পাখি, আমার পাখি
পরমেশ জ্যাঠাকে দাহ করে, ভোরবেলা নিমতলা থেকে উদাস ভাবে হাঁটতে হাঁটতে সকালের মিঠেে বাতাস গায়ে মেখে, কলকাতার উদার আকাশ দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম আমি। ইস, কতদিন সকালের এমন ঝলমলে রোদে উদ্ভাসিত আকাশ দেখা হয় না আমার।
সকাল আটটায় ঘুম ভাঙে আমার। ঘুম থেকে উঠে, প্রাতঃকৃত্য সেরে, ভাত খেয়ে নটার মধ্যে অফিসে বেরিয়ে যেতে হয়। আকাশ দেখার অবকাশ কোথায় ?
হাঁটতে হাঁটতে খান্নার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম , এক পাখিঅলাকে দেখে। অনেকগুলি পাখি নিয়ে বসেছে সে। খাঁচার ভিতরে একটা টিয়া পাখি দেখে খুব পছন্দ হল আমার। কী সুন্দর সবুজ পালকে মোড়া তার দেহ।
ঠোঁট দু’টি গাঢ় লাল। ঝলমলে সতেজ সজীব তার চেহারা। শরীর থেকে যেন জেল্লা চুঁয়িয়ে পড়ছে। দূর থেকে দেখে সব পাখির মধ্যে সবার আগে চোখে পড়বে তাকে। পাখিটাকে দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল।
একটা সিগ্রেট ধরিয়ে, একমুখ ধোয়া ছেড়ে, পাখিঅলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে দোকানি বলল, কী নেবেন বাবু?
বোধহয়, সবে দোকান খুলেছে লোকটা, পাখিগুলি সাজিয়ে সবে বসেছে সে। এখনও কোন ক্রেতা জোটেনি তার।
সিগ্রেটে বড় বড় দুটো টান দিতেই, সকালবেলা খালি পেটে, তারপর সারা রাত জাগা থাকায়, নেশাটা শরীর বেয়ে আমার মাথায় উঠে এলো। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল।
দু’টান দেওয়া, প্রায় আস্ত সিগ্রেটাই আমি রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে, দোকানিকে খাঁচার টিয়াটাকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললাম, ওটার দাম কত?
– দাম তো অনেক বাবু, বউনির সময় আপনি পাঁচশ টাকাই দেবেন। দাম শুনে আমি ফিরে আসবার উপক্রম করছিলাম। দোকানি তা দেখে বলল, কি হল বাবু, চলে যাচ্ছেন কেন, আপনি কত দেবেন, বউনির সময় একবার বলে যান, সম্ভব হলে দেবো?
– দুশো টাকা দিতে পারি, আমার কাছে দুশো টাকাই আছে।
– আচ্ছা, আর পঞ্চাশটা টাকা দেবেন বাবু, আর দাম দর করবেন না বউনির সময়ে।
– আর পঞ্চাশ টাকা আমার কাছে নেই।
– খাঁচাটার দামই তো বাবু পঞ্চাশ টাকা। সেটার দাম তো অন্ততঃ দেবেন।
– ঠিক আছে, খাঁচাটা রেখে তুমি পাখিটাই আমাকে দাও।
শুনে দোকানি আমার মুখের দিকে একবার তাকাল।
তারপর খাঁচা থেকে পাখিটাকে বের করে আমার হাতে দিল। আমি পাখিটাকে হাতে নিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিলাম।
– তা দেখে দোকানি,হায় হায় করে উঠল। এ কী করলেন বাবু?
আমি সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে, পকেট থেকে দুশো টাকার ভাজ করা নোটটা বের করে তার হাতে দিয়ে, হনহন করে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলামম। দোকানি সেই দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল, আমার দেওয়া টাকাটা পকেটে রাখতে ভুলে গিয়ে, মনে মনে ভাবল, এ কী পাগল রে বাবা ! তার দৃষ্টির আড়ালে আমি চলে যাবার পর, দোকনির সম্বিত ফিরলে, সে দুশো টাকার নোটটা তার পকেটে রাখল।
আমি সচারাচর এমন হটকারী কাজকর্ম করি না। আজ আমার কী হল কে জানে? আমি নিজেও বুঝতে পারছি না, কেন আজ আমু পাখিটাকে কিনে এমন করে আকাশে উড়িয়ে দিলাম?
আবেগের বশবর্তী হয়ে? না তো, পাখিটাকে উড়িয়ে দেওয়ার সময়, আমার মনে তো কোন আবেগ কাজ করেনি। উড়িয়ে দেওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত, আমি ভাবিনি পাখিটাকে উড়িয়ে দেওয়ার কথা। তবে?
তবে কি আমার পকেটে থাকা শ্মশান ফেরৎ দুশো টাকা উড়িয়ে দেওয়ার সাধ জেগেছিল আমার? কী জানি ! সে মুহূর্তেটায় কী যে হয়েছিল আমার আমি তা জানি না।
তবে আজকাল আমার মনেহয় , পাখিটাকে আকাশে উড়িয়ে দিলেও পাখিটা সম্পূর্ণভাবে আকাশে উড়ে যেতে পারেনি। আমার বুকের খাঁচায় সযত্নে বন্দী হয়ে আছে।
এভাবে বলাটা বোধহয় ঠিক হল না।
বলা ভাল, ‘বুকের ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’, আমি তা বুঝতে পারি না। আমার বুকের ভিতর পাখিটার অবাধ যাতায়াত। যখন তখন এসে আমাকে ভাবায়, কখনও কখনও অস্থির করে তোলে আমার মনকে।
আজ খুব ভোরবেলা ঘুমটা আমার হঠাৎ ভেঙে যায়। অলসভাবে উঠে আমি মাথার কাছের জানলাটা খুলে দিই। বসন্তের মিঠে তাজা বাতাস ঘরে এসে ঢোকে। শরীর জুড়িয়ে যায়। আমি জলের বোতলের ছিপি খুলে, বোতল থেকে দু’ ঢোক জল পান করি , তারপর একটা সিগ্রেট ধরাই। ঠিক এমন সময় পাখিটা এসে আমার ঘরে ঢোকে – গান গাইতে গাইতে, “আমার সুখ নেইকো মনে, নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।”
তার গান শুনে, আমি ‘হা – হা – হা – হা’ করে
বিদ্রুপের হাসি হেসে উঠি।
– এভাবে হাসছো কেন তুমি?
– হাসবো না তো, কি করব বল?
– মানে?
– তোমার নাকছাবি হারিয়ে গেছে? তোমার নাক কোথায় যে নাকছাবি পরবে?
– তুমি জান? আমি মোটেই পাখি নয় ,আসলে আমি কুসুমগড়ের রাজকন্যা।
– সকাল বেলায় তুমি আমায় এসব গাঁজাখুরি অবাস্তব গল্প শোনাতে এসেছো?
– বিশ্বাস করবে না, তা তো আমি জানি । সেজন্য সেসব কথা কখনও বলতে চাইনি তোমাকে।
– না না, বলতে শুরু করেছো যখন, বল শুনি
– না আর বলব না।
– আমার ভুল হয়েছে স্বীকার করছি ,প্লীজ বল শুনি।
– বললে, তুমি আমার নাকছাবি খুঁজে এনে দেবে তো?
– চেষ্টা করব (হাসি চেপে রেখে ভিতরে আমার) বললাম।
– বেশ, তবে শোন। কুসুমগড় রাজ্যে এক দুষ্ট পাজি যাদুকর ছিল। সে রাজ্যের অনেককে গরু, ছাগল, পাখি বানিয়ে রাখত। তা জেনে আমার বাবা তাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেয়। তবু সে মাঝে মাঝে অন্যরূপ ধরে আমাদের কুসুমগড়ে আসত। সেদিনও সে এক সন্ন্যাসীর রূপ ধরে আমাদের রাজ্যে এসেছিল। আমি তখন আমাদের রাধাচূড়া বাগানে ঘুরছিলাম। কাছের ডালে একটি রাধাচূড়া ফুল দেখে তা ছিড়বার জন্য আমি লাফালাফি করতেই আমার নাকছাবিটা (বোধহয় আলগা হয়ে গেছিল) নাক থেকে খুলে কোথায় পড়ে গেল। আমি সেটা খুঁজতে খুঁজতে একটু বে-খেয়ালী হয়ে পড়েছিলাম বোধহয় , সেই সৃযোগে সেইসময় সেই পাজি যাদুকরটা আমাকে তার যাদুবলে টিয়াপাখি বানিয়ে দিল। ওটা আমার নাকে পরা থাকলে, শয়তানটা কখনই তা করতে পারত না। কারণ তার যাদু তখন আমার উপর কাজ করত না। নাকছাবিটা মন্ত্রপূত ছিল। হিমালয় থেকে আসা এক সন্ন্যাসী বাবাকে দিয়েছিল ওটা, আমার জন্য।
– তাই নাকি?
– হ্যাঁ গো
– কেন বদশাশ যাদুকরটা তোমাকে টিয়াপাখি বানিয়ে দিল?
– বাবা তাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিযেছিল বলে, বাবার উপর তার খুব রাগ ছিল, তাই সে আমাকে একা পেয়ে তার সেই প্রতিশোধের নেওযার সুযোগটা সে পেয়ে, সেটা কাজে লাগাল আমার উপর।
– তারপর?
– তারপর আমি এক ব্যাধের পাতা ফাঁদে ধরা পড়লাম। সে বাজারে এনে আমাকে এক পাখিঅলার কাছে, মাত্র পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করে দিল।
– তুমি সত্যি বলছো এসব? আমার মোটেও বিশ্বাস হচ্ছে না, তুমি কিছু মনে কোরো না।
– সেই জন্যই তো তোমাকে আমি বলতে চাইনি।
তুমি আমার নাকছাবিটা খুঁজে দেবে না, তাই বলো, তাঁর স্বর কেমন করুণ শোনাল।
– খুঁজে দেব না কখন বললাম আমি? যখন বলেছি তেমাকে, খুঁজে দেব,তখন তা আমি দেবই। চলো আমাকে নিয়ে সেখানে।
– তবে তুমি আমার পিঠে উঠে বস।
– তুমি এতটুকু একটা একটা পাখি, আমার ভার তুমি সইবে কী করে?
– তুমি একটা বোকা। এবার পাখির চোখে হাসি ফুটল।
– কেন?
– আমি তোমার হৃদয়টাকে আমার পিঠে বসিয়ে নিয়ে যাব। তোমার শরীরটা এখানে পড়ে থাকবে।
– তাই নাকি, তবে চলো। বলে আমি তার পিঠে চড়ে বসলাম।
আশ্চর্য ! কী হাল্কা লাগছে আমার। তবে কি সত্যি সত্যিই শরীরটা ঘরে পড়ে আছে আমাধর? হৃদয় চলেছে পাখির পিঠে উড়ে। কতক্ষণ এভাবে বসেছিলাম জানি না। পাখি উড়েই চলেছ। একসময় সে এসে নামল একটা একটা হলুদ বনে। যেদিকে তাকাই শুধু হলুদ ফুলের সমারোহ। মাটিতেও অজস্র হলুদ ফুল ছড়িয়ে আছে। সেই ফুলের উপর দিয়ে আমাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পাখি একজায়গায় এসে থামল, সেখানে একটি রাধাচূড়া গাছ বাগান আলো করে যেন গর্বিত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। সেটা দেখিয়ে পাখি বলল, আমি এই গাছটা থেকেই ফুল ছিঁড়তে গিয়ে, নাকছাবিটা কোথায় যেন পড়ে গেল। আর খুঁজে পেলাম না। তখনই বদমাশ যাদুকরটা আমাকে টিয়াপাখি বানিয়ে দিল।
– বেশ করেছে। কে যেন বলে উঠল। শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে চারিদিকে তাকালাম। ভাবলাম
আমি আর পাখি ছাড়া তো, এখানে তো আর কেউ নেই। তবে কে বলল কথাটা? আমি না বুঝতে পারলেও, পাখি বুঝতে পেরেছে ঠিক, কে কথাটা বলেছ। তাই সে গাছটার দিকে তাকিয়ে বলল, মর তুই মুখপুড়ি রাধা।
– আহা পাগলি, ক্ষেপছিস কেন? আমি তো তোকে রাগাবার জন্য বললাম।
– কী কথার ছিরি, রাগাবার জন্য বলবে, আর আমি রাগব না।
– আচ্ছা বেশ বেশ, এবার বলতো, তোর সঙ্গের ছেলেটি কে ?
– বলব কেন তোকে?
– আহারে বল না সখী
– না বলব না।
গাছের গোড়ায় শিকড়ের দিকে চোখ পড়তেই আমি দেখলাম, নীচে হলুদ ফুলে ঢাকা, চকচক করছে কী যেন একটা?
আমি নীচু হয়ে সেটা হাতে তুলে নিয়ে দেখি, হীরে বসানো একটা সোনার নাকছাবি।
পাখি এতক্ষণ গাছটার সঙ্গে কথা বলছিল, আমি কি করছি লক্ষ্য করেনি।
পাখিকে দেখিয়ে সেটা আমি বললাম,দেখ তো এটাতোমার কীনা?
পাখি সেটা দেখে আনন্দ উচ্ছাসে বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই তো আমি খুঁজে পাইনি। তুমি এটা পেলে কোথায়?
ওই গাছের গোড়ায
তবে এটা আমার নাকে পরিয়ে দাও এখন।
নাক কোথায় পাব? আমি পাখির লাল ঠোটের মাঝে একটা ফুটো দেখতে পেয়ে সেখানে পরিয়ে দিয়েই, কিছুক্ষণ পড়ে দেখি, পাখি কোথায়? আমার সামনে এক অপরূপ সুন্দরী তরুণী দাঁড়িয়ে আছে।
সে বলল, চলো এবার তোমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাব। গিয়ে তোমাকে দেখিয়ে বলল, বাবা এরজন্যই তুমি আমাকে আজ ফিরে পেলে। না হলে আমি তো টিয়াপাখি হয়ে একটা খাঁচায় বন্দী হয়ে থেকে কারও বাড়ির ঝুল বারান্দায় শোভা বর্ধন করে আমার জীবনটা কেটে যেতো। তারপর সব কথা তাকে খুলে বলব।
এসব কী সত্যি ! নাকি আমি কোন স্বপ্ন দেখছি? অন্যমনস্কভাবে নিজের হাতে একটা চিমটি কেটে দেখলাম, নাহ্ ব্যথা লাগছে তো, তবে?
এমন সময় পাখি বলল, কী ভাবছে এতো, চল এবার? তারপর আমার হাতটা ধরে বলল, কী হলো? চলো বাবার কাছে যাব।
আমি সম্বিত ফিরে, হেসে বললাম, হ্যাঁ তাই চলো।
হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে তরুণী বলল, আচ্ছা সব শুনে বাবা যদি তোমাকে কোন পুরস্কার দিতে চায, কী নেবে তুমি?
আমি হেসে নির্দিধায় বললাম, তোমাকে?
তরুণী হেসে বলল, তা শুনে বাবা যদি বলে, না বলে। বলে, তুমি রাজকন্যা পাবে না, তুমি রাজ্য চাইলে, আমি তোমাকে দিতে পারি। তখন তুমি কী করবে?
আমি তাকে বলবো, (তারপর নাটকীয় সুরে বললাম) ‘ হে মহান রাজা ভুল হলে আমাকে দিতে পারেন সাজা,
রাজ্য চাই না আমি,
রাজকন্যাকেই শুধু আমি চাই
এ আমার প্রাণের দোহাই।’
আমার বলার ভঙ্গি দেখে, হি হি হি হি করে উচ্ছসিত ভাবে হেসে উঠল সে। তারপর বেলল,
আমার জন্য রাজ্যপাট রাজত্ব ছেড়ে দেবে তুমি। কিন্তু কেন?
তুমিই আমার প্রেমের রাজত্ব, ভালবাসার রাজ্যপাট
– সত্যি?
– সত্যি সত্যি সত্যি, তিন সত্যি
অদূরে একটি রাজপ্রাসাদ দেখিয়ে তরুণী বলল, ওই আমাদের বাড়ি। চলো একটু দ্রুত পা চালাই। আমি তার হাত নিবিড় ভাবে মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে সেদিকে হাঁটতে লাগলাম অন্যমনস্ক ভাবে।