ছুটির ঘণ্টা
আমাদের ছেলেবেলায় পাড়াগাঁয়ের প্রাইমারি স্কুলকে বলা হতো পাঠশালা আর ক্লাসকে বলা হতো শ্ৰেণী। সব পাঠশালায় ক্লাস ফোর পর্যন্ত থাকবে তার মানে নেই। আমি যে পাঠশালায় পড়তুম সেখানে ছিল শিশুশ্রেণী, প্রথম শ্রেণী আর দ্বিতীয় শ্রেণী। শিক্ষক মোটে একজন। তাকে বয়স্করা বলতেন নিসিং পণ্ডিত। আমরা বলতুম পণ্ডিতমশাই।
নিসিং পণ্ডিতের এক দাদা ছিলেন। তাঁর নাম গিরিজাবাবু, আড়ালে আমরা বলতুম গিজাংবাবু। মাটির ঘর আর খড়ের চালের পাঠশালার দাওয়ায় তালপাতার চাটাই পেতে শিশু শ্রেণীর বাচ্চারা স্বরে অ, স্বরে আ বলে বেদম চ্যাঁচিত। খুঁটিতে হেলান দিয়ে পিড়ির ওপরে বসে নিসিং পণ্ডিত নিমডালের ছিপটা তুলে বলতেন, আরও জোরে–আরও জোরে। আমরা প্রাণপণে চেঁচিয়ে পড়া মুখস্ত করতুম। তার পরে এসে পড়তেন গিজাবাবু। লম্বা ঢ্যাঙা গড়নের মানুষ। খালি গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া নোংরা একটা পৈতে পেঁচানো থাকত। মাথার পেছনে খাড়া এক টিকি। গলায় তুলসি কাঠের মালা। পায়ে খড়ম আর হাতে হুঁকো। একটু তফাতে বসে ভুড়-ভুড় শব্দে হুঁকো টানতেন। তামাকের গন্ধটা ছিল ভারি মিঠে।
ঘরের ভেতর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ছেলেরা পড়ত। সম্ভ্রমের চোখে ভেতরটা দেখে ভাবতুম, কবে ঘরে ঢোকার দিন আসবে আমার? নিসিং পণ্ডিত সেই উঁচু শ্রেণীর ছাত্রদের পড়াতে ঘরে ঢুকলে তাঁর দাদা গিজাংবাবু দাওয়ার শিশু শ্রেণীর দিকে মুচকি হেসে তাকাতেন। তারপর বলতেন,–ও কী পড়ছিস রে? ওটা কী পড়া হচ্ছে? নে পড়।
স্বরে অ স্বরে আ
বাড়ি গিয়ে মুড়ি খা
হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ
আমি হুঁকো খাচ্ছি
হ্রস্ব উ দীর্ঘ ঊ
এর নাম তামাকু…
ঘর থেকে নিসিং পণ্ডিত শুনতে পেয়ে বলতেন, আবার তুমি গণ্ডগোল বাধাচ্ছ দাদা? ওদের পড়তে দাও তো।
রাগ করে গিজাংবাবু উঠে যেতেন। একটু তফাতে শিবমন্দিরের বটতলায় গিয়ে বসতেন। পাঠশালার চারপাশটা ছিল ভারি নিরিবিলি। নিমগাছের জঙ্গল, আমবাগান, একটা পুকুর-তার পাড়ে এক জরাজীর্ণ মন্দির। মন্দিরের পাশ দিয়ে একফালি রাস্তা ধরে আমি একা বাড়ি ফিরে যেতুম। কারণ ওটাই ছিল আমার শর্টকাট রাস্তা। ফেরার সময় মন্দিরের কাছে কোনওদিন দেখা হয়ে যেত গিজাংবাবুর সঙ্গে। লোকটিকে আমার ভালোই লাগত। ফিক করে হেসে বলতেন, কী খোকা? কোন শ্রেণীতে পড়ো?
বলতুম,–ছিছু ছেনি (অর্থাৎ শিশু শ্রেণী)।
অমনি হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়তেন গিজাংবাবু। হুঁকোর জলও গড়িয়ে পড়ত। সামলে নিয়ে বলতেন, ছিছু ছেনি। অ খোকা, বাড়ি গিয়ে মায়ের কোলে বসে দুধু ভাতু খাও গে।
একদিন ফেরার সময় গম্ভীর মুখে বললেন,–অ খোকা! নিসিং শটকে শেখায় না?
শটকে মানে শতকিয়া–এক থেকে একশো পর্যন্ত মুখস্থ করা। বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ।
–কই, বলল শুনি।
–একে চন্দ, দুয়ে পক্ষ। তিনে নেও…
গিজাংবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন,–থাক, থাক! ওই শটকে পড়াচ্ছে বুঝি নিসিং? শোন এমনি করে শটকে পড়বে।
একে চাঁদ মামা/রেতে দ্যায় আলো
দুয়ে দুই পক্ষ/রং সাদাকালো
তিনে তিন চোখো/শিব জটাধারী
চারে চার বেদ/জানে দর্পহারী
পাঁচে পঞ্চবাণ/বড় ভয়ংকর
ছয়ে ষড়ঋতু/শোভে মনোহর
সাতে সিন্ধু সপ্ত/আটে বসু অষ্ট
নয়ে গ্রহ নব/কুদৃষ্টিতে কষ্ট
দশে দশ দিক/করহ মুখস্থ
বাড়ি যাই দাদা/সূর্য গেল অস্ত…
এখন বুঝতে পারি গিজাংবাবুর পদ্য রচনার ক্ষমতা ছিল। অতটুকুন বয়সে তাঁর ছড়ার সুরে এসব আওড়ানো শুনে ভক্তি জাগত। কোনওদিন ডেকে বলতেন, অ খোকা। পণ্ডিত তোমায় আকার পড়িয়েছে তো? বলল দিকি কাক বানান কী?
বানান শুনে হেসে বলতেন,
কাক থাকে গাছে
জলে থাকে মাছ
বনে থাকে বাঘ
মনে থাকে রাগ…
পাঠশালায় ছুটির ঘণ্টা নিসিং পণ্ডিত নিজেই বাজাতেন। ওটা নাকি পোড়া শিবমন্দিরেরই পুজোর ঘণ্টা। চৈত্রের সংক্রান্তিতে মন্দিরে পুজো হতো-বছরের এই একটা দিনের ঘণ্টা। সেদিন ঘণ্টাটার দরকার হতো মন্দিরে। নিসিং পণ্ডিত নিজেই পূজারী। তাই ঘণ্টাটা তার কাছেই থাকত সারা বছর।
গ্রীষ্মের ছুটির পরে একদিন হঠাৎ নিসিং পণ্ডিতের ঘণ্টাটা গেল চুরি। মনমরা হয়ে পণ্ডিতমশাই মুখেই ছুটি ঘোষণা করলেন। কিন্তু সেই পাঠশালা থেকে ছেলেরা হইহই করে বেরিয়েছে, অমনি পুকুরপাড়ে জঙ্গলের ভেতর মন্দিরের ওখানে কোথায় ঘণ্টার শব্দ শোনা গেল, ঢং, টং, ঢং!
নিসিং পণ্ডিত লাফিয়ে উঠে চেঁচালেন, ধরো, ধরো, পাকড়ো। তারপর মন্দিরের দিকে দৌড়তে শুরু করলেন। পাঠশালার সর্দার পোডড়া মন্দিরের দিকে দৌড়তে শুরু করলেন। পাঠশালার সর্দার পোডড়া ছিল বাবুল নামে একটা ছেলে সে বয়সেও সব ছেলের বড়। তাকে পণ্ডিতমশায়ের পেছনে-পেছনে ছুটতে দেখে আমরাও দৌড়লুম।
মন্দিরের ওখানে গিয়ে পণ্ডিতমশাই বললেন,–খোঁজ, খুঁজে দ্যাখ! এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে।
আমরা সবাই জঙ্গল তন্নতন্ন খুঁজে ঘণ্টা-চোর বা ঘণ্টার পাত্তা পেলুম না। শেষে হতাশ মুখে নিসিং পণ্ডিত বললেন, যাকগে। ওটা আর পাওয়া যাবে না। বরাবর ঘণ্টাটার ওপর লোভ ছিল যে। কথায় বলে, স্বভাব যায় না মলে।
ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিলুম। সর্দার পোড় বাবুল ধমক দিয়ে বলল,-শিগগির বাড়ি চলে যা বলছি। আর এখানে থাকবি না…
সেদিনও ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। পরদিন কানাকানিতে টের পেলুম, গিজাংবাবুই নাকি ঘণ্টাটা চুরি করে পালিয়েছেন। তাই আর তাকে গ্রীষ্মের ছুটির পর
থেকে পাঠশালার আনাচে-কানাচেও দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু মন্দিরের কাছ দিয়ে আসতে-আসতে তামাকের গন্ধ পাই, তাও তো সত্যি। নিশ্চয় তাহলে জঙ্গলে লুকিয়ে তামাক খান গিজাংবাবু।
তারপর প্রতিদিন বিকেলে বেশ মজার কাণ্ড শুরু হল। তখনও ছুটির সময় হয়নি–পড়াশুনো খুব জমে উঠেছে, হঠাৎ কোথাও ঘণ্টাটা বেজে ওঠে ঢং-ঢং করে। অমনি অভ্যাসে পাঠশালা থেকে ছেলেরা হইহই করে বেরিয়ে পড়ে। নিসিং পণ্ডিত আর বাবুল ছপটি তুলে সবাইকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। কান ধরে সবাইকে বাকি সময়টা দাঁড়িয়ে শটকে আওড়াতে হয়।
প্রতিদিন এই কাণ্ড। বিকেল চারটে বাজলে ছুটির সময় নিসিং পণ্ডিত পকেট ঘড়ি বের করে আধঘণ্টা আগে থেকে সবাইকে সতর্ক করে দেন। খবরদার! দুকানে আঙুল গুঁজে পড়া মুখস্থ করো।
তাই শুনে আমরা সবাই দুকানে আঙুল ঢুকিয়ে রাখি।
কিন্তু ঘণ্টাটা ঠিকই বাজে। অনেকক্ষণ ধরে বেজে তারপর থেমে যায় যেন হতাশভাবেই।
দিন কতক পরে মন্দিরের পথে বিকেলে বাড়ি ফিরছি একা। হঠাৎ দেখি মন্দিরের একপাশে বসে আছেন গিজাংবাবু। হুঁকো টানছেন, পাশে ঘণ্টাটা রাখা আছে। মুখটা গম্ভীর।
চলে আসব কিংবা ফিরে গিয়ে পণ্ডিতমশাইকে খোঁজ দেব তাই ভাবছি। তখন একটু হেসে বললেন, কী খোকা? কেমন পড়াশুনো চলছে? কী বানান পড়াচ্ছে নিসিং?
বললুম, দীর্ঘ উকার।
হুঁকো নামিয়ে রেখে গিজাংবাবু বললেন, হুঁ, কই বলে দিকি ভূত বানান কী?
–ভয়ে দীর্ঘ উকার, তো, ভূত।
–কী বললে? ভয়ে দীর্ঘ উকার। ইভয়েই বটে। ভয়ের সঙ্গে ভূতের সম্পর্ক আছে যে। তা অ খোকা, ভূত কখনও দেখেছ?
বিকেল পড়ে এসেছে। গাছপালার ভেতর পুরোনো মন্দির। গা ছমছম করে। একটু ভয় হল। বললুম, আজ্ঞে না।
ভয়ে দীর্ঘ ঊকার আছে বটে, ভূতকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। গিজাংবাবু মিটিমিটি হেসে বললেন, ভূত মানুষের মতোই দেখতে। কোও খায়। কথায় বলে না–অভ্যাস যায় না মলে। আমার অভ্যাস যায়নি। হুঁকো এখনও খাই। আর এই ঘণ্টাটার ওপর বড্ড লোভ ছিল। কেন জানোর নিসিংটার কাণ্ড দেখে। একদল বাচ্চা ছেলেকে সারাদিন খোঁয়াড়ে আটকে রেখেছে। এ কি তাদের ভালো লাগে? তাই ইচ্ছে করত, ঘন্টাটা পেলে আমি ঢং-ঢং করে ছুটি বাজিয়ে দিতুম।
আমি কিছু বুঝতে না পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলুম।
গিজাংবাবু হাই তুলে বললেন, বাড়ি যাও খোকা। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। তারপর আমাকে আরও অবাক করে পেছনে বটগাছটায় গিয়ে উঠলেন। ঘণ্টার দড়িটা কোমরে গোঁজা, হাতে হুঁকো। তারপর উঁচু ডালে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজলেন। তারপর নাক ডাকতে বসলেন।
পণ্ডিতমশাইয়ের দাদার এরকম করে গাছে চড়ে ঘুমোনোটা আমার ভালো মনে হল না। ভাবতে-ভাবতে বাড়ি ফিরলুম।
পরদিন পাঠশালায় গিয়ে পণ্ডিতকে বলে ফেললুম ওঁর দাদার কথা। ভাবলুম ঘন্টাটা উদ্ধারের সূত্র পেয়ে উনি আমাকে পড়া বলতে না পারার শাস্তি কমিয়ে দেবেন।
কিন্তু শোনামাত্র খাপ্পা হয়ে নিসিং পণ্ডিত গর্জালেন, কান ধর! কান ধরে দাঁড়া হতচ্ছাড়া! অ বাবুল। এই বয়সেই কী জলজ্যান্ত মিথ্যে বলতে শিখেছে শুনছিস।
বাবুল ভেতর থেকে গম্ভীর স্বরে বলল, দু-ঘা ছিপটি।
আমি আঁতকে উঠে কেঁদে ফেললুম। বললুম, না পণ্ডিতমশাই! কাল বিকেলে আপনার দাদা…
মাটিতে ছিপটি ঠুকে নিসিং পণ্ডিত বললেন,–চোপরাও! দাদা একমাস আগে সানিপাতিক জ্বরে ভুগে মারা গেছে! তাকে গঙ্গার ধারে দাহ করে এসেছি। আর বাঁদর বলে কি না, তাকে মন্দিরে বসে হুঁকো খেতে দেখেছে। অ বাবুল, এই মিথ্যুকটা বড় হয়ে কী হবে বল দিকি?
বাবুল ভেতর থেকে বলল,–তিন ঘা ছিপটি।
যাই হোক, আর মন্দিরের পথে শর্টকাট করে পাঠশালা যাতায়াত সেই শেষ। তবে মাঝে-মাঝে পড়া মুখস্থ করতে করতে হঠাৎ তামাকের ভুরভুরে মিঠে গন্ধটা ভেসে আসত মন্দিরের দিক থেকে। আর যেন অবেলায় ঘন্টাটাও চাপা ঢং করে বাজত। আশ্চর্য ব্যাপার, আমি ছাড়া আর কেউ এসব টের পেত না।
কিন্তু ঘণ্টাটা শেষপর্যন্ত নিসিং পণ্ডিত ফেরত পেয়েছিলেন। শুনেছি গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে আসার পর একদিন মন্দিরে গিয়ে ঘণ্টাটা কুড়িয়ে পান। শিবলিঙ্গের পেছনে লুকোনো ছিল। এবং কোটাও।
কারণ পিণ্ডি পেয়ে মানুষের আত্মা উদ্ধার হয়ে যায় বটে, কাঁসর-ঘণ্টা আর হুঁকোর যে আত্মা নেই। তাই তাদের পৃথিবীতে পড়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।