এক সর্দারের গল্প (১)
না, এক কিস্তিতে সম্ভব হবে না। একাধিক কিস্তি লিখতেই হবে।
সর্দার মানে যা তা, যেমন তেমন সর্দার নয়, রীতিমতো সর্দার খুশবন্ত সিং। এই বিতর্কিত সাংবাদিক যতটা সম্ভব সংবাদ পরিবেশন, সম্পাদনা অথবা মৌলিক চিন্তার জন্য বিখ্যাত তার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় তাঁর অসামান্য রসিকতার জন্য। উপহাস, পরিহাস, কটু বাক্য কখনও কিঞ্চিৎ শ্লীলতার সীমানা ছাড়িয়ে বহু বহুবার অসামান্য সব মন্তব্যের জন্মদাতা, রচনাকার সর্দার খুশবন্ত সিং।
সর্দার খুশবন্তের সব রসিকতাই যে তাঁর নিজস্ব তাও নয়। অবশ্য রসিকতার আবার নিজস্ব, পরস্ব কী, রসিকতা পাঁচজনের। মহাভারতের দ্রৌপদীর মতো ভাগেযোগে উপভোগ করার।
খুশবন্ত সিংয়ের রসিকতাগুলো তিনভাগে ভাগ করা যায়, (এক) যেগুলো সর্দারজির নিজেরই চিন্তা বা রচনা, যদিও হলপ করে বলা কঠিন তবুও যেগুলো সম্ভবত তাঁর মৌলিক ভাবনা।
(দুই) যে রসিকতাগুলো সুপ্রচলিত অথবা পূর্বপ্রচলিত, যেগুলোকে, অনেকটা আমি যে রকম করে থাকি, নিজের কায়দায় নিজের ভঙ্গিতে নতুন ফ্রেমে উপস্থাপন করেছেন খুশবন্ত। তবে বলা বাহুল্য সর্দারজির উপস্থাপনার সঙ্গে আমার উপস্থাপনার কোনও তুলনা হয় না। আমি তাঁর কাছে নাবালক।
(তিন) শেষের ব্যাপারটাই সবচেয়ে সহজ কিন্তু সবচেয়ে ভাল এবং জনপ্রিয়। এই রসিকতাগুলো আর কিছুই না। নানা জায়গা থেকে নানা পাঠকপাঠিকা যা কিছু মজার গল্প তরল আখ্যান শুনেছেন সেগুলো খুশবন্তকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার থেকে বেছে হয়তো বা কিঞ্চিৎ সম্পাদনা করে প্রেরকের নাম উল্লেখ করে (অর্থাৎ ঋণ স্বীকার করে) তিনি সেগুলি ছাপিয়ে দিয়েছেন।
কিছুদিন আগে সর্দার খুশবন্ত সিং তাঁর সুদীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের এইসব রসিকতাগুলো থেকে বেছে নিয়ে একটি জোকবুক বার করেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে সেটি খুবই জনপ্রিয় হয়। এডিশনের পর এডিশনের পর এডিশন।
ফলে সর্দার খুশবন্ত সিংয়ের আরও জোকবুক বেরিয়েছে। প্রথম বইটির এর মধ্যেই দশটি সংস্করণ হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডটিও সমানই জনপ্রিয় হতে চলেছে। তারও পরে আরও খণ্ড বেরিয়েছে কি না আমি জানি না, তবে জানি সেগুলোও সমান জনপ্রিয় হবে।
সর্দার খুশবন্ত সিংহের মতো ঝলমল চরিত্র এবং তাঁর জোকবুকের মতো ঝলমল গ্রন্থ নিয়ে আমি আপাতত যে ভনিতা করলাম তা আমার মূর্খতারই পরিচায়ক।
সুতরাং আমি আর সময় নষ্ট না করে সরাসরি রসিকতায় যাই। খুশবন্তীয় রসিকতা।
আমি ইতিপূর্বে যে তিনধরনের রসিকতার উল্লেখ করেছি, এক সর্দারের গল্পের প্রথম কিস্তিতে সেই তিন জাতের আখ্যানই পেশ করছি পর্যায়ক্রমে।
খুশবন্ত সাহেবের নিজের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। তবে আগেও বলেছি এবারেও বলি, রসিকতা গল্পে কোনটা যে কার নিজের গল্প কোনটাই বা অন্যের গল্প কেউ বলতে পারবে না দেবতারাও না।
যা হোক আমার এই প্রথম গল্পটায় খুশবন্ত সিংয়ের দুটো বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট।
প্রথমে বৈশিষ্ট্যটি অসাধারণ, সর্দার সাহেবের অধিকাংশ ঠাট্টা নিজেকে নিয়ে, নিজেদের নিয়ে, এ গল্পেও তাই এক সর্দার পরিবার নিয়ে।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য, সেটা কিঞ্চিৎ গোলমেলে, একটু অশালীনতার দিকে ঝোঁক সর্দার সাহেবের, ব্যাপারটা আমার তেমন আসে না, নব যৌবনেই আসেনি আর এই পড়ন্ত যৌবনে? কিন্তু একটু রেখেঢেকে লিখতে (মানে অনুবাদ করতে) আপত্তি কী?
কী আছে, আগে লিখি তো তারপর বোঝা যাবে।
এক সর্দার পরিবারে নতুন বিয়ে হয়ে একটি বউ এসেছে। বউয়ের বর চার ভাইয়ের মধ্যে একজন। ভাসুর, দেওর, বর সব ভাই একসঙ্গে একই বাড়িতে থাকে। একই সঙ্গে চাষবাস করে।
প্রতিদিন সকালে বাড়ির পুরুষেরা জমিতে যায় চাষের কাজে, তারপর সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আসে। তখন সবাই একসঙ্গে খেতে বসে। নতুন বউ আর শাশুড়ি ওড়নায় মুখ ঢেকে তাদের খাবার দেয়।
বিয়ের দিন পনেরোর মাথায় নববধূ তার শাশুড়িকে খুব নরমভাবে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, ওই যে আপনার চার ছেলে একসঙ্গে চাষে যায়, একসঙ্গে চাষ থেকে ফেরে তারপর একসঙ্গে খেতে বসে ওর মধ্যে ঠিক কোনজন আমার বর?’
এই প্রশ্ন শুনে হেসে শাশুড়ি উত্তর দিলেন, ‘বউরানি, তোমার মাত্র দুই হপ্তা বিয়ে হয়েছে, আমার বিয়ে হয়েছে আজ পঁচিশ বছর, এখন পর্যন্ত আমি আমার স্বামীকে তার ভাইদের থেকে আলাদা করে চিনতে পারলাম না। জানতেই পারলাম না কে আমার স্বামী, কেই বা দেওর, কেই বা ভাসুর?’
এবার দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্প।
এই গল্পগুলো পুরনো এবং প্রচলিত। সর্দার খুশবন্ত সিং নিজের মতো করে লিখেছেন। যেমন:
এক ধোপার গাধা অন্য একটা গাধার কাছে দুঃখ করছিল তার মালিক তাকে ভালভাবে খেতে দেয় না। তার থাকবার জায়গা নেই সে বৃষ্টিতে ভেজে, রোদে পোড়ে, শীতের ঠান্ডা হাওয়ায় ঠকঠক করে কাঁপে। তার ওপরে মালিক তাকে দিয়ে ভারী ভারী বোঝা বওয়ায়, বোঝা টানতে না পারলে বেত দিয়ে মারে।
তার এই দুঃখের কাহিনী শুনে গাধা বন্ধুটি বলল, ‘তুমি কেন পালিয়ে যাও না?’
ধোপার গাধাটি বলল, ‘আমি পালাই না শুধু একটি লোভে। আমার একটি বড় আশা আছে। সেটা যে কোনও দিন পূরণ হতে পারে।’
গাধা বন্ধুটি বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কী আশা? কী পূরণ হবে?’
ধোপার গাধা বলল, ‘ধোপার একটি পরমা সুন্দরী মেয়ে আছে। ধোপা তাকেও খুব মারধোর করে, বেত মারতে মারতে বলে, একদিন তোর আমি কী করি দেখিস, তোকে আমি ওই গাধাটার সঙ্গে বিয়ে দেব। বদ মেয়ে!’ একটু থেমে নিয়ে করুণ হাসি হেসে ধোপার গাধা বলল, ‘আমি তো সেই আশাতেই সব কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছি।’
সর্বশেষ হল খুশবন্ত সিংকে পাঠকদের প্রেরিত রসিকতা। এগুলোর সংখ্যাই বেশি।
নয়াদিল্লির জে পি সিং কাকা নামে এক ভদ্রলোক এই রসিকতাটি খুশবন্তকে পাঠিয়েছিলেন।
তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসায় স্ত্রী স্বামীকে প্রশ্ন করল, ‘কী হল আজ এত তাড়াতাড়ি এলে?’
স্বামী অপ্রসন্ন মুখে বলল, ‘কী বলব, অফিসের বড়সাহেব আমার ওপর রেগে আগুন হয়ে গিয়ে আমাকে বললেন, জাহান্নমে যাও। কী আর করব, বাড়ি চলে এলাম।’