পোস্টমাস্টার এবং ধাঁধা
ঝিরঝিরে বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার বৃদ্ধ বন্ধু প্রকৃতিবিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকার পাশেই হুইলার স্টলে পত্রিকা ঘাঁটছিলেন। সেই সময় আবার ভদ্রলোককে কাছাকাছি ঘুরঘুর করতে দেখলাম। ওঁর দৃষ্টি একবার কর্নেলের দিকে, একবার আমার দিকে। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর।
একটু আগে উনি আসতে আসতে হঠাৎ যেন আমাদের দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। তারপর ভিড়ে মিশে গিয়েছিলেন। রোগাটে বেঁটে গড়নের মানুষ। বয়স আমার ধারণায় চল্লিশের উপরে। চাঁছাছোলা মুখ। বসা গাল। ছুঁচলো চিবুক। চোখদুটো ছোট এবং যাকে বলে কুতকুতে চাউনি। কিন্তু দেখার মতো লম্বা এবং তীক্ষ্ণ নাক। গায়ে ফুলহাতা ঘিয়ে রঙের শার্ট এবং পরনে ফিকে খয়েরি প্যান্ট। এক হাতে একটা চটাওঠা ব্রিফকেস। অন্যহাতে ভঁজকরা ভিজে ছাতি। কাজেই তেমন কোনও হোমরা-চোমরা বলে মনে হয় না।
এই যে বর্ণনাটা দিলাম, সেটা কর্নেলের শিক্ষা সহবত। নৈলে কালেও এত খুঁটিয়ে দেখা আমার স্বভাব নয়। তবে এ-ও সত্যি, ভদ্রলোকের আচরণ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
এবার আমি তার চোখে চোখ রাখলাম এবং আমার দৃষ্টিতে যথাসম্ভব তীব্রতা ছিল। তখনই ওঁর মুখে একটু কাচুমাচু হাসি ফুটে উঠল। কয়েক পা এগিয়ে এসে চাপা স্বরে বললেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? কিছু মনে করবেন না তো?
না। বলুন। ভারিক্কি চালে বললাম।
আচ্ছা, ওই যে সাদা দাড়ি, মাথায় টুপি, গলায় বাইনোকুলার ঝুলছে, উনিই কি বিখ্যাত রহস্যভেদী সেই কর্নেল সাহেব?
অস্বস্তিটা কেটে গেল। হাসি চেপে বললাম, হ্যাঁ। তা আপনার কি কোনও রহস্যটহস্য–
না, না। ভদ্রলোক জিভ কেটে ঝটপট বললেন, তাহলে আপনি নিশ্চয় জয়ন্তবাবু?
একটু অবাক হয়ে উঠলাম, হ্যাঁ। জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার। আপনি আমাদের কি করে চিনলেন?
ভদ্রলোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ওরে বাবা! আপনাদের চিনব না? আমি সত্যসেবক পত্রিকার ফ্যান। আপনাদের দুজনকারও ভীষণ ফ্যান। আপনার লেখা কত রোমাঞ্চকর ক্রাইমস্টোরি পড়েছি। কর্নেল সায়েবের ছবি না দেখলেও চেহারার ডেসক্রিপশন পড়েছি। তো যেখানে উনি সেখানেই আপনি।
বলে উনি চাপা অদ্ভুত শব্দে হেসে উঠলেন। বললাম, আপনি কোথায় থাকেন?
ভদ্রলোক আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চোখে রহস্য ফুটিয়ে বললেন, কর্নেল সায়েব নিশ্চয় কোথাও রহস্য ফাঁস করতে যাচ্ছেন। তাই না?
কপট গাম্ভীর্যে বললাম, হ্যাঁ। উনি এবার এক সাংঘাতিক রহস্যের পিছনে ছুটেছেন।
তা-ই বটে! উনি খুব চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়, তা বলতে আপত্তি আছে?
আছে। তবে–
বলুন না প্লিজ! বুঝলেন না? আপনাদের কীর্তিকলাপ পড়ে পড়ে আমারও ওই এক বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন কি, আপনারা যদি আমাকে কো ওপারেট করতে ডাকেন, আমি আপনাদের দলে ভিড়ে যাব। আর কর্নেল সায়েব থাকলে ভয়টা কিসের?
রহস্যটা যদি খুনোখুনি সংক্রান্ত হয়?
হোক না। তা ঘটনাটা কোথায় ঘটেছে?
ভীমগড়ে।
ভদ্রলোক চমকে উঠলেন। অ্যাঁ? ভীমগড়ে? কবে?
দুদিন আগে। আমি অবশ্য নিদিন কি এক সপ্তাহ আগেও বলতে পারতাম। কিন্তু কেন কে জানে দুদিন আগে বলে ফেললাম। আসলে বেশ মজা পাচ্ছিলাম ওঁর কথাবার্তা শুনে। এদিকে সময়ও দিব্যি কেটে যাচ্ছিল। ট্রেন: প্ল্যাটফর্মে। পৌঁছাতে দেরি করছে। সাতটায় ছাড়ার কথা। পৌনে সাতটা বেজে এল।
তো উনি আমার কথা শুনে আরও চমকে গিয়ে বললেন, সে কী! ভীমগড়ে মার্ডার হল। আর আমি জানতে পারলাম না? আমি ভীমগড়ে থাকি। সেখানকার নাড়ীর খবর রাখি। গতরাতে ট্রেনে চেপে আজ সকালে কলকাতা এসেছি। এখন ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আশ্চর্য তো!
আপনি ভীমগড়ে থাকেন বুঝি? হ্যাঁ। আমি সেখানকার পোস্টমাস্টার। এসেছিলাম পি. এম. জি. অফিসে। জরুরি কাজে।
আপনার নাম?
অনিল কুমার সাঁতরা। তিন পুরুষের বাসিন্দা ভীমগড়ে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, মার্ডারটা
বেগতিক দেখে বললাম, আসলে মার্ডারটা পুলিশ গোপন রেখেছে। খুব রহস্যময় মার্ডার কিনা?
অনিলবাবু আমার আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদের বাড়িতে মাৰ্ডর? কে মার্ডার হয়েছে? আমি ভীমগড়ের সব্বাইকে চিনি। ক্লু দিতে পারব।
সময় কাটাতে গিয়ে কি উটকো ঝামেলায় পড়া গেল দেখছি। কর্নেল স্টলে কী একটা পত্রিকার পাতায় দৃষ্টি রেখে মগ্ন। যা মাথায় এল, বলে দিলাম। নাম কর্নেল জানেন। ব্যাপারটা টপ সিক্রেট। নামী লোক কিনা?
অনিলবাবু ভুরু কুঁচকে একটু চিন্তাভাবনার ভঙ্গি করে বললেন, হুঁ। বুঝেছি। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তো!
ঠিক এইসময় ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে এসে ভিড়ল। হইহল্লা শুরু হয়ে গেল। পোস্টমাস্টার ভদ্রলোক আবার ভিড়ে হারিয়ে গেলেন।
এতক্ষণে কর্নেল পত্রিকাটির দাম মিটিয়ে ট্রেনের দিকে ঘুরলেন। হাল্কা বোঁচকাকুঁচকি হাতে নিয়ে আস্তে সুস্থে শেষ প্রান্তে কুপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তো!
তার মানে?
ভদ্রলোকের শেষ সংলাপটা।
হেসে ফেললাম। আপনি শুনছিলেন নাকি?
কানে আসছিল। তুমি তো জানো জয়ন্ত আমার শ্রবণেন্দ্রিয় বিচ্ছিরি রকমের প্রখর। শুনতে না চাইলেও শোনা হয়ে যায়।
বাইরে কোথাও ট্রেনে গেলে কর্নেল কুপে পছন্দ করেন। এবারকার যাত্রা ভীমগড়ে এবং সেখানে নাকি এক দুর্লভ প্রজাতির অর্কিড এই বর্ষাকালে অবিশ্বাস্য রকমের ফুল ফোঁটায়, যা নাকি ময়ূরের পেখমের মতো। কর্নেল তার কি একটা লাতিন নামও বলেছিলেন, ভুলে গেছি। তবে এবার দেশের সর্বত্র বর্ষার যা বিক্রম শুনছি, ভ্রমণ আমার কাছে কতখানি আনন্দদায়ক হবে সংশয় ছিল।
ট্রেন ছাড়ার পর হাসতে হাসতে বললাম, ভদ্রলোক আপনার চেয়ে বাতিকগ্রস্ত। ওঁকে ভীষণ ভড়কে দিয়েছি। ভীমগড়ে দুদিন আগে গোপন হত্যাকাণ্ড এবং আপনি চলেছেন সেই রহস্য ফাঁস করতে।
প্রকৃতিবিজ্ঞানী টুপি খুলে রেখে টাকে হাত বুলোচ্ছিলেন। চুরুট ধরিয়ে বললেন, । রহস্য তো বটেই।
কি রহস্য?
অনিল কুমার সাঁতরার শেষ সংলাপটা। বলে কর্নেল আবার আওড়ালেন, কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তো।
আশ্চর্য! আপনি দেখছি আপনার এক গুণমুগ্ধ ফ্যানের কথাতেও রহস্য আবিষ্কার করে ফেললেন! কর্নেল, এরপর আপনি আমার কথাতেও
ডার্লিং! ভদ্রলোকের ওই কথাটা আমার কানে বিধছে।
হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, ঠিক আছে বস্। ভীমগড়ে গিয়ে পোস্টমাস্টার ভদ্রলোকের সঙ্গে নিরিবিলি কথা বললেন। তবে আমি এসবে নেই। না আপনার কোন দুর্লভ প্রজাতি অর্কিডে, না অনিলকুমার সাঁতরার ব্যাপারে। আপনি বলেছেন, কোন টিলার ওপরে বাংলোয় বসে বৃষ্টির রূপ দর্শন নাকি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হবে। ব্যস্!
টিলাটাকে স্থানীয় লোকেরা বলে ভীমের গদা।
সে কি! পাথরের ন্যাড়া টিলার ওপর বাংলো?
কর্নেল হাসলেন। না। দ্বাপর যুগের গদার এই কলিযুগে কি অবস্থা হবে। চিন্তা করো। তাতে বনদফতরের মালীদের হাত পড়েছে। তাছাড়া এখন বর্ষাকাল। বলে কর্নেল সেই পত্রিকাটি খুললেন এবং ফের পোস্টমাস্টারের শেষ সংলাপ আওড়ালেন, কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি আশ্চর্য তো!
বিরক্ত হয়ে কিটব্যাগ খুলে একটা গোয়েন্দা উপন্যাস বের করলাম।
একটু পরে শুনি, কর্নেল বলছেন, নাঃ। এর আগে একটা কথা ছিল। কী যেন কথাটা?
বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে বললাম, ব্যাপারটা কি খুলে বলুন তো?
মনে পড়েছে। শব্দ জুড়ে বাক্য, বাক্য জুড়ে সন্দর্ভ। ইংরেজিতে বলে ডিসকোর্স। কর্নেল আপনমনে বললেন, প্রায় একটা সন্দর্ভের সূচনা। প্রথম বাক্যটি ছিল, হুঁ। বুঝেছি। পরের দুটি বাক্য কিন্তু তা কি করে সম্ভব? আশ্চর্য তো! তার মানে, ভীমগড়ের পোস্টমাস্টার অনিলকুমার সাঁতরা, যিনি সেখানে তিনপুরুষ ধরে বাসিন্দা, তিনি একটি কল্পিত গোপন হত্যাকাণ্ডের কথা শুনে তিনটি বাক্য উচ্চারণ করলেন। মাই গুডনেস!
কর্নেলকে নড়ে বসতে দেখে বললাম, কি?
স্বস্তিকা।
তার মানে?
নাগমিথুন।
ওঃ!
জয়ন্ত। গুপ্তযুগে নাগমিথুনের প্রতীক ছিল স্বস্তিকা চিহ্ন, সে যুগের মন্দির স্থাপত্যের শৈলীতে স্বতিকা চিহ্ন ছিল একটি আবশ্যিক অংশ।
হঠাৎ গুপ্তযুগের স্থাপত্য এবং স্বস্তিকা নিয়ে পড়লেন কেন?
কর্নেল বৃষ্টিরোধী নেভি ব্লু রঙের জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে একটা ভঁজকরা কাগজ খুলে আমার হাতে দিলেন। মুখে মিটমিটে হাসি। দেখি কাগজটার মাথায় স্বস্তিকা এবং নিচে একটা শব্দছক আঁকা আছে। যেদিক থেকে পড়া যাক, শব্দগুলো একই থাকে। শব্দছকটা এই
ম ক র
ক চ্ছ প
র প ট
বললাম, এ আবার কি? কর্নেল কাগজটা আমার হাত থেকে নিয়ে ভাঁজ করে ভেতর পকেটে ঢুকিয়ে শুধু বললেন, রহস্য। তবে শব্দরহস্য। যাকে বলে ধাঁধা।