Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঘুম ভাঙার রাত || Nihar Ranjan Gupta

ঘুম ভাঙার রাত || Nihar Ranjan Gupta

সেই বেলা একটা থেকে কিরীটী

সেই বেলা একটা থেকে কিরীটী যে কি এক ওয়ার্ড পাজ নিয়ে পড়েছে তা ওই জানে।

ইদানীং দেখছি, কিছুদিন ধরে ঐ এক খেয়াল ওর মাথায় চেপেছে। দিন-রাত্রি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ঘুমনো আর খাওয়া-দাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময়টা যেন ওর আর কোন কাজ নেই। এমন কি—অত সাধের বাগান ও পাখীর দিকেও ওর নজর নেই আজকাল। চিরদিনের খেয়ালী তো, এক-এক সময় এক-এক খেয়াল মাথায় চাপে।

ইদানীং দেখছি, কিছুদিন ধরে ঐ এক খেয়াল ওর মাথায় চেপেছে। দিন-রাত্রি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ঘুমনো আর খাওয়া-দাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময়টা যেন ওর আর কোন কাজ নেই। এমন কি—অত সাধের বাগান ও পাখীর দিকেও ওর নজর নেই আজকাল। চিরদিনের খেয়ালী তো, এক-এক সময় এক-এক খেয়াল মাথায় চাপে।

একদিন ঠাট্টা করে বলেছিলাম, কি রে! রাতারাতি ধনী হবার মতলব করেছিস নাকি-ওয়ার্ড পাজল সম্ভ করে?

মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দিয়েছিল, না। কমন-সেন্সটা ঠিক আছে কিনা তাই ঝালিয়ে দেখি মাঝে মাঝে।

ওয়ার্ড পাজ নিয়ে কমন-সেন্স ঝালানো–অভিনব বটে! হেসে জবাব দিয়েছিলাম। চেষ্টা করে দেখিস সুব্রত,ব্রেনের গ্রে সেলগুলো বেশ ঝরঝরে হয়ে ওঠে ক্রওয়ার্ড পাজল সভ করতে করতে।

ঘাঁটিয়ে কোন লাভ নেই দেখে আমিও কথা বাড়াইনি।

আজও দ্বিপ্রহরে ওর বাসায় গিয়ে দেখি, যথারীতি ও ওয়ার্ড পাজ নিয়েই মশগুল; আমি কটা মাসিক নিয়ে মনঃসংযোগের চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু তারও সাধ্য কি! ঘরের জানলা-দরজা সব বন্ধ, মাথার উপরে প্রচণ্ড বেগে ফ্যান ঘুরছে, তবু মনে হচ্ছিল যেন ঘর জুড়ে একটা তপ্ত আগুনের হল্কা বইছে। দিনের বেলায় ঘরের জানলা-দরজা এঁটে রাখায় ঘরটা অন্ধকার হয়ে পড়ায় ফ্লোরোসেন্ট টিউব ল্যাম্পটা জ্বেলে দেওয়া হয়েছিল।

কৃষ্ণা এসে ঘরে প্রবেশ করল জংলীর হাতে চায়ের ট্রে ও প্লেটভর্তি পাম কেক নিজের হাতে নিয়ে। সত্যি, বসে বসে মুখ বুজে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।

সানন্দে কৃষ্ণাকে আহ্বান জানালাম, এস বৌদি ভাই। Just in time.

চায়ের সরঞ্জাম টেবিলের উপরে গোছাতে গোছাতে কৃষ্ণা বললে, এবার আলোটা নিভেয়ে জানলাগুলো খুলে দাও তো ঠাকুরপো। বাইরে চমৎকার মেঘ করেছে।

সত্যি! বলতে বলতে উঠে গিয়ে জানলা খুলে দিতেই ঠাণ্ডা একটা হাওয়ার ঝাপ্টা এসে যেন চোখে মুখে একটা স্নিগ্ধ চন্দনের প্রলেপ দিয়ে গেল। আঃ!

সত্যিই সমস্ত আকাশটা ইতিমধ্যে কখন এক সময় মেঘে একেবারে পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে।

আকাশ জুড়ে অপরূপ মেঘপুঞ্জের কি মনোরম দৃশ্য!

দূরে কোথাও নিশ্চয় বৃষ্টি নেমেছে, তারই আর্দ্রতা বাতাসে।

হঠাৎ কৃষ্ণার উচ্চ কণ্ঠস্বর কানে এল, দেখ, সত্যি বলছি, তোমার ঐ ভূতুড়ে ওয়ার্ড পাজ যদি না থামাও, একসময় সমস্ত নিয়ে আমি ডাস্টবিনে ফেলে আসব।

রুষ্টা কেন দেবি! এ তো নীরস শুষ্ক কতকগুলো কাগজ মাত্র!—কিরীটী জবাব দেয় হাত গুটোতে গুটোতে।

ঠিক বলেছ বৌদি, আমিও তোমার সঙ্গে একমত। বলতে বলতে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম।

বাবাঃ, এ যে একেবারে সাঁড়াশী আক্রমণ। কিরীটী হাসতে হাসতে বলে, একেবারে একযোগে দুদিক থেকে।

বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি নেমেছে।

কয়েকদিন একটানা অসহ্য গুমোট গ্রীষ্মের পর বাইরের বৃষ্টি ও জলো ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘরের মধ্যে আমাদের চায়ের আসরটা জমে উঠতে দেরি হয় না। জংলী এসে ঘরে ঢুকল।

একজন বাবু এসেছেন। বলছেন বিশেষ জরুরী দরকার। দেখা করতে চান।

এই বৃষ্টিতে আবার কে বাবু এল? সুব্রত, যা দেখে আয়, বোধ হয় তোরই কোন বন্ধুজন—আমার দিকে তাকিয়ে কিরীটী কথাগুলো বলে।

এবারেই ঠিক বলেছিস। কিরীটী রায়ের বাড়িতে এই অসময়ে বৃষ্টি মাথায় করে আমায় খুঁজতে এসেছে। যেতে হয় বাবা তুমিই যাও, আমি পাদমেকং ন গচ্ছামি। বলতে বলতে তৃতীয় চায়ের পেয়ালায় আমি চুমুক দিই।

কোথা থেকে এসেছেন, কি চান, কাকে চান—জিজ্ঞাসা করেছিলি ভূত? কিরীটী এবারে জলীকে জিজ্ঞাসা করে।

না তো।

তবে?

আপনার সঙ্গেই দেখা করতে চান। বললেন তো।

যা, এই ঘরেই পাঠিয়ে দে গিয়ে।

জংলী চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণাও উঠে দাঁড়ায়, ঠাকুরপো, তুমি কিন্তু ভাই রাত্রে একেবারে খেয়ে যাবে।

যাব অবশ্যই। কিন্তু কেবল মুখে খাওয়ালেই চলবে না। কর্ণেও সুধা বর্ষণ করাতে হবে।

কি, মধু ঢেলে?

না গো না! তোমার ঐ মধুকণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের বর্ষ-সঙ্গীত!

আচ্ছা সে দেখা যাবে। বলে হাসতে হাসতে কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সিঁড়িতে পদশব্দ পাওয়া গেল। এবং জংলীর পিছনে পিছনে একজন অপরিচিত ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।

নমস্কার।

নমস্কার। আসুন, বসুন– কিরীটী আহ্বান জানাল।

কিরীটীর আহ্বানে ভদ্রলোক সম্মুখের খালি সোফাটার উপরে উপবেশন করলেন।

মিঃ কিরীটী রায়—

আমি। কিন্তু আপনি–আপনাকে তো—

আমার নাম সচ্চিদানন্দ সান্যাল।–ভদ্রলোক প্রত্যুত্তরে বললেন।

ভদ্রলোককে আমি লক্ষ্য করছিলাম।

খড়ের মত তীক্ষ্ণ ধারালো নাসিকা। ছোট কপাল। গালের মাংস চুপসে গিয়ে দু পাশে হনু দুটো ব-এর মত জেগে উঠেছে। বড় বড় চোখ। চোখে পাতার কোলে একটা কালো ছাপ। মুখের দিকে তাকালেই মনে হয় দীর্ঘ অত্যাচারের যেন সুস্পষ্ট একটি স্বাক্ষর। বয়স বোধ করি পঞ্চাশের নীচে নয়। এবং সে অনুপাতে চুলে যে রকম পাক ধরা উচিত, তা দেখা যাচ্ছে না। বরং একটু বেশী কালোই। বুঝতে কষ্ট হয় না, কলপের সদ্ব্যবহার করা হয়েছে—সযতনে পক্ক কেশকে ঢাকা দেবার জন্য। মাথায় পরিপাটী অ্যালবার্ট টেরি। পরিধেয়র মধ্যে একটা নিখুঁত পরিচ্ছন্নতা যেন স্পষ্ট, বোঝা যায় তাকালেই।

ভদ্রলোক যে একজন বনেদী সৌখীন প্রকৃতির, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। গায়ে ফিনফিনে শ্বেত-শুভ্র আদ্দির পাঞ্জাবি। পরিধানে সরু কালোপাড় চুড়িদার কাঁচির মিহি ধুতি, গিলে করা কোঁচানো। পায়ে একজোড়া কালো রঙের অ্যালবার্ট সু। ঝকঝকে ব্রাস করা।

গলার অ্যাডামস্ অ্যাপেলটা বিশ্রীভাবে যেন ঠেলে আছে। হাড়-জাগানো শিরাবহুল লম্বা লম্বা হাতের আঙুল। দু হাতে গোটাচারেক সোনার আংটি। গায়ের রং প্রথম যৌবনে একদা হয়ত গৌরই ছিল, এখন তামাটে মনে হয়। যেন প্রখর রৌদ্রতাপে পুড়ে ঝলসে গিয়েছে।

আমার কাছে কি কোন প্রয়োজন ছিল সান্যাল মশাই? —কিরীটী প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ। মানে—প্রত্যুত্তরে কথাটা বলে একটু যেন ইতস্তত করেন সচ্চিদানন্দ; তাকান আমার দিকে আড়চোখে।

ওর কাছে আপনার কোন কিন্তুর কারণ নেই সান্যাল মশাই। সুব্রত আমার বন্ধু।

ও, উনিই সুব্রত রায়! নমস্কার।

নমস্কার।

সচ্চিদানন্দ এবারে গলাটা ঝেড়ে যেন একটু পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, দেখুন মিঃ রায়, বিশেষ প্রয়োজনীয় অথচ একটা গোপন ব্যাপারে আপনার পরামর্শ নিতে এসেছি।

বলুন।

আমার একটি বিশেষ পরিচিতা—শুধু পরিচিতা বলি কেন, আত্মীয়াও বলতে পারেন—গত আট বছর ধরে তার কোন সন্ধানই করতে পারছি না। অথচ তাকে যেমন করেই হোক খুঁজে বের করা বিশেষ আমার প্রয়োজন। তাই, মানে, আপনার কাছে এসেছি।

কিরীটী বললে, গত আট বছর ধরে যিনি নিরুদ্দিষ্টা, কোন সন্ধান পাননি, তাঁর কি আর কোন সন্ধান পাওয়া যাবে বলে আপনার মনে হয় সচ্চিদানন্দবাবু?

জানি না, তবে সেই জন্যেই আপনার কাছে এসেছি। সচ্চিদানন্দ বললেন।

কিন্তু, আপনি তো এ ব্যাপারে পুলিসের সাহায্য নিলেই পারতেন। তারাই

না। পুলিসের কোন সাহায্যই এ ব্যাপারে আমি নিতে চাই না। তাই কবছর ধরে নিজেই তাকে সর্বত্র যথাসাধ্য খুঁজেছি, কিন্তু কিছুতেই তার কোন সন্ধান না করতে পেরে অবশেষে আপনার কাছে এসেছি, কারণ বললাম তো একটু আগে—আমার ধারণা, তাকে আবার খুঁজে পাবই আর আপনি হয়ত তার সন্ধান আমাকে করে দিতে পারবেন।

কিন্তু সান্যাল মশাই—

না–না কিরীটীবাবু, আমার এ উপকারটুকু আপনাকে করতেই হবে। না বললে শুনছি। অনেকখানি আশা নিয়েই আপনার কাছে এসেছি। নিরাশ করবেন না দয়া করে।

ভদ্রলোক যেন কাকুতিতে একেবারে ভেঙে পড়লেন।

তারপর একটু থেমে আবার বললেন, শিবানীকে না খুঁজে বের করতে পারলে, মৃত্যুর সময় আমাকে এ জীবনের সব চাইতে বড় দায়িত্বটাই অসমাপ্ত রেখে যেতে হবে। মরেও আমি শান্তি পাব না, কিরীটীবাবু। বলতে বলতে বুকপকেট থেকে একটা মোটা খাম বের করলেন সচ্চিদানন্দ সান্যাল।

খামের ভিতর থেকে বের করলেন মলিন একটি ফটোগ্রাফ।

ফটোটা খাম থেকে বের করে কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, দেখুন। এই সেই শিবানীর ফটো।

কিরীটী হাত বাড়িয়ে ফটোটা নিয়ে চোখের সামনে ধরল।

সতেরো-আঠারো বছরের একটি মেয়ের হাফ-বাস্ট ফটো।

ফটোটা একটু পুরাতন হয়ে লালচে হয়ে গেলেও এখনো বেশ স্পষ্ট। ছড়ানো চুলের রাশ কাঁধের দু পাশ দিয়ে পীনোন্নত বক্ষের উপরে এসে পড়েছে সর্পিল গতিতে। মুখের চেহারার মধ্যে বিশেষ কিছু আকর্ষণীয় না থাকলেও দু চোখে যেন একটা বুদ্ধির দীপ্তি আছে। দক্ষিণ ভূর ঠিক নীচে, চোখের পাতার উপর বোধ হয় একটি ছোট্ট কালো তিল।

এই ফটো কতদিন আগেকার ভোলা মিঃ সান্যাল?—কিরীটী ফটোটার দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করে।

বছর আষ্টেক আগেকার।

হুঁ। এই ফটো যখনকার, তখন এর–মানে এই মেয়েটির বয়স কত ছিল?

সতেরো-আঠারো হবে।

মনে মনে একটু হিসাব করে কিরীটী বলে, তাহলে বর্তমানে এর বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে, এই তো?

হ্যাঁ, তাই।

নিরুদ্দিষ্টা হয়েছেন——আপনি বলছেন—ইনি?

হ্যাঁ।

আপনার ধারণা হল কেন যে ইনি নিরুদ্দিষ্টাই হয়েছেন?

মানে—

মানে কেউ হয়ত তাঁকে সরিয়ে ফেলতে পারে বা—

ব্যাপারটা তাহলে গোড়া থেকেই খুলে বলি আপনাকে কিরীটীবাবু।

বলুন।

.

সচ্চিদানন্দ সান্যাল তখন তাঁর কাহিনী শুরু করলেন।

মেয়েটির নাম শিবানী, সে আপনাকে আগেই বলেছি। বছর বারো আগে শিবানীর মা নারায়ণী পনেরো-মোলো বছরের কিশোরী ঐ শিবানীকে নিয়ে হঠাৎ একদিন সকালে ঢাকা থেকে আমার কলকাতার বাড়িতে এসে উঠল। নারায়ণীর বিধবার বেশ। নারায়ণীর স্বামী যতীন আমার ছেলেবেলার বন্ধু ছিল। এক গ্রামের স্কুল থেকে দুজন একসঙ্গে এনট্রান্স পাস করেছি। তারপর আমি কলকাতায় কলেজে এসে ভর্তি হলাম, যতীন ঢাকা কলেজেই পড়তে লাগল। পুজো ও গ্রীষ্মের ছুটিতে দুজনে দেখা-সাক্ষাৎ হত। আই-এ পাস করে আমি বাবার লোহা-লক্কড়ের ব্যবসায় ঢুকি, যতীন কিন্তু পড়াশুনা চালাতে লাগল। বি-এ পাস করে যতীন ওখানেই গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতার কাজ নিলে। যতীনের বিবাহের সময় আমি গিয়েছিলাম।

একটা কথা সান্যাল মশাই, আপনি বিয়ে-থা করেননি?

করেছিলাম, দুবার—প্রথমবার যতীনের বিবাহের বছর খানেক আগেই। কিন্তু সে স্ত্রী বেঁচে ছিলেন মাত্র তিন বছর। তারপর আবার—আবার যাকে বিবাহ করি, সে যদিও আজও বেঁচে আছে কিন্তু চিররুগ্না, মস্তিষ্ক-বিকৃতিতে ভুগছে।

হুঁ। তারপর বলুন।

যতীনের ঐ বিয়ের পর আর একবার মাত্র যতীনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল; শিবানীর বয়স তখন দু বছর। তারপর আর দুজনের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। সেই যতীনের বৌকে প্রথমটায় বিধবার বেশে দেখে তাই আমি চিনতে পারিনি।

যতীনের স্ত্রী নারায়ণী বললে, আমাকে বোধ হয় চিনতে পারছেন না সচ্চিদানন্দবাবু?

বললাম, না–মানে ঠিক চিনতে পারছি না।

আমি নারায়ণী।

নারায়ণী!

তবু চিনতে ঠিক পারি না। আর চিনবই বা কেমন করে, বারো-তোররা বছর আগেকার কথা তো! বারো-তেরো বছর আগে নারায়ণীর চেহারাটা ছিল প্রথম যৌবনে ঢলঢল বেশ নধর গঠন। গায়ের রংও ছিল টকটকে গৌর। কপালে ছিল সিঁদুরের টিপ। হাতে শাঁখা ও সোনার চুড়ি। আর এখন সম্পূর্ণ নিরাভরণ, সাদা থান পরিধানে, গায়ের রংও দারিদ্র্য ওঅনটনে কেমন যেন জ্বলে গিয়েছে। রোগা কৃশ চেহারা।

এবারে কথা বললে মেয়েই, আমার বাবার নাম যতীন চাটুয্যে। ঢাকা থেকে আসছি আমরা।

কি আশ্চর্য, তাই বল, যতীনের মেয়ে তুমি! বসতে হয় আগে সেকথা! কিন্তু বৌদি—

এবারেও জবাব দিল শিবানী। বললে, তিন বছর হল বাবা মারা গিয়েছেন।

তিন বছর যতীন মারা গিয়েছে! এতদিন তাহলে চলেছিল আপনাদের কেমন করে?

নারায়ণী এবারে জবাব দিলেন, কোনমতে চালাচ্ছিলাম সচ্চিদানন্দবাবু। কিন্তু মেয়ে বড় হয়েছে, গ্রামের ব্যাপার জানেনই তো। অতিকষ্টে মা ও মেয়ের গ্রাসাচ্ছাদন চালালেও মেয়ের বিয়ে দেব এমন সঙ্গতি আমার কোথায়? ত্রি-সংসারে আত্মীয় স্বজনও এমন কেউ নেই যে ঐ সোমখ মেয়ে নিয়ে তার আশ্রয়ে গিয়ে দাঁড়াব। শেষে মনে পড়ল আপনার কথা। অবশ্য মরবার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন, এ দুনিয়ায় কোথাও আমাদের স্থান না হলেও আপনার কাছে এসে দাঁড়ালে স্থান পাবই।

বললাম, তবে মনে করেননি কেন এতদিন বৌদি?

নারায়ণী বললেন, মনে পড়ত সদাই। কিন্তু দাবী যেখানে টিকবে জানি সেখানেই যে সঙ্কোচ বেশী হয় সচ্চিদানন্দবাবু। তাছাড়া কোনমতে চালিয়ে যখন নিচ্ছিলাম, তখন কেন মিথ্যে আর আপনাকে এসে বিরক্ত করি! কিন্তু শেষটায় না এসে আর চলল না বলেই

চলে এলাম শিবুর হাত ধরে।

বললাম, বেশ করেছেন, আমার যদি দুমুঠো অন্নের সংস্থান হয়, আপনার ও শিবানীরও হবে।

.

নারায়ণী ও শিবানী আমার ওখানেই থেকে গেল। শিবানীর পড়াশুনা গান-বাজনার ব্যবস্থা করে দিলাম।

বেশ চালাক-চতুর ও চটপটে ছিল মেয়েটা। বছরখানেকের মধ্যেই ঘষামাজায় মেয়েটা যেন ঝকঝকে হয়ে উঠল।

কিন্তু গোলযোগ শুরু হল আমার রুগ্না বিকৃত-মস্তিষ্কা স্ত্রী রাধারাণীকে নিয়ে।

কিরীটী আবার বাধা দিল, কেন?

সে লজ্জা ও দুঃখের কথা আর বলবেন না কিরীটীবাবু। শিবানী আমার সন্তান তুল্য, কিন্তু রাধারাণীর অসুস্থ বিকৃত-মনের মধ্যে দেখা দিল শিবানীকে নিয়ে আর এক উপসর্গ। তার ধারণা হল, শিবানীর জন্য আমি লালায়িত হয়ে উঠেছি। দিবারাত্র সে আমার ও শিবানীর পিছনে ছায়ার মত spying করতে লাগল। ছি ছি, কি লজ্জা কি লজ্জা! শিবানীর সঙ্গে আমাকে কোন সময়ে কথা বলতে শুনলে এমন বিশ্রী ভাবে চেচাঁমেচি শুরু করে দিত যে লজ্জায় আমিই পালাতাম তখন। হাতের কাছে যা-কিছু পেত ছুঁড়ে ভেঙে একাকার করে সব তছনছ করে ফেলত। সে এক বিশ্রী পরিস্থিতি। সর্বদা তটস্থ হয়ে বেড়াতাম আমরা। পারতপক্ষে কেউ কারো সামনেই যেতাম না! কিন্তু এক বাড়িতে থেকে কাঁহাতক সতর্ক হওয়া যায়। এক আধ সময় কথা বলতেই হত।

কিন্তু কি আশ্চর্য দৃষ্টি ছিল রাধারাণীর—ঠিক তার নজরে পড়ে যেতাম। আর সঙ্গে সঙ্গে কুরুক্ষেত্র বেধে যেত। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা চরমে উঠল,একদিন কি একটা কাজে বের হয়েছিলাম, ফিরতে রাত সাড়ে দশটা হয়ে গেল। মস্ত বড় বাড়ি আমার। একতলায় থাকত দুটো ঘর। নিয়ে নারায়ণী ও তার মেয়ে শিবানী। আমার নির্দেশ ছিল চাকরবাকরদের ওপরে, রাত দশটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গেই অন্দরে যাবার দরজাটা বন্ধ করে দেবার। কাজেই দরজা তখন বন্ধ ছিল। দরজার কড়া নাড়তেই কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেন্য। দরজা খুলে দিতে এসেছিল শিবানী। শিবানীকে দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম।

শিবানী তুমি! পাঁচুর মা কোথায়?

পাঁচুর মা তো নেই। দুপুরেই রাত্রের মত ছুটি নিয়ে গিয়েছে, তার এক ভাইঝি বরানগরে এসেছে, তার সঙ্গে দেখা করতে। আপনার জন্যই জেগে বসেছিলাম। ফিরতে এত দেরি হল যে?

একটা কাজ ছিল, সারতে দেরি হয়ে গেল।

সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, পিছনে পিছনে শিবানীও সিঁড়ি দিয়ে উঠছে।

দাঁড়ালাম। কিছু বলবে শিবানী?

না, চলুন আপনাকে খেতে দিয়ে আসি।

ইদানীং নারায়ণী আসবার পর থেকে দিনে ও রাত্রে দুবেলা নারায়ণী নিজেই আমাকে বসিয়ে খাওয়াত।

ফিরতে আমার যতই রাত হোক, নারায়ণী আমার জন্য জেগে বসে থাকত। তাই শিবানীর কথায় বেশ একটু আশ্চর্যই হলাম।

জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার মা কোথায়?

বিকেল থেকে মার খুব জ্বর। একেবারে বেহুঁশ হয়ে আছেন।

চমকে উঠলাম, সে কি! ডাক্তার ডাকিয়েছিলে?

না। ওরকম জ্বর মার দেশের বাড়িতেও প্রায় হত। দুদিন পরে আবার ঠিক হয়ে যায়—পালা জ্বর।

আহা, এ তো দেশের বাড়ি নয়, কলকাতা! দেশের বাড়িতে তোমরা তোমাদের যা খুশি তাই করে এসেছ, সে তো আর আমাকে দেখতে হয়নি। কিন্তু এখন আমার এখানে যখন, তখন এখানকার মতই সব ব্যবস্থা হবে। চল, তাঁকে একবার দেখে আসি।

ব্যস্ত হবেন না আপনি। চলুন, আগে খেয়ে নেবেন চলুন।

না না, তাই কখনো হয়। চল, দেখে আসি তোমার মাকে একবার।

শিবানী তবু বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমি শুনলাম না। গিয়ে দেখি, নারায়ণী জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।

চিন্তিত হয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি, পাশেই দাঁড়িয়ে শিবানী—এমন সময় হঠাৎ সিঁড়ির উপরে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার স্ত্রী রাধারাণী।

সিঁড়ির আলো রাধারাণীর চোখে-মুখে পড়েছে। সেই আলোতে রাধারাণীর মুখের দিকে তাকিয়ে যেন চমকে উঠলাম।

দুচোখে তার জ্বলন্ত অগ্নিদৃষ্টি। অন্ধকারে হিংস্র শ্বাপদের চোখ যেমন জ্বলে, তেমনি ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে।

আমি আর শিবানী বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে। কণ্ঠের ভাষা যেন লোপ পেয়েছে।

হঠাৎ বাজের মত তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল রাধারাণী, বেরিয়ে যা—বেরিয়ে যা রাক্ষুসী এখুনি আমার বাড়ি থেকে।

বলতে বলতে ছুটে এসে বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়ল রাধারাণী শিবানীর উপরে অতর্কিতে।

অবিশ্রাম কিল-চড়-ঘুষি দিয়ে জর্জরিত করতে করতে দরজা খুলে প্রায় গলাধাক্কা দিতে দিতেই শিবানীকে বাড়ির বাইরে ঠেলে দিয়ে দরজা এঁটে দিল সে।

ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে পাথরের মত নিশ্চল হয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। এতটুকু প্রতিবাদের কোন শক্তি যেন আর আমার তখন ছিল না কেমন যেন বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।

এদিকে প্রবল উত্তেজনার মুখে শিবানীকে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে টলে পড়ল সিঁড়ির উপরেই রাধারাণী। তারপর গড়াতে গড়াতে সিঁড়ি দিয়ে পড়তে লাগল।

এতক্ষণে আমার সম্বিৎ ফিরে এল। ভূপতিত রাধারাণীর কাছে ছুটে গেলাম। দেখি, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে।

রাধারাণীকে উপরে নিয়ে গিয়ে শয্যার উপরে শুইয়ে দিয়েই ডাক্তার ডাকতে ছুটলাম।

শিবানীর কথা আর মনেই ছিল না তখন।

শেষরাত্রির দিকে রাধারাণী একটু সুস্থ হয়ে ঘুমুলে শিবানীর খোঁজ নিতে নীচে গেলাম।

কিন্তু কোথায় শিবানী!

নারায়ণী তার ঘরে শয্যার উপরে তখনও জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ। শিবানী ঘরে বা বাইরে রাস্তায় যতদূর দৃষ্টি চলে কোথাও নেই।

সেই যে শিবানী হারিয়ে গেল, আর তার কোন সন্ধানই পাওয়া গেল না।

বিনা দোষে চোরের মত মার খেয়ে মেয়েটা অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে রাত্রের অন্ধকারে সেই যে আত্মগোপন করল, তারপর দীর্ঘ আট বছর কেটে গিয়েছে।

একটা কথা সচ্চিদানন্দবাবু, শিবানী দেবীর মা?–প্রশ্নটা করলাম আমি।

নারায়ণী আমার কাছেই ছিল সুব্রতবাবু। গত বছর মারা গিয়েছে।জবাব দিলেন সচ্চিদানন্দ।

নিরুদ্দিষ্টা মেয়ের সঙ্গে তাহলে তাঁর আর এ-জীবনে দেখা হয়নি?—আবার আমি জিজ্ঞাসা করি।

না।

আচ্ছা, আপনার কোন ছেলেমেয়ে?

না। নিঃসন্তান আমি।

আপনার রুগ্না স্ত্রী তো এখনো বেঁচে আছেন?

হ্যাঁ।

বর্তমানেও তাঁর অবস্থা কি সেই পূর্বের মতই?

না। পূর্বের সে রোগের উগ্রতা এখন আর নেই। চট্ করে বাইরে থেকে দেখে পাগল বলেও মনে হবে না। কোন একটা কথামাথা নেই, মুণ্ডু নেই, সেটাই হয়ত বার বার repeat করে চলেছে। কখনো হয়ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘোমটা টেনে ঘরের কোণে বসে আছে। ততা আছেই, ডাকলে সাড়া দেবে না, স্নান করবে না, খাবেও না। আবার হয়ত কখনন কখনো বিছানায় শুয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখ বুজে পড়ে আছে তো আছেই।

ঘুমিয়ে? —আবার প্রশ্ন করি আমি।

মোটেই না। চোখ বুজে জেগেই পড়ে থাকে।

আর একটা কথা, আপনার বন্ধুর স্ত্রী নারায়ণীদেবীর উপরে আপনার স্ত্রীর কিরূপ মনোভাব ছিল?

সেও এক বিচিত্র ব্যাপার সুব্রতবাবু। অত্যধিক স্নেহ করত তাকে।

আশ্চর্য তো!

আশ্চর্যই বটে।

তারপর যা বলছিলেন বলুন।

মাত্র মাসখানেক আগে হঠাৎ ডাকে একখানা চিঠি পেলাম দেরাদুন থেকে বলতে বলতে সচ্চিদানন্দ একটা খাম-ভরা চিঠি কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিলেন, পড়ে দেখুন আগে—এই সেই চিঠি।

চিঠিটা হাতে নিয়ে কিরীটী বললে, কার চিঠি?

পড়েই দেখুন আগে–-লিখছে শিবানী।

শিবানী—মানে সেই মেয়েটি?

হ্যাঁ। অন্তত তারই পরিচয় চিঠিতে আছে ও তার নামও চিঠির নীচে সই করা হয়েছে। তার মানে আপনার মনে হয়, এ চিঠি আসল শিবানীর নয়?

আগে পড়ুন চিঠিটা তারপর বলছি।

.

সচ্চিদানন্দবাবুর একান্ত অনুরোধেই শেষ পর্যন্ত কিরীটী খাম থেকে টেনে বের করে চোখের সামনে আলোয় চিঠিটা মেলে পড়তে শুরু করল।

আমিও পড়তে লাগলাম।

বেশ পরিষ্কার করে গোটা গোটা মেয়েলী হস্তাক্ষরে র কালিতে লেখা চিঠিটা। মনে মনেই পড়তে লাগলাম চিঠিটা।

শ্রদ্ধাস্পদেষু—

কাকাবাবু! চিঠিটা পড়ে পাছে আপনি বিস্ময়ান্বিত হন বা ভাবেন কার চিঠি, তাই সর্বাগ্রে বলে নিই—আমি আপনাদের সেই নিরুদ্দিষ্টা শিবানী, আপনার বাল্যবন্ধু যতীন চাটুয্যের মেয়ে। সে-রাত্রে কাকিমা আমাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বার করে দিলেও আমি মরিনি—আজও বেঁচে আছি। কাকিমা সে-রাত্রে আমাকে আচমকা অমন করে বাড়ি থেকে বের করে না দিলেও আমি দু-একদিনের মধ্যেই আপনার বাড়ি ছেড়ে চলে আসতাম। তাই আচমকা ঐভাবে বিতাড়িত হলেও আমি চমকাইনি বা মুষড়ে পড়িনি। বেরিয়ে তো আসতামই, না হয় দুদিন আগেই নিজের গোপন ইচ্ছেটা অন্যের গলাধাক্কার মধ্য দিয়ে পূর্ণ হয়ে গেল। ফলে, আমার কাজও হয়ে গেল। লোকেও জানল, আমি ইচ্ছে করে বের হয়ে আসিনি। আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সেকথা যাক। যে কারণে এতকাল পরে আবার আপনাকে চিঠি দিচ্ছি, তাই বলি। আমি আবার আপনার গৃহেই ফিরে যেতে চাই। সংবাদ অবশ্য পেয়েছি, আমার মা আর জীবিতা নেই—তা সত্ত্বেও ফিরে যেতে চাই এই জন্যে যে, আমি চাই আজ একটি শান্ত নির্জন গৃহকোণ। আপনি হয়ত বলতে পারেন, তা তো আমি নিজে দেখেশুনে মনোমত কাউকে বিবাহ করে সে আশা মেটাতে পারতাম, তার জন্যে আপনার ঘরে ফিরে যেতে চাই কেন? বিশেষ করে যেখান থেকে একদিন আমাকে গলাধাক্কা খেয়ে বের হয়ে আসতে হয়েছিল, সেই গৃহেই? তার জবাবে বলব, আপনি যে একদিন আমাকে নৃত্যগীতে পারদর্শিনী করে তুলেছিলেন, তারই সুযোগে ও নিজের অভিনয় করবার স্বাভাবিক ক্ষমতায় আজ আর আমার অর্থের কোন অভাব নেই যেমন, তেমনি অভিনেত্রীর জীবনকে বেছে নেওয়ায় সাধারণ সমাজ থেকেও আমি নির্বাসিত। আমরা যে সমাজের ছাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াই সে সমাজের সঙ্গে সাধারণ গৃহস্থ ভদ্র সমাজের কোন যোগাযোগ নেই। আমাদের অভিনয় দেখে তাঁরা তারিফ করেন, বাহবা দেন, ঘরের দেওয়ালে আমাদের ফটো ও ছবি সযত্নে টাঙিয়ে রাখেন, কিন্তু তার চাইতে বেশী কিছুই নয়। এক পঙক্তিতে নিয়ে আমাদের তাঁরা তাঁদের সমাজে কোনদিনই বসাতে চান না বা বসাবেনও না। সেইখানেই আমরা অপাংক্তেয়। আমাদের জীবনটা তাঁদের কাছে লোভনীয়, কিন্তু সে জীবনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁরা কোনদিনই তাঁদের ঘরে আমাদের তুলবেন না। সেইখানে তাঁরা খুবই সাবধান, অতিমাত্রায় সচেতন। অথচ আমি চাই, তাঁদের সেই ঘরের এক কোণে—সত্যিকারের তাঁদের পাশেই একটু ঠাঁই। এবং সেই ঠাঁই আমাকে পেতে হলে আপনাদের সমাজের পাসপোর্ট নিয়েই এগুতে হবে।

আপনি আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। চিঠিটা একটু দীর্ঘ হল, কিন্তু উপায় ছিল না। আপনার পত্রের জবাবের আশায় রইলাম। হাঁ ভাল কথা—এই পথ বেছে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার ফেলে-আসা জীবনের ওপরে পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়েছিলাম। পূর্বজীবনকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করার সঙ্গে সঙ্গেই পুরনোনামটাও বদলে নতুন নাম নিয়েছিলাম অভিনেত্রীরই উপযোগী-মণিকা দেবী। বর্তমানে আমার পরিচয় মণিকা দেবী। কলকাতাতেই আছি আমি বর্তমানে। শরীর খারাপ যাচ্ছে কিছুদিন থেকে, তাই দেরাদুনে এসেছি চেঞ্জে।

প্রণতা
শিবানী

চিঠিটা পড়া হয়ে গিয়েছিল, ভাঁজ করে খামে ভরে পূর্ববৎ কিরীটী সচ্চিদানন্দবাবুর হাতে। ফিরিয়ে দিতে দিতে বললে, পড়লাম।

এই চিঠি পেয়ে সচ্চিদানন্দবাবু আবার তাঁর পূর্ব-কাহিনীর জের টেনে শুরু করলেন, আমি প্রথমটায় কি যে করব ভেবে পাইনি। কারণ এ শুধু আকস্মিকই নয়, অপ্রত্যাশিত। শিবানী বেঁচে আছে আজও। নিরুদ্দিষ্টা হবার পর দু-দুটো বছর এমন জায়গা নেই যেখানে খোঁজ আমি করিনি। শেষটায় ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিতে কতকটা বাধ্যই হয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত এই দীর্ঘ আট বছরের ব্যবধানে যাকে ভেবেছিলাম হয়ত আর বেঁচেই নেই এবং যার মৃত্যুর জন্যে বরাবর নিজেকেই নিজে আমি নিমিত্ত মনে করেছি, তার যে এভাবে সন্ধান মিলবে, এ যে স্বপ্নেরও অগোচর।

এবারে আমিই বাধা দিয়ে বললাম, তবে কি সচ্চিদানন্দবাবু, আপনার ধারণা হয়েছে কোন কারণে যে, অভিনেত্রী মণিকাদেবী আপনার সেই আট বছর আগের নিরুদ্দিষ্টা শিবানীদেবী নন?

আমার কথায় সচ্চিদানন্দবাবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, সেই কথাতেই আসছি এবারে। প্রথমটায় মনে আমার কোন সন্দেহই জাগেনি সুব্রতবাবু। আর বলুন আপনারা, সন্দেহ জাগেই বা কি করে! যে ব্যাপারের জন্যে এই সুদীর্ঘ আট বছর ধরে দিন-রাত্রের। প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে দুষেছি, যে জন্যে আমার অনুতাপ ও অনুশোচনার অবধিমাত্র ছিল না, সেই শিবানীর চিঠি যখন পেলাম, মুহূর্তে যেন সব ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম সে পলাতকা, ভুলে গেলাম গত আট বছর সে অভিনেত্রীর জীবন যাপন করেছে, ভুলে গেলাম। তাকে ঘরে এনে তুললে অনেক প্রশ্নের উদয় হতে পারে। সব কিছু একপাশে সরিয়ে রেখে তাকে চিঠি দিলাম, চলে এস।

তারপর?

দিন দশেকের মধ্যেই সে চলে এল। এসে একেবারে সোজা আমার বাড়িতেই উঠল। শিবানী ও তার ভৃত্য নন্দন। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়স্ক তার ভৃত্য। আট বছর পরে দেখলাম, তবু শিবানীর চেহারাটা যেন আজও স্পষ্ট আমার চোখের সামনে ভাসে। সে সময়টায় ছিল তার যৌবনের সবে শুরু, রোগা ছিপছিপে শ্যামলা মেয়েটি, মাথাভরা কালো চুলের রাশ। বুদ্ধির দীপ্তিতে ঝলমলে মুখখানার মধ্যে ছিল একটা পেঁয়ো সারল্য। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে—বিশেষ করে উঠতি বয়সে চেহারা বদলায় এবং এ আট বছরে শিবানীর চেহারা বদলাবে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তবু যেন মনে হল প্রথম দর্শনেই, মুখের মধ্যে আট বছর আগেকার একটি পরিচিত মেয়ের আদল থাকলেও পরিবর্তনও অনেক হয়েছে। গায়ের রঙটা আরও একটু যেন পরিষ্কার উজ্জ্বল মনে হল, চোখে-মুখে শহুরে ঔদ্ধত্য। প্রথম দর্শনের দিন যেমন নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল, সেদিনও তেমনি করে পায়ের ধুলো নিলে আমার। আর সবচাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার কি হল জানেন, আমার স্ত্রী রাধারাণীর পায়ে হাত দিয়ে যখন হাসতে হাসতে শিবানী এসে প্রণাম করল, রাধারাণী কয়েক মুহূর্ত ভূ-কুঞ্চিত করে তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে সহসা দু হাত বাড়িয়ে তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে কেঁদে উঠল, এতদিন কোথায় ছিলি মা? আর শিবানীও যেন সেই সঙ্গে নিবিড় স্নেহে ও মমতায় আমার স্ত্রী রাধারাণীকে বহুদিনের অ-দেখা মায়ের মতই আঁকড়ে ধরল। ইংরাজীতে একটা প্রবাদ আছে না, এল আর মুহূর্তে জয় করে নিল—এও যেন ঘটল ঠিক তেমনটি। আমার বাড়ির চাকর-চাকরাণী, রাঁধুনি, সোফার, মায় আমার এতকালের বিকৃত-মস্তিষ্কা স্ত্রী পর্যন্ত শিবানীকে পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। মেয়ে যেন দীর্ঘদিন পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে তার বাপের বাড়িতে আবার ফিরে এসেছে। এক কথায় বাড়ির সকলে নিঃসংশয়ে শিবানীকে মেনে নিল, কেবল পারলাম না একা আমিই মানতে।

কেন—কেন পারলেন না?–প্রশ্ন করলাম আবার আমিই সচ্চিদানন্দ সান্যালকে।

কিরীটী পূর্বের মতই তেমনি নির্বিকার। চুপ করে বসে শুনছে।

সচ্চিদানন্দ আবার বলতে লাগলেন একটু থেমে, কেন তা ঠিক বলতে পারব না সুব্রতবাবু। তবে এও সত্যি কেন যেন কেবলই আমার মনে হতে লাগল, দীর্ঘ আট বছর আগেকার নিরুদ্দিষ্টা শিবানীকে যেন আজকের এই শিবানীর মধ্যে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিনা। কি যেন তার ছিল, কি যেন এর নেই। অনেকদিন আগেকার একটা চেনা সুর, যা একটু একটু করে সময়ের ব্যবধানে ভুলে গিয়েছিলাম, আজকের এই সুরের মধ্যে যেন সেই চেনা সুরটি ঠিক ধরা দিচ্ছে না। সরগমের মধ্যে কোথায় যেন কেটে যাচ্ছে। অথচ আশ্চর্য, মেয়েটির মধ্যে কোন খুঁতই ধরতে পারছি না। একবার মনে হচ্ছে, এই তো সে-ই-আবার মনে হয়, এ তো সে নয়। মনে মনে সর্বক্ষণ ছটফট করতে লাগলাম। মনকে কত ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলাম, একে ফিরে পাওয়ার জন্যেই তো এই আট বছর ধরে তুমি উদগ্রীব হয়ে ছিলে, তবে আজ তাকে ফিরে পেয়ে সুখী হতে পারছ না কেন? কিন্তু এ কেনর জবাব খুঁজে পাই না। ফলে হল এই যে শিবানীকে সামনে দেখলেই যেন বুকের মধ্যে কি এক অজানা আশঙ্কায় শিরশির করে ওঠে আমার। পালাতে পারলে ওর সামনে থেকে যেন বাঁচি। কিন্তু এক বাড়িতে থেকে সদা-সর্বদা পালিয়ে পালিয়েই বা থাকা যায় কি করে! তাছাড়া দেখছি, শিবানী যেন আমার সমস্ত সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটির মধ্যে ছড়িয়ে আছে। বাড়ির মধ্যে কেউ শিবানীকে জোর করে অস্বীকার করবে, এ সাধ্য যেন কারো নেই। তাকে অস্বীকার বা অবজ্ঞা করা যায় না। আর কি অদ্ভুত শান্ত ধীর স্বভাব মেয়েটির। সংসারে সকলের জন্যে নিঃশব্দে প্রাণপাত করাই যেন মেয়েটির একমাত্র লক্ষ্য।

বাধা দিলাম আবার আমিই, ভুলে যাচ্ছেন কেন সচ্চিদানন্দবাবু, মেয়েটি আজ একজন নামকরা অভিনেত্রী। হয়তো সবটাই তার অভিনয়–

অভিনয়! না সুব্রতবাবু, জীবনে অভিনয় অনেক দেখেছি, কিন্তু যে যত বড় অভিনেত্রীই। হোক, দীর্ঘ দেড় মাস ধরে দিন-রাত্রে, চব্বিশ ঘণ্টা, প্রতিমুহূর্তে এমনি নিখুঁত অভিনয় করতে পারে না। ভুলে যাবেন না, অভিনেত্রীও মানুষ। অভিনয়ের বাইরেও তার একটা আলাদা, সত্ত্বা আছে। কিন্তু যাক সে-কথা, যা বলছিলাম—ও যে আসলে শিবানী নয়, সেই সন্দেহটাই শেষ পর্যন্ত অদৃশ্য একটা কাঁটার মত খচখচ করে আমার মনে বিধতে লাগল। ওর ওপরে আমি তীক্ষ্ণ নজর রাখলাম। কিন্তু তবু যেন প্রতি পদেই আমার হার হতে লাগল। শেষ পর্যন্ত দিন কুড়ি আগে হঠাৎ একটা জিনিস আমার নজরে পড়তেই আমি চমকে উঠলাম ও সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত সংশয়ের নিরসন ঘটল। বুঝতে পারলাম এতদিনকার সন্দেহ সত্যিই আমার মিথ্যে নয়। ও শিরানী নয়।

কিসে বুঝলেন?—প্রশ্ন করলাম।

শিবানীর দক্ষিণ ভূর নিচে চোখের পাতায় একটা ছোট কালো তিল ছিল। শিবানী হাসত, চোখ বুজে এবং হাসতে গেলেই বোজা চোখের পাতার ঠিক নীচে কালো তিলটা স্পষ্ট হয়ে উঠত। এ শিবানীর চোখের পাতায় তো সে তিলটি নেই। এতদিনে—এতদিনে হারানো সূত্র-চিহ্নটি নিরুদ্দিষ্টা শিবানীর খুঁজে পেয়েছি। আনন্দের সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু বুকটা আমার কেঁপে উঠল। এ যদি সেই শিবানীই না হয়, তবে এ কে? কি এর সত্য পরিচয়? আর কেনই বা শিবানীর পরিচয়ে আমার এখানে এসে উঠল? কি মতলব?

তাই যদি বুঝলেন এ আপনার সে শিবানী নয়, স্পষ্টাস্পষ্টি মুখের ওপরে মণিকাদেবীকে সে কথা বললেন না কেন সচ্চিদানন্দবাবু?—প্রশ্ন করলাম আমিই।

পারলাম না—বলতে পারলাম না। মুখ দিয়ে আমার স্বর বেরুল না। পরের দিন ভাবলাম। বলব, কিন্তু কি আশ্চর্য! আপনাকে কি বলব, পরের দিন সে যখন স্নানের পর প্রসাধন শেষে আমাকে চা ও জলখাবার দিতে এল দেখলাম অবাক হয়ে, দক্ষিণ ভূর নিচে চোখের পাতায় একটি কালো তিল।

বলেন কি!

হ্যাঁ, তাই। বিস্ময়ে আমি যেন একেবারে বোবা হয়ে গেলাম। মনে হল, তবে কি গতকাল সকালে আমি ভুল দেখেছি! তিলটি ছিল, কিন্তু আমার চোখে পড়েনি! না, ব্যাপারটা আগাগোড়াই আমার চোখের দেখার ভুল! কেমন যেন সব গুলিয়ে যেতে লাগল।

এতক্ষণে কিরীটী একটি প্রশ্ন করল, প্রথম যেদিন আপনি তাঁর চোখের পাতায় তিলটি নেই লক্ষ্য করেছিলেন, সেদিনও কি প্রসাধন শেষেই শিবানীদেবী আপনার কাছে এসেছিলেন?

তা তো ঠিক আমার স্মরণ নেই কিরীটীবাবু। তবে আমার ওখানে আসা অবধি লক্ষ্য করেছি, সে প্রত্যহই খুব ভোরে উঠে স্নান সেরে সামান্য প্রসাধন করে সংসারের কাজ শুরু করে।

হুঁ। আচ্ছা বলে যান। তারপর?

তারপর আর কি, প্রথম থেকেই মনে সন্দেহ জাগার সঙ্গে সঙ্গে তলে তলে শিবানী-বেশী মণিকার যাবতীয় খোঁজখবর আমি সংগ্রহ করতে থাকি। পরে আরো আগ্রহের সঙ্গে সন্ধান নিতে শুরু করলাম। কিন্তু আট বছরের অভিনেত্রী জীবন মণিকার। গত আট বছর বাদে তার পূর্ব-জীবনের কোন সংবাদই সংগ্রহ করতে পারলাম না। সকলেই বললে, মণিকার অতীত জীবন সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। সে যেন অকস্মাৎ একদিন প্রাতে নিয়মিত সূযযাদয়ের মতই অভিনয়ের আকাশে দেখা দিয়েছে।

তাঁর অভিনেত্রী জীবনের ইতিহাস?—প্রশ্ন করলাম আবার আমিই।

না, সেও সাধারণ অভিনেত্রীদেরই জীবনের পুনরাবৃত্তি মাত্র। কোন আচমকা বিস্ময় বা অঘটন নেই সেখানেও। শুধুযেমণিকা সম্পর্কেইখোঁজখবর নিতে লাগলাম তাই নয়, অনেকদিন পরে আবার নিরুদ্দিষ্টা সেই শিবানীরও নতুন করে অনুসন্ধান করে দেখতে লাগলাম। কিন্তু কোন ফল হল না। শেষ পর্যন্ত মনে হল আপনার কথা কিরীটীবাবু। চলে এসেছি আপনার কাছে। এ রহস্যের একটা মীমাংসা আমাকে করে দিন। হয় নিরুদ্দিষ্টা শিবানীর সন্ধান এনে দিন, না হয় মণিকার সমস্ত রহস্য আমাকে সংগ্রহ করে দিন। আপনার যা ন্যায্য ফিজ তার চাইতেও বেশী আপনাকে আমি দেব। বলুন, আমাকে সাহায্য করবেন? সাগ্রহে তাকিয়ে থাকেন সচ্চিদানন্দ কিরীটীর মুখের দিকে।

কিছুক্ষণ পরে কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বললে, চেষ্টা করব আমি।

ঘড়িতে এমন সময় ঢং ঢং করে রাত্রি দশটা ঘোষণা করল।

সচ্চিদানন্দ চমকে উঠলেন, উঃ, রাত দশটা! এবার তাহলে উঠি কিরীটীবাবু।

হ্যাঁ, আসুন। একটা কথা, কাল সকালে আপনার ওখানে আমি যাব। বাড়ির সকলের সঙ্গে একটু-আধটু পরিচয় করতে চাই।

বেশ তো, আসবেন—আসবেন। আচ্ছা আজ তাহলে চলি, নমস্কার।

নমস্কার জানিয়ে সচ্চিদানন্দ বিদায় নিলেন সেরাত্রের মত।

ধীরে ধীরে সচ্চিদানন্দের জুতোর শব্দ সিঁড়িতে মিলিয়ে গেল এক সময়।

কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকল, কিছু খাওয়া-দাওয়া হবে, না—না? এদিকে সব যে জুড়িয়ে জল হয়ে গেল।

ওঠ, ওঠ সুব্রত, চল–বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে।–কিরীটী উঠে দাঁড়াল।

গরম খিচুড়ী ও ভাজাভুজি সহযোগে সে রাত্রের আহারপর্বটা শেষ হতে হতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।

তারপর কৃষ্ণা বৌদিকে ধরলাম, খাওয়া হল, এবার গান।

ক্ষেপেছো ঠাকুরপো! এই মধ্যরাত্রে গান।

বাধা দিয়ে আমি বললাম, নিশ্চয়, আলবৎ! জানো মধ্যরাত্রেরও রাগ-রাগিনী আছে। সঙ্গীতের আবার সময়-অসময় আছে নাকি?

সুব্রতর যুক্তি বড় কঠিন কৃষ্ণা। গাও, ধর, রেহাই নেই। হাসতে হাসতে কিরীটী বলে।

কৃষ্ণা অগানের সামনে গিয়ে হাসতে হাসতে বললে, এই মাঝরাত্রে গলা ছাড়লে যদি পাশের বাড়ির ভদ্রলোকেরা ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে বলে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে ঠাকুরপো!

বল কি বৌদি, এমন বেরসিক দুনিয়ায় কেউ আছে নাকি! মধ্যরাত্রে গান—বিশেষ করে তোমার মত সুললিত মধু-কষ্ঠে, সে তত ঘুমেরই ওষুধ।

অ্যাঁ—তার মানে, আমার গান শুনতে শুনতে তুমি ঘুমুবে? না, তবে কক্ষনো আমি গাইবো না তো!

এই দেখ! সেটা কি একটা সহজ complement হল নাকি! ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি, জীবনে মার বুকে শুয়ে ঘুমপাড়ানী গানই শোনা হল না। এ যে আমার কি দুঃখ, তুমি তা জানবে কি করে?

কৃষ্ণা অতঃপর সত্যিসত্যিই গান ধরল।

গান শেষ হলে বললাম, সত্যিই কিরীটী, ভাগ্যবান যদি কেউ থাকে তো তুই—

কাকে বলছ ঠাকুরপো? দেখছ না, এ জগতে কি ও আছে নাকি?

তাই তো! চেয়ে দেখি, সত্যিই কিরীটী ঘরের মধ্যে নেই। গেল কোথায়?

ঘরের সংলগ্ন ব্যালকনিতে এসে দেখি, স্বল্প-পরিসর সেই স্থানটিতে যে আরাম কেদারাটা সর্বদা পাতা থাকে, সেইটার উপরে বসে ধূমপানের মধ্যে আত্মচিন্তায় নিমগ্ন সে।

কিরীটী!

কোন সাড়া নেই।

আবার ডাকলাম, কিরীটী—এই–

উঁ!—কিরীটী তার স্বপ্নাচ্ছন্ন অন্যমনস্ক দৃষ্টি তুলে আমার দিকে তাকাল, ও, সুব্রত! কি রে?

বেশ লোক তো তুই! ঘরে ও গান করছে, আর তুই এখানে বসে সিগার খাচ্ছিস?

ভাবছিলাম মণিকা দেবীর কথা।

মণিকা দেবী?

হ্যাঁ রে, আমাদের স্বনামধন্যা অভিনেত্রী মণিকা দেবী।

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় সব কথা। সন্ধ্যার সেই কাহিনী।

কিরীটী বলল, সচ্চিদানন্দের ধারণা যদি নির্ভুল হয়, তাহলে স্বীকার করতেই হবে, সত্যিকার উঁচুদরের একজন অভিনেত্রী সে। Really an extraordinary talented girl!

কিন্তু শুধু অভিনয়ের কথাই বা বলছিস কেন, কি দুর্জয় বুকের পাটা একবার ভেবে দেখ কিরীটী মেয়েটার! কথাটা না বলে পারলাম না।

হুঁ। তাই তো ভাবছিলাম কোন্ পথে এগুবো। অবশ্য ভেবে একটা পথ দেখতে পেয়েছি।

কিরকম?

শঠে শাঠ্যং। আমাদেরও অভিনয় করতে হবে।

অভিনয়!

হ্যাঁ রে। যদি সত্যি সত্যিই মেয়েটা আসল শিবানী না হয় তাহলে ভাবতে বিস্ময় লাগছে, কতটা আটঘাট বেঁধে মেয়েটা ক্ষেত্রে নেমেছে।

কিন্তু উদ্দেশ্যটা কি?

উদ্দেশ্যটা অবশ্যই সাধু। আর সেটাই যদি জানতে পারব, তাহলে চিন্তার কি ছিল?

কৃষ্ণা এসে পাশে দাঁড়ালো, ঠাকুরপোও জমে গেলে নাকি!

আর বল কেন, তোমার কতটি—

কিন্তু এদিকে যে রাত কাবার হতে চলল! আজ রাত্রে কি আর ঘুমের প্রয়োজন নেই তোমাদের কারোর? না থাকে থাক, আমি কিন্তু চললাম।

কৃষ্ণা চলে যাবার জন্য পা বাড়ায়।

শোন, শোন কৃষ্ণা, সুব্রতর শোবার ব্যবস্থা–

আমাদের পাশের ঘরেই জংলী ব্যবস্থা করে রেখেছে বলতে বলতে আর দাঁড়ায় না কৃষ্ণা, সোজা শয়নঘরের দিকে চলে গেল।

.

পরের দিন বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ আমি আর কিরীটী শ্যামবাজারে কাঁটাপুকুর অঞ্চলে নির্দিষ্ট ঠিকানায় সচ্চিদানন্দ সান্যালের প্রাসাদোপম ত্রিতল অট্টালিকার সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমেই থমকে দাঁড়ালাম।

সান্যাল-ভবনেরগেটের সামনে দাঁড়িয়ে দুজন লাল-পাগড়ী-পরিহিতকনস্টেবলও পুলিসের একটি কালো তার-দেওয়া ভ্যান। আশেপাশে কৌতূহলী প্রতিবেশী দু-চারজন ছোকরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ব্যাপার কি! কোন অঘটন ঘটল নাকি?

কিরীটীই প্রথমে এগিয়ে গেল সদরের দিকে, আমিও তার পিছু নিই।

সদরে যে কনস্টেবল দুটি ঐ বাড়ির প্রহরায় মোতায়েন ছিল, তাদের মধ্যে একজন রামপ্রী, কিরীটী ও আমার পূর্ব-পরিচিত।

রামপ্রীত্ আমাদের দুজনকেই সৈলাম দিয়ে প্রশ্ন করলে, বাবুসাব, আপনারা?

কি ব্যাপার! এ বাড়িতে রামপ্রীত? আমি প্রশ্ন করলাম।

কে একজন বাবু আত্মহত্যা করেছেন এ বাড়িতে।

আত্মহত্যা করেছেন?

হ্যাঁ। সুশীলবাবু, ইন্সপেক্টর বলীনবাবু, থানা-ইনচার্জ সবাই ভিতরে আছেন, যান না।

তাই তো! ব্যাপার কি! কে আবার বাবু আত্মহত্যা করল এ বাড়িতে?

.

সেকেলে ধরনের পুরাতন বনেদী বাড়ি।

লোহার গেটের পরেই সামান্য একটু জায়গা, তারপরই বারান্দা, মোটা মোটা কাজ করা থাম। থামের মাথায় খিলানে কবুতরের বাসা। কবুতরের মৃদু বকম-বকম গুঞ্জন শোনা গেল। বারান্দার উপরেই পর পর গোটা দুই ঘরের দরজা চোখে পড়ে। ভারী পাল্লাওয়ালা সেগুন কাঠের তৈরী সেকেলে মজবুত দরজা। দুটো দরজা বন্ধ ভিতর থেকে, সামনেরটি খোলা ছিল। উন্মুক্ত দ্বারপথে চোখে পড়ল, ঘরের মধ্যে চৌকির উপরে ফরাস বিছানো এবং একধারে এ যুগের গৃহসজ্জার সরঞ্জাম দু-চারটি সোফাকাউচও আছে।

ভিতরে প্রবেশ করলাম।

ঘরটা খালি। ঘরের মধ্যে কেউ নেই। মাথার উপরে সিলিং থেকে সেকেলে আমলের একটি বেলোয়ারী কাঁচের ঝাড়বাতি ঝুলছে। দেওয়ালে এ যুগের ইলেকট্রিক আলোরও ব্যবস্থা আছে চোখে পড়ল।

ঘরে ঢুকতেই সামনের দেওয়ালে দেখা যায়, কারুকার্য-করা সেকেলে সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো একটি মস্ত বড় অয়েলপেন্টিং। ছবিটি হচ্ছে সেকেলে ধনী জমিদারদের পোশাক-চোগা-চাপকান পরিহিত ও মাথায় পাগড়ী-বাঁধা একজন পুরুষের। প্রশস্ত ললাট। উন্নত নাসা। আয়ত চক্ষু। এবং ওষ্ঠোপরি একজোড়া গোঁফ। দাড়ি নিখুতভাবে কামানো।

আর আছে ঘরে একটা দামী জার্মান ওয়াল-ক্লক ও একটি পুরাতন ডেট ক্যালেণ্ডার। দুজনেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সামনের অন্দরের খোলা দরজা-পথের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, আর অগ্রসর হব কি হব না, এমন সময় একটা ভারী জুতোর মম্ মম্ শব্দ কানে এল। শব্দটা এই ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে।

ঘরে এসে ঢুকলেন লালবাজারের পুলিস-ইন্সপেক্টর সুশীল রায়।

সুশীল রায় আমাদের উভয়েরই পূর্ব-পরিচিত এবং কিরীটীকে তিনি বিশেষ রকম শ্রদ্ধা করেন। মোটাসোটা নাদুসনুদুস চেহারা। মাথায় চকচকে বিস্তীর্ণ একখানি টাক। বেশ রসিক

লোক।

কিরীটীকে ঘরে দেখেই সুশীল রায় সোল্লাসে বলে উঠলেন, আরে, কিরীটী যে! কি ব্যাপার–তুমি এখানে? তারপরই হঠাৎ বোধ হয় মনে পড়ায় বললেন, কিন্তু আশ্চর্য, কি করে সংবাদ পেলে বল তো যে, এখানে এ বাড়িতে একটা অঘটন ঘটে গিয়েছে? শকুনের মত কি তোমারও ভাগাড়ে গরু পড়তে-না-পড়তেই নাকে গন্ধ যায় বাতাসে?

কিরীটী হেসে জবাব দিল, হে না। দৈবাৎ নয়, গন্ধ পেয়েও নয়। আজ সকালে এখানে আমার সচ্চিদানন্দবাবুর সঙ্গে appointment ছিল যে—

কার সঙ্গে?

এ বাড়ির মালিক সচ্চিদানন্দ সান্যালের সঙ্গে–কথাটার পুনরাবৃত্তি করি আমিই।

Appointment! তাহলে এবারে অন্যলোকে যেতে হবে যে appointment রাখতে হলে।

তার মানে—সচ্চিদানন্দবাবুই—

কথাটা আমার সমাপ্ত করবার পূর্বেই সুশীল রায় বললেন, হ্যাঁ, তিনিই গত হয়েছেন।

বল কি সুশীল! কিরীটী বললে।

হ্যাঁ। চল, দেখবে নাকি?

ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই আমরা যেন একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছি তখন। সচ্চিদানন্দ সান্যাল মৃত!

ব্যাপারটা বড় আশ্চর্য লাগছে সুশীল! বল তো শুনি?

সুশীল রায় প্রত্যুত্তরে এবার বললেন, এসে পড়েছ যখন, তখন না বললেও শোনাতাম আমি নিজেই। কিন্তু বলবই বা কি ছাই! ব্যাপারটা যেমন মিস্টিরিয়াস তেমনি অবিশ্বাস্য!

কি রকম? কিরীটী সাগ্রহে প্রশ্ন করে।

সচ্চিদানন্দবাবুর বাড়ির তিনতলায় যে একটি কাচঘর আছে, তারই মধ্যে ভদ্রলোককে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।

কিরীটী সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে, কাচঘর?

সুশীল রায় প্রত্যুত্তরে বললেন, হ্যাঁ। ভদ্রলোকের গাছগাছড়ার খুব শখ ছিল। ছাতে একটা বহু টাকা ব্যয় করে কাঁচের অর্কিড-ঘর তৈরী করিয়েছিলেন।

হুঁ। স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চয় নয়—কিরীটী বলে।

নিশ্চয়ই না–নচেৎ এখানে আমাদের শুভাগমন হবে কেন? ওঁরা অবিশ্যি বলছেন আত্মহত্যা।

মৃতদেহ তুমি পরীক্ষা করে দেখেছ সুশীল?

করেছি। আর তাতেই তো বুঝেছি, ঠিক আত্মহত্যা নয়।

কেন? চল না, মুখে শুনে আর কি হবে! সশরীরে অকুস্থানে যখন এসেই গিয়েছ।

চল। আয় সুব্রত।

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *