Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » “সতী” গল্পে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের এক অসাধারণ সমাজবার্তা || Purabi Dutta

“সতী” গল্পে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের এক অসাধারণ সমাজবার্তা || Purabi Dutta

“সতী” গল্পে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের এক অসাধারণ সমাজবার্তা

এক থেকে ছ’টি অধ্যায়ে বিবৃত  এক বড়ো গল্প  হলো “সতী”। লেখক শরৎচন্দ্র  আক্ষরিক অর্থেই  গল্পের মূল চরিত্র  নির্মলার সতীত্বের  নিদর্শন চিহ্নিত  করেছেন। কেমন সে সতীত্ব তা প্রতি পাতায় পাতায় বর্ণিত। আপাত দৃষ্টিতে  মনে  হয়, সতীত্বের পরাকাষ্ঠাই বুঝি গল্পের  প্রধান  লক্ষ্য। কিন্তু সত্যিই  কি তাই? সতী শব্দের পুলিঙ্গ জানা নেই বা তার প্রয়োজনও নেই। কারণ “সতী”,  “বাজা” , “বেশ্যা” এসবের পুলিঙ্গ হবে কেন? এ তো শুধু বিশেষ বিশেষ নারী চরিত্রের  বিশেষণ ।

নির্মলার কেমন সতীত্ব ছিল, সে কথা গল্পে নানা রঙে রঞ্জিত।

কিন্তু শেষ  অধ্যায়ে এসে থমকে যেতে হয়, সন্দেহ  হয়, সতীত্বের আধারে লেখক কি  এক বার্তা দিয়েছেন, সমাজকে?

হ্যাঁ, গল্প  শেষে তাই  মনে হয়, “সতী” না হয়ে গল্পের  নাম “সাম্যবাদ” হলেও অযৌক্তিক  হতো না। আসলে “সতী” নামটি গল্পের শ্লেষাত্বক  এক খবর মাত্র। তো প্রকৃত সতী ত তিনিই ছিলেন যিনি স্বামীর  মৃত্যুর  পর স্বেচ্ছায় সহমরণে যেতেন, তা বয়স যাই হোক না কেন বাপু– আট থেকে আশি। এমনই তা স্বেচ্ছায়  যে, মহাসমারোহে ঢাকঢোল উচ্চস্বরে বাজিয়ে, বাঁশ দিয়ে সতীর দেহ চেপে ধরে , তার আনন্দ ধ্বনির সংবাদ কানে আসতে দেওয়া হতো না ।

পরবর্তীকালে হিন্দু বিধবারা বঞ্চিত  হলো সে আনন্দ  পেতে, কোন এক রাজা রামমোহন রায়ের জন্য  নাকি!!!! তা যাক্ এবার একটু গল্পে আসি, কেমন সে সতীত্ব —–

গল্পের  প্রধান  নারী চরিত্র  নির্মলা । হরিশ (কলকাতায়, তার পিতা রায়বাহাদুর, সাবজজ)—  পাবনায়  এক সম্ভ্রান্ত  উকিল। বিধবা ছোট বোন উমা এবং স্ত্রী নির্মলা ও দাস দাসী, ঘোড়ার গাড়ির  কোচোয়ান ইত্যাদিরকে নিয়ে তার সংসার। জনসাধারণের কাছে একটি ঘটনায় নির্মলার  চূড়ান্ত সতীত্বের প্রমাণ হয়ে যায়।

একবার  হরিশ  দূরারোগ্য  ব্যাধি (বসন্ত রোগ) আক্রান্ত  হলে, বাড়িতে সকলেই  ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল ,  কলকাতা থেকে  রায়বাহদুর এলেন , ডাক এলো কবরেজ এর….. হরিশের বৃদ্ধা মা আছড়ে  পড়লেন। কিন্তু, নির্মলার সেসবে ভ্রুক্ষেপ  নেই,স্বামীর কাছেও এলেন না, ছুটে এক কাপড়ে বেড়িয়ে গেলেন, চীৎকার করতে করতে…. ” আমি যদি  সতীমায়ের কন্যা  হই, তবে এ যাত্রায় আমার নোয়া সিঁদুর  ঘোচাবে সাধ্যি কার? তোমরা ওঁকে দেখো, আমি চললুম,…. ….” তিনি শীতলা মায়ের মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে রইলেন অনাহারে। প্রায় সাতদিন পর হরিশ সুস্থ হয়ে উঠলেন, তা সে কবরেজের পাচনের জন্য,  না সাহেব ডাক্তারের ঔষধগুণে বা ঠাকুরের চরণামৃতের দরুণ, না উমার সেবাশুশ্রূষার তরে অথবা নির্মলার  হত্যে দেবার জন্য, না হরিশের পরমায়ুর জোরে, কোন একটা কারণ ত বটেই।

কিন্তু, এক বাক্যে  আশপাশের  সকলের দৃঢ় ধারণা হলো , এ যাত্রায় হরিশ সেরে উঠেছে শুধুমাত্র  নির্মলার গুণে, এমন সতী স্ত্রী সত্যিই বিরল!!! চারদিক  রটে গেলো মুখে মুখে—- হ্যাঁ, সতী বটে!!! হরিশ উকিলের স্ত্রী—-

আমার  প্রশ্ন,  নিমর্লা নিজ সতীত্বের  কথা বলতে পারে, কিন্তু আবার  মায়ের সতীত্বেরও দোহাই  দিল কেন? তবে কি মনে কোন  দ্বন্দ্ব ছিল, কোন অঘটন হলে মায়ের সতীত্বের  তীর সেদিকে যাবে? যাকে বলে loopholes ।

বিয়ের দিনেই, নির্মলাকে তার গর্ভধারিণী চুপেচাপে বলেছিলেন সংসারের মূলমন্ত্র— স্বামী  পুরুষটিকে সর্বদা চোখে চোখে রাখতে হয়, নতুবা বলা যায় না, রাশ আলগা করলে কি কি হতে পারে !!! বেদবাক্যের মতো  নির্মলা তা পালন করে চলত। হরিশের কোন স্বাধীনতা ছিল না, যেমন কোন মহিলা মক্কেলের এর সাথে একান্তে মামলা আলোচনা বা, সহপাঠিনীর সান্ধ্য চায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা  বা এমন কি কোন দাসীদের সাথে কথা বলার দরকারে ইত্যাদির। কোন রকম মহিলার সাথেই  হরিশের কথা বললেই সঙ্কটের মাঝে পড়তে হতো, একমাত্র  উমা ব্যতীত। অকথ্য তিক্ত ভাষায় হরিশের চরিত্র  নিয়ে সকলের সামনে, দাস দাসী, কোচোয়ানদের উপস্থিতিও উপেক্ষা করে দোষারোপ  করত। প্রথমদিকে হরিশ  সকলের কাছে স্ত্রীর  পাগলামি  বলে রেহাই  পাবার চেষ্টা চালাত। কিন্তু তাও হলো না। হরিশের জীবন  দুর্বিসহ হয়ে উঠল, তার সর্বদা মনে হতো, পেছনে দুটো চোখ  তাকে অনুসরণ করছে। সারা শহরে ফলে কিছুদিনের মধ্যেই  হরিশের বদনাম হতে লাগল। চরিত্রে নারীঘটিত কালি। বন্ধুগণও নানা ইঙ্গিতে হাস্যরসিকতায় লিপ্ত হতো। আদালতেও এক অবস্থা। ক্রমে, সকলেই  বলতে  থাকলো এমন সতী সাধ্বী স্ত্রীর  স্বামী  এত চরিত্রহীন !!!

অবশেষে সব কিছু ছেড়ে হরিশ নির্বাসন নিলেন নিজ বাড়ির  একতলার এক ঘরে। তার মনের অবস্থা, তার দুর্দশা, তার দুঃখের এই নির্বাসন  বুঝতে পারল শুধু বোন উমা—-

“বিশ্বাস” হলো ভালবাসার  প্রথম বুনিয়াদ আর “সন্দেহ”  বাস করে ভালবাসার   বিপরীত মেরুতে । আর যাহোক হরিশ ও নির্মলার দাম্পত্য ভালবাসা ছিল না। নির্মলা ভালবাসত এক দাম্পত্য  ধারণাকে, মানুষ হরিশকে নয়।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে যেমন শরৎচন্দ্র  লিখেছেন…….

“”উমা আসিয়া চোখ মুছিয়া কহিল–দাদা, তুমি আবার বিয়ে কর। হরিশ  কহিল, পাগল। উমা কহিল,পাগল কেন? আমাদের  দেশে ত পুরুষদের বহুবিবাহ  ছিল।

হরিশ কহিল, তখন আমরা বর্বর  ছিলাম।

উমা জিদ করিয়া কহিল,  বর্বর  কিসের? তোমার  দুঃখ আর কেউ না জানে, আমি ত জানি। সমস্ত জীবনটা কি এমনি ব্যর্থ হয়েই যাবে?

হরিশ  বলিল, উপায় কি বোন ? স্ত্রী ত্যাগ  করে আবার বিয়ে করার ব্যবস্থা পুরুষের  আছে জানি, কিন্তু মেয়েদের  ত নেই। তোর বৌদির যদি এ পথ খোলা থাকত, তোর কথায় রাজী হতাম, উমা।

তুমি কি যে বল দাদা! উমা রাগ করিয়া চলিয়া গেল। হরিশ  চুপ করিয়া একাকী বসিয়া রহিল। তাহার উপায়হীন অন্ধকার চিত্ততল হইতে কেবল একটি কথাই বারংবার উত্থিত  হইতে লাগিল, পথ নাই, পথ নাই! এই আনন্দ হীন জীবনে দুঃখই ধ্রুব  হইয়া রহিল।””

বাস্তবিক, এক স্ত্রীর  বর্তমানে, তখন ত, পুরুষের বহুবিবাহের চল ছিল, বিশেষ,  সন্তান না হলে ত আরও। স্ত্রী মৃত হলে ত কথাই নেই, স্ত্রী ত্যাগ  করেও অনায়াসে বিবাহের  চল ছিল। ছোটবেলাতে গল্প  শুনেছি, আমাদের এক আত্মীয় স্ত্রীর শবদেহ, শ্মশানে দাহ করে এসে পরদিনই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন। এ শুধু গল্প  বা স্মৃতিকথন, সম্পূর্ণ  স্বাভাবিক—- কোন ছি-ছি রবে ধিক্কৃত  নয়।

সেই সমাজে শরৎচন্দ্রের  নারী পুরুষের  সাম্যবাদের এ বার্তা অনাগত ভবিষ্যদ্বাণী হিসাবে কতটা স্পর্ধিত ও ইঙ্গিতাবহ  ছিল, তা ভাবতে সত্যিই অবাক হতে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress