Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গোলমাল || Tarapada Roy

গোলমাল || Tarapada Roy

গোলমাল

গোলমাল শব্দের অর্থ গণ্ডগোল। গণ্ডগোল শব্দের অর্থ গোলমাল।

আসলে গোল, গণ্ডগোল, গোলযোগ, গোলমাল সবগুলি শব্দেরই প্রায় একই অর্থ, ব্যবহারও একই রকম। এর সব কয়টিই বাংলায় সমান চালু। কিন্ত শব্দগুলির ব্যুৎপত্তির ইতিহাস খুবই গোলমেলে।

মূল ‘গোল’ শব্দটি ফারসি। তার তিন রকম মানে। তিন রকম অর্থেই বাংলা ভাষায় এর ব্যবহার।

প্রথম অর্থ হল, উচ্চ রব। আধুনিক বাংলা নাটকের গানে আছে, ‘গোল কোরো না, কথা বোলে না, ভগবান ঘুমিয়ে আছেন।’

দ্বিতীয় অর্থ হল, জটিলতা, প্যাঁচ, সারল্যের অভাব। যেমন লোকে বলে, ‘এম এল এ সাহেবের মনে গোল আছে।’

তৃতীয় অর্থ হল, ফ্যাসাদ। আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকোয় চড়তাম না। না বুঝে গোলে জড়িয়ে পড়া।

এত উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই। এই স্বল্প পরিসর রচনায় আমাকে গোলমালের গল্পে যেতে হবে। যাওয়ার পথে আরও দুয়েকটা জ্ঞানের কথা বলে নিই।

গণ্ড মানে বড়। গণ্ডগ্রাম মানে সচরাচর ভাবা হয়, তা নয়। গণ্ডগ্রাম ছোট গ্রাম নয়, বেশ বড় গ্রাম। তেমনই গণ্ডগোল খুব বড় গোল।

গণ্ডগোল শব্দটির গঠনও লক্ষণীয়। প্রথম অংশ গণ্ড সংস্কৃত, দ্বিতীয় অংশ গোল ফারসি। গোলযোগে ঠিক এর বিপরীত প্রথমে ফারসি, পরে সংস্কৃত।

আর গোলমাল শব্দটি? সে নিয়ে খুবই গোলমাল। গোল শব্দটি ফারসি থেকে সরাসরি বাংলায় এসেছে কিন্তু গোলমাল এসেছে হিন্দি কিংবা উর্দু হয়ে উত্তর ভারতের রাস্তা ধরে কাজির আদালত, ফৌজি শিবির কিংবা জরিপি তাঁবু মারফত।

কবি বলেছিলেন, শব্দ ব্রহ্ম। ব্রহ্মের কথা, শব্দের কথা থাক, আপাতত থাক; এবার বাচ্যে যাই। বাচ্য থেকে অনুচ্ছেদে। একেকটি অনুচ্ছেদে একেকটি গল্প নয়। সব মিলে এটি আরেকটি গোলমেলে কথিকা।

গোলমালের এই গল্পটি বারবার বলার মতো। তাই বারবার বলছি।

প্রকৃতপক্ষে এটা ঠিক কোনও গল্প নয়।

চল্লিশের দশকের একটি অতি ফ্লপ হলিউডি ছবির চিত্রনাট্যের একটি অংশ। বলা বাহুল্য, সেই যুদ্ধের এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাজারে এতটা হালকা ব্যাপার মোটেই প্রশ্রয় পায়নি। চার্লি চ্যাপলিনই প্রায় বাতিল হতে বসেছিলেন।

গল্পটা বলি, তারপর অন্য কথা।

একটা বড় হোটেলের পানশালায় এক ভদ্রলোক হাঁফাতে হাঁফাতে, দৌড়তে দৌড়তে প্রবেশ করলেন। ঢুকেই হাতের বুড়ো আঙুল ও মধ্যমার সহযোগে উচ্চরবে তুড়ি দিয়ে বেয়ারাকে ডেকে বললেন, ‘ভাই, আমাকে ডবল পেগ ব্র্যান্ডি দু’গেলাস চট করে দাও। তাড়াতাড়ি দিও, গোলমাল হওয়ার আগে দিয়ে দিয়ো৷’

বেয়ারা ছুটে গিয়ে দু’ গেলাসে দুই-দুই চার পেগ ব্র্যান্ডি এনে দিল। ভদ্রলোক পানীয়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘তোমাদের এখানে চিকেন তন্দুরি, ফিশ ফিঙ্গার পাওয়া যাবে?’ বেয়ারা বলল, ‘যাবে। খুব ভাল বানায় এসব এখানে।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘তা হলে দেরি করছ কেন? তাড়াতাড়ি যাও, গোলমাল লাগার আগে দু’ প্লেট নিয়ে এসো।’

বেয়ারা খাবার আনতে গেল। এসব খাবার নিয়ে আসতে একটু সময় লাগে। বানাতে সময় লাগে, আগের লোকদের আগে দিতে হয়।

মিনিট পনেরো পরে বেয়ারা যখন খাবারের প্লেট নিয়ে এল, তখন ভদ্রলোকের পানীয় শেষ। তিনি আবার অর্ডার দিলেন, ‘দু’ গেলাসে দুটো দুটো করে মোট চারটে ব্র্যান্ডি তাড়াতাড়ি নিয়ে এস। তাড়াতাড়ি করো, কখন গোলমাল লাগবে। এখনই নিয়ে এসো।

বেয়ারা আজ্ঞা পালন করল। কিন্তু তার মনে একটা খটকা লেগেছে। সাহেব বারবার ‘গোলমাল-গোলমাল’ করছেন কিন্তু গোলমাল কোথায়? কীসের গোলমাল?

কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে বেয়ারাটি ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, গোলমাল হবে, গোলমাল হবে তখন থেকে বলে যাচ্ছেন, কিন্তু কী গোলমাল, কীসের গোলমাল, কোনও গোলমাল তো দেখতে পাচ্ছি না।’

পানীয়ের গেলাসে শেষ চুমুক দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘গোলমাল কাকে বলে এখনই দেখতে পাবে। এই যে এত খাবার পেলাম, মদ খেলাম—কিন্তু আমার কাছে একটা পয়সাও নেই। এখন তুমি নিজে, তোমার ম্যানেজার গোলমাল শুরু করে দেবে।’

এই গোলমাল কাহিনীটির দুটি পরিণতি আমার জানা আছে।

প্রথম ক্ষেত্রে, বারের ম্যানেজারকে বেয়ারা গিয়ে ডেকে নিয়ে এল। ম্যানেজারসাহেব সব শুনে বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে? আপনার কাছে এখন টাকা না থাকতে পারে, পরে এসে কোনওসময় বকেয়াটা মিটিয়ে দিয়ে যাবেন।’

এ রকম সুপ্রস্তাবে বর্তমান ভদ্রলোক খুবই খুশি হলেন। তিনি উঠতে যাচ্ছিলেন, ম্যানেজারসাহেব বললেন, ‘আপনার নামটা বলে যান।’

ভদ্রলোক নিজের নাম বলে তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন?’ ম্যানেজারসাহেব বললেন ‘আমাদের বারের দেয়ালের একপাশে আপনার নামটা লিখে রাখব।’

ভদ্রলোক ছদ্ম উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বললেন, ‘সে কী কথা? তা হলে যে সবাই আমার নামটা দেখে ফেলবে।’ বলা বাহুল্য, দেয়ালে নাম লিখে রাখলে তাঁর যে কিছু আসে যায় না, সেটা ইনি ভালভাবেই জানেন, এখন একবার এ জায়গা থেকে বেরতে পারলে বাঁচেন, নেশাটা মাটি হতে চলেছে।

ম্যানেজারসাহেব এবার আশ্বাস দিলেন, ‘এ নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আপনার নাম স্যার কেউ দেখতে পাবে না। যেখানে নাম লেখা হবে তার ওপরে একটা পেরেক লাগিয়ে আপনার জামাটা খুলে সেই পেরেকে ঝুলিয়ে দিচ্ছি। নামটা ঢাকা পড়ে যাবে।’

এই বলে দেয়ালে নাম লিখতে লিখতে ম্যানেজারসাহেব বেয়ারাকে কড়া গলায় আদেশ দিলেন, ‘এই উল্লু, দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? স্যারের গায়ের জামাটা তাড়াতাড়ি খুলে নে।’

অতঃপর দ্বিতীয় পরিণতিটি।

ওই একই ঘটনা। ওই একই বার, একই ভদ্রলোক। সেই বেয়ারা, সেই ম্যানেজার।

বিলের টাকা মেটাতে না পারায় ভদ্রলোককে খুব মারধর খেতে হল ম্যানেজারের হাতে।

চুলের মুঠি ধরে দুই গালে দুটি থাপ্পড় কষিয়ে গলাধাক্কা দিয়ে ভদ্রলোককে ম্যানেজারসাহেব বার থেকে বিতাড়িত করলেন।

গলাধাক্কা খেয়ে বারের দরজা থেকে সামনের রাস্তায় ফুটপাতে মুখ থুবড়িয়ে পড়ে ভদ্রলোক যখন ওঠার চেষ্টা করছেন, সেই সময় বেয়ারাটা এসে তাঁকে এক লাথি মারল।

ব্যথিত ভদ্রলোক বেয়ারাকে বললেন, ‘ম্যানেজারই যথেষ্ট মারল, তুমি কেন?’

বেয়ারা বলল, ‘ম্যানেজার মারলেন বিলের জন্য, আর এই লাথিটা আমার বকশিশের জন্যে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *