জীবন যে রকম
সকালটা আজ কেমন কুয়াশা মাখা। রোদ তেমন চড়া না হলেও সূর্য উঠেছে অনেকক্ষণ। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে এখন সকাল সাত টা… গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে ঝাপসা পেঁজা তুলোর চাক, সবুজ মাঠে লেগে আছে ফিকে ধোঁয়া….শীতের পুর্বাভাষ।
রান্নাঘরে স্নিগ্ধা আনমনে,চায়ের জল ফুটছে, পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়ে নতুন বৌ রুদ্রাণী। তাকে দেখেই হাসিমুখে …. কি রে আজ এতো সকালে ঘুম ভাঙ্গলো? কর্তা তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল বুঝি?
যৌথ বনেদি পরিবার বলতে এই পাড়াতে এরাই। রুদ্রাণী এই পরিবারের আনকোরা নতুন… কার সাথে কি সম্পর্ক তার সব গুলিয়ে যায়। সম্পর্ক শব্দটি বড় জটিল! তবে বড়গিন্নী, অর্থাৎ তার শাশুড়ি মায়ের যে এই পরিবারে ভীষণ দাপট তা এই কদিনের মধ্যে সে ভালই বুঝেছে। তাদের একমাত্র ছেলে রনৌকের স্ত্রী এই রুদ্রাণী। মেজ কাকু ও কাকিমার দুই মেয়ে, ছোট কাকু ও কাকীর দুই ছেলে।
আর সেজ কাকু কি এক কঠিন অসুখে বিয়ের ছয় মাস পর মারা যান… সেই থেকে সেজ কাকীমনি এই বাড়িতে একা, নীরবে সব কাজ একা হাতে সামলে যান। বিশেষত রান্নাঘর সামলানোর ভার। অদ্ভুত সংসার! কেমন এক দৃষ্টিতে সবাই স্নিগ্ধার দিকে তাকায়… এমন খারাপ মেয়ে যেন আর কারো বাড়িতে না থাকে.. বিয়ের পর বর কে খেয়ে শান্তি নেই, পর পুরুষের সাথে বেহাল্লাপনা … যত্ত সব বাজে মেয়েছেলে… ওই বুড়ি ঠাকুমা আর আমার মায়ের জন্য সে আজ এই বাড়িতে, না হলে কবেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে এই বাড়ি থেকে…তুমি ওই স্নিগ্ধা কাকীর সাথে একদম মিশবে না… বিয়ের কদিন যাবার পর এক রাতে রনৌক কথাগুলো রুদ্রাণী কে বললে… খুব অবাক হয় সে। মনে মনে ভাবে…. এ কেমন মুখের ভাষা? যে মানুষ টা নীরবে প্রতিদিন তোমাদের জন্য রান্না করছে। যত্ন করে মুখের সামনে খাবার তুলে দিচ্ছে….সেই মানুষটার প্রতি এতো অবহেলা? স্নিগ্ধা কাকীর প্রতি রুদ্রানীর এই কদিনে কেমন একটা মায়া জন্মে গেছে..কেন সে নিজেই জানে না। তাই ফাঁক পেলেই সে সেজ কাকীমনির কাছে যায়, গল্প করে,বুঝতে চেষ্টা করে, তবুও কিছু একটা রয়ে যায়,বুঝতে পারে না।
সবাই বেড়াতে গেলে সেজকাকি কখনও যায়না। কিছু বললে বলে, ..আমার একা থাকাতেই আনন্দ….! এই একা শব্দটির মধ্যে এক গাঢ় নির্জনতার আভাষ পায় রুদ্রাণী।
একদিন বড়ো মা আর শাশুড়ি মা কে হঠাৎ একা পেয়ে একটু সাহস করেই রুদ্রানী বললো…
সবাই সেজ কাকীমনি কে এমন কেন করে? আপনার ছেলে সেজকাকির সাথে কথা বলতে বারণ করেছে। শাশুড়ি মা বলেন, জানি তুমি কানাঘুষো অনেক কিছু শুনেছো, আমার ছেলের কাছেও কিছু শুনেছো… তোমার সব শুনে কি মনে হয় বৌমা? রুদ্রাণী একটু চুপ থেকে বললে, মনে হয় আপনি আর ঠাকুমাই ঠিক..।
উনি হেসে বললেন, একদম ঠিক বলেছো মা… স্নিগ্ধা সত্যিই খুব ভালো স্বভাবের মিষ্টি মেয়ে, চিরদুঃখী, সুখ যে সবার কপালে সয় না… যে যাই বলুক যতো দোষ নভাইয়ের।
মানে নকাকুর, সে আর এখন এই বাড়িতে থাকে না। বিয়ে করে নি, অথচ যতো ঝোঁক বিবাহিত বৌদের প্রতি, কি বলবো ..একদিন রাতে আমরা সবাই যখন ঘুমাচ্ছি হঠাৎ স্নিগ্ধার ঘর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ!
সবাই ছুটে গিয়ে দেখি স্নিগ্ধা ভয়ে কাঁপছে! দেওরের কপালের ডান দিক টা কেটে রক্ত পড়ছে। সেদিন সবাই স্নিগ্ধার চরিত্র নিয়ে কুৎসা করেছিল.. কিন্তু আমি আর আমার শাশুড়ি মা নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম, সবাই স্নিগ্ধা কে তাড়িয়ে দিতে চাইলে, আমি বলি যেতে হলে ন দেওর কে যেতে হবে… আমি বেঁচে থাকতে স্নিগ্ধা আর কোথাও যাবে না। স্নিগ্ধার মা, বাবা কেউ বেঁচে নেই, ভাইয়ের সংসারে কেন অতিথি হয়ে দিন কাটাবে। এই বাড়িতে ওর সমান অধিকার আছে। সব শুনতে শুনতে রুদ্রাণীর চোখ ভিজে গেল। শাশুড়ি মায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায়…জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি তো সবার মা.. ।
সেইরাতেই রুদ্রানী সব কথা রনৌকে বুঝিয়ে বললো। রনৌক তখন অনেকটাই ছোট, তেমন করে কিছু জানতো না, সবার মুখে যা শুনতো, সেটাই সত্যি ভেবেই মানতো। আসলে সত্যি টা বাঁচে মিথ্যে হয়ে, আর মিথ্যা বাঁচে সত্যি হয়ে। জীবন তো এমনই..! সং এর সার সংসার! সেদিনও রোজকার মতোন ভোর হলো,তবে কুয়াশা মাখা.. আজ রনৌকের জন্মদিন। অফিস যাবার সময় খেতে বসলে পায়েসের বাটি স্নিগ্ধা এগিয়ে দিলো, রনৌক বললো সেজ মা পায়েসটা খেতে দারুন হয়েছে, আর একটু দেবে? তোর জন্য তো করেছি বাবু, একটু কেন, যতটা মন চায় নে। আজ প্রথমবার রনৌক সেজ মা বলে ডাকতেই,গিন্নি মা, ঠাকুমার মুখ খুশিতে ঝলমল…মনের কুয়াশা কেটে বুঝিবা চোখে জল এলো…
সজল নয়নে রুদ্রানীর দিকে তাকিয়ে রইলো স্নিগ্ধা চোখের ভাষায় কিছু যেন বলতে চায়…. বাইরে তখন রৌদ্রজ্জ্বল নীলাভ আকাশ….।