Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নিমন্ত্রণ || Tarapada Roy

নিমন্ত্রণ || Tarapada Roy

নিমন্ত্রণ

নিমন্ত্রণ কথাটার মধ্যে একটা বাজনা আছে, একটা জৌলুস আছে, সেই তুলনায় ইংরেজি ‘ইনভিটেশন’ শব্দটা খুব সাদামাটা।

জন্মদিন বা বড়দিনের নিমন্ত্রণ আমরা সাহেবদের কাছ থেকে নিয়েছি। কিন্তু আমাদের নিজেদের নিমন্ত্রণের তালিকাও অতি-দীর্ঘ।

শুধু বিয়ের নিমন্ত্রণের কথাই ধরা যাক, পাকা দেখার নিমন্ত্রণ, আশীর্বাদের নিমন্ত্রণ, গায়ে হলুদের নিমন্ত্রণ, তারপর বিয়ে, বাসি বিয়ে, ফুলশয্যা, বউভাত, অষ্টমঙ্গলা থেকে দ্বিরাগমন পর্যন্ত নিমন্ত্রণের আর শেষ নেই।

একজন সাধারণ বঙ্গজনের কথাই ধরা যাক, তিনি জন্মানোর আগে থেকেই তাঁকে নিয়ে নিমন্ত্রণের সূচনা। মাতৃগর্ভে থাকার সময়েই তাঁর আসন্ন জন্ম নিয়ে সাধের নিমন্ত্রণ। তারপর আটকড়াই থেকে অন্নপ্রাশন, বছর বছর জন্মদিন, বিয়ে, বিবাহবার্ষিকী। এমনকী মৃত্যুর পরে চতুর্থী, ঘাট, শ্রাদ্ধ, মৎস্যমুখী। এবং সেখানেও শেষ নয়, যতদিন না গয়াধামে পিণ্ডদান করা হচ্ছে, বৎসরে বৎসরে বার্ষিক শ্রাদ্ধ। ফিরিস্তি বাড়িয়ে লাভ নেই। বরং সরাসরি নিমন্ত্রণপত্রে চলে যাই। নিমন্ত্রণপত্র মানে বিয়ের, শুভবিবাহের নিমন্ত্রণপত্র। এই বিয়ের মরশুমে হলুদ এবং সিঁদুর ফোঁটা দেওয়া গোলাপি নিমন্ত্রণ চিঠিতে বাড়িতে বাড়িতে ডাকবাক্স ভরে গেছে। নানা আকারের, রংবেরংয়ের সব চিঠি।

কিন্তু এই সব চিঠিরই এক গৎ, বাঁধা বুলি। সেই ‘ওঁ প্রজাপতয়ে নম’ দিয়ে শুরু আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইনের উল্লেখ দিয়ে শেষ।

অধিকাংশ বিয়ের-চিঠিতে দুটি বাঁধা বয়ান দেখা যায়, যার সঙ্গে বিয়ের কোনও যোগ বা সম্পর্ক নেই।

প্রথমটি হল ওই অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন বা Guest Control Act. এ বিষয়ে একটি কথা বলার আছে। অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন পালিত হবে, এ কথার অর্থ কী?

আমি কোনও আইন মান্য করব, একথা আমাকে ঘোষণা করতে হবে কেন? তা হলে তো প্রত্যেককেই গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে ঘুরতে হয়। যাতে লেখা থাকবে,

‘আমি চুরি করব না’,

‘আমি ডাকাতি করব না’

‘আমি খুন করব না’, ইত্যাদি।

আমি আইন মান্য করে চলব, আইন ভঙ্গ করব না, একথা ঘোষণা করতে হবে কেন? এটাই তো স্বাভাবিক। এর জন্যে মুদ্রিত নোটিশের কী প্রয়োজন!

নিমন্ত্রণপত্রের আরও কিছু কিছু আনুষঙ্গিক ব্যাপার আছে। সম্ভাষণের কথাই ধরা যাক। শ্রাদ্ধের চিঠিতে ‘সময়োচিত নিবেদন’, বলা যায়, চলতে পারে। কিন্তু শুভবিবাহের নিমন্ত্রণপত্রের সম্ভাষণ?

সুকুমার রায়ের হযবরল বইয়ের ‘কার্যঞ্চাগে’ মনে হলে হাসি পায়। কিন্তু ‘যথাবিহিত সম্মান পুরঃসর’ এখনও প্রায় প্রতিটি বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রে ব্যবহৃত হয়। নিমন্ত্রণকর্তা বহুক্ষেত্রেই সুশিক্ষিত ও বুদ্ধিমান। তিনি যে ভেবেচিন্তে এ রকম সম্ভাষণ করেন, তা নয়। কিন্তু সবিনয় নিবেদন করতে বাধা কোথায়?

অবশেষে নিমন্ত্রণপত্রের সবচেয়ে নীচে চলে যাই। যেখানে ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন’⋯ ইত্যাদির নীচে লেখা আছে, ‘লোকিকতার পরিবর্তে আশীর্বাদ প্রার্থনীয়।’

এই বাঁধা গৎ বা বয়ানটির ব্যাপারটাও গোলমেলে।

আমি এখন পর্যন্ত একটি বাড়ি ছাড়া আর কোথাও দেখিনি উপহার গ্রহণ না করতে। শুধু অনেকদিন আগে দেখেছিলাম এক কন্যাকর্তা উপহার দেওয়ার সময় কিছু বলেননি, কিন্তু পরের দিন ট্যাক্সি ভাড়া করিয়ে লোক দিয়ে সব উপহার বাসায় বাসায় ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দুটো উপহারের উপহারদাতাকে নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি। সে দুটো কন্যাকর্তা নিজে গিয়ে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে এসেছিলেন। আর একটি ব্যাপার শুনেছি। যদিও সেই নিমন্ত্রণপত্রটি আমি স্বচক্ষে দেখিনি। এক পণভারাতুর কন্যার পিতা (একদা কবিতা লিখতেন) নিমন্ত্রণপত্রের শেষে যোগ করিয়েছিলেন,

‘নাই খাদ্য, নাই পানীয়,
আসতে পারেন এই শর্তে
লৌকিকতার পরিবর্তে
আশীর্বাদ প্রার্থনীয়।’

নিমন্ত্রণপত্রের ব্যাপারটা মোটামুটি হল। এবার একটু নিমন্ত্রণ রক্ষার চেষ্টা করি।

নিমন্ত্রণ রক্ষার চেষ্টার গল্পটা খুবই করুণ। অনেকদিন আগে পাটনা শহরে এই ঘটনাটা ঘটেছিল। কী একটা সাহিত্যসভায় আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম। সময়টা বোধহয় মে মাস, রবীন্দ্রজয়ন্তীর কাছাকাছি সময়। পাটনায় পৌঁছেই বিকেলে সাহিত্যসভা। তারপরে সন্ধ্যায় নৈশবাসর, সেখানে প্রচণ্ড হই-হল্লা-ফুর্তি।

সেই হই হল্লার মধ্যে স্থানীয় এক সাহিত্যপ্রেমিক আমাদের অনুরোধ করলেন, পরদিন তাঁর ওখানে মধ্যাহ্নভোজন করতে। যেহেতু আমাদের ফেরার গাড়ি পরদিন রাতে সুতরাং, আমরা রাজি হয়ে গেলাম। পরের দিন দুপুরে বুঝতে পারলাম, নিমন্ত্রণ গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। খরগ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে পাটনা শহর গনগন করে জলছে, লু বইছে। রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। চারদিক থেকে আগুনের হলকা আসছে।

কোনও রকমে রিকশা জোগাড় করে অচেনা শহরে অনেক ঘুরপাক খেয়ে নিমন্ত্রণকর্তার গৃহে পোঁছলাম। তিনি তো আমাদের দেখে অবাক। আমরা খবর পাইনি শুনে, তিনি খুবই খেদ প্রকাশ করলেন, একটু আগেই তিনি আমাদের হোটেলে ফোন করে আমাদের জানাতে বলে দিয়েছেন, ‘ইনভিটেশন ক্যানসেল হো গয়া।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *