নীল রঙের মশারি
এ ঘটনা কাউকে কখনও বলিনি। কিন্তু এই পাঁচবছর ধরে ব্যাপারটা বুকে চেপে রেখে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। মনে হচ্ছে, এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব। যদি যাই, তা হলে এ ঘটনা আর কেউ কখনও জানতে পারবে না। আর আমিও আপনাদের কাছে বিচার চাইতে পারব না। বলতে পারব না, ‘সব তো শুনলেন। এবারে আপনারই বলুন, আমি কোনও অন্যায় করেছি কি না। আমার বন্ধু রোহনকে আমি সত্যি-সত্যিই খুন করেছি কি না। ওকে আমি…।’
নাঃ, আর পারছি না। কেন যেন মনে হচ্ছে, এটাই আমার শেষ সুযোগ। এখন এ কাহিনি না শোনালে পরে আর কখনও—।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল একটা নীল রঙের মশারি দিয়ে। সস্তায় এই মশারিটা আমি কিনতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাও আমার জন্যে নয়—রোহনের জন্যে। রোহনের চামড়া নাকি প্রজাপতির মতো নরম-সরম। আর আমারটা নাকি গন্ডারের। তাই মশার কামড় আমি গায়ে না মাখলেও রোহন সেটা একেবারে সহ্য করতে পারে না।
চিড়িয়ামোড়ের কাছাকাছি একটা পুরোনো বাড়িতে দুটো ছোট-ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে আমি থাকি। ভাড়া নিয়েছিলাম সেই ছাত্রজীবনে—আর এখন চাকরিজীবনে পৌঁছে গেছি। তাই আজকের আগুন বাজারেও ভাড়াটা বেশ কমসমই রয়ে গেছে।
আমার ঘর দুটো পাশাপাশি, দোতলায়। বহুদিন ধরে ওদের দেওয়ালে রং পড়েনি। জায়গায়-জায়গায় নোনা ধরে পলেস্তারা ফেঁপে গেছে।
দুটো ঘরেরই পেছনদিকের দেওয়ালে লোহার গরাদ বসানো একজোড়া ছোট-ছোট জানলা। জানলা দিয়ে তাকালে ফ্রি-তে প্রকৃতি দেখা যায়।
প্রকৃতি বলতে একটা বিশাল পুকুর—তার বেশিরভাগটাই শ্যাওলার সবুজ গুঁড়োয় ঢাকা। তার পাড়ে বড়-বড় নারকোল গাছ—সবসময়েই বাতাসে মাথা নাড়ছে। এ ছাড়া আমার ঘরের খুব কাছাকাছি একটা প্রকাণ্ড আমগাছ। গরমের সময়ে ছেলেছোকরারা তার ডালে-ডালে হনুমানের মতো দাপাদাপি করে।
গাছগুলোর আশপাশ দিয়ে তাকালে আকাশ দেখতে পাই। আর বেশ কয়েকটা রঙিন পাখি রোজ ফ্রি-তে দেখা দেয়।
আমার ঘরজোড়ায় মশা আছে বটে তবে তেমন মারাত্মক কিছু নয়। তা ছাড়া ওরা তো ওই ফ্রি প্রকৃতিরই একটা পার্ট!
আমার বাপি মাঝে-মাঝে কলকাতায় কাজে এলে আমার কাছেই থাকে। মশার কামড় খেয়ে দু-চারবার আমার কাছে কমপ্লেইন করেছে বটে, কিন্তু আমি তেমন গা করিনি। আবার দেড়শো-দুশো টাকা খরচ করব! বাপিকে বুঝিয়েছি, ‘এক-দুটো রাতের তো ব্যাপার! কয়েল জ্বেলে চাদর মুড়ি দিয়ে ম্যানেজ করে নাও।’
কিন্তু রোহন অন্য জিনিস। ও ম্যানেজ করতে নারাজ। ও শিলিগুড়ির কোন একটা ফার্মে ঢুকেছে। সেখান থেকে অডিটের কাজে প্রায়ই ওকে কলকাতায় পাঠায়। আর এসে ও আমার আস্তানাতেই ওঠে। তারপর কাজ মিটে গেলে কেটে পড়ে।
আমার দু-ঘরে দুটো সস্তার তক্তাপোশ আছে। তার ওপরে বিছানা-বিছানা ভাবওয়ালা যে-লেয়ার দুটি পাতা আছে তাকে টোস্টে মাখানো মাখনের লেয়ারের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তবে থিকনেস ওই মাখনের মতো হলেও সফটনেস তার মতো নয়। এ নিয়েও রোহনের কাছে আমাকে কথা শুনতে হয়। সত্যিই, ও খলিফা জিনিস!
তো ওর উৎপাতেই মশারিটা কিনেছিলাম এবং দামটা শেয়ার করার জন্যে ও জোর করে একশোটা টাকাও আমার হাতে আগাম গুঁজে দিয়েছিল।
মশারিটা শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের একটা দোকান থেকে কিনেছিলাম। দোকানে অনেক মশারি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার পর বিরক্ত এবং ক্লান্ত দোকানদার তার কোনও গুপ্ত কোটর থেকে এই নীল রঙের মশারিটা বের করে নিয়ে আসেন।
মশারিটার রং বেশ উজ্জ্বল নীল। সাধারণত এই রঙের মশারি চোখে পড়ে না। আর তার কাপড়টাও দারুণ—রেশম-রেশম ভাব।
ভাবছিলাম দাম বোধহয় অনেক হবে। কিন্তু দোকানদার ভদ্রলোক, কী জানি কেন, মাত্র একশো পঁচিশ টাকায় ওটা আমাকে গছিয়ে দিলেন। বললেন, ‘এরকম জিনিস আর পাবেন না। কম দামে কেনা, তাই মিনিমাম লাভে ছেড়ে দিলাম—।’
তো ওই মিনিমাম লাভে কেনা মশারিটা থেকেই ম্যাক্সিমাম গোলমালের শুরু।
প্রথম রাতে কোনও প্রবলেম হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় রাতে ব্যাপারস্যাপার দাঁড়াল অন্যরকম।
রাতে কোনও একসময় ঘুম ভেঙে গেল। বাথরুম যেতে হবে। আমাদের এজমালি বাথরুম একতলায়। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে সরু করিডর ধরে ঘুমচোখে পা ফেলে এগোচ্ছি, নজরে পড়ল আমার পাশের ঘরটার দরজার একটা পাল্লা খোলা।
ঘুম চটকে গেল পলকে। রাতে আমি ঘরটায় তালা দিই না, তবে বাইরে থেকে দরজা টেনে হাঁসকল লাগিয়ে দিই। কিন্তু সেটা তো নিজে থেকে আর খুলতে পারে না!
তা হলে কি চোর ঢুকল ঘরে?
কিন্তু ঘরে তো চুরি করার মতো বিশেষ কিছু নেই। তা ছাড়া এই বাড়িটার দোতলায় আমি একা থাকলেও একতলায় চারঘর ভাড়াটে রয়েছে। দোতলায় কাউকে আসতে হলে সেই ঘরগুলো পেরিয়ে আসতে হবে। সেটা চোরছ্যাঁচোড়ের পক্ষে যথেষ্ট ঝুঁকির ব্যাপার। তাই আমার দোতলাটা সবসময়েই নিরিবিলি এবং নিরাপদ।
এ বাড়ির করিডর বা সিঁড়িতে কোনও আলো নেই। কিন্তু তাতে আমার কোনও অসুবিধে হয় না। রাস্তার লাইট বা অন্যান্য ঘর থেকে ছিটকে আসা আলোয় দিব্যি কাজ চলে যায়। আর আকাশে চাঁদ থাকলে খানিকটা বাড়তি সুবিধে পাওয়া যায়। তা ছাড়া এতবছর এ বাড়িতে থেকে এর করিডর বা সিঁড়ির প্রতিটি ভাঁজ আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। তাই রাতে বাথরুমে যাওয়ার সময় কোনওকালেই আমি টর্চ ব্যবহার করি না।
প্রথমে ভাবলাম, চিৎকার করে লোক জড়ো করি। কিন্তু তার পরই মনে হল, এ-পাড়ার চুরি-টুরির সেরকম ট্রাডিশান নেই। শেষে যদি দেখা যায় চোর-টোর কিছু নয়, তা হলে ব্যাপারটা বিতিকিচ্ছিরি হাস্যকর এপিসোড হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং একটিবার দরজার পাশ থেকে উঁকি মেরে দেখি।
পা টিপে-টিপে দরজার খুব কাছে এগিয়ে গেলাম। দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে খোলা পাল্লা দিয়ে উঁকি মারলাম ঘরের ভেতরে। এবং যা দেখলাম তাতে ব্যাপার স্যাপার আমার পছন্দ হল না।
প্রথম কথা, সিলিংফ্যান ঘোরার শব্দ আমি শুনতে পেলাম। আর দেখলাম, ঘরের জানলা দুটো খোলা। খোলা জানলা দিয়ে অন্ধকার গাছের ডালপালা আর খানিকটা আকাশ দেখা যাচ্ছে। বাইরের বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে।
অথচ রোজ রাতে আমি ঝড়-বৃষ্টির ভয়ে জানলা দুটো নিজের হাতে ছিটকিনি এঁটে বন্ধ করি। কাল রাতেও করেছি।
জানলা দুটো এমন হাট করে খুলল কে? আশ্চর্য! কোনও চোর নিশ্চয়ই এ কাজ করবে না!
মশারিটা কে যেন দড়ি দিয়ে তক্তাপোশের ওপরে দিব্যি টাঙিয়ে দিয়েছে। আর মশারির ধারগুলো পরিপাটি করে পাতলা তোশকের নীচে গুঁজে দিয়েছে। জানলা দিয়ে ছুটে আসা বাতাস আর সিলিংফ্যানের হাওয়ার মশারির নীল কাপড়ে তিরতিরে ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
মশারিটা আমি মোটেই টাঙাইনি। ওটা ভাঁজ করে ঘরের একপাশে দাঁড় করানো একটা ছোট টেবিলে রেখেছিলাম। তা হলে…।
খুব দ্রুত চিন্তা করছিলাম। যুক্তি দিয়ে ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলাম। তাতে যেটা মনে হল, নিশ্চয়ই বাপি কিংবা রোহন কাল গভীর রাতে আচমকা এ-বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। নীচের ভাড়াটেরা ওদের চেনে—তাই দোতলায় উঠে আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি। তারপর আমাকে অযথা ডেকে ঘুম না ভাঙিয়ে চুপচাপ তক্তপোশে শুয়ে পড়েছে। এবং টেবিলের ওপরে নতুন মশারিটা দেখে বিনা দ্বিধায় সেটা কাজে লাগিয়েছে।
কিন্তু কে এই রাতের কুটুম্ব? বাপি, না রোহন?
এবার ঘরের ভেতরে পা রাখলাম আমি। সুইচ টিপে আলো জ্বালালাম। একইসঙ্গে ডেকে উঠলাম, ‘কে, বাপি?’
কোনও সাড়া নেই।
আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়েই মশারির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আলো জ্বালার ফলে মশারির নীল রঙের ঘন বুনট পেরিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না। তবে আবছা একটা আভাস মতন পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন মশারির ভেতরে কেউ শুয়ে আছে।
আমি আবার ডেকে উঠলাম, ‘কে, রোহন?’
এবারে আগের চেয়ে জোরে ডেকেছি, কিন্তু তাও কেউ উত্তর দিল না। কিংবা ঘুমের ঘোরে ডাক শুনতে পেল না।
ভৌতিক কিংবা অলৌকিকে আমার ছিটেফোঁটাও বিশ্বাস নেই। অন্তত কোনওকালে ছিল না। কিন্তু এখন যে একটু গা-ছমছম করছিল না তা নয়।
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
খোলা জানলা দিয়ে বাতাস ঢুকছিল। আমগাছের পাতা খসখস শব্দ তুলছিল। আমার মনে হচ্ছিল, মশারিটা যেন একটা প্রাণী—থম মেরে কীসের জন্যে যেন অপেক্ষা করছে।
আমি আবার বাপি আর রোহনের নাম ধরে ডাকলাম। তারপর আর একবার।
মশারি তবুও চুপচাপ। মশার পিনপিন শব্দ কানে এল। আমি একদৃষ্টে মশারিটার দিকে তাকিয়ে। মশারিটাও মনে হল ওর অদৃশ্য চোখ দিয়ে আমাকে দেখছে।
কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর টের পাচ্ছিলাম, আমার কপাল, গলা, ঘাড় ঘেমে উঠেছে।
আমি টেনশানে আর থাকতে পারলাম না। হঠাৎই দুঃসাহসের একটা ঝটকা খেলে গেল আমার মাথায়। সেই ঝটকায় ক্ষিপ্ত পাগলের মতো ছুটে গেলাম মশারিটার দিকে। হ্যাঁচকা টানে মশারিটা তুলে ধরলাম শূন্যে। টানাহ্যাঁচড়ায় একটা দড়ি পট করে ছিঁড়ে গেল। আর দলাপাকানো মশারিটা খামচে ধরে আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
কারণ, মশারির ভেতরে কেউ নেই। বিছানা শূন্য!
অবাক চোখে বিছানার দিকে তাকিয়ে যখন এই মাঝরাতের হেঁয়ালির উত্তর ভাবছি, তখন হঠাৎই নাকে একটা গন্ধ পেলাম।
গন্ধটা অনেকটা যেন হালকা ঘামের গন্ধ।
একইসঙ্গে বিছানায় হাত দিয়ে সামান্য উষ্ণতা টের পেলাম। যেন বিছানায় এতক্ষণ ধরে কেউ শুয়ে ছিল—এইমাত্র উঠে চলে গেছে।
মাথার বালিশের দিকে তাকিয়েও যেন মাথার গোল ছাপের একটা আদল চোখে পড়ল। বালিশের কাছে ঝুঁকে পড়ে জোরে শ্বাস টানলাম। নারকোল তেলের গন্ধ নাকে ভেসে এল।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কপালে গলায় হাত বুলিয়ে ঘাম মুছলাম।
ভূত-প্রেত কিছুই দেখিনি অথচ তাও আমি এত ভয় পাচ্ছি কেন? হতে তো পারে, রোহন কিংবা বাপি সত্যিই হয়তো এসেছে—তারপর উঠে বাথরুমে গেছে।
নিজেকে ভুল বোঝানোর চেষ্টায় আমার ভেতরে একটা লড়াই চলছিল। বেশ বুঝতে পারছিলাম, যুক্তি ক্রমশ হেরে যাচ্ছে কুসংস্কারের কাছে।
একটু পরে আমি মশারিটা ফেলে দিলাম বিছানায়। মনে সাহস জড়ো করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। করিডর ধরে এগোলাম বাথরুমের দিকে।
কিন্তু যা আন্দাজ করছিলাম তাই।
বাথরুমে কেউ নেই—না বাপি, না রোহন।
সুতরাং বাথরুম সেরে আবার উঠে এলাম দোতলায়। খোলা দরজা দিয়ে উঁকি মারলাম।
ঘরের অবস্থা একইরকম: টিউবলাইট একইভাবে জ্বলছে, সিলিংফ্যানে চলছে, মশারিটাও পড়ে আছে বিছানায়।
বিরক্তির একটা শব্দ করে ঘরের আলো-পাখা নিভিয়ে দিলাম। দরজার পাল্লা টেনে দিয়ে হাঁসকল লাগিয়ে দিলাম আবার।
নিজের ঘরে ফিরে এসে অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে মশারিটার কথা ভাবতে লাগলাম। কিন্তু কিছুতেই একটা সহজ-স্বাভবিক ব্যাখ্যা দাঁড় করতে পারলাম না।
পরপর তিনদিন—কিংবা বলা ভালো তিনরাত্তির—বেশ নিশ্চিন্তে কাটল। মাঝরাতে উঠে পাশের ঘরের হাঁসকল খুলে দেখেছি কোনও ‘অলৌকিক’ ব্যাপার নেই। জানলা দুটো দিব্যি বন্ধ। এবং মশারিটা ‘ভালো ছেলে’-র মতো টেবিলের ওপরে ভাঁজ করা অবস্থায় ‘শুয়ে’ আছে।
তখন মনে হল, সেদিন রাতে যা দেখেছি সেটা আমার মনের ভুল নয় তো? হয়তো ভাবছিলাম, রোহন কিংবা বাপি হঠাৎ করে কলকাতায় চলে আসতে পারে। মশারিটা টাঙিয়ে দিলে আর ওদের মশার কামড় খেতে হবে না। হয়তো আধোঘুমে এসব নিয়েই স্বপ্ন দেখছিলাম। তারপর স্বপ্নের ঘোরে পাশের ঘরের দরজা খুলে ওসব ভুলভাল জিনিস দেখেছি। হয়তো আমি সে-রাতে ঘোরতর ভাবে ‘ঘুমিয়ে চলা’-র অসুখে পড়েছিলাম।
এসব ভেবে-ভেবে শেষ পর্যন্ত মেনে নিলাম যে, আমি সে-রাতে ভুলই দেখেছি। তাই চারনম্বর রাত্তিরে বেশ নিশ্চিন্ত মনে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
কিন্তু সেদিন রাতে যা দেখলাম সেটা বিশ্বাস করা বেশ কঠিন।
বাথরুমে যাওয়ার জন্যে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। করিডরে এসে পাশের ঘরের দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালাম। কান পেতে ঠাহর করার চেষ্টা করলাম।
হ্যাঁ—সিলিংফ্যানটা ঘুরছে। পুরোনো পাখার কিচকিচ শব্দ শোনা যাচ্ছে।
তাড়াতাড়ি হাঁসকল খুল দরজার পাল্লা ঠেলে দিলাম ভেতরে।
নীল মশারিটা তক্তপোশে পরিপাটি করে টাঙানো রয়েছে। মশারির ওপাশে জানলা দুটো খোলা। জানলা দিয়ে ঢুকে পড়া বাতাসে এবং সিলিংফ্যানের হাওয়ায় মশারির কাপড় নড়ছে, দুলছে।
দৃশ্যটা দেখামাত্রই আমি সেদিনের মতো হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে দিলাম। দুবার ঝিলিক মেরে টিউবলাইট জ্বলে উঠল।
আর তখনই মনে হল, দরজার হাঁসকল তো বাইরে থেকে বন্ধ ছিল! তা হলে কেউ ভেতরে ঢুকে মশারিই-বা টাঙাল কী করে, আর পাখাই-বা চালাল কী করে?
একটা ঠান্ডা ভয় আমাকে জাপটে ধরল। মনে হল, ঘরের বাতাস কমে গেছে—আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আলো জ্বালার জন্যে মশারির ভেতরটা দেখা যাচ্ছিল না। তা ছাড়া বাতাসে মশারির কাপড়ে ঢেউ খেলছিল বলে দেখতে আরও অসুবিধে হচ্ছিল।
হঠাৎই আমার মনে হল, মশারির ভেতরে কেউ যেন নড়ছে। কারণ, কোনও শব্দ-টব্দ না হলেও মশারিটা জায়গায়-জায়গায় ফুলে উঠছিল। মানে, কারও মাথা কিংবা হাত-টাতের আদল বোঝা যাচ্ছিল। যেন মশারির ভেতর থেকে কেউ আমাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করছে, অথবা মশারির দেওয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
আমি একেবারে পাথর হয়ে গেলাম। অবাক ভয়ের চোখে সেই অপার্থিব দৃশ্যের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। আমার কপাল থেকে ঘামের ফোঁটা যে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সেটা অনুভবে টের পেলাম।
হঠাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের ফোঁস-ফোঁস শব্দ কানে এল। শব্দটা এমন, যেন কেউ হাঁপাচ্ছে।
স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, শব্দটা আসছে মশারির ভেতর থেকেই।
কিন্তু কে রয়েছে মশারির ভেতরে? মশারির ভেতর থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারছে না কেন?
জানি, অবাস্তব চিন্তা, কিন্তু তবুও—অকূলপাথারে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো—আমি রোহন আর বাপির নাম ধরে ডেকে উঠলাম। কিন্তু যে-কণ্ঠস্বর আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল সেটা আমার কাছেই অচেনা ঠেকল।
‘রোহন!…বাপি!’
কোনও সাড়া নেই। তবে শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
‘রোহন! রোহন!’ এবারে বেশ জোরে ডেকেছি: ‘বাপি! বাপি!…বাপি!’
কিন্তু এবারেও কোনও সাড়া নেই। শুধু ভারী শ্বাস-প্রশ্বাস।
গলা পর্যন্ত ভয়ে টইটম্বুর অবস্থাতেও আমার মধ্যে কী করে যেন একটা মরিয়া ঝোঁক ঝলসে উঠল। মনে হল, মশারিটাই আমার চিরশত্রু। ওটাই বড়-বড় নিশ্বাস ফেলছে।
সঙ্গে-সঙ্গে পাগলের মতো ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম মশারিটার ওপরে। পটপট করে মশারি টাঙানোর দুটো দড়ি ছিঁড়ে গেল। আর আমি শূন্য মশারি বুকে নিয়ে তক্তপোশে আছড়ে পড়লাম।
তারপর পাগলের মতো মশারিটাকে হাতড়াতে লাগলাম। কারও অস্তিত্বের খোঁজে চাপড় মেরে থাপড়ে-থাপড়ে দেখতে লাগলাম ওটার নানান জায়গায়।
কিন্তু কোনও লাভ হল না। কেউ নেই।
এক প্রবল আক্রোশে মশারিটা টান মেরে বিছানা থেকে ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর দলাপাকানো মশারিটা হাতে নিয়ে শূন্য বিছানার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
কেউ কোত্থাও নেই।
শুধু আগের দিনের মতো বালিশে কারও মাথার ছাঁচ চোখে পড়ল। নাকে এল ঘামের গন্ধ। আর বিছানায় হাত রেখে মনে হল যেন বাড়তি উষ্ণতা টের পেলাম।
ভয়ে স্পঞ্জের মতো ফোঁপরা হয়ে গেলাম এবং তার ফাঁকফোকরে ঠান্ডা ভয়ের স্রোত ঢুকে গেল।
আমি বিছানায় বসে পড়লাম। বারবার খোলা জানলা আর দরজার দিকে তাকাতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল, কেউ বুঝি আমাকে ফাঁকি দিয়ে কোনওরকমে ওই জানলা কিংবা দরজা দিয়ে সটকে পড়েছে—আবার এক্ষুনি হয়তো আচমকা ফিরে আসবে ঘরে।
যদি সত্যিই আসে?
ভয়ে ঘামতে শুরু করলাম।
মশারিটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে বিছানা ছেড়ে আচমকা ছুট লাগালাম দরজার দিকে। চটপট আলো-পাখার সুইচ অফ করে দরজা টেনে বন্ধ করে দিলাম। তারপর হাঁসকল লাগিয়ে দিয়ে সোজা নিজের ঘরে। ঘরের আলো জ্বেলে সেই অবস্থাতেই শুয়ে পড়লাম বিছানায়।
ভয়ে সারা রাত একফোঁটাও ঘুম এল না। মাথাটা অসহ্য যন্ত্রণায় দপদপ করতে লাগল। কানে তখনও ভেসে আসছে ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ।
মনে-মনে ঠিক করলাম, কালই মশারিটাকে আগুনে পুড়িয়ে ‘খতম’ করব। এবং এই ‘অন্ত্যেষ্টি’-র কাজটা রাতের অন্ধকারে তিনতলার ছাদে কিংবা পুকুরপাড়ে গিয়েই সারতে হবে।
তখনও জানি না, আগামীকাল আমার কী কাল হবে!
সকাল ন’টা নাগাদ রোহন হইহই করে এসে আমার ঘরে ঢুকল। কিন্তু তার অনেক আগেই মশারিটার এককোণে শুকনো রক্তের দাগটা আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি।
আজ সকালে কষ্ট করে আর ঘুম থেকে উঠতে হয়নি—যেহেতু সারাটা রাত বলতে গেলে জেগেই ছিলাম।
সকালে হাত-মুখ ধুয়ে নমো-নমো করে চা-বিস্কুট খেয়ে সোজা চলে গেছি পাশের ঘরে।
মশারিটা অগোছালোভাবে মেঝেতে পড়ে ছিল। ওটা তুলে নিয়ে বিছানায় বসলাম। এই বস্তুটার মধ্যে কোন অলৌকিক ব্যাপার লুকিয়ে আছে সেটা আমি আজ তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখতে চাই।
জানলা দুটো খোলাই ছিল। সেদিকে তাকালে চোখে পড়ছে সকালের রোদ, গাছের সবুজ পাতা, পুকুরের জল, দু-চারটে পাখি। এসব দেখে মনেই হয় না পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু থাকতে পারে। কাল রাতে এ-ঘরে ঢুকে যেসব কাণ্ডকারখানা দেখেছি সেগুলোও আর সত্যি বলে মানতে মন চায় না।
সুতরাং বেশ হালকা মন নিয়েই মশারি পরীক্ষার কাজ শুরু করেছিলাম, এবং মনে-মনে যেন ধরেই নিয়েছিলাম শত পরীক্ষা করেও তেমন কিছু পাওয়া যাবে না।
কিন্তু পেলাম।
মশারিটার এক কোণে ভাঁজের আড়ালে একটা দাগ দেখতে পেলাম। দাগটা মাপে একটাকার কয়েনের চেয়ে বেশ খানিকটা বড়। রং কালচে লাল।
দাগটার ওপরে আলতো করে আঙুল বোলাতেই আমার গোটা শরীর শিরশির করে উঠল। মনে হল যেন জ্যান্ত সাপের গায়ে হাত দিয়েছি।
চট করে আঙুল সরিয়ে নিলাম।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মনে সাহস এনে দাগটা ধীরে-ধীরে নিয়ে এলাম নাকের কাছে। মাথা ঝুঁকিয়ে গন্ধ শুঁকলাম।
মনে হল যেন আবছা আঁশটে গন্ধ পেলাম।
তখন সবমিলিয়ে উত্তর বেরোল একটাই—দাগটা রক্তের দাগ।
কিন্তু এখানে রক্ত এল কোথা থেকে? এ কী মশার পেটের রক্ত?
প্রশ্নটা মনে জেগে উঠতেই হাসি পেয়ে গেল আমার। অন্তত কয়েকশো রক্তচোষা মশা মারলে পর এরকম মাপের একটা রক্তের দাগ তৈরি হতে পারে। সুতরাং, আমি যা ভাবছি তাই। দাগটা রক্তের—তবে মশার নয়।
দোকান থেকে মশারিটা কেনার সময় এই দাগটা আমার চোখে পড়েনি। পড়লে বোধহয় ভালোই হত। মশারিটা কিনে এভাবে হেনস্থা হতে হত না।
এরপর রোজকার কাজ শুরু করলাম বটে কিন্তু রক্তের দাগের ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে গেল না! তখনও জানি না, রোহন হুট করে এসে হাজির হবে।
ন’টার কাছাকাছি বাইরে থেকে রোহনের ডাক শুনতে পেলাম।
‘পেরো! পেরো—!’ বলে ডাকতে-ডাকতে রোহন দোতলায় উঠে এল। তারপর সটান ঢুকে পড়ল আমার ঘরে।
ঢুকেই একটা চেয়ার দখল করে বসে পড়ল রোহন। লম্বা হাঁপ ছেড়ে বলল, ‘পেরো, শোন, এই খেপে তিনদিন থাকব। শালা, এই চাকরিটা করে লাইফ হেল হয়ে গেল। আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।’
কথা শেষ করেই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল ও। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দে, দে, আগুন দে—।’
রোহন এইরকমই। ভীষণ মুডি। আমার নাম পরিমল—ডাকনাম পরি। কিন্তু রোহন সেই ছোটবেলা থেকেই আমাকে ‘পেরো’ বলে ডাকে। আমার এতে আপত্তি ছিল, কিন্তু রোহন পাত্তা দেয়নি। এক তুড়িতে সব আপত্তি উড়িয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে ওই পেরোর গেরো আমার কপালে গেঁথে গেছে।
একটা ড্রয়ার থেকে লাইটার বের করে রোহনকে দিলাম। ও ফস করে আগুন জ্বেলে সিগারেট ধরাল। সিগারেটের টান মারতে-মারতে লাইটারটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিল।
কয়েকসেকেন্ড পরই ও হুকুমের ঢঙে বলল, ‘এক গ্লাস জল খাওয়া। তারপর তোর হাতের তৈরি ফার্স্টক্লাস চা—।’
আমি ঘরের এককোণে গিয়ে প্লাস্টিকের বোতল থেকে একটা গ্লাসে জল ঢালতে লাগলাম। রোহন আবার সরাসরি বোতল থেকে জল খেতে পারে না। ওর কিছু খুচরো বাবুয়ানি আছে।
রোহন আমার ছোটবেলার বন্ধু হলেও ওর সঙ্গে আমার কোনও তুলনা হয় না। কোথায় ও, আর কোথায় আমি!
রোহন পড়াশোনার বরাবর একনম্বর। আর আমি যে কত নম্বর সেটা স্রেফ ভুলেই গেছি।
ও দেখতে সুন্দর। ফরসা। মাথায় কোঁকড়া চুল। চিবুকের ডানদিকে ছোট্ট তিল—বিউটি স্পট। শক্তপোক্ত চেহারা। মাথায় বেশ লম্বা। তা ছাড়া দারুণ চাকরি করে।
আর আমি? রোগা, কালো। হাইট মাঝারি। বুদ্ধিও তাই। সেইসঙ্গে চাকরিটাও।
সত্যি, মাঝে-মাঝে রোহনকে আমার হিংসে হয়। ওকে দেখলেই আমি কেমন একটা কমপ্লেক্সে ভুগি। বন্ধু হলেও ওর সামনে আমি যেন ঠিক সহজ হতে পারি না। ও আমাকে যখনই কিছু বলে, তার মধ্যে সবসময় একটা চাপা অর্ডারের ভাব থাকে। যেমন এখন।
চা-টা খেয়ে পায়ের ওপরে পা তুলে বসল রোহন। আবার জুত করে সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘পেরো, আজ আর তোর অফিস গিয়ে কাজ নেই। আমি বাজার থেকে মুরগি নিয়ে আসছি— তুই কষে রান্না কর। আমি খেয়ে-দেয়ে দুটোর সময় কাজে বেরোব। তারপর সাতটা সাড়ে সাতটায় ফিরলে দুজনে মিলে পুকুরপাড়ে বসে আড্ডা মারব। রিয়েলি, ও-জায়গাটা ফ্যানট্যাস্টিক।’
সত্যিই, আমার বাড়ির পেছনে যে-পুকুর আছে তার পাড়ে সন্ধেবেলা বসে থাকতে বেশ লাগে। রোহন যখনই আমার আস্তানায় এসে ওঠে তখনই পুকুরপাড়ে বসে আড্ডা মারার সুযোগ খোঁজে। এক-একদিন আমি আর ও রাত এগারোটা পর্যন্তও আড্ডা মেরেছি। তা ছাড়া রোহন আড্ডা জমাতেও পারে। কত বিষয়ে যে ও কতকিছু জানে! আর অনর্গল সুন্দর করে কথা বলতে পারে।
কথার মাঝে সামান্য ফাঁক পেতেই আমি ওকে জানালাম যে, আমি একটা বিউটিফুল মশারি কিনেছি।
শুনেই রোহন একেবারে হইহই করে উঠল। বলল, ‘পেরো, অ্যাদ্দিনে তুই একটা কাজের কাজ করেছিস। আজ রাতে মাইনাস মশা ঘুমোনো যাবে…।’
রোহন আমাকে মশারির দামের বাকি পঁচিশটা টাকা দিয়ে দিতে চাইছিল কিন্তু আমি নিলাম না। বললাম, ‘খানিকটা কনট্রিবিউশান আমারও থাক। সবসময় তো ওটা আমিই ব্যবহার করব…তুই আর ক’দিন ইউজ করবি…।’
মশারিটার বাকি ইতিহাস রোহনকে কিছুই জানালাম না। কারণ, ও সেসব বিশ্বাস তো করবেই না—উলটে আমাকে প্যাঁক দিয়ে-দিয়ে জান কাহিল করে ছাড়বে।
সারাটা দিন আমাদের সুন্দরভাবে কাটল। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর দুজনে দু-ঘরে শুয়ে পড়লাম।
সন্ধে থেকেই আমার মধ্যে একটা টেনশান কাজ করছিল। বারেবারে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম। রোহন সেটা টের পেয়ে বেশ কয়েকবার আমাকে ধাতানি দিয়েছে: ‘পেরো, কোনদিকে তোর মন পড়ে আছে বল তো—!’
যাই হোক, রাতে যখন আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম, তখন টেনশানটা যেন আরও জাঁকিয়ে বসল। অন্ধকারে জেগে রইলাম। কিছুতেই ঘুম এল না। আমি যেন কীসের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি পাশের ঘর থেকে রোহনের চিৎকার শুনতে পাব: ‘পেরো!পেরো, কুইক! বাঁচা আমাকে…।’
অনেক রাতে—রাত তখন কত হবে জানি না—পাশের ঘর থেকে মনে হল যেন একটা শব্দ পেলাম। আর তার ঠিক পরেই কথাবার্তার শব্দ। চাপা গলায় দুজন লোক কথা বলছে।
কিন্তু পাশের ঘরে রোহন তো একা! এত রাতে কার সঙ্গে ও কথা বলবে?
তা হলে কি নীচে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে কেউ কথা বলছে—আর সেই কথাবার্তা আমি দোতলার ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছি?
কিন্তু এত রাতে কারা কথা বলবে?
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। জানলার কাছে গিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে তাকালাম। চাঁদের আলোয় আবছাভাবে সব দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু কোনও মানুষজন আমার নজরে পড়ল না।
অথচ চাপা কথাবার্তার শব্দ তখনও শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হল, পাশের ঘর থেকেই আওয়াজটা আসছে।
আর দেরি করলাম না। অন্ধকারেই দরজা খুলে করিডরে বেরিয়ে পড়লাম।
রোহনের ঘরের কাছে এসে দরজায় কান পাতলাম। সিলিংফ্যানের শব্দ ছাড়াও কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কথাগুলো বোঝা না গেলেও ব্যাপারটা যে অনেকটা বচসা মতন, সেটা আঁচ করা যাচ্ছে।
দরজায় দুবার টোকা দিয়ে চাপা গলায় ডেকে উঠলাম, ‘রোহন! রোহন!’
সঙ্গে-সঙ্গে সব কথাবার্তা থেমে গেল। শুধু সিলিংফ্যানের কিচমিচ শব্দ।
এ-ঘরের দরজার ছিটকিনিটা বেশ গোলমেলে—ঠিকমতো আটকাতে চায় না। বাইরে থেকে দরজার পাল্লায় একটু ঠোকাঠুকি করলেই খুলে যায়। তা ছাড়া রোহন অনেকসময় ছিটকিনি না এঁটেই শুয়ে পড়ে। কারণ, ও ভালো করে জানে, এ-ঘরে চুরি করার মতো কিছু নেই।
রোহন কোনও উত্তর দিচ্ছে না দেখে আমি আবার ওর নাম ধরে ডাকলাম। কিন্তু তিনবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে দরজায় বেশ জোরে দুবার ধাক্কা দিলাম।
ঠং করে ছিটকিনিটা পড়ে গেল। নাকি রোহনই ছিটকিনিটা ওরকম আওয়াজ করে খুলল কি না কে জানে!
এবারে দরজা ঠেলতেই খুলে গেল।
ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। নাকে এল সিগারেটের গন্ধ। আমার সিগারেট-বিড়ির অভ্যেস নেই বলে গন্ধটা বেশ চড়া লাগল।
‘রোহন—!’
কেউ সাড়া দিল না। অথচ তক্তপোশের দিক থেকে সামান্য নড়াচাড়ার শব্দ পাচ্ছিলাম।
চাপা টেনশানে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল। তাই আর দেরি না করে ঘরের আলো জ্বেলে দিলাম। তারপর স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম নীল রঙের মশারিটার দিকে।
মশারির ভেতরে কিছু একটা নড়ছে। কারণ, মাঝে-মাঝেই মশারিটা জায়গায়-জায়গায় ফুলে উঠছে। ওটার নীল রঙের কাপড় ভেদ করে ভেতরটা কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু আকারহীন একটা কালচে ছায়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
আমি আবার রোহনের নাম ধরে ডাকলাম, ‘রোহন! রোহন!’
মশারির ভেতর থেকে কোনও উত্তর এল না। তবে এলোমেলো নড়াচড়াটা চলতেই লাগল।
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। মনের ভেতরে ভয় আর কৌতূহলের টানাপোড়েন চলছিল। মনে হল, রোহন আমাকে নিয়ে এ কী রসিকতা করছে!
তাই ‘রোহন’ বলে ডেকে উঠে ছুটে চলে গেলাম মশারির কাছে। এক হ্যাঁচকায় মশারিটা টান মেরে খুলে দিলাম।
মশারির ভেতরে কেউ নেই! সব শূন্য!
পাগলের মতো টানাহ্যাঁচড়া করে দড়ি-টরি ছিঁড়ে মশারিটা দু-হাতে খামচে ধরলাম বুকে। উত্তেজনায় বড়-বড় শ্বাস দিতে লাগলাম।
কোথায় গেল রোহন?
ওই তো, মেঝেতে ওর হাওয়াই চটিজোড়া পড়ে আছে। ওই যে, দেওয়ালের কাছে দাঁড় করানো রয়েছে ওর সবুজ রঙের ভি. আই. পি. সুটকেস। এগুলো ফেলে রেখে কোথায় উধাও হল ও? তা ছাড়া গেলই-বা কোথায় দিয়ে? ওর ঘরের দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ ছিল!
আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করলাম। রক্তের দাগ লাগা এই ভয়ংকর মশারিটা নিশ্চয়ই রোহনকে…।
না, না—এ অসম্ভব!
আর ভাবতে পারলাম না। এই হতচ্ছাড়া মশারিটাকে আগে আমি পুড়িয়ে ছাই করব। তারপর রোহনকে খুঁজব। থানা-পুলিশ করব। কাগজে আর টিভি-তে বিজ্ঞাপন দেব। যে-করে হোক রোহনকে আমি খুঁজে বের করবই।
কিন্তু আগে মশারিটার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষুনি।
মশারিটাকে প্রাণপণে জাপটে ধরে ছুটে চলে এলাম আমার ঘরে। ড্রয়ার থেকে লাইটার বের করে নিয়ে রওনা দিলাম তেতলার ছাদের দিকে।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মনে হল, মশারিটা সাপের মতো নড়ছে, আমার হাতের বাঁধন ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।
আমি আরও জোরে ওটাকে আঁকড়ে ধরলাম। প্রচণ্ড ভয় থেকে এক অদ্ভুত মরিয়া শক্তি আমার ভেতরে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেই শক্তির জোরেই ছাদে এসে পড়লাম।
মশারিটাকে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে সঙ্গে-সঙ্গে লাইটার জ্বেলে ধরলাম ওটার গায়ে।
মশারিটা জ্বলতে শুরু করল।
আমি একটু দূরে সরে গিয়ে হাঁপাতে লাগলাম। দেখতে লাগলাম, একটা অশুভ অলৌকিক শক্তি জ্বলছে, পুড়ছে। কালো আর পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে।
আকাশের চাঁদ-তারা আর রাতের বাতাস এই অন্ত্যেষ্টির সাক্ষী হয়ে রইল।
হঠাৎই এক অদ্ভুত ক্লান্তি আমাকে জড়িয়ে ধরল। তন্দ্রার টানে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতে চাইল।
আর ঠিক তখনই আমাকে চমকে দিয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল কেউ।
‘উঃ! জ্বলে যাচ্ছি…পুড়ে যাচ্ছি…। পেরো, আমাকে বাঁচা! পেরো, প্লিজ, বাঁচা আমাকে…।’
রোহনের গলা আমার কানে গরম সীসে হয়ে ঢুকে পড়ল। আমি দু-কানে আঙুল গুঁজে দিলাম। আতঙ্কে চোখ বুজে ফেললাম।
কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই!
মশারিটা জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে যাক।