Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মাতালের কাণ্ডজ্ঞান || Tarapada Roy

মাতালের কাণ্ডজ্ঞান || Tarapada Roy

এবার গঙ্গাজলে গঙ্গা পূজা। বহু জায়গা থেকে বহু গল্প চুরি করে সঙ্গে কিছু গোঁজামিল দিয়ে সপ্তাহে সপ্তাহে কাণ্ডজ্ঞান চালাতে হয়। অনেকেই সেটা দেখেও দেখেন না, খেমাঘেন্না করে ছেড়ে দেন।

এইভাবে আমার সাহস বেড়ে গেছে। এইবার দেশ পত্রিকার খোদ সম্পাদক মহোদয়ের গল্প দিয়েই শুরু করব। শ্রীযুক্ত সাগরময় ঘোষের বলা এই গল্পটি অনেকেই অনেক জায়গায় বিভিন্ন ভাষ্যে শুনেছেন, ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ বইতে গল্পটি তিনি চমৎকার রসালো ভাবে লিখেও রেখেছেন। তবুও কাণ্ডজ্ঞানের জন্যে গল্পটি আমি সংক্ষিপ্ত করে আবার এখানে লিখছি।

দু’জন মাতাল অনেক রাতে মদ খেয়ে চুরচুর হয়ে বড় রাস্তার মোড়ে ঠিক মধ্যিখানটায় পরম্পরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। পুলিশ এসে তাঁদের অনুরোধ করছে যাতে এ ভাবে দু’জনে ধরাধরি করে বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে যে যার বাড়িতে চলে যান। কিন্তু পরস্পরকে ছেড়ে তাঁরা যেতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন, ‘United we stand, divided we fall’ ‘ অর্থাৎ দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে এই অবস্থায় আছেন বলেই দাঁড়িয়ে আছেন, যে মুহূর্তে দু’জনে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা হয়ে যাবেন অমনি সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে যাবেন।

এ গল্প মাতালের বাড়ি না-ফেরা নিয়ে। মাতালের বাড়ি ফেরা নিয়ে চমৎকার গল্প আছে সৈয়দ মুজতবা আলির। একজন মাতাল গভীর রাতে বাড়ি ফিরে বাবাকে ডাকছে বাবা বাবা বলে নয়; বাবার নাম হরিপদ, ডাকছে, ‘হরিপদবাবু, ও হরিপদবাবু, দরজা খুলুন।’ বাবা তো রেগে আগুন, কী আমারুনাম ধরে ডাকা? মাতলামির জায়গা পাওনি!’ মাতাল ছেলে তখন বাবাকে বোঝায়, ‘আমি যদি নেশা করে এসে আপনাকে বাবা বাবা বলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডাকি, পাড়ার লোকেরা জানবে আপনার ছেলে মাতাল। তাতে কি আপনার সম্মান থাকবে! তার চেয়ে আমি যদি আপনাকে হরিপদবাবু বলে ডাকি, লোকে ভাববে আপনার কোনও ইয়ার-বন্ধু নেশা করে এসে আপনাকে ডাকছে। কত লোকেরই তো ইয়ার-বন্ধু মাতাল থাকে, তাতে আপনার কোনও মানহানি হবে না।’ অকাট্য যুক্তি, অতঃপর পিতৃদেব কী করেছিলেন আমাদের জানা নেই।

(শ্রীযুক্ত সাগরময় ঘোষের এবং সৈয়দ মুজতবা আলির গল্প দুটি মনে আছে, কিন্তু হাতের কাছে বই দুটি নেই। গল্প দুটি বোধহয় আরও মজার। স্মৃতি আমাকে কিঞ্চিৎ প্রতারণা করল বলে মনে হচ্ছে, ত্রুটি মার্জনীয়।)

মদ্যপ সম্পর্কে একমাত্র বিয়োগান্ত গল্পটি শ্রীযুক্ত হিমানীশ গোস্বামীর। মাতাল ও মদ খাওয়া নিয়ে সব গল্পই ওই উত্তেজক পানীয়টির মতোই তরল। কিন্তু হিমানীশবাবুর গল্পটি বড়ই করুণ।

গল্পটি অযোধ্যা সিং নামে এক মদ্যপ যুবককে নিয়ে। সে অত্যন্ত বেশি মদ খেত। একদিন পর পর কয়েক বোতল রাম দুয়েক ঘণ্টার মধ্যে গলাধঃকরণ করল অযোধ্যা সিং। তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। তখন অযোধ্যা সিং-এর আত্মীয়বন্ধুরা অযোধ্যার শেষকৃত্যের সময় সে যে রামের বোতলগুলি খেয়েছিল এবং যেগুলিতে তখনও রাম ছিল সেগুলো অযোধ্যা সিং-এর চিতায় রাগ করে তুলে দেয়।

হিমানীশের এই গল্প শুনে অনেকে বিশেষ রকম আপত্তি করেছিলেন, তাঁরা বলেছিলেন, ‘মদ অতিরিক্ত খেলে শরীর খারাপ হতে পারে, অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, অনেক দিন ধরে খেলে গুরুতর অসুখে ভুগে মরে যেতে পারে, কিন্তু বেশি মদ পান করে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু, এ অতি অসম্ভব কথা।’ এবার হিমানীশ করুণ মুখে বলেছিলেন, ‘দেখুন, সব শুনলেন তো, ওই অযোধ্যা সিং-এর সঙ্গে রামের বোতলগুলোও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। এখন যদি কিছু আমাকে প্রমাণ করতে বলেন, সে আমি পারব না। পারলে বিশ্বাস করুন, না পারলে বিশ্বাস করবেন না।’

মাতাল সম্পর্কে সবই শোনা গল্প বলছি। আমার সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা লেখা অতি বিপজ্জনক। আমার এই লেখা পড়ে তাঁরা যদি কেউ বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তারপর বেশি নেশা করেন, তারপর আমার খোঁজ করেন, সেই সমাগম খুব মধুর না হতেও পারে।

তার চেয়ে অমল কৈশোরের কথা বলি। কলকাতার থেকে অনেক দূরে যে ছোট শহরে আমরা বড় হয়েছি, সেখানে মদ খাওয়া খুব চালু বা জনপ্রিয় ছিল না। মাত্র একটি কি দুটি স্থানীয় মাতাল ছিলেন, শহরসুদ্ধ লোক তাদের চিনত, তাঁদের খ্যাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে এমনকী সাত-সকালে যখন তাঁরা হয়তো বিশুদ্ধ, নির্মদ চিতে বাজারের থলে হাতে যাচ্ছেন, তখনও আমাদের মতো অল্পবয়স্করা তাঁদের হঠাৎ দেখলে, ‘মাতাল-মাতাল’ চিৎকার করে ভয়ে দৌড়ে পালাতাম। তাঁরা যে খুব ক্ষতিকর ছিলেন, বিপজ্জনক বা মারকুটে ছিলেন—তা কিছু মনে হয় না। শহরের সাধারণ লোকে একদিকে তাঁদের মাতাল বলে সমীহ করতেন, অন্যদিকে একটু রোমান্টিকভাবেও দেখতেন। আসলে সেটা ছিল দেবদাস-পার্বতীর যুগ, নবীন বাংলার প্রমথেশ-পর্ব। তাই যে কোনও ভদ্রলোক মাতালকেই অহেতুক গৌরবান্বিত করে বলা হত, ‘ম্যাট্রিকে গোল্ড মেডাল পেয়েছিল, বাবা-মা লাভ ম্যারেজ করতে দিল না, এখন মদ খেয়ে এই অবস্থা দাঁড়িয়েছে,’ অথবা ‘মদ খাওয়া আরম্ভ করার আগে কী চেহারা ছিল নিখিলের, একেবারে রাজপুত্রের মতো। আর সব সময় ফটফট করে সাহেবদের মতো ইংরেজির খই ফুটত মুখে।’

সেই সব সুপুরুষ, সুপণ্ডিত, ভগ্নহৃদয়, ব্যর্থ-প্রেমিক মাতালদের আজকাল আর দেখতে পাওয়া যায় না। আজকালকার অধিকাংশ মদ্যপ পেঁচি, ধান্দাবাজ এবং অত্যন্ত গোলমেলে। অবশ্য দু’-একজন ফুর্তিবাজ মাতালও আছেন।

হাওড়া স্টেশনে একটা ওজনের যন্ত্র আছে, আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। বন্ধুর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ভাবলাম ওজনটা নিয়ে নিই। ওজনের যন্ত্রটায় হেলান দিয়ে গিলেরা পাঞ্জাবি ও তাঁতের ধুতি পরা এক ঈষৎ মত্ত ভদ্রলোক দাড়িয়েছিলেন। আমি পকেট থেকে দুটো দশ পয়সা বের করে যন্ত্রটির দিকে এগুতেই ভদ্রলোক একটু আলগা হয়ে সরে দাঁড়ালেন। যন্ত্রটা নিশ্চয় খারাপ ছিল, আমার কুড়ি পয়সা গলাধঃকরণ করে খটখট শব্দসহ যে কার্ডটি বেরিয়ে এল তাতে আমার ওজন উঠেছে মাত্র পনেরো কেজি। আমার বিস্মিত দৃষ্টি অনুসরণ করে পার্শ্ববর্তী মত্ত ভদ্রলোক কার্ডটির দিকে ভাল করে দেখে হঠাৎ আমার পেটে একটা খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘দাদা একদম ফাঁপা।’

এ তো তবু রেল স্টেশনের কথা। একবার এক পার্টিতে দেখেছিলাম এক ভদ্রলোক প্রচণ্ড হইহুল্লোড়, নাচ-গান করছেন, তার স্ত্রী একটু রক্ষণশীলা, তিনিও উপস্থিত, তবে স্বামীর আচরণে রীতিমতো বিব্রতা। তিনি একা একা বাইরের বারান্দায় চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে স্বামী বেচারির হুঁশ হয়েছে, পার্টিও ভেঙে এসেছে, স্বামী টলতে টলতে গিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে মাতালের পক্ষে যতটা অনুতপ্ত হওয়া যায় সেই রকম গলায় স্ত্রীর হাত ধরে বললেন, ‘চলো, বাড়ি যাই।’ পত্নীদেবী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঝংকার দিয়ে উঠলেন, ‘না।’ মাতাল তখন হাতজোড় করে বললেন, ‘দেখুন, কিছু মনে করবেন না, আপনি অনেকটা আমার স্ত্রীর মতো দেখতে, তাই ভুল করেছিলাম, ক্ষমা করবেন।’ স্ত্রী এবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন, ‘বদমাইস, মাতাল, সব জায়গায় আমার মুখে কালি দিচ্ছ। তোমার মুখ শিল-নোড়া দিয়ে থেতলে দিলে আমার মনে শান্তি হবে।’ হতভাগ্য মদ্যপ আরও সংকুচিত হয়ে গেলেন, করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘দেখুন, আমার দোষ নেবেন না। আপনি যে শুধু আমার স্ত্রীর মতো দেখতে তাই নয়, আপনার কথাবার্তাও হুবহু আমার স্ত্রীর মতো।’

মাতালের গল্পের শেষ নেই। বত্রিশ পুতুল, চল্লিশ চোর কিংবা সহস্র এক আরব্য রজনীর চেয়েও দীর্ঘ সেই কথামালা। এই ধূলিমলিন, পাই পয়সা, শাকচচ্চড়ির গোমড়ামুখ পৃথিবীতে এখনও দু’-একটি মজার গল্প মাতীলেরাই রচনা করেন। তারা আমাদের নমস্য, তবে দূর থেকে।

নমস্কার করার আগে শেষ গল্পটা আমি বলি। এ গল্পটা আমি দু’ভাবে শুনেছি। এক, মদের দোকানে দু’জন অনেকক্ষণ ধরে মদ খাচ্ছে, শেষে একজন আরেকজনকে বলল, ‘এই তুই আর মদ খাসনে, তোকে কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছে।’ দুই নম্বর গল্প, পার্টিতে এক মহিলার পদপ্রান্তে এসে বসলেন এক মাতাল, তারপর মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘দেখুন, মদ খেলে আপনাকে বড় সুন্দরী দেখায়।’ ভদ্রমহিলা লেমনেড খাচ্ছিলেন, বললেন, ‘কিন্তু আমি তো মদ খাচ্ছি না।’ ভদ্রলোক সংশোধন করে বললেন, ‘না না, আপনার কথা নয়, আমি তো মদ খাচ্ছি!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *