গুছিয়ে আবার টেবিলে রেখে দিল। তারপর নিজের মোবাইল ফোনের দু-একটা বোতাম টিপে ফোনটা অশোকচন্দ্রের চোখের সামনে ধরল : ‘স্যার, এই যে, কোডটা ওরা পাঠিয়েছে। এটা ইউজ করলেই আপনি হিডন ফাইলের কাহানি জেনে যাবেন। সব সারভিস প্রোভাইডারের সেম কোড—আই. এম. ই. আই. নম্বর দেখতে গেলে যেমন সেম কোড।’
অশোকচন্দ্র কোডটা ভালো করে দেখলেন। ঘাড় নাড়লেন দুবার। বিড়বিড় করে বললেন, ‘গুড ওয়ার্ক, রঘুপতি—গুড ওয়ার্ক।’
রঘুপতি এসিজির পাশে বসে পড়ল।
এসিজি টেবিলে রাখা চারটে ফোনের মধ্যে একটা ফোন হাতে তুলে নিলেন। এবং চশমাটা নাকের ওপরে নাড়াচাড়া দিয়ে সেট করে তীক্ষ্ন মনোযোগে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একইসঙ্গে হ্যান্ডসেটের বোতাম টিপতে লাগলেন।
এমন সময় জানলার বাইরে থেকে বৃষ্টির ফোঁটার টপাটপ শব্দ ভেসে এল। বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। এসিজি একবার খোলা জানলার দিকে তাকালেন। তারপর অনেকটা যেন আপনমনেই কথা বলতে শুরু করলেন।
‘আপনাদের সবার স্টেটমেন্ট আর পি. এম. রিপোর্ট কোরিলেট করে পুলিশ এই ডিসিশানে এসেছে যে, নিলয় মজুমদার খুন হয়েছেন গত মাসের বাইশ তারিখ রাত দশটা থেকে একটার মধ্যে। কিন্তু আজ সকাল থেকে সব দেখে-শুনে, ফাইলের কাগজপত্র ঘেঁটে, আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আমার মনে হয়েছে, নিলয়বাবু খুন হয়েছেন দশটা বাজার অন্তত এক কি দেড়ঘণ্টা আগে। খুনের সময়টাকে ঘেঁটে দেওয়ার জন্যে খুনি একটা কায়দা ব্যবহার করেছিল। সেই কায়দাটা এই ফোনের মধ্যে আছে—’ হাত উঁচু করে ধরে ফোনটা সবাইকে দেখালেন এসিজি। সময় নিয়ে সবার মুখের দিকে পালা করে তাকালেন। তারপর : ‘রঘুপতির এফার্ট আর সাপোর্টে আমরা একটা ডিলিটেড ফাইল রেস্টোর করতে পেরেছি। অবশ্য তার সঙ্গে মোবাইল কানেকশানের সার্ভিস প্রোভাইডারদের হেলপ-এর ব্যাপারটাও অ্যাকনলেজ করতে হবে।
‘ফাইলটা একটা অডিয়ো ফাইল। তবে ব্যাপারটা খোলসা করে বলার আগে আমি আপনাদের একটা ঘটনা শোনাতে চাই। সেই ঘটনার সাক্ষী সাবি—মানে, সাবিত্রী…।’
‘সাবি আবার আমাদের কী শোনাবে?’ রুক্ষভাবে প্রশ্ন তুললেন প্রজেন বসু রায়, ‘আর…আপনার হাতের মোবাইলটা কার বলুন তো? আমার?’
এসিজি প্রজেনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেশ চওড়া করে হাসলেন : ‘মোবাইলটা কার একটু পরেই সেটা বুঝতে পারবেন।…যাই হোক, এবারে কাজের কথায় ফিরে আসি…।’ সাবিত্রীর দিকে নজর ফেরালেন বৃদ্ধ গোয়েন্দা। বেশ নরম এবং শান্ত গলায় বললেন, ‘সাবি, তুমি মা আমাদের সবাইকে মহাভারতের গল্পটা আর-একবার শোনাও তো! সেই যে, পাশা খেলার চ্যাপ্টারটা—যেটা নিলয়বাবু খুন হওয়ার রাতে দুবার পড়েছিলেন!’
সাবিত্রী ধন্দভরা চোখে অশোকচন্দ্র গুপ্তকে দেখতে লাগল। বৃদ্ধের চোখমুখ ভীষণ সিরিয়াস—মজা করছেন বলে মোটেই মনে হচ্ছিল না।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করল সাবি। ছ’জন মানুষের মুখের দিকে পালা করে তাকাল। ঢোঁক গিলল দুবার। তারপর দ্বিতীয়বার তাকাল তনয়ের দিকে।
ধীরে-ধীরে ‘মহাভারতের গল্প’-টা শোনাল সাবিত্রী। শেষ দিকে ওর গলার স্বর এত নেমে গিয়েছিল যে, প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না।
ওর কথা শেষ হলে সবাই চুপ করে রইল।
ঘরটা কেমন থমথমে হয়ে গেল। শুধু বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত শব্দ করে গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর আপনমনে সামান্য হেসে বিশেষভাবে কারও দিকে না তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
‘আপনারা সবাই নিশ্চয়ই এখন বুঝতে পারছেন, খুনের সময়টা ঘেঁটে দেওয়ার জন্যে মার্ডারার কোন কায়দাটা ব্যবহার করেছিল। মহাভারতের একই জায়গা দুবার পড়াটা যেমন একটা পয়েন্টার, তেমনই ওই হাঁচির শব্দ—দুবারই এগজ্যাক্টলি একই জায়গায় হাঁচির শব্দটাও আর-একটা পয়েন্টার…।’
এবার প্রজেনের দিকে তাকালেন এসিজি। কয়েকসেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর ওঁর দৃষ্টি শিফট করল তনয়ের দিকে। তারপর টুনির দিকে।
‘তার মানে, আপনরা তো এখন স্পষ্টই বুঝতে পারছেন, নিলয় মজুমদার ওঁর রোজকার নিয়ম মতো মহাভারত পড়া শুরু করার আগেই মার্ডারার ওঁর ঘরে গিয়ে হাজির হয়েছিল। ওঁর নজরের আড়ালে নিজের স্মার্ট ফোনটা রেকর্ডিং মোডে অন করে রেখে এসেছিল।
‘পরে খুনি আবার নিলয়বাবুর ঘরে যায়। খুনির হাতে তখন একটা ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট ছিল। ইনস্ট্রুমেন্টটা হতে পারে একটা শক্তপোক্ত গাছের ডাল—যেটা দিয়ে ক্রিকেট ব্যাট কিংবা বেসবল ব্যাটের মতো জোরে হাঁকানোর কাজ চলতে পারে। কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে, ফোরেন্সিক এক্সপার্টরা নিলয়বাবুর মাথার উন্ডে কাঠের গুঁড়ো, ময়লা, কিংবা শ্যাওলা, কিছুই পাননি। ফলে, আমার মনে হয়েছে, ওই গাছের ডালটার ওপরে খুনি হয়তো কোনও পলিথিনের প্যাকেট বা ওইরকম একটা কিছু জড়িয়ে নিয়েছিল।
‘ওয়েপন হিসেবে আমি যে গাছের একটা মোটা ডালের কথা ভেবেছি সেটার কারণ, এ-বাড়িতে ঢোকার সময় আমি লক্ষ করেছি, বাগানে পাঁচিল ঘেঁষে অনেকগুলো গাছের ডালের টুকরো সাজিয়ে রাখা আছে…।’
এসিজিকে বাধা দিয়ে তনয় বলে উঠলেন, ‘ওগুলো রামাইয়া—আমাদের বাগানের মালি—ও রেখেছে। ও ওগুলো জ্বালানি কাঠ হিসেবে ইউজ করে।’
এসিজি তনয়ের দিকে কৌতুকের চোখে তাকালেন : ‘মিস্টার মজুমদার, আপনি বলছেন, রামাইয়া ফায়ারউড হিসেবে ওই কাটা ডালগুলোকে ইউজ করে। সে করুক। তাই বলে সেখানকার একটা ডাল মার্ডারার ওয়েপন হিসেবে ইউজ করতে পারবে না এমন তো নয়! তবে হ্যাঁ, ওয়েপনটা গাছের ডাল না হয়ে একটা লোহার রড কিংবা সেই টাইপের কিছুও হতে পারে। এবং সেই রডটাও পলিথিন বা অন্য কিছু দিয়ে কভার করা ছিল।
‘তো মহাভারতের গল্প রেকর্ড করা সেই মোবাইলটা সেফ জায়গায় রেখে খুনি ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়ে তার কাজ শেষ করল। তারপর রাতের অন্ধকারে নিজেকে যতটা সম্ভব মিশিয়ে দিয়ে সে ফিরে গেল নিজের ঘরে। রক্তের ছিটে লাগা জামাকাপড় পালটে নিল। খুনের অস্ত্রটাকে লুকিয়ে ফেলল রাতারাতি। যদি গাছের ডাল সেই খুনের অস্ত্র হয় তা হলে সেটাকে নিশ্চিহ্ন করতে ওটা কেটেকুটে টুকরো করে স্ট্রেইট পুড়িয়ে ফেলা যেতে পারে।
‘এরপর এল মোবাইলে রেকর্ড করা মহাভারতের পাশা খেলার অংশটা প্লেব্যাক করার সময়। ধরা যাক, স্মার্ট ফোনটা নিয়ে খুনি সেকেন্ড টাইম আবার নিলয়বাবুর ঘরে এল। ফোনে রেকর্ড করা অংশটা প্লেব্যাক মোডে চালিয়ে দিল। আবার মহাভারত পাঠ শুরু হল—শুরু হল পাশা খেলা। খুনি এটুকু জানত, সেই মহাভারত পাঠ আর কেউ না শুনুক অন্তত সাবি শুনবে, এবং পুলিশকে জানাবে। তাতে পুলিশ ভাববে নিলয় মজুমদার তখনও বেঁচে ছিলেন—অথচ তখন মানুষটা নেহাতই একটা ডেডবডি। হয়তো সেই ডেডবডির মুখে-মাথায় তখন মাছি বসতে শুরু করেছে।
‘সত্যিই একসময় সাবিত্রীর ঘুম চটে যায় এবং শুনতে পায় ওর ”দাদুবাবা” মহাভারত পড়ছেন। সেই মহাভারত পড়া শেষ হলে খুনি কোনও এক ফাঁকে মোবাইল ফোনটা আবার হাতিয়ে নেয়।’
টেবিল থেকে তুলে নেওয়া স্মার্ট ফোনটা অশোকচন্দ্রের হাতেই ধরা ছিল। সেটা সবাইকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি সার্ভিস প্রোভাইডারের দেওয়া কোড ইউজ করে ডিলিটেড আডিয়ো ফাইলটা রিট্রিভ করেছি। এবার সেই হিডন ফাইলটা প্লেব্যাক করে সবাইকে শোনাব : নিলয় মজুমদার মহাভারত পড়ছেন—পাশা খেলা শুরু হচ্ছে—।’
‘ইয়ে কিসকা ফোন হ্যায়, গুপ্তাসাব?’ রঘুপতি প্রশ্ন করল।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত কোনও জবাব দেওয়ার আগেই প্রজেন বসু রায় ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন। এসিজির দিকে আঙুল তুলে ঝাঁজালো গলায় বললেন, ‘আপনারা কি ন্যাকামো করছেন? আপনারা জানেন না ওটা কার ফোন? ওটা আমার ফোন—আমার! আমার!’
তনয় হাত নেড়ে প্রজেনকে শান্ত করতে চাইলেন : ‘আঃ, প্রজেনদা, ডোন্ট গেট এক্সাইটেড। কিপ ইয়োর কুল!’
কিন্তু প্রজেন থামলে তো!
এসিজি ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আমি কি সবাইকে এখন মহাভারত শোনাব? নাকি আপনার কিছু বলার আছে?’
‘প্রজেনদা! প্রজেনদা! বোসো—ঠান্ডা হও।’ তনয় তখনও প্রজেনকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছেন। ওঁর চোখে-মুখে আশঙ্কার ছায়া।
প্রজেন তনয়ের দিকে ঘুরেও তাকালেন না। ওঁর কপালে ঘামের বিন্দু। চোয়াল শক্ত। চোখে রাগ। রগের কাছে শিরা ফুলে উঠেছে। হাত থরথর করে কাঁপছে।
‘আমার ফোনে কোনও অডিয়ো ফাইল থাকতে পারে না। বিকজ আমি সব ডিলিট করে দিয়েছি। ওই শয়তান বুড়ো লোকটার মতো। ওকেও আমি দুনিয়া থেকে ডিলিট করে দিয়েছি।’
‘প্রজেনবাবু, আপনি প্লিজ বসুন—’ এসিজি নরম গলায় প্রজেন বসু রায়কে অনুরোধ করলেন। রঘুপতি আর নিজামুল হকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনারা ওঁকে একটু শান্ত করুন…।’
রঘুপতি আর নিজামুল প্রজেনের কাছে গেলেন। ওঁকে শান্ত করতে চেষ্টা করলেন।
একটু পরেই প্রজেন অনেকটা স্বাভাবিক হলেন। বিছানায় বসে পড়লেন আবার।
রঘুপতি আর নিজামুল নিজেদের চেয়ারে ফিরে এলেন।
এর মধ্যে তনয় একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছেন। তাতে ঘন-ঘন টান দিচ্ছেন।
টুনি মজুমদার যে বারবার ভুরু কুঁচকে অপছন্দের চোখে ওঁর দিকে তাকাচ্ছেন সেটা তনয় খেয়াল করেও করছেন না।
প্রজেন বসু রায় শূন্য চোখে এসিজির দিকে কয়েকসেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। তারপর অনেকটা যেন আপনমনেই বলতে শুরু করলেন।
‘নিলয় মজুমদার ভীষণ বাজে লোক ছিলেন। ওঁর মধ্যে অনেস্টি কিংবা প্রিন্সিপল বলে কোনও ব্যাপার ছিল না। আউট অ্যান্ড আউট আনএথিক্যাল পাবলিক ছিলেন। তা ছাড়া সবার সঙ্গে ফর নাথিং বাজে ব্যবহার করতেন। মানুষকে মানুষ বলে মনে করতেন না—চাকরবাকরের চেয়েও বাজেভাবে ট্রিট করতেন। আমার বাবাকে…আমার বাবাকে উনি বলতে গেলে মার্ডার করেছিলেন। কাশীপুরের ফ্লাইওভার তৈরির সময় নিলয় মজুমদার বি গ্রেড কি সি গ্রেডের বিল্ডিং মেটিরিয়াল পারচেজ করেছিলেন। কিন্তু এই মিসহ্যাপটা নিয়ে পুলিশের ইনভেস্টিগেশানের সময় উনি কোনওভাবে বোধহয় পুলিশকেও পারচেজ করেছিলেন। কারণ, ফাইনালি হি কেম আউট ক্লিন। মানে, স্ট্রেইট ছাড়া পেয়ে যান। পরে ওঁর কোম্পানিতে ঢুকে দেখেছি, কনস্ট্রাকশনের কাজে পার্টিকে চিট করাটাই ওঁর স্ট্যান্ডার্ড স্টাইল। দ্যাট ম্যান ডিজার্ভড টু ডাই…।’ প্রজেন হঠাৎ মুখে হাত চাপা দিয়ে মাথা নীচু করলেন।
তনয় হাতের সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে পায়ের স্লিপার দিয়ে ঘষে নিভিয়ে দিলেন। তারপর প্রজেনের কাছে গিয়ে ‘প্রজেনদা! প্রজেনদা!’ বলে ওঁর পিঠে হাত বুলিয়ে মানুষটাকে ভরসা দিতে লাগলেন।
টুনি মজুমদার অস্বস্তি ভরা চোখে প্রজেনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মনে-মনে টুনিও বোধহয় চাইছিলেন প্রজেন শান্ত হোন।
একসময় প্রজেন বসু রায় শান্ত হলেন। মুখ তুলে আনমনা বিভ্রান্ত চোখে তাকালেন এসিজির দিকে।
ওঁর চোখ সামান্য ফোলা। মুখে হেরে যাওয়া মানুষের ছাপ।
‘ডক্টর গুপ্ত, কাশীপুরের ফ্লাইওভার তৈরির সময় মিস্টার মজুমদার যে-বাজে চিপ মেটিরিয়াল পারচেজ করেছিলেন তার ওরিজিন্যাল ডকুমেন্ট আমার কাছে আছে।’
‘কী ডকুমেন্ট?’ রঘুপতি জিগ্যেস করল।
‘দু-নম্বরি বিল্ডিং মেটিরিয়াল পারচেজের সব বিল—আই মিন, বিল আর চালানের কপি। বাবা মারা যাওয়ার সময় আমি ছোট ছিলাম। কিন্তু আমার মা বাবার সমস্ত কাগজপত্র ফাইল-টাইল যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। আমি বড় হলে পর মা সেগুলো আমাকে দেয়। তার মধ্যে বাবার একটা ডায়েরিও ছিল। সেটা পড়ে আমি জানতে পারি ফ্লাইওভার কনস্ট্রাকশনের চিটিং-এর কথা। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে নিলয় মজুমদারের অনেকবার তর্কাতর্কি কথাকাটাকাটি হয়েছিল। মা আমাকে এসব কথা বলেছে। তারপর…তারপর… বাবা ভাবছিলেন, ”নিলয় কনস্ট্রাকশনস” ছেড়ে দেবেন। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি…তার আগেই বাবা…বাবা চলে যান।
‘বাবা মারা যাওয়ার পর আমি বাবার সব ফাইলপত্র ঘেঁটে পারচেজ বিলের কপির ফাইলটা খুঁজে পাই। সেইসব বিল দেখলেই বোঝা যায়, মিস্টার মজুমদার সমস্ত দাগি সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে সিমেন্ট, রড আর স্টোনচিপ কিনেছিলেন।।
‘ওই ফাইলটা নিয়ে পুলিশে গেলে হয়তো ফ্লাইওভারের কেসটা রি-ওপেন করা যেত, কিন্তু সেটা না করে আমি বলতে গেলে ব্ল্যাকমেইলের পথ ধরলাম। কারণ, বাবা মারা যাওয়ার পর আমি আর মা হেভি ফিনানশিয়াল ক্রাইসিসের মধ্যে পড়েছিলাম। মানে, মান্থলি বাড়িভাড়ার টাকাটাও পে করতে পারছিলাম না।
‘আমি ফাইলটার একটা ব্যাক আপ কপি তৈরি করে ওটা নিয়ে মিস্টার মজুমদারের সঙ্গে দেখা করলাম। উনি খুব ধুরন্ধর মানুষ ছিলেন। ব্যাপারটা ছক কষে নিতে ওঁর দশমিনিটের বেশি সময় লাগেনি। উনি আমাকে ওঁর ”নিলয় কনস্ট্রাকশনস”-এর ম্যানেজার করে দিলেন এবং একইসঙ্গে টুয়েন্টি পারসেন্টের পার্টনার করে নিলেন। চটজলদি সব পেপারস তৈরিও করে দিলেন। আমার মা সেইসময়ে হঠাৎ করে মারা গেলেন। আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম। তখন মিস্টার মজুমদার আমাকে এ-বাড়িতে এসে থাকতে বললেন। যাকে বলে একেবারে পুজো বোনাস। কিন্তু…কিন্তু এতসব করা সত্ত্বেও বাবার মার্ডারারকে আমি ক্ষমা করতে পারছিলাম না। তার ওপর মিস্টার মজুমদার খুব বাজেভাবে কথা বলতেন। বিনা কারণে, বলতে গেলে সবসময়, খিচিরখিচির করতেন। বোধহয় ভাবতেন আমি ওঁর কেনা সম্পত্তি। কে জানে!
‘তারপর…তারপর…এখানে থাকতে-থাকতে বুঝলাম, আমি একা নই—এ বাড়ির প্রত্যেকেই নিলয় মজুমদারের কেনা সম্পত্তি। কাউকে এক কণাও সম্মান দিয়ে কথা বলতে পারতেন না উনি। নতুন-নতুন নোংরা কথা শোনার ভয়ে, নতুন-নতুন অপমানের ভয়ে, আমরা সবাই কাঁটা হয়ে থাকতাম। আমি ভাবতাম…আমি ভাবতাম…’ হঠাৎই থেমে গেলেন প্রজেন। কপালে হাত বোলালেন দুবার। রগের কাছটা টিপে ধরে মুখ নীচু করলেন। তারপর…।
‘আমি ভাবতাম, মানুষটার বয়েস আশি পেরিয়েছে। হয়তো যে-কোনও দিন ওপর থেকে ডাক আসবে…তখন আমরা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচব। কিন্তু সে-ডাক আর আসছিল কই!’
‘সেইজন্যে আপনি ওনাকে ডাক পাঠালেন?’ নিজামুল হক ব্যাঙ্গ করে বললেন।
প্রজেন নিজামুলসাহেবের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। ওঁর চোখে জল। ওপর-নীচে মাথা নেড়ে ধরা গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি ডাক পাঠালাম। একটা শয়তান পাপীকে সাজা দিতে চেয়ে আর-এক পাপ করে বসলাম। নিন, ইনস্পেকটরসাহেব, আমাকে অ্যারেস্ট করুন—সাজা দিন…।’ প্রজেন কথা বলতে-বলতে উঠে দাঁড়ালেন। দুটো হাত সামনে বাড়িয়ে নিজামুল হকের দিকে এক পা এগিয়ে গেলেন।
তনয় আর টুনি যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন সেটা অশোকচন্দ্র গুপ্ত লক্ষ করেছিলেন। ব্যাপারটা রঘুপতিরও চোখ এড়ায়নি। কিন্তু কেন এই মুখ চাওয়াচাওয়ি সেটা রঘুপতি আঁচ করতে পারল না।
নিজামুল প্রজেনকে বললেন, ‘প্রজেনবাবু, একটা কথা বলুন দেখি। সত্যি কথা বলবেন…।’
‘কী কথা?’ ধরা গলায় জানতে চাইলেন।
‘এই মার্ডারটা ঠিকঠাকভাবে করার জন্যে খুনিকে অনেক কাজ করতে হয়েছে। কাজগুলোর লিস্টি করলে সে-লিস্টি অনেক লম্বা হবে। একটু আগে গুপ্তসাহেবকে, ইনস্পেকটর যাদবকে সে-কথা আমি বলেছি। এত কাজ একজনের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তো এত কাজ আপনি একা-একা করলেন কেমন করে?’
প্রজেন দেওয়ালে বসানো একটা পেরেকের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। চোখের কোণে জল, ঠোঁটে হাসির রেখা। মনে হল হাসিটা যেন ওর দুঃখকে আরও বেশি করে চিনিয়ে দিল।
প্রজেনের ঠোঁট কাঁপল তিরতির করে। তারপর তিনি বেশ নীচু গলায় পেরেকটাকেই যেন বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। মার্ডারটার পেছনে এত কাজ! এত কাজ আমি একা-একা করলাম কেমন করে!’ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে-ধীরে মুখ ফেরালেন নিজামুলের দিকে। বললেন, ‘কী করে করলাম জানি না…বাট করেছি…একা করেছি। একা করেছি…একা করেছি…একা!’ বলতে-বলতে প্রজেন নিজের বুকে কিল মারতে শুরু করলেন। ওঁর মুখে লালচে ভাব, দৃষ্টিতে শুধু শূন্যতা।
সাবিত্রী ভয় পেয়ে গেল, ডুকরে কেঁদে উঠল।
তনয় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ওঁর মুখ-চোখ কেমন পালটে গেছে। সকাল থেকে যে-মানুষটার মুখে এসিজি কেবল শান্ত ভাবটাই লক্ষ করেছেন, এখন সেই মানুষটার মুখে ভাব আর আবেগের ছড়াছড়ি। তবে তার সবটাই শুধু দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণা।
কষ্ট পাওয়া গলায় তনয় বললেন, ‘আমি আর নিতে পারছি না, প্রজেনদা! তুমি চেঁচিয়ে বললেই একটা মিথ্যে পট করে সত্যি হয়ে যাবে না।’ চটপট পা ফেলে রঘুপতির দিকে এগিয়ে এলেন তনয় : ‘ইনস্পেকটর যাদব, আপনি প্লিজ আমাকেও অ্যারেস্ট করুন। প্রজেনদার পাশাপাশি আমিও দোষী। আমিও একজন কালপ্রিট…।’
রঘুপতি যাদব খানিকটা বিভ্রান্তভাবে তাকালেন ওর পুরোনো স্যারের দিকে।
‘গুপ্তাসাব, ইয়ে সব কেয়া হো রহা হ্যায়? হাউ মেনি মার্ডারার্স ডু উই হ্যাভ রিয়েলি?’
এসিজি খানিকটা অবাক হয়ে প্রজেন এবং তনয়ের দিকে পালা করে দেখছিলেন। অঙ্কটা কোথায় যেন মিলছিল, আবার মিলছিল না। এসিজি কেমন কনফিউজড হয়ে যাচ্ছিলেন।
এতদিন ধরে অশোকচন্দ্র গুপ্ত র’ ডেটা স্টাডি করেছেন। তার সঙ্গে বুনে দিয়েছেন গেসওয়ার্ক আর লজিক। আজ এখানে এসে সবকিছু দেখে-শুনে তিনি মার্ডার অ্যাক্টটাকে রিকনস্ট্রাকট করার চেষ্টা করেছেন। ‘লকড রুম পাজল’-টাকে সলভ করার চেষ্টা করেছেন। মার্ডার মিস্ট্রিটার ওপরে পুরোটা না পারলেও অনেকটা আলো ফেলতে পেরেছেন। তারপর রঘুপতির সঙ্গে ‘ষড়যন্ত্র’ করে একটা ব্লাফ দিয়েছেন সবাইকে : যে একটা স্পেশাল কোড ব্যবহার করে মোবাইল হ্যান্ডসেটের ডিলিট করা ফাইল রিট্রিভ করা যায় এবং সার্ভিস প্রোভাইডারদের কাছ থেকে তিনি সেই স্পেশাল কোড জেনে ডিলিট করা ফাইল রেস্টোর করেছেন। সেই ব্লাফে কাজ হয়েছে। টেনশন আর মেন্টাল প্রেশারে পড়ে একজন মার্ডারার কনফেস করেছে। কিন্তু তারপর…তারপর হঠাৎ সেকেন্ড মার্ডারার! কী কনফিউজিং!
এখন রঘুপতির দিকে ঝুঁকে পড়ে সেই কনফিউশন নিয়েই চাপা গলায় কথা বলতে লাগলেন এসিজি। বৃদ্ধ হুনুরের বারবার মনে হচ্ছিল তিনি হেরে যাচ্ছেন।
তখন তনয় প্রজেনের একটা হাত চেপে ধরেছেন। দম দেওয়া কলের পুতুলের মতো বলে চলেছেন কীভাবে তিনি খুনের নানা ধাপে ‘প্রজেনদা’-কে সাহায্য করেছেন।
আসলে নিলয় মজুমদারের নোংরা শয়তানি ব্যবহার ওঁরা কেউ আর নিতে পারছিলেন না। তনয়ের মা মারা যাওয়ার পর নিলয় আরও নোংরা, আরও ভয়ংকর চেহারা নিয়েছিলেন। তখন তনয় বা প্রজেনের কাছে নিলয় সিম্পলি অসহ্য হয়ে উঠেছিলেন।
ওঁদের পাশাপাশি টুনি মজুমদারও নিলয়ের পেট ভিকটিম ছিলেন। খেয়াল অথবা মরজি হলেই নিলয় টুনিকে ডেকে পাঠাতেন। ওঁর মডেলিং করা নিয়ে নানারকম অশালীন মন্তব্য করতেন। এমনকী প্রজেনকে জড়িয়েও অনেক আজেবাজে কথা বলতেন।
তনয় মাথা নীচু করে আঙুল খুঁটছিলেন। একটু থেমে-থেমে কথা বলছিলেন। কথা বলতে-বলতে গলা ধরে এলেও বাবার প্রতি অপছন্দ আর ঘৃণার ভাবটা ভালোই বোঝা যাচ্ছিল।
‘বাবা নিজে বাঁচতে ভালোবাসতেন। এই চুরাশি বছর বয়েসেও ওঁর বাঁচার ইচ্ছেটা ছোটবেলার মতোই ছিল। আমাদের তিনজনের কাজ ছিল দিন-রাত ওঁর সেবা করা; ওঁর জঘন্য ধমক, বকুনি আর অপমান হজম করে ওঁকে সবসময় তোয়াজ করে চলা; মুখ থেকে কোনও কথা খসানোমাত্রই সেটা সঙ্গে-সঙ্গে এক্সিকিউট করা—কারণ, না করতে পারলেই উনি মুখ খারাপ করতেন—যা-তা বলে অপমান করতেন।
‘দিনের পর দিন আর কত আমরা সহ্য করতাম বলুন তো! একদিন রাতে টুনির সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। তখন আমি বিরক্ত হয়ে টুনিকে বলি : ”চুরাশি বছর বয়েস, তবু মরার কোনও লক্ষণ নেই। আমাদের জ্বালানোর জন্যে অসভ্য বুড়ো জানোয়ারটা বেঁচে আছে! কবে যে মরবে কে জানে!” তখন টুনি জবাব দেয় : ‘হ্যাঁ, ওই আশাতেই বসে থাকো!” তখন আমি বলি, ”তা নয় তো কী করব!” তার উত্তরে টুনি মারাত্মক একটা কথা বলেছিল, ”নিজেরা একটু ইনিশিয়েটিভ নাও—যাতে চুরাশিটা পঁচাশিতে না পৌঁছোয়।”
‘তখন, ডক্টর গুপ্ত, লাস্ট মান্থের বাইশ তারিখে আমরা সেই ইনিশিয়েটিভ নিয়েছি। চুরাশিটা আর পঁচাশিতে পৌঁছোতে পারেনি। রোজ রাতে তাস খেলার সময় আমরা তিনজনে মিলে বাবাকে খুনের প্ল্যান করতাম। হ্যাঁ, টুনিও আছে এর মধ্যে—’ ঘাড় ঘুরিয়ে টুনি মজুমদারের দিকে তাকালেন তনয়। বিষণ্ণ হাসলেন। টুনিও একচিলতে মলিন হাসি ফিরিয়ে দিল। এই হাসি বিনিময়ে দুজনের মধ্যে বন্ডিংটা ফুটে বেরোল।
তনয় মাথার চুলে বারকয়েক আঙুল চালালেন। চঞ্চলভাবে মাথা ঝাঁকালেন দুবার। প্রজেনের দিকে দেখলেন, তারপর স্ত্রীর দিকে। ওঁকে দেখে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল।
নিজামুল হকের দিকে তাকিয়ে তনয় বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, হকসাহেব। এই মার্ডারটা ঠিকঠাকভাবে করার জন্যে খুনিকে অনেক কাজ করতে হয়েছে। সত্যিই সে-কাজের লিস্ট অনেক লম্বা। তো এত কাজ আমরা কেউ একা করিনি—তিনজনে মিলে করেছি। যেমন, দোতলার বারান্দার লোহার জাল কাটার কাজটা করেছে টুনি। জাল কাটার কাতুরি আমি শ্যামবাজারের একটা হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে কিনে এনেছি। কাজ হয়ে যাওয়ার পর সেটা বাগানের পেছনদিকের পাঁচিল ঘেঁষে একটা জায়গায় পুঁতে দিয়েছি। চলুন, জায়গাটা আপনাদের দেখিয়ে দেব—।’
উত্তেজিতভাবে কথা বলতে-বলতে তনয় একটু হাঁপাচ্ছিলেন। সেইজন্যই বোধহয় একটু থামলেন। তারপর বেশ নীচু গলায়, অনেকটা মন্ত্রপাঠের ঢঙে, বলতে শুরু করলেন আবার।
‘খুনের দিন রাতে আমি আর প্রজেনদা বেশ কয়েকবার বাবার ঘরে গেছিলাম। সাবিত্রী একসময় শুয়ে পড়েছিল। আমরা জানি, ও একবার ঘুমিয়ে পড়লেই কাদা। আমি বাবার ঘরে একবার গেছিলাম বাবার মহাভারত পড়াটা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করার জন্যে। পুলিশের কাছে ব্যাপারটাকে ঘেঁটে দেওয়ার জন্যে প্রজেনদা আমাকে বলেছিল ওর মোবাইলে ব্যাপারটা রেকর্ড করতে। আমিও সেটাই করেছিলাম। পরে সেই অডিয়ো ফাইলটা প্রজেনদা আমার আর টুনির মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপ করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এনি ওয়ে…বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় সাবি আমাকে দেখতে পায়।
‘এর আধঘণ্টা কি চল্লিশ মিনিট পর প্রজেনদা চুপিসাড়ে বাবার ঘরে যায়। প্রজেনদার হাতে মার্ডার ওয়েপনটা ছিল। ডক্টর গুপ্ত ঠিকই আইডিয়া করেছেন—অস্ত্রটা একটা শক্তপোক্ত গাছের ডাল…ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট…অনেকটা বেসবল ব্যাটের মতো। তবে পলিথিন দিয়ে নয়—প্রজেনদা ওটা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নিয়েছিল, যাতে হিট করার সময় আওয়াজটা অতটা না হয়। পরে আমরা সেই রক্তে ভেজা কাপড়টা সে-রাতেই পুড়িয়ে ফেলেছিলাম। ইন ফ্যাক্ট, এই কাজটা টুনি করেছিল। কারণ, তখনও আমার আর প্রজেনদার মাথা ঠান্ডা হয়নি—আমরা দুজনে ভীষণ এক্সাইটেড আর আনস্টেবল ছিলাম।’ টুনির দিকে ফিরলেন তনয় : ‘টুনি, আ স্পেশাল থ্যাংকস ফর ইউ…।’
সেই রাতটার কথা টুনির খুব মনে পড়ছিল।
ওদের শোওয়ার ঘরে থমথমে মুখে বসেছিলেন টুনি আর তনয়। টুনি চুপচাপ বিছানায় বসে অপেক্ষা করছিলেন প্রজেনের ফেরার জন্য।
ঘরের তিনটে লাইটই জ্বেলে দিয়েছেন টুনি : দুটো টিউবলাইট, আর একটা আট ওয়াটের এল. ই. ডি. ল্যাম্প। কারণ, টুনির মনে হয়েছিল, ঘরের সবগুলো বাতি জ্বেলে দিলে মনের ভয় আর উত্তেজনা খানিকটা হয়তো কমবে।
মাঝে-মাঝে টুনির চোখ চলে যাচ্ছিল ঘরের একটা খোলা জানলার দিকে। জানলার বাইরেটা অন্ধকার। সেই অন্ধকারের দিকে তাকালেই ভয়টা যেন আবার মাথাচাড়া দিচ্ছিল। টুনি মনে-মনে ভাবছিল, ‘প্রজেনদাটা নীচে গিয়ে এতক্ষণ ধরে কী করছে? এত সময় লাগছে কেন? আচ্ছা, দোতলা থেকে ”ধপ” করে একটা শব্দ শোনা গেল না? তা হলে কি কাজটা হয়ে গেছে?’
ঘরের মেঝেতে রঙিন বেডকভার পাতা। তার ওপরে ছড়ানো রয়েছে তাস। তনয় বেডকভারের এককোণে বসে সেই তাস নিয়ে এলোমেলোভাবে শাফল করছিলেন, সাজাচ্ছিলেন, আর ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছিল, তনয়ও অপেক্ষা করছিলেন।
বড় রাস্তা দিয়ে মাঝে-মাঝে গাড়ি ছুটে যাচ্ছিল। শোনা যাচ্ছে ছুটে যাওয়ার শব্দ, হর্নের আওয়াজ।
তনয় বুকের ভেতরে একটা চাপ টের পাচ্ছিলেন। বারবার ভাবছিলেন, ‘এভাবে একজন মানুষকে সময় হওয়ার আগেই সরিয়ে দেওয়াটা কি পাপ?’
একইসঙ্গে ওঁর ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল। বাবাকে ঘিরে ভালো-ভালো কয়েকটা স্মৃতি মনের ভেতরে ভিড় করছিল। কিন্তু তার পরের মুহূর্তেই ভয়ংকর অপমান আর হেনস্থার স্মৃতিগুলো হুড়মুড়িয়ে মনের ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল।
তনয় বারবার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছিলেন।
‘এতক্ষণ লাগছে কেন? তা হলে কি প্রজেনদার সঙ্গে বাবার হাতাহাতি ধস্তাধস্তি হচ্ছে?’
ঠিক সেইসময় প্রজেন বসু রায় ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন।
দৃশ্যটা টুনি মজুমদারের মনে চিরকাল আঁকা হয়ে থাকবে।
দরজার ফ্রেমে বাঁধানো একজন মানুষ। পরনে পাঞ্জাবি আর পাজামা। পাঞ্জাবির রং হালকা বাদামি, আর পাজামার রং সাদা। কিন্তু এখন সেই বাদামি আর সাদা রঙের ওপরে লাল রঙের অজস্র কলঙ্কের ছিটে।
রক্তের দাগ।
পাঞ্জাবির ওপরে যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে আছে রক্তের ছোপ। আর পাজামার ওপরেও ভালোরকম রক্তের ছিটে।
প্রজেনের ডানহাতে ধরা একটা গাছের ডালের টুকরো। তার ওপরে কাপড় জড়ানো। কী রঙের কাপড় সেটা আর বোঝা যাচ্ছে না, কারণ, কাপড়টা লালে লাল। আর মানুষটার গা থেকে রক্তের আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছে।
প্রজেনের সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল। শত চেষ্টাতেও সে-কাঁপুনি থামছিল না।
তনয় আর টুনি চোখে প্রশ্ন নিয়ে প্রজেনের দিকে তাকিয়েছিলেন। সেই নীরব প্রশ্নের উত্তরে প্রজেন ওপর-নীচে মাথা নেড়েছিলেন আর ভাঙা এবং কাঁপা গলায় বলেছিলেন, ‘ডান। আমরা এখন ফ্রি…।’
টুনি একটা বড় পলিথিনের প্যাকেট নিয়ে প্রজেনের কাছে গেলেন। সেটার মুখটা চওড়া করে খুলে প্রজেনকে বললেন, ‘হাতের লাঠিটা এর মধ্যে ফেলে দিন—।’
প্রজেন চুপচাপ কথা শুনলেন। ওঁর শরীর তখনও কাঁপছিল।
তনয় বেডকভার থেকে উঠে পড়েছিলেন। বিছানার নীচ থেকে আর-একটা পলিথিনের প্যাকেট বের করে প্রজেনের কাছে গেলেন।
‘প্রজেনদা, তুমি আমাদের ওই অ্যাটাচড বাথরুমটায় চলে যাও। এই স্টেইনড জামাকাপড়গুলো খুলে এই প্যাকেটটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ো। পরে টুনি ওটার ব্যবস্থা করবে।’
প্রজেন প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কাঁপা পা ফেলে বাথরুমের দিকে এগোলেন।
টুনি চাপা গলায় বললেন, ‘বাথরুমে সাবান, শ্যাম্পু সব আছে। ড্রেস আছে, ডিও আছে। ফ্রেশ হতে আপনার বড়জোর হাফ অ্যান আওয়ার লাগবে। প্লিজ, স্টেবল হোন, প্রজেনদা। আমরা যা করেছি সবার ভালোর জন্যেই করেছি…।’
প্রজেন বাথরুমে ঢুকে গেলেন।
টুনি গাছের ডালসমেত পলিথিনের প্যাকেটটা নিয়ে চটপটে পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ওঁর বুকের ভেতরে ধুপ-ধুপ আওয়াজ হচ্ছিল।
একটু পরে টুনি ফিরে এলেন। দেখলেন, তনয় এখনও বিভ্রান্তভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।
প্রজেন যে বাথরুমে আছে সেটা দেখে নিয়ে স্বামীকে জাপটে ধরলেন টুনি। কান্না মেশানো গলায় বারবার বলতে লাগলেন, ‘কোনও ভয় নেই, আমি তো আছি! কোনও ভয় নেই, আমি তো আছি…!’
এসব কথা ভাবতে-ভাবতে টুনির আবার কান্না পেয়ে গেল।
টুনি বিছানা থেকে উঠে চলে এলেন স্বামীর কাছটিতে। ওঁকে আর প্রজেনকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসালেন বিছানায়। নিজেও বসলেন। নরম মমতায় তনয়ের হাতে-পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
তনয় মাথা নীচু করে ছিলেন। এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ছিলেন বারবার। হয়তো আক্ষেপ কিংবা হতাশায়—অথবা পিতৃহত্যার অনুশোচনায়।
ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসেছিলেন। তনয়ের কথা শুনছিলেন, বৃষ্টির শব্দ শুনছিলেন আর ভাবছিলেন, এই খুনটার তদন্তে হাত না দিলেই বোধহয় ভালো হত।
এসিজি চোখ খুলে রঘুপতি আর নিজামুল সাহেবকে লক্ষ করলেন।
ব্যাপারস্যাপার দেখে-শুনে রঘুপতি যাদবের মতো আদ্যন্ত পুলিশি মানুষও কেমন যেন থম মেরে গেছে। আর নিজামুল হক মন দিয়ে সব দেখছিলেন, শুনছিলেন এবং নিজের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার সমৃদ্ধ করছিলেন।
তনয় যে আবার কখন কথা বলতে শুরু করেছিলেন কেউ খেয়াল করেননি।
নিজামুলসাহেবের কোনও একটা কথার পিঠে তনয় বলছিলেন, ‘বললাম তো, কাপড়টা সে-রাতেই আমরা পুড়িয়ে ফেলেছিলাম, তবে গাছের ডালের টুকরোটা বাগানে রেখে এসেছিল প্রজেনদা। ওই যে, যেখানে গাছের ডালের টুকরো জড়ো করে রাখা আছে…।’
রঘুপতি একবার এসিজির দিকে তাকাল। কারণ, ওর স্যার একবার এরকমই কিছু একটা ইশারা করেছিলেন।
‘কয়েকদিন পর গাছের ডালটাকে প্রজেনদা ওর কনস্ট্রাকশন সাইটে নিয়ে গিয়ে কেটেকুটে পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা করে। না, প্রজেনদা শুধু ওই একটা ডাল নিয়ে যায়নি—ওটাকে আড়াল করতে আরও চার-পাঁচটা ডালের টুকরো নিয়ে গিয়েছিল।
‘বাইশ তারিখে রাতে প্রজেনদা বাবার ঘরে আরও একবার গিয়েছিল মোবাইল ফোনটাকে প্লে-ব্যাক মোডে চালু করতে। যাতে সাবি অন্তত ভাবে, বাবা তখনও বেঁচে আছেন। ঘর থেকে প্রজেনদা চুপিচুপি বেরিয়ে আসার পর একটু আওয়াজ-টাওয়াজ করে সাবির ঘুম চটিয়ে দেয়। সেসময় প্রজেনদা বাবার ঘরের দরজায় এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল যেন মনে হয় ও বাবার ঘরে ঢুকবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। সাবিকে শুনিয়ে প্রজেনদা বলে যে, স্যারকে এখন ডিসটার্ব করে লাভ নেই…এটসেটরা এটসেটরা। তারপর সেখান থেকে চলে যায়। মহাভারতের পাশাখেলা তখনও চলছিল।
‘অনেক রাতে…বলতে গেলে প্রায় ভোরের দিকে…আমি আর প্রজেনদা আবার বাবার ঘরে আসি…ঘরটা সাজিয়ে-গুছিয়ে লকড রুম পাজল তৈরি করার জন্যে। ডক্টর গুপ্ত…’ মুখ তুলে এসিজির দিকে তাকালেন তনয় : ‘আপনার বুদ্ধি সত্যিই তারিফ করার মতো। শুধু বুদ্ধি, লজিক আর গেসওয়ার্ক দিয়ে আপনি সত্যি ব্যাপারটার কত কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন!
‘ডক্টর গুপ্ত, আমরা এই তিনটে মানুষ—আমি, টুনি আর প্রজেনদা—প্রতিদিন কীভাবে যে টরচারড হচ্ছিলাম সেটা আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। নিজেদের আর মানুষ বলে মনে হত না—মনে হত, আমরা জন্তুজানোয়ার বা সেরকম কিছু। আমরা তিনজন ধীরে-ধীরে একজোট হলাম। বিশ্বাস করবেন না, স্রেফ অপমান আর চোখের জল আমাদের একজোট করল। আমরা মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করেছিলাম। আমি জানি, মুক্তির পথ খোঁজা মানে অন্যায়ের পথে পা বাড়ানো। কিন্তু আপনি একবার ভাবুন তো, দিনের পর দিন কত অন্যায় আমরা সহ্য করছিলাম!’
তনয় থামলেন। টুনির হাতটা ধরে সামান্য চাপ দিলেন। প্রজেন বসু রায়ের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হাসলেন। তারপর :
‘ডক্টর গুপ্ত, আমাদের আর কিছু বলার নেই। আমাদের তিনজনকে নিয়ে আপনারা যা ভালো বোঝেন করুন…যেরকম শাস্তি দিতে চান দিন।’
তনয় চুপ করতেই ঘরটা কেমন থমথমে হয়ে গেল। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ ছাপিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যেতে লাগল।
তনয় আর প্রজেনের কথা শুনে এসিজি ভীষণ ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল, রঘুপতির কথায় এই খুনের তদন্তে না নামলেই বোধহয় ভালো হত।
বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপ।
টুনি মজুমদার তনয়ের কাঁধে মাথা এলিয়ে আছেন। মুখে দুশ্চিন্তার প্রলেপ।
তনয় শূন্য চোখে ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে।
প্রজেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে জানলার দিকে তাকিয়ে আছেন। এই মুহূর্তে অন্ধকার আর বৃষ্টিই বোধহয় ওঁর সবচেয়ে প্রিয়।
অনেকক্ষণ পর রঘুপতিই প্রথম কথা বলল। চাপা গলায় এসিজিকে জিগ্যেস করল, ‘স্যার, নাউ হোয়াট টু ডু? প্লিজ অ্যাডভাইজ।’
এসিজি চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। রঘুপতির চোখে তাকালেন : ‘রঘুপতি, আমার মনে হয়, এই কেসটা আমাদের একটু অন্যভাবে ডিল করা উচিত…।’
‘কীভাবে, স্যার?’
‘দ্যাখো, নিলয় মজুমদার খুব বাজে টাইপের লোক ছিলেন। কনস্ট্রাকশনের কাজ করতে গিয়ে উনি অনেক ক্রাইম করেছেন—এমনকী কয়েকজনকে ইনডিরেক্টলি মার্ডারও করেছেন। যেমন, ব্রজেন বসু রায় ওঁর একজন ভিকটিম। তা ছাড়া উনি চুরাশি বছর লাইফ এনজয় করেছেন।…আর…আর সবচেয়ে বড় কথা হল, তনয় মজুমদার, টুনি মজুমদার আর প্রজেন বসু রায়ের ডেইলি লাইফ উনি হেল করে তুলেছিলেন। সো…।’
‘সো হোয়াট, গুপ্তাসাব?’ রঘুপতি উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল।
নিজামুল হকও হান্ড্রেড পারসেন্ট আগ্রহ নিয়ে এসিজির দিকে তাকিয়ে।
এসিজি ধীরে-ধীরে বললেন, ‘রঘুপতি, তোমরা ধরে নাও এই কেসটার মধ্যে আমি ঢুকিনি। মানে, আমি আজ—শুধু আজ কেন, কোনওদিনই—মজুমদারদের ”নিলয়নিবাস”-এ আসিনি। তা হলে পুলিশের রেকর্ড যেমন ছিল তেমনই থাকবে। মানে, কয়েকমাসের মধ্যেই কেসটা আনসলভড মার্ডার কেসের তকমা পেয়ে যাবে। তারপর এই কেসের ফাইলটা কোল্ড স্টোরেজে ঢুকে যাবে। ব্যস—ফিনিশ!’
কথা শেষ করার সময় এসিজির ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল।
রঘুপতি যাবদ আর নিজামুল হক এসিজির কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন।
অশোকচন্দ্র আলতো গলায় বললেন, ‘তা ছাড়া এই কেসে প্রমাণ কই, রঘুপতি, প্রমাণ? মার্ডারাররা কনফেস করেছে ঠিকই, বাট সলিড প্রূফ কোথায়, সলিড প্রূফ? খুনটা হওয়ার এতদিন পরে তুমি নতুন কোনও প্রূফ আর পাবে না। সুতরাং, বাইরের কোনও অচেনা অজানা লোক এসে দোতলার লোহার জাল কেটে বারান্দায় ঢুকেছে—তারপর নিলয় মজুমদারের ঘরে ঢুকে ওঁকে ব্রুটালি মার্ডার করে রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়েছে—এরকম একটা রিপোর্ট লিখে তুমি এ-কেসের ফাইলটা ক্লোজ করার বন্দোবস্ত করো। দ্যাটস ইট, রঘুপতি। কেস ক্লোজড।’
রঘুপতি আর নিজামুল হক কোনও কথা বললেন না, শুধু ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন।
নিলয়ের বিছানায় বসা তিনটে মানুষ তখন খুব কাছাকাছি। প্রজেন এবং টুনির মাথা দুপাশ থেকে ঝুঁকে পড়েছে ওঁদের মাঝখানে বসা তনয়ের দিকে। মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা যেন খেলা শুরুর আগে ক্রিকেট প্লেয়ারদের হাডল।
টুনি মজুমদারের মুখের অনেকটাই দেখতে পাচ্ছিলেন এসিজি। ওঁর মুখে ছেয়ে থাকা দুশ্চিন্তার প্রলেপ তখন অনেকটা সরে গেছে। ওঁকে দেখে এখন আর কিছুতেই ‘ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট’ বলে মনে হচ্ছে না। একসময় ওঁকে সেরকম ভেবেছিলেন বলে এসিজি মনে-মনে একটু লজ্জা পেলেন।
বৃষ্টিটা ধরে এল রাত সাড়ে আটটার পর।
এসিজি, রঘুপতি, নিজামুল হক আর ভগবান মিস্ত্রি মজুমদারদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে খোলা জমিতে পা দিলেন। ঠান্ডা বাতাস ওঁদের ছুঁয়ে গেল। বৃষ্টির মিহি গুঁড়ো বাতাসে উড়ছে।
বাড়ির বাইরে খোলা জায়গায় একটা মলিন আলো জ্বলছে। সিমেন্ট বাঁধানো পথের দুপাশে এখানে-সেখানে জল জমে ছোট-ছোট গোস্পদ তৈরি হয়েছে। সেই জলে আলোর টুকরো চিকচিক করছে।
এসিজিদের সঙ্গে তনয় আর সাবিত্রী রয়েছে। সামনে আর আট-দশ পা এগোলেই লোহার মেন গেট।
একটা ব্যাপার বহুক্ষণ ধরেই অশোকচন্দ্রের মনের ভেতরে খচখচ করছিল। অস্বস্তির কাঁটা বিঁধছিল বারবার।
সে-রাতে সাবিত্রী বারান্দায় শুয়ে ছিল। হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছিল। কিন্তু একেবারে পাশের ঘরে প্রজেন একটা গাছের ডাল দিয়ে নিলয় মজুমদারের মাথায় প্রচণ্ড জোরে হিট করলেন অথচ সাবিত্রী কোনও শব্দ-টব্দ পেল না! যদিও ডালটার ওপরে কাপড় জড়ানো ছিল, তবুও একটা জোরালো ভোঁতা শব্দ তো হবে!
এসিজি ভাবলেন, ‘এখন তো সব চুকেবুকে গেছে। এখন সাবিকে সরাসরি ব্যাপারটা একবার জিগ্যেস করলে হয়…।’
এসিজি তনয় মজুমদারকে বললেন, ‘মিস্টার মজুমদার, আর এগোতে হবে না—আপনি এবার আসুন।’
এ-কথায় তনয় ইতস্তত করছেন দেখে এসিজি আরও যোগ করলেন, ‘সাবিত্রীকে আমি আলাদা করে দু-একটা কথা বলতে চাই…।’
একটু থতোমতো খেয়ে তনয় বললেন, ‘ও, আচ্ছা…আচ্ছা। ঠিক আছে। আমি তা হলে আসি। আপনাদের…আপনাদের অনেক ধন্যবাদ…।’ তারপর বাড়ির দিকে ব্যাক করলেন।
রঘুপতি আর নিজামুল অবাক হয়ে ডক্টর গুপ্তর দিকে তাকিয়েছিলেন। সাবিত্রীর সঙ্গে এখন আবার কী কথা!
সাবিও অবাক হয়ে বৃদ্ধ মানুষটির দিকে তাকিয়ে ছিল। এই দাদু এখন কী বলতে চায়?
এদিক-ওদিক তাকালেন এসিজি।
ভেজা মাটি, ভেজা গাছের পাতা। সদর দরজার বাইরে ভেজা রাস্তা। রাস্তায় ছুটে যাচ্ছে ভেজা গাড়ি।
চারপাশে কেমন এক মায়াবী বিষণ্ণতা।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তিনি সাবিকে মনে-কাঁটা-বেঁধানো প্রশ্নটা করলেন।
‘প্রজেনবাবু যখন ওই ডালের বাড়ি মেরে তোমার দাদুবাবাকে খুন করে তখন তুমি কোনও শব্দ শুনতে পাওনি? তুমি তো ঘরের পাশেই বারান্দায় শুয়ে ছিলে!’
সাবি কয়েকসেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘পেয়েছি। কেমন একটা ”ধপ” শব্দ। আমার তখন ঘুম চটে গেছিল।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘চোর-টোর এসেছে ভেবে আমি চট করে উঠে পড়েছিলাম। অন্ধকারে দাদুবাবার জানলার কাছে গিয়ে দেখি নতুন দাদাবাবু ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে। আর দাদুবাবা বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বিছানায় অনেক রক্ত… অনেক রক্ত…।’
‘তুমি সব দেখেছ অথচ পুলিশকে কিছু বলোনি!’
‘না, স্যার। ফ্যামিলির ঝামেলায় আমার জড়িয়ে কী লাভ! আমি ছোট মানুষ—আর ওনারা আমার অন্নদাতা…। তাই মনে হয়েছিল পুলিশ যা করার করবে।’
সাবি চুপ করে গেল। আর সবাই চুপচাপ।
একসময় এসিজি বললেন, ‘সাবি, এবার তুমি যাও। আমরাও আসি—।’
সাবিত্রী চট করে কপালে হাত ঠেকিয়ে একটা নমস্কার গোছের ছুড়ে দিয়ে চলে গেল বাড়ির দিকে।
‘নিলয় নিবাস’-এর মেন গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পুরোনো একটা কথা এসিজির আবার মনে পড়ল : ‘খুন অতি জঘন্য কাজ, কিন্তু খুনি ধরার কাজটা আরও জঘন্য।’