বাইশ বছর পর
বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, পুত্র কন্যা নিয়ে ভরা সংসারটা একটু যখন প্রায় গুছিয়ে নিচ্ছিল সমীরণ আচমকা হেড অফিসের জরুরি তলব।এতদিন ভাড়া বাড়িতে ছিল, সবে নতুন বাড়িতে উঠে এসেছে এই মাস খানেক হলো। এখনো মিস্ত্রিদের হেঁকে ডেকে সময় ছুটি পেলেই বাকি থাকা কাজ গুলো করাতেই হয়।সেই সঙ্গে ছোট্ট থেকে গাছেদের প্রতি একটা অসম্ভব ভালোবাসা থেকে সামনে ছোট্ট বাগান করার জোর প্রস্তুতি শুরু করেছে ।সমীরণ লক্ষ্য করেছে অসুস্থ মা ভাড়া ঘরে টবে গাছ পরিচর্যা করার কাজে নিয়োজিত থেকে শারীরিক ভেবে কেবল সুস্থ থাকতো তা নয়, মনের মধ্যে একটা চনমনে ভাব লক্ষ্য করতো সবাই। গাছ যে মানুষের মন ভালো করে দেয় সেটা শিশুকাল থেকেই সমীরণ ও তার মায়ের থেকে ভালো কে আর বুঝবে!
বিষাদের মাঝে হঠাৎ বদলী সমীরণকে একটা কারণেই একটু স্বস্তি দিচ্ছিল সেটা হলো উত্তর বঙ্গের এই রায়গঞ্জে শৈশবের অনেক গুলো বছর কেটেছে তার।তারপর বাবা বদলি নিয়ে মালদাতে এলে কলেজ জীবন চাকরি শুরু এখানে।তবু যেন আজও চোখ বুঝলেই পৌঁছে যায় সে ছোটবেলার গাছ পালা ঘেরা সেই ছোট ছোট কোয়ার্টার জঙ্গল পরিবেশে। আসার দিন মা বললেন, ‘পারলে একবার ঘুরে আসিস তো বাবু আমাদের সেই কলোনি পাড়ায়’-‘হ্যাঁ মা আমি অফিসে জয়েন করেই ছুটবো একদিন, আমারও ওই পুরানো স্মৃতিগুলো ভীষণ যেন ডাকছে’বলে বেরুলো সমীরণ।উপায় আর কি অফিসের যখন অর্ডার কাজে যোগ তো তাকে দিতেই হবে!
আজ প্রায় বাইশ বছর পর ফরেস্ট অফিসার সমীরণ রায় পৌঁছে গেছিলো তার শৈশবের জঙ্গল ঘেরা পাড়ায়! হাঁ করে দেখেই চলেছে আগাছায় জরাজীর্ন ভেঙে পড়া বাড়িটাকে।’কিছু কি খুঁজছেন স্যর’-নেপালি ড্রাইভারের প্রশ্নে সম্বিৎ ফেরে সমীরণের।পাশেই বিরাট আবাসন তৈরি হচ্ছে, আমূল পরিবর্তন-স্মৃতি যেন খামচে ধরলো তাকে। কত কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সমীরণের একদম তরতাজা হয়ে ।তার মনে হচ্ছে একবার মা কে আনতে হবে। মা দেখে যাক নিজের চোখে স্মৃতির কলোনি যেখানে সমীরণকে নিয়ে মা বাবার প্রায় ছয় বছরের সংসার ধর্ম।আজ বাবা নেই ভেবে উদাস হলো মনটা! ইস ওই তো ওদিকটায় তাদের কোয়ার্টার গুলো ছিলো।চোখের সামনে ভাসছে কত রঙিন স্মৃতি, যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সবুজ প্রকৃতির মাঝে বন্ধুদের সাথে তার কাটানো প্রাণবন্ত শৈশব ।আবার ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ওই পোড়ো বাড়িটা নজর পড়লেই একটা চাপা কষ্ট জড়িত শৈশবের একটুকরো চিত্র মনের মধ্যে এসে সমীরণকে বেদনায় মুচড়ে দিতে লাগলো।
“মা, ওমা তাকাও না, গাছ দাদুকে আবার বকছে দেখো”-ছেলেকে কি উত্তর দেবে রঞ্জনা! ওসব বড়দের ব্যাপার, যাও ঘরে গল্পের বই পড়ো।ওই বাড়িতে চিৎকার নতুন নয়।গাছ পাগল বয়স্ক মানুষটা সারাবছর উঠোন, ছাদ জুড়ে ফুল ফলের চারা তৈরিতে মশগুল থাকে।কত রকমের দুষ্প্রাপ্য গাছ তার বাগানে।স্কুল-ক্লাব, বাচ্চাদের বিলিয়ে দেন।খুশিতে বলেন সবুজের বিপ্লব করবেন এভাবেই একদিন।নিজের বাড়িতেই নিত্য অত্যাচার, উপড়ে ফেলা দেওয়া হয় গাছ!সেবার ঠেলে হাতও ভেঙে দিলো মেয়ে। যার বিয়ে দিতে গিয়ে বর পক্ষের নানান দাবিতে, কন্যাপণে সর্বস্বান্ত হলো এই গাছ দাদু সেই মেয়েই কিনা শ্বশুর বাড়িতে অশান্তি পাকিয়ে বাবার ঘাড়ে এসে অন্ন ধ্বংস করছে আর হম্বিতম্বি।
পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে অবাক করে একদিন ওই গাছ বাড়িতে তালা পড়তেই, আগাছায় ভরলো চারিদিক।সমীরণেরও মনখারাপ হয়েছিল গাছদাদুর ভ্যানিসে।কদিন পর থেকে বিকট পচা গন্ধ, টেকা দায় হলো আসেপাশে বসবাস করা মানুষগুলোর। সন্দেহ ও অভিযোগ পেয়ে পুলিশ দরজা ভেঙে উদ্ধার করলো পচা গলা গাছ দাদুর দেহ। বিশ্বাস হচ্ছিল না কারুর এমন অমায়িক গাছ পাগল মানুষটার এমন বীভৎস পরিণতিতে! পচা মাংস কঙ্কাল হওয়া গাছ দাদুর হাতে লেগে থাকা কিছুটা মাটিতে অবাক করে কি সুন্দর মাথা তুলেছে অঙ্কুরিত দুটি পাতা।ঘর খুঁজে উদ্ধার হলো পোড়া ডায়রীর টুকরো কিছু পাতা। কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশের বয়ানে ছবির মতো সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না কারুর কেন এমন নৃশংস মৃত্যু ও প্রতিদিনের অত্যাচার চলতো!গাছ দাদুর নামে থাকা এ বাড়ি সম্পত্তি না পেয়ে প্রাণ নাশের আশঙ্খা সহ অত্যাচারের বর্ণনা মানুষটা লিখে গেছেন ডায়রীর পাতায় আর মুক্তি পেতে আঁকড়ে ধরেছিলেন সবুজ প্রকৃতি গড়ার স্বপ্ন।