পোড়া বই
চিরকাল বিদগ্ধ পাঠকের কথা শুনেছি। এবারের বইমেলা নিজেই বিদগ্ধ হয়েছিল।
পুড়ে যাওয়ার পরের দিন খুব সকালে বইমেলায় গিয়েছিলাম। আগের দিন সন্ধ্যাবেলা থেকে মনটা কেমন খুঁত খুঁত করছিল বইমেলায় আগুন লেগেছে শুনে। কিন্তু সেদিনের সন্ধ্যাবেলার মেঘ ও বৃষ্টি উপেক্ষা করে এই শীতের রাত্রে সুদূর সল্টলেক থেকে ময়দানে যেতে ভরসা পাইনি।
ময়দানের যে জায়গাটায় বইমেলা, সেই জায়গাটা আমার খুব চেনা। এর বিপরীত দিকে চৌরঙ্গি রোডের ওপারে রাসেল স্ট্রিটের কাছে প্রায় দশ-বারো বছর ছিলাম। ময়দানের এই অঞ্চলে প্রায় প্রতিদিন ভোরে হেঁটেছি সে সময়।
মেলার কাছে পৌঁছে সবাই যা দেখেছে আমিও তাই দেখলাম। জলে-কাদায় মাখামাখি পোড়া কাগজ, বাঁশ-কাঠ, ইতস্তত জুতো ও চপ্পলের পাটি। ভিজে যাওয়া পোড়া কাগজের একটা গন্ধ আছে, সকালবেলার বাতাসে সেটা থমথম করছে।
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরে আসছিলাম। গেটের এপাশটায় দেখি আধপোড়া বইয়ের গাদা। যেসব বই উদ্ধার করা হয়েছিল, তার মধ্যে বেশি পুড়ে যাওয়া বইগুলো বিক্রি হবে না বলে পুস্তক ব্যবসায়ীরা ফেলে দিয়েছেন।
কী বই, কীরকম বই কৌতূহলভরে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে সামনে থেকে একটা বই তুলে নিলাম। একটা ইংরেজি বই, বেশ ভাল প্রকাশকের ছাপা। আশেপাশে আরও দু’-চারখানা একইরকম বই। এরই মধ্যে একখানা বই পেয়ে গেলাম কৌতুককাহিনীর। দুই মলাটই পোড়া, সামনের দিকে প্রায় ফর্মা দুয়েক নেই, মধ্যের অংশও আধপোড়া, শেষটুকু ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে।
বইটির কী নাম, কার লেখা, কিছুই জানি না। কোনওদিন হয়তো জানাও যাবে না। তবে এসব বইয়ের মজা এই যে ইতস্তত দু’-চার পৃষ্ঠাও পড়া যায়।
বইটা হাতে নিয়ে বাড়ি চলে এসেছি। অবশিষ্ট পাতাগুলি যেটুকু পড়া যাচ্ছে পড়ে মনে হচ্ছে কৌতুহল-উদ্দীপক এবং বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুককাহিনীর সংকলন এবং সবই বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে।
একেবারে সামনের দিকে অর্ধদগ্ধ পৃষ্ঠাগুলি মহেঞ্জোদরোর শিলালিপির মতো বহু চেষ্টায় পাঠোদ্ধার করে প্রথমেই পেয়ে গেলাম ফ্রয়েডকে নিয়ে একটা কাহিনী।
আধুনিক মানুষের চিন্তাধারাকে যাঁরা গত শতকের শেষে এবং এই শতকের প্রথমে সবচেয়ে বেশি ঝাঁকি দিয়েছিলেন মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁদের অন্যতম শুধু নন, বিশিষ্টতমদের একজন।
ফ্রয়েড যদিও পরে নাজি অত্যাচারের ভয়ে লন্ডন চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তবু তাঁর বসবাস, কাজকর্ম, প্রতিষ্ঠা সবই ভিয়েনায়।
তখন ফ্রয়েড খুবই বিখ্যাত। জগৎজোড়া নাম তাঁর। সারা পৃথিবী থেকে মনোরোগীরা তাঁর কাছে আসে, তাঁদের অধিকাংশই সচ্ছল এবং অভিজাত পরিবারের।
ধীরে ধীরে সরকারি আয়কর দপ্তরের নজরে এল ব্যাপারটা। আয়কর দপ্তর ফ্রয়েডকে নোটিশ পাঠালেন তাঁর বার্ষিক আয় জানানোর জন্যে। নোটিশটি পেয়ে ফ্রয়েড খুব হেসেছিলেন, বলেছিলেন, ‘যাক, এতদিনে তা হলে আমার কাজের একটা সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া গেল।’
আততায়ীর গুলিতে নিহত দুই শতকের দুই মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাদৃশ্যের একটা তালিকা এই বইতে পেলাম।
সাদৃশ্যগুলি প্রায় অবিশ্বাস্য। হাজার বছরেও দুটি হত্যাকাহিনী ও তার নায়ক এবং আততায়ীদের মধ্যে এতখানি মিল পাওয়া অসম্ভব।
মার্কিন রাষ্ট্রপতিদ্বয় হলেন আব্রাহাম লিঙ্কন এবং জন এফ কেনেডি। লিঙ্কন জন্মেছিলেন ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে আর কেনেডি জন্মেছিলেন ঠিক একশো বছর পরে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে।
আব্রাহাম লিঙ্কন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে, কেনেডি ১৯৬০-এ।
দুই রাষ্ট্রপতিকেই মাথার পিছনে গুলি করে হত্যা করা হয়। দু’জনারই স্ত্রী সেই সময়ে সঙ্গে ছিলেন। লিঙ্কনের হত্যাকারী বুল জন্মেছিলেন ১৮৩৯ সালে, কেনেডির হত্যাকারী অসওয়াল্ড জন্মায় ১৯৩৯ সালে। দু’জনেই একশো বছর ব্যবধানে একই শহরের অধিবাসী ছিল। দু’জনারই মৃত্যু হয়েছিল গ্রেপ্তার হওয়ার পরে, আদালতে হাজির হওয়ার আগে।
খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে লিঙ্কনের হত্যাকারী বুল থিয়েটারের মধ্যে লিঙ্কনকে মেরে গাড়ি করে পালিয়েছিল। আর কেনেডির হত্যাকারী অসওয়াল্ড কেনেডিকে গাড়ির মধ্যে মেরে থিয়েটারের মধ্যে পালিয়েছিল।
আর বেশ কয়েকটি চমকপ্রদ মিল আছে এই দুই রাষ্ট্রপতির মধ্যে। লিঙ্কনের ব্যক্তিগত সচিবের নাম ছিল কেনেড়ি আর কেনেডির ব্যক্তিগত সচিবের নাম ছিল লিঙ্কন।
এবং এটাও উল্লেখযোগ্য যে লিঙ্কনের পর যিনি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হন তাঁর নাম জনসন। কেনেডির পরের রাষ্ট্রপতির নামও জনসন।
এ রকম আরও বহু বৃত্তান্ত রয়েছে বইটিতে। সব পড়া যাচ্ছে না, যেটুকু পড়া যাচ্ছে সেটুকুও ভাল করে পড়া যাচ্ছে না। অনুমানে পড়তে হচ্ছে।
আজকালের মধ্যে আর একদিন বইমেলায় নাম-না-জানা, পুড়ে যাওয়া, পড়ে পাওয়া বইটির খোঁজ করব। আসল বইটিকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করব। পেয়ে গেলে আরও দু’-চারটি অনুরূপ বৃত্তান্ত ‘কী খবর’ পাঠক-পাঠিকাদের উপহার দেব।