চোরাবালির চোর
ছোটমামার মাথায় বড়-বড় চুল। চুল নয়, যেন সজারুর কাটা। রকমারি শ্যাম্পু ঘেযেও ছোটমামা তার ওই নচ্ছার চুলগুলোকে বাগ মানাতে পারছিলেন না। শেষে বাবা পরামর্শ দিলেন, তার চেয়ে ন্যাড়া হচ্ছ না কেন ভায়া?
ছোটমামা মুখে কিছু না বললেও ভেতরে-ভেতরে রেগে টাই হয়ে যেতেন। কদিন পরে দেখি, ছোটমামা স্নানের পর একটা শিশি থেকে লাল রঙের একটা তরল পদার্থ ঢেলে চুলে ঘষছেন। জিগ্যেস করলাম, গন্ধতেল নাকি ছোটমামা?
ছোটমামা গম্ভীর মুখে বললেন, কবরেজি আরক।
আরক থেকে কেমন যেন একটা বিদঘুঁটে গন্ধ বেরুচ্ছিল। মাথায় ঘষার পর ছোটমামা একটা বাঁকাচোরা কাস্তের গড়নের অদ্ভুত চিরুনি বের করে চুল আঁচড়াতে শুরু করলেন। তারপর অবাক হয়ে দেখলাম, ছোটমামার খাড়া চুলগুলো নেতিয়ে মাথায় সেঁটে গেল। ছোটমামা আয়নার দিকে চেয়ে নিজের মাথা দেখতে-দেখতে বাঁকাহাসি হেসে বললেন,–তোর বাবাকে এবার ডাক! ন্যাড়া হতে বলছিলেন না আমায়? হুঁ:!
বললাম,–আরকটা না হয় কবরেজি। এই চিরুনিটা কোথায় পেলেন ছোটমামা? এও কি কবরেজি চিরুনি!
ছোটমামা খুশিমুখে বললেন, নাবাবু কবরেজকে চিনিস তো? ওই যে মোড়ের মাথায় আয়ুর্বেদ ভবন।
ছোটমামার চুলের একটা হিল্লে হওয়ায় বাড়ির সবাই খুশি। বাড়িতে অসুখবিসুখ কারও নেই–অথচ একটা লোক সবসময় রোগীর মতো মুখ করুণ করে বেড়াচ্ছে। থেকে-থেকে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। এই দেখে কার না খারাপ লাগে? এখন ছোটমামার মুখ আর করুণ নয়। সবসময় হাসিখুশি।
কিন্তু কদিন পরেই ছোটমামার সেই কবরেজি চিরুনিটা হারিয়ে গেল। ড্রয়ার, তাক, আলমারি, বিছানা তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। ছোটমামার মুখের চেহারা আবার করুণ হয়ে গেল। ঠাকুমা বললেন,–এ তাহলে শিঙ্গিদের হুলোবেড়ালের কাজ। ওর জ্বালায় কিছু থাকবার জো নেই। আমার জর্দার কৌটোটা সেদিন নিয়ে পালাচ্ছিল দেখলে না?
ঠাকুরদা বললেন, হুলোর পক্ষে জর্দা খাওয়া অসম্ভব নয়। গন্ধটা যে মিঠে। তাই বলে চিরুনি কি করবে ব্যাটাচ্ছেলে?
ঠাকুমা বললেন,–কেন? হুলোর গায়ের লোমগুলো দেখনি? নান্টুর চুলের চেয়ে খাড়া।
মা বললেন, উঁহু–বেড়াল নয়, কাক। সেদিন সাবানকৌটো নিয়ে পালিয়েছিল। আম গাছের ডগায় ওর বাসা থেকে খোকাকে দিয়ে পেড়ে আনালাম। তাই না রে খোকা?
খোকা, মানে আমি, সায় দিয়ে বললাম, কাকেরা কি সাবান মাখে মা?
মা বললেন,–কিছু বলা যায় না।
আমি বললাম, তাহলে কাকটা বেজায় বোকা। কৌটোয় তো সাবান ছিল না!
এইসব আলোচনা চলছে, ছোটমামা গম্ভীরমুখে শুনছেন! হঠাৎ আমাকে বললেন, আমার সঙ্গে একবার আয় তো পুঁটু। বলেই আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেলেন।
ছোটমামার কথার অবাধ্য হওয়া কঠিন আমার পক্ষে, পুঁটু নামটা যতই অপছন্দ হোক না কেন। রাস্তায় যেতে-যেতে জিগ্যেস করলাম, কবরেজ মশায়ের কাছে যাবেন তো ছোটমামা?
ছোটমামা বললেন,–গিয়েছিলাম তো। নাড়ুকবরেজ বললেন, ওই একখানাই ছিল। আর পাওয়া যাবে না। এ তো যে-সে চিরুনি নয়। কামরূপকামাক্ষায় পাহাড়ি জঙ্গলে যে ডাকিনীরা থাকে, তাদের চিরুনি। বুঝলি পুটু? ডাকিনিদের চুল তো সহজ চুল নয়। খেজুরটা দেখেছিস? সেইরকম।
কথা বলতে-বলতে ছোটমামা খেলার মাঠের দিকে ঘুরলেন। আমি বললাম, মামা এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?
ছোটমামা চাপাগলায় বললেন, আমার চিরুনি কে চুরি করেছে, বুঝতে পেরেছি। তাকে হাতেনাতে ধরব, আয়।
আমার বুক ঢিপঢিপ করল। বললাম,–ও ছোটমামা, তার চেয়ে থানায় গেলেই তো ভাল হতো।
ছোটমামা থমকে দাঁড়িয়ে বললেন,–তা মন্দ বলিসনি। ব্যাটাচ্ছেলে যদি ছুরিটুরি বের করে, বিপদ হবে। চল বরং থানাতেই যাই।
থানার দিকে যেতে-যেতে জিগ্যেস করলাম, কিন্তু চোরটা কে ছোটমামা? কোথায় থাকে?
ছোটমামা বললেন,–কোথায় থাকে তা কি জানি? ওই নদীর ধারে ওকে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতে দেখি।
–কেমন করে জানলেন, সে আপনার চিরুনি চুরি করেছে?
আমার কথায় ছোটমামা বিরক্ত হয়ে বললেন,–তোর খালি প্রশ্ন করা অভ্যেস। কেমন করে জানলেন? লোকটার মাথায় যে আমার মতো চুল–বরং আমার চেয়ে আরও খোঁচা-খোঁচা। যেন পেরেক।
বুঝলাম, তাহলে ছোটমামা ঠিকই ধরেছেন।
আমাদের এই ছোট্ট শহরে বংকুবাবু দারোগার খুব নামডাক। বিশেষ করে আমার বাবার সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ত্ব আছে। ছেলেবেলায় নাকি বাবার ক্লাসফ্রেন্ড ছিলেন। সেই খাতিরে মাঝে-মাঝে আমাদের বাড়িতেও আসেন। সব শুনে কিছুক্ষণ চোখ বুজে ভাবলেন। তারপর বললেন,–হুম! কেমন চেহারা বললেন যেন? রোগা ঢ্যাঙা, পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জি, মাথার চুল পেরেকের মতো?
ছোটমামা বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।
–নদীর ধারে ঘুরে বেড়ায়?
–আজ্ঞে।
–রোজ সন্ধ্যার একটু আগে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
বংকুদারোগা দুলতে-দুলতে বললেন,–হুম বুঝেছি। চোরাবালির গোবিন্দ।
ছোটমামা অবাক হয়ে বললেন,–চোরাবালি মানে?
মিটিমিটি হেসে বংকুদারোগা বললেন,–এই চোরের সঙ্গে চোরাবালির সম্পর্ক আছে–খুব গূঢ় সম্পর্ক। আপনি ভাববেন না। দেখছি ব্যাটাছেলেকে। তবে কী জানেন? বড় ফিচেল।
ছোটমামা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলবেন স্যার?
বংকুদারোগা বললেন, বুঝলেন না? ওই নদীতে একজায়গায় চোরাবালি আছে জানেন না?
এবার আমি বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ। ও ছোটমামা, সেই যে অনেকটা জায়গা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা আছে–লেখা আছে? সাবধান। আর…
ছোটোমামা নড়ে বসলেন,–আর একটা মড়ার খুলি আঁকা নোটিশ ঝোলানো আছে। দেখেছি বটে।
বংকুদারোগা বললেন,–গোবিন্দ আমার তাড়া খেয়ে কিছুদিন শ্মশানবটের কোটরে লুকিয়ে থাকত। টের পেয়ে হানা দিলাম। কী ধুরন্ধর চোর মশাই! মড়া সেজে একটা খাঁটিয়ার তালাই জড়িয়ে শুয়েছিল। এদিকে আসল মড়াটাকে খাঁটিয়ার তলায় লুকিয়ে রেখেছে। যারা মড়া পোড়াতে এসেছে, তারা বটতলায় এসে মুড়ি খাচ্ছে, লক্ষও করেনি। রাতটাও ছিল যে অমাবস্যা।
বংকুদারোগা একটিপ নস্য নিয়ে ফের বললেন,–মড়া পোড়াতে গিয়ে ধরা পড়ল ব্যাপারটা। গোবিন্দ তখন দৌডুচ্ছে। অন্ধকারে দৌডুতে-দৌডুতে পড়েছে একেবারে চোরাবালির ওপর। তখন ওখানে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। শুধু একটা নোটিশ লটকানো ছিল।
ছোটমামা বললেন, সর্বনাশ! চোরাবালিতে পড়ে তো তলিয়ে যাওয়ার কথা।
–হুঁ-উ, তলিয়ে গেল বইকী গোবিন্দচোর।
আমি বললাম, তারপর কে টেনে তুলল ওকে?
বংকুবাবু হাসলেন, তুলবে কী করে? আমি যখন পৌঁছলাম, তখন বালিতে তার মুণ্ডুটা দেখা যাচ্ছে। টর্চ জ্বেলে রেখেছিলাম। এক মিনিটের মধ্যে মুন্ডুটাও তলিয়ে গেল। তারপর যেমন বালি, তেমনি। বোঝবার উপায় নেই।
ছোটমামা অবাক হয়ে বললেন, তাহলে তো গোবিন্দ বেঁচে নেই।
নেই। আবার আছেও। বকুদারোগা গম্ভীর হয়ে বললেন। কথায় বলে না? অভ্যেস যায় না মলে। আমার মুশকিল কী হয়েছে জানেন নান্টুবাবু? তাড়া করলেই ব্যাটাচ্ছেলে কাটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ঝাঁপ দেয়। চোরাবালির ভেতর আজ্ঞা এখন। ওর খুব নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। এখন ওকে ধরাই কঠিন। তবে যদি ওকে মাঝপথে পাকড়াও করতে পারা যায়। তাহলেই সুবিধে হয়। দেখা যাক, আপনি ভাববেন না।…
থানা থেকে ফেরার পথে ছোটমামা বললেন, তুই বংকুদারোগার কথা বিশ্বাস করলি পুটু? আসলে আজকাল পুলিশই এরকম। মনবোঝানো দুটো কথা বলে বিদায় করতে পারলে বেঁচে যায়। তোদের এই বংকুদারোগা দেখছি, আরও এককাঠি সরেস। গুলতাপ্পির রাজা। মানুষ মরে ভূত হতেই পারে। তাই বলে চোর মরেও কি চোর থেকে যায় কখনও? ভূত ঘাড় মটকাতে পারে বটে, চুরি করতে যাবে কোন দুঃখে?
বললাম, কেন ছোটমামা? ভূতের মাথায় পেরেকের মতো চুল থাকলে…
ছোটমামা খাপ্পা হয়ে বললেন,-থাম তো। আজ ওবেলায় আমি নিজেই চিরুনিচোরকে হাতেনাতে ধরে ফেলব। সেজন্যই তো নদীর ধারে ওৎ পাততে যাচ্ছিলাম। খামোকা তোর কথায় থানায় গেলাম।
বেলা পড়ে এলে ছোটমামা আমাকে নিয়ে বেরুলেন আবার। ছোটমামা প্যান্টের পকেটে একটা দড়ি নিয়েছেন। আর আমাকে দিয়েছেন একটা কাগজ কাটা ছুরি। নদীর ধারে শ্মশানবটের কাছে গিয়ে চাপা গলায় বললেন, আমি ওকে ধরে ফেলব, আর তুই ছুরি বের করে চেঁচিয়ে বলবি, একটু নড়লেই পেট ফাঁসিয়ে দেব সাবধান!
এই বলে আমাকে রিহার্সাল দিইয়ে ছাড়লেন,-বলত শুনি, কেমন করে চোখ কটমটিয়ে বলবি?
অগত্যা ছোটমামার জেদে আমাকে ছুরি বাগিয়ে চিকুর ছেড়ে বলতে হল, একটু নড়েছ কি পেট ফাঁসিয়ে দেব সাবধান!
উঁহু সাবধানটা হবে আরও জোরে। এমনি করে।–বলে ছোটমামা বিকট গর্জালেন, সা—ব—ধা–ন।
বারকতক বলার পর উনি খুশি হলেন। ই ঠিক হয়েছে। বুঝলি পুটু? ভালোয় ভালোয় যদি কাজটা করে ফেলতে পারি, তোকে এক প্যাকেট লজেন্স দেব।
শ্মশানবটের এদিকটা নিঃঝুম। শ্মশানে আজ কেউ মড়া পোড়াতে আসেনি। নদীতে ধুধু চড়া পড়েছে। দেখতে-দেখতে সূর্য ডুবে গেল। আলো কমে এল। সেই সময় ছোটমামা হঠাৎ আমাকে খামচে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,–চলে আয়! ওই দ্যাখ, ব্যাটাচ্ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
চমকে উঠে দেখি, নদীর বালিতে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলাম। পাড়ের নিচে একফালি জল তিরতির করে বয়ে হচ্ছে। তার ওধারে বালির চড়া ওপার অবধি ছড়িয়ে রয়েছে। কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম, আরে! লোকটা ছোটমামার সেই চিরুনিটা দিয়ে সত্যি সত্যি চুল আঁচড়াচ্ছে যে!
ছোটমামা দড়ি বের করে চলে যায় বলেই নিচে ঝাঁপ দিলেন। আমিও ওঁকে অনুসরণ করলাম। জলটুকু পেরিয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,–একপা নড়ছে কি মরেছ, সা—ব–ধা–ন!
ছোটমামা ফুঁসে উঠে বললেন,–ভ্যাট! দিলে সব ভেস্তে। এখন নয়, এখন নয়।
গোবিন্দ কিংবা যেই হোক, সে ঘুরে আমাদের দেখল তারপর দৌডুতে শুরু করল। ছোটমামা,–তবে রে ব্যাটা চোর, যাবি কোথায়–বলে দৌড়লেন তার পেছনে। আমিও।
তখনও দিনের আলো আছে, তবে খানিকটা আবছা হয়ে গেছে। কালো মূর্তিটাকে ছোটমামা প্রায় ধরে ফেলেন এমন অবস্থা। তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। সামনে সেই কাঁটাতারের বেড়া। একটা সাইনবোর্ড লটকানো আছে। তাতে একটা মড়ার খুলি।
হতভম্ব হয়ে দেখলাম, লোকটা বেড়া ডিঙিয়ে ভেতরে চলে গেল। তারপর ধীরসুস্থে বালিতে তলিয়ে যেতে থাকল। কালো মুখের সাদা দাঁতে সে নিঃশব্দে হাসছে দেখে ছোটমামা ভেংচি কেটে বললেন লজ্জা করে না হাসতে ব্যাটাচ্ছেলে চোর কোথাকার? ভালো চাও তো চিরুনিটা দাও বলছি! ছোটমামা আমার হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে চ্যাঁচিমেচি করে বললেন,–ছুরি ছুড়ব বলে দিচ্ছি! চিরুনি দাও আমার। দেবে না? তবে রে! ওয়ান–টু–থ্রি।
গোবিন্দচোর হাত্তেরি বলে চিরুনি ছুঁড়ে দিল। সেটা ঘ্যাস করে ছোটমামার পায়ের সামনে বালিতে বিধে গেল কাস্তের মতো। চিরুনিটা তুলে ছোটমামা সম্ভবত শাসাতে যাচ্ছিলেন, তখন গোবিন্দের মডুটাও তলিয়ে গেল।
আমি বেজায় ভয় পেয়ে গেলাম,–ও ছোটমামা! আর এখানে নয়। বড্ড ভয় করছে যে!
ছোটমামা বললেন, ভয় তো আমারও করছে। দাঁড়া, আগে চুলগুলো ঠিক করে নিই! তারপর যাচ্ছি।