অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণ
শরৎচন্দ্র জন্মসূত্রে হিন্দু, পরবর্তীকালেও তাঁর হিন্দুত্ব বজায় ছিল, ছিল না ধর্মের গোঁড়ামি।
কলমাস্ত্রে প্রতিবাদস্বরূপ তুলে ধরেছিলেন সমাজের কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথা, ছ্যুৎমার্গ অভ্যাস, নারীদের অবস্থান ও অবমাননা, অশিক্ষার কালোছায়াতল।
দারিদ্র তার নিত্য সঙ্গী ছিল বলেই নানা পরিস্থিতিতে ঋদ্ধ হয়েছিলেন ক্রমাগত,ছিল তৃতীয় নয়নে আশপাশ অঞ্চল অবলোকন— পরে মনীষাদীপ্ত মেধার পরিস্ফুটন ঘটলো কাগজ কলম দ্বৈত সমাহারে।
শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল দেবানন্দপুর , তার পৈতৃক বাড়িতে।
১৬০৬ সালে, প্রথম দুর্গা পূজার প্রচলন করেন নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। এর আরও অনেক আগে থেকেই ১৫৮১ সালে কনৌজ থেকে এ দেবানন্দপুরে এসে জমিদারি পত্তন করেন দত্ত মুন্সিদের পঞ্চদশ পুরুষ কামদেব দত্ত। কামদেবের জমিদারির রমরমা ছিল কাঠের কারবার থেকে। সপ্তগ্রামে ছিল সরস্বতী নদীর বানিজ্য পথ। দেবানন্দপুর তখন ছিল এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। তারপর দেবানন্দপুরের জমিদার বাড়ি তিনটি ভাগে ছিল– বড় বাড়ি, নতুন বাড়ি ও ফুলিরতলা বাড়ি। তিন বাড়ি মিলেই শুরু হলো দুর্গা পূজার বিশাল আয়োজন। চলে আসছে ধারাবাহিক ভাবে।
আর সেই জমিদারি পত্তনের প্রায় দুশো বছর পর ১৮৭৬ সালে জন্ম হলো শরৎচন্দ্রের।
জমিদার বাড়ির শারদীয়া দুর্গা মূর্তি আর পাঁচজন বালক/শিশুদের মতোই প্রথম অবলোকন করেছিলেন শরৎচন্দ্র ওরফে নেড়া– সিংহের লেজ থেকে অসুরের গোঁফ অবধি।
তারপর ভাগ্য বিরম্বনায় ভাগলপুরে বাস। মাঝে মাঝে আসতেন দেবানন্দপুর, তার পৈতৃক গ্রাম—
ছেলেবেলার স্মৃতি বিজড়িত “দুর্গাপূজা” বাল্য স্মৃতির ভাণ্ডার ছিল জমির জরিপে। পরে প্রতিষ্ঠিত লেখক মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই আসতেন সে দুর্গাপূজা উৎসবে। এ কথা মুখে মুখে প্রচলিত পিতৃপুরুষদের পুরাণ কথার মতো, বর্তমান প্রজন্মের কাছে।
কথাশিল্পী সেকালের ঐ দুর্গা মণ্ডপে এসে বসতেন, চলত কিছু সাহিত্য আলোচনা, দেবী বন্দনা, বাঁশীর সুর যোজনা– মনো রঞ্জনের সাবেকি ধারা।
বদলে যায় সবকিছু— সরস্বতী নদী কোথায় লুকিয়ে চলে গেলেন। শ্রীহীন হয়ে পড়ে রইল সপ্তগ্রাম ।
ক্রমশঃ ধীরে ধীরে দেবানন্দপুর হয়ে উঠল জরিষ্ণু।
এখন চারদিক— ভেঙেপড়া পলেস্তারা, বাসন্তী ইটের চাঁপা হাসির ঝিলিক । ঝোপ জঙ্গল প্রসাধনে সজ্জিত দেবানন্দপুর বদলে নিয়েছে নিজেকে আর এক আদিম উদাসী রূপে।
বদলে গিয়েছে মনোরঞ্জনের রূপটানও।
ভাঙা মন্দিরে এখনও দুর্গাপূজার আয়োজন —- চলছে এবারেও।
মা, শরৎচন্দ্রকে আর পাঁচজনের মতো কাছে টেনে নিয়ে গেছেন। প্রকৃতিমা এ খেলায় ত অটুট সর্বদাই, কারোকে ছাড় নেই।
ছবিতে দেখা যায় সে ঐতিহ্যময় মন্দির। চারপাশ আদিম-সদৃশ ঝোঁপের জঙ্গল, আর স্মৃতিসৌধ —
“সমাজসংস্কারের বার্তাবাহক শরৎচন্দ্রের মূর্তি”।