দময়ন্তী
“মেয়েটা ঠিক একদম বাপের মতো লম্বা হয়েছে”-পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, কারুর আর বলতে বাকি রইল না!মা, বনানী অবশ্য, সামনে প্রতিবারই উত্তর দেয়, মেয়েদের লম্বা হওয়া তো বেশ ভালো, বরং অরুন এর পাশে তাকে নিজেকে বেশ বেঁটে লাগে। যাক বাবা মেয়েটা অন্তত বাবার মতো হোক! সেই ক্লাস ফোর থেকেই চড় চড় করে, এমন বাড় দিলো যে মা’র মাথা ছুঁই ছুঁই! ভাসুরের ছেলের ক্লাস সেভেনে পড়া ছেলেতো বোনের পাশে আসতেই চায় না লজ্জায়! সে যাই হোক সব ঠিক ছিল, দময়ন্তী কেমন যেন ক্যাবলাই রয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন! ক্লাস নাইন হয়ে গেল, কিন্তু কোনো যেন সপ্রতিভতা নেই! প্রায় দিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরবে, আজ ক্লাসে এ রাগিয়েছে, ও রাগিয়েছে এসবের পাহাড় অভিযোগ নিয়ে! শিলং এ পোস্টিং অরুনের, সেই ক্লাস ফাইভ থেকে বনানীকেই সব কিছু সামলাতে হয়।বাইরে থেকে ওই ফোনে খবর নেওয়া টুকু ছাড়া, আর কি আর করতে পারে অরুন এটা বোঝে মা মেয়ে দুজনেই, তবু!” আর এই আর এক ধিঙ্গি মেয়ে হয়েছে, একটু যে টুকি টাকি বাজার হাট গুলো করবে, সে ভরসা টুকু নেই!
বনানী লক্ষ্য করেছে, ওর হাঁটা চলা সব যেন কেমন গোবেচারা টাইপের প্রথম থেকেই! স্কুলে জানা অঙ্ক গুলো ভুল করে চলে আসছে!পাড়া প্রতিবেশীরা, ছেলে পিলে গুলোও মুখ টিপে হাসে দময়ন্তীর রকম সকম দেখে!
একদিন সন্ধ্যায় বনানী পুরো দু ঘন্টা, মেয়ের সঙ্গে সময় কাটালো! যদিও, সব সময়ই ওরা দুটোতেই ঘরে থাকে তবু আজ কোনো পড়া শোনা নয়। দুই বন্ধুর মতো কত গল্প করলো মা, মেয়ে। অবশ্য চেহারায় মা কে ছাপিয়ে গেছে মেয়ে ! বনানী সেদিন কোনো রকম কথার লাগাম না রেখে, সিনেমা, সিরিয়াল, হিরোদের ফিগার, জন্ম বৃত্তান্ত, এমনকি যৌনতা নিয়েও নানা কথা তুলে আনছিল, মেয়ের গভীরতা জানার জন্য। আর প্রতিবারেই একটা কাঠিন্য, সঙ্কোচ বজায় রেখে দময়ন্তী নিজেকে আড়াল করছিলো!
এরপর থেকে প্রতি শনি, রবিবার মা মেয়ে বসে হিন্দি, ইংরেজি সব রকম সিনেমা দেখতো, শপিং করতো চুটিয়ে। এর ফল ও যে পায়নি বনানী তা নয়। মাধ্যমিকে বেশ ভালোই রেসাল্ট করে ওই স্কুলেই আর্টস নিয়ে ভর্তি হয়েছে দময়ন্তী। বনানী লক্ষ্য করেছে আর সেভাবে অভিযোগ নিয়ে বাড়ি ফেরে না মেয়ে, কিন্তু বেশ গুম হয়ে থাকে। বেশি হৈ হুল্লোড় একদম পছন্দ করে না।
আজ পূজার ছুটি পড়ার আগে শেষ স্কুল ছিল। একটু জলদি ছুটি হয়ে যেতে, স্কুল বাস থেকে নেমে একাই হেঁটে আসছিলো।অন্যদিন রোজ বনানী যায় আনতে আজ সর্দি লাগিয়ে হেঁচে অস্থির সে বাড়িতে। প্রতিদিন ওই এক টাইম চারটে পঁচিশে, নামলেও আজ ঘড়িতে দুপুর একটা চল্লিশ।
একপ্রকার সুনসান হলেও, মেন রোড থেকে নেমে দুটো বাঁক নিয়েই ওদের বহু পুরাতন গাছপালা ঘেরা বাড়ি যেন স্বাধীনতা যুগের সাক্ষী বহন করে মাথা তুলে আছে। হটাৎ একটা ঝড়ো হাওয়া উঠে চোখে মুখে ধুলোতে কিচ কিচ করে দিলো ! দুপুরের গরমে অল্প কটা পথ চারী আর রাস্তার দুপাশে, কিছু দোকান দুপুরের ঝাঁপ বন্ধ করার তোড়জোড় করছিল।
গলির বাঁক টা নিতেই একটা সরু অব্যবহৃত বারান্দা, ওই সদ্য গোঁফ দাড়ি ওঠা পাড়ার কিছু ছেলেগুলোর ঠেক হয়েছে ইদানিং। এমন হাওয়া দিচ্ছে ঝড়ো, দময়ন্তী হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, বুকের ওড়না সামলাচ্ছে তো স্কুল ব্যাগ আবার সালোয়ার কামিজ টা হাওয়ায় উঠে ওকে লজ্জায় লাল করে তুলছে বারে বারে ।আর এই অস্বস্তিকর দৃশ্য দেখে ফচকে ছেলে গুলো সিটি দিয়ে উল্লসিত ও ড্যাব ড্যাব করে যেন ওর উন্নত শরীর গিলে খেতে আসছে!
মুহূর্তেই একটা রাগ এসে দময়ন্তীর মাথা গরম করে দিলো।এমনিতে শান্ত, কোনো বিষয়ে ঝুট ঝামেলা পছন্দ না করা মেয়ে সে, অনেক কন্ট্রোলে, চুপ করে একদম ঠেক টা পার হলো। আর একদিন মায়ের সাথে ফিরছিল, ওদের কটূক্তি গায়ে মাখেনি সেদিন। হটাৎ আবার দমকা হাওয়াতে কামিজ টা সরে যেতেই যেই কানে এলো উল্লসিত হাসি, ঘাড় ঘুরতেই দেখে একজন ঠিক পেছনে এসে ওর এই অপ্রস্তুত অবস্থার ছবি নিচ্ছে! মুহূর্তেই কাঁধ থেকে স্কুল ব্যাগ টা এক লাইট পোস্টে হেলান দিইয়ে, ওড়না টা কে আচ্ছা করে কোমড়ে বেঁধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো ওই রোগা পটকা চারটে কে! ততক্ষনে একটা তো এই ক্যাবলা ও চুপ থাকতে দেখে অভ্যস্ত শান্ত মেয়েটির এমন রণংদেহী রূপ দেখে পগার পার!
বাকিদের কাঁচু মাঁচু মুখ দেখে উত্তেজিত দময়ন্তী বলল, “আবে শুনে রাখ, আমাদের তো তাও শরীরে ওড়না, কামিজের আস্তরণ আছে আর তোরা তো চির ল্যংটা! এই বলে দুটোকে দু গালে কষিয়ে থাপ্পড়।আরো মারতে যাবে কি ওতেই অস্থির ওরা। হাতের ধুলো ঝেড়ে স্কুল ব্যাগটা নিয়ে আপন খেয়ালে হাঁটতে লাগলো, আজ মন টা খুব হালকা লাগছিল দময়ন্তীর, আর তার নিজের কোনো কাজের জন্য গর্ব নয়, মায়ের দুশ্চিন্তা, ও পাড়া প্রতিবেশীর অমন তির্যক বাঁকা মন্তব্যের জন্য করুনা হচ্ছিল। ছোটবেলার স্বাধীনতা সংগ্রামী দাদুর একটা কথা মনেও পড়ছিল, “কুকুর যদি পেছনে লাগে, চুপ থাকলে ঘেউ ঘেউ করেই যায়, কখনো কেমন রুখে দাঁড়াতে হয় আত্মরক্ষার স্বার্থে।”
বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছতেই কানে এলো পাশের বাড়ির জ্যেঠু মোবাইলে আগমনির গান চালিয়েছেন, “জাগো… তুমি জাগো…, তুমি দুর্গা…তুমি দশভুজা..”জানলায় নজর পড়লো মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ, দময়ন্তীর দশ মিনিট লেট হয়ে গেছে কিনা! প্রতিদিন গম্ভীর হয়ে বাড়ি ফেরা মেয়েটা আজ কেমন ফুরফুরে মেজাজে গুন গুন করে গান ধরেছে।