Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মানুষখেকোর ফাঁদ || Syed Mustafa Siraj

মানুষখেকোর ফাঁদ || Syed Mustafa Siraj

মানুষখেকোর ফাঁদ

খ্যাতনামা বেসরকারি ঘুঘু অর্থাৎ গোয়েন্দা কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ডাকলে এই রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরি নরকে যেতেও রাজি। কিন্তু নরকে নয়, সেবারে ডাক এল রাজস্থান থেকে। জায়গাটার নাম মাধোপুর। জয়পুর থেকে অনেক দূরে একটা জঙ্গুলে জায়গা। কীভাবে যেতে হবে, সব পথনির্দেশ ছিল টেলিগ্রামে। তাই পৌঁছতে কোনও অসুবিধে হল না।

মাধোপুরে গিয়ে দেখলুম, আমার জন্যে একটা জিপ অপেক্ষা করছে। জিপের ড্রাইভারের কাছে জানলুম, আমার বৃদ্ধ বন্ধুটি এখন বাঘ শিকারের নেশায় মেতেছেন। জয়পুরের মহারাজার এক সংরক্ষিত বনাঞ্চল আছে মাধোপুরের মাইল পাঁচেক দূরে। এখন অবশ্য তার মালিক ভারত সরকার। সেখানে বনবিভাগের বাংলোয় কর্নেল সায়েব মহামান্য অতিথির সম্মানে বাস করেছেন। সম্প্রতি ওই এলাকায় একটি মানুষখেকো বাঘের ভীষণ উপদ্রব দেখা দিয়েছে। কর্নেলের মাথায় বাঘটা নিকেশ করার ঝোঁক চেপে গেছে বিলক্ষণ।

শুনে আমার বুক কেঁপে উঠল। আফসোস হল, খুলে জানালে আমার হেভি এক্সপ্রেস রাইফেলটা আনতুম! তারপর মনে পড়ল, কিছুদিন আগে কর্নেলকে কথায় কথায় বলেছিলুম, মানুষখেকো বাঘ মারার সুযোগ আজ অব্দি পাইনি। পেলে একবার চেষ্টা করে দেখতুম। তার জবাবে কর্নেল ঠাট্টা করে বলেছিলেন, আদতে সাধারণ বাঘ কি তুমি কখনও মেরেছ, জয়ন্ত? হাজারটা সাধারণ বাঘ যে না মেরেছে, তার পক্ষে মানুষখেকো বাঘ মারার স্বপ্ন দেখা উচিত নয়।

বুড়ো কথাগুলো মনে রেখেছিলেন বোঝা যাচ্ছে। কারণ, আমি জোর তর্কাতর্কি করেছিলাম, ওঁর বক্তব্য মেনে নিতে পারিনি। তাই কি এই ডাক? কিন্তু তাহলে আমাকে রাইফেল আনতে বলেননি কেন? এইসব ভেবে খুব রাগও হল। উনি আমাকে নিয়ে বরাবর এমন পরিহাস করেন কেন?

পৌঁছে দেখি, একটা ছোট্ট টিলার গায়ে সুন্দর বাংলোর বারান্দায় কর্নেল আর আমার অচেনা এক ভদ্রলোক বসে রয়েছেন। কর্নেল আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন—হ্যাল্লো ডার্লিং! কনগ্রাচুলেশনস! গুড লাক ফর ইউ!

বললুম—আগাম ওটা নিতে চাইলেন কর্নেল!

কর্নেল হেসে উঠলেন। তারপর সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ওঁর নাম রাজাধিরাজ আচরল। পুলিশ সুপার। একজন জবরদস্ত শিকারি উনি।

কর্নেলের সঙ্গে সময় পুলিশকর্তাদের যোগাযোগ ঘটে যায়-এটা অবাক লাগে আমার। ঠাট্টা করে বললুম—ম্যান ইটার পাকড়াও করতেও প্রাইভেট গোয়েন্দা আর পুলিশ দরকার হয় আজকাল! বাঃ!

মিঃ আচরল কিন্তু হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন-না না! জাস্ট আকস্মিক যোগাযোগ!

গল্পগুজব বন্ধ করে কর্নেল আমাকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিতে বললেন। পথশ্রমের ক্লান্তি দূর করার জন্য স্নান করলুম। তারপর তিনজনে একসঙ্গে বসে লাঞ্চটা সেরে নেওয়া হল।

সেই ফাঁকে মানুষখেকো বাঘটার খবরাখবর দিলেন কর্নেল। কদিন আগে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যে হাইওয়ে গেছে, তিনজন লোক সাইকেল চেপে আসছিল একের পর এক—কেউ পাশাপাশি ছিল না। প্রথম সাইকেলটা বাঁকের দশগজ দূরে যখন, তখন হঠাৎ বাঁদিকের পাথরের পাঁচিলে একটা বাঘ উঠে আসে। ব্রেক কষবার আগেই সে রাস্তার মাঝখানে লাফিয়ে পড়ে। তার ফলে সাইকেলের সঙ্গে তার ধাক্কা লাগে। অমনি সে গর্জন করে ওঠে। এদিকে লোকটা সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে ছিটকে সরে আসে, সাইকেলটা পড়ে যায় এবং চাকা ঘুরতে থাকে। পিছনের লোক-দুটো কিছু লক্ষ্য করেনি। তাই তারাও এসে প্রথম সাইকেলটার ওপর একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং সামনে বাঘ দেখে লাফ দিয়ে সরে আসে। তিনটে সাইকেলের চাকা বোঁ বোঁ করে তখন ঘুরছে এবং একটা বাঘ ক্ষেপে গিয়ে থাবা মারছে একবার এটায়, একবার অন্যটায়। আর প্রচণ্ড গর্জাচ্ছে। অন্যদিকে পাথরের গায়ে সেঁটে তিনটে ভয়পাওয়া মানুষ কাঠ হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। তাদের পালানোর ক্ষমতাও নেই।

বাঘটা কিছুক্ষণ সাইকেল তিনটের সঙ্গে লড়াই করার পর বিরক্ত হয়েই যেন শেষ ডাক ছেড়ে ডানদিকের পাঁচিলে লাফিয়ে ওঠে এবং অদৃশ্য হয়। তখন তোক তিনটে ধীরে সুস্থে সাইকেলের কাছে আসে। আশ্চর্য, সাইকেলের কোনও ক্ষতিই হয়নি।

তারা এরপর কী করেছিল বোঝাই যায়। ঘন্টায় কমপক্ষে পঞ্চাশ ষাট মাইল জোরে পালিয়ে যাওয়া এক্ষেত্রে স্বাভাবিক। প্রথমেই যে বসতিতে তারা পৌঁছয়, সেখানে হুলুস্থুলু শুরু হয়েছিল। কারণ লোকেরা দেখে, তিনটে সাইকেলওয়ালা আচমকা ঝড়ের মতো এসে সাইকেল থেকে লাফ দিয়ে পনে অজ্ঞান হয়ে যায়। সাইকেলগুলো আবার চারদিকে ছিটকে পড়ে।

জ্ঞান হলে তাদের মুখে সব জানা যায়। কিন্তু ঘটনার শেষ এখানে নয়। পরদিন সকালে দেখা গেল, সেই বসতির এক বুড়ি উঠোনে পড়ে আছে। ক্ষতবিক্ষত শরীর। বোঝা যায় বাঘটা টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল বুড়িকে—পারেনি। কেন পারেনি কে জানে। কিন্তু পায়ের খানিকটা মাংস খুবলে খেয়ে গেছে।

এরপর দ্বিতীয় শিকারের খবর পাওয়া গেল মাঠের খেতে। একটা বুড়ো ঘাস কাটতে গিয়েছিল বিকেলে। কিন্তু রাতেও ফিরল না। ব্যাপারটা অনুমান করে গাঁয়ের লোক পরামর্শে বসল। কিন্তু রাতের বেলায় সাহস করে কেউ খুঁজতে বের হল না। পরদিন সকালে দেখা গেল একই দৃশ্য। এবারেও বাঘটা বুকের কিছুটা খেয়েছে—টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। পারেনি।

আজ সকালে ঘটেছে আরেক বীভৎস কাণ্ড। সেই গাঁয়ের মোড়লকে বাঘটা একইভাবে মেরে রেখে গেছে। মোড়লের বাড়ির পিছনে জঙ্গল আছে। তার নিচে ধাপবন্দি পাহাড়ি খেত। মোড়লকে সম্ভবত শেষ রাতে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু এবার বাঘটা ঘরে ঢুকেছিল। ঘর থেকে তাকে টেনে উঠোন পার করে খেতে নিয়ে যায়। তারপর একইভাবে বুকের খনিকটা খেয়ে রেখে যায়। লাশটা এখনও রয়েছে। কাছেই দুটো গাছে দুটো মাচান বাঁধা হয়েছে। কর্নেল এবং মিঃ আচরল সেখানে বাঘটার আশায় বন্দুক হাতে অপেক্ষা করবেন।

কর্নেল আরও জানালেন, প্রথম ঘটনার পরই সরকারি শিকারিরা লাশের কাছে ওত পেতে রাত জাগেন। কিন্তু বাঘটা আর আসেনি। দ্বিতীয় লাশের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। এ থেকে মনে হচ্ছে, মোড়লের লাশের কাছেও সে আসবে কি না সন্দেহ। তবে…

ওঁকে চুপ করতে দেখে মিঃ আচরল বললেন—তবে কী কর্নেল?

কর্নেল কেমন হেসে বললেন—আমার ধারণা এবার বাঘটার আসার চান্স আছে। অন্ততঃ যদি বুদ্ধিমান বাঘ হয়, তাহলে তো আসা একান্ত উচিত। না এলে যে সে প্রাণে মারা পড়বে!

আমরা দুজনেই হতভম্ব হয়ে গেলুম। বলেন কী! বাঘটা মড়ির কাছে না এলে মারা পড়বে! এ কী উদ্ভট কথা; মড়ির কাছে এলে তবে না গুলি খেয়ে বাঘ মারা পড়ে। মিঃ আচরল অবাক হয়ে বললেন—এ হেঁয়ালির মানে কী কর্নেল?

—হেঁয়ালি? মোটেও না! বলে কর্নেল ঘনঘন মাথা নাড়তে থাকলেন। একটু পরে বললেন—বুঝলেন না?

বাঘ মানুষখেকো হয় কেন? যখন শিকার ধরার স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, তখন বাঘ সবচেয়ে সহজে ধরার মতো শিকার মানুষের ওপর হামলা করে। এই বাঘটার ব্যাপারস্যাপারগুলো দেখুন। প্রথম ঘটনা সেই সাইকেল পর্ব। ওই অবস্থায় বাঘ বিরক্ত হয়ে ওদের আক্রমণ করাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা করেনি। বোঝা যায়, বাঘটার মধ্যে সুস্থতার লেশমাত্র নেই। অর্থাৎ সে ভীতু, কিংবা স্বাভাবিক প্রবৃত্তিজাত ক্ষমতা তার মধ্যে নেই। এ অবস্থা বাঘের কখন হয়? যখন কোনও কারণে সে শারীরিক কিছু দরকারি ক্ষমতা হারায়। এটা নিছক বার্ধক্যের দরুন না হতেও পারে। বরং কোনও শিকারির গুলিতে সে স্বাভাবিক তৎপরতা হারিয়ে অক্ষম হয়ে গেছে, কিংবা কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী জন্তুর সঙ্গে যুদ্ধে তা হারিয়েছে। এই বাঘটার প্রথম একটা বৈশিষ্ট্য দেখুন—সে তার মড়ি টেনে নিয়ে গিয়ে নিরাপদ জায়গায় লুকোতে পারে না। অর্থাৎ তার শিকার বওয়ার ক্ষমতা নেই। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য—সে আর মড়ির কাছে ফেরে না। তার মানে, নিশ্চয় কোথাও মড়ির ওপর বসা অবস্থায় গুলি খেয়েছিল।

মিঃ আচরল বললেন—তাহলে বলছেন কেন সে মোড়লের মড়ির কাছে এবার ফিরবেই?

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন—না এলে যে ক্ষিধের জ্বালায় মরতে হবে ওকে! প্রতিবার মড়ি পেট পুরে না খেয়ে পালাবে নাকি? ক্ষিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এবার হয়তো সে একটা রিস্ক নেবে।

এই ব্যাখ্যায় মিঃ আচরল সন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু আমি হলুম না। এই বুড়ো ঘুঘুকে তো হাড়ে হাড়ে চিনি। ওঁর হেঁয়ালি বোঝার ক্ষমতা কারও নেই।

কথা হল, আমরা ঠিক সূর্যাস্তের আগে সেই গাঁয়ে যাব এবং মড়ির কাছে মাচানে উঠব। তখনও ঘন্টা দুই দেরি। আমি গড়িয়ে নিতে গেলুম ততক্ষণ। মিঃ আচরল সেই ফাঁকে তাঁর জরুরি কয়েকটা ফাইল নিয়ে বসলেন—থানা থেকে লোক এসেছিল। আর কর্নেল বেরোলেন। বলে গেলেন—গ্রামেই অপেক্ষা করব আপনাদের জন্যে। আপনারা টাইমলি চলে যাবেন।

রাইফেল হাতে কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। এটা ওঁর পক্ষে স্বাভাবিক। সব কাজ ভালভাবে খুঁটিয়ে দেখে এগোবেন না। গ্রামে গিয়ে হয়তো বাঘটার সম্পর্কে আরও খবর জেনে নেবেন।

সূর্য ড়ুবতে ড়ুবতে আমি আর মিঃ আচরল জিপে করে যথাস্থানে গেলুম। জিপটা গাঁয়ের কাছারির সামনে রেখে পায়ে হেঁটে আমরা ধাপবন্দি পাহাড়ি খেত ধরে এগোচ্ছি, হঠাৎ দেখি কর্নেল একটা বঁটাঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন।

কাছে গেলে বললেন—আসুন মিঃ আচরল। এস জয়ন্ত ডার্লিং। গুড ইভনিং!

মিঃ আচরল বললেন—এখানে কী করছেন কর্নেল?

কর্নেল ঝোপে আটকানো একটা কাপড় দেখিয়ে বললেন—এটা পরীক্ষা করছিলুম। মোড়লের জামাটা আটকে আছে। চলুন, মাচানে ওঠার সময় হয়ে গেছে।

লাশটা দেখে আমি শিউরে উঠলুম। আর দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস হল না। দশ গজ চড়া পনেরো গজ লম্বা ছোট্ট খেতের মধ্যিখানে সেটা পড়ে আছে একপাশে কাত হয়ে। বীভৎস! তার পশ্চিমে একটা মস্ত নিম গাছ—সেখানে বিশফুট উঁচুতে মাচান দেখলুম। কর্নেল বললেন—মিঃ আচরল, আপনি ওই মাচানে উঠুন। একটা কথা বলে রাখি। আমি শিস না দিলে কিন্তু কোন প্রলোভনেও গুলি করবেন না প্লিজ, কথা দিন।

মিঃ আচরল বললেন—অবশ্যই। কথা দিচ্ছি।

কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন—ডার্লিং, তোমাকেই গুলি করার সুযোগটা দিতে চাই। এই নাও রাইফেল। এবার দেখব, তোমার হাতের টিপ কেমন! কিন্তু মনে রেখো, আমি শিস না দিলে

তুমিও গুলি ছুড়বে না। কথা দাও।

এর পরে বুড়োর সঙ্গে আমি পুবদিকের একটা গাছের মাচানে উঠলুম।

কোনওরকম নড়াচড়া চলবে না। চুপচাপ বসে রইলুম। দেখতে দেখতে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠল। সময় কাটতেই চায় না। তারপর আমাদের পিছনে চাঁদ উঠলে স্বস্তি পেলুম। হাল্কা জ্যোৎস্না গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মুড়ির ওপর পড়ল। আরও কিছুক্ষণ পরে মড়িটা জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট হয়ে উঠল।

কিন্তু বাঘের কোনও লক্ষণ নেই। ঝিঝি ডাকছে একটানা! অনেক দূরে একবার শেয়াল ডাকল। তারপর আবার সব স্তব্ধ হয়ে গেল। গ্রামের দিকে শেষ আলোটিও নিভে গেল। চোখ জ্বালা করতে লাগল—একদৃষ্টে কতক্ষণ আর তাকিয়ে থাকা যায়। আস্তে আস্তে উত্তেজনা থিতিয়ে একটা ঝিমধরা ভাব জাগল শরীরে। রাইফেলটা অসম্ভব ভারী লাগছিল। এবার হাত পা ছড়াতে পারলে আরাম পাওয়া যেত। কিন্তু নড়াচড়া করা বারণ।

গ্রামের দিকে সেই সময় কুকুরের ডাক শোনা গেল। কুকুরগুলোর বোকামি রেখে রাগ হচ্ছিল-কারণ ওরা ডাকতে ডাকতে এদিকেই আসছে মনে হচ্ছিল—সাবধানে কর্নেলের দিকে ঘুরলুম। দেখি, বুড়োর চোখদুটো যেন জ্বলছে এবং কখন হুমড়ি খেয়ে বসে কিছু দেখছেন, লক্ষ্য করিনি।

কুকুরের ডাক থেমে গেলে কর্নেল নড়ে বসলেন। এটা কি ঠিক হল? বাঘের চোখ খুব তীক্ষ্ণ। বিন্দুমাত্র নড়াচড়া সে টের পেয়ে যায়। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমাকে আরও অবাক করে কর্নেল দেখলুম পা বাড়াচ্ছেন। এক পা নামিয়েছেন, যেন নামতে যাচ্ছেন। ফিসফিস করে ওঠার আগেই উনি আমার হাঁটুতে চাপ দিয়ে চুপ করার ইঙ্গিত দিলেন। তখন হতভম্ব হয়ে বসে ওঁর কাণ্ড দেখতে থাকলুম।

কর্নেল নিঃশব্দে গাছ থেকে নেমে গেলেন। তারপর আর ওঁকে তন্ন তন্ন খুঁজেও দেখতে পেলুম না। ব্যাপারটা কী? যেচে বিপদের মুখে পড়তে গেলেন কেন?

হঠাৎ আমার চোখ গেল মড়ির দিকে। কী একটা কালো বস্তু নড়াচড়া করছে ওখানে? তাহলে বাঘটা এসে গেছে। কিন্তু কর্নেলের শিস না শুনলে গুলি করা করা বারণ। হাত নিশপিশ করতে থাকল। কালো জন্তুটা কিন্তু মড়িতে বসল না! আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। তখন মনে হল, ওটা তাহলে বাঘ নয়—সম্ভবত হায়েনা অথবা ভালুক। তা যদি হয়, তাহলে বোঝা যাচ্ছে বাঘটার আসা এখন অনিশ্চিত হয়ে গেল।

আমার চোখ ছিল জন্তুটার দিকে। একটু পরে সেটা মড়ির কাছে স্থির হয়ে বসতেই দেখলুম, আমাদের মাচানের তলা থেকে আরেকটা জন্তু হামাগুড়ি দেওয়া মানুষের মতো এগোচ্ছে। চাদের আলো এই জায়গায় স্পষ্ট নয়—ছায়া আছে। কিন্তু জন্তুটা যে মড়ির দিকেই এগোচ্ছে, তা ঠিক। উত্তেজনায় অস্থির হয়ে দেখতে থাকলুম।

দ্বিতীয় জন্তুটা মড়ির কাছাকাছি যেতেই প্রথম জন্তুটা যে লাফ দিয়ে উঠল। সে পালিয়ে যাওয়ার তালে—তার ভঙ্গি দেখেই সেটা বোঝা গেল। কিন্তু অমনি দ্বিতীয় জন্তুটা তার ওপর ঝাঁপ দিল। নির্ঘাৎ মড়ি নিয়ে হায়েনা আর ভালুকে লড়াই বাধল।

কিন্তু সেই মুহূর্তে কর্নেলের চিৎকার শুনলাম, আর টর্চও জ্বলে উঠল। কর্নেল ডাকছিলেন—মিঃ আচরল! জয়ন্ত! চলে এস। বাঘ ধরেছি!

বাঘ ধরেছেন! আমি মাচান থেকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নেমে গেলুম। মিঃ আচরলও ততক্ষণে। এসে পড়েছেন। হাতে টর্চ। গিয়ে দেখি, যে দুটো কালো জিনিসকে জন্তু ভেবেছিলুম—তা মানুষ এবং প্রথম জন্তুটা একজন অচেনা মানুষ, দ্বিতীয় জন্তুটা স্বয়ং কর্নেল নীলাদ্রি সরকার! লোকটাকে উনি জাপটে ধরে আছেন- লোকটার হাতে একটা বড় ছোরা। হাতদুটোসুদ্ধ ধরে কর্নেল ওকে রেকায়দায় ফেলেছেন।

মিঃ আচরল ছোরাটা কেড়ে নিয়ে হুইসিল বাজিয়ে দিলেন। অমনি গাঁয়ের দিক থেকে টর্চ জ্বেলে কারা সব দৌড়ে এল। ধুপধুপ শব্দ শুনে বুঝলুম, সবাই পুলিশ!

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। কোথায় ম্যান-ইটার? এ যে নিতান্ত মানুষ!

বাংলোয় ফিরতে রাত একটা বেজেছে। ফেরার পর কর্নেল বললেন-জয়ন্ত কি খুব হতাশ হলে? বাঘের বদলে মানুষ! আই অ্যাসিওর ডার্লিং, এরপর তোমাকে সত্যিকার মানুষখেকো বাঘ মারার চান্স দেব। প্লিজ, রাগ কোরো না।

আমি গুম হয়ে থেকেছি সারাক্ষণ। এবার বললুম—কিন্তু ব্যাপারটা কী?

কর্নেল বললেন—সামান্য। এ আমার বরাত জয়ন্ত। যেখানে যাব, খুন আর খুনি এসে আমার ঘাড়ে পড়বেই! এই দেখোনা-ম্যান-ইটার মারব বলে আসর জাঁকিয়ে বসলুম এখানে। অথচ এখানেও সেই খুন আর খুনি!

এই বলে কর্নেল সব হেঁয়ালির সমাধান করলেন। সংক্ষেপে তা বর্ণনা করছি। তিনটি সাইকেলের সঙ্গে একটা খেয়ালী বাঘের সংঘর্ষ থেকেই এই খুনি লোকটার মাথায় মতলব খেলেছিল। সে হতভাগ্য মোড়লের একজন পুরনো শত্রু। জমিজমা নিয়ে বিবাদ ছিল। মামলায় হেরে সে ভূত হয়েছিল। কিন্তু মোড়লকে খুন করার সুযোগ পাচ্ছিল না। কারণ, মোড়ল খুন হলেই তার ওপর স্বাভাবিক দায় পড়বে খুনের। সবাই জানে এই শত্রুতার কথা। অতএব সে সাইকেল ও বাঘের সংঘর্ষ থেকে মতলব আঁটল। কিন্তু প্রমেই মোড়লকে খুন করলে পাছে কেউ কিছু সন্দেহ করে বসে—তাই সে অন্য রাস্তা নিল। এই ধূর্ততার কোনও তুলনা হয় না।

প্রথমে খুন করল এক নিরীহ বুড়িকে। ঠিক বাঘে ধরার মতো চিহ্ন রাখল। ছুরি দিয়ে এমনভাবে খুনটা করল যে বাঘের নখ ও দাঁতের দাগ বলে সবার মনে হবে। মড়ি টেনে নিয়ে যাওয়ার চিহ্নও রাখল। দ্বিতীয়বার খুন করল একই ভঙ্গিতে। তারপর তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য মোড়লকে খুন করতে আর অসুবিধে হল না। কারণ ততদিনে মানুষখেকো বাঘের খবর রটে গেছে। শিকারিরা এসেছে। মাচানে বসেছে। আবহাওয়া তৈরি হয়ে গেছে। অতবে মোড়লকে মারতে আর অসুবিধা নেই।

কিন্তু কর্নেলের চোখ তীক্ষ। প্রথমেই তিনি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে অবাক হলেন। কোনও মড়ির আশেপাশে বাঘের পায়ের দাগ নেই কেন? মোড়লের মড়িটা তিনি হাতেনাতে দেখলেন—অন্যদুটো দেখার সুযোগ পাননি। মড়ি পরীক্ষা করেই ওঁর সন্দেহ বেড়ে গেল। মাথার খুলি দুফাঁক হয়েছে। এটা বাঘের থাবায় হতে পারে। চুলে রক্ত নেই। তার মানে মড়ার ওপর ছুরি চালানো হয়েছে। আর জামা বা ধুতি যেভাবে ঝোপে আটকানো আছে, বাঘ টেনে নিয়ে গেলে অমনভাবে থাকতেই পারে না। সবচেয়ে অদ্ভুত কাণ্ড, মোড়লের লাশের নিচে মাটিতে একটা ফাটল আছে—ফাটলের মধ্যে একটা মোটা হাতুড়ির মাথা কর্নেলের চোখে পড়েছিল। হাতল থেকে খুলে গিয়েছিল মাথাটা। সম্ভবত খুনির হাতে হাতুড়িটা ছিল। ওই অবস্থায় টেনে এনেছিল মড়িটা—তারপর কীভাবে খুলে ওখানে ঢুকে যায়। বাঘের মড়ি বলে লাশ কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। তাই চোখে পড়েনি। কিন্তু কর্নেল তা দেখেছিলেন। তারপর কৌশলে গাঁয়ে রটিয়ে দিয়েছিলেন যে গাঁয়ের কারও একটা হাতুড়ির মাথা হারিয়ে গেছে কি না। এর ফলে খুনি সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে এবং ফাঁদে পা দেয়। সে এসেছিল হাতুড়ির মাথাটা নিয়ে যেতে।

কিশোর কর্নেল সমগ্র ১ (Kishore Cornel Samagra)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *