Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নস্টালজিয়া || Manisha Palmal

নস্টালজিয়া || Manisha Palmal

নস্টালজিয়া

আমি কুমু, বসু বাড়ির একমাত্র নাতনী! থাকি শহরে! বড়দিনের ছুটিতে দেশের বাড়ি বাঁকুড়ার এই গ্রামে এসেছি! আমি গ্রাম খুব ভালবাসি আর ভালবাসি এই মাটি মাখা মানুষগুলোকে। বাড়ির একমাত্র নাতনী হওয়ার সুবাদে আমার দুরন্তপনার মাত্রাটা একটু বেশি ছিল। আমার দাদু ডাক্তার সবাই বলে তিনি ধন্বন্তরি। আমাদের বাড়িতে সব সময় লোকজনের ভিড় লেগেই থাকত। ছুটিতে বাড়ি এলে আমি সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতাম। সেবারও ঘুরতে গিয়েছি– আমাদের আম বাগানের পুকুর পাড়ে একটা- নতুন কুঁড়েঘর দেখলাম! এক ছুটে ওই পুকুর পাড়ে যেতে যাবো পেছন থেকে চুনীদিদা চেঁচিয়ে উঠলো—” যাসনি যাসনি– ছুতা” অর্থাৎ ওখানে গেলে আমাকে আবার স্নান করতে হবে! কোন কথা কানে না নিয়ে সোজা ওই ঘরের দাওয়ায় উঠে গেলাম। দেখলাম সুন্দর নিকোনো দাওয়ায় দুজন মহিলা বসে আছেন একজনের বয়স প্রায় 55— 60 অন্যজন কুড়ি-একুশ হবে। আমাকে দেখে চমকে উঠলেন দুজনে সমস্বরে বলে উঠলেন —“কেন এলি মা আমরা যে ছুতা রে– তোকে যে আবার চান করতে হবে!”
ওদের পাশে বসে জানতে চাইলাম —“ও দিদা তোমরা কবে এসেছ গো ?আগে তো তোমাদের দেখিনি!”
ওরা বলল- “আমরা নাচনীভাই ।মাস ছয়েক হলো এসেছি।”
নাচনী মানে ঝুমুর শিল্পী । আমাদের গ্রামের বাউরি পাড়ার ঝুমুর গানের ওস্তাদ বা রসিক আছে জানি। জিজ্ঞেস করলাম -“-কখন আসর বসে দিদা?”
ওরা বলল”পরবের সময় ভাই।”
আমি খুব খুশি মনে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম এবার বাউরী পাড়া যাবার তাডা। চুনি দিদা জোর করে বাড়ি নিয়ে এলো। আমিও বদমাইশি করে জামা-জুতো সমেত পুকুরে ঝপাং—! তারপরে ওই অবস্থায় বাড়ি ঢুকে ঠাম্মিকে ডাকা—দেখে যাও ঠাম্মি ডুবে এসেছি। কারণটা কি তাও খুলে বললাম যে নাচনিদের ঘরে গিয়েছিলাম। আমার মন তো পড়ে রয়েছে সেই ঝুমুর গানে। বাড়ির কেউই রাত্রে আসরে যেতে দেবে না। দাদুভাই কে গিয়ে ধরলাম। উনি বললেন রাতে আসরে যাওয়া চলবে না তবে দুপুরে যখন মহলা চলে তখন শোনা যেতে পারে। তাই সই! দুপুরে খেয়ে আবার গেলাম দিদার সাথে ঐ পুকুরপাড়ে নাচনীদের ঘরে। দেখলাম অনেক লোকজন যাদের নাম জানিনা মুখ চিনি ,তারা বসে আছে !বাদ্যকর রা হারমোনিয়াম ,তার যন্ত্র ,তবলা বাঁয়া ,খোল সব নিয়ে প্রস্তুত! দেখলাম দিদার মেয়ে সুন্দর করে পেচিয়ে শাড়ি পরেছে, পাতা কেটে চুল বেঁধেছে, দুই হাতে দুটি লাল রুমাল আঙ্গুলে বেঁধে গান শুরু করলো—– ভালো ছিল শিশুবেলা যৌবন কেন আসিল
রাঙা ফুল ফুটল ডালে
ভ্রমরা আসি জুটিলো।
কি মোহময় কণ্ঠস্বর !কান জুডিয়ে গেল। সুর-ছন্দের দোলায় মন ভরে গেল কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। দিদা টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে গেল ।আমি খালি ঝুমুরের কলি গুনগুন করছি ভালো ছিল— শিশুবেলা –ভালো ছিল শিশুবেলা—!

পরদিন সকালে ঘুম ভাংলো লোকজনের হট্টগোলে– ভাবলাম দাদুর ডিস্পেন্সারিতে রোগীদের ভিড়! নিচে নেমে দেখি নাচনী দিদার মেয়ে হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে ।সবাই ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে ।কি হয়েছে বুঝতে পারলাম না। আমাকে ওখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হল।
বাড়ির ভেতরে এসে শুনলাম নাচনি দিদা কাল রাতে মারা গেছেন। ওরা নাচনি বলে কেউ মরা ছোঁবে না। কিভাবে দাহ হবে —তাই দাদু ভাইয়ের কাছে এসেছে সাহায্যের জন্য! কিছুক্ষণ পর দেখলাম তালাই অর্থাৎ খেজুর পাতার মাদুরে জড়িয়ে বাঁশে বেঁধে মরা জন্তুর মত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওই মৃতদেহ! দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছি দূরে লালমাটির পথের বাঁকে ওই তালাই জড়ানো মৃতদেহ তারা নিয়ে যাচ্ছে আর পেছন পেছন নাচনী দিদার মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে ।কোনো মানুষই তার সঙ্গী হয়নি। এই দৃশ্যটা আমার অবচেতনে এমন এক অনুরণন তুলল যে আজও চোখ বুজলে আমি তা দেখতে পাই! মানুষের প্রতি মানুষের এই অমানবিক ব্যবহার আমার শিশু মনকে একেবারে উদ্বেল করে তুলেছিল। কেন এমন হয় এই প্রশ্ন আমাকে কুরে কুরে খেত। পরে বড় হয়ে আসল কারণ জানতে পেরেছি ঠিকই কিন্তু আজও চোখ বুজলে কানে ভেসে আসে ঝুমুরের বোল আর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে ব্রাত্য নাচনির শেষ যাত্রারচিত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *