গোয়েন্দা এসিজি (Goyenda ACG) : পাখি ধরা
পরনের সাদা ধবধবে পাঞ্জাবির সঙ্গে এক মাথা সাদা ধবধবে চুল একেবারে মিশে গিয়েছিল। বৃদ্ধের শরীরটা ঝুঁকে পড়েছে অতি-আধুনিক একটা টেপরেকর্ডারের ওপরে। টেপ চলছে। শোনা যাচ্ছে নানারকম শিসের শব্দ। মিষ্টি এবং কর্কশ সুর। পাখি ডাকছে।
বৃদ্ধ তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। হাতে খাতা-পেনসিল। নোট নিচ্ছেন। কখনও কখনও ঘাড় নাড়াচ্ছেন। আবার কোনও এক ফাঁকে পেনসিল-ধরা হাতে টান মারছেন শুভ্র চুলের গোছায়। তারপরই চশমার কালো ফ্রেম ঠিকঠাক করছেন।
‘গুড মর্নিং, গুপ্তাসাব। সক্কালবেলায় নকলি চিড়িয়ার ডাকে কোনও মউজ নেই।’
ফিরে তাকালেন ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত, সংক্ষেপে এসিজি। হাসলেন। সাতসকালে তাঁর এই আস্তানায় হুটহাট করে ঢুকে পড়ে এরকম দোআঁশলা ভাষায় মন্তব্য করতে পারে মাত্র একজনই। ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব। মুখের রেখা কাঠ-কাঠ, চোয়াড়ে, গায়ের রং রোদে পোড়া, চোখ শরীরে বিঁধে যায় যেন, আর পুরুষালি মোটা গোঁফ।
দেখে রঘুপতিকে যতই অপ্রিয় মনে হোক এসিজি ওকে ভীষণ ভালোবাসেন। একসময় এসিজির ছাত্র ছিল ও। কথাবার্তায় রুক্ষ হলে কী হবে, মনটা বড় ভালো। আর কাজ-পাগল। মনে পড়ে, একবার একটা নির্বোধ ওকে ঘুষের প্রস্তাব দিয়েছিল। ও হাসতে-হাসতে যুযুৎসুর প্যাঁচ দিয়ে তার ডান হাতটা ভেঙে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘যার সব কাজই বাঁ-হাতের তার আবার ডাঁয়ে হাতের জরুরত কী?’
খোলা জানলার পাশেই টেবিলে কোকিল-ঘড়ি। ন’টা এখনও বাজেনি। ঘড়ির পাশেই স্টেনলেস স্টিলের ‘মোনালিসা’ ফ্লাস্ক। রঘুপতি জানে, ভোরবেলায় উঠেই এসিজি নিজের হাতে ফ্লাস্কভর্তি কফি করে রাখেন। কারণ, এখানে এখনও পরের হাত বলে কিছু নেই। স্ত্রী মালিনী চলে গেছেন প্রায় এক যুগ আগে। আর একমাত্র মেয়ে ঊর্মিলারও বিয়ে হয়ে গেছে গত বছর।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত টেপরেকর্ডার বন্ধ করে খাতা-পেনসিল গুছিয়ে রাখলেন তার পাশে। হাসতে-হাসতে বললেন, ‘বোসো, রঘুপতি। নকলি চিড়িয়ার ডাকে মউজ না থাকলে কী হবে, আমার ফ্লাস্কের কফিতে থাকতে পারে। আজাকে দেখো।’
ছাপা কাপড়ে আবৃত বেতের চেয়ারে বসল রঘুপতি যাদব। গা এলিয়ে দিল শোয়ার ভঙ্গিতে। হেসে বলল, ‘স্যার, পাখিতে কী মজা পান বুঝি না। মাঝে-মাঝে ডাক শুনতে ভালো লাগে। তা বলে দিনভর কিচিরমিচির?’
এসিজি কাপে কফি ঢেলে এগিয়ে দিলেন রঘুপতিকে। তারপর ঘরের মেঝেতে সাজিয়ে রাখা বইয়ের কয়েকটা স্তূপকে সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে আর-একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।
সাদা পাজামা টেনে ঠিক করে বললেন, ‘তুমিই বা চোর-ডাকাত-খুনে-বদমাসের মধ্যে কী মজা পাও বুঝি না। পাখিরা তার চেয়ে অনেক ভালো।’
রঘুপতি যাদব কফিতে চুমুক দিল কয়েকবার। তারপর সিরিয়াস মুখ করে বলল, ‘গুপ্তাসাব, আপনার জরুরি কাজে ডিস্টার্ব করলাম…।’
এসিজি ঝুঁকে পড়ে রঘুপতির কাঁধ চাপড়ে দিলেন আলতো করে। বললেন, ‘যা শুরু করেছি তা এক-আধ দিন পরিশ্রমের ব্যাপার নয়। অন্তত দু-বছর লাগবে।’
‘কী কাজ?’ রঘুপতির কৌতূহল হল। কপালে ভাঁজ পড়ে।
এসিজি মাথার চুল টানলেন একবার। তারপর ঘরের ছাদের দিকে চোখ তুলে বললেন, ‘বার্ড কমিউনিকেশন। পাখিদের ভাষা। কোন-কোন পাখি কীরকম ভাষায় কথা বলে তাই বোঝার চেষ্টা করছি। যে-টেপটা বাজাচ্ছিলাম, সেটা গত সপ্তাহে সুন্দরবনের জঙ্গলে টেপ করা। এর মধ্যে রাডি কিংফিশারের আওয়াজ শুনতে পেলে?’
‘রাডি কিংফিশার?’ রঘুপতি জলদি চুমুক দিয়ে ফেলে কফির কাপে। তারপরই ‘উঃ’ করে ওঠে। একটু সময় নিয়ে ও বলল, ‘স্যার, আমি এদিকে এক ব্লাডি কিংফিশারকে নিয়ে ফেঁসেছি। গত কয়েক বছর ধরে প্রীতম দাস চৌধুরি বহু মছলি পাকড়েছে। কিন্তু আমরা ওকে ফাঁদে ফেলতে পারিনি। মছলি পাকড়েছে আর শটকেছে। সিধা ন’দো গিয়ারা।’
এসিজি বাধা দিয়ে বললেন, ‘রঘুপতি, জিভে আগল দাও। বোঝাই যাচ্ছে তুমি ডিসটার্বড, না হলে আমাকে ডিসটার্ব করতে আসতে না। তা এই প্রীতম দাস চৌধুরি লোকটা করেছে কী? খুন করেছে?’
রঘুপতি যাদবের কফি শেষ হয়ে গিয়েছিল। পাশের ছোট্ট টেবিলে কাপটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘এতদিন শুধু ওর খুন করাটাই বাকি ছিল। পরশু সেটা সেরে ফেলেছে।’ একটু থেমে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘বুঝতে পারছি, খুনটা দাস চৌধুরিই করেছে। কিন্তু কী করে করেছে ধরতে পারছি না। লোকটা গহেরা পানিকা মছলি, গুপ্তাসাব।’
রঘুপতির মুখের দিকে তাকিয়ে অশোকচন্দ্র গুপ্ত ওর অস্বস্তিকর দুশ্চিন্তাটা অনুভব করতে পারছিলেন। ছেলেটা সত্যিই প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে ওর চাকরিকে। লালবাজার ওর কাছে মন্দির। আর পুলিশি উর্দি ওর গর্ব। কিন্তু প্রীতম দাস চৌধুরি ওকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
এসিজি কাশলেন। মাথার এক গোছা চুল ধরে টানলেন বারদুয়েক। তারপর বললেন, ‘প্যাঁচার মতন মুখ করে বসে থেকো না, রঘুপতি। আমি এখনও মরে যাইনি। আই নো হাউ টু ক্যাচ আ রেয়ার বার্ড।’ হাসলেন এসিজি, বললেন, ‘একটা কথা তোমাকে তো সবসময় বলি। চেহারা আমার শার্লক হোমসের মতো নয়, সেরকম করে পাইপ টানতেও পারি না। এরকুল পোয়ারোর মতো মোমের পালিশ দেওয়া গোঁফও আমার নেই। এছাড়া দেবেন্দ্রবিজয়, হুকাকাশি, রবার্ট ব্লেক বা ব্যোমকেশের ছিটেফোঁটা গুণও নেই আমার মধ্যে। তবে আমি, সাধারণ একজন গোয়েন্দা, মোটামুটিভাবে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালিয়ে নিই। সুতরাং, মনে হয় প্রীতম দাস চৌধুরির ধাঁধা আমি সলভ করতে পারব।’
কোকিল-ঘড়িতে সুরেলা শব্দে ন’টা বাজল।
রঘুপতি দেখল এসিজির দিকে। জানলা দিয়ে একফালি রোদ এসে পড়েছে বৃদ্ধের মাথায়। সাদা চুলের গুচ্ছ চকচক করছে রুপোর মতো। পাখি-পাগল এই মানুষটা একসময়ে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপনা করতেন। এখন পাখি আর অপরাধী নিয়ে গবেষণা করেন। বলেন, বার্ড ওয়াচিং আর ম্যান ওয়াচিং-এ নাকি অনেকটাই মিল। ঈশ্বর জানেন!
রঘুপতি একটু সময় নিয়ে মনে-মনে গল্পটা গুছিয়ে নিল। তারপর শুরু করল, ‘দাস চৌধুরির নাম আপনি হয়তো শোনেননি, তবে লোকটা বহত সাল ধরেই দু’নম্বরি কারবার চালাচ্ছে। যেমন, প্রথমে করত কালোয়ারি, চোরাই মাল-টাল খরিদ করত। তারপর ধরমতল্লায় একটা হোটেল খুলে বসল। ছোট কিন্তু টিপটপ হোটেল। নাম, ”মুসাফির”। তো হোটেল খোলার পর লোকটা স্মাগলিং-এর বেওসায় নেমে পড়ল। তারপর শুনেছি গত বছর থেকে নাকি ড্রাগের লাইনে পা দিয়েছে।’
একটু ফাঁক পেতেই অশোকচন্দ্র গুপ্ত হাত তুললেন, বললেন, ‘রঘুপতি, ডিয়ারবয়, তোমার রাজধানী এক্সপ্রেসের গতি কিছুটা কমাতে পারলে ভালো হয়। তোমাদের রেকর্ডে দাস চৌধুরির নাম নেই?’
রঘুপতি বলল, ‘আছে। তবে সে সবই ছোটামোটা লাফড়া। সবক’টা কেসেই জামিনে ছুট হয়ে গেছে। তা ছাড়া প্রীতম পয়সাওয়ালা রইস। সবসময় এক নম্বর ল’ইয়ার দাঁড় করায়।’
এসিজি চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গেলেন কফির ফ্লাস্কের দিকে। নিজের জন্য এক কাপ ঢাললেন। রঘুপতির দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করতে ও মাথা নাড়াল। বিরক্তভাবে বলল, ‘স্যার, আমি দু-রাত্তির ধরে ঘুমোতে পারছি না। আমার জান জ্বলে যাচ্ছে। প্রীতমকে ধরার এটাই সুনহরি মওকা। কিন্তু যদি এবারেও পিছলে বেরিয়ে যায় তা হলে—।’
‘টেক ইট ইজি, রঘুপতি,’ কফির কাপ হাতে নিয়ে এসিজি ফিরে এলেন। চেয়ারে গুছিয়ে বসে কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। মাথা গরম না করে গল্পটা ধীরে-ধীরে বলো। গায়ের জোরের লড়াইয়ে স্পিডটা একটা ফ্যাক্টর, কিন্তু বুদ্ধির লড়াইয়ে নয়। নাও, বলো।’
‘মুসাফিরের চারতলাটা প্রীতম নিজে ব্যবহার করে। তিনটে ঘর আছে সেখানে। গত পরশু, সকালে ওর দুই দোস্ত মুকেশ আর সুদেশ তেওয়ারি হোটেলে আসে। মুকেশ আর সুদেশ দু-ভাই। তবে ওরা দুজনেই প্রীতমের বিজনেস পার্টনার। কীসের বিজনেস তা বলতে পারব না। তবে পাঁচ-ছ’রকম তো হবেই। তার মধ্যে কয়েকটা ন্যাচারালি কালা ধান্দা।’
এসিজি চোখ বুজে শরীর এলিয়ে দিলেন। হাতের কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। হঠাৎই চোখ খুলে বললেন, ‘লোকগুলোর ছবি এনেছ তুমি?’
পাশেই একটা খালি চেয়ারে একটা মোটা ফোল্ডার পড়ে ছিল। সেটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিল রঘুপতি। এসিজির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘শুধু ফটো কেন, এখানে ওই তিনজনের পুরা দাস্তান পেয়ে যাবেন। এ ছাড়া স্পটের নানান ফটোগ্রাফ আর রিপোর্টও আছে।’
এসিজি ফোল্ডারটা নিলেন। তাঁর চোখ সজাগ হল। শীর্ণ শরীর ঋজু হল। কয়েক চুমুকে কফি শেষ করে কাপ নামিয়ে রাখলেন। তারপর পাখি-দেখা তীক্ষ্ন চোখে ফোল্ডারের কাগজপত্র উলটেপালটে দেখতে শুরু করলেন। তাঁর চশমার কাচ চকচক করছিল।
প্রথমেই প্রীতম দাস চৌধুরির ছবি। বছর পয়তাল্লিশের মোটাসোটা মানুষ। গায়ের রঙ কালো। কপাল মাথার দিকে উঠে গেছে অনেকটা। চোখ দুটো কুতকুতে, শয়তানের নজর যেন তাতে। চোখের নিচে চর্বির থাক। বেপরোয়া অত্যাচারের চিহ্ন। গলায় সোনার সরু চেন।
ছবির নিচেই রয়েছে প্রীতমের দাস্তান বা জীবনী। সেটা খুঁটিয়ে পড়লেন এসিজি। তারপর পাতা উলটালেন।
মুকেশ তেওয়ারি। বয়েস বোধহয় পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হবে। রোগা ফরসা চেহারা। চোখেমুখে ভীষণ পরিশ্রমের ছাপ। আর দৃষ্টিতে যেন একটা চাপা জেদ ফুটে বেরোচ্ছে।
ফটোর ওপরে একটা সিলমোহরের ছাপ দেখা যাচ্ছিল। সেটার কথা রঘুপতিকে জিজ্ঞাসা করতেই ও বলল, ‘মুকেশ তেওয়ারিই মারা গেছে গত পরশু। পাতা উলটালেই ওর ডেডবডির ফটো দেখতে পাবেন। এই তসবিরটা আমরা ওর পাসপোর্ট থেকে কপি করেছি।’
এরপর সুদেশ তেওয়ারি। বয়েসে দাদার চেয়ে অন্তত বছর আট-দশের ছোট। চুল খাটো করে ছাঁটা। সরু গোঁফ। চোয়ালের রেখা উদ্ধত। চোখের নজর দাদার মতোই।
ফটো দেখা শেষ করে অশোকচন্দ্র গুপ্ত বাকি রিপোর্টগুলোয় চোখ বোলাতে শুরু করলেন। তারপর হঠাৎই চোখ তুলে রঘুপতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নাঃ, তোমার ধৈর্য দেখছি নিতান্ত পলকা।’
রঘুপতি যাদব উশখুশ করছিল। একটু অস্বস্তিবোধ করল।
সেটা লক্ষ করে এসিজি বললেন, ‘ওকে রঘুপতি, তুমি গল্পটা বলে যাও। আমার কান মনোযোগ দিয়ে শুনছে।’
রঘুপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর আগের চেয়ে অনেক নরম গলায় এবং ধীরে-ধীরে বলতে শুরু করল, ‘খোঁজখবর নিয়ে যা জেনেছি বিজনেসের ব্যাপারে মাথা বলতে ছিল মুকেশ তেওয়ারিরই। সুদেশ প্রীতমের প্রায় সমান উমরের হওয়ার জন্যে দুজনে বেশিরভাগ সময়টাই ফুর্তিফার্তা করে কাটিয়ে দিত। এবারে বিজনেসের কোনও কনট্র্যাক্ট নিয়ে বোধহয় লাফড়া হয়েছিল। তাতে হোটেলের চাকর-বেয়ারা বহত হল্লাগুল্লা শুনেছে। মুকেশ তেওয়ারিই চিৎকার চেঁচামেচি করছিল বেশি। মাঝে-মধ্যে প্রীতম দাস চৌধুরি ওর গুসসা ঠান্ডা করার কোশিশ করছিল।’
এসিজি ফোল্ডারের কাগজ থেকে চোখ তুলে বললেন, ‘ঝগড়াটা হয় সন্ধে সাড়ে ছ’টায়?’
রঘুপতি বুঝল গুপ্তাসাব রিপোর্টটা ধেয়ান দিয়েই পড়ছেন। ও শুধু ঘাড় হেলাল। তারপর বলল, ‘সে যাই হোক, মুকেশ তেওয়ারি অনেক মেহনতের পর ঠান্ডা হয়। কিন্তু রাত সাড়ে বারোটার সময় সে মারা যায়। তখন ওর পাশের ঘরে বসে প্রীতম আর সুদেশ গল্প করছিল, আর ভিডিয়োতে কী একটা সিনেমা দেখছিল। হঠাৎই প্রীতম একটা শব্দ শুনতে পায় অন্তত স্টেটমেন্টে সেরকমই বলেছে। শব্দটা অনেকটা নাকি ধামাকার মতো। এই পটকা-ফটকা যেমন হয়। সুদেশ বলেছে, সে কিছু শুনতে পায়নি। অবশ্য বুঝতেই পারছেন, সে হয়তো ঠিক বহাল তবিয়তে ছিল না। চোখে রং ধরে গিয়েছিল। তা আওয়াজটা হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ওরা দুজনে ছুটে যায় পাশের ঘরে। দরজায় ধাক্কা দেয়, কিন্তু দরজা কেউ খোলে না। তখন প্রীতম চাবির ফুটোয় নজর দিয়ে দেখে। সুদেশকেও দেখায়। তারপর সুদেশকে বলে, চাবিটা ভেতর থেকে তালার গর্তে ঢোকানো রয়েছে। ইয়ানি অন্দর থেকে কেউ দরজা বন্ধ করে চাবি দিয়েছে। তারপর চাবিটা আর কেউ খুলে নেয়নি।’
এসিজি শব্দ করে ফোল্ডার বন্ধ করলেন। রেখে দিলেন পাশের টেবিলে। তাঁর মুখে-চোখে কৌতূহল ফুটে উঠল। কপালে চার-পাঁচটা ভাঁজ ফেলে বলে উঠলেন, ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং। তারপর তারপর?’
রঘুপতি যাদব গালে হাত ঘষল। ঠোঁট উলটে বলল, ‘তারপর আর কী, ধাক্কাধাক্কি করে সুদেশ যখন দরজা ভাঙতে যাবে তখন প্রীতম ওকে থামায়। একটা দারুণ মতলব দেয়। কোথা থেকে একটা অখবারের পাতা এনে তার অর্ধেকটা দরজার নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দেয় ভেতরে। তারপর একটা কাঠ দিয়ে চাবির ফুটোর ভেতরে খোঁচা দেয়। ভেতরের চাবিটা শব্দ করে পড়ে যায় নিচে। তখন অখবারের পাতাটা টেনে নিতেই চাবিটা বেরিয়ে আসে ঘরের বাইরে। সেটা নিয়ে প্রীতম নিজেই দরজার তালা খোলে। তারপর হুড়মুড় করে দু-মক্কেল একসাথ ঢুকে যায় ঘরের ভেতরে।’
অশোকচন্দ্র গুপ্ত হাসলেন। কফির কাপ নিয়ে চলে গেলেন ফ্লাস্কের কাছে। কফি ঢালতে-ঢালতে শিস দিয়ে উঠলেন। যেন কোনও পাখি ডাকছে। তারপর আবার ফিরে এলেন চেয়ারে, পরপর তিন-চার চুমুক দিলেন কাপে।
এসিজির আচরণ দেখে রঘুপতি যাদব থেমে গিয়েছিল। চোখ বড় করে বলে উঠল, ‘স্যার, ম্যায়নে কোই খুশিকি বাত সুনায়া কেয়া?’
‘বেশক, ইন্সপেক্টরসাব, বেশক। তবে তুমি থেমো না, প্লিজ কন্টিনিউ।’ এসিজির চোখে চাপা কৌতুক।
রঘুপতি আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘রাম কি লীলা রামহি জানে। তো যাই হোক, ওরা দুজনে ঘরে ঢুকে দ্যাখে মুকেশ তেওয়ারি বিছানার কাছে একটা চেয়ারে কাত হয়ে পড়ে আছে। ডাঁয়ে হাথে রিভলভার ঝুলছে। আর বুকের বাঁ দিকে গোলি কি নিশান। খতম। ব্যস। তখন প্রীতম দাস চৌধুরি তার দোস্ত সুদেশকে বলে মুকেশ তেওয়ারি সুইসাইড করেছে। বড়ি আফসোস কি বাত। তাতে সুদেশ তেওয়ারি হঠাৎই খেপে যায়। ও বলে, না, ওর দাদা খুন হয়েছে। তারপর ও ঘরের সবক’টা দরওয়াজা আর খিড়কি ভালো করে দেখে। লেকিন সব অন্দরসে বন্ধ। একদম ছিটকিনি লাগানো, গুপ্তাসাব। অন্য কোনও লোক যে মুকেশকে খুন করে হাতে রিভলভার সাজিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাবে তার কোনও উপায় নেই। কামরার দরওয়াজা-খিড়কি সব অন্দর থেকে পাক্কা বন্ধ ছিল। কিন্তু তাতেও সুদেশ তেওয়ারি বুঝতে চায় না। ও খালি বলে, আমার বড়াভাইকে কেউ সাজিশ করে খুন করেছে। সুইসাইড না-মুমকিন। ইমপসিবল।’
রঘুপতি একটু থামল। এসিজি কফি শেষ করে ফেলেছিলেন। কাপটা রেখে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দাদা খুন হয়েছে বলে সুদেশ তেওয়ারি গোঁ ধরে বসে আছে কেন?’
রঘুপতি হেসে বলল, ‘এইখানেই মজা, স্যার। সেদিন বিকেলে মুকেশ তেওয়ারি নাকি ভাইকে বলেছিল, আগামীকাল অর্থাৎ, গতকাল বেওসার কীসব হিসাবকিতাব নিয়ে বসবে। আজকাল হিসেবপত্তরে নাকি উলটা-সিধা গড়বড় দেখা যাচ্ছে। এর জন্যে মুকেশ পুরোপুরি প্রীতমকেই দায়ী করেছে। এ ছাড়া দু-ভাইয়ে মিলে কাল সকালে ওদের এক বুড়ি মওসিকে বড়বাজারে দেখতে যাবে প্ল্যান করেছিল। তারপর তো সাড়ে ছ’টায় কাজিয়া। আর সাড়ে বারোটায় মুকেশ তেওয়ারির খেল খতম। এই সব কারণেই সুদেশ কিছুতেই মানতে পারছে না ওর দাদা খুদকুশি মানে, সুইসাইড করেছে।’
রঘুপতি উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। হাত-পা নেড়েচেড়ে আড়মোড়া ভাঙল।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘রিভলভারটা কার?’
রঘুপতি ঘাড় ফিরিয়ে দেখল বৃদ্ধকে। বলল, ‘কার আবার, মুকেশ তেওয়ারির! রিপোর্টে লেখা আছে।’
‘গুলি কি ক্লোজ রেঞ্জ থেকে করা হয়েছিল? ব্যালিস্টিক রিপোর্ট কী বলছে?’
‘ক্লোজ রেঞ্জ। কোনও গোলমাল নেই। কিন্তু সুদেশ তেওয়ারি হইচই শুরু করে দিয়েছে। আর প্রীতম দাস চৌধুরির দাঁত বের করা হাসি আমি সইতে পারছি না। ষোলো আনা মোটিভ রয়েছে, কিন্তু কোনও সবুত নেই।’ বাঁ হাতের চেটোয় ডান হাতে ঘুষি মারল রঘুপতি যাদব। বলল, ‘শয়তানটাকে অন্দর করতে পারলে মউজ করে পালিশ লাগাব। কিন্তু…।’
‘আঃ, রঘুপতি।’ অশোকচন্দ্র স্নেহের সুরে ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুমি ঠান্ডা হয়ে বোসো দেখি। তোমাকে আমি প্রমাণ-টমান সব জোগাড় করার মতলব বাতলে দিচ্ছি।’
রঘুপতি যাদব চেয়ারে গিয়ে বসল বটে, কিন্তু তার মুখে অসন্তোষের ছোঁয়া লেগে রইল।
এসিজি বললেন, ‘সুদেশ কি গুলির আওয়াজ শুনেছিল?’
‘ও তো বলছে, না শোনেনি।’
‘হোটেলের আর কেউ কিছু শুনেছে?’
একটু ভেবে রঘুপতি বলল, ‘সুলেমান নামে এক বেয়ারা কসম খেয়ে বলছে রাত বারোটা নাগাদ ও একটা ধামাকার শব্দ শুনেছে। কিন্তু সন্ধের পর সুলেমান একটু-আধটু নেশা করে। তো কে জানে আসলি নকশা কী!’
এসিজি নড়েচড়ে বসলেন। সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন দু-বার। বললেন, ‘রঘুপতি তুমি ঠিকই বলেছ। মুকেশ তেওয়ারি খুন হয়েছে। আর, ওকে খুন করেছে প্রীতম দাস চৌধুরি।’
রঘুপতি যাদব শিরদাঁড়া টানটান করে বসল। জিজ্ঞাসা করল, ‘লেকিন ক্যায়সে, স্যার? দরওয়াজা-খিড়কি সব তো অন্দরসে বনধ ছিল!’
এসিজি হেসে বললেন : ‘সেটাই তো বন্ধ ঘরের রহস্যের মজা, রঘুপতি। তবে এটুকু তোমাকে বলে রাখি, মুকেশ তেওয়ারিকে গুলি করা হয়েছে বারোটা নাগাদ। তোমার সুলেমানের কথাই বোধহয় ঠিক। খোঁজ করে দেখো, ওই সময়ে প্রীতম দাস চৌধুরি বন্ধুবর সুদেশকে ছেড়ে কিছুক্ষণের জন্যে উধাও হয়েছিল কিনা। তা ছাড়া আমার ধারণা, গুলি করার সময়ে সে হয়তো রিভলভারের মুখে চাদর-টাদর কিছু চাপা দিয়ে থাকবে। তাতে গুলির আওয়াজটা অনেক ভোঁতা শোনাবে। তোমার কাজ হবে সেই দাগি চাদরটা উদ্ধার করা। হয় ওটা হোটেলের স্টোররুমে আছে, নইলে প্রীতম গুঁজে দিয়েছে কোনও উনুনে।’
রঘুপতি অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, ‘খুন করার পরে ও কী করল। সেটা ভি বলুন।’
‘বলছি।’ এসিজি একটু দম নিয়ে বললেন, ‘ঘরের জানলাগুলো ঝটপট বন্ধ করে দিল প্রীতম। তারপর দরজার ভেতর দিকের চাবির গর্তে এমন একটা চাবি ঢুকিয়ে দিল যার মাথাটাই কাটা। অর্থাৎ, তালা খোলার জন্যে চাবির যে-অংশটা সবচেয়ে জরুরি সেইটুকুই কেটে বাদ দেওয়া। এই অকেজো চাবিটা দরজার ভেতর দিকে লাগিয়ে প্রীতম বাইরে এসে দরজা টেনে দরজা লক করে দেয় বাইরে থেকেই। হোটেলের মালিক হওয়ার সুবাদে প্রীতমের কাছে মুকেশের ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি নিশ্চয়ই ছিল।’
‘সে যাই হোক, জলদি কাজ সেরে প্রীতম ফিরে এল সুদেশের কাছে। এসে এতক্ষণ গরহাজির থাকার জন্যে যা হোক একটা বাহানা শোনাল। তারপর সাড়ে বারোটা নাগাদ মিথ্যে বলল যে, সে একটা তোমার ভাষায়, ধামাকার শব্দ শুনতে পেয়েছে। তখন সে জোর করেই সুদেশকে সঙ্গে নিয়ে মুকেশের ঘরের দরজায় হাজির হয়। ওকে সাক্ষী মানার জন্যে ভেতর দিকে লাগানো অকেজো চাবিটা ওকে দেখায়। এমনিতে ওরকম ভাবে তালায় চাবি ঢোকানো থাকলে বাইরে থেকে চাবি ঢুকিয়ে দরজা খোলা মুশকিল। তাই প্রীতম খবরের কাগজ পেতে কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে অত সব কাণ্ড করেছে।’
এসিজি থামতেই রঘুপতি বলল, ‘কিন্তু যে-চাবিটা অখবারের পাতা দিয়ে প্রীতম বাইরে বের করে নিয়ে এল সেটা তো ফালতু! তা হলে ওই চাবি দিয়ে দরজা খুলে গেল কী করে, স্যার?’
হাসলেন এসিজি। বললেন, ‘একে বাংলায় বলে হাতসাফাই, রঘুপতি। সুদেশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঘরের ভেতর থেকে এত কষ্ট করে বের করে আনা অকেজো চাবিটা বোধহয় আসল চাবির সঙ্গে পালটে নিয়েছিল প্রীতম। আসল চাবিটা ওর পকেটেই ছিল হয়তো। ব্যস, তারপর আর কী!’
রঘুপতি উঠে দাঁড়াল। ঝুঁকে পড়ে ফোল্ডারটা তুলে নিল টেবিল থেকে।
অশোকচন্দ্র গুপ্তও উঠে দাঁড়ালেন। হাতে হাত ঘষে বললেন, ‘রঘুপতি, এবারে কী-কী জিনিস খুঁজে বের করতে হবে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ? তার মধ্যে আসল হচ্ছে ওই মাথা কাটা চাবিটা। আর খোঁজ করে দ্যাখো, কোনও চাবিওয়ালা সেইদিন সন্ধেবেলা ”মুসাফির” হোটেলে এসেছিল কিনা। অবশ্য চাবি কাটাকাটির কাজটা প্রীতম দাস চৌধুরি নিজেও করে থাকতে পারে। সাড়ে ছ’টা থেকে বারোটা, অন্তত সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময়। পেয়েছিল লোকটা।’
‘থ্যাংক য়ু, স্যার,’ বলে বড়-বড় পা ফেলে চলে যাচ্ছিল রঘুপতি, ওকে থামালেন এসিজি।
‘একটা কথা, রঘুপতি। আমি তো শুধু, থিয়োরি বাতলে দিলাম। বাস্তবে সেটা কতটা মিলবে জানি না। কে জানে, প্রীতম দাস চৌধুরি হয়তো সত্যিই মুকেশ তেওয়ারিকে খুন করেনি…।’
রঘুপতি হেসে বলল, ‘সে ভার আপনি আমার ওপরে ছেড়ে দিন। কালই আপনাকে ফোন করে থিয়োরির রেজাল্ট জানিয়ে দিতে পারব বলে মনে হয়। লেকিন, গুপ্তাসাব, কী করে আপনি এই থিয়োরির আইডিয়া পেলেন? ইট ইজ একসিলেন্ট।’
অশোকচন্দ্র চুলের গোছায় টান মারলেন। হেসে বললেন, ‘জন ডিকসন কার, রঘুপতি, জন ডিকসন কার। এই ভদ্রলোক জন ডিকসন কার আর কার্টার ডিকসন, এই দুটো নামে সারাটা জীবন শুধু বন্ধ ঘরের রহস্য আর অসম্ভব সমস্যা নিয়ে কিতাব লিখে গেছেন। সুতরাং, যখনই আমি কোনও ক্লোজড রুম প্রবলেম পাই তখনই জন ডিকসন কারের মতো করে ভাবতে চেষ্টা করি। তবে সব সময় যে পারি তা নয়…।’
রঘুপতি হেসে বলল, ‘আপনাকে বিনয় মানায় না। জন ডিকসন কারের চেয়েও আপনি জাদা অকলমন্দ। এগেইন আ বিগ থ্যাংকস, স্যার। গুড বাই।’
রঘুপতি যাদব চলে গেল হনহনিয়ে। অশোকচন্দ্র আবার টেপরেকর্ডারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। টেপ চালু করলেন। নাম-না-জানা পাখিরা আবার মিষ্টি সুরে ডাকতে শুরু করল। এসিজি তখন জানলা দিয়ে বাইরের রোদ দেখছিলেন।