Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কিঙ্কর-কিঙ্করী || Tarapada Roy

কিঙ্কর-কিঙ্করী || Tarapada Roy

কিঙ্কর-কিঙ্করী

নতুন কাজের মেয়েটি একটু দায়সারা ভাবে ঘর মুছছিল। তাই দেখে গৃহিণী তাকে বললেন, একটু ভাল করে, যত্ন নিয়ে ঘরের মেঝেটা মুছতে। নবনিযুক্তা পরিচারিকাটি এই কথা শুনে গালে হাত দিয়ে চোখ গোলগোল করে বলল, ‘অমন অলক্ষুণে কথা বোলো না গো, বউদি!’

পরিচারিকার এই জবাবে গৃহিণী রীতিমতো বিব্রত বোধ করলেন। ঘর মোছার মধ্যে সুলক্ষণ-অলক্ষণ কী আছে?

বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করতে হল না। মেঝে মোছা থামিয়ে পরিচারিকাটি নিজেই ব্যাখ্যা দিল, ‘আগের বাড়ির বউদি ঠিক এই রকম বলত, তাদের মেজে মুছে মুছে এমন পিছলে হয়ে গিয়েছিল যে দাদাবাবু পা হড়কে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভেঙে আজ চার মাস হাসপাতালে।’

স্বীকার করা উচিত যে, এই পরিচারিকাটি ভালভাবে ঘর না মোছর যে অব্যর্থ অজুহাত দেখিয়েছে তার তুলনা নেই। হয় সে খুব বুদ্ধিমতী, না হয় খুবই সরল।

পরিচালিকাদের সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণা একটু অন্যরকম ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রই বা কেন, সেই রামায়ণের মন্থরা থেকে সাহিত্যে কিঙ্করী-কীর্তন শুরু হয়েছে। দেশি-বিদেশি মহাকাব্য-নাটকে, গল্প-উপন্যাসে কিঙ্কর-কিঙ্করীর ভূমিকা কিছু কম নয়। বড়লোক দেশগুলিতে আজকাল অবশ্য উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিও ঝি বা চাকর রাখতে পারে না। আমাদের মতো দেশে ভৃত্যতন্ত্র এখনও চমৎকার চলছে, এবং আমাদের জীবনে তার ভূমিকা কিছু কম নয়। সকালে উঠে কাজের লোক ঠিকমতো না এলে, চিৎকার-চেঁচামেচি-হইচই, একটা সাধারণ পরিবারের চেহারা বদলিয়ে দেয়।

ঠিকে কাজের মেয়েটি এসে গেলেও খুব সুখকর নয়। অনেক সময়ই সে খুব মুখরা ও কলহপরায়ণা। তার চেয়েও বিপদ, সে প্রতিবেশীদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়।

বঙ্কিমচন্দ্রের কথা বলছিলাম, কৃষ্ণকান্তের উইলে’ বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন:

‘সুবিধা হউক, কুবিধা হউক, যাহার চাকরানি নাই তাহার ঘরে ঠকামি, মিথ্যা সংবাদ, কোন্দল এবং ময়লা এই চারিটি বস্তু নাই। চাকরানি নামে দেবতা এই চারিটির সৃষ্টিকর্তা। বিশেষ, যাহার অনেকগুলি চাকরানি, তাহার বাড়িতে নিত্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, নিত্য রাবণবধ।’

বঙ্কিমচন্দ্র হয়তো কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জন করে ফেলেছিলেন। কিন্তু আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে আমি নিজেও দু’-একটি মারাত্মক নমুনা দেখেছি।

একদিন সকালবেলায় দেখেছিলাম মনোহরপুকুর রোডে। গৃহস্থ বাজার করে ফিরছেন, প্রাক্তন (সম্ভবত সদ্য ত্যক্ত) পরিচারিকা পথের ওপরে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছিল। দৃষ্টিপথে আসামাত্র, অতিকায়া ভীমরূপা মহিলাটি চিল যেভাবে ইঁদুরছানা ধরে সেইভাবে কিংবা তার চেয়েও ক্ষিপ্রগতিতে ক্ষীণপ্রাণ, শীর্ণতনু তার পুরনো মনিবের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মনিব ভদ্রলোক একবারমাত্র কোঁক করার সুযোগ পেলেন, তার শার্টের কলার ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে পরিচারিকাটি কোনও অনির্দিষ্ট লক্ষে তাঁকে নিয়ে চলল। ভদ্রলোকের হাত থেকে তাঁর বাজারের থলে মাটিতে পড়ে গেল। ভদ্রলোেক সেদিন কয়েকটা তাজা ছোট ছোট কই মাছ কিনেছিলেন, পতিত থলে থেকে সেই চঞ্চল মাছগুলি বেরিয়ে ফুটপাথের উপর লাফাতে লাগল।

আমার স্মৃতিতে এই দৃশ্যটি অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। আমি হরিণঘাটার দুধ নিয়ে বাড়িতে ফিরছিলাম, হাতের বোতলের দুধ জমে দই হয়ে গিয়েছিল। পাঁচ বছর আগের ঘটনা। কিন্তু এ রকম তো আমারও হতে পারত। ভাবলে রীতিমতো হৃৎকম্প হয়।

অবশ্য আমাকে এখনও ব্যক্তিগতভাবে আমার গৃহভৃত্য বা পরিচারিকার হাতে নিগৃহীত হতে হয়নি। তবে বছর দুয়েক আগে আমার দুর সম্পর্কের এক শালার বউয়ের মাথায় রান্নার ঠাকুর আঘাত করায় তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। পাচকটির কোনও চুরি বা ডাকাতি করার উদ্দেশ্য ছিল না। গৃহিণী সকাল থেকে খিচখিচ করছিলেন, পাচক নিঃশব্দে রান্না করে যাচ্ছিল, হঠাৎ শেষ পর্যন্ত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ভাতের হাতা দিয়ে মনিবানীর মাথায় একটি আঘাত করে উধাও হয়ে যায়। বাসায় তখন আর কেউ ছিল না। ঠাকুরটি সদর দরজা ভেজিয়ে রেখে মোড়ের মাথায় ডাক্তারবাবুকে খবর দিয়ে যায়, ‘বারো নম্বর বাড়ির বউদির শরীরটা ভাল নেই। আপনাকে এখনই একবার ডেকেছে।’ সেদিন ডাক্তার এসে শূন্য গৃহে ওই শালাজকে ওইভাবে পড়ে থাকতে দেখেন, অবশেষে পাড়াপ্রতিবেশী ডেকে, সেবা-শুশ্রুষা কবে, ওষুধ দিয়ে মহিলার জ্ঞান ফেরানো হয়। পাচকটি কিন্তু আর আসেনি, তার আর খোঁজ পাওয়াই যায়নি।

আমার সেই মিষ্টভাষিণী, সদাহাস্যময়ী, সুন্দরী শালাজ সাতসকালে পাচকটিকে এমন কী কটুবাক্যে জর্জরিত করেছিলেন যাতে সে প্রভুপত্নীকে এমন নির্দয়ভাবে আঘাত করে, সে তথ্য কিন্তু জানা যায়নি। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে, চমৎকার সব মহিলারা কাজের লোকদের সঙ্গে অনেক সময় এমন আচরণ করেন যে, তাঁরা যে খুন-জখম হন না সেটাই আশ্চর্য।

তবে অনেক সময় গর্হিত কারণ থাকে। এক বনেদি বাড়ির চাকরটি সকালবেলা ঘর ঝাড়তে গিয়ে একটি অমূল্য ও সুপ্রাচীন কাটগ্লাসের ফুলদানি ভেঙে ফেলে। গৃহিণী খুব ক্ষুব্ধ ও দুঃখিত হয়ে বললেন, ‘এত পুরনো জিনিসটা এতদিন পরে ভেঙে ফেললে। কবে আমার দাদাশ্বশুরের বাবা বিলেত থেকে নিয়ে এসেছিলেন জিনিসটা।’ ভৃত্যটা দাত বার করে বলল, ‘তাই বলন, পুরনো মাল, আমি ভয় পেলাম নতুন জিনিস ভাঙলাম বুঝি।’ অতঃপর ভদ্রমহিলা এক গ্লাস জল ভৃত্যটির গায়ে ছুড়ে দিয়েছিলেন।

আমাদের বাড়িতে কিন্তু কখনও কোনও কাজের লোককে এ রকম করি না। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় না যে তা নয়; যখন দেখি রান্নাঘর থেকে চায়ের পেয়ালা টেস্ট করতে করতে নিয়ে আসছে। কারণ আর কিছু নয়, একটা চিনি ছাড়া, তিনটে চিনিওলা এবং কোনটা কী গুলিয়ে ফেলেছে, তখন মনে হয় ১৯৯১ সালে প্রকাশিতব্য অখণ্ড রবীন্দ্র রচনাবলি দিয়ে লোকটার মাথায় মারি।

তা যে করি না তার কারণ এই নয় যে, ওই ভারী বইটি এখনও প্রকাশিত হতে আট বছর বাকি। হাতের কাছে ভারী বইয়ের অভাব নেই, ইচ্ছে করলে ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ কিংবা যে বইয়ের উপর আমার স্পষ্ট অধিকার রয়েছে, আমাকে ও মিনতিকে উৎসর্গীকৃত ‘নীললোহিত সমগ্র’ দিয়েও মারতে পারি।

এই তো গত মাসের শেষ শনিবার। বাসায় আমি আর আমাদের একমাত্র কাজের লোক গোবিন্দ। শেষ শনিবার বা চতুর্থ শনিবার আমার অফিস বন্ধ। ভাইয়ের অফিস খোলা, ছেলের কলেজ খোলা। দু’জনেই বেরিয়েছে। স্ত্রীও কোথায় কেনাকাটা করতে বেরিয়েছেন।

বাড়িতে লোক বলতে আমি আর গোবিন্দ। টেবিলের ওপরে একটা দশ টাকার নোট পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দিয়ে বাথরুমে স্নান করতে গেছি, স্নান সেরে এসে দুটো রুমাল কিনতে যাব এই উদ্দেশ্যে।

দাড়ি কামিয়ে, স্নান করে জামাকাপড় পরে বেরতে যাব, ওমা, দেখি যে টেবিলে টাকাটা নেই।

সঙ্গে সঙ্গে গোবিন্দকে ধরলাম, ‘গোবিন্দ, এই টেবিলে পেপারওয়েটের নীচে দশটা টাকা রেখেছিলাম, সেটা কী হল?’

গোবিন্দ সরলভাবে বলল, ‘পেপারেট কী বাবু?’ আমি আরও রেগে গেলাম, কাচের কাগজচাপাটা তুলে দেখিয়ে বললাম, ‘এইটা, এর নীচে দশটা টাকা এইমাত্র ছিল, সেটা কী হল?’ গোবিন্দ সরলতরভাবে জানাল যে, এ বিষয়ে ঘুণাক্ষরেও সে কিছু জানে না। কোনও দশ টাকার নোট সে দেখেনি।

আমি বললাম, ‘দ্যাখো গোবিন্দ, বাড়িতে আমি আর তুমি ছাড়া কেউ নেই। বেশি চালাকি করবে না, টাকা দিয়ে দাও।’ গোবিন্দ বলল, ‘ঠিক আছে, আপনার কথা বুঝেছি বাবু, বেশি কথা বাড়াবেন না, পঞ্চাশ-পঞ্চাশ, ফিফটি ফিফটি হয়ে যাক। আপনারও পাঁচ টাকা যাক, আমারও পাঁচ টাকা যাক।’ বলে গোবিন্দ অম্লানবদনে একটি পাঁচ টাকার নোট আমাকে এগিয়ে দিল।

তবুও গোবিন্দকে কিছু বলিনি। গোবিন্দ, গোবিন্দের মা বা গোবিন্দের বউ, যখন যেই থাক কিঙ্কর-কিঙ্করী, কাউকে কিছু বলি না। মনোহরপুকুরের ভদ্রলোক আর শালার বউয়ের পরিণতির কথা মনে করে আত্মসংবরণ করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *