হাওয়া-বাতাস
সোমবার পুজোর সময় আমার মামাবাড়ির ছোট-বড় সবাই মিলে হিমালয়ে ভ্রমণে গেলে বাড়ি পাহারার দায়িত্ব পড়েছিল আমার কাঁধে। অবশ্য আমি একা নই, বাড়ির পুরোনো কাজের লোক রামলালও ছিল। লোকটা রাঁধুনি হিসেবে খাসা। দুজনে মনের আনন্দে যথেচ্ছ খেতুম আর ক্যারাম পিটতুম। শুধু রাতের বেলাটা–
সে কথা বলতেই এই গল্প।
বাড়িটা শহরতলি এলাকায়। একেবারে সুনসান নির্জন আর গাছপালা, পুকুর ডোবাও প্রচুর। মনেই হবে না শহরের নাকের ডগায় এমন পাড়াগেঁয়ে পরিবেশ থাকতে পারে। তাছাড়া খুব পুরোনো আমলের বাড়ি। চারদিকে বাগান, পুকুর, একটা বাঁশবন পর্যন্ত।
রামলালের বয়স হলেও শরীরখানা এখনও জোয়ানের মতো তাগড়াই। বোঝ যায়, এক সময় রীতিমতো ব্যায়ামবীর ছিল। আর এমন মানুষ কাছে থাকলে পরিবেশ যাই হোক, কোনওরকম–ভাবনা থাকার কথা নয়। চোর-ডাকাতের সামনে রামলাল গোঁফে তা দিয়ে দাঁড়ালেই লেজ তুলে পালিয়ে যেতে পথ পাবে না।
হ্যাঁ, প্রথমদিন সে কথাই মনে হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যার মুখে বাইরে গেট বন্ধ করতে গিয়ে যখন রামলাল আমাকে ডেকে বলল, দাদাবাবু, আপনি একটু দাঁড়ান তো এখানে, আমার কেমন ডর লাগছে,–তখনই আঁচ করলুম, লোকটাকে যতটা সাহসী ভেবেছিলুম, ততটা হয়তো নয়।
গেট বন্ধ করে ঝটপট ঘরে ঢুকে রামলাল একটু হেসে বলল, চোর, গুণ্ডা, ডাকু-তাদের সঙ্গে একহাত লড়া যায় দাদাবাবু! কিন্তু হাওয়া-বাতাসের সঙ্গে তো লড়া যায় না!
অবাক হয়ে বললুম, তার মানে? ও রামলাল, হাওয়া-বাতাস ব্যাপারটা কী?
রামলাল চোখ টিপে বলল,–সে আছে। কর্তাবাবু যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, ততক্ষণ কোনও ঝামেলা হয় না। রাতবিরেতে উনি বাড়ি না থাকলে ব্যাটা পেয়ে বসে!
কেমন অস্বস্তি হয় ওর কথাটা শুনে। বললুম, কার কথা বলছ, খুলে বলল তো রামলাল?
রামলাল ফের চোখ টিপে বলল,–আছেন তো! মালুম হয়ে যাবে।
হয়তো মালুম খানিকটা হল কিছুক্ষণ পরেই। দোতালার একটা ঘরে বসে ফের একদফা চা খেতে-খেতে একটা গোয়েন্দা-উপন্যাস সবে খুলেছি। রামলাল নিচের তলায় কিচেনে রাতের জন্য রান্না করছে এবং মাঝে-মাঝে তার হেঁড়ে গলার গানও শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ একটা বাতাস উঠল শনশনিয়ে। বাগানের দিকে যেন হুলুস্থুল শুরু হল। তারপর বাঁশবন থেকে বিচ্ছিরি কাঁচকাঁচ শব্দ শোনা যেতে লাগল। ঘরের জানালার কপাটগুলো খটখট করে নড়তে থাকল। আর সেই সময় গেল আলো নিভে। সারা এলাকা অন্ধকার হয়ে গেল দেখে বুঝলুম লোডশেডিং। কিন্তু ততক্ষণে রামলালের গানটা বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর সিঁড়িতে ধুপধাপদুদ্দাড় শব্দ করে সে এসে হাজির হল। হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, কিচেনে হ্যারিকেন ছিল। খুঁজে পেলুম না। শিগগির মোম জ্বালুন দাদাবাবু!
টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে মোমবাতি বের করে জ্বেলে নিলুম। আশ্চর্য, বাতাসটা আর নেই। বললুম, কী ব্যাপার রামলাল? তুমি কি ভয় পেয়েছ?
রামলাল কাচুমাচু মুখে হাসল। বলল,–পাইনি, আবার পেয়েছিও। বুঝলেন দাদাবাবু? হাওয়া-বাতাসের সঙ্গে এঁটে ওঠা মুশকিল। দেখুন না, গালটা এখনও বরফ হয়ে আছে। হাওয়া-বাতাসের চড় বলে কথা।
বিরক্ত হয়ে বললুম, ধ্যাত্তেরি, তোমার হাওয়া-বাতাসের নিকুচি করেছে। তুমি কী বলতে চাইছ, বুজতে পারছি না!
রামলাল তেমনি চোখ টিপে রহস্যময় হেসে বলল,–আছেন যখন এ বাড়িতে, সব মালুম হয়ে যাবে। এখন কৃপা করে একটু কিচেনে এসে বসুন দাদাবাবু। ব্যাটা বড় জ্বালাচ্ছে।
ওর কথা শুনে এবং ভাবভঙ্গি দেখে অস্বস্তি বেড়ে গিয়েছিল। তবে লোকটা গায়ে-গতরে যেমন, সাহসের বেলায় মোটেও তেমনটি নয় তাহলে। রান্না ও খাওয়া শেষ হলে ওপরের ঘরে শুতে এলুম। আমিই ওকে এ ঘরে শুতে বলতুম, কিন্তু কিছু বলার আগে রামলাল নিজেই অনুরোধ করল, আমার ঘরেই মেঝেতে শুতে পারলে রাতে ঘুমটা তার হবে। নইলে নাকি ওই হাওয়া-বাতাস তাকে ঘুমোতেই দেবে না।
বাতাসের কি প্রাণ আছে? বাতাস কীভাবে এবং কেন মানুষকে জ্বালাতন করবে আমি ভেবেই পাচ্ছিলাম না। ততক্ষণে আলো এসেছে। মেঝেয় শতরঞ্চির ওপর চাদর পেতে রামলাল নাক ডাকতে শুরু করেছে। ভিন্ন জায়গায় আমার সহজে ঘুম আসে না। তাছাড়া ওই অস্বস্তি। বিছানায় শুয়ে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় গোয়েন্দা-উপন্যাসটা পড়ার চেষ্টা করছি। এমন সময় আবার সেই উটকো বাতাসটা বাগানের দিকে শনশনিয়ে উঠল। তারপর জানালা খটখটিয়ে ঘুরে ঢুকল। জোরে ফ্যান চালিয়ে দিয়েছিলাম মশার অত্যাচারে। ভাবলুম, ভালোই হল, বাইরের এই হতচ্ছাড়া বাতাসটা এসে মশাগুলোর দফা-রফা করুক।
কিন্তু ফের সেই লোডশেডিং। তারপর বাঁশবনের কাঁচকোঁচ আওয়াজের মধ্যে ক্রমশ যেন যন্ত্রণাকাতর মানুষের গোঙানি শুনতে পেলুম। কে যেন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ককিয়েককিয়ে কাঁদছে। আমার গায়ে কাঁটা দিল। এ কখনও কানের ভুল নয়। তাছাড়া ঘরের ভেতর বাতাসটা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চারদিকে বাইরে এবং ভেতরে প্রচণ্ড হুলুস্থুল চলছে। আমি কাঠ হয়ে পড়ে রইলুম। উঠে জানালা বন্ধ করার সাহসও হল না।
তারপর আচমকা নিচের তলায় প্রচণ্ড শব্দে কী একটা পড়ে গেল শুনলুম। পড়ার বিকট ঝনঝন শব্দে বুঝি প্রকাণ্ড একটা কাঁচ ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। আর চুপ করে থাকতে পারলুম না। ডাকলুম, রামলাল! রামলাল! ওঠ, শিগগির ওঠ তো!
অবাক হয়ে দেখি, রামলাল কখন জেগে গেছে। সে ভারী গলায় বলল, চুপসে শুয়ে থাকুন দাদাবাবু! ও কিছু না!
উঠে দাঁড়িয়ে বললুম,–কী বলছ তুমি? নিশ্চয় নিচের কোনও ঘরের জানালা খুলে গেছে! ছবিটবি পড়ে ভেঙে গেছে।
রামলাল বলল,–ও হাওয়া-বাতাসের কাণ্ড দাদাবাবু! চুপচাপ শুয়ে থাকুন।
খাপ্পা হয়ে বললুম, নিকুচি করেছে তোমার হাওয়া-বাতাসের! মামাবাবু এসে যদি দেখেন, এভাবে আমরা বাড়ি পাহারা দিয়েছি, তোমারও চাকরি যাবে, আমিও মুখ দেখাতে পারব না। ওঠো, চলো দেখি কী ভাঙল।
রমলাল অন্ধকারে বলল, আপনি গিয়ে দেখুন দাদাবাবু। আমি যাব না।
রাগ হলে মানুষের সাহস বাড়ে। বালিশের পাশ থেকে টর্চ নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলুম! সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় টের পেলুম বাতাসটা হঠাৎ থেমে গেছে।
বাতাস বলা আর উচিত হবে না। একে ঝড় বলাই ভালো। শরৎকালে এমন ক্ষণিক ঝড় ভারি অদ্ভুত বটে! বছরের এসময়টা ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টিও হয় এবং তা একনাগাড়ে কয়েকদিন থাকে। কিন্তু এই আচমকা ঝড়ের স্থায়িত্ব মাত্র কয়েক মিনিট। তাছাড়া একফেঁটা বৃষ্টি নেই। আকাশ সারাদিন প্রায় নির্মেঘ ছিল। রাতেও তাই। আকাশভরা তারা ঝকমক করছে দেখছি। নিচের তলায় পৌঁছে মনে পড়ল, যাঃ! চাবির গোছাটা আনতে ভুলে গেছি। মামাবাবু সব চাবির ডুপ্লিকেট দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন প্রতিদিন সব ঘর যেন রামলালকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে নিই। পরিচ্ছন্নতার বড় বাতিক ওঁর।
টর্চের আলো বসার ঘরের দরজায় পড়তেই চমকে উঠলুম! দরজা হাট করে খোলা। মরিয়া হয়ে ভেতরে ঢুকে গেলুম। যা ভেবেছি তাই। ঘরের দেয়ালে প্রকাণ্ড সব বিদেশি পেন্টিং টাঙানো ছিল। দাদামশাইয়ের মস্ত একটা ছবি ছিল। মহাপুরুষদের ছবি ছিল খানকতক। একটাও দেয়ালে আর নেই। মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে খানখান হয়ে গেছে সব কাঁচ। ফ্রেম পর্যন্ত ভেঙে গেছে।
আরও অদ্ভুত ব্যাপার, সারা ঘরে যেন হুলুস্থুল লড়াই করেছে কারা। সোফাগুলো উল্টে পড়েছে। ডিভানটা কাত হয়ে রয়েছে। বইয়ের দুটো আলমারি টানাটানি করে স্থানচ্যুত করেছে কারা।
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেছি ব্যাপার দেখে। অবশ্য আঙুল টর্চের বোতাম থেকে সরে যেতেই অন্ধকার ঘিরে ফেলল এবং তখন সচেতন হয়ে আবার বোতাম টিপলুম।
উজ্জ্বল এক ঝলক আলো কোণের দিকে গিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমার হৎপিন্ডে রক্ত ছলকে উঠল। সারা শরীর হিম হয়ে গেল যেন। কোণের মেঝে ও দেয়ালে চাপচাপ রঙটাটকা রক্ত জ্বলজ্বল করছে।
আর এক মুহূর্ত দাঁড়াবার বা ব্যাপারটা ভালো করে দেখার সাহস হল না। ভক্ষুনি ঘুরে কাঁপতে কাঁপতে এবং টলতে টলতে প্রায় দৌড়ে চললুম।
সিঁড়িতে আছাড় খেয়ে টর্চটাও গেল বিগড়ে। চেঁচিয়ে উঠলুম, রামলাল! রামলাল!
রামলাল মোমহাতে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে বলল, কী হল দাদাবাবু? ভাঙা গলায় অতি কষ্টে বললুম,–নিচের ঘরে কাকে খুন করা হয়েছে।
রামলাল আশ্চর্য, ফিক করে হাসল। আগের ভঙ্গিতে বলল, ও কিছু না। হাওয়া-বাতাসের কাজ। চলে আসুন, দাদাবাবু।…
সমস্ত ব্যাপারটা অস্বাভাবিক এবং ভয়ঙ্কর। কিন্তু সকালে দুরুদুরু বুকে নিচের সেই ঘরে গিয়ে আমি অবাক হয়ে দেখি, রাতের সেই ভয়ঙ্কর প্রলয়ের এতটুকু চিহ্ন নেই কোথাও কোথাও একফোঁটা রক্ত কেন, এতটুকু লাল দাগ পর্যন্ত নেই।
তাহলে কি ব্যাপারটা নিছক দুঃস্বপ্ন?
মোটেও না। একই স্বপ্ন দুজনে তো একসঙ্গে দেখা অসম্ভব। তাছাড়া রামলাল বলল, কর্তাবাবু বাড়ি না থাকলে এমনটা হয়। বাড়ির ছোটবড় সবাই তা জানে। তাই রাতের ঘটনা নিয়ে আপনার মতো কেউ মাথা খারাপ করে না।
শরতের উজ্জ্বল রোদে বাড়ি এবং পরিবেশ কী সুন্দর দেখাচ্ছিল। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল রাতের ঘটনাগুলো। দিনমানে হাওয়া নেই। কেমন একটা গুমোট ভাব। বিকেল অবধি রামলালের সঙ্গে সেই বসার ঘরে ক্যারাম খেললুম। তারপর রোদ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তি জেগে উঠল। রাত হলেই এই বাড়িটা জেগে উঠবে। তাকে জাগিয়ে তুলবে এসে এক অদ্ভুত ঝোড়ো হাওয়া। বড় অবিশ্বাস্য লাগে।
এ রাতে শোওয়ার সময় মনে-মনে ঠিক করেছিলুম যা কিছু ঘটুক রামলালের মতো নির্বিকার থাকব। রামলাল যথারীতি নাক ডাকিয়ে ঘুমতে শুরু করল। কিন্তু আমি জানি ঘটনা শুরু হলে সে জেগে যাবে। যথারীতি লোডশেডিং চলছে। বাইরে চারদিকে একটা অস্বাভাবিক স্তব্ধতা। যেন মঞ্চের পরদা ওঠার প্রতীক্ষায় স্থাবরজঙ্গম রুদ্ধশ্বসে রয়েছে। রাত দশটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আবার বাগানের দিকে শনশন শব্দ শুনতে পেলুম। অমনি একটা জেদ এসে গেল। নিচের ঘরটাতে কাল রাতে এক হত্যাকাণ্ডের শেষ দৃশ্যে উপস্থিত হয়ে ছিলুম, আজ গোড়া থেকে উপস্থিত থাকার ইচ্ছে পেয়ে বসল।
পাছে রামলাল বাধা দেয়, তাই টর্চ নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেলুম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ততক্ষণে সেই অদ্ভুত রহস্যময় ঝোড়ো-বাতাস হুলুস্থুল বাধিয়েছে। এসে। সিঁড়িতে পা রাখা দায়। ঝড়ের ধাক্কায় টাল খাচ্ছি শুধু।
সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমেই আলো ফেললুম বসার ঘরের দরজায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলুম না, যা দেখলুম। ঘরের দরজাটা পুরোনো এবং প্রকাণ্ড। মচমচ খটাং-খট শব্দে দুটো কপাট খুলে গেল। বাতাসটা শনশন করে ঢুকে গেল তক্ষুনি। ভেতরে তোলপাড় শুরু হল।
এক লাফে নেমে ঘরে ঢুকে পড়লুম। টর্চের আলোয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভেসে উঠল পাতা চাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাসে বেঁটে একটা শরীর–মানুষেরই শরীর। পরনে প্যান্টশার্ট আর মাথার টুপিও যেন আছে। সে একটা ছবি টেনে নামাচ্ছিল। আমার দিকে ঘুরল। মুখটা যেন চীনাদের মতো। সেই মুহূর্তে টর্চটা বিগড়ে গেল। আমি চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলুম, রামলাল! রামলাল!
তারপর টের পেলুম অসম্ভব ঠান্ডা হিম দুই হাতে কেউ আমার গলা টিপে ধরেছে। জ্ঞান হারানোর মুহূর্তেও রামলালকে ডাকার চেষ্টা করছিলুম…
জ্ঞান হলে দেখি রামলালের বিষণ্ণ মুখ। সে আস্তে-আস্তে বলল, শরীর ঠিক হয়েছে তো দাদাবাবু?
প্রথমে ঘড়ি দেখে নিলুম। বারোটা পঁচিশ বাজে। ঘরে উজ্জ্বল আলো। বিদ্যুৎ এসে গেছে। শরীর খুব ক্লান্ত। গলায় সেই ঠান্ডা স্পর্শটা এখনও লেগে আছে। দুঃস্বপ্ন নয়, যা ঘটেছে, সবই সত্যি তাহলে।
ব্যাপারটা রামলালকে বলতে যাচ্ছিলুম, সে বাধা দিয়ে বলল, চুপসে নিদ করুন দাদাবাবু! বুঝলেন তো, হাওয়া-বাতাসের ব্যাপারটা কী! এ বাড়ি কর্তামশাই কেনার পর প্রথম প্রথম আমি খুব লড়ার চেষ্টা করেছিলুম। পারিনি। তবে কর্তামশাইও এ বাড়িতে আর থাকতে চান না! বলে গেছেন, ফিরে এসে বেচে দেবেন।
বললুম,–নিচের ঘরে একজন চীনা আমার গলা টিপে ধরেছিল।
রামলাল, চীনা নয় দাদাবাবু! জাপানি! শুনেছি ব্রিটিশ আমলে জাপানের সঙ্গে লড়াই বাধলে লোকটা নিজের পেটে ছোরা মেরে আত্মহত্যা করেছিল। এ বাড়িটা ছিল তারই। তবে ব্রিটিশ সোলজাররা এসে লাশটাও বাঁশবনে ফেলে দিয়েছিল। তখনও নাকি ধড়ে প্রাণটা ছিল। এখনও রাত-বিরেতে বাঁশবনে শুয়ে কাঁদে।
চমকে উঠে বললুম,–তাহলে সেই রক্তই দেখেছি। হারাকিরির রক্ত।
হাই তুলে রামলাল বলল,–ছেড়ে দিন। আপনাকে বলেছিলুম দাদাবাবু, এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না! হাওয়া-বাতাস থেকে গা বাঁচিয়ে চললে কোনও ক্ষতি হবে না। লড়তে গেলেই যত ঝামেলা! বুঝলেন তো? বুঝলুম। জাপানি ভদ্রলোক হারাকিরি করে মারা গেছেন বটে, এখনও ব্রিটিশদের ওপর রাগটা মেটেনি। ওঁকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার, এদেশ ছেড়ে ব্রিটিশরা কতকাল আগে চলে গেছে। আমার বিশ্বাস, সেটা বুঝলেই উনি স্বদেশে চলে যাবেন।