Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বৃষ্টিরাতের আপদ বিপদ || Syed Mustafa Siraj

বৃষ্টিরাতের আপদ বিপদ || Syed Mustafa Siraj

বৃষ্টিরাতের আপদ বিপদ

আমাদের গোরাচাঁদ রোডে একপশলা বৃষ্টিতেই হাঁটু জল জমে। এদিনে বিকেল মাচারটে থেকে রাত আটটা অব্দি একটানা বৃষ্টি। খবরের কাগজের আপিসে চাকরি করি। রাত নটায় ডিউটি শেষ। বেরিয়ে দেখি, বৃষ্টি বন্ধ। কাতারে কাতারে লোক বাস-ট্রামের অপেক্ষায় এসপ্লানেড জুড়ে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। ভাগ্য ভালো। একটা বাসে গোত্তা মেরে ঢুকে গেলুম। আধঘন্টা পরে যখন গোরাচাঁদ রোডে বাস থামল, নেমেই দেখি অথৈ সাগর।

বাড়ি পর্যন্ত এত জল ঠেলে এগোতে হলে নির্ঘাত নিউমোনিয়া হবে। এক রিকশাওলা পাঁচ টাকা দর হাঁকল। পাঁচমিনিটের হাঁটার রাস্তার জন্য পাঁচটাকা। দায়ে পড়ে রাজি হয়ে চেপে বসলুম। রিকশাওলা টান দেওয়ার আগে ফের বলল,–কোথায় যেন যাবেন বললেন বাবু?

–থানার কাছে।

রিকশো এগোলো। একে জল, তার ওপর লোডশেডিং। টিপটিপ করে ফের বৃষ্টি ঝরাও শুরু হয়েছে। হুড তোলা আছে। পর্দাটাও নামিয়ে দিতে হল। অন্ধকারে চারদিকে খালি ঝপাংঝপাং জলের শব্দ। মাঝেমাঝে মোটর গাড়ির মৃত্যুকালীন শ্বাস টানার মতো ঘড়ঘড়ানি। একঝলক করে আলো। পর্দার ফাঁকে নোংরা নর্দমা উপচানো জলের বিদঘুঁটে হাসিমুখ। কিন্তু চলেছি তো চলেছি। বাড়ি সমান দূরত্ব থেকে যাচ্ছে। ভাবছি, আহা বেচারা বিকশোওলা! পেটের দায়ে এই অমানুষিক খাটুনি খাটছে। মানুষ হয়েও জানোয়ারের মতো গাড়ি টানছে। আর আমি নবাব খাঞ্জা খায়ের মতো বসে আছি। খারাপ লাগছে, অথচ উপায় কী? একটু জলে ভেজা সহ্য হয় না। সপ্তায় দুদিন স্নান করি। একটুতেই ঠান্ডা লেগে দাঁতের গোড়া ফোলে। সর্দিকাশি এসে হামলা করে।

কিন্তু ব্যাপারটা কী? এখনও বাড়ি পৌঁছনো যাচ্ছে না কেন? পর্দার ফাঁকে উঁকি মেরে কিছু ঠাহর হল না। ঘুটঘুঁটে আঁধার। বললুম,–কোথায় এলুম হে?

রিকশোওলা বলল,–কোথায় যাবেন বললেন, যেন বাবু?

খাপ্পা হয়ে বললুম,–থানার কাছে। কতবার বলব বলোতো?

–আচ্ছা বাবু আচ্ছা। এবারে বুঝে গেছি।

–কী উজবুক লোক রে বাবা! কোথায় যাবে বোঝেনি, অথচ দর হেঁকে বসেছে পাঁচটা টাকা। পরক্ষণে ফের মায়া হল। আহা বেচারা! পেটপুরে খেতে পায় না, তাই জলের ভেতর রিকশো টানতে কষ্ট হচ্ছে। তার ওপর রাস্তার যা অবস্থা। খানাখন্দ পায়ে-পায়ে। চাকা গড়ানন সহজ তো নয়।

কতক্ষণ পরে আবার পর্দার ফাঁকে উঁকি দিলুম। তেমনি নিরেট আঁধার। কোথাও একচিলতে আলো নেই! আঁধারে জলের ঝপাং ঝপাং শব্দ। লোকেরা জল ভেঙে হাঁটছে। মাঝে-মাঝে রিকশোর ঠংঠং। কিন্তু তাহলেও এত দেরি হওয়া তো উচিত নয়। সন্দেহ হল, ঠিক শুনেছে কিনা রিকশোওলা–হয়তো বাড়ি ছাড়িয়ে বেনে পুকুর বাজারের কাছে এসে গেছি। তাই বললুম, কী ব্যাপার হে? এখনও পৌঁছনো গেল যে! ঠিক পথে যাচ্ছ তো?

রিকশোওলা বলল,–কোথায় যেন যাবেন বললেন বাবু?

যা ব্বাবা! এ যে দেখছি ভুলো মনের রাজা। খাপ্পার চূড়ান্ত হয়ে বললুম, কতবার বলব তোমাকে? অ্যাঁ? কানে শুনতে পাওনা নাকি? থানার কাছে–এ। থা—না—র—কা–ছে–এএ! চেঁচিয়ে ওর কানে ঢোকাতে চাইলুম। থানা বোঝো? থানা?

–আজ্ঞে। বুঝেছি।

বৃষ্টিটা বেড়ে গেল এতক্ষণে। কুঁকড়ে বসে রইলুম। আবার অন্ধকার জলে নানারকম শব্দ। ঠং-ঠং রিকশোর আর্তনাদ। খানাখন্দে চাকা আটকে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে। আরও কিছুক্ষণ পরে চেঁচিয়ে বললুম,–এখনও থানার কাছে পৌঁছতে পারলে না? ব্যাপারটা কী?

–কোথায় যেন যাবেন বললেন বাবু?

আবার সেই কথা? গর্জে বললুম, রোখ, রোখ! আমি এখানেই নামব।

–এই যে এসে পড়েছি, বাবু! একটু সবুর করুন।

–না। এখানেই নামিয়ে দাও।

রিকশোওলা রিকশো থামাল। বলল, ওই তো পিলখানা আলো জুলজুল করছে।

হাঁটুজলে বৃষ্টির মধ্যে নেমে ওর হাতে পাঁচটাকার নোট গুঁজে দিয়ে সামনে বাঁহাতি আলো লক্ষ করে এগিয়ে গেলুম। রিকশোলা রিকশো ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল। আর বুঝতে অসুবিধা হল না যে লোকটা কানে কম শোনে। বলছি থানার কাছে, সে শুনেছে পিলখানার কাছে।

কিন্তু পিলখানা যে বলে গেল, সে আবার কী জিনিস? এ নাম তো কস্মিন কালে শুনিনি। বাঁ হাতের গেটের ভেতর একটা উঁচু তিনদিক খোলা দালানের চত্বরে লণ্ঠন সামনে রেখে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন। মাথায় টাক। মুখে অমায়িক ভাব। জায়গাটা ঠাকুর দালান বলে মনে হয়। গেটের কাছে আমাকে দেখা মাত্র তিনি বলে উঠলেন, কী সৌভাগ্য! আসুন আসুন!

আমি তো অবাক। ভাবলুম, নিশ্চয় চেনেন-টেনেন কোনও সূত্রে। ছাদের তলায় তো পৌঁছনো যাক। বৃষ্টিতে ভিজে একসা হয়ে যাচ্ছি।

ভদ্রলোক একই ভঙ্গীতে বললেন,–বসুন রামবাবু, তখন থেকে আপনার অপেক্ষা করছি। তবে বৃষ্টিটাও বড্ড বেশি আজ। বলে হাঁক দিলেন মুখ ঘুরিয়ে, কেষ্ট! অ কেষ্ট। বড়বাবু এসেছেন রে! শিগগির চা নিয়ে আয়।

সর্বনাশ! আমাকে কোন রামবাবু ওরফে বড়বাবু ভেবে বসেছেন। রিকশাওলা কানে কালা। আর ইনি চোখে কম দেখেন নাকি? ঝটপট বললুম, দেখুন, আপনার বোধহয় ভুল হচ্ছে। আমি রামবাবু নই। রিকশোওলা ভুল করে আমাকে থানার বদলে পিলখানায়–

কথা কেড়ে খি-খি করে হাসলেন বৃদ্ধ। নানা। ভুল করেনি। ঠিক জায়গায় নামিয়ে দিয়েছে। অ কেষ্টা, চা কৈ রে?

কী মুশকিল! কথাটা শুনুন। আমি রামবাবু নই।

পেছনদিকের দরজা খুলে এক মূর্তির উদয় হল। কালো কুচকুচে গায়ের রং। লিকলিকে পাঁকাটি গড়ন। পরনে হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি। সাদা দাঁত বের করে বলল,–বড়বাবু বরাবর এইরকম বলেন। বুঝলেন দাদুমণি? বসুন, বসুন–চা খান। পরে কথা হবে।

সে এককাপ চা প্লেটসুদ্ধ এনে লাল মসৃণ মেঝেয় রাখল। তারপর সেইরকম হেসে চলে গেল। বৃদ্ধ বললেন,–বসুন। কাজের কথা সেরে নেওয়া যাক চা খেতে খেতে।

বেগতিক দেখে বললুম, প্লিজ শুনুন। প্রথম কথা আমি রামবাবু নই। দ্বিতীয় কথা, আমি ভুল করে পিলখানায় চলে এসেছি। রিকশোলা–

ভুল কীসের? পিলখানার এখন সে দিন নেই, তাই! এক সময় এখানে নবাবের তিরিশটা হাতি বাঁধা থাকত! তাই পিলখানা নাম। পিল মানে হল গিয়ে হাতি এলিফ্যান্ট। বৃদ্ধ আবার খি-খি করে হাসলেন। এখন হাতি নেই। তার বদলে আমরা আছি। আমি, কেষ্টা, গোবর্ধন, আর ওই হরি। হরি একটু পরে আসবে। হরি না হলে জমে না! অ গোবরা, দেখে যা কে এসেছেন!

পেছনের দিকে কোত্থেকে কেউ খ্যানখেনে গলায় বলল,–কে, দাদুমণি?

বৃদ্ধ বললেন, রামবাবুরে রামবাবু! মানে–আমাদের বড়বাবু। বুঝলি তো?

–যাচ্ছি, দাদুমণি!

ওরে অ কেষ্টা, হরিকে গিয়ে বল রামবাবু এসে গেছেন।

আমি ভাবলুম, ভুলটা যখন ভাঙছে না এঁদের, না ভাঙুক। বৃষ্টিরাতে এককাপ গরম চা ছাড়ি কেন? তারপর ব্যাপারটা কোথায় গড়ায়, দেখা যাক!

চা খেতে থাকলুম। বৃদ্ধ বললেন,–হ্যাঁ-যেজন্য খবর দিয়েছিলুম। ওর আসার আগে তার গোড়াপত্তন করা যাক। কথা হল ওই ভগলু কে নিয়ে।

–ভগলু কে?

–সেটাই তো বুঝতে পারছি না। শুনেছি, ওপাশের ওই কবরখানার একটা গাছে কোত্থেকে এসে আড্ডা নিয়েছে। তা–

–গাছে গাছে কেন?

–মাটি জুড়ে তো কবর। মুসলমানরা ওকে থাকতে দেবে কেন? ও তো হিন্দু। তাই খুব ঝগড়া হয়েছিল। শেষে রফা হয়েছে, গাছে তো আর কবর নেই। কাজেই গাছে ভগলু আস্তানা করতেই পারে।

–বেশ! তারপর?

–তা ভগলুর নাকি গাছে থেকে বৃষ্টিতে ভিজে খুব কাশি হচ্ছে। সারারাত খকখক করে কাশে। তাই আমাদের এই পিলখানায় আশ্রয় চায়। এদিকে কেষ্টাদের তাতে আপত্তি। ভগলুটা নাকি বেজায় নোরা। ভগলু সেটা বুঝতে পেরে রোজ রাতে ঢিল ছুঁড়ছে। তিষ্ঠোনো যায় না।…

বলার সঙ্গে-সঙ্গে খুট করে একটা ঢিল পড়ল তফাতে। তিন দিক খোলা ঠাকুরদালানের মণ্ডপের মতো চত্বর। ঝটপট সরে বসলুম। বৃদ্ধ চেঁচিয়ে উঠলেন, এই শুরু হল! কেষ্টা! গোবরা!

কেষ্টাকে দেখেছি। গোবরাকে দেখলুম। একটা প্রকাণ্ড কুমড়ো বললেই চলে। পরনে কেষ্টার মতোই হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি। দুজনে এসেই চত্বরের একদিকে দাঁড়িয়ে ঘুষি পাকিয়ে অন্ধকারের দিক লক্ষ করে চেঁচাতে থাকল, ভগলু দাঁতের পাটি খুলে নেব বলে দিচ্ছি।

বৃদ্ধ উত্তেজিতভাবে বললেন, দেখলেন তো স্বচক্ষে, রামবাবু? এজন্য আপনাকে ডাকা। এর বিহিত না করলে তো থাকা যায় না।

অনুমান করলুম, ওদিকটাই তাহলে কবরখানা। তার মানে ওটা গোবরা গোরস্তান এবং তার মানে আমাকে রিকশোওলা উল্টো দিকে এনে ফেলেছে। এবং তার মানে…

না। মাথা ঠিক রাখতে হবে। বললুম,–আপনারা শান্ত হোন। আমি দেখছি ব্যাটাকে!

কেষ্টা আমার কথা শুনে সাহস পেল যেন। ফের চাচাল ভগলুর উদ্দেশে। কী হচ্ছে রে ভোগলে! দাঁড়া রামবাবু যাচ্ছে! কে সে জানিস তো? বেনে-পুকুর থানার বড়বাবু! তোকে বেঁধে গুঁতো মারতে মারতে হাজতে নিয়ে যাবে।

অন্ধকার থেকে ভগলুর কথা ভেসে এল,–আরে যা যা! কেত্তা দারোগা হাম দেখ লিয়া। বিহার মুল্লুককা কেত্তা দারোগাভি এ ভগলুকে দেখা, তো তেরা বাঙালি দারোগাবাবু!

গোবর্ধন বলল,–শুনলেন দাদা, শুনলেন ব্যাটার আস্পর্ধার কথা?

গলা চড়িয়ে বললুম,–ভগলু! তুমকো হাম আভি অ্যারেস্ট করে গা।

যস্মিন দেশে যদাচার। যে জায়গায় এসে পড়েছি, তাতে তাল দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু আমার শাসানি শুনে ভগলু তার গাছের আস্তানা থেকে হিহি করে হেসে বলল,-চলা আও না! আও বাঙালিবাবু!

বৃদ্ধ বললেন, আপনাকে চ্যালেঞ্জ করছে রামবাবু, শুনছেন তো?

বললাম, দাঁড়ান, দেখাচ্ছি মজা ওকে।

উঠে দাঁড়িয়ে ভাবছি, ওই হচ্ছে ভেগে পড়ার মোক্ষম সুযোগ। এমন সময় অন্ধকারে কবরখানার দিকে চ্যাঁচিমেচি শোনা গেল,-কেষ্টা! গোবরা! দাদুমণি! চলে এসো শিগগির! ভোগলে ব্যাটার ঠ্যাং ধরে ফেলেছি। সেই সঙ্গে ভগলুরও চ্যাঁচিমেচি চলেছে,–ছোড় দে! ছোড় দে হরিয়া! হাম গির যায়ে গা! গির যানে সে হাম ফজলু খাঁকা উপরমে গিরেগা। উও কসাই আছে। হামকো জবাই করেগা।

হ্যাঁ–গাছের নিচে এক কসাই ফজলু খায়ের কবর! তার ওপর পড়লে গলায় ছুরি চালিয়ে দেবে। তাই ভগলু ত্রাহি ত্রাহি আর্তনাদ করছে। কিন্তু হরি তার ঠ্যাং ছাড়ার পাত্র নয়। এদেরও ডাকছে।

বৃদ্ধ, কেষ্টা আর গোবর্ধন ঝপাং ঝপাং করে জলে লাফিয়ে পড়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হল। লণ্ঠনটা জ্বলছে। চায়ের কাপপ্লেট পড়ে আছে। আমিও ঝাঁপ দিলুম তবে গেটের দিকে।

বৃষ্টিটা ছেড়েছে এতক্ষণে। জল ভেঙে প্রাণপণে এগিয়ে গেলুম যেদিক থেকে এসেছি, সেই দিকে! একখানে একটা বাড়ির বোয়াকে লণ্ঠন দেখলুম। কিন্তু আর সাহস হল না তাকাতে। যদি আবার…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *