Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সমাজ দর্পণ || Rana Chatterjee

সমাজ দর্পণ || Rana Chatterjee

সমাজ দর্পণ

‘..আবার এদিক-ওদিক তাকায়..!” বলে চোখ পাকিয়ে গলা খাঁকারি দিলো ছেঁড়া ময়লা আলখাল্লা পড়া পাগলটা।খানিক তফাতে নতুন ওভারব্রিজে সারি সারি দামি গাড়ি,ভারী ট্রাকগুলোর পিঁপড়ের মতো মিছিল করে যাওয়া দেখে উদাস হয়ে গেছিল বাচ্চা ছেলেটা।বেচারার কি দুর্গতি,যে কিনা শহরের যত্ত ফেলে দেওয়া এই ময়লা আবর্জনার স্তুপ ঘেঁটে প্লাস্টিক,কাগজ কুড়াতে আসতো,কেমন যেন বাধা পড়ে গেছে তাও ওই আধ পাগল বুড়োর খপ্পরে। ইদানিং ওই কাগজ কুড়িয়ে দুটো পয়সার মুখও দেখতে পাচ্ছিল হরি।সে যে সত্যিই কিছু করে মায়ের পাশে দাঁড়াতে পারে, নিজেকে দায়িত্বশীল সন্তান ভেবে খুশিও হচ্ছিল কিন্তু এখানে এলে বেশ খানিক সময় ঘাড় ধরে পড়াতে বসায় তাও কিনা ওই ভবঘুরে পাগলটা।

হরি যখন নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে কাগজ কুড়িয়ে শহরের সব থেকে বড়ো এই আবর্জনার স্তূপে এসে পৌঁছাতো,পাগল টাকে প্রায় দিনই দেখতো সেই একইরকম নিষ্পলক দৃষ্টি। ওই দুর্গন্ধ স্তূপের পাশে কেউ যে এভাবে শুয়ে বসে থাকতে পারে নির্দ্বিধায় ,ভেবেই অবাক হতো হরি।মুখ ভর্তি দাড়িতে পাগলটা চুপচাপ দেখতো হরির প্রতিটি পদক্ষেপ কিন্তু কোনোদিন কিছু মুখে রা কাটতো না।

তারপর মুখ চেনা হয়ে যেতেই বিকালে সংলগ্ন যে খেলার মাঠটা আছে সেখানে হরি তাকে দেখতে পেত ।ঘাসের মধ্যে কেমন গড়াগড়ি খাচ্ছে এক মুখ দাড়ি ভর্তি এই লোকটা। খেতে না পাওয়া হাড়-কঙ্কাল বেরুনো বুড়োটা বাচ্চাগুলোর ফুটবল খেলা, যোগব্যায়াম কিংবা হই হুল্লোড় চুপ করে শুয়ে উপভোগ করত।কোন কোন গার্জেন বাচ্চাদের পপকর্ন, বাদাম চকলেট কিনতে এসে যখন সামান্য কিছু পাগলটার দিকে ছুঁড়ে দিত,কি আনন্দ তখন তার চোখে মুখে। কিছু খাবার পেলেই বেজায় খুশি হয়ে লোকটা ওই চিটুনি ময়লার পাঞ্জাবির পকেট থেকে কুড়িয়ে পাওয়া অতিযত্নে ভাঁজ করে রাখা খবরের কাগজের টুকরো বের করে সবুজ ঘাসে মেলে গড়গড় করে পড়তো।তখন তাকে দেখে কে বলবে যে ও একটা পাগল বুড়ো ,যে কিনা ভবঘুরের মত শহরের নানা অলি গলি মহল্লা ঘুরে বেড়ায়। এত সুন্দর ঝরঝরে রিডিং পড়া দেখে হরির মনে পড়তো স্কুলে সবথেকে ভালো রিডিং পড়লেই বাংলা ক্লাসের খোকন বাবু হরির পিঠ চাপড়ে বলতেন,’ বাহ রে ছেলে,বাহ এত সুন্দর ঝরঝর করে পড়িস ,তোর হবে বুঝলি তোর হবে’।এত গুলো মাস স্কুল বন্ধে সব যে কোথায় তলিয়ে গেলো সেসব সুখের দিন,হরির আক্ষেপ ঝরে পড়ে।

খালপাড়ের বস্তিতে থাকা হরি আর পাঁচজনের মতোই প্রাইমারি স্কুলে যেত। বাড়িতে অভাব থাকলেও পড়াশোনার ব্যাপারে সে ছিল খুব সজাগ। পাড়ার পাঁচু মাস্টার ওর বুদ্ধি দেখে বিনা পয়সায় টিউশন পড়ানোর সুযোগ দিয়েছিলেন। এভাবেই চলছিল সব কিছু কিন্তু বাঁধ সাধলো গতবছর হঠাৎ আসা বিষাক্ত ভাইরাস দাপট।

ট্রেন বন্ধ হতে বাবার হকারি কাজ শুধু নয় রোগের প্রকোপে হরির স্কুলের ছুটি শুরু।মা, যে কটা বাড়িতে কাজ করতো,এক দুমাস তারা বেতন দিলেও আর কাজের লোক রাখতে রাজী নয় ।তবু বাবা বলতেন হরি তোকে কিন্তু পড়া চালাতেই হবে, ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গিয়েও মা সাহস দিতেন। তবু দশ বছরের হরি বেশ বুঝতে পারতো যেখানে দুবেলা খাবার জুটছে না লেখাপড়া সেখানে স্বপ্ন। বাড়ির হাড়-কঙ্কাল অবস্থা,কাজের জন্য বাবার হন্যে হয়ে ঘোরা,তারওপর লাগাতার স্কুল বন্ধ শিশুমনে খুব চাপ দিতো।যে হরি একাগ্রতা নিয়ে প্রতিদিন পড়তে যেত পাঁচু মাস্টারের আটচালায়, কেউ না আসার আগে উঁচু ক্লাসের বই উল্টে কতকিছু নিত্য নতুন বিষয় পড়ে অবাক হতো সে কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে থাকতো।বাবা কখনো মাস্ক, টুপি, গ্লাভস বিক্রি করে সংসারটাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চালাচ্ছিল কিন্তু করোনা ছোবল যে এমন ভাবে অকালে বাবাকে কেড়ে নেবে ভাবতেও পারে নি মা ছেলে।

পথে বসল পরিবার টা। পাওনাদারদের তাগাদায় অতিষ্ঠ, অসহ্য হয়ে উঠলো ওরা। কোনদিন খাবার জুটত কোনদিন কিছুই না। এদিকে কাজ নেই মায়ের, স্কুল বন্ধ পড়ায় কি আর মন বসে!! পাড়ার একটি এনজিও কাজ হারানো পথে বসা পরিবারগুলোকে মাস্ক বিক্রির কাজ দিলে দুটো পয়সা আসছিল কিন্তু হরি ঠিক করল তাকেই কিছু করতে হবে! বয়সটা কাঁচা হলে কি হবে সে বুঝে গিয়েছিল তার ওপর একটা বিরাট দায়িত্ব মাকে সুস্থ রাখা। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাঁধে বস্তার ঝোলা নিয়ে কাগজ কুড়াতে শুরু করে দেয়। প্রায় দিন সব থেকে বড় আবর্জনার স্তূপে এসে পুরনো খবর কাগজ দেখলেই পড়ার অভ্যাসটা যেন তার জেগে উঠতো ।পেপারে যে কত রকম খবর কত গল্প যা তার শিশু মন কে কিছুক্ষনের জন্য বিভোর করতো।হরি পাড়ি দিতো এক অচেনা অজানা পরিবেশে।

এমনই একদিন স্তুপ থেকে কিছু খাবারের প্যাকেট পেয়ে ভীষণ খুশি। পেটভরে কিছু বাসি বিরিয়ানি খেয়ে একটা খবর কাগজ মেলে বাচ্চাদের গল্প পড়তে বসে ছিল হরি। অমনি কোত্থেকে সামনে এসে চুপ করে দাঁড়ায় পাগলা বুড়োটা, হয়তো নিজের কাগজ পড়ার প্রতি আগ্রহের ছবি সে দেখতে পেয়েছিল বাচ্চাটার মধ্যে ।পড়ার প্রতি বাচ্চাটির তীব্র আকর্ষণ মন ভরিয়ে দিয়েছিল পাগলটার। সেই থেকে শুরু,যে পাগল টাকে কোনদিন যেচে কথা বলতে দেখে নি কেউ,সে কিনা স্নেহ বৎসল কণ্ঠে বলে ওঠে,” এই রোজ এখানে পড়তে আসবি, আমি পড়াবো তারপর না হয় কাগজ কুড়ানোর কাজ করিস”! যাকে এতদিন আধ পাগল ভেবে এড়িয়ে গেছে হরি, তার এমন আন্তরিক হওয়া,তার ওপর পড়া বিষয়ে নির্দেশ আর উপেক্ষা করতে পারে নি সে।মা কে বলেছিল, মা গো স্কুল না খুললেই বা, পাড়ার পাঁচু মাস্টার অসুস্থ হয়ে পড়ানো বন্ধ করলে কি হবে ,আমি আপনভোলা এক মাস্টার মশাইকে পেয়েছি যেখানে পড়াশোনাও হবে সেই সঙ্গে তার এই প্লাস্টিক কুড়ানোর কাজও বজায় থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *