উত্তর মেলেনি
পিওন কাঞ্জিলাল খামটা নিয়ে অফিস ঘরে এলে ইশারায় টেবিলে রাখতে বলে আবার কাজে মন দিলাম। বাড়ী যাবার তাড়ায় ভুল হয়ে যেতে পারে বলে ছুটি হবার ঘণ্টা দেড়েক আগে থেকেই ক্যাশ মেলানোর কাজ শুরু করে দিই। অন্যান্য দিনের মতোই আজও ব্যস্ত ছিলাম ক্যাশ মেলাতে। হাতের কাজ শেষ হলে দেখলাম ছুটি হতে তখনও আধঘন্টার মতো বাকি।
টেবিলের উপর থেকে খামটা হাতে নিয়ে প্রেরকের নামটা দেখে চমকে উঠলাম! স্বপ্ন দেখছি নাকি! ঝুমুর!ঝুমুরের চিঠি!ঝুমুর চিঠি লিখেছে আমাকে!এই দীপঙ্কর সেন কে।
ভারি আশ্চর্য লাগলো।আশ্চর্য হবার কারণ আছে বৈকি!অতগুলো দিন ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে থেকে প্রতিনিয়ত সব কিছু ভুলে থাকতে সাহায্য করেছি, যার খুশির জন্য নিজের জীবন তুচ্ছ করে দিয়েছিলাম। এমন কী নিজের ভবিষ্যতের কথাও ভাবিনি, সে যখন তার যাবার কথা আমাকে বিন্দুমাত্র কিছু জানালো না পর্যন্ত ।কোন কিছু জানানো তো দূরের কথা, আমি অফিসে থাকাকালীন অবস্থায় সে চলে গেল।আমি কী বাধা দিতাম স্বামীর কাছে যেতে । আটকে রাখতাম নিজের কাছে! বড়ো অপমানিত বোধ করেছিলাম। দুঃখের সীমা ছিল না। কী স্বার্থ ছিল আমার! নিজের কাছে নিজেকে বড়ো ছোট মনে হয়েছিল । সে লজ্জা যে আজও বুকের মধ্যে চেপে বসে আছে! একটু একটু করে সব মনে পড়ে যাচ্ছে।
চাপা একটা উত্তেজনা বোধ করছি। এ বয়সে উত্তেজনা শরীরের পক্ষে খুব একটা ভালো নয়। পঞ্চান্ন পার হয়ে গেছে মাসচারেক আগেই।
সব মনে পড়ে যাচ্ছে। স্মৃতির পাতায় ধুলো জমতে দিই নি একফোঁটাও,তবুও আজ যেন পরপর উঠে আসছে বুকের ভেতর থেকে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি
সেই প্রথম যৌবনের দিনগুলি ।ফুটবল খেলার চরম উন্মাদনায় যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পড়েছি। ফুটবলের সঙ্গে কিশোর বেলা থেকেই অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ জীবন।উত্তেজনার মধ্যে টগবগ করে ফুটতাম সর্বদা।
বাবার আদরের দুলাল ছিলাম বলে আমার কোন অপরাধই বাবার কাছে অপরাধ বলে গণ্য হতো না। আমার জন্য তার বুকের মধ্যে ভালোবাসার যে স্রোতস্বিনী বয়ে যেত তার হদিশ অন্য কারোর জানা ছিলনা, জানতাম শুধু আমি!
আমার যত গল্প, সব বাবার সাথে! বাবাও মিশতেন বন্ধুর মতো। আমার খেলা দেখতে গুটিগুটি ঠিক চলে যেতেন।ছাতাটি মেলে মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতেন আমার।
উফঃ সেকি দিন গেছে তখন! বড়ো বড়ো সব ম্যাচ জিতে আসছি, আর তত উন্মাদনা। এর মধ্যেই দু দুবার খেলার সময় দুর্ঘটনায় মরতে মরতে বেঁচেছি।
কুড়ি বছর বয়স হতে না হতেই খেলার জন্য দু-দুটো চাকরির অফার! বিদ্যুৎ পর্ষদের চাকরীটাতেই যোগ দিলাম শেষমেশ ।
ইতিমধ্যেই দাদার বিয়ে হলো। বৌদি এলো বাড়ীতে।
বৌদির সাথে এলো বৌদির বোন ঝুমুর। ধবধবে ফরসা খুকি খুকি দেখতে। বৌদিকে যত না ভালো লাগতো, তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো লাগতো ঐ ঝুমুরকে। লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতাম,পরের গাছের পেয়ারা চুরি করে খেলে যেমন আনন্দ হয় তেমনি আনন্দ অনুভব করতাম। সে তো আমাকে হাঁ করে গিলতো। ওর বয়স কম ছিল বলে ও আমার মতো অতটা লজ্জা পেত না। সময় পেরিয়ে যায় এমনি করে। বেশী দেরী হলো না দুজনের দুজনকে বুঝে নিতে। সাহসও বেড়েছে ততদিনে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠছিল আমাদের প্রেম। সেকি আনন্দ তখন! বুকের গভীরে নূপুরের ধ্বনি। পৃথিবীটা আলোয় আলোময় মনে হতো।
বাবা ভালোবাসতেন খুব। সব বুঝতেন তিনি। হাসতেন মিটিমিটি। বুঝতো অন্যরাও,সবাই জানতো বিয়ে হবে আমাদের। আমরাও তাই ভাবতাম। সব অনুভূতির উর্ধ্বে তখন! খেলা দেখে আমার কৃতিত্বে ও পাগল হয়ে উঠতো। ঘরে ফেরার পর খুব আদর করতাম ওকে। আমার বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখতাম ।
বুকের ভেতর যে ভালোবাসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে, বিয়ের হোমাগ্নিতে মিশে যাবার অপেক্ষায় ছিলাম বসে।
মানুষ ভাবে এক হয় আর! উপরওয়ালা যা লিখে রেখেছেন তার বাইরে যাবার সাধ্য কার!
বিনা মেঘে বজ্রপাত! হার্ট অ্যাট্যাকে বাবা চলে গেলেন মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে।
বাবার যাবার সাথে সাথেই কত কিছুই বদলে গেল!দাদার ইচ্ছে নয় আমার সাথে ঝুমুরের বিয়ে হয়। দাদার মতেই বৌদির মত। আমি ঐ বয়সে কীই বা করতে পারতাম! অগত্যা দুজনেরই অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা চলতে লাগলো। ঝুমুরের অনুরোধে ওর বিয়ের পাঁচদিন আগে তড়িঘড়ি বিয়ে হয়ে গেলো আমার।
আমার বউ অপূর্ব সুন্দরী! বাবা নেই ,মামাবাড়ীতে মানুষ। আমাকে পাত্র হিসেবে পেয়ে তো হাতে চাঁদ পেলেন । বউ শেলী চাইলো আমাকে পরিপূর্ণ করে তুলতে।মায়ের ভারি বাধ্য । সংসারের প্রতি ,মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় সর্বদা তটস্থ থাকতো । সব দায়িত্ব , কর্তব্য মুখ বুজে পালন করতো ।
সুন্দরী স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে পরিপূর্ণ সংসার, তবুও বুকের ভেতর অনুরণন। অপূর্ণ ভালোবাসার গুঞ্জরণ! একাকীত্ব জেগে রইলো বুকের ভেতর।মা হঠাৎ করেই চলে গেলেন।
ঝুমুরের বিয়েটা ভালো হয়নি। প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলল। সারা শরীরে স্বামীর ভালোবাসার চিহ্ন নিয়ে দিদির বাড়ী থাকতে এলো। সঙ্গে মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছে । সারা শরীরে কালশিটে পড়ে গেছে। চোখ ফেটে জল আসছিল ওকে দেখে। বুকের ভেতর আশ্চর্য অনুভূতি! ঝুমুর! আমার ঝুমুর এত কাছে! বিশ্বাস হচ্ছিলো না। এতদিন পর ওকে পেয়ে খুব ভালো লাগলো। ভাগ্যের ফেরে যার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল চিরদিনের মতো, অকস্মাৎ ফিরে এল যখন আগুনে পাখায় ভর করে যেন কতযুগ আগের ফেলে আসা বসন্ত দিন গুলি স্ফটিক জল হয়ে ফিরে এল তৃষাতুর চাতক পাখির কাছে । আশ্চর্য আনন্দে ভরে উঠলো মন। আগের সব অনুভূতিকে ছাপিয়ে গেল। সব দুঃখ ভুলে ঝুমুরের মুখে চোখেও তখন অন্য আলো। আমাকে জড়িয়ে বাঁচতে চাইলো নূতন করে। স্বামীর ঘরে ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই ছিল না ওর।
যখন তখন আমার ঘরে ঢুকে পড়ে আমার পাশে শুয়ে পড়তো। আঁকড়ে ধরতো আমায়।
যাকে পাওয়ার জন্য বুকের ভেতর একদিন কতো ব্যাকুলতা , সে আজ আমার এত নিবিড় উষ্ণতায়। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠতো। সমাজ সংসার সব তুচ্ছ মনে হতো। শরীরে মনে প্রবল দাহ! উন্মাদ হয়ে উঠতে চাইতো মন, তবুও নিজেকে বেঁধে রাখতাম কঠোর সংযমে।
ওর জন্য অনেক কিছুই করতে চাইলেও, বাস্তব বোধটুকু হারাই নি কখনোই। সমাজ, সংসার সবদিক দিয়েই ঝুমুর আজ আর আমার কেউ নয়।
শেলী আমার স্ত্রী , কোনদিন একটা কথাও বলেনি কখনো। বললেও যে খুব একটা লাভ হবে না জানতো বলেই বোধহয় মুখ বুজে কৃতজ্ঞতার দায় শোধ করে যেত। ঝুমুরের জন্য কতকিছু এনে দিতাম, দেখতো বলতো না কিছু। মুখ বুজে মেনে নেওয়া ছাড়া ওর আর অন্য কোন উপায় ছিল না বলেই হয়তো এমনি করেই দায়বদ্ধতা পালন করতে বাধ্য হয়েছিল। তবুও ওর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
ঝুমুরকে কাছে পেয়ে অদ্ভূত অনুভূতি হতো।ওর যা ভালো লাগে তাই করতাম।
তারপর এলো জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন।
আগের দিন রাতেও কথা বলেছে ,একবারও বলেনি পরের দিন চলে যাবে ! আমি অফিস থেকে ফিরে আসার সময় ওর মেয়ে লিচু ভালো বাসতো বলে ওর জন্য লিচু নিয়ে এসেছিলাম সেদিন।শেলীর মুখে শুনলাম ঝুমুর চলে গেছে।
……
চিঠিটা পড়লাম।দেখা করতে
লিখেছে।অনেক দিন দেখা হয়নি বলে দুঃখ প্রকাশও করেছে।
কাল অফিস ছুটি নিয়ে যাবো আমি !, মুখোমুখি জিজ্ঞাসা করতে!আমার কী অপরাধ ছিল যে , সেদিন না বলে চলে গিয়েছিল !