অন্য ভুবন
‘যাই বলো তুমি ,বিয়ের পর অনেক সুযোগ, ফাঁকা সময় তুমি পেয়েছ ‘-মুখ বেঁকিয়ে কথা গুলো ছুঁড়ে তোয়ালেতে মুখ মুছে অন্যদিনের মতো বেরিয়ে গেল অর্ঘ্য ।সন্ধ্যার পর বাবার সাজানো বাগানের মতো বিজনেস এই বিরাট বড়ো মোবাইল শো-রুম থেকে ফিরে প্রতিদিনই বন্ধুদের সাথে ঠেকে আড্ডা দিতে যাবার অমোঘ আকর্ষণ বিয়ের চতুর্থ দিন থেকেই উপলব্ধি করেছিল সুনীতা । বাবা ,মায়ের আদুরে ছেলে ,যাক একটু ঘুরেই আসুক ,শাশুড়ী মায়ের প্রচ্ছন্ন আবদার সেদিন একটু অবাকই করেছিল তাকে ।
স্বামী -স্ত্রীর মধ্যে নূন্যতম কিছু প্রয়োজনীয় কথা বার্তা যে থাকতে পারে ,বৌ কে যে সময় দিতে হয় ,এই বোধ টাই ,বিয়ের দু বছর পার করে আজও এলো না অর্ঘ্যর ,যখনই বলতে গেছে ,”আরে কি আছে -ড্রাইভার নিয়ে বাজার চলে যেতে পারো না “বলেই কেবল ঝাঁজই দেখিয়েছে ।শরীর কেবল জাগলেই যে সহধর্মিণীর প্রয়োজন কেবল সেটা নয় তারও উর্দ্ধে সংসার নামক গোলক ধাঁধাঁর জটিল রসায়ন সামলাতে স্বামী -স্ত্রী পরস্পরকে সময় দিতে হয় ,এটা বয়সে ছোটো হলেও সুনীতা উপলব্দি করে ,কিন্তু কেবল একা একাই !
তবে সুনীতা প্রত্যক্ষ করেছে ,কোনো যে অ্যাফেয়ার আছে অর্ঘ্যর সেটাও কিন্তু নয় ।সারাদিন হই হই করেই কাটায় বন্ধুদের নিয়ে , ঘরে যেটুকু সময় থাকে ,নয় মোবাইলে গেম , নেট না হয় টিভি ,মিউজিক সিস্টেম এইসব নিয়েই মেতে থাকে ।অথচ কি আশ্চর্য্য ,ঘরে যে একটা সুন্দরী বৌ আছে ,তার প্রতি নূন্যতম দায়িত্ব বোধ পালনের কোনো আগ্রহ পর্যন্ত নেই।এমন অবহেলা, কেবল প্রয়োজনে ব্যবহারযোগ্য জিনিসের মতো নিজেকে ব্যবহার ও বাকি সময় পাস কাটিয়ে রাখা যেনো অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে প্রথম থেকেই সুনীতা।
না ,খাওয়া পড়ার কোনো অভাব বোধ হয়নি এই বাড়িতে সুনীপার বরং প্রয়োজনের তুলনায় সব কিছু একটু বেশিই পর্যাপ্ত এখানে , কেবল অভাব অনুভূত হয় প্রয়োজনীয় ভালবাসা টুকুর । ডাইনিং টেবিল জুড়ে থরে থরে সাজানো হরেক রকমের ফলের বাহার ,মার্বেল ফিনিশিং ঝাঁ চক চকে বাড়ি ঘর -ফার্নিচার কোনো কিছুর অভাব নাই এই বাড়িতে । এক গ্লাস যে জল গড়িয়ে খাবে,সে উপায় টাও নাই ,ওমনি পড়ি কি মরি করে দৌড়ে এসে সারাদিনের কাজের মাসি ঝর্ণা দি জিভ কেটে বলবে “এমা ছি ছি !একি করছো গো বৌদিমনি ,আমি থাকতে কিনা ,তুমি জল নিয়ে খাবে “! প্রথম প্রথম এইসব ভালই লাগত শুনতে ,এমন স্বাচ্ছন্দ্য তো অনেকের কাছে স্বপ্নই ।
আর এই সব দেখেই তো বাবার বাল্য বন্ধু হরিহর কাকু বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন এক রবিবারের বিকালে ,সেই দিনটা খুব মনে পড়ে সুনীতার ।ঠিক আগের দিনই ইংরাজী অনার্স নিয়ে পড়া মেয়েটা ভালো মার্কস নিয়ে স্বপ্নের বীজ বুনে ফেলেছিলো ,তার কাছে মনে হয়েছিল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবাকে হেল্প করে সংসারের হাল ধরাটা অনেক বেশি প্রয়োজনের -বিয়েটা নয় । তাই হরিহর কাকা সহাস্যে কথাটা পাড়তেই প্রোটেস্ট করেছিলো সে ,”কাকাবাবু আপনিতো সবই জানেন ,আমি কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই ,প্রতিষ্ঠিত হতে ,অন্তত এই সুযোগ টা যেনো পাই “। উনি কি বুঝেছিলেন জানি না ,খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলেছিলেন ,”সুপ্রতিষ্ঠা তো ,আলবৎ হবিরে মা ,দেখবি সব বাঁধা কাটিয়ে একদম রাজ-রানী হয়ে থাকবি ।
বরাবরই মা বাবার অত্যন্ত বাধ্য মেয়ে সুনীতা,সেদিন হয়তো নারী স্বাধীনতার এমন সুযোগে বরং আশ্বস্ত হয়েছিল ,যাক ভাই টা কে যদি একটু ভালোভাবে পড়াশোনা করাতে পারি ।প্রতিবছর পূজোর সময় এলেই বাবা কেমন যেনো গুটিয়ে যেতেন ।খুব মনে পড়ে তার ,এক বছর দশমীর দিন ও বাবার পূজা বোনাস হয় নি ! অবাঙালি মালিক ঝুনঝুনওয়ালার প্রতিনিয়ত শ্রমিক শোষন আর চটকলে নিত্য মালিক- ইউনিউনের ঝামেলা সামলানো সূপরভাইজার বাবা শ্রমিকদের স্বার্থে পাওনা গন্ডা আদায়ে ছিলেন সামনের সারি তে।সবাইকে নিয়ে বাবার এই নিত্য বেচেঁ থাকার লড়াই ,মহড়া দেখেই বেড়ে ওঠা কলোনীর আর দশ বারোটা পরিবারের সাথে সুনীতার যা ওকে অনেক বেশি বয়সের তুলনায় অভিজ্ঞ করেছিল।এই পরিবার গুলো আর্থিক মাপকাঠি এক হবার কারণেই বোধহয় এত্ত আন্তরিকতা,বিপদে আপদে পরস্পরের প্রতি এত্ত দায়বদ্ধতা ।এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কাল রাত থেকে ভীষণ জ্বর নিয়ে শুকনো মুখে হঠাৎ তার সম্বিত ফেরে তার সু সজ্জিত “অন্য ভুবন”এর বেড রুমে ।বড়ো একা লাগে ,হাঁফিয়ে ওঠে সে এমন সোনার খাঁচায় !
রাত্রি সাড়ে ন’ টা বাজলেই মায়ের হাতে সেঁকা গরম রুটির গন্ধ আজও তাকে বিভোর করে দেয় ,এখানে এসে চির-অভ্যাস মতো শ্বশুর -শাশুড়ী মাকে রাতের খাবার দিতে গেলে মিষ্টি হেসে উনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন “একি করছো তুমি বৌমা ,ঝর্ণা তো আছেই,যাও তুমি রেস্ট নাও “।
বিদূষী এই মহিলা কে প্রথম থেকেই বেশ ভালো লেগেছিল সুনীতার ,কি সুন্দর শৌখিন নরম মনের ,কাঁচা পাকা ছোটো চুলের গোল ফ্রেমের চশমায় ,রুচিবোধে সর্বত্রই এক অনন্য আভিজাত্যের ছোঁয়া,যিনি বিভিন্ন রকমের সমাজ সেবামূলক কাজের সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে ও পরিচালনায় যুক্ত থাকেন সর্বক্ষণ ।কোনো এক মাসের মান্থলি মিটিং চলছিল এই বাড়ির নিচের তলার ঘরে।সুনীতা একটু আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখেছিল ,কি সুন্দর আন্তরিক ভাবে তার শাশুড়ী মা ,আগত সকল সদস্যদের মিটিং এর অ্যাজেন্ডা গুলো বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন ,গাইড করছিলেন আগামী কাজের রূপরেখা ,ঠিক যেমন করে বাবা ,শ্রমিক কাকুদের নিয়ে মাঝে মধ্যে মিটিং করতেন ।এক অদ্ভুত মিল আর ভালো লাগা থেকে শাশুড়ী মা কে সাহস আর কিছুটা আবদারের সুরে সুনীতা বলেছিলো ,”মা ,আমাকেও তো আপনাদের দলে নিতে পারেন ,খুব বোর হয়ে যাই একা একা ওপরে “। ততক্ষণাৎ কোনো প্রতিক্রিয়া না দিলেও একদিন মিষ্টি হেসে বলেছিলেন,”এখনো নতুন বৌ এর গন্ধ যায় নি তোমার বৌমা ,পড়াশোনা টা চালিয়ে যাও ,পরে দেখা যাবে “।বলতে খুব ইচ্ছা হয়েছিল সেদিন ওনাকে, কিন্তু পারে নি বলতে যে ,”চাকরির পরীক্ষার জন্য কোচিং এর প্রয়োজন হয় মা , আপডেট থাকতে হয় ,আর চাই প্রতিযোগীতা মূলক মানসিকতা, একাগ্রতা বৃদ্ধির সুস্থ পরিবেশ,পাশের মানুষের উৎসাহ।আর যাই এই বদ্ধ স্বার্থপর পরিবেশে অন্তত হয়না “।
আর রইল বাকি ,বাড়ির অন্যতম রাশভারী সদস্য ,তার শ্বশুর মশাইয়ের পরিচয় বৃত্তান্ত ,যিনি সর্বদাই মুখে চুরুট নিয়ে আপন মনে নিচের তলার ঘরে শিকারের বইপত্র নিয়েই মগ্ন ,কেবল খাবার সময় ছাড়া সচরাচর তিনি ওপরের ঢাউস দুতলায় খুব একটা যান না ,একদিন বাইরে যাবার সময় ওনার খোলা দরজা থেকে ভেতরের জগত দেখে ঘাবড়ে গেছিল সুনীতা ,বাবা রে এটা ঘর না গভীর জংগল ! দেওয়াল জুড়ে বন্য হিংস্র দের অয়েল পেন্টিং সঙ্গে হরেক রকম মুখোশ !
ভাবলেই যেনো গা ছমছম করে তার তবু সে নানান ভাবনায় আবার ডুব দেয় ।এ বাড়িতে ইঁট কাঠ পাথরের জঙ্গল,চাপা উত্তেজনা , ভয়,কেবলই নীরবতা ,শূন্যতা ,হঠাৎ রাতের হিংস্রতা ,সব কিছুই আছে।সেই সঙ্গে আছে এমন তীব্র অনুশাসনের শেকল যেখানে সবার মাঝে মস্ত বড়ো দেওয়াল যেনো গিলতে আসে তাকে !হাঁস ফাঁস করে ওঠে সুনীতা ,হঠাৎ ভাইকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে দিদির স্নেহশীল হৃদয় ,জানালার গ্রিল ধরে নিচের রাস্তার দিকে এক অদ্ভুত শূন্যতায় দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয় ,স্কুল ছুটির ছাত্র দের ভিড়ে ভাই কে যেনো খুঁজে পেতে চায় তার উৎসুক মন ,এক ছুটে শৈশবের স্কুল জীবনে পৌঁছে যায় সে ,বাড়ি মুখো টিচার ম্যাম দের আওয়াজ ,আবার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্নকে খুঁচিয়ে দেয়। সম্বিত ফেরে দূরে কোথা থেকে ভেসে আসা গানের কলিতে “তুমি অন্য কারুর সঙ্গে বাঁধো ঘর “।