ভূতনাথের ডায়েরি : কনে-দেখা আলোয়
‘সব মেয়েকেই ভালো দেখায়।’ ছোট হয়ে-আসা বিড়িতে জোরালো টান দিয়ে মন্তব্য করলেন জগৎ শ্রীমানী।
‘কনে-দেখা আলো কাকে বলে জানতে পারি কি?’ বরেন মল্লিক পান চিবোচ্ছিলেন—একটু খোঁচা দিয়েই প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন জগৎ শ্রীমানীর দিকে।
আলোচনাটা শুরু হয়েছিল পাড়ার রবিশঙ্করবাবুর মেয়ের বিয়ে নিয়ে। গতকাল বিয়ের ব্যাপারটা মিটে গেছে। পাত্রের চেহারা একেবারে কার্তিকের মতো। অথচ মেয়ের চেহারা মোটেই মানানসই নয়। কালো-কোলো এই মেয়েটির পাত্রস্থ হওয়া নিয়ে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা ছিল অবশ্যই, তবে পাড়ার লোকেদের দুশ্চিন্তা ছিল যেন তার শতগুণ। তাই হঠাৎ করে সেই মেয়েটির বিয়ের নেমন্তন্ন পেয়ে অনেকেই বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
সুপ্রকাশ পালিত, জগৎ শ্রীমানী, বরেন মল্লিক, বিজন সরকার, আর প্রিয়নাথ জোয়ারদার—সকলেরই সেই বিয়েতে নেমন্তন্ন ছিল। তবে প্রিয়নাথের এক আত্মীয়ের বিয়ে ছিল গতকালই। ওঁকে সেখানে যেতে হয়েছিল—পাড়ার নেমন্তন্নে যেতে পারেননি।
বৈঠকখানায় বসে বেশ কিছুক্ষণ এই বিয়ে নিয়ে আলোচনার পর সুপ্রকাশ হঠাৎই বলেছিলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দেখুন, রবিশঙ্করবাবু হয়তো কনে-দেখা আলোয় মেয়েকে দেখিয়েছেন। তাই পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়ে গেছে…।’
তাঁর উত্তরে জগৎ শ্রীমানী মন্তব্য করেছেন এবং বরেন মল্লিক পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন।
বিড়ির শেষ টুকরোটা তক্তপোশে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন জগৎ শ্রীমানী। তারপর ভুরু উঁচিয়ে গোল-গোল চোখে বরেন মল্লিকের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বললেন, ‘বরেন, তুমি কি সত্যিই জানতে চাইছ, না আমি জানি কি না সেটা টেস্ট করছ?’
বরেন মল্লিক ইতস্তত করে চোখ সরিয়ে নিলেন। বোঝা গেল, জগৎ শ্রীমানীর শেষের কথাটাই ঠিক।
প্রিয়নাথ গলাখাঁকারি দিয়ে অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝাড়লেন, বললেন, ‘কনে-দেখা আলো কাকে বলে সবাই জানে। সূর্য ডুবে যাওয়ার ঠিক পরে—মানে, গোধূলির সময়—যে-আলোটা থাকে সেটাই কনে-দেখা আলো…।’ হাসলেন ভূতনাথ : ‘কিন্তু এটা কেউ বলতে পারেন, সেই আলোতে কেন কনেকে বা কাউকে ভালো দেখায়?’
চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক তুলে একে-একে তিনজনের মুখের দিকে তাকালেন ভূতনাথ।
সবাই চুপচাপ। মাথার ওপরে ব্রিটিশ আমলের কাঠের ব্লেডওয়ালা পাখা ঘুরছে, ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হচ্ছে।
হঠাৎই অ্যানসনিয়া পেন্ডুলাম ঘড়িতে ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বাজতে শুরু করল। সকলে যেন ঘণ্টার শব্দ শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ঘণ্টার শব্দ শেষ হলে জগৎ শ্রীমানী বললেন, ‘ওই আলোটা খুব নরম। মানে, মোলায়েমভাবে মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়ে!’
বরেন মল্লিকের মুখ দেখে মনে হল, ব্যাখ্যাটায় তাঁর সায় আছে।
কিন্তু সুপ্রকাশ পালিত উসখুস করছিলেন, বারবার ভূতনাথের দিকে তাকাচ্ছিলেন।
ভূতনাথ সিগারেটে মেজাজি টান দিয়ে জগৎ শ্রীমানীকে বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন—তবে ওটা ঠিক সায়েন্টিফিক এক্সপ্লানেশন হল না। আমি একটু ধার করা বিদ্যে জাহির করি। কারণ, বিজ্ঞান যেখানে শেষ সেখান থেকে আমার বিদ্যে শুরু। এটা আমি শুনেছিলাম এক সায়েন্টিস্ট বন্ধুর মুখে।
‘কনে-দেখা আলোর মোদ্দা ব্যাপারটা হল, ওই আলোয় কোনও ছায়া পড়ে না। যাকে বলে ডিফিউজড লাইট। মানে, ঘষা কাচের মধ্যে দিয়ে আলো যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সেইজন্যেই মুখের ওপর আলোটা নরম মোলায়েম বলে মনে হয়।’
কিছুক্ষণ কেউই কোনও কথা বললেন না। বোধহয় প্রিয়নাথের ব্যাখ্যাটা মনে-মনে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন।
হঠাৎই সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রিয়নাথ বললেন, ‘রাতের কনে-দেখা আলোর কথা আপনারা কেউ কখনও শুনেছেন কি?’
‘তার মানে!’ হাই পাওয়ার চশমার কাচের পিছনে সুপ্রকাশ পালিতের চোখ দুটো অস্বাভাবিকরকম বড় দেখাল।
প্রিয়নাথ ম্লান হাসলেন। মাথা ঝুঁকিয়ে সিগারেটের ছাই ঝাড়তে-ঝাড়তে বললেন, ‘আমার তো বেশিরভাগ কাজ-কারবারই রাত নিয়ে। তবে এই ঘটনার শুরু হয়েছিল কনে-দেখা আলো দিয়ে। আর শেষও হয়েছে, বলতে পারেন কনে-দেখা আলো দিয়ে। তফাতের মধ্যে শুধু এই—প্রথমটা দিনের কনে-দেখা আলো, আর শেষেরটা রাতের।’
‘রাতের কনে-দেখা আলো!’ অস্ফুটে বললেন বরেন মল্লিক।
‘হ্যাঁ, রাতের—’ ভূতনাথ বললেন, ‘ধরে নেওয়া যাক, ছেলেটির নাম সুজন—বয়েস আর কত হবে?—এই ছাব্বিশ-সাতাশ। আমার গল্পটা—মানে, সত্যি ঘটনাটা—ওকে নিয়েই। ও তখন ভালো চাকরি করে। মা-বাবা ওর জন্যে মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছেন। একমাত্র ছেলেকে এবার সংসারী করে দেবেন ঠিক এইরকম একটা সময়ে ঘটনার শুরু…।’
ধানবাদ থেকে ট্রেনে ফিরছিল সুজন। সঙ্গে মা আর বাপি। মাসিমণির মেয়ের বিয়েতে ওরা চারদিনের জন্য ধানবাদ গিয়েছিল। মায়ের আরও ক’দিন থাকার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সুজন থাকতে চায়নি। কারণ, অফিস থেকে ও মাত্র চারদিনেরই ছুটি পেয়েছে। অফিসে জয়েন করেই ওকে আবার চেন্নাই ছুটতে হবে—অফিসের একটা নতুন প্রজেক্টের মিটিং আছে সেখানে।
বাপিরও অবশ্য বেশিদিন থাকার ইচ্ছে ছিল না। কলকাতায় ব্যবসার কাজ ছেড়ে কোথাও ওঁর মন বসে না। তাই সুজনের মায়ের মন খারাপ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক।
ট্রেনে ওঠার পর থেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছিল সুজন। বলছিল, ক’মাস পরেই ও ছুটি নিয়ে মাকে ধানবাদ ঘুরিয়ে নিয়ে যাবে। এবারে আর চারদিন নয়—কমপক্ষে দশদিন।
মা তবুও মুখ ভার করে বসেছিল।
বাপি কোনও কথা বলেননি। লম্বা সিটের এক কোণে বসে আপনমনে সিগারেট খাচ্ছিলেন, আর আড়চোখে সুজনদের দেখছিলেন।
সুজনের অনেক কথা গোমড়া মুখে শোনার পর শেষে মা বলল, ‘তোর জন্যেই আরও দু-দিন থাকতে চেয়েছিলাম—আমার জন্যে নয়।’
‘কেন, আমার জন্যে কেন?’ সুজন অবাক হয়ে জানতে চাইল।
‘রুবিকে তোর জন্যে মেয়ে দেখতে বলেছিলাম। ও একটা মেয়ের খবর দিয়েছিল। দেখতে নাকি দারুণ। কাল বিকেলে ও রুবিদের বাড়িতে আসবে কথা ছিল। তোরা এমন করলি, মেয়েটাকে দেখার আর সময় পেলাম না।’
রুবি সুজনের মাসিমণির নাম। বিয়ের সম্বন্ধ করার ব্যাপারে মাসিমণির উৎসাহ অফুরন্ত। প্রায়ই অহঙ্কার করে বলেন, ‘এ পর্যন্ত চোদ্দোটা বিয়ের সম্বন্ধ করেছি।’
সুজন মায়ের কাছেই শুনেছে, মাসিমণির টার্গেট নাকি পঁচিশটা সম্বন্ধ। তারপর তিনি এই গুরুদায়িত্বের কাজ থেকে রিটায়ার করবেন। তখন ভারতে বিয়ের হার নির্ঘাত গোত্তা খেয়ে নীচে নেমে যাবে।
সুজন জানে, ওর বিয়ের জন্য মা একেবারে আদা-জল খেয়ে লেগে পড়েছে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মেয়ের ফটো দেখেছে ও—কিন্তু ওর পছন্দ হয়নি। কোনও-কোনও সময় মাকে ও মিনমিন করে বলেছে, ‘এত তাড়াহুড়োর কী আছে। আগে চাকরিতে একটু দাঁড়িয়ে নিই…।’
কিন্তু মা সেসবে আমল দেয়নি। অনুসন্ধান পুরোদমে চলেছে মায়ের আক্ষেপটা শোনার পর সুজন মাথা নেড়ে বলল, ‘উফ, তোমাদের কিছু এনথু আছে বটে!’
‘কী বললি?’ ছেলের কথাটা ঠিক ধরতে না পেরে মা প্রশ্ন করল।
সুজন বলল, ‘না—কিছু না।’
তারপর জানলা দিয়ে বাইরের ছবি দেখতে লাগল।
গাছপালা, মাঠ-প্রান্তর, দিঘি, হাঁস, ফিঙে ঘুঘু—সব একে-একে ছুটে চলেছে উলটো দিকে। শুধু পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যটা জানলার ফ্রেমে নাছোড়বান্দার মতো আটকে রয়েছে।
কী অপূর্ব ছবি! এ-ছবি কেবল একজনই আঁকতে পারেন।
সুজন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল, আনমনা হয়ে গিয়েছিল। তাই খেয়াল করেনি, ট্রেন কখন যেন আসানসোল স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে। চা আর শিঙারাওয়ালাদের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে।
আজ রবিবার। তাই ট্রেন বেশ ফাঁকা। সুজনদের উলটোদিকের সিটে জানলার পাশ ঘেঁষে একজন মাত্র যাত্রী বসে আছেন। চোখে হাই পাওয়ার চশমা। থলথলে চেহারা। ধানবাদ থেকে ওঠার পরই একটা হিন্দি ম্যাগাজিন খুলে বসেছেন।
ট্রেন ছাড়ার হুইসল দিল। তারপর নড়ে উঠল। ঠিক তখনই সুজন দেখল তিনজনের একটি পরিবার ওদের কিউবিকল-এর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনজনেরই চোখের নজর পছন্দসই সিট খুঁজছে।
লম্বা সিটটা প্রায় খালি দেখে পরিবারের কর্তা তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই, এখানে এসো—।’
সুজনদের উলটোদিকে ওরা তিনজন বসে পড়ল।
ভদ্রলোক প্রৌঢ়। তার স্ত্রীর বয়েসও মানানসই। আর ওঁদের মেয়ের বয়েস কত হবে? বড়জোর কুড়ি-বাইশ।
মেয়েটির বোধহয় জানলার কাছে বসার ইচ্ছে ছিল। কারণ, সুজন লক্ষ করল, খানিকক্ষণ উশখুশ করার পর ও হিন্দি-ম্যাগাজিন-পড়া ভদ্রলোককে নীচু গলায় কিছু একটা অনুরোধ করল।
ভদ্রলোক চমকে উঠে মেয়েটির দিকে তাকালেন। তারপর সৌজন্য দেখিয়ে বললেন, ‘হাঁ, হাঁ, কিঁউ নহি—।’ এবং কষ্ট করে উঠে সিটের একেবারে এ-প্রান্তে এসে বসলেন—যাতে ওরা তিনজন পাশাপাশি বসতে পারে।
সুজন মেয়েটিকে একটু খুঁটিয়ে দেখছিল—অনেকটা যেন পাত্রী দেখার চোখে। হলুদ-কালোয় ছাপা চুড়িদার। গলায় সরু চেন। কানে চকচকে পাথরকুচি বসানো দুল। বাঁ-হাতে ঘড়ি। কপালে সরষের দানার মতো টিপ।
গায়ের রং ময়লা। মুখটা সামান্য লম্বাটে। নাক—স্পষ্ট। তার ডান পাশে একটা বড় জরুল। ঠোঁট কালচে গোলাপি। চিবুকে ছোট্ট টোল রয়েছে।
মেয়েটির চোখ দুটি অতি সাধারণ। তবে চোখের পালক বেশ ঘন এবং লম্বা। মাথায়ও অনেক চুল। আলগা বেণীর বেশ খানিকটা সিটের ওপরে সাপের মতো এঁকেবেঁকে পড়ে আছে।
মেয়েটি মোটেই সুন্দরী নয়। তবে সুশ্রী বলা যায় অনায়াসেই। আচ্ছা, সুজন যদি পাত্রী দেখতে যেত তা হলে এই মেয়েটিকে কি ও সত্যি পছন্দ করত? বোধহয় না।
সুজনের এখন এই এক মুশকিল হয়েছে। অবিবাহিতা কোনও তরুণী দেখলেই ওর মন পাত্রী দেখার মাপকাঠিতে তার সৌন্দর্য মাপতে চায়। এ এক অদ্ভুত খেলা। মনকে হাজার বারণ করেও সুজন বাগ মানাতে পারেনি। এ জন্য নিজের ওপরে ওর মাঝে-মাঝে ভীষণ রাগ হয়।
নিজের এই পাগলামিতে সুজন আপনমনেই হেসে ফেলল। ওর খেয়াল ছিল না, তখন ও আনমনাভাবে তাকিয়ে ছিল মেয়েটিরই দিকে।
‘হাসছেন কেন?’
সুজন একেবারে হকচকিয়ে গেল। কী বলবে ভেবে পেল না।
কারণ, মেয়েটিই সামান্য বিরক্ত গলায় প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছে। ওর ভুরু কুঁচকে গেছে। চোখে সন্দেহের ছায়া।
দুজনেরই মা-বাবা পাশে বসা। সুজন খুব বিব্রত হয়ে পড়ল। ওর মুখ লাল হয়ে গেল। কানে উত্তাপ টের পেল।
কোনওরকমে ও বলল, ‘আপনি মনে হয় ভুল বুঝেছেন। আমি আনমনা হয়ে স্কুল লাইফের কথা ভাবছিলাম। তখনকার একটা মজার ব্যাপার হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় হাসি পেয়ে গেছে…।’
মেয়েটি এই উত্তরে তেমন খুশি হল বলে মনে হল না। তাই সুজন সাততাড়াতাড়ি স্মৃতি হাতড়ে একটা স্কুলের গল্প শুনিয়ে দিল।
গল্পটা সত্যিই মজার ছিল। তাই মেয়েটিও হেসে ফেলল।
দুই পরিবারের গল্প শুরু হয়ে গিয়েছিল খানিক আগেই। কথায়-কথায় জানা গেল মেয়েটির নাম চন্দ্রা। ওদের ‘দেশ’ আসানসোল। সেখানে এক আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে ওরা এসেছিল। এখন কলকাতায় ফিরছে। ধানবাদেও ওদের দু-চারজন আত্মীয় আছে। কখনও-কখনও ধানবাদেও ওরা বেড়াতে যায়।
টুকরো-টুকরো কথা হচ্ছিল, চা খাওয়া হচ্ছিল। তারই মধ্যে সুজন লক্ষ করল, মা বারবার ওর দিকে দেখছে। মনে হল যে ইশারায় কিছু একটা জানতে চাইছে। সুজন মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল।
চন্দ্রা তখন ওর জানলার তাকে বাঁ হাত রেখে ঝুঁকে পড়ে ওর হাতের পিঠের ওপরে চিবুক রেখেছে। দু-চোখ মেলে দেখছে বাইরের দিকে। ওর কয়েক গোছা চুল হাওয়ার উড়ছে—কখনও কপালে পড়ছে, কখনও চোখের ওপর।
বাইরে তখন সুর্য ডুবে গেছে। কিন্তু তার দীপ্তির আভা থেকে গেছে আকাশময়। এ সময়ে মেঘের যা কাজ তাই করেছে। সূর্যের ভালোবাসায় কুটিকুটি হয়ে রামধনুর নানান রং মেখে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে। অপরূপ এক আলো সবাইকে তখন সুন্দর করে তুলেছে। গাছপালা, ধানখেত, পুকুর, ইলেকট্রিক-তারে বসে থাকা পাখি—সবই কেমন যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে।
চন্দ্রাকেও তখন অন্যরকম দেখাচ্ছিল।
এই অসামান্য আলোয় ওকে দেখে সুজন মুগ্ধ হয়ে গেল। ওর বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি মুচড়ে উঠল। কিশোর বয়েসের প্রথম প্রেমের মতো ওর মনে হল, চন্দ্রাকে না পেলে বাঁচবে না।
কলকাতায় ফিরেও এই অনুভবটা ওর একটুও পালটাল না। অফিসে জয়েন করে, চেন্নাইয়ে মিটিং-এ গিয়ে, আবার বাড়িতে ফিরে—সবসময় ওর নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হতে লাগল।
এর নাম যদি প্রেম হয় তা হলে মানতেই হবে এ বড় অদ্ভুত প্রেম!
ঠিকানা আদান-প্রদান ট্রেনেই হয়েছিল। সুতরাং বেশ কিছুদিন উদাসভাবে ছটফট করে কাটানোর পর সুজন একদিন চিঠি লিখল চন্দ্রাকে।
প্রথম চিঠিটা ছিল নির্দোষ বন্ধুত্বের চিঠি। উত্তরও এল অনেকটা সেইরকম।
কিন্তু ধীরে-ধীরে চিঠিগুলোর রং বদলাতে লাগল। সুজন আর চন্দ্রার নিয়মিত দেখা হতে লাগল। এক রহস্যময় টান সুজনকে চন্দ্রার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলতে চাইল।
মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মনে-মনে খুশি হয়েছিল। তবে আক্ষেপের একটা ছোট্ট খোঁচা তাকে কখনও-কখনও বিরক্ত করছিল : চন্দ্রার চেয়ে সুন্দরী বেশ কয়েকটি মেয়েকে সুজন এর আগে নাকচ করেছে। যদিও তাদের বংশমর্যাদা, ধনসম্পদ, ইত্যাদি ছিল অনেক উঁচু মানের।
কিন্তু প্রেম কখনও অভিভাবকদের ইচ্ছেমতন পথ চলে না। সুতরাং, দুই পরিবারের সমঝোতায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের কথাবার্তা শুরু হল। এবং বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক হয়ে গেল।
ঠিক এইরকম একটা সময়ে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
চন্দ্রারা সপরিবারে রাতারাতি নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
নিরুদ্দেশই বলা যায়, কারণ সুজন একদিন ওদের বেলঘরিয়ার বাড়িতে গিয়ে দ্যাখে ওদের দরজায় তালা ঝুলছে।
আশপাশে খোঁজখবর করে স্পষ্ট কিছু জানা গেল না। দু-একজন ভাসা-ভাসা ভাবে বললেন, যে, ওদের কোন এক আত্মীয় নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেই খবর পেয়ে ওরা তাড়াহুড়ো করে চলে গেছে।
এর বেশি আর কোনও খবর জোগাড় করতে পারল না সুজন। ভাঙচোরা মন নিয়ে ফিরে এল। ওর রঙিন হয়ে ওঠা জীবনটা চোখের পলকে সাদা-কালো হয়ে গেল।
বিষণ্ণ বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্যে সুজনের দিন কাটতে লাগল। অবশ্য দিন না বলে সেগুলোকে রাত বলাই ভালো। চন্দ্রার কোনও খবর পাওয়া গেল না, কোনও চিঠিও এল না। সুজনের মা-বাপি ধাক্কাটা ধীরে-ধীরে সামলে নিতে পারলেও সুজন পারল না। ও কেমন চুপচাপ হয়ে গেল। অফিসের কাজে আরও বেশি করে ডুবে গেল। আগ বাড়িয়ে অফিসের টুরে যেতে লাগল, আর চলার পথে তিনটে চেনা মুখকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াতে লাগল। চন্দ্রাকে খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েও ও ঠিক যেন ছাড়তে পারেনি।
প্রায় একবছর পর চলন্ত ট্রেনের কামরায় বিবাগী সুজন হঠাৎই চন্দ্রার বাবা অপরেশবাবুকে দেখতে পেল।
কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে অপরেশবাবুর!
সারা মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। গাল চুপসে গেছে। চোখ গর্তে বসা। কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। গায়ের রং আগের তুলনায় অনেক কালচে হয়ে গেছে। মাথার চুলের চেহারা দেখে মনে হয় বহুদিন তাতে তেল-জল পড়েনি।
অপরেশবাবুকে দেখেই চন্দ্রার কথা মনে পড়ে গেল সুজনের। উঃ কতদিন…কতদিন পর চন্দ্রার ঘনিষ্ঠ একজন আত্মীয়কে সুজন দেখতে পেল!
সুজন পূর্বা এক্সপ্রেস ধরে দিল্লি থেকে ফিরছিল। অফিস থেকে ফার্স্ট ক্লাসে যাতায়াতের সুযোগ থাকলেও ও সেকেন্ড ক্লাসে যাতায়াত করে। চন্দ্রারা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে ও এই অভ্যেসটা রপ্ত করেছে। ওর মনে অদ্ভুত এক আশা ছিলঃ যদি আচমকা কোনও ট্রেনে চন্দ্রার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! দিল্লির ট্রেন ধানবাদ আসানসোল ছুঁয়ে যায়। তাই অফিস থেকে ও প্রায়ই দিল্লি টুরের দায়িত্ব চাইত।
এবারে টুর সেরে ফেরার পথে ট্রেন যখন ধানবাদে দাঁড়িয়েছে তখনও ও বরাবরের মতোই জানলা দিয়ে চঞ্চল চোখ মেলে ধরেছে, আর্তের মতো খুঁজছে একটা চেনা মুখ—কিন্তু বরাবরের মতোই হতাশ হয়েছে।
ট্রেন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লেটে চলছিল। সহযাত্রীরা অনেকেই বিরক্তির মন্তব্য করছিল। সুজনের সেগুলো কানে ঢোকেনি। ও চোখ বুজে বিভোর হয়ে চন্দ্রার কথা ভাবছিল।
আচমকা অপরেশবাবুকে চিনতে পেরে সুজনের হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল গলার কাছে।
কামরার দেওয়ালে মাথা হেলিয়ে জীর্ণ-শীর্ণ মানুষটা শূন্য চোখে চেয়ে আছে একটা সিলিং ফ্যানের দিকে। ওঁর পায়ের কাছে একটা বড় থলে।
‘মেসোমশাই!’ ওঁর কাছে গিয়ে ডাকল সুজন।
অপরেশবাবু চমকে উঠে তাকালেন সুজনের দিকে। কামরার মলিন আলোয় ঝাপসা নজরে ওকে ঠাহর করতে চাইলেন।
‘মেসোমশাই, আমি সুজন। মাসিমা কেমন আছেন? চন্দ্রা কেমন আছে?’
অপরেশবাবু সুজনকে চিনতে পেরে ব্রিবত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, চোখ নামিয়ে বসে রইলেন অপরাধীর মতো।
সুজন বসে পড়ল ওঁর পাশেঃ ‘এ কী চেহারা হয়েছে আপনার। চন্দ্রা, মাসিমা…ওঁরা কেমন আছেন?’
অপরেশবাবু আর সামলাতে পারলেন না। বুকের ভেতর থেকে পাক খেয়ে উঠে আসা একটা কষ্ট ওঁকে ভেঙেচুরে দিল। শীর্ণ হাতে সুজনের হাত চেপে ধরে তিনি থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। কিছু একটা বলতে চেয়েও যেন বলতে পারছিলেন না—শুধু ঠোঁট বেসামালভাবে কাঁপছিল, চোখ দুটো ভিজে উঠছিল পলকে।
অনেকগুলো নীরব মুহূর্ত এইভাবে কেটে গেল।
সুজন মানুষটাকে সময় দিল। অনেক প্রশ্ন ওর মনে ভিড় করে এলেও ও চুপ করে রইল।
নিজস্ব তালে শব্দ তুলে টেন ছুটে চলেছে। বাইরের অন্ধকার ভেদ করে তিরের মতো ছুটে আসছে বাতাস। বাতাসে সামান্য ঠান্ডা ভাব। শীত আর বেশি দূরে নেই।
অনেকক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে কথা বলতে পারলেন অপরেশবাবু।
মালবাজারে ওঁর ছোট ভাইয়ের হঠাৎই হার্ট অ্যাটাক হয়। তার সঙ্গে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা এতটাই ছিল যে, টেলিগ্রাম পাওয়ামাত্রই ওঁরা তিনজনে ছুটে যান শিলিগুড়ি। শহর থেকে প্রাইভেট কারে করে মালবাজারে যাওয়ার পথে একটা ট্রাকের সঙ্গে ওঁদের গাড়ির মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট হয়। চন্দ্রা, চন্দ্রার মা—দুজনেই সাঙ্ঘাতিকরকম চোট পায়। বাঁচার কোনও আশাই ছিল না। তারপর বহু কষ্ট করে ডাক্তার-হাসপাতাল, জড়িবুটি-কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক-তন্ত্রমন্ত্র করে কোনওরকমে শেষ রক্ষা হয়। অপরেশবাবুর বাঁ-হাতটা ভেঙে গিয়েছিল, তা ছাড়া মাথাতেও চোট পেয়েছিলেন। সেসব সামলে ওঠার পর কারও সঙ্গে তিনি আর যোগাযোগ করেননি—যোগাযোগ করার মতো পরিস্থিতিও ছিল না। তাই ওঁরা একরকম অজ্ঞাতবাসে চলে যান। আসানসোলের এক নির্জন প্রান্তে গিয়ে নতুন ঠিকানায় থাকতে শুরু করেন। অপরেশবাবু একসময় গিয়ে কলকাতার পাট চুকিয়ে চলে আসেন। তারপর থেকে সম্পর্কের সব ডালপালা ছিন্ন করে ওঁরা একান্তে চুপিচুপি দিন কাটান।’
‘…এ আমাদের নিজেদের দুনিয়া, সুজন। এখানে কেউ ঢুকতে পারে না…এখান থেকে কেউ চলে যেতেও পারে না…।’ বুক ভাঙা এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অপরেশবাবু।
ওঁর কাহিনির সবটুকু সুজনের কাছে স্পষ্ট হয়নি। কেন ওঁরা আত্মগোপন করে রয়েছেন? তা হলে কি দুর্ঘটনার পর চন্দ্রা আর মাসিমার মুখ বীভৎস কুৎসিত ভয়ংকর হয়ে গেছে! এমন কী হয়েছে, যে ওরা এরকম চোরের মতো মুখ লুকিয়ে বসে আছে!
সুজন ভেতরে-ভেতরে অস্থির হয়ে পড়ছিল। চন্দ্রাকে একটিবার দেখার জন্য ওর অন্তরাত্মা ছটফট করছিল।
আর থাকতে না পেরে ও বলল, ‘আমি…আমি চন্দ্রার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।’
‘না, তা আর হয় না।’ শীর্ণ অবসন্ন অপরেশবাবু ক্লান্তভাবে মাথা নাড়লেন।
‘মেসোমশাই, প্লিজ! আপনি জানেন না, এই একটা বছর আমি কীরকম পাগলের মতো আপনাদের খুঁজে বেড়িয়েছি! অফিসের টুরে সবসময় সেকেন্ড ক্লাসে ট্যাভেল করি শুধু এই আশায় যে, কোনদিন হুট করে আপনাদের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। সত্যিই…দেখা হল তো!’ সুজন কেঁদে ফেলল। কনে-দেখা আলোয় প্রথম চন্দ্রাকে দেখার অপরূপ ছবিটা ওর বুকের ভেতর থেকে হঠাৎ করেই চলে এল চোখের সামনে।
ও কিছুতেই কান্না চাপতে পারছিল না। এতদিনের কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা, যেন এই প্রথম অন্ধকার কুঠরি থেকে বেরিয়ে এল বাইরে।
অকালবৃদ্ধ মানুষ্টার হাত আঁকড়ে ধরে ভাঙা গলায় সুজন বলল, ‘একটিবার…মেসোমশাই, প্লিজ…একটিবার…।’
আকুল যুবকটির কান্না-ভেজা চোখে অপরেশবাবু কী দেখলেন কে জানে! নরম গলায় বললেন, ‘চলো। কিন্তু চন্দ্রা কি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইবে?’
‘কেন, দেখা করতে চাইবে না কেন!’
‘ও…ও অনেক…বদলে গেছে…।’
কেমন বদলে গেছে চন্দ্রা? দুর্ঘটনায় ওর চেহারা বদলে গেছে? নাকি মনটা?
সুজন শত ভেবেও কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না। এলোমেলো বহুরকম ভাবনা ওর মনের ভেতরে উথালপাথাল করতে লাগল।
এরকম একটা মনের অবস্থা নিয়ে আসানসোল স্টেশনে নামল সুজন। স্টেশনের বাইরে এসে ওরা একটা সাইকেল রিকশায় উঠে বসল।
জ্যোৎস্নার রাত। কালো ভেলভেটের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। কারও কাছে কিছু ধার করে সেটা অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া বড় সহজ নয়। অথচ চাঁদ হাসিমুখে ধার করা আলো বিলিয়ে চলেছে।
সাইকেল রিকশা ছুটছিল। বাতাসে সামান্য শীত-শীত ভাব। সুজন বেশ গুটিসুটি মেরে বসল। অপরেশবাবু আপনমনে সিগারেট খাচ্ছিলেন। কোনও কথা বলছিলেন না।
শুরুতে একবার শুধু বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘তুমি ওদের সঙ্গে দেখা না করলেই ভালো করতে! কিন্তু তুমি যেভাবে জেদ ধরেছ…। অবশ্য তোমার কষ্টটাও আমি বুঝি…।’
জনপদ ক্রমশ কমছিল। রাস্তায় লোকজন আঙুলে গোনা যায়। সাইকেল রিকশাও চোখে পড়ছে কম। শুধু সুজনদের নিয়ে এই রিকশাটা একঘেয়েভাবে ছুটে চলেছে। কখন থামার সময় আসবে কে জানে!
একসময় পিচের রাস্তা শেষ হয়ে কাঁচা রাস্তা শুরু হতেই রিকশা থামালেন অপরেশবাবু। রিকশা থেকে নেমে ওঁরা হাঁটা পথ ধরলেন।
হাঁটা পথ একসময় শেষ হল। টিনের চাল দেওয়া বড়সড় একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে অপরেশবাবু আলতো গলায় বললেন, ‘এসো, সুজন—আমরা এখন এখানেই থাকি।’
বাড়ির ভেতরে ঢুকেই কেমন অদ্ভুত লাগল সুজনের। ঠান্ডার কামড়টা বাইরের চেয়ে যেন বেশি। আর হালকা ন্যাপথালিনের গন্ধে পরিবেশটা ভারী হয়ে রয়েছে।
বড় মাপের বসবার ঘর। তার চারটে জানলাই হাট করে খোলা। এদিক-ওদিক ছিটকে পড়া চাঁদের আলো চোখে পড়ছে। আর ঘরের আলো এতই কম যে, চাঁদের আলোর সঙ্গে প্রায় পাল্লা দিচ্ছে।
‘এত কম আলো…আপনাদের অসুবিধে হয় না?’ সুজন অবাক হয়ে বলল।
‘অসুবিধে?’ শব্দ করে সামান্য হাসলেন অপরেশবাবু। ওঁর মুখে ছায়া পড়ায় হাসিটা দেখা গেল না : ‘আলো না থাকলেই বরং আমাদের সুবিধে হয়। ওরা তো একদম আলো সহ্য করতে পারে না। আমিও আস্তে-আস্তে ওদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।’
সুজনের মনের ভেতরে হঠাৎই কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হল। ওর চোখ এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে চন্দ্রাকে, মাসিমাকে খুঁজল।
সেটা লক্ষ করে অপরেশবাবু বললেন, ‘তুমি বোসো—আমি ওদের ডাকছি।’
একটা কাঠের চেয়ারে বসল সুজন। কিন্তু কাঠের চেয়ারটা ভীষণ ঠান্ডা। ও বেশ অবাক হয়ে গেল। হাতের ব্রিফকেসটা নামিয়ে রাখল একপাশে।
অপরেশবাবু চলে যাওয়ার একটু পরেই মাসিমা ঘরে এসে ঢুকলেন।
কী জমকালো সাজে সেজেছেন তিনি! ম্লান আলোতেও সেই সাজ গ্লো-সাইনের মতো ঝকমক করছে।
গাঢ় হলুদ রঙের জরিপাড় শাড়ি। দু-হাত ভরা গয়না। গলায় জড়োয়া হার। কানে চকচকে দুল। নাকে নাকছাবি। কপালে বড় টিপ। সিঁথিতে উজ্জ্বল সিঁদুর। যেন একেবারে নতুন বউ।
মাথায় ঘোমটা টেনে শাড়িটা গুছিয়ে নিয়ে সুজনের কাছাকাছি বসলেন মাসিমা।
‘কেমন আছ, সুজন?’
সুজন বিহ্বল চোখে চন্দ্রার মাকে দেখছিল, কোনওরকমে ঘাড় নাড়লঃ ‘ভালো আছি।’
মেসোমশাইয়ের কাছে আমাদের বিপদ-আপদের কথা সব তো শুনেছ।’
সুজন আবার ঘাড় নাড়ল।
এতদিন পর দেখা হল, অথচ মাসিমার মধ্যে কোনও উচ্ছ্বাস নেই। যেন আগে থেকেই জানতেন, সুজন আজ দেখা করতে আসবে!
‘কেমন আছেন, মাসিমা?’
‘ওই একরকম…।’
‘চন্দ্রা কেমন আছে?’
বিষণ্ণ হাসলেন মাসিমাঃ ‘ওই আমারই মতন।’
ঘরের আলোটা কমজোরি হলেও সরাসরি মাসিমার মুখের ওপরে গিয়ে পড়েছিল। সুজন মুখটাকে আগের চেনা মুখের সঙ্গে মনে-মনে মিলিয়ে দেখছিল।
মুখের চামড়া তেলতেলে টানটান। দু-চোখ ছবির মতো সুন্দর। মাসিমার মুখটা হয়তো এরকমই ছিল, তবে এখন অনেক সজীব আর নবীন দেখাচ্ছে।
সুজনের ছৌ-নাচের মুখোশের কথা মনে পড়ল।
মাসিমার টুকটাক কথা বলার মধ্যেই অপরেশবাবু সুজনের জন্য এক কাপ চা নিয়ে এলেন। সঙ্গে প্লেট নেই, বিস্কুট নেই।
সব মিলিয়ে দৃশ্যটা সুজনের কেমন খাপছাড়া লাগল। মাসিমা, চন্দ্রা থাকতে অপরেশবাবু হঠাৎ চা করতে গেলেন কেন! তা ছাড়া ওঁদের অবস্থা কি এখন এতই খারাপ যে, অতিথির কপালে প্লেট বা বিস্কুটও জোটে না!
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুজন ন্যাপথালিনের গন্ধ পেল। এই বিশ্রী গন্ধটা ওঁরা কীভাবে সহ্য করছেন কে জানে!’
‘সব কাজ আমাকে একার হাতেই করতে হয়…’ হাতে হাত ঘষে অনেকটা যেন কিন্তু-কিন্তু ভাবে অপরেশবাবু বললেন, ‘ওরা ঠিক পারে না…।’
অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা নিয়ে খানিকক্ষণ কথা হল। চন্দ্রার কথাও হল। সুজনের মা-বাপির খোঁজ নিলেন মাসিমা। কিন্তু ওঁর কথায় উষ্ণতার কোনও ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাচ্ছিল না সুজন। টিভিতে যাঁরা খবর পড়েন মাসিমা যেন ঠিক তাঁদের মতন করে কথা বলছিলেন।
কিছুক্ষণ পর যখন কেউ আর কথা খুঁজে পাচ্ছিল না তখন ভেতরে- ভেতরে অধৈর্য হয়ে ওঠা সুজন জিগ্যেস করল, ‘চন্দ্রা কোথায়, মাসিমা? ওর সঙ্গে একটু দেখা করব…।’
‘দেখা করবে করো। ও বাইরের বাগানে বসে আছে।’ নির্লিপ্তভাবে এই কথা বলে বাড়ির পিছনদিকটা ইশারায় দেখালেন মাসিমা।
অপরেশবাবু সুজনকে ডাকলেন, ‘এসো, আমার সঙ্গে এসো—।’
একটা ছোট ঘর এবং রান্নাঘর পেরিয়ে বাড়ির খিড়কি দরজার কাছে পৌঁছে গেল সুজন। অপরেশবাবু দরজা খুলে বাইরে বেরোলেন, ওকেও ডেকে নিলেন।
সামনে প্রায় বিঘেখানেক জমি। তার এখানে-সেখানে এলোমেলোভাবে নানান জাতের গাছ বড় হয়ে উঠেছে। তবে একপাশে অনেকটা জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে কয়েকটা বেদি চোখে পড়ছে। হয়তো অপরেশবাবুই সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করিয়ে নিয়েছেন।
সবক’টা বেদি খালি—শুধু একটি ছাড়া। সেখানে ছায়া-ছায়া কেউ একজন বসে আছে।
‘চন্দ্রা—।’ অপরেশবাবু চাপা গলায় ডাকলেন।
নীচু গ্রামের সেই ডাক চন্দ্রা দিব্যি শুনতে পেল, সামান্য ঘাড় ফেরাল সুজনদের দিকে।
‘তুমি যাও—কথা বলো।’ সুজনকে আলতো করে ঠেলে দিলেন অপরেশবাবু। তারপর ফিরে চলে গেলেন বাড়ির ভেতরে। চন্দ্রার সঙ্গে একা কথা বলতে পারলে সুজন খানিকটা হালকা হবে।
কেমন যেন সম্মোহিতের মতো সুজন এক পা দু-পা করে এগিয়ে চলল চন্দ্রার দিকে। পায়ের নীচে ঠান্ডা ঘাসের ছোঁওয়া ওর শরীরে একরকম শিরশিরানি জাগিয়ে তুলছিল। এক ঝাঁক পাখির মতো উড়ে এসে রাতের বাতাস সুজনের চোখে-মুখে ঝাপটা মারল।
এক টুকরো মেঘ কোথা থেকে ভেসে এল। পুর্ণিমার চাঁদকে সেটা ঢেকে দিতেই কটকটে জ্যোৎস্নার আলো-ছায়া উধাও হয়ে গেল। এক পরিব্যাপ্ত ঘষা আলো মোলায়েমভাবে ছড়িয়ে পড়ল চরাচরে।
সুজনের কনে-দেখা আলোর কথা মনে পড়ে গেল।
ও পায়ে-পায়ে পৌঁছে গেল সেই বেদির কাছে। চন্দ্রার কাছ থেকে হাতদুয়েক দুরত্বে বসে পড়ল।
চন্দ্রার সাজপোশাক সুজনকে মোটেই অবাক করল না। কারণ, একটু আগেই ওর মায়ের জমকালো সাজ ও দেখেছে। তবে চন্দ্রার সাজ যেন হুবহু মায়ের মতন—এমনকী ঘোমটাটা পর্যন্ত!
চন্দ্রার পরনে টুকটুকে লাল শাড়ি, যদিও চাঁদের আলোয় রংটা ভালো করে ঠাহর হচ্ছে না। সারা গায়ে গয়না। খোঁপার পাশ থেকে ফুলের মালা ঝুলছে। তার ওপর দিয়ে ঘোমটা টানা। আর ঘোমটার ভেতরে চন্দ্রার টলটলে মুখ।
‘চন্দ্রা!’ আবেগমথিত গলায় ডেকে উঠল সুজন। ন্যাপথালিনের গন্ধটা তখনও ওর নাকে আসছে।
চন্দ্রা ওর ডাকে মুখ ফেরাল। কোনও কথা বলল না।
চন্দ্রার মাথায় ঘোমটা কেন! ওর কি তা হলে বিয়ে হয়ে গেছে! কিন্তু কপালে বা সিঁথিতে তো সিঁদুরের ছোঁওয়া চোখে পড়ছে না!
‘চন্দ্রা, এই একটা বছর আমি তোমাকে পাগলের মতো খুঁজেছি। যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন হয়ে আমি শেষ হয়ে গেছি। আমার কথা তোমার মনে পড়েনি?’
‘পড়েছে।’ আবেগহীন গলায় বলল চন্দ্রা, ‘কিন্তু কোনও উপায় ছিল না। তুমি আমাকে খুঁজে পাও…আমাদের খুঁজে পাও…আমরা চাইনি। কিন্তু সবই নিয়তি! নইলে বাবার সঙ্গে আচমকা তোমার দেখা হবে কেন!’
এ কোন চন্দ্রা! এ রকম কোনও চন্দ্রাকে তো সুজনের মনে পড়ছে না।
‘আমি এখনও তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছি, চন্দ্রা…।’
‘অপেক্ষা!’ খিলখিল করে হাসল চন্দ্রাঃ ‘আমার সব অপেক্ষা শেষ হয়ে গেছে। তুমি এবার চলে যাও।’
অবাক হয়ে চন্দ্রার মুখের দিকে তাকাল সুজন। চন্দ্রা ওকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। ও তো ভেবেছিল রাতটা এখানে থাকবে। তারপর কাল সকালে বিয়ের কথাবার্তা পাকা করে তবে ফিরবে!
চন্দ্রাকে হারিয়ে পাওয়ার আনন্দ সুজনের অন্যান্য চেতনা আর বোধ আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল। ও হতবাক হয়ে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে ছিল।
রাতের বাতাস হঠাৎই যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। গাছের পাতা শিরশির শব্দ তুলল। জোনাকিরা এদিক-ওদিক উড়ছে। আর টলটলে জ্যোৎস্নার অপরূপ কনে-দেখা আলো রাতকে আরও সুন্দর, আরও রহস্যময়ী করে তুলেছে।
ঘোমটার আড়ালে চন্দ্রাকে যেটুকু দেখা যাচ্ছিল তাতেই মাতাল হয়ে গিয়েছিল সুজন। ও সামনে ঝুঁকে পড়ে চন্দ্রার একটা হাত মুঠো করে ধরল।
সঙ্গে-সঙ্গে চিৎকার করে উঠল চন্দ্রা। এক ঝটকায় হাত টেনে নিতে চাইল। বাতাসের ঝাপটায় ওর ঘোমটা খসে গেল।
‘এসব কী করছ! তুমি চলে যাও!’
অবাক হয়ে সুজন হাতটা ছেড়ে দিয়েছিল। তবে চন্দ্রাকে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। দেবী প্রতিমার মতো মসৃণ তেলতেলে মুখ চাঁদের আলোয় অনন্য হয়ে উঠেছে।
‘চন্দ্রা!’ আবার ডেকে উঠল সুজন, ‘আমি চলে যাওয়ার জন্যে আসিনি।’ ওর বুকের ভেতরটা কেমন মুচড়ে উঠছিল।
হঠাৎই পিছন থেকে অপরেশবাবুর গলা পাওয়া গেল : ‘তুমি চলে যাও, সুজন। তাতে সবার ভালো হবে।’
চমকে মুখ ফেরাতেই অপরেশবাবুকে দেখতে পেল সুজন। পাশে দাঁড়িয়ে মাসিমা। ওঁরা কখন যেন নিঃশব্দে ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন।
‘আজ রাত্তিরটুকু থেকেই কাল সকালে চলে যাব, মেসোমশাই।’ অনুনয়ের সুরে বলল সুজন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অপরেশবাবু। বিব্রতভাবে বললেন, ‘তুমি আজ রাতেই চলে যাও—।’
‘কেন?’
‘আমাদের এখানে রাতে কেউ থাকে না।’ একটু থেমে তারপরঃ ‘শুধু আমরা তিনজনে থাকি।’
অপরেশবাবুর শেষ কথাটা জ্যোৎস্নারাতে নিশাচর পাখির মতো ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াতে লাগল। ওদের ঘিরে ঘুরপাক খেতে লাগলঃ শুধু আমরা তিনজনে থাকি শুধু আমরা তিনজনে থাকি শুধু আমরা তিনজনে…।’
সুজন উঠে দাঁড়াল। ও ঠিক বুঝতে পারছিল না এখন কী করবে। রাতের আঁধার, বাতাস, জোনাকির দল, গাছ-গাছালি, আর এই তিনজন রহস্যময় মানুষ ওকে কেমন যেন দিশেহারা করে দিচ্ছিল।
মাসিমা মেসোমশাইয়ের হাত ধরে টানলেন। ওঁরা গিয়ে বসলেন বেদিতে, চন্দ্রার পাশে। মেসোমশাই মাঝখানে—ওঁর দু-পাশে ওঁর স্ত্রী আর মেয়ে। ওঁদের বসার ঢংটা এমন যেন স্টুডিওতে বসে গ্রুপ ফটো তোলার পোজ দিচ্ছেন।
চাঁদের সামনে থেকে মেঘের আড়াল হঠাৎই সরে যেতে জ্যোৎস্নার তীব্র আলো-ছায়া আবার ফিরে এল।
তখন সুজন দেখল, চন্দ্রার মুখে জরুলটা আর নেই। ওটা কোথায় গেল! অ্যাক্সিডেন্টের পর কি প্লাস্টিক সার্জারিতে বাদ গেছে!
ও অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই অপরেশবাবু হাত তুলে ওকে থামতে ইশারা করলেন।
‘চন্দ্রাকে তুমি দেখতে চেয়েছিলে—দেখেছ, কথাও বলেছ। এবার তুমি যাও সুজন। তোমার কষ্ট আমি বুঝতে পারছি। তবে জেনে রেখো, আমরা আরও কষ্টে আছি।’
বাতাস হঠাৎই আরও অস্থির হয়ে উঠতেই মাসিমার ঘোমটা খসে পড়ল। মাসিমা আর চন্দ্রার খোঁপা কোন এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় খুলে গেল। বাতাসে ওদের এলো চুল পাগলের মতো উড়তে লাগল—চাঁদের আলোয় চিকচিক করতে লাগল।
অপরেশবাবু স্ত্রী আর মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন, বললেন, ‘অ্যাক্সিডেন্টের পর আমি যেভাবে ওদের ফিরিয়ে এনেছি তা কেউ বিশ্বাস করবে না। তবে এ তো ঠিক ফিরিয়ে আনা নয়—চৌকাঠে দাঁড় করিয়ে রাখা। দু-জগতের মাঝখানে। আর আমি?’ বিষণ্ণ আক্ষেপের এক শব্দ করলেন অপরেশবাবু : ‘আমি ওদের দুজনের পাহারাদার হয়ে দিন কাটাচ্ছি।’
‘তোমাকে আমরা ভালোবাসি।’ চন্দ্রা আর মাসিমা একইসঙ্গে বলে উঠলেন।
‘আমিও চন্দ্রাকে পাগলের মতো ভালোবাসি…।’
‘জানি। আর জানি বলেই তো এত কষ্ট করেও টিকে আছি।’
‘আমিও আপনাদের সঙ্গে কষ্ট করে টিকে থাকব।’ বায়না করার সুরে বলল সুজন।
অপরেশবাবু হতাশভাবে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন : ‘তুমি তো কিছুতেই বুঝতে চাইছ না! তা হলে দ্যাখো—’ স্ত্রী আর মেয়ের কানে-কানে কী যেন বললেন অপরেশবাবু।
মাসিমা আর চন্দ্রা খিলখিল করে হেসে উঠলেন—হাসতেই থাকলেন। আর একইসঙ্গে ওঁদের ডানহাতটা তুলে নিয়ে গেলেন ডান চোয়ালের নীচে।
এরপর সুজন যা দেখেছিল তা সত্যি হলেও পরে কখনও সেটাকে ও সত্যি বলে মানতে পারেনি। কিন্তু ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভুল দেখার কোনও অবকাশ ছিল না।
চন্দ্রা আর মাসিমা—দুজনেই ওঁদের মুখ দুটো খুলে নামিয়ে নিলেন। মুখ নয়, মুখোশ। সুজন দেখল, ওঁদের মুখের জায়গাটায় একরাশ অন্ধকার।
ন্যাপথালিনের উৎকট গন্ধে সুজনের দম বন্ধ হয়ে এল। রাতের বাতাস হঠাৎই যেন আরও ঠান্ডা হয়ে গেল। একটা ঘোরের মধ্যেই ও শুনতে পেল নিশাচর কোনও পাখির কান্না।
দুটো অন্ধকার মুখের পিছনে বিশাল কালো পতাকার মতো ওঁদের চুল উড়ছিল। সেই পটভূমিতে অপরেশবাবুর মুখটা ছবির মতো দেখচ্ছিল। স্ত্রী আর মেয়েকে আঁকড়ে কাছে টেনে নিলেন তিনি।
ওঁদের খিলখিল হাসির শব্দ তখনও থামেনি।
জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়ার আগে অপরেশবাবুর শেষ কথাটা যেন বহুদূর থেকে ভেসে এল সুজনের কানে।
‘…সেইদিন থেকে দুজন অন্ধকারকে নিয়ে আমি বাস করি। আমার মেয়ে-অন্ধকার, আর বউ-অন্ধকার। এখানে আমরা তিনজন ছাড়া আর কারও ঠাঁই নেই…।’