সেই সব ভূত
আমাদের গাঁয়ে একসময় প্রচুর ভূত ছিল। শুধু রাতবিরেতে নয়, দিনদুপুরেও মাতারা একলা-দোকলা মানুষকে বাগে পেলে ভয় দেখিয়ে দুষ্টুমি করত। দুষ্টুমিই বলা উচিত। কারণ কখনও তারা কারুর ঘাড় মটকেছে বা ঠ্যাং ভেঙেছে বলে শুনিনি। তবে ভয়ের চোটে কেউ ভিরমি খেয়ে মারা পড়লে কিংবা দৌড়ে পালাতে গিয়ে কারুর ঠ্যাং ভাঙলে সেজন্য তো আর ভূতকে দায়ী করা চলে না। যার যা কাজ! ভূতের কাজটাই হল মানুষকে ভয় দেখানো। যে ভূত ভয় দেখায় না, সে আবার কীসের ভূত?
কথাটা বলতেন আমার বড়মামা।
বড়মামা রেলে চাকরি করতেন। ছুটিছাটায় আমাদের বাড়ি আসতেন। সাংঘাতিক সব ভূতের গল্প বলে আমাদের রক্ত জল করে ফেলতেন। গল্প শোনার পর আমরা যারা ছোট তাদের অবস্থা তখন শোচনীয়! কিন্তু তারপরই বড়মামা হো-হো করে হেসে বলতেন, ওরে। ভূতকে কখনও ভয় পাবি না। কারণ কী জানিস? মানুষ যেমন ভূতকে ভয় পায়, ভূতও মানুষকে খুব ভয় পায়। ভূত যদি ভয় দেখায়, তোরাও তাকে ভয় দেখাবি। দেখবি, ব্যাটাচ্ছেলে তক্ষুনি কেটে পড়েছে।
সেকথা শুনেও যে খুব একটা সাহস পেতাম, তা নয়। আমার তো খালি ভাবনা হতো, ভূত বড়দের ভয় পেতেও পারে, কিন্তু আমাদের মতো ছোটদের কি আর ভয় পাবে?
আমাদের বাড়ির পিছন দিকটায় ছিল একটা বাগান! তার ওধারে একটা ঝিল। ঝিলের ওধারে ছিল ঘন জঙ্গল। ঠাকুমা বলতেন, ঝিলের জঙ্গলে থাকে এক কন্ধকাটা। আর ঝিলের ধারে থাকে এক শাঁকচুন্নি। শাঁকচুন্নিটা রোজ রাত্তিরে আলো জ্বেলে ঝিলের ধারে কী যেন খুঁজে বেড়ায়। কন্ধকাটা আলো সইতে পারে না। তাই সে এসে শাঁকচুন্নির সঙ্গে খুব ঝগড়া বাধায়। ঝগড়ার চোটে সারারাত্তির ঘুমোতে পারিনে।
ঠাকুমা থাকতেন বাড়ির পিছনের ঘরে। কখনও কখনও রূপকথা শোনার লোভে আমি ঠাকুমার কাছে শুতে যেতাম। রূপকথা বলতে বলতে ঠাকুমা হঠাৎ থেমে গেলে বলতাম, তারপর কী হল বলল না?
ঠাকুমা আস্তে বলতেন,–ওই আবার বেধেছে।
–কী বেধেছে?
–কন্ধকাটার সঙ্গে শাঁকচুন্নির ঝগড়া। শুনতে পাচ্ছিস না তুই?
–কই না তো!
জ্বালাতন!–বলে ঠাকুমা উঠে গিয়ে ওদিকের জানালাটা বন্ধ করে দিতেন। তারপর বলতেন,–এর একটা বিহিত করা দরকার। কালই মোনা-ওঝাকে ডেকে পাঠাতে হবে।
মোনা ছিল ভূতের ওঝা। ভূতগুলোর সঙ্গে নাকি বেজায় ভাব। তারা তাকে খুব সমীহ করে। একবার হল কী, সিঙ্গিমশাই রাত নটার বাসে শহর থেকে ফিরছেন। হাতে ছিল একভাড় রসমালাই। ঠাকরুনতলার বটগাছের কাছে যেই এসেছেন, অমনি গাছ থেকে ঝুপঝুপ করে কয়েকটা ছায়ামূর্তি লাফিয়ে পড়ে তাকে ঘিরে ধরেছে। রসমালাইয়ের ওপর ভূতদের লোভ হতেই পারে। দেঁ-দেঁ করে তারা চেঁচাচ্ছিল।
এসব ক্ষেত্রে নিয়ম হল, দেব-দিচ্ছি করে বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সিঙ্গিমশাই নিয়মটা ভুলে গিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পালালেন। পালাতে গিয়ে পড়লেন একটা গর্তে। আর একটা ঠ্যাং-ও গেল ভেঙে। রসমালাইয়ের ভাড়টা হাত থেকে ছিটকে পড়েছিল। ভূতেরা আহ্লাদ করে রসমালাই সাবাড় করল। সিঙ্গিমশাই যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সবই দেখলেন। কিন্তু কী আর করা যাবে?
তার কাতরানি রামুধোপা শুনতে পেয়েছিল। সে বেরিয়েছিল তার গাধাটাকে খুঁজতে। গাধাটার ছিল বিচ্ছিরি স্বভাব। প্রায় রাত্তিরেই দড়ি ছিঁড়ে খেলার মাঠে চলে যেত এবং পছন্দসই কোনও ভূতকে পিঠে চাপিয়ে ছুটোছুটি করত। আসলে রামুর গাধার সঙ্গে ভূতদের ছিল বেজায় গলাগলি, বন্ধুত্ব।
তো রামু সিঙ্গিমশাইকে কাঁধে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। তারপর শহরের হাসপাতালে কয়েকমাস কাটিয়ে সিঙ্গিমশাই ফিরে এলেন বটে, কিন্তু একটি ঠ্যাং হাঁটুর ওপর থেকে বাদ। ক্রাচে ভর করে হাঁটতেন এবং নতুন নাম পেয়েছিলেন খোঁড়াসিঙ্গি।
খোঁড়াসিঙ্গি ভূতের ওপর খাপ্পা হয়ে মোনা-ওঝাকে তলব করেছিলেন। বলেছিলেন,–শুধু ঠাকরুনতলার নয়, গাঁয়ের সব ভূতকে গঙ্গার ওপারে তাড়িয়ে দিয়ে আয় তো মোনা। যা চাস, পাবি।
মোনা-ওঝা বলল,–তাড়িয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে সিঙ্গিমশাই? কাউকে ভিটেছাড়া করা যে মহাপাপ। তা ছাড়া, ওদের সঙ্গে আমার কতকালের সম্পর্ক। যা বলি তাই শোনে। এ কাজ আমি পারব না সিঙ্গিমশাই।
খোঁড়াসিঙ্গি তর্জনগর্জন করে বললেন, তাহলে তোকেই ভিটেছাড়া করব বলে দিচ্ছি। বেশ বুঝেছি, তুই-ই যত নষ্টের গোড়া। তোরই আস্কারা পেয়ে হারামজাদাগুলোর এত বাড় বেড়েছে। দাঁড়া! কালই পঞ্চগেরামি করে তোর বিচারের ব্যবস্থা করছি।
সে আমলে পঞ্চগেরামি অর্থাৎ পঞ্চগ্রামী মানে পাঁচ গাঁয়ের মাতব্বর লোকদের ডেকে বিচারসভার আয়োজন। সেই বিচারসভা বসল চণ্ডীমন্ডপে। মোনাকে ডেকে আনা হল। মোনা-ওঝা কিন্তু একটুও দমে যায়নি। সে মুচকি হেসে বলল, বাবুমশাইরা! ওপরে দেবতা, নিচে মা বসুমতী। ন্যায্য বিচার করে বলুন দিকি দোষটা কার? সিঙ্গিমশাইয়ের ঠ্যাং কি ভূতগুলো ভেঙেছে, নাকি নিজেই গর্তে আছাড় খেয়ে নিজেই ভেঙেছেন? জিগ্যেস করুন তো সিঙ্গিমশাইকে।
সবাই একমত হলেন যে, ভূতগুলো সিঙ্গিমশাইয়ের ঠ্যাং-এ আঘাত করেনি, এটা সত্যি। কিন্তু পাশের গাঁয়ের চক্কোত্তিমশাই বললেন,-মানছি,–ওরা সিঙ্গি মশাইয়ের ঠ্যাং ভাঙেনি। তবে এ-ও তো ঠিক যে ভূতগুলো ওঁকে ভয় না দেখালে উনি দৌড়ে পালাতেন না এবং গর্তেও পড়তেন না। ঠ্যাং-ও ভাঙত না।
মোনা-ওঝা হাত নেড়ে বলল,–ভুল! একেবারে ভুল। ভূতগুলো ওঁকে কক্ষনও ভয় দেখায়নি। মা চণ্ডীর দিব্যি করে বলুন উনি।
মাতব্বররা সিঙ্গিমশাইকে জিগ্যেস করলেন কথাটা। সিঙ্গিমশাই গাঁইগুই করে বললেন,–মানে, ঠিক ভয় দেখায়নি। তবে আমার হাতে রসমালাইয়ের ভঁড় ছিল। সেটা কেড়ে নিতে এসেছিল।
মোনা-ওঝা বলল, আবার ভুল হল বাবুমশাইরা! কেড়ে নিতে এসেছিল, নাকি চেয়েছিল? মা-চণ্ডীর দিব্যি, সত্যি কথাটা বলুন।
আমাদের গাঁয়ের মা-চণ্ডী জাগ্রত দেবী। তার ভয়ে খোঁড়াসিঙ্গিকে স্বীকার করতে হল, রসমালাইগুলো কেড়ে নেবে বলে মনে হচ্ছিল বটে, তবে ওরা র্দে-দে করে চেঁচাচ্ছিল সেটা মিথ্যা নয়।
তাহলে? –মোনা-ওঝা একগাল হেসে বলল,-এবার বলুন দোষটা কার? হাতে রসমালাই দেখলে কেউ চাইতেই পারে। আপনি ইচ্ছে হলে দেবেন, নয়তো দেবেন না, আপনি বলতেন পারতেন, দেব না। তা না করে আপনি দৌড়ে পালালেন। গর্তে পড়ে ঠ্যাংটি ভাঙলেন। আর দোষটা দিচ্ছেন অনাকে?
মামলা ভেস্তে যাচ্ছে দেখে খোঁড়াসিঙ্গি বললেন, কিন্তু আমার নালিশ তো এই মোনর বিরুদ্ধে। মোনার আস্কারাতেই এ গাঁয়ের ভূতগুলোর বড় বাড় বেড়েছে।
মোনা-ওঝা বলল,–প্রমাণ?
মাতব্বররাও বলে উঠলেন,–হ্যাঁ। প্রমাণ চাই। সাক্ষী চাই, সিঙ্গিমশাই, কই আপনার সাক্ষীদের ডাকুন।
সাক্ষী পাওয়া গেল না। আমাদের গাঁয়ের লোকেরা বলল, ভূতগুলো বাড়াবাড়ি করলে বরং মোনা-ওঝাই এসে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেয়। কাজেই মোনা তাদের আস্কারা দেয় বলা চলে না। তা ছাড়া আজ অব্দি মোনা-ওঝা কারুর পেছনে ভূতকে লেলিয়ে দিয়েছে বলেও জানা নেই।
পঞ্চগেরামি বিচারসভায় মোনা-ওঝা বিলকুল খালাস পেয়ে গেল।
কিন্তু খোঁড়াসিঙ্গির রাগ পড়েনি। কিছুদিন পরে উনি কোত্থেকে এক সাধুবাবাকে নিয়ে এলেন। সাধুবাবা ঠাকরুনতলায় ত্রিশূল পুঁতে মড়ার খুলির সামনে ধুনি জ্বেলে ধ্যানে বসলেন। গা-সুষ্টু ছোট-বড় সবাই ভিড় জমাল সেখানে। আমরা, ছোটরাও ব্যাপারটা দেখতে গেলাম।
সাধুবাবা একসময় ধ্যান ভেঙে লালচোখে চারদিকে দেখে নিয়ে মড়ার খুলিটা তুলে নিলেন। মন্তর আওড়ে গর্জন করলেন, আয়-আয়! যে যেখানে আছিস, চলে আয়। এই খুলির মধ্যে ঢুকে পড় সবাই। বেম্মদত্যি, কন্ধকাটা, শাঁকচুন্নি, মামদো, পেঁচো, গোদানো, হাঁদা, নুলো, ভুলো, কেলো, ক্যাংলা-খ্যাংলা দুই ভাই, জট-জটি, পিশাচ, গলায় দড়ে, যখবুড়ো সব্বাই আয়! সব্বাই এসে ঢুকে পড় এই খুলির ভেতর।
এই বলে সাধুবাবা মড়ার খুলিটা দুহাতে চেপে ধরে ঝুলিতে ঢোকালেন। ত্রিশূল তুলে হুঙ্কার দিতে দিতে এগিয়ে গেলেন ঝিলের দিকে। ঝিলের জলে মড়ার খুলিটা বের করে ছুঁড়ে ফেলে বললেন, থাক তোরা জলের তলায়। আর বলে দিচ্ছি, যে এই খুলি তুলবে, তার মুখে রক্ত উঠে মারা পড়বে।…
এরপর বেশ কিছুদিন আমাদের গায়ে আর ভূতের সাড়াশব্দ ছিল না। মোনা ওঝা নাকি মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াত। লোকেরা রাত-বিরেতে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করত। মাঝে-মাঝে দেখতাম, রামুখোপার গাধাটা ঝিলের ধরে ঘাস খেতে-খেতে হঠাৎ মুখ তুলে তাকাত! ওর দৃষ্টিটা খুব করুণ মনে হতো। তার খেলার সঙ্গীরা জলের তলায় খুলির ভেতর বন্দি। বেচারার দুঃখ হতেই পারে।
হঠাৎ একদিন হইচই পড়ে গেল।
রামুধোপ গিয়েছিল ঝিলের জলে কাপড় কাঁচতে। সে দেখেছে সেই মড়ার খুলিটা ঝিলের ধারে পড়ে আছে। জল থেকে নিশ্চয় কেউ ভূতবোঝাই খুলিটা তুলেছে।
সারা গাঁ ভেঙে পড়ল ব্যাপারটা দেখতে। খোঁড়াসিঙ্গিও ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে সেখানে হাজির হলেন। আমারও দেখার ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বড়রা কিছুতেই ছোটদের যেতে দিলেন না। জলের তলার খুলি থেকে খালাস পাওয়া ভূতগুলো খাপ্পা হয়েই আছে। কাজেই অবোধ আর দুর্বল ছোটদের ওপর তাদের নজর পড়ার সম্ভাবনা আছে।
পরে শুনলাম, দায়টা চেপেছে মোনা-ওঝারই কাঁধে। মোনাও তন্ত্রমন্ত্র জানে। কাজেই সাধুবাবার ফেলে দেওয়া খুলি সে ছাড়া জল থেকে তুলবে সাধ্য কার? তা ছাড়া মোনা নিশ্চয় কোনও বড় ওঝার কাছে নতুন বিদ্যে রপ্ত করে এসেছে। তবে শেষপর্যন্ত এতে মোনা-ওঝারাই জয়-জয়কার পড়ে গেল। মুখে রক্ত উঠে সে মারা পড়েনি। তার মানে, আমাদের গাঁয়ের এই ওঝা সেই সাধুবাবার চেয়ে এখন আরও ক্ষমতাশালী। সিঙ্গিমশাই কেঁচো হয়ে ঘরে ঢুকলেন। কদাচিং বাইরে বেরুতেন তিনি। বেরুলেই দিনদুপুর ছাড়া নয়। মোনা-ওঝার এতে দাপট বেড়ে গেল।
এদিকে আবার ভূতের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল সেদিন থেকেই। পণ্ডিতমশাই পাঠশালার ছুটির পর বাড়ি ফিরছেন। হঠাৎ গাছ থেকে টুপটাপ করে ঢিল পড়ল। পণ্ডিতমশাইয়ের বেলায় এ কোনও নতুন ঘটনা নয়। বরং ঢিল পড়া বন্ধ হওয়াতে তার খারাপ লাগত। আবার ঢিল পড়ায় খুশি হয়েছিলেন। বললেন, কীরে তোরা সব কেমন আছিস?
গদাই মোড়ল সন্ধেবেলা মাঠ থেকে ফিরছেন। একটা কালো বেড়াল তাঁর সঙ্গ নিল। মোড়ল খুব খুশি হয়ে বললেন, ভালো আছিস তো বাবা? জলবন্দি হয়ে নাকি খুব কষ্টে ছিলিস?
এইসব ঘটনা সন্ধেবেলায় ছোটকাকা খুব জমিয়ে বর্ণনা করতেন। আমি কিন্তু তখনও ভূত দেখিনি বা সেরকম কোনও সাড়াশব্দও পাইনি। বড়রা বলতেন, ভূত আছে। আমরা ছোটরাও মেনে নিতাম, ভূত আছে। তাছাড়া বড়মামা এসে ভূতের স্বভাবচরিত্র, কীর্তিকলাপ শুনিয়ে ভূতের ব্যাপারটাকে আরও পাকাঁপোক্ত করে ফেলতেন।
তো অমন একটা ঘটনার কিছুদিন পরে ঠাকুমার মুখে ঝিলের ধারের শাঁকচুন্নি আর জঙ্গলের কন্ধকাটার ঝগড়ার কথা শুনেছিলাম। বলেছিলেন,–মোনা-ওঝাকে ডাকতে হবে। মোনা ছাড়া এর বিহিত হবে না।
মোনা-ওঝা পরদিন এসেছিল। ঠাকুমার মুখে সব শুনে সে বলল, বড় সমিস্যে দিদিঠাকরুন। ওদের ঝগড়াঝাটির কথা আমার অজানা নয়। অনেক চেষ্টা করেও মিটমাট করাতে পারিনি। আসলে শাঁকচুন্নিটা আলো ছাড়া এক পা হাঁটতে পারে না। মেয়েটা রাতকানা। ওদিকে কন্ধকাটার চোখে ঘা। আলো লাগলেই জ্বালা করে। কাকে দোষ দেব বলুন?
–তুই কন্ধকাটাকে বরং অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে বল মোনা!
–যাবে কোথায়? সব জায়গাই তো দখল হয়ে আছে।
–খুঁজলে নিশ্চয় কোথাও পাওয়া যাবে। তুই খুঁজে দ্যাখ না।
মোনা-ওঝা একটু ভেবে নিয়ে বলল,-মুসলমানপাড়ার গোরস্থানে একটা শ্যাওড়া গাছ আছে। গাছটাতে একটা মামদো থাকত দেখেছি। কাল রাত্তিরে গিয়ে তাকে ডাকলাম, চাচা আছে নাকি? কোনও সাড়া পেলাম না। আমার সন্দেহ হচ্ছে, মামদোচাচা ডেরা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। প্রায়ই বলত, গাছটা পছন্দ হচ্ছে রে। হাত-পা ছড়িয়ে বসা যায় না! বড্ড বেশি ডালপালা। হাওয়া বাতাস ঢোকে ।
ঠাকুমা খুব উৎসাহ দেখিয়ে বললেন, তাহলে তুই কন্ধকাটাকে গিয়ে কথাটা বল মোনা। ওদের ঝগড়ার জ্বালায় সারারাত্তির ঘুমোতে পারিনে।
মোনা-ওঝা কিন্তু কিন্তু করে বলল,–দেখি, বলেকয়ে। তবে গোরস্থানে কন্ধকাটা যেতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।
–কেন? রাজি হবে বলে মনে হয় না?
–বুঝলেন না? কন্ধকাটা হল গিয়ে হিন্দু। মুসলমানদের গোরস্থানে যেতে চাইবে কি?
ঠাকুমা ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন, ধুর পাগল! ভূতের আবার হিন্দু মুসলমান কী রে? ভূত হল ভূত। মানুষের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান আছে। ভূতের মধ্যে নেই। তুই কন্ধকাটাকে একবার বলেই দ্যাখ গে না। বলবি, গোরস্থানের তল্লাটে একেবারে শুনশান অন্ধকার। আরামে থাকবে।…।
কদিন পরে মোনা-ওঝা এসে বলল,–কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে দিদিঠাকরুন! কন্ধকাটাকে বলেকয়ে রাজি করিয়েছিলাম। কাল সন্ধেবেলায় সে গোরস্থানের শ্যাওড়াগাছে ডেরা বাঁধতে গিয়েছিল। কিন্তু মামদোচাচা আবার ফিরে এসেছে। তাড়া খেয়ে কন্ধকাটা পালিয়ে এল।
ঠাকুমা নিরাশ হয়ে বললেন,–মুখপোড়া মামদোটা ফিরে এল কেন জানিস?
বলতে গেলে সে অনেক কথা! –মোনা-ওঝা শ্বাস ছেড়ে বলল।–বেঁচে থাকতে এক কাবুলিওয়ালার কাছে দেনা করেছিল। এদিকে কাবুলিওয়ালাও যে মরে ভূত হয়েছে আর মোদিপুরের গোরস্থানের কাছে বাজপড়া তালগাছের ডগায় ডেরা খুঁজে নিয়েছে, মামদোচাচা জানত না। ওকে দেখেই কাবুলিওয়ালা লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিল। তাড়া খেয়ে কঁহা কঁহা মুল্লুক ঘুরে মামদোচাচা বাড়ি ফিরেছে।
হ্যাঁরে মোনা, তাহলে এক কাজ কর না তুই।–ঠাকুমা মিটিমিটি হেসে বললেন,– ঘটকালিতে লেগে যা। শাঁকচুন্নির সঙ্গে কন্ধকাটার বিয়ে দিয়ে দে। তাহলেই মিটমাট হয়ে যাবে।
মোনা-ওঝা ফিক করে হাসল।–সেই চেষ্টাই তো করছি দিদিঠাকরুন। শুধু একটাই সমিস্যে! কন্ধকাটার চোখের ঘা সারিয়ে দেওয়া দরকার। তাহলে শাঁকচুন্নির পিদিমের আলো ওর চোখের ঘায়ে খোঁচা দেব না। দেখি, তেমন বদ্যি-কোবরেজ কোথাও পাই নাকি!
মোনা চলে গেলে বললাম, আচ্ছা ঠাকুমা, কন্ধকাটাদের তো মুন্ডু নেই শুনেছি। ছোটকাকা বলছিলেন। ওদের চোখ কোথায় থাকে তাহলে?
ঠাকুমা বললেন,–ধুর বোকা! চোখ থাকে ওদের বুকের ওপর।
কন্ধকাটার বুকে চোখের কথা শুনে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর থেকে দিনদুপুরেও আর ঝিলের জঙ্গলের দিকে তাকাতে সাহস পেতাম না। বড়মামা বলতেন বটে, ভূতকে কক্ষনও ভয় পাবি না। কিন্তু কন্ধকাটার একে তো মুণ্ডু নেই, তার ওপর বুকে দুটো চোখ। মুখোমুখি দেখা তো দূরের কথা, কল্পনা করতেই যে রক্ত হিম হয়ে যায়!
তো শেষপর্যন্ত মোনা-ওঝা ভূতের কোবরেজ খুঁজে পেয়েছিল। সেই কোবরেজের মলমে নাকি কন্ধকাটার চোখের ঘা সেরে যাচ্ছিল। আগামী কালীপূজার অমাবস্যার রাত্তিরেই কন্ধকাটার সঙ্গে শাঁকচুন্নির বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়েছিল। মোনা নোজই এসব খবর দিয়ে যেত। বিয়েতে খরচাপাতির ব্যাপার আছে। ঠাকুমা সবই দিতে রাজি হয়েছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ এক অঘটন ঘটে গেল।
হঠাই বলা চলে। কারণ ইতিমধ্যে আমাদের গায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা হয়েছে এবং খুটি পোঁতার কাজও শেষ, কিন্তু বিদ্যুতের পাত্ত ছিল না। লোকেরা হাল ছেড়ে দিয়েছিল। এতদিনে খবর পাওয়া গেল, সামনের দুর্গাপুজোয় বিদ্যুৎ আসছে। উদ্বোধন করতে আসছেন বিদ্যুৎমন্ত্রী। সাজো সাজো রব পড়ে গেল খবর শুনে। শহর থেকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আসার হিড়িক পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। ছোটকাকা আমাদের বাড়িতে মিস্ত্রি এনে বিপুল উৎসাহে কাজে নেমে পড়লেন। বাগানের দিকে আলোর ব্যবস্থা করা হল। তারপর ষষ্ঠীর দিন সন্ধেবেলায় খেলার মাঠে জনসভা হল, বিদ্যুত্মন্ত্রী এসে সুইচ টিপে উদ্বোধন করলেন। চারদিকে উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল।
সে রাত্তিরে আমরা প্রায় জেগেই কাটালাম। এত আলো, এমন উজ্জ্বল আলো ছেড়ে কি ঘুমোতে ইচ্ছে করে?
শুধু ঠাকুমার মুখ গম্ভীর। কেন গম্ভীর, তা সকালবেলায় জানতে পারলাম। বাগানের কোণায় একটা বেলগাছ ছিল, সেই গাছে থাকত এক বেম্মদত্যি। সকালে দেখি, ঠাকমা বেলতলায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি ঝিলের দিকে।
ঠাকুমার কাছে গেছি, সেই সময় মোনা-ওঝা ঝিলের দিক থেকে হন্তদন্ত এসে ধপাস করে বসে পড়ল। ঠাকুমা বললেন,-খুঁজে পেলি?
মোনা-ওঝা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল, নাহ। সব পালিয়েছে। কেউ নেই।
ঠাকুমা বেলগাছের ডগার দিকে মুখ তুলে বললেন, এ বুড়োও পালিয়ে গেছে। কাল রাত্তিরে স্পষ্ট দেখলাম, যেই ওই আলোটা জ্বলেছে, অমনি বুড়ো গাছ থেকে নেমে পালিয়ে গেল। ওই দ্যাখ, হাত থেকে হুঁকোটা পড়ে গেছে। কল্কেটাও পড়ে আছে দেখতে পাচ্ছিস?
মোনা উদাসচোখে হুঁকোটার দিকে তাকিয়ে বলল,–দিদিঠাকরুন যদি হুকুম দেন, বাবা বেম্মদত্যির কোকস্কে আমিই নিয়ে যাই।
নিয়ে যা।–ঠাকুমা করুণমুখে বললেন। তবে এঁটো করিসনে যেন। বামুনবুড়ো জানতে পারলে কষ্ট পাবে। রোজ রাত্তিরে বুড়ো হুঁকো খেত আর খকখক করে কাশত। আহা, কোথায় ভিটেছাড়া হয়ে চলে গেল সব?
মোনা-ওঝা হুঁকোকল্কে কুড়িয়ে নিয়ে বলল, আমার সবচেয়ে দুঃখুটা কী জানেন দিদিঠাকরুন? শাঁকচুন্নি আর কন্ধকাটার বিয়েটা ভন্ডুল হয়ে গেল। এ আলো কি যেমন-তেমন আলো? ইলেকটিরি বলে কথা। আমি যে মানুষ, আমারও চোখ জ্বালা করে। তবে দেখবেন দিদিঠাকরুন, এ পাপ সইবে না। আমি বরাবর বলে আসছি, কাউকে ভিটেছাড়া করার মতো পাপ আর নেই। এই মহাপাপ কি ভগবান সইবেন ভাবছেন? কক্ষনও না।…
ঠিক তা-ই।
মোনা-ওঝার কথা ফলেছে বলা চলে। এখন বড় হয়েছি। কলকাতায় থাকি। খবর পাই, আমাদের গাঁয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন বিদ্যুৎ থাকে না। মোনার ভগবান নাকি লোডশেডিং নামে এক সাংঘাতিক দানো পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে ভিটেছাড়া ভূতগুলোকে ফিরিয়ে এনেছে। তাছাড়া চোখে সইয়ে-সইয়ে বিদ্যুতের আলো দিয়ে ভূতগুলোকে সে চাঙ্গা করে তুলেছে। সেইসব ভূতই নাকি তার কাটে। ট্রান্সফরমার চুরি করে। কত উপদ্রব বাধায়। ঠাকুমা বেঁচে নেই। মোনাও বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে শাঁকচুন্নি আর কন্ধকাটার বিয়েটা লোডশেডিংয়ের দৌলতে ঘটা করেই ওঁরা দিতেন।
বললে তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না। গত পুজোয় গাঁয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। রাত্তিরে হঠাৎ লোডশেডিং অভ্যাসমতো ঠাকুমার সেই ঘরে শুয়েছিলাম। রাতদুপুরে বাগানে হঠাৎ খকখক করে কাশির শব্দ শুনে জানলায় উঁকি মেরে দেখি, সেই বেলগাছে হুঁকোর আগুন জ্বগজুগ করছে। খুব খুশি হলাম। মানুষের জীবনে ভূতটুত না থাকলে কি চলে? জীবনটাই যে নীরস হয়ে যাবে, যদি না থাকে ভূতপেতনি, যদি না থাকে অন্ধকার।