Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জাতির গৌরব || Mallik Kumar Saha

জাতির গৌরব || Mallik Kumar Saha

জাতির গৌরব

এক শ্রেণীর লোক আছে যারা সমাজে একেবারে অবহেলিত। দিন আনে দিন খায়। ঈশ্বরে তাদের অগাধ বিশ্বাস। নিজের যতই কষ্ট হোক, কিছু যায় আসে না। কিন্তু ঈশ্বর নিন্দা কোন মতেই তাদের সহ্য হয় না। অন্নের অভাবে দারে দারে ঘুরে বেড়ানো যেন তাদের কাছে চরম অপমান। নিজের পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থের বিনিময়ে নিয়ে আসা নূন্যতম সাংসারিক বস্তুগুলোকে অতিযত্ন সহকারে উপভোগ করার মত আনন্দ এজগতে আর কেউ করতে সক্ষম হয় না। ধনী সমাজের মানুষগুলো এদের কাছে দেবতুল্য। মনোরঞ্জনের সরঞ্জাম হিসেবে একখানা রেডিও কেনার সাধ করতে গিয়ে একযুগ সময় পার হয়ে গেছে। এযাবৎ সেই তৃণসম আশাটুকু মেটে নাই। তাহলে তারা কি শুধুই নিরানন্দ জীবন কাটায়? কেউ যদি এমন অভিমত ব্যক্ত করে তাহলে একেবারে ভুল বলা হবে। এই তো সেদিন পাড়ার এক ধনী ব্যবসায়ী টিভি এনে ঘরে চালিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এই খবর সমস্ত গরীবের কুটিরে পৌঁছে গেল। যাদের ভাগ্যে রেডিও জুটে না তাদের কপালে টিভি যে অতি দুরের কথা! নিজের না হোক, নিজে কখনও দেখতে না পেলেও তাদের পাড়ার লোক এই জিনিষ কিনেছে— তাতেই এদের আনন্দের সীমা নেই। নিজেদের সীমানায় বৈদ্যুতিক আলো নেই বটে, কিন্তু দূর থেকে সেই আলো দেখেই মনের মধ্যে এদের আনন্দের ফুলঝুরি ফোটে। সাধ থাকলেই সব আশা পূরণ হয় না। কিন্তু অভাবের সংসারে সাধ আহলাদ টুকু পূর্ণ না হলেই যে মনের মাঝারে আনন্দের জোয়ার আসে না তা কি করে হয়? সংসারে এমন বহু লোক আছে যারা বস্তু সামগ্রীর অভাবেও হাসতে ভুলে না। অর্থের বিনিময়ে নয়, প্রতিবেশীর সামান্য প্রয়োজনে হাত বাড়িয়েই মনুষ্যত্ববোধের ছোঁয়া উপভোগ করে।

এমনি এক শ্রেণীর মানুষ হচ্ছে আমাদের পাশের গ্রামের হারুণ সেক। লোকটি কাঠমিস্ত্রী। কৃষ্ণকায় ও নাতিদীর্ঘ। মাথায় কোনদিন চিরুনী পরে নাই। পরনে একখানা লুঙ্গি এবং গায়ে জামা অথবা গেঞ্জি। এর বেশী পরনে কোনকিছু নেই। পায়ের চটিজোড়া পর্যন্ত কোনদিন দেখিনি। শুধু দেখেছিলাম তার কোলে ছোট ছোট শিশু। কোন কোন সকালে কোলের শিশুকে নিয়ে এদিক সেদিক হেঁটে যেতে দেখেছি। কখনও আমাকে জিজ্ঞাসা করত— কেমন আছ? এখন কোথায় থাক? এর থেকে আর বেশী কিছু নয়। বেশী কথা বললেই যে মনের গভীরে স্থান করে দিতে হয় এমনও নয়। স্বল্প কথার মাধ্যমেও মানুষের চরিত্রের নিগূঢ় অনেক তথ্য উদ্ঘাটন করা যায়।

অনেকদিন অতীত হয়ে গেল। এই অতি সাধারণ লোকটিকে মনে রাখার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। যার কাছ থেকে কোন কিছু চাওয়া পাওয়ার আশা থাকে না অথবা অনুপ্রেরণাও পাওয়া যায় না, তাকে বোধ হয় খুব কম মানুষই মনে রাখে।

আমি উচ্চ শিক্ষার তাগিদে ‘তুরা’ শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছি। অতি কষ্টসহকারে খোঁজাখুঁজির পর এই পার্বত্য শহরে একখানা ভাড়া ঘর পেলাম। সারাটাদিন ধরে পরিশ্রমের পর নানান সামগ্রী কিনে সন্ধ্যার সময় সেই ভাড়া বাড়ীতে গেলাম। ভাবলাম, আজ রাতের জন্য এক পেকেট বিস্কুটই সম্বল। কাল সকালে উঠে রান্নার ব্যবস্থা হবে। এখন একটু বিশ্রাম করা যাক।

রাত তখন আটটা। এমন সময় পাশের দরজার তালা খোলার শব্দ পেলাম। পরে জানতে পেয়েছি লোকটি কয়েক মাস থেকে এবাড়ীতে ভাড়া আছেন। কিছুক্ষণ পর লোকটি ঘর থেকে বের হয়ে এসে আমাকে চেনার জন্য দরজায় আঘাত করলেন। দেখেই চিনতে পেলাম ইনিই সেই পাশের গ্রামের হারুন সেক। বিদেশে এসে স্বদেশের লোক দেখে মনের মধ্যে একটু শক্তি সঞ্চার হলো। দুজনের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা হলো। অনেকটা একাকিত্ব দূর হলো। রাত্রে রান্নার কোনরূপ আয়োজন না দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: রাত্রে খাবে কি?

আমি অতি সরলভাবে উত্তর করলাম— “এক পেকেট বিস্কুট এনেছি। আজ রাতে এটা খেয়েই কাটাব।” উত্তর শুনে লোকটি বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দিলেন না। একটু চুপচাপ বসে রইলেন। জানি না কি ভাবলেন। শুধু এইটুকু ভেবে নিলাম যে উনি তো গরীব লোক, হয়তো অনেক রাত অনাহারেই কাটিয়েছেন। তাই এই ব্যাপারটি উনার কাছে অতি স্বাভাবিক বলে মনে হবে। উনি আস্বস্ত যে আমাকে না খেয়ে ঘুমোতে হবে না।

কিছুক্ষণ পর তিনি বলে উঠলেন: “আমাদের দুজনেরই বাড়ীর রাস্তা একই দিকে। আমি রাতে ভাত খেয়ে ঘুমোব, আর তুমি কিনা বিস্কুট খেয়ে ঘুমোবে। তা কি করে হয় ? একটু অপেক্ষা কর, আমি তোমার জন্য ডাল আর আলুসিদ্ধ ভাত এনে দিচ্ছি।”

—আমি অনেক আপত্তি করলাম যে আমার হয়ে যাবে। কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। ইত্যাদি…. ইত্যাদি।

আমরা বাঙালীরা খিদের পেটে ভাত খেতেই বেশী পছন্দ করি। কিন্তু আমার অনেক আপত্তি হলো। কারণ লোকটি গরীব শ্রেণীর মুসলমান। এমন নয় যে এর আগে কোন মুসলমান বাড়ীতে খাইনি। উনার অনুরোধটুকু সহজভাবে মেনে নিতে পারলাম না। ভেবে ছিলাম, উনি আমাকে আর জোর করবেন না। আমার কাছে এটা এক বিপরীত পরিস্থিতি বলে মনে হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই উনার অনুরোধটুকু এতটাই প্রবল হয়ে উঠল যে আমি হার মানতে বাধ্য হলাম।

প্রায় আধঘণ্টা পর উনি একথালা ভাত, একবাটি মুসুর ডাল এবং তেলেভাজা শুকনা লংকা সহযোগে আলুসিদ্ধ মেখে আমাকে ডেকে বললেন— “তুমি ডাল- ভাতটুকু খেয়ে নাও।”

আর কিছু না ভেবে আমি সিদ্ধ আর ডাল দিয়ে ভাতটুকু খেলাম। সেদিনের একমুঠো ভাত শুধু আমার ক্ষিধে মিটায়নি— মিটিয়ে ছিল আমাদের দুই বিধর্মের দূরত্ব। স্নেহ ও যত্ন সহকারে পাওয়া দুমুঠো ভাত মনের গভীরে এক অনাবিল তৃপ্তি দান করেছে। ধনী-গরীব, উঁচুনীচু— এসবের ব্যবধান ঘুচিয়ে মানব ধর্মের গোপন চেতনাকে জাগ্রত করতে পেরেছিল বলেই সেই দিনের ‘হারুণ’ আজও মনের ভিতরে চির আদ্রিত। সেই শ্রেণীর মানুষকে সশ্রদ্ধ প্রণাম করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *