Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পিয়ো হে পিয়ো || Tarapada Roy

পিয়ো হে পিয়ো || Tarapada Roy

মদের ব্যাপারে আমার দুর্বলতা অপরিসীম এবং সুবিদিত। তবে আত্মপক্ষ সমর্থনে একটি কথাই বলতে পারি যে মদের ব্যাপারে লেখা নিয়ে যতটা আমার দুর্বলতা, পান করার ব্যাপারে তা নয়।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এই প্রাচীন, ভুবনমনোমোহিনী পানীয়টির প্রতি আমার কিঞ্চিৎ পক্ষপাত রয়েছে, বিশেষ করে আমার লেখায়। এক বাক্যে বলা উচিত, আমি সুরার গুণগ্রাহী।

চার্লস ল্যাম্ব, সেই বহুখ্যাত ইংরেজ লেখক, স্বপ্ন দেখেছিলেন, যদি কখনও বিয়ে করেন তা হলে জমিদারের মেয়ে বিয়ে করবেন এবং তখন তিনি সুখে পানশালায় বসে ঠান্ডা ব্রান্ডি জল দিয়ে পান করতে পারবেন।

ঠিক এই ধরনের স্বপ্ন দেখা আমার অভ্যাস নেই। আবার মহাকবি ওমর খৈয়ামের মতো আমি পান করা সম্পর্কে এ রকম কথাও বলতে পারব না—

‘পান করো। কারণ তুমি জানো না কোথা থেকে এসেছ,

পান করো। কারণ তুমি জানো না তুমি কোথায় যাবে।’

ব্যাপারটা একটু খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে, সুতরাং আরও দু’-একটা খাপছাড়া ঘটনা বলে নিচ্ছি।

মার্কিন দেশে এক ছোট শহরের এক শেরিফ ভয়ংকর মদ্যপান বিরোধী। তিনি বিশেষ করে অপছন্দ করেন মদ খেয়ে গাড়ি চালানো। যদি কখনও কোনও মাতাল ড্রাইভার তাঁর হাতে পড়ে তা হলে সেই মাতালের মোটেই অব্যাহতি নেই। তিনি সোজা সেই ড্রাইভারকে নিয়ে যান জেলখানায়, সেখানে জেলখানার বাঁধানো উঠানে নিজের হাতে টেনে দেন চক দিয়ে লম্বা লম্বা সাদা লাইন। তারপর ড্রাইভারকে নির্দেশ দেন,—এই লাইনের উপর দিয়ে সরাসরি হেঁটে যাও, বাঁয়ে ডাইনে যে কোনও দিকে হেলে পড়লে সাজা হবে।

কিন্তু মজার কথাটা এই যে শেরিফ সাহেব কখনওই চক দিয়ে লাইনটা সোজা টানতে পারেননি। তার কারণ আর কিছুই নয়, তিনি নিজেই সব সময়ে মদে চুর থাকেন, তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না উবু হয়ে উঠোনে বসে সোজা লাইন টানা। সেই আঁকা বাঁকা লাইন দিয়ে টলতে টলতে মাতাল ড্রাইভারেরা চলে যায় অনায়াসে, শেরিফ সাহেব তাদের ধরতে পারেন না, পারেন না তাদের সাজা দিতে।

আরেকটি হাস্যকর ঘটনা, সেটিও মার্কিনি এবং সেটিও গাড়ি চালানো সংক্রান্ত। মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর অপরাধে এক ব্যক্তিকে পুলিশ আদালতে চালান দেয়। সে তার জবানবন্দিতে বলে,—আমার মত্ত অবস্থায় গাড়ি না চালিয়ে উপায় নেই। কারণ আমার বউ আমাকে বাড়িতে মদ খেতে দেয় না। তাই পুরো বোতলটা গাড়িতে বসে আমাকে খেয়ে নিতে হয়।

এর পরের আরেকটি দিশি ঘটনা বোধ হয় তেমন হাস্যকর নয়, কিন্তু অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর দায়ে গ্রেপ্তার হন এক ভদ্রলোক; পরে পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে যে ভদ্রলোক একজন মোটর ভিহিকল ইনস্পেক্টর, তাঁর বৃত্তি হল গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্সের টেস্ট নেয়া এবং সবচেয়ে বড় কথা তিনি নিজে গাড়ি ঠিকমতো চালাতে জানেন না। শুধু তাই নয়, তাঁর নিজেরই কোনও রকম গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই।

মত্ততা বিষয়ক আইন-আদালতীয় ঘটনা লিখে শেষ করা যাবে না। বরং আদালতের প্রাঙ্গণ ছেড়ে এবার আমরা সরাসরি পানশালায় প্রবেশ করি!

পানশালার এই গল্পটির সম্পূর্ণ দায়িত্ব এবং কৃতিত্ব আমার প্রিয় বন্ধু সুরসিক শ্রীযুক্ত হিমানীশ গোস্বামীর, আমি অনুলেখক মাত্র।

এক সুরাবিলাসী নিয়মিত পানশালায় যান। কিন্তু তাঁর স্বভাব কিঞ্চিৎ বিচিত্র, তিনি সব সময়ে একসঙ্গে দু’গেলাস পানীয়ের অর্ডার দেন। ফুরিয়ে গেলে তারপর আবার দু’গেলাস। আবার দু’গেলাস। সব সময়ে একসঙ্গে দু’গেলাস, কিছুতেই এক গেলাস নয়।

একদিন এক দুঃসাহসী, কৌতূহলী বেয়ারা ওই ভদ্রলোককে বিনীতভাবে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা স্যার, একটা কথা, যদি কিছু মনে না করেন। ভদ্রলোক গেলাস থেকে ঠোঁট তুলে নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কী কথা?’ বেয়ারা মাথা চুলকিয়ে বলল, ‘না স্যার, তেমন কিছু নয়, এই আপনি এক সঙ্গে একেক বারে দু’গেলাস করে নেন কেন?’

এই প্রশ্নে ম্লান হেসে ভদ্রলোক এক করুণ কাহিনী শোনালেন, ‘আমার প্রাণের বন্ধু ছিল প্রাণেশ। প্রাণেশ আর আমি সব সময়ে এক সঙ্গে মদ খেতাম। প্রাণেশ খুব ভালবাসত মদ খেতে। সে আজ কিছুদিন হল মারা গেছে। কিন্তু আমার আর একা মদ খেতে ইচ্ছে করে না। তাই সব সময়ে দু’গেলাস নিই। এক গেলাস প্রাণেশের জন্যে, আর অন্য গেলাস আমার।’

এর কিছুকাল পরে হঠাৎ দেখা গেল স্বর্গীয় প্রাণেশের প্রাণের বন্ধু সেই ভদ্রলোক পানশালায় এসে দু’গেলাসের বদলে এক গেলাসের অর্ডার দিয়েছেন। এই নিয়মভঙ্গ দেখে আগের দিনের সেই দুঃসাহসী বেয়ারা বলল, ‘কী হল স্যার, আজকে আপনার বন্ধুর জন্যে আরেক গেলাস নিলেন না?’ ভদ্রলোক একটু ম্লান হেসে গেলাসে ছোট একটা চুমুক দিয়ে বললেন, ‘এটা তো আমার বন্ধুরই গেলাস। আমার গেলাস লাগবে না। আমি কাল থেকে মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।’

অন্য এক অদ্বিতীয় মাতালের গল্প বলি। তিনি একদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল তিনটার সময় অফিস গেলেন। অফিসের ম্যানেজার তাঁকে ধরলেন, ‘কী ব্যাপার রমেশবাবু? বেলা তিনটের সময় অফিসে হাজিরা দিতে এসেছেন, ছুটির সময়ই তো হয়ে গেল।’

নতমুখে রমেশবাবু বললেন, ‘স্যার, ব্যাপারটা খুবই অন্যায় হয়ে গেছে কিন্তু দোষটা ঠিক আমার নয়।’

শুনে আরও রেগে গিয়ে স্যার মহোদয় প্রশ্ন করলেন, ‘দোষ যদি আপনার না হয়, তা হলে আপনি দেরি করে আসার সব দোষ নিশ্চয় আমার।’

রমেশবাবু আরও নরম হয়ে গেলেন, ‘না স্যার। কথাটা ঠিক তা নয়, ব্যাপারটা আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলি। আপনি তো জানেন স্যার কাল ছুটি ছিল। সন্ধ্যাবেলা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বসে একটু নেশা করলাম। আমি আবার মাত্রা ঠিক রাখতে পারি না। রাত তিনটে পর্যন্ত মদ খেয়ে চুর হয়ে বাড়ি ফিরলাম।’

স্যার অস্থির হয়ে উঠলেন, ‘কী বলবেন বুঝতে পেরেছি।’

ক্ষীণ প্রতিবাদ করলেন রমেশবাবু, না স্যার, বুঝতে পারেননি। আমি বেলা পর্যন্ত ঘুমোইনি, সকালবেলা হ্যাংওভার ছিল, কিন্তু ঠিক সময়েই ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। দ্বিতীয়বার ঘুম থেকে উঠে দেখি দশটা বেজে গেছে। এদিকে তখন বেশ নেশা রয়েছে। তাড়াতাড়ি উঠে দাড়ি কামাতে গেলাম। আয়নায় তাকিয়ে দেখি আমি নেই। কেমন খটকা লাগল। বুঝলাম, আমি অফিসে চলে গেছি।’

চোখ গোল গোল করে স্যার বললেন, ‘তারপর।’

রমেশবাবু বললেন, ‘আর তারপর। আবার ঘুমোলাম, দুটোয় ঘুম থেকে উঠে নেশা কাটতে ব্যাপারটা ধরতে পারলাম। না, আমি অফিস যাইনি শুধু আয়নার কাচটা খুলে গেছে, তাই নিজেকে দেখতে পাইনি। ভুল বোঝা মাত্র এই ছুটে এলাম।’

আজগুবি গল্প ছেড়ে প্রত্যক্ষ ঘটনায় ফিরে যাচ্ছি। আবার মাতাল ও আদালত।

কলকাতার ব্যাঙ্কশাল স্ট্রিটের মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এক ব্যক্তিকে পুলিশ অভিযুক্ত করে মাতলামি এবং রাস্তায় হল্লা করার অভিযোগে। লোকটি জামিনে খালাস ছিল কিন্তু মামলার দিন আদালতে অনুপস্থিত হওয়ায় তার নামে ওয়ারেন্ট বেরোয়। পরের তারিখে পুলিশ তাকে আদালতে উপস্থিত করলে সে আগের তারিখে তার অনুপস্থিতির জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে এবং জানায় আগের তারিখে তার উপায় ছিল না আদালতে আসার, কারণ সে তখন ছিল হাওড়া জেলে। জেলে কেন ছিল একথা আদালত জানতে চাওয়ায় সে নির্বিকারভাবে বলে, ‘একটা ছোট মামলায়। মাতলামি আর হল্লা করার জন্যে পুলিশ আমাকে চালান দিয়েছিল।’

পানীয় বিষয়ক এই তরল কথিকা একটি মহাজন বাক্য দিয়ে শেষ করি। মহামতি শেক্সপিয়ার আক্ষেপ করেছিলেন ‘ওথেলো’ নাটকে (দ্বিতীয় অঙ্ক, তৃতীয় দৃশ্য):

‘—হায় ঈশ্বর। মানুষেরা কেন তাদের বুদ্ধিকে ঢাকা দেয়ার জন্যে শত্রুকে গ্রহণ করবে তাদের মুখের মধ্যে; কেন তারা আনন্দ, উত্তেজনা আর হইহল্লায় মেতে নিজেদের পশুতে রূপান্তরিত করবে?’

মহাকবির এই জিজ্ঞাসার উত্তর আমার জানা নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *