বেবী পারভিন
বেবী পারভিনের বয়স সাতাশ।খুবই আদুরি গলায় কথা বলে। মুখশ্রী মোটামুটি, সুঠাম স্বাস্থ্য। পর্দানশীন নয়। হালকা একটা মেক আপ থাকে মুখে, সেটা বোঝা যায় না, কিন্তু সেটা ওকে বেশ আকর্ষণীয়া করে তোলে, আর যখন ও কালো রঙের ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে তার খানিকটা অংশ মাথায় তুলে দেয়, তখন ওকে বেশ কেউকেটা অভিজাত ঘরের মেয়ে বলে মনে হয়।
বেবীর তেরো বছরের একটা ছেলে আছে। ও নিজে না বলে দিলে ছেলে তো দূরের কথা, ওর যে আদৌ বিয়ে হয়েছে সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। বেবীর বর সৈয়দ আলির সাথে ওর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। বেচারি বেবী খুবই দুঃখী। নাবালক সন্তানসমেত সে বাপের বাড়িতে উঠেছে। তার মা জীবিত, বাবা গত হয়েছেন। সেই সংসারে ভাই এবং ভাই-বউদের মুখনাড়া খেয়ে, অজস্র অপমান সহ্য করেও মুখ বুঁজে পড়ে আছে, একরকম অনন্যোপায় হয়ে।
একদিন বেবী হঠাৎ এসে হাজির আমার কাছে। ও বাংলাদেশে যাবে। রাজশাহী তে ওর ছোট বোন থাকে। সেখানে সে একটা বিউটি পার্লার করেছে। সে তার বিউটিশিয়ান কোর্স পাশ করা দিদিকে ডাক পাঠিয়েছে, যাতে তার পার্লার ভালো ভাবে চলে। সে এও জানে যে তার দিদির হাতের ছোঁয়া পেলে যে কোনো সাধারণ মেয়েও অপরূপা হয়ে যায়, দিদি আসলে তার পার্লার দারুণ চলবে।সে তার দিদিকে আরও বলেছে, যে এখানে কাজ করতে করতে চাই কি তোর একটা হিল্লেও হয়ে যেতে পারে। বেবী তাই খুবই আগ্রহী রাজশাহীতে যেতে।
বেবী বললো, দাদা, বাংলাদেশে তো যাবো, কিন্তু আমার ছেলেটার কি হবে? বললাম, গাজী সাহেবকে তো তুমি চেনো, গাজী সাহেবের মালিক,আমীর আলী সাহেব এডুকেশন সেন্টার করেছে, তুমি ওখানে ছেলেকে পাঠাও। তোমার কথা শুনলে একদম বিনা পয়সায় তোমার ছেলের খাওয়া দাওয়া পড়াশোনার সব খরচই আমীর সাহেব বহন করবেন, কারণ ওনার সেন্টারটি গরীব এবং দুঃস্থ ছেলে মেয়েদের জন্য।
ওকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, বেবী, তোমার এতো তাড়াতাড়ি বিবাহ বিচ্ছেদ হলো কি করে?
বেবী বলেছিলো, কি বলবো দাদা, ধর্মতলার আধুনিক শিক্ষিতা মেয়ের সাথে যদি মহেশতলার অশিক্ষিত চাষির বেকার ছেলের বিয়ে হয়, সে বিয়ে কি টিকতে পারে? তাছাড়া বুঝতেই তো পারছেন, আমার বয়স এখন সাতাশ আর আমার ছেলের বয়স তেরো, তাহলে ঠিক কতো বছর বয়সে আমার বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, আর কতো বছর বয়সে আমি সন্তান ধারণ করেছিলাম?
বললাম, বুঝলাম।
বেবী বললো, শুধু এখানেই শেষ নয় দাদা, ধর্মতলার মতো মধ্য কলকাতায় বাড়ি বলে, ওরা মনে করতো আমরা খুব বড়োলোক, শ্বশুর বাড়ির লোকেরা চাইতো আমি যেন বাপেরবড়ি থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পয়সা নিয়ে যাই। ওদের যত বলেছি যে আমরা ভাড়া থাকি, আমার বাবা খানসামার চাকরি করে সামান্য রোজগার করে, ওরা মানতেই চাইতো না। এমনকি আমার বরও চাইতো, বাপের বাড়ি থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে ওর হাতে তুলে দিই। পারতাম না দাদা, ফলে কপালে জুটতো বেদম মার। আচ্ছা, বলুন তো দাদা, যারা ধর্মতলায় থাকে তারা কি সবাই আমীর? কতো লোক এখানে ফুটপাতেই রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে শীতে কাঁপতে কাঁপতে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়।দাদা, অসহ্য বাক্যি যন্ত্রণা আর প্রহারের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে স্বামীর ঘর ছাড়ি।
আমি থাকতে না পেরে বললাম, বেবী, তুমি আমীর সাহেবের সঙ্গে দেখা করো। উনি খুব বড়ো মাপের মানুষ, প্রচুর উপার্জন, আশা করি তিনি তোমার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।
বেবী বললো, দাদা, আপনি জানেন না, আমি সহজে কোনো লোকের কাছে যেতে চাই না। বেওয়া বলে আমাকে নানান সুবিধে দেবার অছিলায় নিজেদের কামনা চরিতার্থ করতে চায়। আমি বড়ো মানুষদের এড়িয়ে চলি দাদা।
তারপর বেবীর সাথে অনেক দিন আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। জীবন যুদ্ধের কঠিন লড়াইয়ে প্রায় পর্যুদস্ত আমিও বেবীর কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম।
সেদিন আকাশে মেঘ জমেছে, সন্ধে হতে না হতেই অন্ধকার জাঁকিয়ে বসেছে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে, ভাবলাম, মির্জা গালিব স্ট্রিটের একটা রেস্তোরাঁ থেকে রুটি আর কাবাব নিয়ে ঘরে ফিরবো। ভাড়া বাড়ির এক চিলতে ঘরে আজ আর নিজের হাত পুড়িয়ে রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছা আছে, ঘুলঘুলির জানলাটা খুলে দিয়ে শরৎ বাবুর অন্নদা দি টা আর একবার ঝালিয়ে নেবো।
অন্নদা দি র কথায় হঠাৎ বেবীর কথা মনে পড়লো, মেয়েটাকে অনেক দিন দেখিনি। রুটি আর কাবাব নিয়ে ঘরে ফিরবো বলে পা চালিয়েছি, একটু আনমনা হয়েছি। চেনা গলার একটা ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালাম। কেউ আমাকে ডেকে বলছে, আসুন খুব অল্প পয়সায় ম্যাসেজ পাবেন।
এগিয়ে গেলাম, একটা ম্যাসেজ পার্লারের পাশে আধো আলো আঁধারিতে দাঁড়িয়ে আছে বেবী পারভিন! আমাকে দেখা মাত্র ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। বললো, দাদা, আপনি?
আচমকা ডাকে আমার হাতে ধরা রুটি আর কাবাব পড়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে সামলে ধরে বললাম, বেবী, তুমি, এখানে! জানোনা জায়গাটা কতো খারাপ?
বেবীও হতভম্ব। ঘাড় নুইয়ে আদাব করে বললো, জানি দাদা, আর জানি বলেই তো রোজ লড়াই করি নিজের সাথে, সামান্য গ্রাসাচ্ছদনের জন্য খদ্দের ধরার কাজ করতে হচ্ছে। ওর চোখে জল চিকচিক করছে। জল মুছে নিয়ে বললো, দাদা, সেই গাজী সাহেবের সঙ্গে তার মালিক আমীর সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম। এতো সজাগ থাকা সত্ত্বেও ফাঁদটা যে এতো নিখুঁত ছিলো বুঝতে পারিনি। ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই ওরা আমার ইজ্জত লুটে নিলো। তারপরে আমার পুর্নবাসন হলো এই পার্লারে। কতো দয়ালু ওরা বলুন দাদা! দাদা, আপনার বেবী অনেক দিন আগেই মরে গেছে, তার রাজশাহীতে যাওয়া হয়নি, আপনার সামনে এখন যে দাঁড়িয়ে আছে, সে বেবী নয় আপনার আদুরী বোনের কঙ্কাল, বলে বেবী হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।
সেই মেঘলা সন্ধ্যায়, সেই হিমেল হাওয়ার অন্ধকারে নিজেকে বড়ো অসহায় বলে মনে হলো, মনে হলো, হায় আল্লা, আমি কিছুই পারি না, বেবীদের মতো দুখিনী মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে পারি না, আমার উপার্জন সামান্য, ঘর ভাড়া মিটিয়ে, এমনকি সব দিন ভরপেট আহারও জোটে না।
মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেলো। হাতের রুটি আর কাবাব টুকু জোর করে বেবীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, বোন, আমার কোনো সামর্থই নেই, এই গরীব দাদার কথা ভেবে আজকের এই দুর্যোগের রাতটা তুমি বাড়ি ফিরে যাও। শুধু সেই উপর ওয়ালার কাছে প্রার্থনা কোরো, কোনো পাপ যেন কোনোদিন তোমাকে স্পর্শ করতে না পারে।
সেই আধো আলো আঁধারিতে সেই পার্লারের পাশে দাঁড়িয়ে বেবী তখনও দু’হাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কেঁদে চলছে, সান্ত্বনা দেবার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি, কান্নায় ওর শরীর টা ফুলে ফুলে উঠছে, আমি বিমর্ষ হয়ে অবরুদ্ধ কান্না কে সামাল দিতে নিঃশব্দে চোখের জল মুছতে মুছতে এক বুক শূন্যতা নিয়ে ঘরের পথে পা বাড়ালাম।