ঈশ্বর সমীপে
একটি ছোট মেয়ে একটা গিনিপিগ পুষত। সবসময় গিনিপিগটাকে নিয়ে খেলা করত, খুবই ভালবাসত সে এই ছোট জন্তুটাকে, সাদা-কালো লোমের, জুলজুলে ফিকে নীল চোখের গিনিপিগটাকে।
যেমন হয়ে থাকে, একদিন গিনিপিগটা দেহরক্ষা করল। ছোট মেয়েটা তো কেঁদেকেটে অস্থির। কিছুদিন আগে তার এক দাদু মারা গিয়েছিল। তার দাদুকে শ্মশানে নিয়ে পোড়ানো হয়েছিল। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বায়না ধরল তার সাধের গিনিপিগটাকেও দাহ করে শেষ সৎকার করতে হবে। তাকে অনেক বোঝানো হল যে যেহেতু গিনিপিগ মানুষ নয় তাই এটাকে না পুড়িয়ে মাটি খুঁড়ে কবর দিতে হবে। তাকে আরও বোঝানো হল যেসব মানুষকে পোড়ানো হয় না, অধিকাংশকেই কবর দেওয়া হয়।
অনেক ভাবনাচিন্তা করে, চোখের জল মুছে অবশেষে মেয়েটি রাজি হল তার প্রিয় গিনিপিগকে কবর দিতে। তার বাবা একটা পুরনো জুতোর বাক্সে মৃত গিনিপিগটা ভরে বাড়ির পিছনের বাগানে একটা চৌকো মতন গর্ত করে তার মধ্যেই সেই জুতোর বাক্সটা সুদ্ধ গিনিপিগটা কবর দিলেন।
কবর দেওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরে মেয়েটি তার বাবাকে প্রশ্ন করল, ‘বাবা আমাদের এই বাক্সটা কি এবার স্বর্গে ভগবানের কাছে পৌঁছে যাবে? মেয়েকে আশ্বস্ত করার জন্যে তার বাবা বললেন, ‘তা নিশ্চয়ই যাবে।’ তখন মেয়েটি মোক্ষম কথা বলল, ‘বাবা ভগবান যখন বাক্স খুলে দেখবেন ভেতরে কোনও জুতো নেই, মরা গিনিপিগ রয়েছে, নিশ্চয়ই আমাদের উপর খুব চটে যাবেন।’
সত্যিই এক্ষেত্রে জুতোর বাক্স খুলে জুতো না পেয়ে ভগবান ওই বালিকাটি এবং তার পিতৃদেবের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন কিনা তা বলা আমার সাধ্য নয় কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে ঈশ্বর বিষয়ে অনেকের চিন্তাই ওই মেয়েটির ভাবনার মতোই সাদামাটা।
এক সরলপ্রাণা সাধ্বী রমণীর কথা বলি। তিনি একটি বিখ্যাত কালীমন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিলেন। এর আগে তিনি এই মন্দিরে আর কখনও যাননি।
সব বড় মন্দিরে যেমন হয় প্রধান দেবতা বা দেবী ছাড়াও অন্যান্য দেবদেবীর ছোট বড় মন্দির পাশেই থাকে। এই কালী মন্দিরেও তাই। পাশেই শিবলিঙ্গ, তার পাশে অন্নপূর্ণার মন্দির, সোনার গৌরাঙ্গ, লক্ষ্মীনারায়ণ—এমনকী মন্দিরে ঢোকার গেটের পাশে একটা ছোট চালায় একটা শীতলা মন্দিরে সত্য অর্চিতা প্রতিমা অধিষ্ঠিতা রয়েছেন।
ভদ্রমহিলা শীতলা মন্দির পার হয়ে মন্দিরের ভিতরে ঢুকে সামনেই অন্নপূর্ণার মন্দির পেলেন, সেখানে গড় হয়ে প্রণাম করে তারপর আঁচল খুলে একটি রুপোর টাকা বার করে সামনের প্রণামীর থালায় রাখলেন। খাঁটি রুপোর বনেদি টাকা, পঞ্চাশ বছর আগের পঞ্চম জর্জীয় নিকষকুলীন রৌপ্যমুদ্রা। বহুদিন ধরে সুরক্ষিত। এই মুদ্রাটি তিনি এই মন্দিরের মা কালীর কাছে মানত করেছিলেন।
প্রণামীর থালায় টাকা রেখে অন্নপূর্ণার মন্দির থেকে বেরিয়ে আসতেই তাঁর খেয়াল হল এটা কালী মন্দির নয়। সামনে উঠোনের ওপাশে খুব ভিড় ওখানেই রয়েছে মা কালীর মন্দির এবং এই রৌপ্যমুদ্রাটি এই অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণীর নয় ওই কালীমাতার প্রাপ্য।
এরপর ভদ্রমহিলা প্রভূত চেষ্টা করেছিলেন অন্নপূর্ণার প্রণামীর থালা থেকে রৌপ্যমুদ্রাটি উদ্ধার করার কিন্তু বলা বাহুল্য তাঁর সে প্রয়াস সফল হয়নি। তিনি ক্ষুন্ন মনে, ব্যথিত চিত্তে মানত পালন করা হল না বলে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। সবাই তাঁকে বুঝিয়েছিল যে এতে কিছু আসে যায় না অন্নপূর্ণাকে দিলেই মা কালীকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি সেকথা মানেননি। বহু কষ্টে এবং রীতিমতো অর্থব্যয়ে অনুরূপ একটি নিকষকুলীন রৌপ্যমুদ্রা সংগ্রহ করে পরেরবার তিনি সঠিক স্থানে দিয়ে এসেছিলেন। আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘এত কি দরকার ছিল?’ তিনি বলেছিলেন ‘মা কালী আমাকে গুরুতর বিপদের দিনে রক্ষা করেছিলেন। আমি মানত করেছিলাম, সে মানত রক্ষা না করলে মহাপাতকী হতাম।’
কঠিনতম স্বীকারোক্তি করেছিলেন আলেকজান্দার দুমা, ‘থ্রি মাসকেটিয়ারস’ খ্যাত সেই ঊনবিংশ শতকের বিপুল প্রতাপান্বিত ফরাসি ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার। বলা বাহুল্য, দুমা সাহেবের ঈশ্বর বিশ্বাস বা ভগবভক্তি খুব প্রবল ছিল না।
সে যা হোক, হয়তো কোনও রচনার প্রয়োজনেই আলেকজান্দার দুমা একদা এক প্রবীণ যাজককে অনুরোধ করেছিলেন যে তার প্রার্থনাগুলো যেন তিনি দুমা সাহেবকে বলেন।
যাজক মহোদয় একটু বিস্মিত হয়ে উলটে দুমা সাহেবকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কি এসব বিশ্বাস করেন?’ বুদ্ধিমান আলেকজান্দার দুমা বলেছিলেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, আমি এসব বিশ্বাস করি না। কিন্তু যখন প্রয়োজন পড়বে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করব।’
একথা মর্মান্তিক রকমে সত্যি। অধিকাংশ লোক ভূত আর ভগবানে বিপদে না পড়লে বিশ্বাস করে না।
বোধহয় শরৎচন্দ্রেরই একটি চরিত্র স্বীকার করেছিল যে সে ভূতে বিশ্বাস করে না, কিন্তু ভয় করে। সেইরকমই আমাদের চারপাশে অধিকাংশ চরিত্র ভগবানকে তখনই ডাকে যখন তার বিপদ বা অসুবিধে হয়, নিজের প্রয়োজন পড়ে।
একটি বিলিতি গল্প মনে পড়ছে।
সেই এক সাহেবদের খোকা বড় হয়েছে, মানে আট বছর বয়েস হয়েছে তার। পাঁচ বছর বয়েস থেকেই সে মা-বাবার থেকে আলাদা ঘরে শোয়। তবে রাতে অন্ধকারে যাতে ভয় না পায় সেই জন্যে তার ঘরে সারা রাত ধরে একটা কম পাওয়ারের বালব জ্বালিয়ে রাখা হয়।
কিন্তু যেহেতু এখন তার আট বছর বয়েস হয়েছে সে বড় হয়েছে তাই অহেতুক ভয় পাওয়ার বয়েস তার চলে গেছে। তার মা একদিন রাতে শোয়ার সময় তাকে বললেন, ‘খোকা, এখন তুমি বড় হয়ে গেছ। এখন আর তোমার খালি ঘরে অন্ধকারে ভয় পাওয়ার বয়েস নেই আজ রাত থেকে শোয়ার সময়ে তোমার ঘরের আলো নিবিয়ে দেওয়া হবে।ֺ’
এই পরিবারটি একটি গোঁড়া খ্রিস্টান পরিবার। প্রতিদিন রাতে শোওয়ার আগে এরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে ঘুমোতে যায়। এই খোকাটিও তাই করে।
আজ যখন তার মা বলল যে আজ রাত থেকে তার ঘরে আর আলো জ্বালিয়ে রাখা হবে না। দুয়েকবার ক্ষীণ প্রতিবাদ করার পরে সে বলল, ‘তা হলে মা শোয়ার আগের প্রার্থনাটা আরেকবার করি। এবার একটু মন দিয়ে করি।’
অর্থাৎ এতদিন সে দায়সারা প্রার্থনা করে এসেছে ঘরে আলো জ্বালা থাকে এই সাহসে কিন্তু আজ অন্ধকার ঘরে সাহস সঞ্চয় করার জন্যে তাকে একটু ভাল করে প্রার্থনা করতে হচ্ছে।
এই খোকাটির ঘটনা কোনও ব্যতিক্রমের ব্যাপার নয়। দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা যেদিন চোখের জল নেমে আসে দুঃখের বরষায় সেই বিপদের, বঞ্চনার দিনেই সাধারণ মানুষ বারবার ঈশ্বরকে স্মরণ করে, প্রার্থনা করে। সেদিন সে কালী বাড়িতে পুজো মানত করে, দরগায় সিন্নি দেয়। ভাঙা গির্জার পাতাঝরা ধুলো ভরা চাতালে অনেকদিন পরে সেই সন্ধেবেলায় সে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে আসে।
সায়াহ্নের অবসন্ন বাতাসে কম্পমান ক্ষীণ দীপশিখা অসহায় মানুষের নীরব আকুতি নিবেদন করে সেই অমোঘ নিয়তির কাছে, যার অন্য নাম ঈশ্বর।