ছোটনের কীর্তি
পাড়ার ছেলে ছোটন ভীষণ দুরন্ত। ছোটবেলায় পাড়ার অন্যান্যদের বাড়িতে গিয়ে ভুলভাল কাজ করে মজা পেত। একবার একজনের বাড়ির ছাগল চুরি করে অন্যের বাড়িতে লুকিয়ে বেঁধে রেখে এসে দুই বাড়ির মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছিল।উল্টো দিকের বাড়ির মেয়েটা জানলা দিয়ে সেটা দেখেছিল। সে বলে দেওয়ায় ছোটনের কীর্তি ফাঁস হয়ে যায় এবং সে বেদম মার খায়। তবে ছেলেটি সরল ছিল মানুষের উপকারে লাগত। তোতলা ছিল বলে সবাই ওকে ক্ষেপাতো।
মনে পড়ে একবার ‘শোলে’ সিনেমা দেখে এসে শোলের ডায়লগ বলছে আর সবাই শুনে মজা পাচ্ছে। বলছে ” তেলা তেয়া থোগা লে তালিয়া” উ–ফ্ সবার কি হাসি! ওর মুখের এই ডায়লগ শোনার কারণে লোকের কাছে ওর বেশ কদর ছিল।
একদিন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ” হ্যাঁরে ছোটন শোলে সিনেমায় কে কে অভিনয় করেছে রে?” বলল- ধনন্দন আল হেনানালিনী। আমি বললাম, আর কেউ নেই?
ও বলল, “আতে তো! অনিতাদ বাত্তন, দয়া ধাদুলি, হন্দিত্ তুনাল, আনজাদ আলি থান।” বললাম একটা ডায়লগ বলনা। ও খুশি হয়ে বলল, ” তিতনে আদনি তে? দো আদনি?”
এতটুকু বলেছে; অমনি একদল ছেলে এসে ওকে বলছে, ” তুই আমাদের ঘুড়ির সুতো চুরি করেছিস কেন রে–? ” বলেই ওকে মারতে শুরু করেছে। ও বার বার বলছে , “আনি তুলি তলিনি ” কিন্তু ছেলেগুলো শুনছে না।
ওর এইসব বদনাম আছে বলে আমি প্রথমটা গা করিনি। পরে ছেলেগুলোকে বাধা দিয়ে বললাম, ” ও যে চুরি করেছে তার প্রমাণ কোথায়? তোমরা ওকে একদম মারবে না।” ছোটন কেঁদে কেঁদে বলছে” আনি তো ঘুলি ওলাই না, তুলি তলবো তেন?” ছেলেগুলো বলল, তাহলে তোদের বাড়ির বাগানে কেন সুতো গুলো ছিল?
ছেলে মার খাচ্ছে শুনে ছুটে এসেছেন ওর মা। বললেন , “দেখছেন দিদি , পাড়ায় কিছু হলেই ওর দোষ হয়।ওকে কত বলি দুরন্তপনা করিস না। ও এখন তেমন বদমায়েশি করে না। তবু ওকে সবাই দোষ দেয়। তারপর ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঐ ঘুড়ির সুতো মন্টু আর দিলু রেখে গেছে আমাদের বাগানে আমার সামনেই; বলল পরে নিয়ে যাবে। এখন শুনি ছেলে মার খাচ্ছে , তাই ছুটে এলাম।”
তারপর ছেলেকে বললেন, “দেখ তোর পরিচিতি কি হয়েছে! এর ওর জিনিস নিয়ে এখানে ওখানে লুকিয়ে রেখে মজা পাস; এখন কিছু ঘটলে তোকেই এসে ধরে। কতদিন বলেছি এসব করিস না, ঘর থেকে বেরোবি না। তোকে বাজে বললে আমার খারাপ লাগে না। আমি যে তোর মা!” বলেই কেঁদে ফেললেন।
আমি সাত্বনা দিয়ে বললাম, বাচ্চারা ওরকম একটু দুষ্টুমি করে থাকে, ও তো ভালো ছেলে। এখন তো আর দুষ্টুমি করে না; তাই না? ছোটন মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “না আনি আল থেলবো না। আনায় পাথি তিনে দাও, আনি পাথি নিয়ে থেলবো”। মা আঁচলে চোখ মুছে ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন।
আমার খুব খারাপ লাগলো। ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলতে পারেনা ছেলেটা। সবাই ওকে খ্যাপায়। একা একাই ঘোরে। তাই হয়তো ঐসব ভুলভাল কাজ করে মনে আনন্দ উপভোগ করে।
অনেক দিন হলো ছোটনটাকে দেখা যায় না। ভাবলাম ওর মা হয়তো ওকে আর বেরোতে দেয় না।পাড়ায় অন্য ছেলেপুলেদেরও বিশেষ খেলতে দেখি না।
শীতের বেলা বিকালে বারান্দায় বসে উল বোনার কাজে ব্যস্ত। পাশের বাড়ির মহিলা আমায় ডেকে বললেন,- ছোটনের কীর্তি শুনেছেন? বাব্বা! ভাবতাম ছেলেটা খুবই দুরন্ত, সবাইকে বিরক্ত করা কাজ। জানেন ও কি করেছে? আজকে ঐ পাড়ার টোকনকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে।
বললাম, ঘটনাটা কি?
উনি বললেন ছোটনের মা গোটা কয়েক পায়রা কিনে দিয়েছে ছেলেকে। সেই নিয়েই ছেলের দিন কাটে। আজ দুপুরে একটা পায়রা উড়ে টোকনদের বাড়ির ভিতর ঢুকে যায়।ছোটন পায়রার পিছন পিছন পাঁচিল টোপকে টোকনদের বাড়িতে ঢোকে। দ্যাখে উঠোনে মাদুর পেতে রোদে টোকন শুয়ে আছে আর ওর মাথার কাছে একটা সাপ ফনা তুলে আছে। ছোটন তাড়াতাড়ি উঠোনে শুকোতে দেওয়া চাদর নিয়ে সোজা সাপটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সাপটাকে ঢেকে ফেলে।এতে টোকনের গায়ে ধাক্কা লাগে। টোকন ধড়পড়িয়ে উঠে ছোটনকে টানা হিঁচড়া করে মারতে থাকে আর বলে তোর স্বভাব যাবেনা বল! তুই বাড়ির ভিতর ঢুকে উৎপাত করতে চলে এসেছিস!
ছোটন চাদরের উপর শুয়েই আছে, চাদরের তলায় সাপ। কিছুতেই চাদর ছাড়ছে না; তোতলিয়ে বলছে” থা–প, থা–প; গোথলো থাপ তাদলেল তলায়”।
টোকনের চিৎকারে বাড়ির অন্যরা চলে এসেছে। ছোটন কি বলতে চাইছে আন্দাজ করে টোকনের বাবা সামনে রাখা গামলা দিয়ে চাদর সমেত সাপটা ঢাকা দিয়ে রাখলেন। পরে কায়দা করে চাদরে জড়িয়ে সাপটাকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে এলেন। বিপদ থেকে ছেলেকে বাঁচানোর জন্য ছোটনকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বাহবা দিলেন।
ছোটনকে পায়রার খোঁজ করতে দেখে টোকন বলে, তোকে আর পায়রার খোঁজ করতে হবেনা, আমি তোকে চারটে পায়রা কিনে দেব ; এখন বাড়ি যা।
খবরটা শুনে আমি আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। সঙ্গে সঙ্গে ছোটনদের বাড়ি ছুটলাম। দেখি সেখানে টোকন ও তার মা বসে আছে। ছোটনের খুব গুনগান করছে। আমি ছোটনকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করলাম। বললাম, ” দেখেছো আমাদের এই ছেলে কত পরপোকারী। আমরা এতদিন শুধু ওকে দুরন্ত, দুষ্টু বলেই জানতাম। আজ ঈশ্বর দেখিয়ে দিলেন ওর মধ্যে কেমন মহৎ গুণ আছে”। ছোটন হাসলো, ওর মায়ের মুখেও হাসি।
শুনলাম ওর পায়রাটা ফিরে এসেছে। সকলেই খুশি। আমি বাড়ি চলে এলাম। মনে মনে ভাবলাম, আমিও দুটো পায়রা কিনে ছোটনকে গিফট করবো।