শনি-সন্ধ্যার পঞ্চভূত
আমরা উত্তর কলকাতার কজন বন্ধু মিলে একটা ক্লাব করেছিলুম। উদ্দেশ্য ছিল প্রতি শনিবার সন্ধ্যাবেলায় চুটিয়ে আড্ডা দেব। তাস, দাবা আর ক্যারাম খেলব। সেই সঙ্গে ফিস্টিরও আয়োজন থাকবে।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল ক্লাবের নাম হবে স্যাটারডে ইভনিং ক্লাব। কিন্তু তারাপদর মধ্যে বাঙালি-বাঙালি ভাব বড় বেশি। তার মতে, স্বাধীন দেশে ইংরেজিপ্রীতি দাস মনোভাবের প্রতীক। সেই কবে ইংরেজ এ দেশ থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে। এখনও ইংরেজি আঁকড়ে থাকার মানে হয় না। ক্লাবের নাম হোক শনি-সন্ধ্যা ক্লাব।
শেষপর্যন্ত তাইই হল। এ-ও ঠিক করা হল, আমরা ছজন বন্ধু বাদে আর কাউকেই শনি-সন্ধ্যা ক্লাবের মেম্বার করব না। তারাপদ, দীপক, গোপাল, সেলিম, ব্রতীন এবং আমি এই ছজন মেম্বার। কিন্তু শুধু ক্লাব করলেই হল না, একটা ঘর চাই। দীপক সে-সমস্যার সমাধান করে দিল। গঙ্গার ধারে তার দাদামশাইয়ের একটা পুরোনো বাগানবাড়ি খালি পড়ে আছে। সেই বাড়ির হলঘরটাই আমাদের ক্লাবের ডেরা হবে।
গঙ্গার ধারে চারদিকে পাঁচিল-ঘেরা প্রায় দু-একর জায়গা। মধ্যিখানে একতলা বাড়ি। কেয়ারটেকার রঘুনাথ একটা ঘরে থাকে। পুরোনো আমলের ফলবাগান জঙ্গ ল হয়ে গেছে। কিছু উঁচু গাছও পরিবেশকে জঙ্গুলে করে ফেলেছে। এক রবিবার সামনের লনটা পরিষ্কার করা হল। পরের শনিবার ফিস্টি হল ধূমধাম করে। রঘুনাথ খুব খুশি। বাড়িটা এতদিন হানাবাড়ি হয়েছিল। রাতবিরেতে ভূতের অত্যাচারে নাকি তিষ্ঠোতে পারছিল না। এবার ভূতেরা ভয় পেয়ে জব্দ হয়ে যাবে। মানুষ ভূতকে যেমন ভয় পায়, ভূতও নাকি মানুষকে দেখে ভয় পায়।
রঘুনাথের কথা শুনে আমরা হাসাহাসি করেছিলাম। এমন নিরিবিলি জায়গায় একা থাকলে মাথায় খুব কল্পনাশক্তি গজায়। বিশেষ করে রাতবিরেতে ছুঁচো-হঁদুর আরশোলার চলাফেরা এবং গাছপালা-ঝোঁপঝাড়ে বাতাসের শব্দ ভুতুড়ে মনে হতেই পারে। তবে রঘুনাথকে সাহসী বলতেই হবে। তার তাগড়াই গড়ন। গায়ে জোরও আছে মনে হয়। প্রতি শনিবার সন্ধ্যার আড্ডায় সে কিছুক্ষণ অন্তর চা জোগান দেয়। বাইরে থেকে পান-সিগারেট, আবার কখনও তেলেভাজা, মুড়ি, জিলিপি, কচুরি, সিঙাড়া যখন যা ফরমায়েশ করা হয়, সে এনে দেয়। দীপক আর সেলিম দাবা খেলতে বসে। বাকি চারজন ক্যারাম খেলি বা তাস পিটি। হইহল্লা করি। তারপর রাত দশটার যে যার বাড়ি ফিরি।
আমরা ক্লাবের মেম্বাররা একটা শর্ত করে নিয়েছিলুম। ঝড়-বৃষ্টি হোক, রাস্তায় জল জমুক, কিংবা এলাকায় হাঙ্গামা হোক কিংবা কারফিউ জারি হোক, প্রত্যেককে শনিবার সন্ধ্যা ছটা নাগাদ ক্লাবে পৌঁছতেই হবে। না এলে একশো টাকা ফাইন। ফাইন দেওয়ার ভয়ে প্রত্যেকে শনিসন্ধ্যায় আচ্ছায় ঠিকই এসে জুটত।
ক্লাব শুরু হয়েছিল এপ্রিলে। তারপর দেখতে-দেখতে জুন মাস এসে গেল। বর্ষা শুরু হল। এক পশলা বৃষ্টিতেই রাস্তায় এক হাঁটু জল জমে যায়। একদিন বিকেলে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি বিপদ বাধাল। রাস্তায় জল ঠেলে আমার যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু ঝোড়ো হাওয়ায় ছাতি সামলানো কঠিন। একটা রিকশাও পাওয়া গেল না। কিন্তু একশো টাকা জরিমানার ভয়ে মরিয়া হয়ে বেরিয়ে পড়লুম। বুদ্ধি করে কিটব্যাগে একপ্রস্থ প্যান্ট শার্ট-তোয়ালে নিলুম। তারপর বাগানবাড়িতে যখন পৌঁছলুম, তখন ভিজে একসা হয়ে গেছি। বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলুম বিকেল চারটেয়। পৌঁছতে দুঘণ্টা লেগে গেছে। রঘুনাথ একটা লণ্ঠন জ্বেলে দাঁড়িয়েছিল। বলল, বিকেল থেকে লোডশেডিং দাদাবাবু! মনে হচ্ছে কেবিল ফল্টা বেশি বৃষ্টি হলেই এইরকম হয়। বরাবর দেখে আসছি।
বললুম, আর কেউ আসেনি?
রঘুনাথ বলল, না। তবে এসে যাবেন একে-একে। আপনি বসুন। খুব ভিজে গেছেন দেখছি। এক কাজ করুন। আমি একটা শুকনো কাপড় এনে দিচ্ছি
বললুম, দরকার হবে না রঘুনাথ। শুকনো কাপড় সঙ্গে নিয়েই বেরিয়েছি। তুমি বরং এক কাপ চা খাওয়াতে পারো নাকি দেখো।
রঘুনাথ হলঘরে একটা টেবিলে লণ্ঠন রেখে চলে গেল। লণ্ঠনটা এ বাড়ির মতো পুরনো। কাঁচে কালি পড়েছে। আলোটা তেমন খেলছে না। মাঝেমাঝে দপদপ করছে। নিভে গেলেই কেলেঙ্কারি। বাইরে ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি সমানে চলেছে। তোয়ালেতে গা মুছে শুকনো প্যান্ট শার্ট পরে ভিজে কাপড়গুলো নিঙড়ে একট জানালার রডে কোনওরকমে ঝুলিলে রাখলুম। তারপর চেয়ারে বসে পা দুটো টেবিলে তুলে দিলুম। জুতো ভিজে ঠান্ডা হয়ে গেছে।
হ্যারিকেনের কাঁচে কালি বেড়ে যাচ্ছে দেখে দম কমিয়ে দিলুম। সেই সময় কেউ ঘরে ঢুকল। আবছা আলোয় দেখলুম, তারাপদ। বললুম, কী রে? আসতে পারলি তাহলে?
তারাপদ বলল, আসতেই হবে।
–ভিজে গেছিস তো? বুদ্ধি করে আমার মতো—
তারাপদ আমার কথার ওপর বলল, আমি ভিজিনি।
অবাক হয়ে বললুম,–ভিজিসনি মানে? এখনও তো সমানে বৃষ্টি হচ্ছে।
তারাপদ সেকথার জবাব না দিয়ে বলল,–এক কাপ চা চাই। রঘুনাথ কোথায়?
–রঘুনাথ আমার জন্য চা করতে গেছে। ওকে বল গিয়ে।
তারাপদ কিচেনের দিকে চলে গেল। তারপরই হারিকেনটা দপদপ করতে করতে নিভে গেল।
আমি সিগারেট খাই না।
তাই দেশলাই নেই। ডাকলুম, রঘুনাথ! একটা দেশলাই। আলো নিভে গেছে।
রঘুনাথের কোনও সাড়া নেই। তারাপদও ফিরে আসছে না। ঘরের ভেতর গাঢ় অন্ধকার। মাঝে-মাঝে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে। সেই আলোয় মুহূর্তের জন্য দেখলুম, দরজা দিয়ে কেউ ঢুকল। বললুম,–কে?
–আমি গোপাল।
–হ্যারিকেনটা নিভে গেছে। দেশলাই জ্বাল।
গোপাল বলল,–দেশলাইটা ভিজে গেছে। জ্বলবে না। রঘুনাথ কই?
–কিচেনে চা করতে গেছে।
–আর কেউ আসেনি?
–তারাপদ এসেছে। কিচেনে গেল চায়ের কথা বলতে।
–আমারও চা খেতে ইচ্ছে করছে। রঘুনাথকে বলে আসি।
অন্ধকারে গোপালের ভিজে জুতোর মচমচ শব্দ শোনা গেল। সেই সময় বিদ্যুতের আলোয় দেখলুম আরেক মেম্বার ঢুকছে। বললুম,–কে?
সেলিমের সাড়া পেলুম,–পুঁটু নাকি? আর কেউ আসেনি?
–তারাপদ এসেছে। কিচেনে গেল চায়ের কথা বলতে।
–আমারও চা খাওয়া দরকার। বলে আসি।
অন্ধকারে ভিজে চটি-জুতোর শব্দ শুনে বুঝলুম, সেলিমও কিচেনে চলে গেল। রঘুনাথ এখনও কেন আসছে না বোঝা যায়। কেটলির জলে আরও দুকাপ জল ঢালতে হবে তাকে। কাজেই সময় লাগবে জল গরম হতে। একসঙ্গে ছকাপ জল ঢাললেই তো হয়। বারবার একজন করে আসবে আর চায়ের জল গরম হবে আরও সময় লাগবে। কথাটা কিচেনে গিয়ে বলার জন্য উঠব ভাবছি, দরজায় আর এক মেম্বারকে দেখা গেল। গলা শুনে বুঝলুম, ব্রতীন। সে ডাকল, রঘুনাথ। রঘুনাথ?
বললুম, ব্ৰতীন কী করে এলি রে? ভিজিসনি?
ব্রতীন বলল, পুঁটু নাকি? অন্ধকারে বসে আছিস দেখছি।
–লোডশেডিং। হ্যারিকেনটা নিভে গেল। দেশলাই দে।
–আর দেশলাই! ভিজে ঢোল হয়ে গেছে। হারে পুঁটু, আর কেউ আসেনি?
–তারাপদ, গোপাল আর সেলিম এসেছে। কিচেনে রঘুনাথকে চায়ের কথা বলতে গেছে।
ব্রতীন অন্ধকারে খ্যাখ্যা করে হেসে বলল,-তাহলে আমিও যাই। চা খেতে ইচ্ছে করছে।
জুতোর শব্দে বুঝলুম সে-ও চলে গেল। নাঃ, এরকম করলে আর চা খাওয়াই হবে না। উঠে দাঁড়ালুম কিচেনে যাওয়ার জন্য। সেই সময় কাছাকাছি দীপকের সাড়া পেলাম, কোথায় যাচ্ছিস পুঁটু?
চমকে উঠে বললুম, দীপক, তুই কখন এলি? তোকে তো ঢুকতে দেখলুম না!
দীপক আমার উল্টোদিকের চেয়ার থেকে খি-খি করে হেসে বলল,–দেখবি কী করে? অন্ধকার যে!
তারপরই ব্রতীনের সাড়া পেলুম, আমাকেও দেখতে পায়নি পুটু!
ওরা দুজনে হাসতে লাগল। বললুম,–হাসি পরে হবে। হ্যারিকেনটা জ্বালানো দরকার যে!
দীপক বলল, অন্ধকার ভালো লাগছে। তাই না ব্ৰতীন?
ব্রতীন সায় দিয়ে বলল, এ্যা। আর অন্ধকারেই আড্ডাটা জমবে ভালো। কিন্তু চা-টা না হলে আড্ডা তো জমবে না। দেখি, রঘুনাথ চায়ের ব্যবস্থা করছে নাকি।
দীপক বলল,–চ। আমিও যাই। পুঁটু, যাবি নাকি?
রাগ করে বললুম, নাহ। কখন রঘুনাথকে চায়ের কথা বলেছি। তার পাত্তা নেই। এদিকে তারাপদ, সেলিম আর গোপাল গেল তো গেলই। চায়ের নিকুচি করেছে।
ব্রতীন বলল,–আয় দীপক! পুটু মনে হচ্ছে রাগ করে চা খাবে না।
অন্ধকারে খসখস চটাং চটাৎ মসমস শব্দ হল। বুঝলুম ভেজা জুতোর শব্দ। সবাই ভিজে গেছে। ভিজতে বাধ্য। রাস্তায় এতক্ষণ এক কোমর জল না হয়ে যায় । কিন্তু তারাপদ যে বলল সে একটুও নাকি ভেজেনি? নিশ্চয় বাস বা গাড়ি পেয়েছিল।
কিন্তু আমি বসে আছি তো আছিই। রঘুনাথের পাত্ত নেই, ওদেরও নেই। ব্যাপারটা দেখা দরকার। হলঘরের কোনার দিকের দরজা দিয়ে কিচেনকাম-ডাইনিং রুমে যাওয়া যায়। অন্ধকারে ঠাহর করে সেই দরজার কাছে গেলুম। গিয়ে দেখি, কেরোসিন কুকার জ্বলছে। কেটলিও চাপানো আছে। সেই আলোয় আবছা দেখা গেল ডাইনিং টেবিলের পাঁচটা চেয়ারে আমার পাঁচ বন্ধু বসে আছে। একটা চেয়ার খালি। কিন্তু রঘুনাথকে দেখতে পেলুম না।
আমাকে দেখে তারাপদ ডাকল,–চলে আয় পুঁটু! বসে পড়! চা খাওয়াটা এখানেই জমবে।
বললুম, রঘুনাথ কোথায়?
তারাপদ হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হেসে বলল, ঘুনাথ পালিয়ে গেছে।
–সে কী পালাল কেন?
–আমাকে দেখে।
অবাক হয়ে খালি চেয়ারটাতে বসে বললুম,–তোকে দেখে পালানোর কী আছে?
তারাপদ জবাব দিতে যাচ্ছিল, দীপক বলল,–চেপে যা, চেপে যা! দ্যাখ, চায়ের জল ফুটছে নাকি।
তারাপদ উঠে গিয়ে চা করতে থাকল। বললুম, হ্যাঁ রে দীপু, চেপে যা বললি কেন?
দীপক মিটিমিটি হেসে বলল,–সেসব কথা পরে হবেখন। চা খাওয়া যাক। বৃষ্টিটা বেশ জমেছে।
ব্রতীন বলল,–শুধু চা? তেলেভাজা-টাজা হলে ভালো হতো।
গোপাল বলল,-পরের বার হবে। আপাতত চা খেয়ে চাঙ্গা হওয়া যাক।
আমি বললুম, একটা আলো চাই যে! এ ঘরে মোমবাতি নেই? বরং হ্যারিকেনটা নিয়ে আসা যাক।
সেলিম বলে উঠল,-না-না! এই শনি-সন্ধ্যাটা বিনি আলোতেই আড্ডা দেওয়া যাক।
ততক্ষণে তারাপদর চা তৈরি হয়ে গেছে। কাপগুলো সে প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিল। চুমুক দিয়ে তেতে লাগল। বললুম,–বিচ্ছিরি কড়া হয়ে গেছে। তারাপদ, তুই
চা করতে জানিসনে।
তারাপদ চেয়ারে বসে বলল, কড়া চা না হলে এখন চলে? দীপক বলল,-কুকারটা নিভিয়ে দে। খামোকা তেল খরচ করা কেন?
তারাপদ বলল,–একটু জ্বলুক না। পুঁটু অন্ধকার পছন্দ করে না।
কথাটা বলে সে আমার দিকে ঘুরল। হঠাৎ দেখলুম, তারাপদ নয়। প্যান্ট শার্ট পরা একটা কঙ্কাল! চমকে উঠে অন্যদের দিকে তাকালুম। আতঙ্কে শরীর হিম হয়ে গেল। বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। পাঁচটি পোশাকপরা কঙ্কাল ডাইনিং টেবিল ঘিরে চায়ে চুমুক দিচ্ছে।
অমনি বিকট চেঁচিয়ে উঠলুম, রঘুনাথ! রঘুনাথ!
কঙ্কালগুলো হিহিহিহি করে হাসতে লাগল। চেয়ার থেকে উঠে মরিয়া হয়ে হলঘরে, তারপর সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে চাচাতে থাকলুম, রঘুনাথ! রঘুনাথ!
বৃষ্টি সমানে ঝিরঝির করে ঝরছে। লনের ওধারে একটা গ্যারেজ ঘর আছে দেখেছি। সেখানে দীপকের দাদামশাইয়ের গাড়ি থাকত একসময়। সেখান থেকে রঘুনাথের সাড়া এল,–পালিয়ে আসুন দাদাবাবু! পালিয়ে আসুন!
দৌড়ে ঘাস ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে গ্যারেজঘরে পৌঁছলুম। আবছা রঘুনাথকে দেখা যাচ্ছিল। সে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, খুব বেঁচে গেছেন দাদাবাবু!
হাঁপাতে-হাঁপাতে বললুম,–পাঁচ-পাঁচটা ভূ-ভূ-ভূ…
চুপ! চুপ! রঘুনাথ বলল, এই বিপদের সময় ও কথাটা বলতে নাই।
একটু ধাতস্থ হওয়ার পর বললুম, কিন্তু এখানে আর কতক্ষণ থাকব? বৃষ্টি ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। চলো! বরং আশে-পাশের বাড়ির লোকজনের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বলি। ওদের তাড়ানো দরকার।
রঘুনাথ বলল, ঠিক বলেছেন। কথাটা এতক্ষণ কেন যে মাথায় আসেনি! তবে আপনাকে আর কষ্ট করে বেরুতে হবে না। আপনি এখানে চুপচাপ বসে থাকুন। পাড়ার সবাই আমাকে চেনে। আমি এক্ষুনি লোক ডেকে আনি।
মুখে বললুম বটে, তাই যাও, কিন্তু একা থাকতে ভয় করছিল। রঘুনাথ চলে যাওয়ার পর ভয়টা আরাও বেড়ে গেল। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি একটা কঙ্কাল চুপিচুপি এসে আমার ঘাড়টি মটকে দেবে। অবশেষে গুঁড়ি মেরে বসলুম, যাতে ওরা আমাকে এখানে দেখতে না পায়।
তারপর বসে আছি তো আছি। রঘুনাথের পাত্তা নেই। অন্ধকার আরও ঘন হয়েছে। বৃষ্টিটা অবশ্য কমে গেছে। একসময় বাড়ির দিক থেকে কাদের চাপা গলায় কথাবার্তা শোনা গেল। উঁকি মেরে দেখি, হলঘরের ভেতরে হ্যারিকেন জ্বলছে। খোলা দরজা-জানালা দিয়ে ছায়ামূর্তির মতো যাদের দেখা যাচ্ছে, তারা সেই পঞ্চভূত ছাড়া আর কারা হবে? একটু পরে তারাপদর ডাকাডাকি শুনতে পেলুম,–রঘুনাথ! রঘুনাথ!
সর্বনাশ! পঞ্চভূত আবার আমার বন্ধুদের রূপ ধরে নতুন কোনও মতলব ভেঁজেছে। রঘুনাথটা একেবারে অপদার্থ। পঞ্চভূতের খবর পেলে জল কাদা ভেঙে লোকেরা মারমার করে তেড়ে আসবেই। সে বোধহয় ঠিকভাবে কথাটা বুঝিয়ে বলতে পারছে না। কিংবা লোকেরা তার কথা বিশ্বাস করছে না।
আবার চাপাগলায় কথাবার্তা, তারপর ক্যারামের গুটি চলার খটখট শব্দ শুনতে পেলুম। রোসো ব্যাটাচ্ছেলেরা রঘুনাথ এখনই এসে যাবে লোকজন নিয়ে। মেরে ভূত ভাগিয়ে দেবে।
আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল। গ্যারেজঘর থেকে দেখতে পাচ্ছি, পঞ্চভূত ক্যারাম আর তাস খেলছে। রাগে গায়ে জ্বালা ধরে গেল। একবার দীপকের কথা শুনতে পেলুম। সে বলল,–এই ভিজে জামা-প্যান্ট নিশ্চয় পুঁটুর।
তারপরই একটা হল্লা শোনা গেল। বাগানবাড়ির গেট দিয়ে টর্চ জ্বেলে লাঠিসোটা নিয়ে একদল লোক ঢুকেছে। তাদের আগে মারমার বলে হাঁক ছেড়ে রঘুনাথ দৌড়ে আসছে। ভেতরে ঢুকেই চাচাতে লাগল, কই ভূত? মারমার। ঠ্যাং ভেঙে দে।
সাহস পেয়ে আমিও যোগ দিলাম ওদের সঙ্গে। লন পেরিয়ে মারমুখী ভিড় হলঘরের দরজার সামনে যেতেই দড়াম করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। হ্যারিকেনের আলোও গেল নিভে। এতে মারমুখী লোকগুলো আরও রেগে গিয়ে দরজায় লাথি মারতে লাগল। লাথির চোঠে দরজা মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। লোকগুলোকই ভূত? মারমার! ভূতের ঠ্যাং ভেঙে দেয় বলে ঘরে ঢুকল। টর্চের আলোয় কাকেও দেখা গেল না।
একটা দল নিয়ে আমি আর রঘুনাথ কিচেনে ঢুকলুম। আর একটা দল বাড়ির চারপাশে খুঁজতে বেরুল। কিন্তু পঞ্চভূতের পাত্র পাওয়া গেল না। কিচেনের ডাইনিং টেবিলে ছটা কাপ দেখতে পেলুম। পাঁচটা কাপে চায়ের তলানি পড়ে আছে। একটা কাপ চায়ে ভর্তি। এই কাপটা আমার।
রঘুনাথ বলল,–মানুষের ভয়ে ভূতগুলো পালিয়ে গেছে দেখছি।
একজন তাগড়াই চেহারার লোক তার লাঠিটা রঘুনাথকে দিয়ে বলল,–এটা হাতের কাছে রেখে দিও রঘুদা। আমরা যাই। ফের যদি ঝামেলা করে, খবর দিও।
বাড়ির চারদিকে যারা খোঁজাখুঁজি করছিল, তারা হলঘরে ফিরে এসে বলল,–পালিয়ে গেছে। তাদের একজন দেশলাই জ্বেলে লণ্ঠনটা ধরাল। তারপর বলল,–চলি রঘুদা! তেমন কিছু হলে আবার খবর দিও।
পাড়ার লোকগুলো চলে যাওয়ার পর রঘুনাথ বলল, হ্যারিকেনটা নিয়ে কিচেনে চলুন দাদাবাবু! ভূতের এঁটো কাপগুলো ধুয়ে ফেলি। তারপর দুজনে চা খাওয়া যাবে। বড্ড ধকল গেছে।
কিচেনের ডাইনিং টেবিলে হ্যারিকেন রেখে বসে আছি। রঘুনাথ বেসিনে কাপগুলো, রগড়েরগড়ে ধুচ্ছে। এমন সময় জানালায় কে চাপাস্বরে ডাকল,–পুঁটু! পুঁটু!
চমকে উঠে বললুম, রঘুনাথ! লাঠি-লাঠি! আবার এসেছে ওরা।
রঘুনাথ বেসিনে কাপ রেখে লাঠি বাগিয়ে দাঁড়াল। জানালায় তারাপদর মুণ্ডু দেখা গেল। সে কাঁদকাঁদ স্বরে বলল, আমরা ভূত নই। দরজা খুলে দাও, টুকি।
বললুম, দরজা খুলো না রঘুনাথ। ঝামেলা করলে লাঠির গুঁতো মারো।
তারপদর পাশে দীপক, সেলিম, ব্রতীন আর গোপালের মুণ্ডু দেখা গেল। মুখগুলো করুণ। দীপক বলল, আমরা ভূত নই, রঘুনাথ! পুটু, তুই একটু বুঝিয়ে বল না ওকে।
বললুম,–তোমরা যে ভূত নও, তার প্রমাণ?
পাঁচ দুগুণে দশখানা হাত জানালার ভেতর গলিয়ে দিল ওরা। তারাপদ বলল, ছুঁয়ে দ্যাখ পুঁটু! ভূতের হাত হলে ঠান্ডা হিম হবে।
আমি ছুঁয়ে দেখার জন্য হাত বাড়িয়েছি, রঘুনাথ বলল,–ছোঁবেন না দাদাবাবু! বরং আমি আগে পরীক্ষা করে দেখি। যদি ভূত না হয়, রামরাম বলুক ওরা।
পাঁচটা মুখে করুণ সুরে উচ্চারিত হল, রাম রাম রাম রাম রাম রাম।
রঘুনাথ এ ঘরের দরজা খুলে দিল। পাঁচজনে হুমমুড় করে ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে পড়ল। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ওদের দেখতে-দেখতে বললুম, ব্যাপারটা কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু!
তারাপদ বলল, আমরাও বুঝতে পারছি না পুঁটু! একটু আগে আমরা পাঁচজনে একটা টেম্পে ভাড়া করে চলে এলুম। এসে দেখি দরজা খোলা। কেউ কোথাও নেই। হ্যারিকেনটা জ্বেলে তাস আর ক্যারাম খেলতে খেলতে হঠাৎ শুনি হল্লা করে কারা তেড়ে আসছে। অমনি ভয় পেয়ে হ্যারিকেন নিভিয়ে আমরা পালিয়ে গেলুম। তারপর অতিকষ্টে গাছে চড়ে গা ঢাকা দিলুম।
দীপক বলল,–ভাগ্যিস গাছের ওপর টর্চের আলো ফেলেনি ওরা।
রঘুনাথ হো-হো করে হেসে ফেলল। বলল, বুঝেছি, বুঝেছি। আপনাদের ঢুকতে দেখে ভূত পাঁচটা পালিয়ে গিয়েছিল। মানুষ যেমন ভূত দেখে ভয় পায়, ভূতেরাও মানুষ দেখে ভয় পায়।
তারাপদ বলল,-পুঁটু, কী হয়েছিল বল তো? তুই কখন এসেছিস?
দীপক বলল,–চা খেতে-খেতে সব শুনছি। রঘুনাথ, শিগগির চা করো।
রঘুনাথ কেরোসিন কুকার ধরাল। তারপর বলল,–আজ রাত্তিরে আর বাড়ি ফিরে কাজ নেই দাদাবাবুরা। চা করে খিচুড়ির ব্যবস্থা করছি। কী বলেন?
আমরা সবাই একবাক্যে সায় দিলুম।