Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কবিতা প্রসঙ্গে কিছু কথা || Sankar Brahma

কবিতা প্রসঙ্গে কিছু কথা || Sankar Brahma

কবিতা প্রসঙ্গে কিছু কথা

ফরাসী কবি মালার্মে বলেছেন ,
‘কবি আসলে নিজের সাথে কথা বলেন,
পাঠক শ্রোতারা আড়ি পেতে তা শোনেন।’

কবিতায় কবি কথা বলেন। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলেন? কবি মালার্মে কথিত, শুধু নিজের সঙ্গে? তাই যদি হবে, তবে কবি আর পাগলের বিশেষ তফাৎ থাকে না।
কবি নিজের সঙ্গে কথা বললেও, সে চায় তার কথাগুলি পাঠকের দরবারে পৌঁছে দিতে।
আর তা করতে গিয়েই তাকে কবিতার ভাষার আশ্রয় নিতে হয়। আশ্রয় নিতে হয় উপমা, চিত্রকল্প, ছন্দ, রূপক, উৎপ্রেক্ষণ, ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার।
কবিতার একটা নিজস্ব ভাষা আছে, সে ভাষা ইঙ্গিতময়।
আনন্দ বর্ধন বলেছেন, ‘যে-বাক্যবদ্ধ থেকে নিতান্ত আক্ষরিক অর্থ ছাড়া আর কিছুই আমাদের লভ্য নয়, কাব্য বলে গণ্য হবার কোনও যোগ্যতাই তার নেই।’
অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ কবি টমাস গ্রে বলেছিলেন, কবিতা কখনও তার সমকালীন ভাষায় রচিত হয় না।
কবিতাকে তিনি বিশেষ এক ধরণের ভাষার শিল্প বলে মনে করতেন, তিনিএমনও ভাবতেন যে, কবিতা হচ্ছে এমনই সুকুমার একটি শিল্প, যা তার উপাদান হিসেবে শুধু সুকুমার শব্দই দাবি করে। সমস্ত শব্দই যে কবিতায় ব্যবহৃত হবার যোগ্য, এবং যোগ্যজনের হাতে পড়লে, কোনও শব্দকেই যে কবিতার মধ্যে অনধিকার-প্রবেশকারীর মতো অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না, এই উদার ধারণা তাদের কাছে প্রশ্রয় পায়নি।
রবীন্দ্রনাথও এই ভাবনার অংশীদার ছিলেন প্রথমদিকে। তিনি তাঁর কবিতায় কোথাও আটপৌরে শব্দ ব্যবহার করেননি, কিন্তু পরবর্তী কালে, তাঁর কবিতায় নিত্য ব্যবহার্য হাঁড়ি’ ‘সরা’ থেকে শুরু করে ‘গুড়ের পাটালি’ আর ‘ঝুনা নারিকেল’ পর্যন্ত এমন-সমস্ত শব্দের উল্লেখ ঘটেছে, তার কবিতায়। যদিও তিনি কবিতায় আটপৌরে শব্দ কবিতায় ব্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন না।
পরবর্তী কালে ওয়ার্ডসওয়র্থ বললেন,
যে, শুধু সেই ভাষাতেই কবিতা লেখা উচিত, যা কিনা মানুষের নিত্যব্যবহার্য মুখের ভাষা। শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেছেন, বাকছন্দ।

কার কাছে কবিতা কি ভাবে আসবে, সেটা নির্ভর করে কবির ব্যক্তি সত্তার উপর।
তার মানসিকতা, রুচি,পাঠাভ্যাস,অধিত বিদ্যা, প্রিয় কবির প্রভাব, পারিপার্শিক পরিস্থিতি, সহযোগী সঙ্গ যাপন প্রভৃতি জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
এটা একটা রহস্যময় ব্যাপার, যেটা কোন কবিই বোধহয় পুরোপুরি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে
পারেন না। কারণ তারা নিজেরাও বোঝেন না সবটা পুরোপুরি এই কুহেলিকার।

কবিতায় পাঠকের প্রবেশের জন্য দরজা জানলা খোলা না থাকলে, পাঠকেরও কোন দায় থাকে না, সে বদ্ধ গুদামে প্রবেশের।
কবিতায় কবি নিজের সঙ্গে যতই না কথা বলুক, তার একটা সংযোগ যদি পাঠকের সঙ্গে না ঘটে, কারও কোন দায় থাকে কি, সেসব কথা শোনার?
কবির লেখা যদি পাঠকরা পড়ে কিছুই না বুঝতে পারে, তবে তারা আগ্রহ বোধ করবে কেন কবিতা পাঠে? তবে সে লেখার সার্থকতা কোথায়?
এই প্রসঙ্গে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপের কথা মনে পড়ছে।
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চাইতেন, পাঠকের অলস মনের জড়তা কাটাবার জন্য কবিতায় অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার। তার যুক্তি ছিল, শব্দ-বাধায় ঠোক্কর খেয়ে,অনেকেই হয়তো ঘরে ফিরবে, কিন্তু তার পরেও যারা এগোবে, তারা অন্তত চলবে চোখ খুলে, কান মেলে প্রতি অগ্র পশ্চাৎ উর্ধ্ব অধঃ দেখতে দেখতে। এখানে অলঙ্কারের কথাও বলে নিই কেননা অলঙ্কার চিন্তাকে পরিস্ফূট করার বিশেষ সহায়ক।
উপমানের সঙ্গে উপমার এত নিবিড় সম্পর্ক যে প্রথমটির স্বভাব অন্তত আংশিক ভাবে হলেও এসে পড়ে। কাজেই উপমার ভিতরেও একটা সামঞ্জস্য, একটা ন্যায় সঙ্গতি না থাকলে মুস্কিল। কিন্তু তাই বলে উপমাগুলিকে গতানুগতিক হতে হবে তার কোন মানে নেই, বরং উল্টোটা হলেই ভালো। সত্যকে নতুন ভাবে দেখতে গিয়ে নূতন রূপকের দরকার হওয়া স্বাভাবিক।
তিনি আরও বলেছেন, যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে, কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদকম্পন অনুভব করতে চায়, তাদের কবিতা না পড়াই উচিৎ। কবিতার গঠন যেমন প্রত্যেক লাইন বিশ্লেষণ করে ধরা যায় না, তার ভাবাবেশও তেমনি খন্ডাকারে দেখা যায় না, বিরাজমান থাকে সমগ্রের মধ্যে।
ভাব শুধু মেঘ বাঁশি প্রিয়া বিরহ মিলন
ইত্যাদি জরাজীর্ণ শব্দের করতলগত নয়, শুধু প্রেম বেদনা ও প্রকৃতিকে নিয়েই কাব্যের কারবার চলে না, তার লোলুপ হাত দর্শন- বিজ্ঞানের দিকেও আম্তে আম্তে প্রসারিত হচ্ছে।
এই ” বিশেষ জ্ঞানে”র দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে, সেই নিবিষ্ট ভিক্ষা করি যেটা সাধারণ অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি।
রবীন্দ্রনাথের এ’মতে সায় ছিল না।
তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে জানিয়ে ছিলেন,
” মানুষের মধ্যে, যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবীর দিকে না তাকিয়ে, যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করার চেষ্টা কর। বুদ্ধিমানদের জন্য আছেন আইনস্টাইন, ব্রার্টান্ড রাসেল, প্রশান্ত মহালনবিশ, সুনীতি চাটুজ্জে মস্ত মস্ত সব লোক ।
অথচ তিনি পাঠকরুচির কাছে আত্মসমর্পণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাতে সস্তা সাহিত্যের আমদানী ঘটে এই বোধ তার তীব্র ছিল। তার ভাষায়, “আদর্শ রক্ষা করতে গেলে প্রায়াসের দরকার, সাধনা না হলে চলে না।
কবি জীবনানন্দ দাশের কথায়,
“কাব্যে কল্পনার ভিতর, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা থাকবে।”
কবির যেমন চিন্তা ও চেতনারএক নিজস্ব জগৎ আছে। বাস্তব অভিজ্ঞতাও তার চিন্তা চেতনাকে আলোড়িত করে, প্রভাবিত করে, এবং কবি তা প্রকাশ করেন, তার নিজস্ব কল্পনার মাধ্যমে। এবং সে কল্পনাকে জাগরুক করতে হলে, তাকে আশ্রয় নিতে হয়, কখনও চিত্রকল্পের, কখনও রূপকের, কখনও উৎপ্রেক্ষণের, কখনও ছন্দ মাধুর্যের, কখনও ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার, কখনও যথার্থ শব্দ ব্যবহারের আশ্চর্য দক্ষতার। সব মিলিয়েই কবিতাটা রূপ পরিগ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত।

জীবনান্দ দাশ যখন লিখলেন,
‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;’

এখানে আমরা লক্ষ্য করলেই দেখব, ‘নক্ষত্র, রূপালি, আগুন, ভরা, রাত’-এ সবই আমাদের কাছে অতি পরিচিত শব্দ। কবি তাকে সাজিয়ে তুললেন। এবং শব্দ হয়ে উঠল ব্রহ্মময়ী! শক্তিময়! কী অপরূপ শব্দ দ্যুতি-দীপ্ত!
কী অসামান্য কল্পনা-জাগানিয়া! প্রতিটি শব্দ যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। নতুন অর্থ-বলয় তৈরি করে হয়ে উঠল অসামান্য। এমনতর-কবিতায় আলাদা কোনও ইঙ্গিত না-থাকলেও, জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাবনা অনুযায়ী, ‘তা আমাদের কল্পনার ও সৌন্দর্যবোধের পরিতৃপ্তি ঘটাচ্ছে।’

শব্দ মহৎ শক্তিমান,কিন্ত যখন রূপ-তপস্বীর হাতে না-পড়ে, তা কোনো আনাড়ি খোদাইকরের হাতে পড়ছে, তখন তা হয়ে উঠছে শব্দের জঞ্জাল। যেহেতু যে কোনও শব্দের সাথে যে কোনও শব্দ যুক্ত করে দেবার অধিকার তাঁর আছে, এবং আলাদাভাবে কবিতায় গভীর কোনও ইঙ্গিত সঞ্চারের দায় থেকেও তিনি মুক্ত, নতুন এই নৈরাজ্যের চরাচরে তিনি হয়ে উঠছেন একজন শব্দ-দাস কিংবা শব্দ-দানব। এবং শব্দের সাথে শব্দের এতসব বিয়ের আয়োজন অন্তে তাঁকে দেখাচ্ছে আত্মবিশ্বাসী, সদা-স্মিতহাসির সফল ঘটকের মতো। কিন্তু তাতে এ জগতে কার ক্ষতি? এ-প্রশ্ন করা যেতেই পারে। যেহেতু অসফল শব্দ-ঘটকের সংখ্যাই বেশি এবং তাঁদের উৎপাদনই বেশি পরিমাণে দৃশ্যমান, দ্বান্দ্বিকতার সূত্র অনুযায়ী, পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসছে বৈকি। এটাই হয়ে উঠছে কবিতার একমাত্র মার্গ-সাধনার পথ। অন্ততঃ নতুন লিখিয়েরা তাই ভেবে নিচ্ছে। এভাবে চলছে এক অচ্ছেদ্য দুষ্টু-চক্র।

তলস্তয় তাঁর ‘What is art?’-এর শুরুতেই যে প্রশ্ন করেছিলেন, সে প্রশ্ন, বিশেষ করে, এখন, এসব কবিতার শব্দ-জঞ্জাল সম্পর্কে করা যায়, ‘যে শিল্পের বেদীতে লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্রম, মানুষের জীবন, সর্বোপরি মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসা সবই বিসর্জিত হয় সে শিল্পই ক্রমশ অস্পষ্টতর এবং মানুষের বুদ্ধির কাছে বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠছে।’
এবং আরো বিশেষ করে বললে, প্লেটোর ‘Allegorical cave’এর সেই মানুষদের মতো একটা ছায়া-সত্যকে সত্য জেনে কাটিয়ে দিচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের লিখিয়েরা। কত মহৎ প্রতিভার সীমাহীন অপচয়! ‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে!’ এবং ইতোমধ্যে আমরা জেনে গেছি, এই দুষ্টু-চক্র কীভাবে সভ্যতার এই সময় গ্রন্থিতে প্রধান স্থান অধিকার করে নিতে চাইছে।
শব্দে যদি ব্যুৎপত্তি থাকে,তা’হলে অকবির পক্ষেও সাজানো কবিতা নির্মাণ করা অসম্ভব নয়।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায় ,
” শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয়। কবিতায় কথাই (শব্দ) সব। কথায় কি না হয়? কবিতায় কথা মন্ত্রের মতো কাজ করে। কথার নড়চড় হলে কবিতা একদম দাঁড়ায় না। শব্দের মূল তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত আছে কবিতার মূল কথা। কেননা, শব্দই হল কবিতার মূলাধার।”
মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কবিতার কথা বলতে গিয়ে একেই বলেছেন, ‘ শব্দে শব্দে বিবাহ বন্ধন।’ বিবাহ বন্ধন সুন্দর হলে যেমন সংসার সুখের হয়ে ওঠে , তেমনি শব্দ ও শব্দের মিলন সুন্দর হলে, কবিতাও সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে।
বস্তুত, শব্দ বাছাইয়ের উপর নির্ভর করে, এর পার্থক্য থেকেই এক কবিকে অন্য কবির থেকে আলাদা করে চেনা যায়। মরা শব্দকেও ব্যবহারিক পারদর্শিতায় কোন কোন কবি জ্যান্ত করে তুলতে পারেন। অবশ্য সকলে নয়। সেজন্যই বুঝি কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন,
‘ সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’
যথার্থ কবির কাছে কথার খেলাই কবিতা হয়ে ওঠে, যা ম্যাজিক সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মননে।
তার জন্য প্রয়োজন হয়, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ” কঠিন সাধনার”।
অনেক সাধনার ফলে, সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব হয়। মহৎ চালাকির সাথে ফাঁকি দিয়ে এই কাজ কখনই করা সম্ভব নয়, বলে আমার বিশ্বাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *