শুদ্ধিকরণ
” মহারাজ,আজ আপনি আমাদের জন্মান্তর নিয়ে কিছু বলুন ?”
” জন্মান্তর ? হুম ,ভালো প্রশ্ন করেছ ? তোমার এই বিষয়ে উৎসাহ নিরসন করবার চেষ্টা করছি। শোন তবে।”—
অদৈত্যনাথ আচার্য তার সামনে বসে থাকা মানুষগুলির মধ্যে থেকে নরেন দলুইকে কথাগুলো বললেন।
দোহারা চেহারা,শান্ত,বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, সৌম্যকান্তিরূপ ।মহারাজের দরাজ গলার আওয়াজ আর এইরূপেই— মনকষ্ট অনেকটাই লাঘব হয়ে যায় সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর।
তার ওপর তিনি জীবনের কঠিনকঠিন কথাগুলোও এমন সহজ করে বলেন যে সেটা যেন ‘জলবৎ তরলং’ হয়ে যায়।যেটা বুঝতে হরি মুচি , নরেন দলুই বা বীরেন ঘরামির এতটুকু অসুবিধে হয় না।
সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পরে সন্ধ্যেবেলায় পানপাড়ায় গিয়ে চোলাইপানে অভ্যস্থ গ্রামের অধিকাংশ পুরুষেরা। হাতের সর্বস্ব খুঁইয়ে ঘরে ফিরে বীর পরাক্রমে অকথ্য গালিগালাজ করা বৌ পেটানোটা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম।
নিয়মিত অত্যাচারে অতিষ্ঠ লক্ষ্মী, অতসী ,ছায়া ,কমলারা একদিন মহারাজের শরনাপন্ন হয়।
ওদের দৃঢ়বিশ্বাস —-মহারাজের অদ্ভুত শক্তিই একমাত্র ওদের দুঃখ দূর করতে পারে —-
অদৈত্যনাথ আক্ষরিক অর্থে গৈরিকবসনধারী কোন বাবা বা মহারাজ নন। হদ্দগ্রাম হৃদয়পুরের গ্রামবাসীর ভালোবাসায় এই উপাধিটি তিনি অর্জন করেছেন।
জীবনের হিসেবখাতার পাঠ চুকিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের শান্তির সন্ধানে সঞ্চিত অর্থটুকুকে সম্বল করে ঘর ছেড়েছিলেন অদৈত্যনাথ।
অনিশ্চিত যাত্রার কোন ঠিকানাই তার ছিল না।নিরুদ্দেশের পথে রওনা হয়ে হৃদয়পুর স্টেশনে ট্রেনটি থামতেই স্টেশনের নামেই একটা টান অনুভব করেন অদৈত্যনাথ।
সেই অনুভূতির টানেই নেমে পড়েন হৃদয়পুরে।
সবুজ ধানক্ষেতের মাঝখানে ছোট্ট একটা স্টেশন। দু চারজন যাত্রীর ওঠা নামা। টিনে ছাউনিতে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। তারপাশেই একটা ছাদপেটানো ঘর।বাইরে লেখা “স্টেশন মাষ্টার “।
কাঁধের ঝোলা ব্যাগটি নিয়ে স্টেশনে নেমে চারদিকে তাকাতেই মলিন পোশাকের এক কিশোর এসে বলে “বাবু , চা খাবে ?”
ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই কিশোরটি কিছুটা অপ্রস্তূত হয়ে বলে “না , দোকান বন্ধ করে দেব তো — তাই বলছি।সন্ধ্যের আগে এখানে কিছু পাবে না।তোমাকে তো আগে কখনো দেখি নি –এখানে নতুন মনে হচ্ছে তাই আর কি —“
অদৈত্যনাথ মৃদু হেসে বলেন “দাও তবে এক কাপ চা আর দুটো খাস্তা বিস্কুট। “
স্টোভ পাম্প করতে করতে কিশোরটির আবার প্রশ্ন ” তা বাবু , এখানে কার বাড়ি যাবে ? “
“তা তো জানি না —
“সেকি ?”– বিস্ময়ে প্রশ্ন করে কিশোরটি বলতে থাকে “এখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে হৃদয়পুর গ্রাম।ট্রেনের সময় অনুযায়ী এখান থেকে খান কয়েক সাইকেল রিক্সা চলে যাত্রীদের আসাযাওয়ার জন্য।এছাড়া আর কিছু নেই।এতক্ষণে তো সব রিক্সাই ফিরে গেছে।”
এতকিছু বলার পরেও বাবুটির মুখে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্নতার ছাপ না দেখে সে নিজে থেকেই বললো “দাঁড়াও দেখি কিছু ব্যবস্থা করতে পারি কিনা !”
অদৈত্যনাথের চোখ আটকে গেছে দীর্ঘদিনে অব্যবহৃত সিমেন্টের চেয়ারের ওপর অনাদরে পরে থাকা আগুনরঙা পলাশ ফুলের কার্পেটের দিকে।
দূরে কোথায় যেন কোকিলের “কু কু “— ডাক।
“এদিকে এসো বাবু।যাক বাবা , তোমার ভাগ্য ভালো তাই আজ খগেনের ভ্যান রিক্সাখানা এখনও আছে —” বলে এসেছি “যাও গিয়ে বসে পড় “—
সাথে আরো তিনজন যাত্রীর সঙ্গে অদৈত্যনাথের যাত্রা শুরু হয়।
গ্রামের সরল সাধাসিধে এই তিনসঙ্গীও নিজেদের কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে আলাপ জমিয়ে বসে অদৈত্যনাথ আচার্যর সঙ্গে।
শহরের প্রাণহীন মানুষের কলরবে হাঁপিয়ে ওঠা অকৃতদার অদৈত্যনাথও প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে পৌঁছে গেলেন হৃদয়পুরে।
অস্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য রামু দোকানির দক্ষিণের ঘরটা ভাড়া নেন।
মাস ছয়েক যেতেই গ্রামের উত্তরপূর্ব দিকে দেবু ঘরামির ফালি জমিটা অনেকবেশী দামে কিনে নেন নিজের সঞ্চিত অর্থ থেকে।
সেই খুশিতেই দেবু আর তার দুই ছেলে অপু, দীপু তাতে মাথা গোঁজার আস্তানাটি বানিয়ে দেয় অদৈত্যনাথকে।
দেবু ঘরামির কন্যা লগ্নভ্রষ্টা হবার হাত থেকে সেদিন বেঁচেছিল কিন্তু প্রাপ্যটুকু ছাড়া বাড়তি অর্থ হাত পেতে নিতে দেবুর আত্মমর্যাদায় লেগেছিল।
তাই দুইছেলেকে নিয়ে নিজে খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘরখানি বানিয়ে অদৈত্যনাথকে উপহার দিয়ে সন্তুষ্ট হয়েছিল দেবুর মন।
দেবুই প্রথম অদৈত্যনাথকে মহারাজ বলে ডাকে।তারপর থেকে অদৈত্যনাথ হয়ে উঠলেন গ্রামের মহারাজ। ছোটবড় যে কোন সমস্যায় অভিভাবকের মত বিশাল ছাতার আশ্রয় দেন গ্রামের মানুষকে।
জন্মান্তরের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেন —
” পরজন্ম বলে সত্যিই কিছু আছে কিনা তা আমি জানি না।তবে শাস্ত্রে বলে আত্মার বিনাশ নেই। এই যে নশ্বর দেহ — যা নিয়ে তোমার আমার মত মানুষের অহঙ্কারের শেষ নেই।শুধুমাত্র সেটিই এক খাঁচা থেকে অন্য খাঁচায় রূপান্তরিত হয়। সেকথাকে মেনে নিলে শুধুমাত্র সেই অস্থায়ী খাঁচাটির জন্য কেন এত দ্বন্দ্ব , কেন এত বিভেদ , কেন এত মান অভিমান। যার মালিকানাই তোমার আমার হাতে নেই –তার জন্য কেন এত অহঙ্কার। তবে সৃষ্টিকর্তা বোধবুদ্ধি বলে একটা জিনিস দিয়ে পাঠিয়েছেন আমাদের। কিছু করে খাওয়ার জন্য। এবার কে কী রান্না করে খাবে সেটা তার ব্যাপার।”
অদৈত্যনাথের কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে লক্ষ্মী, অতসী ,ছায়া , কমলার স্বামীরাও।
এখন তারা নিজেদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের রোজগার ঘরে নিয়ে যায়।
স্ত্রী ‘দের সঙ্গে মিলিতভাবে তারা এখন স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার স্বপ্ন।
শিবু ,শম্ভুরা বাবামায়ের স্বপ্নপূরণ করার পথে এগিয়ে চলেছে যে যার সামর্থ্য মত।
হৃদয়পুর গ্রাম এখন অনেকের হৃদয়েই আর্দশ বলে জায়গা করে নিয়েছে।
হৃদয়পুরের আকাশে বাতাসে শান্তির শীতলহাওয়া। অদৈত্যনাথ আচার্য জন্মান্তরের বাস্তব রূপকে রূপায়িত করতে পেরে মহাশান্তিতে আছেন।এই রেশটুকু নিয়েই তিনি চির শান্তির দেশে যাত্রা করতে চান।