চোখে জলের ঝাপটা
০১.
চোখে জলের ঝাপটা দিতে দিতেই নারান সিঁড়ির মাথায় দেয়াল ঘড়িটার দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
ইসস চারটে বেজে গেছে!
চার লাফে বারোটা সিঁড়ি টপকে উঠে সে হলঘরে এল। ইতস্তত ছড়িয়ে-থাকা টেবিলগুলোয় এক একজন ঘুমোচ্ছে। কেউ লুঙ্গি, কেউ পাজামা, কেউ ধুতি পরে। টেবিলের কাগজপত্র, লেখার প্যাড, দোয়াত-কলম, টেলিপ্রিন্টারের কপিগাঁথা স্পাইক। সবই চেয়ারের উপর নামিয়ে রাখা। পাখার হাওয়ায় টেলিপ্রিন্টার রোল থেকে মেঝেয় লতিয়ে নেমে আসা কাগজ উড়ছে। নারান কাগজ ডিঙিয়ে হলঘরের কোণের দিকে গেল। ওখানে কাঠের আলমারির মাথায় তার টিফিন ক্যারিয়ার রাখা থলিটা রয়েছে।
টেবিলে টোলুবাবু বাঁ কাত হয়ে ঘুমোচ্ছেন। এই সপ্তাহে রাতে স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টে ওঁরই ডিউটি। রাত দুটোয় এক তলার প্রেস থেকে স্পোর্টস পাতা সাজিয়ে দিয়ে উঠে এসে শুয়েছেন। প্রতি রাতে শোবার আগে টোলুবাবু এক গ্লাস জল আর একটা ওষুধের বড়ি খান। নারান জলভরা গ্লাস তৈরিই রাখে। সেটা হাতে নিয়ে মুখে তোলার আগে প্রতি রাতের মতো আজও আক্ষেপ করেছেন, কত ভাল ভাল খবর যে ধরানো গেল না।
কেন, ধরাবার মতো জায়গা কি পাতায়…?
আরে না। ওলিম্পিক হচ্ছে হেলসিঙ্কিতে, ইউরোপের একটা দেশে। ওখানকার সঙ্গে কলকাতার সময়ের কত তফাত হয় জানিস?
অনাদিবাবু সেদিন বললেন পাঁচঘণ্টারও বেশি।
তবেই বোঝ। ইভেন্টগুলো শেষ হবে, রিপোর্ট লিখবে, তারপর পাঠাবে। কলকাতায় সেটা এসে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত বারোটা-একটা। কপিগুলো তর্জমা করবে কে? এগারোটা বাজলেই তো সবাই ট্রাম ধরতে ছুটবে। তারপর অ্যাত অ্যাত কপি আমি…।
এক চুমুকে গ্লাস খালি করে টোলুবাবু শুয়ে পড়েন। হেলসিঙ্কিটা যে পৃথিবীর কোন দিকে, কোন জায়গায় নারান তা জানে না। তার ধারণা টোলুবাবুও জানেন না। কিন্তু সিনিয়ার সাব-এডিটারকে আভাসে-ইঙ্গিতেও একজন বেয়ারার পক্ষে সেটা জানানো যায় না!
নারান ঘুমন্ত টোলুবাবুর পাশ দিয়ে আলমারির কাছে গেল। হাত তুলে আমলারির মাথা থেকে থলিটা নামাবার সময়, সজোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো হ-অ-অ-অ একটা শব্দ শুনল। মুখ ঘুরিয়ে দেখল টোলুবাবু পিট পিট করে তাকে দেখছেন।
নারান, তোদের ধান্যকুড়িয়ায় চালতা হয়?
ঠিক জানি না। নিশ্চয় কারও বাড়িতে গাছ আছে। কেন, আপনার দরকার?
না-হ-হ। ধানের সঙ্গে চালের সম্পর্কটা খুব কাছাকাছি তো তাই ভাবলুম…
আপনি ভাবছিলেন! এতক্ষণ তা হলে ঘুমোননি?
এল না। মনটা খচখচ করছে। যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে খেলা…কী যে হবে। তোর কি মনে হয় বল তো?
নারান এক-পা পিছিয়ে মাথা কাত করে ঘড়ি দেখল। চারটে-দশ! বনগাঁ লোকাল শেয়ালদা থেকে ছাড়বে চারটে-চল্লিশে। স্টেশনে কাগজ নিয়ে যাওয়ার ভ্যানটা অফিস গেট থেকে রওনা হওয়ার সময় হয়ে গেছে।
আমার কিছু মনে হয় না। আমি এখন চলি, নইলে ভ্যানটা পাব না।
আরে দাঁড়া দাঁড়া। সারা রাত আমার ঘুম হল না এই চিন্তায়…প্রথম খেলায় তো ওয়ান নিলে তোরা হারিয়েছিলি, এবারও কি তাই করবি? টোলুবাবু উঠে বসলেন।
নারান বিভ্রান্ত। অবাক হয়ে বলল, আজ্ঞে, ওলিম্পিকে তো আমার ইয়ে…আমাদের তো কোনও দল নেই!
ওলিম্পিক নিয়ে ভাবার জন্য আমার জেগে থাকার কোনও কারণ থাকতে পারে কি? সারা ভারতের লোক জানে, তুই জানিস হকিতে একটা গোল্ড আমরা পাব। আর কিছু নিয়ে মাথাব্যথা করে লাভ আছে কি?
আপনি ফুটবল টিমের জন্য ভাবছিলেন না? এই যে বললেন যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে…
রাখ যুগোশ্লাভিয়া। সুইডেনের এক ক্লাব-টিমের কাছে স্টকহোমে দুই-তিনে, ডেনমার্কের এক ক্লাব-টিমের কাছে কোপেনহেগেনে দুই-পাঁচে, হেলসিঙ্কিতে আমেরিকার ওলিম্পিক টিমের কাছে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে এক-তিনে হেরেছে। ভাব একবার, শেষে কি না আমেরিকার কাছে, যারা ফুটবল কী বস্তু জানে না!
টোলুবাবু কাগজের ভ্যান ছেড়ে দিলে আমার…
তোর কী আবার? ভ্যান চলে গেলে পা তো আছে! আমার ঘুম যে জন্য এল না …হ্যাঁ রে নারান…ততাদের এখন সতেরোটা খেলে সাতাশ, আমাদের যোনোটা খেলে বাইশ। লিগ, ধর পেয়েই গেছিস। এখন তো তোরা একটা ম্যাচ হেরেও যেতে পারিস, কী রে পারিস না?
এতক্ষণে নারান বুঝতে পারল টোলুবাবুর ঘুম হচ্ছে না কেন। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে মোহবাগানের রিটার্ন লিগ খেলাটা আর সাত দিন পরেই। আজই মোহনবাগান দ্বিতীয়বার এবছর জর্জ টেলিগ্রাফের সঙ্গে ড্র করে পয়েন্ট হারিয়েছে। টোলুবাবুর ঘুম ছুটে যাবারই তো কথা।
নারান হালদার যশোরের লোক। আট বছর বয়সে স্কুল মাঠে ফুটবলে পা ছোঁয়াবার দিন থেকেই সে ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার। খবরের কাগজ অফিসে তাকে চাকরি করতে হচ্ছে খেলার বিভাগে। মাত্র ছমাস হল সে এই বিভাগের বেয়ারার কাজ পেয়েছে। প্রথম দুদিনেই সে বুঝে গিয়েছিল বিভাগের হর্তাকর্তারা প্রায় সবাই মোহনবাগান সাপোর্টার। ওঁরা যদি জানতে পারেন সে ইস্টবেঙ্গল ভক্ত তা হলে। হয়তো অন্য কোনও ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিতে পারেন। এটা ধরে নিয়েই সে মুখে চাবি দিয়ে কাজ করে। রিপোর্টার, সাব এডিটররা খেলা নিয়ে যখন তর্ক বা আলোচনা করেন সে মন দিয়ে শুধু শোনে। শুনতে তার ভাল লাগে। অনেক কিছু শিখতে, বুঝতে, জানতে পারে খেলা সম্পর্কে। খেলাকে সে ভালবাসে এবং এই বিভাগটিকেও।
হ্যাঁ রে নারান, কী মনে হচ্ছে তোর?
কী আবার মনে হবে, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোন তো। এখনও ইস্টবেঙ্গলের অনেক খেলা বাকি, দুচারটে হেরেও তো যেতে পারে।…ভেঙ্কটেশ, আমেদ, সালে, চন্দন সিং নেই।
সে তো আমাদেরও মান্না, সাত্তার, রুনু নেই। তোদের আপ্পারাও, ধনরাজ, রমন আর ওই পাকিস্তানি ফকরি তো রয়েছে। উহহ, ওলিম্পিকগুলো এমন সময়ে হয় না! কেন যে পুজোর পর করে না! মান্নার জায়গায় এখন শরৎ দাসকে খেলাবার কথা হচ্ছে। চারবছর কোনও ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেনি শরৎ, কী যে অবস্থা!
টোলুবাবু চারটে-চল্লিশে…
কী বললি? চারটে চল্লিশে? এক ঝটকায় তাঁর শীর্ণ লম্বা কাঠামো টেবলে খাড়া হয়ে গেল। চল্লিশে চার?…চার দিয়ে চল্লিশ ভাগ..ভাগফল দশ,…তার মানে দশ গোল! টোলুবাবুর চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা।
চারটে-চল্লিশে বনগাঁ লোকাল ছাড়বে।
নারান, ওটা বনগাঁ নয়, বনগাঁ নয়, ইস্টেবেঙ্গল লোকাল!
টোলুবাবুর মুখ দেখে নারানের কষ্ট হল। তার থেকে কম করেও পনেরো বছরের বড়, এই সহজ, প্রাণখোলা সাতে-পাঁচে না থাকা মানুষটিকে তার খুব ভাল লাগে। শান্ত টোলুবাবু শুধু অশান্ত হয়ে ওঠেন মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের মুখখামুখি হবার দিন যখন এগিয়ে আসে। ওঁর ব্লাডপ্রেসার নাকি খুবই উঁচুর দিকে। এই সময় অফিসের কেউ, ওঁর কানে যাওয়ার দূরত্বে থাকলে মুখ দিয়ে ফুটবল শব্দটি বার করেন না।
আমি তা হলে এবার যাই টোলুবাবু। জানেনই তো, আমাকে আবার কাগজ বিক্রি করতে বেরোতে হবে। এই ট্রেনটা ফেল করলে…
তা হলে দশ ভাগফল?…রেজাল্টটা যখন তোর মুখ থেকেই…।
নারান দু-তিন পা এগিয়ে গিয়েছিল। হতাশ, ভেঙে পড়া স্বর শুনে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, আমার মুখ থেকে আবার কখন রেজাল্ট বেরোল! আমি তো ট্রেনের টাইম বললুম।
দৈববাণী রে, নারায়ণের দৈববাণী! যা তুই, তোর ট্রেন ছেড়ে দেবে। ধান্যকুড়িয়া, আমি টাইমটেবিলে দেখেছি, দশটা স্টেশন।…এক একটা স্টেশন আর এক একটা গোল।
কী আপনি বলছেন? ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে দশ গোল হয় কখনও? হয়েছে কখনও, না হবে কখনও? আপনি বরং এখন ওলিম্পিকের কথা চিন্তা করুন। সেখানে আমরা দশ গোল খাই কি না। বলতে বলতে নারান বেরিয়ে গেল।
নীচে এসে দেখল ভ্যানে কাগজ ভোলা হচ্ছে। গোবিন্দবাবু দাঁড়িয়ে। নারান তাকে বলল, টোলুবাবু দেরি করিয়ে দিলেন..উঠব?
আজ আর জায়গা হবে না। কাগজ বেশি ছাপা হয়েছে। হেঁটেই স্টেশন যাও।
হেঁটে যাব! ট্রেন পাব কি?
তা হলে দৌড়ে যাও।
নারান গ্যাসের আলো-জ্বলা রাস্তার দুধারে তাকাল। বাড়িগুলো আবছা। সরু ফুটপাথে সার দিয়ে ঘুমন্ত মানুষ। তাদের সঙ্গে কুকুরও ঘুমোচ্ছে। দূরের সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে মাঝে মাঝে ছুটন্ত লরির শব্দ ভেসে আসছে। গোবিন্দবাবু না বলেছেন যখন তখন আর সেটা হ্যাঁ হবে না। এই ভ্যান থেকেই শেয়ালদায় হকারদের কাছে কাগজ বিলি হবে আর মফস্বলের এজেন্টদের জন্য কাগজের প্যাকেট ট্রেনে উঠবে। ধান্যকুড়িয়ার এজেন্ট হরিহর ভট্টাচার্যের জন্য বরাদ্দ একশো কাগজ নিয়ে সেও ট্রেনে উঠবে। যদি এই ট্রেনটা না ধরতে পারে তা হলে এক ঘণ্টা দেরি হয়ে যাবে কাগজ বিলি করতে। ভোরের প্রথম ট্রেন ঘড়ি ঘরে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ে।
নারান মালকোঁচা দিয়ে পরা ধুতিটা হাঁটু পর্যন্ত টেনে তুলে কোমরে গুঁজল। জুতো নেই তার পায়ে। চটি ছিঁড়ে যাবার পর, সেটা মুচির কাছে দিতেই সে একবার মাত্র তাকিয়ে বলেছিল, এটা গঙ্গায় দিয়ে এসে একজোড়া নতুন কিনুন। সারাবার মতো জায়গা এতে আর নেই।
ছুটতে শুরু করল নারান। প্রায় এক মাইল পথ। খোয়ার টুকরো পায়ের তলায় ফুটছে, ছোট গর্তে পড়ে আঙুল আর গোছ ব্যথা পাচ্ছে। সেদিকে নারানের মন দেওয়ার সময় নেই। প্রায় অন্ধকার ট্রামরাস্তা ধরে সে ছুটে চলেছে। ভোরবেলা ব্যায়ামের জন্য যেভাবে দৌড়োনো হয়, নারান সেই বেগে দৌড়চ্ছে না। তারও সাত-আটগুণ জোরে, দেড় হাজার মিটার রেসের প্রতিযোগীদের মতো তার ছোটা। গঙ্গাস্নানের জন্য কিছু মহিলা ও পুরুষকে সে পশ্চিম দিকে হেঁটে যেতে দেখল। তার শুধু একটাই তখন দুশ্চিন্তা পুলিশ আর কুকুর। কিন্তু এদের কারও সঙ্গে সারাপথে তার একবারও দেখা হল না। যখন সে আমহাস্ট স্ট্রিটের মোড়ে তখন সে দেখল কাগজের ভ্যানটা তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। এই সময়ই একটা পেরেক গোড়ালিতে ঢুকে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল। পেরেকটা টেনে বার করে সে আবার ছোটা শুরু করল।
নারান হালদারের বয়স বত্রিশ। ছিপছিপে, প্রায় ছফুট। দূরপাল্লার অ্যাথলিটদের মতো পায়ের আঙুল থেকে কপাল পর্যন্ত তার দেহের গড়ন। গায়ের রং বালিমাটির মতো। মুখটি লম্বাটে, গালের হাড় সামান্য উচু, চোখ দুটি তীক্ষ্ণ জ্বলজ্বলে। চাহনিতে এমন একটা কাঠিন্য আছে যা থেকে মনে হয় লোকটি জেদি, একগুঁয়ে। হাঁটার ধরনে ব্যস্ততা প্রকাশ পায়। নারান ধৈর্যধারী নয়। চট করে রেগে ওঠে যেমন, জল হয়ে যেতেও বেশি সময় সে নেয় না। পরিশ্রমে কখনও সে কাতর হয় না। এই গুণটি তার জন্মগত।
হাতঘড়ি থাকলে নারান জানতে পারত, সে একমাইল পথ পাঁচ মিনিটেই দৌড়ে এসেছে। অবশ্য সময়টা নিয়ে সে অবাক হত না। এই রকম বেগে সে যখন-তখনই দৌড়তে পারে। স্টেশনে কাগজের ভ্যানটিকে ঘিরে তখন প্রচণ্ড ব্যস্ততা। থাক দিয়ে মাটিতে নামানো রয়েছে কাগজের স্তুপ। কলকাতার এজেন্টরা এখান থেকেই বিলি করে দিচ্ছে হকারদে। তারা হেঁটে বা সাইকেলে কাগজ নিয়ে ছুটছে চিৎকার করতে করতে। আর বান্ডিল বান্ডিল কাগজ তোলা হয়েছে ট্রেনে। স্টেশনে স্টেশনে স্থানীয় এজেন্টদের লোকের হাতে সেগুলো দেওয়া হবে।
নারান তার এজেন্টের জন্য নির্দিষ্ট কাগজের বান্ডিল ঘাড়ে নিয়ে ট্রেনে উঠল। এঞ্জিনের পিছনের কামরাটা প্রথম থেকেই বেছে নিয়েছে যেহেতু কয়লার গুঁড়ো কম ভিতরে ঢোকে। কিছু লোকও, যারা রোজই এই ট্রেনে যায়, এই কামরায় ওঠে, তারা সবাই পরস্পরকে চেনে। এদের কেউ ফড়িয়া, কেউ ব্যাপারি, দোকানি, কুলি, কম্পাউন্ডার বা সকালের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকও। কিন্তু নারানের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠতা হয়নি শুধু একটা কারণেই। ট্রেনে উঠেই সে ব্যাঙ্কে কাগজ রেখে, তাতে মাথা দিয়ে, লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
আজও সে তাই করল। তবে শোবার আগে কম্পাউন্ডারকে গোড়ালি দেখিয়ে বলল, কিছুক্ষণ আগে পেরেক ঢুকে গেছল, এখন একটু ব্যথা ব্যথা লাগছে। রাস্তার পেরেক, কিছু হবে না তো?
হতে পারে। পেকে পুঁজ হয়ে গ্রাংগ্রিন হতে পারে। হয়তো পা-টা কেটে বাদও দিতে হতে পারে। কিংবা ধনুষ্টঙ্কার হতে পারে। তাতে আপনি আজই মারা যেতে পারেন। কম্পাউন্ডার পান মুখে দিয়ে হাতের তেলোয় গুণ্ডি ঢালতে লাগল।
ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল নারানের মুখ। সে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বলল, মরে যেতে পারি?
পারেন। রাস্তার পেরেকে মরচে আছে। ওটা মারাত্মক জিনিস। অ্যান্টি-টিটেনাস ইঞ্জেকশন নেওয়া উচিত।
কত খরচ পড়বে?
টাকা চারেকের মধ্যেই হয়ে যাবে।
আর কথা না বলে নারান শুয়ে পড়ল। চার টাকা তার কাছে অনেক টাকা। বউ, দুটি ছেলেমেয়ে, চারটে গোরু, অথচ মাইনে ষাট টাকা! কাগজ বিলি করার জন্য হরিহর ভটচাজ দেয় তিরিশ টাকা। এই আয়ে চার টাকা দিয়ে ইঞ্জেকশন নেওয়া যায় না।
দমদম থেকে সিঙ্গল লাইন। এক একটা স্টেশনে ডাউন ট্রেনের সঙ্গে ক্রশিংয়ের জন্য কিছুক্ষণ ধরে আপ ট্রেনকে অপেক্ষা করতে হয়। নারান ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়েছিল। কাঁধে নাড়া খেয়ে চোখ মেলতেই দেখল মাথায় গামছা বাঁধা ভজনরামের মুখ।
এ্যা নারান, উঠ উঠ…বারাসাত আ গিয়া।
ভজনরাম নেমে গেল। কম্পাউন্ডারও নামতে নামতে বলে গেল, সঙ্গে সঙ্গে চুন লাগানো উচিত ছিল। স্টেশনে নেমেই লাগিয়ে নেবেন।
এখনও আধঘণ্টা বাকি ধান্যকুড়িয়ায় পৌঁছতে। নারান বাঙ্ক থেকে নেমে বেঞ্চে বসল। ট্রেনের শব্দ আর দুলুনিতে আবার তন্দ্রা আসছে। এইরকম সময়ে তার দেশের কথা মনে পড়ে। তার দাদাদের কথা, কাকার কথা; গাছ, দিঘি, খেত চোখে ভেসে উঠে।
নারানের তিন বছর বয়সে বাবা মারা যান। চৈত্রমাসে পাওনা আদায়ে বেরিয়ে, কুড়ি বিঘে জমি বায়না করে দুপুরে তিন ক্রোশ হেঁটে বাড়ি ফিরেই মাথা ঘুরে পড়েন। আর জ্ঞান ফেরেনি। ভীষণ রাগী মানুষ ছিলেন। খাটতেন দৈত্যের মতো। এক সময় তাঁর এক ছটাকও জমি ছিল না, বাড়ি ছিল না। মারা যাবার সময় সত্তর বিঘে জমি, দশটা বলদ, ছটা গাই, দই আর দুধের ব্যবসা, পাঁচ বিঘে জমিতে বাড়ি রেখে যান মাত্র চল্লিশ বছর বয়সেই। নারান মায়ের মুখে শুনেছে, বাবা নাকি তেইশ ঘণ্টা খাটতেন, একঘণ্টা ঘুমোতেন! স্বচ্ছলতার মধ্যে সে বড় হয়েছে। ক্লাস টেন-এ পড়ার সময় তার মা মারা গেলেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি।
দেশভাগের পরই তাদের শিবপোতা গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে নারানও গোপনে। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসে বসবাসের জন্য জমির খোঁজে। বনগাঁ থেকে ঠাকুরনগর তারপর ধান্যকুড়িয়ায় এসে এক চেনা লোকের সঙ্গে তাদের হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। তাদের পাশের গ্রামেরই রতন ঘোষ। এখানে সে রেলের কেবিনম্যানের কাজ করে। রতনের মাধ্যমেই শিবপোতার বারোটি পরিবার ধান্যকুড়িয়ায় আট বিঘা জমি কিনল সাড়ে তিনশো টাকা বিঘেয়। তারপর আবার তারা গোপনে দেশে ফিরে গিয়ে পরিবারের লোকদের নিয়ে আসে। এই আসার ব্যাপারে তাদের সাহায্য করেছিল গ্রামের কয়েকজন মুসলমান।
নারান কিনেছিল দেড় বিঘে। কিছু টাকা, গহনা, তিন বছরের মেয়ে নয়ন আর বউ মহামায়াকে নিয়ে পৈত্রিক ভিটে ছেড়ে পাঁচ বছর আগে নারান পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে চিরকালের জন্য। থাকার জন্য টালির চালের একটা মাটির ঘর, গোয়াল ঘর আর চারটে গাই কেনার পর হাতে আর টাকা ছিল না। শূন্য হাতে নারান দুধের ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু ধান্যকুড়িয়া সাধারণ একটা গ্রাম, লোকসংখ্যা কয়েকশো। দুধ বেচে দিনে এক টাকাও লাভ হয় না। নারানকে তাই চাকরির খোঁজ করতে হয় এবং খবরের কাগজের অফিসে কাজ পেয়ে যায়।
নারান তার ফেলে আসা গ্রাম শিবপোতার কথা যখনই ভাবে বুক ভারী হয়ে যায়। আর এই ভাবনাটা ভোরের ট্রেনেই তার মনে জেগে ওঠে। কিছুক্ষণের জন্য সে পারিপার্শ্বিক ভুলে চলে যায় সীমান্তের ওপারে, আবার এপারে ফিরে আসে ধান্যকুড়িয়ায় ট্রেন থামলে।
ট্রেন থেকে নামার সময় অন্য দিনের মতো আজও সে মনে মনে বলল—পুরনো দিনের কথা ভেবে লাভ নেই। যা ফিরে আসবে না তার জন্য হায় হায় করা বৃথা। বরং আবার কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়ানো যায় সেটাই দেখা উচিত। এজন্য খাটতে হবে। সবাই মিলে, তাকে আর মহামায়াকে, খাটতে হবে।
হরিহর ভট্টাচার্যের বইয়ের দোকানের মধ্যে থাকে সাইকেলটা। খবরের কাগজ অফিস থেকেই এটা কিনে দেওয়া। স্কুলের পাঠ্য বই, খাতা, কাগজ, পেনসিল ইত্যাদি ছাড়াও ছোটখাটো ওষুধ, পাউডার, সাবান, লজেন্স এমন কী পোলট্রির ডিমও দোকানে বিক্রি হয়। একটা পাল্লা খুলে রেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হরিহর দাঁতন করছিলেন। নারানকে দেখে বললেন, পেছনের চাকায় হাওয়া কম মনে হচ্ছে, একটু হাওয়া দিয়ে নাও। আর ঝাউডাঙার বাদল নস্করের কাগজের ও মাসের দামটা বাকি পড়ে আছে, তাগিদ দিয়ো।
নারান দোকানে ঢুকে হাতের ছোট থলিটা কাউন্টারের নীচের তাকে রাখল। তারপর দেয়ালে হেলানো সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে পিছনের চাকায় দুআঙুলে টিপতেই সামান্য বসে গেল। পাম্পার দিয়ে চাকায় হাওয়া ঢুকিয়ে সে সাইকেলটা বার করে আনল। হ্যান্ডেলের উপর অর্ধেক আর পিছনের ক্যারিয়ারে অর্ধেক কাগজ সাজিয়ে রাখতে রাখতেই সে রাস্তার ওপারের চায়ের দোকানের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল, হাবু, চা দে।
গ্লাসে চা আর এক আনা দামের একটা সুজির বিস্কুট হাবু দিয়ে গেল। দোকানের পাল্লা বন্ধ করে তালা দিয়ে হরিহর বললেন, কলকাতা যাব এগারোটার ট্রেনে, টাকাপয়সা ঝন্টুকে বুঝিয়ে দিয়ো।
নারান ধীরে ধীরে চিবিয়ে বিস্কুটটা খেল। যতক্ষণ না মুখের মধ্যে গলে যাচ্ছে। ততক্ষণ সে কোদাল দিয়ে কাদা ছানার মতো বিস্কুটের টুকরো জিভে নাড়ল। মহামায়ার করে দেওয়া চারখানা মোটা রুটি আর লাউপাতা দিয়ে আলুর ছেচকি রাতে অফিসে খেয়েছে। এখন পাঁচটা গ্রামে—শালকোনা, আন্দুলিয়া, ঝাউডাঙা, রঘুরামপুর, তুবড়িয়া-সাইকেল চালিয়ে যেতে হবে। একশো কাগজ দিতে একশোবার নামা আর ওঠা। মোট রাস্তা প্রায় আঠাশ মাইল।
ধান্যকুড়িয়ায় ফেরার সময় সাইকেল চালাতে চালাতে নারানের তখন মনে হয়, একটা রাক্ষস তার পেটটা মুঠোয় ধরে টিপছে আর ছাড়ছে। এক আনার বিস্কুট তখন গলায় উঠে এসে আটকে থাকে। তখন রাস্তার ধারের টিউবওয়েল থেকে সে পেট ভরে জল খেয়ে নেয়। ঝাঁ ঝাঁ রোদে দূরের গাছ আর বাড়ি চোখে তিরতির করে কাঁপে। রাস্তার ভাঙা ইটগুলো মাটি থেকে মাথা তুলে সারাক্ষণই সাইকেলটাকে ঝাঁকি দেয়। লরি আসে, বাস আসে সামনে-পিছন থেকে। গোরুর গাড়ির চাকার গর্ত সামলে রাস্তার ধারে বারবার সরে যাওয়া। ঘণ্টা-পাঁচেক পর, দুপুর দুটো নাগাদ বাড়ি ফেরা। তখন তার পেটভর্তি শুধু টিউবওয়েলের জল!
নারান চায়ে চুমুক দিতে দিতে কাচের বোয়েমে থাক দিয়ে সাজানো বিস্কুটগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। গুনতে শুরু করল। এক, দুই, তিন…এগারো, বারো…গোনা বন্ধ করল। বিস্কুটগুলো খাওয়ার দুটো উপায় আছে—পয়সা দিয়ে কিনে নেওয়া, নয়তো ঝপ করে বোয়েমটা তুলে সাইকেল চালিয়ে সরে পড়া।
মাথা নেড়ে নারান হেসে ফেলল, নিজের উদ্ভট চিন্তায়। তার পকেটে একটা সিকি আছে বটে, কিন্তু এটা নিরুপায়। কোনও অবস্থায় পড়লে তবেই খরচ করার জন্য। মরে গেলেও সে এটা দিয়ে বিস্কুট কিনে খাবে না। আর বোয়েম লুঠ করার মতো কাজের প্রবৃত্তি তার রক্তে নেই।
হ্যাঁ রে হাবু, একটু চুন পাওয়া যাবে?
হাবু চালার নীচে থেকে গলা বাড়িয়ে ডান দিকে তাকাল। রসময়ের দোকান এখনও খোলেনি। কী হবে চুন দিয়ে?
পায়ে একটা পেরেক ফুটেছিল সকালে, সামান্য টাটাচ্ছে জায়গাটা।
ও অমন একটু-আধটু টাটাবে, কিছু হবে না। রাস্তায় পানের দোকান পাবে, লাগিয়ে নিয়ো।
কাগজ বিলি করতে করতে নারানের আর মনে ছিল না চুন লাগাবার কথা। ঝাউডাঙায় বাদল নস্করের বাড়ির দরজার সামনে সাইকেল থেকে নামার সময় গোড়ালিটা পড়ল একটা ইটের উপর। ব্যথা লাগতেই তার মনে পড়ল, চুন লাগাতে হবে।
বাদল নস্কর চাষের কাজ দেখতে ক্ষেতে গেছে। কাগজের পাওনা টাকা না নিয়ে নারান আজ আর ফিরে যাবে না ঠিক করেছে।
ক্ষেত কত দূর? নারান জিজ্ঞেস করল নস্করের ক্লাস এইটে পড়া নাতিকে।
আধ-মাইলটাক হবে।
আমার পায়ে পেরেক ফুটেছে, হাঁটতে পারব না। তুমি গিয়ে বরং খবর দাও কাগজওয়ালা ওমাসের দাম নেবার জন্য বসে আছে। এমাসের আজ একুশ, টাকা না পেলে কাল থেকে আর কাগজ দিতে পারব না।
কাগজ দেবেন না? ওলিম্পিক চলছে যে! ছেলেটির মুখে অসহায় ভাব ফুটে উঠল।
ওলিম্পিক বলে কি কাগজ ফ্রি হয়ে গেছে? কাগজ তো পয়সা দিয়ে আমাদের কিনে আনতে হয়! দশ পয়সা করে হলে তিরিশ দিনে কত হয়?
ছেলেটি মনে মনে গুণ-ভাগ-বিয়োগ করে বলল, চার টাকা চুয়াল্লিশ পয়সা।
যদি ওলিম্পিকের খবর পেতে চাও তা হলে এক্ষুনি গিয়ে দাদুর কাছ থেকে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করো। হাতের কাগজ খুলে সে খেলার পাতাটা ছেলেটির সামনে মেলে ধরল। এতেই কাজ হল। ছুটে চলে যাচ্ছিল তখন নারান আবার ডাকল।
বাড়িতে পান খায়?
হ্যাঁ।
একটু চুন এনে দাও তো, গোড়ালিতে লাগাব।
নারান দরজার সিঁড়ির চওড়া ধাপে বসল। হাতের কাগজটা খুলে চোখ বোলাচ্ছে তখন ছেলেটি ফিরে এল বাড়ির মধ্যে থেকে। আঙুলে কুড়িটা পানে দেবার মতো চুন।
অত কী হবে।বলতে বলতে নারান ওর আঙুল থেকে নিজের আঙুলে চুন তুলে নিল। ছেলেটি দৌড়ে চলে গেল। চুন লাগানো গোড়ালি হাঁটুতে তুলে নারান আবার কাগজে চোখ দিল।
একটা খবরে তার চোখ আটকে গেল:
এমিল জ্যাটোপেকের স্বর্ণ জয়। ওলিম্পিকের দশ হাজার মিটার দৌড়ে তিনি। নতুন রেকর্ড গড়েছেন ২৯ মিঃ ৫৯.৬ সেকেন্ড সময় করে। এর আগে ১৯৪৮-এর লন্ডন ওলিম্পিকেও তিনি স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন নতুন ওলিম্পিক রেকর্ড করে। লন্ডনে তিনি পাঁচ হাজার মিটার দৌড়েও রৌপ্যপদক অর্জন করেছিলেন। ওঁর স্ত্রী। ডানা জ্যাটোপেকও এই ওলিম্পিকে জ্যাভেলিন নিক্ষেপ বিভাগে চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রতিনিধিত্ব করছেন। এমিল জ্যাটোপেকের ১০০ গজ পিছনে থেকে ফ্রান্সের মিষু ১০ হাজার মিটারের রৌপ্যপদক লাভ করেছেন।
খবরটা অসাধারণ বা চমকপ্রদ নয়।
নারান চোখ সরাতে যাচ্ছে পাশের ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচের খবরে! তখন জ্যাটোপেকের একটা কথা তার নজরে এল: জয়ের পর এক সাংবাদিক তাঁর কাছে জানতে চান—-চার দিন পর পাঁচ হাজার মিটার দৌড়েও তিনি অংশগ্রহণ করবেন, এ কথা কি সত্যি? জবাবে জ্যাটোপেক বলেন, ম্যারাথন প্রতিযোগিতার তো অনেক সময় বাকি। তাই ততক্ষণ বসে না থেকে কিছু একটা তো করতে হবে।
তারপর আর একটা বাক্য—জ্যাটোপেক দম্পতির জন্ম একই বছরে একই দিনে, ১৯২২-এর ১৯ সেপ্টেম্বর।
হঠাৎই নারানের শরীরে হালকা শিহরন জাগল। তারও তো জন্ম ১৯ সেপ্টেম্বর! তবে জ্যাটোপেকের দু বছর আগে। হোক না দু বছর আগে কি পরে, তারা তো প্রায় সমবয়সিই! নারানের শরীরে একটা সতেজ ভাব নাড়াচাড়া করে উঠল। কেন যে সে প্রফুল্লতা বোধ করছে তার কোনও কারণ সে বলতে পারবে না। শুধু তার মনে হচ্ছে, তারই সমবয়সি একজন পৃথিবীতে তার বিভাগে সেরা।
আর তার ভাল লেগেছে ওই কথাটাও–ততক্ষণ বসে না থেকে কিছু একটা তো করতে হবে। রসিকতা করেই জ্যাটোপেক বলেছেন, কিন্তু নারান এর মধ্যে তার নিজের মনের ছবিটাই যেন ফুটে উঠতে দেখছে। সেও তো কখনও বসে থাকে না। তার বউ মহামায়াও কখনও অলস হয়ে সময় কাটায় না। তারা দুজনেই কিছু না কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এই জ্যাটোপেক লোকটাও তাই করে।
নারান এই মুহূর্তেই দৌড়কে ভালবেসে ফেলল। সাইকেলটার দিকে সে তাকাল। ভাবল, এটাকে বাতিল করে দৌড়ে দৌড়ে পাঁচটা গ্রামে কাগজ বিলি করলে কেমন হয়? তারপরই মনে হল, এক একটা আট পাতার একশো কাগজ বগলে কি মাথায় নিয়ে দৌড়লে কাজটা বোকার মতোই হবে। বিলি করতে করতে একটা একটা করে কাগজ কমে যাবে ঠিকই, কিন্তু সময়ও তো বেশি লাগবে! দেরি হলে খদ্দেররা চটবেই, আর তার কাছ থেকে কাগজ নেওয়াও বন্ধ করে দেবে।
থাক, দৌড়ে আর দরকার নেই, সাইকেলই ভাল! নারান জ্যাটোপেককে মন থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য ইংল্যান্ডে ভারতের সঙ্গে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচের খবরে চোখ রাখল। এই একটা খেলা যার মাথামুণ্ডু সে একদমই বোঝে না, অবশ্য বোঝার কোনও চেষ্টাও করে না। কাজকর্ম ফেলে পাঁচ দিন ধরে মাঠে বসে যারা খেলা দেখে, তারা যে কী ধরনের লোক সেটাও সে বুঝতে পারে না!
অফিসের রবিবাবু তো ক্রিকেটের উপর ভীষণ খাপ্পা। একদিন টেবল চাপড়ে চিৎকার করে বলছিলেন, পৃথিবীতে যেসব দেশ উন্নতি করেছে, শক্তিশালী হয়েছে, যেমন আমেরিকা, রাশিয়া, এরা কেউ ক্রিকেট খেলে না। এটা হচ্ছে রাজারাজড়াদের রোদ পোয়াবার একটা ফিকির। আরে বাবা, আমাদের হল গরিব দেশ। স্বাধীনতা। পেয়েছি, এবার দিন-রাত পরিশ্রম করে দেশটাকে দাঁড় করাতে হবে। এখন কি আমাদের সময় নষ্ট করার খেলায় মেতে ওঠা উচিত? আর খেলিও তো আমরা তেমনি! এই দ্যাখো না, টুম্যান নামে নতুন এক ছোকরা অ্যায়সা জোরে বল করল যে আমাদের ব্যাটসম্যান ভয়ে পিছু হটে আম্পায়ারের কাছাকাছি চলে গেল।
রবিবাবু অসহযোগ আন্দোলনে জেল খেটেছেন। খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কিছু পরেন না। কুস্তি, বকসিং, সাঁতার, জিমন্যাসটিকসের ভক্ত। ওঁর কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে কীসের যেন জ্বালা আর রাগ বেরিয়ে আসে। টাক মাথাটায় হাত বুলোতে বুলোতে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, হ্যাঁ রে নারান, যদি দেশটা ভাগ না করা হত, তা হলে তুই এখানকার থেকে ভাল থাকতিস না মন্দ থাকতিস?নারান কয়েক মুহূর্ত ভেবে জবাব দিয়েছিল, ভাল থাকতুম ঠিকই, তবে সেখানে জীবনটা সাজানো ছিল তো…এখন নতুন করে আবার গড়ে তুলতে হচ্ছে। গড়ার একটা আলাদা সুখ, আলাদা আনন্দ আছে। রবিবাবু সেটা আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারব না। আমার বউ এটা বোঝে।
স্টিলফ্রেমের গোল কাচের চশমাটা কপালের উপর তুলে দিয়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সি রবিবাবু কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, তুই দেখছি, আলাদা ধরনের মানুষ! ওপার থেকে যত উদ্বাস্তু এসেছে সবাই বলে কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, আর তুই দুঃখ কষ্টের মধ্যে কিনা আনন্দ খুঁজে পাস?..আলাদা মানুষ
নারান অন্যমনস্ক হয়ে একদৃষ্টে কাগজের দিকে তাকিয়ে থেকে ভেবে যাচ্ছিল রবিবাবুর কথাগুলো। লক্ষ করেনি ছেলেটি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
দাদু বললেন, ফিরতে ঘণ্টাখানেক দেরি হবে। আপনি কি ততক্ষণ থাকবেন?
থাকলে আমার চলবে না। তেরো-চোদ্দো মাইল..আমাকে ফিরতে হবে।
কাগজ দেবেন না? ছেলেটির গলায় হতাশা, মিনতি। নারানের মায়া হল। কাগজটা এগিয়ে ধরে বলল, কাল অবশ্যই যেন টাকা পাই। কাগজটা ব্যগ্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে আবার বলল, খেলার খবর পড়তে চাও, কিন্তু কী আছে আমাদের পড়ার জন্য? শুধু তো হকির একটা মেডেল।
কেন ফুটবল আছে!
নারান আর কথা না বলে সাইকেল নিয়ে রাস্তায় উঠে এল। প্যাডেলে পা রেখে সিটে বসার উদ্যোগ করছে, তখন সে ছেলেটিকে আহত স্বরে বলতে শুনল, এ কী! দ-অ-শ গোল!..ওম্মা! এক দিনেই দুটো ইনিংস শেষ!
নারান বুঝতে পারল না, কেন ছেলেটির মুখ থেকে রক্ত সরে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে
গেল। মনে হচ্ছে যেন কলেরার রোগী।
কী হল? চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে, নারান সাইকেল হাতে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে রইল।
দশ গোল খেয়েছে ইন্ডিয়া, একটা গোল শুধু শোধ করেছে…যুগোশ্লাভিয়ার কাছে! আর ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে খেলার থার্ড দিনে ভারত দুবার আউট হয়েছে, আটান্ন আর বিরাশি রানে…ইনিংস আর দুশো সাত রানে হেরে গেছে।
রাখো ক্রিকেট, বলো ফুটবলের খবরটা।
ম্যানেজার এম দত্তরায় খেলার এক ঘণ্টা আগে স্পষ্টই স্বীকার করেন ভারতের পক্ষে জেতার কোনও সম্ভাবনা নেই…সাতজন খালি পায়ে খেলেছে…ওলিম্পিক স্টেডিয়ামের পাশের এক মাঠে খেলা হয়…আর, খেলা শেষের কয়েক সেকেন্ড আগে কুড়ি গজের শটে আমেদ খাঁ গোল দেয়।
দশটা গোল হল কখন?
প্রথম মিনিটেই, তারপর তেরো, আঠারো, তেইশ, চুয়াল্লিশ। ফাইভ নিল। তার পর পঞ্চাশ, একষট্টি, তেষট্টি, আটষট্টি, অষ্টআশি!
ওরে বাবা, তুমি তো নামতা পড়লে দেখছি! অষ্টাশি মিনিটেও ছাড়েনি! আমাদের টিমে খেলেছে কারা? টিম দিয়েছে?
দিয়েছে বি অ্যান্টনি, আজিজ, মান্না, লতিফ, চন্দন সিং, সম্মুগম, ভেঙ্কটেশ, সাত্তার, মৈনুদ্দিন, আমেদ, জে অ্যান্টনি।
কলকাতার প্লেয়ারই তো বেশি।
এই বলেই নারান সাইকেলে উঠে পড়ল। একটা কথা মনে পড়ায় তার অবাক লাগছে—টোলুবাবু তাকে ভোর রাতে এই খেলার রেজাল্ট সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও জানাননি। নিশ্চয়ই বেশি রাতে, খেলার বিভাগের সবাই বাড়ি চলে যাবার পরই, খবরটা এসেছিল। আগে এলে তো টেবিলে হইচই পড়ে যেত, সেও জেনে যেত। বেশি রাতে খবর এসেছে, খবরটা টোলুবাবুই তর্জমা করেছেন, তিনিই প্রেসে গিয়ে কাগজের পাতায় খবর বসিয়েছেন। আর আশ্চর্য এটা নিয়ে সামান্য উচ্চবাচ্যও করলেন না! শুধু মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে কী হবে তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় ঘুমোতে পারছেন না! খেলা পাগল কি একেই বলে? শুধুই মোহনবাগান, তার বাইরে পৃথিবীতে আর কিছু নেই! বয়স্ক লোকেরা খেলা নিয়ে কত যে ছেলেমানুষি করেন! হেলসিঙ্কির দশটা গোল হয়তো ওঁর মাথায় ঘুরছে আর আঁতকে উঠছেন। সব কিছুর মধ্যেই উনি দশ গোল দেখতে পাচ্ছেন।
পাগল, দশ গোল বড় ম্যাচে হয় নাকি! নারান চাকরিতে ঢোকার আগে একবার মাত্র ধান্যকুড়িয়া থেকে কলকাতায় এসে ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখেছে। তারপর নাইট ডিউটি করে, কাগজ বেচে, বাড়ি ফিরেই কাস্তে নিয়ে গোরুর জন্য ঘাস কাটতে বসা। তারপর আবার ট্রেন ধরে অফিসে ডিউটি করতে যাওয়া—সময় কোথায় তার মাঠে যাওয়ার? সাইকেলে প্যাডেল করতে করতে নারান শূন্য চোখে সামনে তাকিয়ে। তারও ফুটবলার হবার সাধ ছিল। পনেরো বছর আগেও স্বপ্ন দেখত ইস্টবেঙ্গল টিমে খেলার, কিন্তু এখন তার এ সবের জন্য সময় নেই। সংসারটাকে আগে দাঁড় করাতে হবে তারপর খেলাধুলোর কথা ভাবা যাবে।
কিন্তু কবে? বয়স তো আর থমকে থাকবে না, বেড়েই যাবে। বুড়ো বয়সে দাবা আর লুড়ো ছাড়া আর কী-ই বা খেলবে? অথর্ব শরীরে দৌড়োদৌড়ি করা তো যাবে না! অথর্ব শব্দটা মনের মধ্যে ঢুকে পড়তেই নারানের মাথা গরম হয়ে গেল। সে কী! আমি অথর্ব হব? অসম্ভব…অসম্ভব।
প্রচণ্ড গতিতে তার দুটো পা ওঠানামা করতে শুরু করল প্যাডেলে চাপ দিয়ে। চোয়াল শক্ত, হ্যান্ডেল ধরা হাতের পেশি ফুলে উঠেছে। মাথার মধ্যে একটা প্রতিজ্ঞা সাইকেলের চাকার মতো বনবন ঘুরছে বুড়ো হব না…বুড়ো হব না…বুড়ো হব না।
ধান্যকুড়িয়া রেল স্টেশনের পুব দিকে নারানের বাড়ি। সাইকেলটা হরিহর ভট্টচাযের দোকানে রেখে, নগদ বিক্রির টাকা ওর ছেলে ঝন্টুকে বুঝিয়ে দিয়ে সে হেঁটে বাড়ি ফেরে। রেললাইন পার হয়ে একটু পা চালিয়ে হাঁটলে মিনিট দশেকের পথ। লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে তার সঙ্গে দেখা হল বিভূতি মুখুজ্জের। হাবড়ায়। বাড়ি। এখানে ওঁর জমি জায়গা আছে। ভাগে চাষ করান।
ইনি নারানকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, অন্যের হয়ে কাগজ না বেচে, নিজেই কিনে এনে বেচ না! নারান বলেছিল, কাগজ কিনে আনব যে, তার টাকা কোথায়? কাগজ পিছু তিন টাকা করে সিকিউরিটি-মানি জমা রাখতে হবে। যদি দেড়শো কাগজ আনি তা হলে সাড়ে চারশো টাকা! বাপস! সাড়ে চার টাকা দেবারই ক্ষমতা আমার নেই, আর কিনা…। বিভূতি মুখুজ্জে বলেছিলেন, ফিফটি ফিফটি শেয়ারে ব্যবসা করো। সিকিউরিটি-মানিটা আমি দেব, তুমি কাগজের দামটা দিয়ো।
কয়েক দিন প্রস্তাবটা নিয়ে সে ভেবেছিল। অফিসের ষাট টাকা আর হরিহর ভটচাযের তিরিশ টাকা, এই নব্বই টাকা আর দুধ বেচে যে কটা টাকা পাওয়া যায়। এই টাকায় তো আর বছরের পর বছর চলা যায় না! খরচ তো বাড়বেই। মহামায়াকে বলা মাত্র সে বলেছিল, ভালই তো, আয় বাড়াবার জন্য নিজেই ব্যবসাটা ধরো। আমার কাছে এখনও ভরি-দেড়েক সোনা তো রয়েছে। নারান তাকে থামিয়ে দিয়ে। বলেছিল, ভারতে এসে চার বছর বেকার ছিলাম। হাতের টাকা সবই গেল ভিটেটা কিনতে আর দুবেলা খেতে। তোমার সাত ভরি গয়না তিনশো টাকায় বন্ধক রয়েছে। সুদে আসলে কত যে হয়েছে আজও তার হিসেব করিনি। ওই গয়না ছাড়িয়ে না আনা পর্যন্ত আমি আর কিছু নেব না তোমার কাছ থেকে। তাতে যদি ব্যবসা করা না হয় তো হবে না।
লেভেল ক্রসিংয়ে সে বিভূতি মুখুজ্জেকে বলল, টাকা দিয়ে ব্যবসা করার মতো অবস্থা হলে করব। আগে কিছু জমাই তারপর আপনাকে বলব। দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো অবস্থা তার এখন নয়। শ্রান্তিতে আর খিদেয় শরীর অবসন্ন। এখন বাড়ি ফিরে আবার ঘাস কাটতে বেরোতে হবে।
নারান, তিরিশ টাকার জন্য এই অমানুষিক পরিশ্রম কত দিন করবে?
যত দিন না বেশি টাকার কাজ পাচ্ছি। এই তিরিশ টাকাই বা কে দেয় বলুন? যা পাওয়া যায় তা আর ছাড়ব কেন? আমার মূলধন তো এই শরীরটা, দেদার খরচ করতে পারি!
নারান বাড়ির দিকে রওনা হল। পিছন থেকে চেঁচিয়ে বিভূতি মুখুজ্জে বললেন, মূলধনটা সামলে খরচ কোরো, অসুখ-বিসুখ বলে একটা কথা আছে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে নারান বলল, অসুখ তো একটাই…ক্যানসার। হলে কিছুই করার নেই। তা ছাড়া আর কোনও অসুখ আমায় কাবু করতে পারবে না।
অহঙ্কার দেখানো হয়ে গেল নাকি? বাড়ি ফিরতে ফিরতে নারান ভাবল, শরীরটা কি ভগবানের দেওয়া জিনিস, না কি মানুষ নিজেই গড়ে তোলে? নিজের ভাবনার। জালে নিজেই আটকে পড়ল সে। চিন্তা-ভাবনা করার মতো লোক সে নয়। তবে বেঁচে থাকার জন্য পরিশ্রম আর নানা ধরনের মানুষের সংস্পর্শে এসে তার মনে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব প্রশ্ন জেগে ওঠে। অন্যদের ধরাবাঁধা গতানুগতিক নজরের মতো নয়, জীবনটাকে একটু আলাদা ভাবেই সে দেখতে পায়। নারান কখনও দিবাস্বপ্ন দেখে না, তবে মাঝে মাঝে মনের মধ্যে কিছু একটা ঝিলিক দেয়।
বাড়ি ফিরে সে ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ঘাস কাটতে। আট বছরের মেয়ে নয়ন তার সঙ্গ নিল ছাতা হাতে। ঝাঁ ঝাঁ রোদুরে, উবু হয়ে বসে যখন নারান দক্ষ হাতে দ্রুত কাস্তে চালায়, নয়ন তখন ছাতা ধরে থাকে তার মাথার উপর। এই কাজ করার জন্য কেউ তাকে বলে দেয়নি। বিঘৎ খানেক লম্বা ঘাস। মুঠোয় ধরে সে কাস্তে চালায় আর ঝুড়িতে ছুড়ে দেয়। উবু হয়ে কাটতে কাটতে এগোয় হাঁসের মতো দুলে দুলে আর নয়ন ঝুড়িটা তার পাশে পাশে এগিয়ে দেয়। একটা-দুটো কথা তাদের মধ্যে হয়। যেমন আজ নারান বলল, সাতের ঘরের নামতাটা মুখস্থ হয়েছে?
নয়ন বলল, না। গড় গড় করে পারব না।
নারান বলল, কাল মুখস্থ ধরব।…প্রথম ভাগ?
নয়ন বলল, দিঘইকার ধরেছি।
পাড়ায় একটা মাত্র টিউবওয়েল। সেটা নারানেরই দূরসম্পর্কের এক দাদা শচীন হালদারের বাড়ির সামনে। শচীন তখন খেয়ে উঠে মুখ ধুচ্ছিল। বালতি হাতে নারান অপেক্ষা করছে। মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকার পর তার মনে হল, শচীন যেন ইচ্ছে করেই অযথা সময় নিয়ে হাত ধুচ্ছে, পা ধুচ্ছে, মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে, কুলকুচি করছে। লোকটির সঙ্গে তার সদ্ভাব নেই। তার মাথা গরম হয়ে উঠল।
কতক্ষণ লাগে হাত মুখ ধুতে? তাড়াতাড়ি করো। নারান বিরক্ত স্বরে বলল।
কেন, অত ধমকে কথা বলছিস কেন? ধুতে যতক্ষণ লাগবে ততক্ষণ পোব। টিউকল কি তোর একার সম্পত্তি?
পাবলিকের সম্পত্তি। তাই বলে লোক দাঁড় করিয়ে রেখে… নারান বালতিটা কলের তলায় বসিয়ে হ্যান্ডেল ধরল। অনেক মুখ ধোয়া হয়েছে। এবার আমায় চান করতে দাও।
তুই আমাকে জোর করে সরিয়ে দিলি? আচমকা শচীন চিৎকার করে উঠল। সামনের বাড়ির দাওয়ায় বেরিয়ে এল এক প্রৌঢ়। জানলায় উঁকি দিল মেয়েদের মুখ।
এখানে সব বাড়িই একতলা, খড়ের বা টালির চালের। বাড়ির সঙ্গে মাটির উঠোন। ওর চিৎকারে আরও অনেকে বেরিয়ে এল।
নারান কথা না বাড়িয়ে পাম্প করে বালতিতে জল ভরতে লাগল। শচীনের বাড়ি থেকে তখন বেরিয়ে এল তার সেজো ছেলে ভরত।
কী ভেবেছ কী, অ্যাঁ? তুমি একাই কল দখল করে চান করবে? ভরত রুক্ষ ভঙ্গিতে বলল।
বাবু হয়ে বসে নারান বালতি থেকে মগে জল তুলে মাথায় ঢালছিল। বলল, যা জানিস না, দেখিসনি, তাই নিয়ে ঝগড়া করতে আসিস না। বাড়ি যা।
নারানকাকা, তোমার গা-জোয়ারি কিন্তু…
এক চড়ে তোর দাঁতের পাটি ফেলে দেব যদি আর একটাও কথা বলিস। পায়ে পা বাধিয়ে তোর বাপই ঝগড়া শুরু করে। বাড়ি যা।
ভরত আরও কিছু কথা বলল অবশ্য গলা নামিয়ে। নারান তাতে কান না দিয়ে বালতিতে জল ভরে বাড়ি ফিরে এল। উঁচু স্বরে গলার আওয়াজ মহামায়া শুনেছে। তাই সে নারানের কাছে কারণ জানতে চাইল।
কী আবার হবে, শচীনদার যা স্বভাব। আমায় খোঁচা দেবার চেষ্টা করল। অনেক কষ্টে রাগ সামলেছি।
মহামায়া এই বিষয়ে আর কথা না বলে নারানকে ভাত বেড়ে দিল। সে জানে তার স্বামীর প্রকৃতি। মোটা চালের ভাত, পুকুরের কলমি শাক, ঘরের পিছনে ছাইগাদায় হওয়া মানকচু, বাড়ির উঠোনে মাচায় হওয়া লাউ। এই সব দিয়েই তৈরি হয়েছে রান্না। নারান পেট ভরে খেয়ে, চাটাইয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করল। শিবপোতা থেকে আসার সময় সে অ্যালার্ম দেওয়া জাপানি টেবল ঘড়িটা এনেছিল। বেশ জোরেই সেটা টিক টিক, টিক টিক শব্দ করে। নারান চোখ বুজে শব্দ শোনে, আর অপেক্ষায় থাকে কখন অ্যালার্ম বেজে ওঠে।
আধ ঘণ্টা পরই, চারটের সময় অ্যালার্ম বেজে উঠল, আর নারানও উঠে বসল। তার ছোটখাটো ঘরের কাজ রয়েছে। মহামায়া চার বাড়ি গোরু দুয়ে পাঁচ টাকা মাসে পায়। সে এইবার বেরোবে। গতকাল নারান বাঁশ কেটে রেখেছিল নতুন একটা মাচা তৈরি করবে বলে। কয়েকটা বাঁশ চিরে হাত চারেক লম্বা বাখারি করা। উঠোনের যেখানে মাচা হবে সেইদিকে বাখারিগুলো ছুড়ে দিতে দিতে, হঠাৎ কী যেন মনে পড়ায় মহামায়াকে উদ্দেশ করে নারান বলল, স্পোর্টসে বর্শা নিক্ষেপ বলে একটা ব্যাপার আছে। লম্বা সরু লাঠির মতো, বোধহয় লোহা টোহা দিয়ে তৈরি কিংবা অ্যালুমিনির, মুখটা ছুঁচলো। এর একটা কী যেন ইংরিজি নামও আছে। ওলিম্পিকে একটা বউ এই বর্শা ছোড়ার কম্পিটিশনে নাম দিয়েছে। তার বরের নাম জ্যাটোপেক, সে নাম দিয়েছে দৌড়ে। তিন রকম পাল্লার দৌড়ে নামবে। প্রথমটায় কাল জিতে গিয়ে সোনার মেডেল পেয়েছে। এবার দ্বিতীয়টায় দৌড়বে।
বউ! মহামায়া হাঁ করে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে। বউ বর্শা ছুড়বে কী গো? বয়স কত? লজ্জা করবে না?
এতে লজ্জা করার কী আছে? কলকাতাতেও তো কত মেয়ে হাফ প্যান্ট পরে দৌড়চ্ছে! জ্যাটোপেক স্বামী-স্ত্রীর জন্ম একই বছরে, একই দিনে। অদ্ভুত না? আরও অদ্ভুত হল, ওরা আমার থেকে ঠিক দু বছরের ছোট, ঠিক দু বছরের…আমাদের তিনজনেরই জন্ম একই তারিখে, উনিশে সেপ্টেম্বর!
আমাদের তিনজন বলে নিজেকে ওঁদের সঙ্গে জড়াতে পেরে নারানের চোখে-মুখে চাপা গর্ব যেন ফুটে উঠল। ঠাট্টার সুরেই সে বলল, তোমার জন্ম তারিখটাও যদি উনিশে সেপ্টেম্বর হত!
তা হলে কী হত? আমি কি তা হলে বর্শা ছুড়তাম ওই বউটার মতো?
যদি এ দেশের না হয়ে ও দেশের বউ হতে, আর দুধ দোয়া, খুঁটে দেয়ার কাজ যদি না করতে হত তা হলে হয়তো বর্শা ছুড়তে কি হাইজাম্প, লংজাম্প দিতে!
সে আবার কী?
দেখবে? বলেই নারান লুঙ্গিটা গুটিয়ে তুলে মালকোচার মতো কোমরের পিছনে গুঁজে, উঠোনের বাইরে রাস্তার কাছাকাছি চলে গেল। তারপর ছুটে এসে একটা লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে প্রায় পনেরো ফুট দূরে উঠোনের উপর জোড় পায়ে নামল।
মাটির উঠোন হলেও জমি সানের মতো শক্ত। নারান কোনওরকমে উইহ শব্দটা মুখে চেপে রেখে উঠে দাঁড়াল। পেরেক ফোটার জায়গাটা ঝন ঝন করে উঠেছে তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্রণায়। কিন্তু সে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, দেখলে তো? এটা হল লংজাম্প। হনুমান এই লাফ দিয়েই লঙ্কায় গেছল।
হাফ প্যান্ট পরে মেয়েমানুষ এইভাবে লাফায়?
নিশ্চয়। তুমিও রোজ প্র্যাকটিস করো, পারবে। কত আর বয়স তোমার, পঁচিশ? আর জ্যাটোপেকের বউয়ের বয়স এখন দু মাস কম তিরিশ, তোমার থেকে পাঁচ বছরের বড়! সন্ধের পর, অন্ধকারে তুমি যদি…
থামো তো। মহামায়া ধমক দিয়ে উঠল। লোকের সামনে হনুমান হওয়ার জন্য আমি এখন অন্ধকারে লাফ দেওয়া শিখব? ওই সময়টায় ঠোঙা বানালে আমার অনেক লাভ হবে।
ঠোঙা? নারান কৌতূহলী চোখে তাকাল। কে ঠোঙা বানাবে?
ঘোষেদের বাড়িতে মেয়েরা রাত্তিরে রান্নাবান্না সেরে ঠোঙা বানায়। গোবরডাঙা থেকে পুরনো কাগজ কিনে আনে। একসেরি ঠোঙা বিক্রি করে এক টাকায় পনেরো দিস্তে।
দিস্তে মানে কত?
বাইশটা।
নারান মনে মনে অঙ্ক কষে বলল, তার মানে এক টাকায় তিনশো তিরিশটা। তা এক টাকার ঠোঙা বানাতে একজনের কত সময় লাগবে জানো? তিনশো তিরিশটা বানাতেই তো সারাদিন লেগে যাবে।
তোমার মাথা! কাল রাত্তিরে গিয়ে কিছুক্ষণ তো দেখলাম। কাগজ কেটে, আঠা বানিয়ে, তৈরি হয়ে বসে এক ঘণ্টাতেই একজন প্রায় আট-দশ দিস্তে তৈরি করে ফেলল। হাত চলছিল যেন যন্ত্রের মতো?
প্র্যাকটিস করে করে হয়েছে।নারান অনমনস্কের মতো বলল। তার চিন্তা এখন। গোড়ালিটা নিয়ে। কম্পাউন্ডার যা বলল তাতে তো এখন তার ভয় ধরে যাচ্ছে। পা ফেললেই খোঁচা লাগার মতো একটা ব্যথা হচ্ছে।
তা তুমি এবার লাফানোর প্র্যাকটিস করো না! ভালই তো লাফালে। ওই জ্যাটো..কী যেন…পেক না ফেক, ওর মতো সোনার মেডেল পেলে তো কোঠাবাড়ি তোলা যাবে।
কথাগুলো বলেই মহামায়া দুমদুমিয়ে পা ফেলে দুধ দুইতে চলে গেল। ও ফিরে এলে নারান অফিসে যাবে সাড়ে ছটার ট্রেন ধরে। মহামায়া যে কথাটা রাগ করে বলে গেল সেটা কিন্তু নারানের মনের কোণে আটকে রইল। তুমি এবার প্র্যাকটিস করো না?
দিন-রাত মিলিয়ে মাত্র চার ঘণ্টার জন্য বাড়িতে থাকা। রবিবার তার ছুটির দিন। এই দিনটাতেই সে রাত্রে ঘুমোবার সুযোগ পায়। নয়তো যাতায়াতে ট্রেনেই মোট ঘণ্টা দুই-আড়াই শুধু সে ঘুমোয়।
সাড়ে ছটার ট্রেনে, ধান্যকুড়িয়া থেকে উঠেই সে বাঙ্কে শুয়ে পড়ে। শোয়া মাত্রই ঘুম এসে যায়। কিন্তু আজ সে চিত হয়ে শুয়ে জ্যাটোপেকের কথাটা প্রথমে মনে করল। সোনার মেডেল আনার চিন্তা সে কোনওদিনই করবে না। ওসব পনেরো-ষােলো বছর বয়সের ব্যাপার। ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার মতো বোকা সে নয়।
বিভূতি মুখুজ্জের কথা—মূলধনটা সামলে খরচ কোরো—তাকে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে গোড়ালির ব্যথাটার মতো। কিন্তু বিভূতিবাবু ঠিকই তো বলেছেন, শরীরটাকে সে বেশিই খাটাচ্ছে। তবে সংসার চালানো যে কী শক্ত ব্যাপার, এক আনা রোজগার করতে কতটা রক্ত যে জল করতে হয় এটা কি বিভূতিবাবু বোঝেন? মহামায়া বোঝে, এমনকী আট বছরের নয়নও বুঝতে শিখছে। ওরা দুজনও যথাসাধ্য খাটে। ওরা তার কষ্টটা অনুভব করে। নারান ভরসা পায় তার সংসারের মানুষদের কথা ভেবে।
ট্রেনের দুলুনিতে ধীরে ধীরে ঘুম নেমে আসে নারানের চোখে। বড় আরাম লাগছে তার। এই ঘণ্টা দেড়েকের ঘুমটুকুই তার বিলাসিতা। সকালে ট্রেনের ঘুমটা ঠিক এমন জুতসই হয় না। ঘুমের মধ্যেও চিন্তা থাকে, স্টেশন ফেলে যেন চলে না যায়। কিন্তু এখন সে চিন্তাটা নেই। শেয়ালদায় পৌঁছেও ঘুমিয়ে থাকলে কেউ না কেউ তাকে তুলে দেবে।
আজও একজন তাকে ঠেলে তুলে দিল। আরে মশাই, আর কত ঘুমোবেন, শ্যালদা থেকে ট্রেন যে ছাড়ার সময় হয়ে গেল!
ধড়মড়িয়ে উঠে নারান দেখল ট্রেন ভরে গেছে যাত্রীতে। ভিড় ঠেলে সে নামল। প্ল্যাটফর্মের ঘড়িতে দেখল, আটটা কুড়ি। অনেক সময় আছে এখনও। ডিউটি তো নটায় শুরু।
নারান ধীরে ধীরে হাঁটতে পারে না। তাই কুড়ি মিনিটেই অফিসে পৌঁছে গেল। দোতলায় উঠে আসতেই বার্তা বিভাগের বেয়ারা অনিল বলল, নারান তাড়াতাড়ি যা, ফুরিয়ে গেল বোধ হয়।
কী ফুরোবে?
রসগোল্লা! ভারত কুস্তিতে একটা ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছে, রবিবাবু কুড়ি টাকার রসগোল্লা আনিয়ে সারা অফিসকে খাওয়াচ্ছেন। দ্যাখ গিয়ে কিছু আর আছে কি না।
খেলার বিভাগের টেবলের মাঝে দুটো হাঁড়ি বসানোে। রবিবাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে। আর বসে আছেন, অনাদিবাবু, মাল্টাবাবু, শৈলেনবাবু। টোলুবাবুর নাইট ডিউটি, এখনও এসে পৌঁছননি। নারানকে দেখে মান্টাবাবু হাঁড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, দুটো তুলে নে।
নারান ইতস্তত করে বলল, ভারত নাকি কুস্তিতে মেডেল পেয়েছে?
পেয়েছে…কম্পোজেও চলে গেছে। প্রথম পাতায় বেরোবে। মাণ্টাবাবু ঘাড় বেঁকিয়ে কপি অনুবাদ করতে করতে বললেন। সিঙ্গল কলাম ছবিও সঙ্গে যাবে।
নারান তাকাল রবিবাবুর দিকে। টাকে হাত বুলোচ্ছেন, মুখে সাফল্যের চাপা হাসি। যেন ব্রোঞ্জটা উনিই জিতেছেন।
কী বলেছিলুম রে নারান? গরিব দেশের এটাই হল আসল খেলা! ফুটবল, ক্রিকেট তো কত ঝুড়ি ঝুড়ি সম্মান এনে গর্বে বুক ফুলিয়ে দিচ্ছে, আর দ্যাখ গরিবের খেলাই কিনা শেষ পর্যন্ত মেডেল এনে দিল।
সোনারটা যদি হত।
রাখ তোর সোনা। মেডেল ইজ মেডেল। যাদব এখন পৃথিবীতে তিন নম্বর লোক। পৃথিবীর জনসংখ্যা কত জানিস?
না। কত এখন?
রবিবাবু অপ্রতিভ হয়ে মাল্টাবাবুর দিকে তাকালেন, মাণ্টা, এখন কত?
মান্টাবাবু মাথা নাড়লেন। আঙুল দিয়ে অনাদিবাবুকে দেখালেন।
অনাদি, পৃথিবীর জনসংখ্যা কত এখন?
অনাদি মাস দুয়েক আগে চাকরিতে যোগ দিয়েছে। ইংরেজি থেকে বাংলা অভিধান খুলে গাল চুলকোচ্ছিল। প্রশ্ন শুনে বলল, পৃথিবীর জনসংখ্যা?…এখন?…তা ধরুন গিয়ে, আড়াইশো কোটির একটু বেশিই হবে।
বোঝ তা হলে? যাদবের পজিশানটা কী!
রবিদা, আড়াইশো কোটির মধ্যে মেয়েরা আছে, বাচ্চারা আছে, ওরা কুস্তি করে না, ওদের বাদ দেওয়া উচিত।মাণ্টাবাবু কপিতে হেডিংয়ের পাশে কত কলমে আর কত পয়েন্টের টাইপে হবে সেটা লিখে পেপারওয়েট চাপা দিয়ে টেবলে রাখলেন। তা ছাড়া যাদব ব্যান্টমওয়েট, মানে একশো সাড়ে পঁচিশ পাউন্ডের ক্যাটাগরিতে লড়েছে। আপনি শুধু ব্যান্টামদের সংখ্যাটাই ধরে বলুন ওদের মধ্যে তৃতীয়।
রবিবাবু হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে টেবলে কিল মেরে বলে উঠলেন, এই তোমাদের এক দোষ। কলোনিয়াল শ্লেভারির হ্যাংওভারটা এখনও কাটল না। সবসময় নিজেদের ছোট করে দ্যাখো! আড়াইশো কোটিতে তোমার আপত্তি কেন?
না না, আপত্তি করব কেন? মান্টাবাবু কুণ্ঠিত স্বরে কাঁচুমাচু মুখে বললেন। কোটি কোটি লোক কুস্তি করে, তার মধ্যে লক্ষ লক্ষ ব্যান্টাম…।
থামো, বাজে কথা বলো না। কোটি কোটি লোেক কুস্তি করলে পৃথিবীর স্বাস্থ্য অন্য রকম হত। গ্যাসট্রিক, ব্লাডপ্রেসার, হার্টের ব্যামো-ট্যামো বলে কিছু থাকত না।..নারান দুটো তুলে নে।
এখন নয়, রাতে রুটির সঙ্গে খাব।
হাঁড়িতে এখনও কয়েকটা রসগোল্লা ডুবে আছে রসের নীচে। বেশ বড় সাইজই, বোধ হয় দুআনাওলা। টোলুবাবুর জন্য রেখে দিতে হবে। দুটো হাঁড়িতেও রয়েছে প্রচুর রস।
এত রস কী হবে, আমি বাড়ি নিয়ে যাব? নারান কিন্তু কিন্তু করে বলল রবিবাবুকে।
নিয়ে যা। চিনির রস, খাবি আর ডায়াবিটিসের খপ্পরে পড়বি। তবে তোর হবে না। যারা খাটাখাটনি করে না, গাড়ি চড়ে বেড়ায় এ রোগ তাদের হয়। বুঝলি নারান, পরিশ্রম করবি। এই দ্যাখ, যাদবের বিভাগে সোনা জিতেছে যে জাপানিটা, শোহাচি ইশি তার নাম। এ জুডো লড়ত, ..জুডোকা বলে এদের। যুদ্ধে জাপান হেরে গেল। আমেরিকানরা দখল করল দেশটা আর বন্ধ করে দিল জুডো। ইশি তখন জুডো ছেড়ে শুরু করল কুস্তি। ভাবতে পারিস, একটা খেলা থেকে আর একটা খেলায় যাওয়া কি সোজা ব্যাপার? কী পরিশ্রম, কী মনের জোর থাকলে তবেই এভাবে বদল করে যাওয়া সম্ভব। আর শুধুই কি যাওয়া!..রাশিয়া, ইরান, টার্কি, হাঙ্গারি, জার্মানি, এইরকম কুড়িটা দেশের কুড়িজন ওয়ালর্ড ক্লাস কম্পিটিটরের মধ্যে একেবারে সোনা জিতে নেবার মতো যাওয়া! যুদ্ধের পর জাপানের এটাই প্রথম ওলিম্পিক সোনা…কী নিষ্ঠা, কী চেষ্টা…কপিতে অবশ্য আমি এসবও জুড়ে দিয়েছি।
তা হলে যাদবের থার্ড হওয়াটাও খুব বড় ব্যাপার!নারান অন্তরের গভীর থেকে বলল। শিবপোতার জীবন থেকে ধান্যকুড়িয়ার জীবনে আসার মতোই তার মনে হল, ইশির জুডো থেকে কুস্তিতে আসাটা। এক জমি থেকে গাছ তুলে অন্য ধরনের জমিতে পুঁতে ফল ধরানোর জন্য গাছকেও তো কম চেষ্টা করতে হয় না! শরীরে কষ্ট, মনের কষ্ট ইশিকে যে কতটা সইতে হয়েছে মর্মে মর্মে সে তা অনুভব করতে পারছে।
নারান কপি জমে গেছে, প্রেসে দিয়ে এসো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাণ্টাবাবু বললেন। টোলুদা এখনও এলেন না, এ দিকে এত কপি জমি গেছে!…ও অনাদি, একটু হাত চালাও।
নারান এসে প্রেসে কপি দিয়ে ফিরে আসার সময় সুপারভাইজার সরল ঘোষ বললেন, ওপরে যাচ্ছ তো, রিডিংয়ে এই প্রুফটা দিয়ে দিয়ো। আর বলো তাড়াতাড়ি দেখে যেন প্রেসে পাঠিয়ে দেয়।
সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় নারান প্রুফটা একবার চোখের সামনে ধরেই থমকে গেল।
“মল্লবীর কে ডি যাদবের কৃতিত্ব।“
ব্যগ্র দৃষ্টিতে সে বিড় বিড় করে পড়ে গেল খবরটা: “ভারতীয় ব্যান্টমওয়েট মল্লবীর কে ডি যাদব ফ্রিস্টাইল কুস্তি যুদ্ধে তৃতীয় স্থান অধিকার করিয়া বিশ্ব ওলিম্পিকের ব্রোঞ্জ পদক লাভ করিয়াছেন। কে ডি যাদব সর্বপ্রথম ভারতীয় যিনি বিশ্ব অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত হইলেন। যাদব শেষ লড়াইতে পরাজিত হইয়াছেন সত্য, কিন্তু সারা সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন রাউন্ডের লড়াইতে তিনি ত্রুটিহীন মল্লযুদ্ধের অবতারণা করায় পদক লাভ করিয়াছেন।—পি টি আই”
এই নারান, রবিবাবু ডাকছেন তোকে। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে অনিল বলে গেল।
রিডিং বিভাগে প্রফটা দিয়ে সে রবিবাবুর কাছে হাজির হল।
মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল চ্যারিটি ম্যাচটা দেখতে যাবি? আমার কাছে একটা টিকিট আছে। আমি তো সব খেলা দেখি না।
আমি বিকেলে সময় পাব না। নারান লক্ষ করল টোলুবাবু আসছেন। আপনি বরং টোলুবাবুকে দিতে পারেন।
নারানের কথাটা টোলুবাবুর কানে গেল। তিনি হাত নেড়ে বললেন, না না না, টিকিটে আমার দরকার নেই।
মাল্টাবাবু ফোড়ন কাটলেন, রবিদার দেওয়া টিকিট নিয়ে প্রেসের কম্পোজিটার রতন এবারের প্রথম ম্যাচটা দেখেছিল। মোহনবাগান সেজন্যই এক গোলে হেরেছিল। তাই রবিদা ইস্টবেঙ্গলের পয়া লোক। টোলু ও টিকিট নেবে না।
দ্যাখো মণ্টা, তুমি বড় বাজে কথা বলল। রবিদা মোহনবাগানের অপয়া, এমন কথা কোনওদিন আমি বলিনি। গত তিন বছর ইস্টবেঙ্গল শিল্ড ঘরে তুলল, দুবার মোহনবাগানকে হারিয়ে। সে তো, ভাল খেলেছে বলেই! তিনবারই রবিদার কাছ থেকে টিকিট নিয়ে ভাগনেকে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেজন্যই যে ইস্টবেঙ্গল জিতেছে…এমন কুসংস্কার আমার নেই। এবার লিগে পাঁচটা ম্যাচে মোহনবাগান এখন পর্যন্ত হেরেছে, তার মধ্যে লাস্ট ছটা ম্যাচে তিনটেতে। এই ছটা ম্যাচে একটা গোলও করতে পারেনি। ভাবতে পারো মণ্টা?…আরও হারবে, আমি বলছি দেখে নিয়ে ক্যালকাটা গ্যারিসনের কাছেও হারবে, শেষকালে রেলিগেশন ফাইট করতে হবে…তুমি এর পর আর আমাকে বিদ্রুপ কোরো না।
গলা ধরে এল টোলুবাবুর। ঝপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। চোখ ছল ছল করছে। মাল্টাবাবু মুচকি হেসে বললেন, কপি ধরো টোলুদা, অনেক খবর জমে রয়েছে। এই দ্যাখো, ইন্ডিয়ান ওয়াটারপোলো টিম ষােলো-এক গোলে ইতালির কাছে হেরেছে। ধরো, ধরো।
ধরছি। কিন্তু তুমি রবিদা সম্পর্কে আমার যে মিথ্যে ধারণা…রবিদা, রবিদা। দিন আপনার টিকিটটা। আমার যে কুসংস্কার নেই এটা অন্তত প্রমাণ হোক। ওই ভাগনেকেই টিকিটটা দেব।
রবিবাবু মুখ নামিয়ে কপি লিখছিলেন। মুখ না তুলেই পকেট থেকে টিকিট বার করে এগিয়ে দিলেন। টোলুবাবু সেটা একবার দেখে নিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে বললেন, টাকাটা কাল দিয়ে দেব।
তা দিয়ো। কিন্তু আজ বোধহয় হকি ফাইনালের রেজাল্ট আসবে। টেলিপ্রিন্টারের দিকে নজর রেখো।..আর হাঁড়ি থেকে দুটো রসগোল্লা তুলে নাও। যদি বেশি থাকে তা হলে তিনটেও খেতে পারো।
টোলুবাবু নারানের দিকে তাকালেন। নারান বলল, কুস্তিতে ভারত মেডেল জেতার জন্য রসগোল্লা খাওয়াচ্ছেন।
রবিদা, হকি ফাইনাল আজ নয় তরশু, ওইদিন জ্যাটোপেকেরও পাঁচ হাজার মিটার আছে। অনাদি অভিধান সরিয়ে রেখে খবরটা দিয়ে বলল, নারান রসগোল্লা একস্ট্রা থাকলে বোলো।
ফাইনাল আজ হচ্ছে না শুনে টোলুবাবুর মুখে স্বস্তি ফুটে উঠল। রাত্রে প্যাঁচালো ইংরেজি নিয়ে কুস্তি করার ধকল, আজ আর অন্তত নিতে হবে না।
নারান, একটা রসগোল্লাও আর অনাদিকে দেবে না। মাণ্টাবাবু নির্দেশ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। থাকেন ব্যান্ডেল, ট্রেন ধরতে হবে। কালীঘাট-রাজস্থান ম্যাচ লিখতে দশবার অভিধান কেন যে খুলতে হয়, এটা বুঝিয়ে না বললে ওকে আর রসগোল্লা নয়।
বিব্রত এবং লজ্জিত মুখে অনাদি বলল, গ্রাস কাটিং শট-এর বাংলাটা ঠিক মতো করতে পারছিলুম না বলে একটু খুলে দেখছিলুম।
তা ওটার মধ্যে ঘাস টাস কিছু পেলে? রবিবাবু প্রশ্ন করলেন।
না।
তা হলে বইটা মুড়ে রাখো। এটা ইংরেজদের খেলা। তার রিপোর্টে দু-চারটে ইংরিজি থাকলে লোকের বুঝতে অসুবিধে হবে না। গোলপোস্টের কি কোনও বাংলা তুমি করবে? তেমনি ঘাস ছাঁটাই শট লিখলে জিনিসটা হাস্যকর হবে।
নারান, দাঁড়িয়ে শুনছিল। ভাবল, ঘাস নিড়নো শট বললেই তো হয়! কিন্তু সাহস করে সে বলতে পারল না। এখানকার বাবুরা লেখাপড়া জানা লোক, যদি চটে যান?
নারান এবার অনাদিবাবুকে রসগোল্লা, যদি একস্ট্রা থাকে তো দাও। বলতে বলতে মাণ্টাবাবু রওনা দিলেন।
রাত্রে পাতা সাজিয়ে দিয়ে প্রেস থেকে উপরে উঠে এসে টোলুবাবু পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢোকালেন ওষুধের বড়ির জন্য। হাতে উঠে এল চ্যারিটি ম্যাচের টিকিটটা। সেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি এক টানে মাঝখান থেকে ছিঁড়ে ফেললেন। তারপর কুচি কুচি করে টেবলের নীচে ছুড়ে ফেলে পিছন দিকে তাকাতেই দেখলেন নারান ব্যাপারটা অবাক চোখে দেখছে।
ছিঁড়ে ফেলে দিলেন?
দিলুম। রবিদার দেওয়া টিকিট নিয়ে মাঠে যেই যাক, মোহনবাগান হারবেই।…এবার আর কেউ যেতে পারবে না। সে পথ মেরে দিলুম। তিনটে টাকা গচ্চা গেল তো বয়ে গেল! তুই যেন বলে দিসনি। জল দে, ওষুধ খাব।
আপনার রসগোল্লা আগে খেয়ে নিন।
না না, রবিদার দেওয়া কোনও জিনিস শনিবারের আগে নেওয়া যাবে না। আমার ভাগেরটা তুই খেয়ে নে।…ব্যাপারটা কী জানিস, পয়া-অপয়া বলে একটা কথা আছে। খুব খাঁটি কথা। আমি এটা মানি।…জল দে।
নারান জলের গ্লাস এনে দিয়ে বলল, ইন্ডিয়া দশ গোলে হেরেছে, আপনি সেটা কাল নিজের হাতেই লিখেছেন। অথচ আমায় বললেন, কী যে হবে, যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে খেলা! রেজাল্টটা জেনেও কিন্তু আপনি না-জানার ভান করলেন।
আহ নারান, তোকে কী করে যে বোঝাই। টেন টু ওয়ান,…ওয়ানটা হল আমেদের গোল, তার মানে ইস্টবেঙ্গলের গোল, তোর টিমের লোকের দেওয়া গোল!…আমার কী এমন মাথাব্যথা তোকে ওই খেলার রেজাল্ট জানাবার? দশ গোল একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার, ওলিম্পিক রেকর্ডও হতে পারে। কেন জানি মনে হল, মোহনবাগানও যদি গোল খাওয়ার রেকর্ড শনিবার করে ফেলে!…আর এক গ্লাস দে।
নারান জল নিয়ে ফিরতেই টোলুবাবু উৎকণ্ঠিত গলায় বললেন, পায়ে কী হয়েছে? খোঁড়াচ্ছিস কেন?
কাল ছুটতে ছুটতে শেয়ালদা যাবার সময় একটা পেরেক ফুটেছিল। ব্যথা হয়ে এখন টাটাচ্ছে।
গরম জলে কম্প্রেস কর আর বোরিক পাউডার লাগা। অবহেলা করিসনি।
টোলুবাবু শুয়ে পড়লেন। নারান ঘড়ি দেখল। আর দেড় ঘণ্টা পর অফিস থেকে ভ্যান রওনা হবে কাগজ নিয়ে। আটটা রসগোল্লা রয়ে গেছে। হাঁড়ি থেকে তুলে খেতে গিয়ে নয়ন আর মহামায়ার মুখ তার চোখে ভেসে উঠেছিল। নয়ন কোনওদিনই রসগোল্লা খায়নি। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে খাবে ঠিক করে সে আবার রেখে দেয়।
চোখে মুখে জল দিয়ে হাঁড়ি হাতে যখন সে নেমে এল তখন ভ্যানে কাগজ তোলা হচ্ছে। গোবিন্দবাবু তাকে দেখে বললেন, একটু দাঁড়াও, আগে কাগজ তোলা হোক।
নারান অপেক্ষা করতে লাগল। তার জীবনের চব্বিশ ঘণ্টার একটা পরিচ্ছেদ এইভাবেই শেষ হল। এরমধ্যে সে উদ্বেগ, ভয়, খিদে, ক্লান্তি, যন্ত্রণা, রাগ সবকিছুই আস্বাদন করেছে। কিন্তু কোনওটিই তাকে হতাশ করেনি। দমিয়ে দেয়নি। হাঁসের গায়ে লাগা জলের মতো সবই ঝরে গেছে তার মন থেকে, দেহ থেকে। জোলো দুধের থেকে হাঁস যেমন জলটুকু বাদ দিয়ে দুধটুকুই খায়, সেও তেমনই দুঃখ বাদ দিয়ে সুখের কথাটুকুই মনে রাখে। যাদবের কথা, জ্যাটোপেকের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে এখন তার মনে পড়ছে। জাপানি ইশি তাকে বিস্মিত করেছে। টোলুবাবু, রবিবাবুকে তার আরও ভাল লাগছে।
ভ্যানে চড়ে শেয়ালদার দিকে যেতে যেতে খুব যত্নে কোলের উপর রাখা হাঁড়িটা সে মমতা ভরে আঁকড়ে ধরল।
.
০২.
ভারত উপর্যুপরি পঞ্চমবার বিশ্ব হকি চ্যাম্পিয়ান
দীর্ঘ চব্বিশ বছর একাদিক্রমে গৌরব অক্ষুন্ন।
হল্যান্ড ৬১ গোললা শোচনীয়ভাবে পরাজিত
নারান প্রথম পাতায় চার কলাম হেডিংয়ের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হালকা গর্ব ছুঁয়ে যাচ্ছে মনকে। কাগজ উলটে খেলার পাতায় খুঁজল আর একটা খবর।
চেকোশ্লাভাকিয়ার জ্যাটোপেকম্পতির রেকর্ড প্রতিষ্ঠা
সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে নারান হাসল। ওরা তার থেকে মাত্র দুবছরের ছোট কিন্তু একই দিনে তাদের তিনজনের জন্ম! একই দিনে দুজনের দুটো সোনার মেডেল! কী অদ্ভুত ভাগ্য ওদের।
সাইকেলে উঠেই সে কাতর একটা শব্দ করল। পেরেক ফোটা গোড়ালি পেকে পুঁজ জমেছে। টোলুবাবু সেদিন বলেছিলেন বটে গরম জলের সেঁক দিয়ে বোরিক পাউডার দিতে। কিন্তু বোরিক আর কেনা হয়নি। মহামায়া গরম জল দিয়ে ধুয়ে, টিপে টিপে পুঁজ বার করে গাঁদাপাতার রস লাগিয়ে, শাড়ির পাড় বেঁধে দিয়েছে।
চাপ পড়লেই যন্ত্রণা হচ্ছে, তাই পায়ের পুরো পাতা প্যাডেলে রাখতে পারছে না। ওই ভাবেই সাইকেল চালিয়ে কাগজ বিলি করতে করতে সে ঝাউডাঙায় বাদল নস্করের বাড়ি পৌঁছল।
ছেলেটি অপেক্ষা করছে রাস্তায় কাগজের জন্য। সাইকেল থেকে নেমে শেষ কাগজটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে নারান বলল, আজ খুব ভাল খবর আছে।
জানি, ভারত হকিতে সোনা পেয়েছে। কাল রেডিয়োতেই শুনেছি।
নারান একটু অপ্রতিভ হয়ে গেল। খবরটা প্রথম তার কাছ থেকে শুনে, ছেলেটির মুখে ফুটে-ওঠা খুশির আলো সে দেখবে ভেবেছিল। কিন্তু সে দমল না। হকি ছাড়া অন্য খবরও তো আছে।
জ্যাটোপেক আর তার বউ, দুজনেই সোনা জিতেছে!
ছেলেটি হকির খবরের মধ্যে ডুবে গেছে। নারানের কথা তার কানে ঢুকল না।
ভারত হকির সোনার মেডেল জিতবে এটা তো জানা কথাই। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর জেতাটার মতো ঘটনা কটা ঘটেছে?
ছেলেটি মুখ তুলে বলল, কে জ্যাটোপেক?
নারান এবার হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল। ছেলেটা বলে কী!
এই তো চার দিন আগেই কাগজে নাম বেরোল, দশ হাজার মিটারে রেকর্ড করে আবার ওলিম্পিকের মতোই সোনা জিতেছে! তুমি লক্ষ করোনি?
রেকর্ড তো রোজ কতই হচ্ছে, কে মনে করে রাখে।
ছেলেটি বাড়ির ভিতরে চলে গেল। নারান আবার সাইকেলে উঠল। আবার চোদ্দো মাইল চালিয়ে তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। গোড়ালির এই যন্ত্রণাটা…একজোড়া চটি কিনতেই হবে। তিন-চার টাকার ধাক্কা। নারান ঠিক করল, সামনের মাসে মাইনে পেলেই কিনে নেবে।
শনিবার শেয়ালদা স্টেশনে নেমেই নারান কয়েকটি ছেলের কথা থেকে বুঝে গেল ইস্টবেঙ্গল জিতেছে।
কয় গোলে?
এক…ফকরি…।
নারান প্রশ্ন করেনি। অফিসে খেলার বিভাগে থমথমে ভাব। মাণ্টাবাবু একমনে ম্যাচ লিখে যাচ্ছেন। রবিবাবু ওলিম্পিক নিয়ে ব্যস্ত। অনাদি অভিধান আর কপির মধ্যে অবিরত যাতায়াত করছে। রাত নটায় এলেন টোলুবাবু। এসেই বললেন, মাণ্টা, এটা লিখেছ কি সিজনে এটা সিক্সথ ডিফিট, লাস্ট সাতটা খেলায় একটাও গোল করতে পারেনি।
লিখব?
অবশ্যই। আর এটাও লিখো, সামনের বছর সেকেন্ড ডিভিশনে খেলতে হবে।
রবিবাবু মুখ তুলে বললেন, টোলু তোমার ব্লাড প্রেসার আছে, একটু ঠাণ্ডা হও।
আমি মোটেই গরম হইনি। থার্মোমিটার থাকলে দেখিয়ে দিতাম, টোলু কখনও উত্তেজিত হয় না..নারান জল।
নারান দ্রুত জল এনে দিল। এক চুমুকে শেষ করে টোলুবাবু বললেন, রবিদা যদি সন্দেশ খাওয়ান তাও খেয়ে নেব।
নারান, যা তো… পকেটে হাত ঢোকালেন রবিবাবু।
আমায় ভয় দেখাচ্ছেন? টোলুবাবু বেপরোয়া ভাব দেখালেন। আমি সাংবাদিক…নিরপেক্ষ। আমার কোনও পক্ষপাতিত্ব নেই। অ্যাই নারান, আমি সন্দেশ আনাব। আমি সবাইকে খাওয়াব…ইস্টবেঙ্গল জিতেছে, লিগ চ্যাম্পিয়ান হয়েই গেছে ধরে নাও।
টোলু, আমার পেটটা আজ সুবিধের নয়। মান্টাবাবু বললেন। আমি উপোস দিয়েছি।
আমি তো মিষ্টি খাই-ই না। রবিবাবু বললেন।
অনাদি আমতা আমতা করে বলল, টোলুদা, মাঠ থেকে ফেরার সময় আমার শ্যালক এগারোটা রাজভোগ খাইয়েছে, আমি আর… ঢোঁক গিলে কথা শেষ করল, খেলে বমি করে ফেলব।
নারান তুই?…নিশ্চয় তোরও পেট খারাপ।
আজ্ঞে, মাথা চুলকে নারান বলল, আমারই তো খাওয়াবার কথা…তাই, আমি আর কোন মুখে খাব বলুন?
টোলুবাবু গুম হয়ে বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর রবিবাবু বললেন, টোলু, আজ আর তুমি কোনও কপি ধরো না। ভুলটুল হয়ে যেতে পারে।
শোনামাত্র টেবলের উপর হামলে পড়ে, মাল্টাবাবুর সামনে রাখা কপিগুলো টেনে আনতে আনতে টোলুবাবু বললেন, অনেক হয়েছে, এবার বাড়ি যান…দয়া করে।
যাচ্ছি। কাল ম্যারাথন, আমার অফ ডে…জ্যাটোপেক নামবে। যদি জেতে তা হলে একটা হিস্টরিকাল অ্যাচিভমেন্ট হবে।…মোহনবাগানের টানা সাতটা ম্যাচে গোল না করতে পারার মতোই। একটু ভাল করে লিখো। কথাগুলো মান্টাবাবু বলে আর উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করলেন না।
মাঝ রাতে টোলুবাবু যখন প্রেস থেকে উঠে এলেন তখন নারান জিজ্ঞেস করল, রবিবাবুর দেওয়া টিকিটটা ছিঁড়ে ফেলে কিছুই তো হল না।
কে বলল হল না? মাঠে একটা লোক তো কম হল! হাজার পনেরোর বেশি আজ লোক হয়নি।…এ কী তোর পায়ে ছেড়া ন্যাকড়া বাঁধা কেন?
পুঁজ বেরোচ্ছে।
সেপটিক হয়ে গেছে তা হলে। কাল অবশ্যই ডাক্তার দেখাবি।
নারানের মুখ শুকিয়ে গেল। ডাক্তার দেখানো মানে তো চারটে টাকা, তারপর ওষুধের দাম। অন্য কেউ হলে নারান বলত, নিশ্চয় কাল দেখাব। কিন্তু টোলুবাবুকে সে যত দূর বুঝেছে তাতে আসল কথা ওঁকে খুলে বলা যায়। তাই সে বলল, ডাক্তার দেখাবার পয়সা কোথায় যে দেখাব? একজোড়া চটিও আমার কাছে বিলাসিতা।
টোলুবাবু কয়েক সেকেন্ড নারানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে তাঁর চোখ থেকে হতাশা, ক্ষোভ, বিরক্তি সরে গিয়ে ফুটে উঠল মমতা। নরম গলায় বললেন, কাল তো তোর ছুটি, তা হলেও বিকেলবেলা চলে আয়। আমি ক্যাম্বেল হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকব। আমার এক বন্ধুর চেম্বার ওর সামনেই।…না না, পয়সা টয়সার কথা তোকে ভাবতে হবে না।
পরদিন তিনটে পঞ্চাশের ট্রেনে নারান শেয়ালদায় নেমে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাসপাতালের সামনে এসে দেখল টোলুবাবু দাঁড়িয়ে। তাকে দেখেই ঘড়িবাঁধা হাত চোখের সামনে থেকে নামিয়ে একগাল হেসে বললেন, এসেছিস! বাঁচালি।
কী বাঁচালাম?
মনে মনে ধরে নিয়েছিলাম, আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে যদি এসে যাস তা হলে সামনের বছর লিগটা পাব। তুই চার মিনিট আঠাশ সেকেন্ডের মাথায় এসেছিস। চল।
ডাক্তারের ঘরের বাইরে নেমপ্লেটে ডিগ্রির বহর দেখে নারান একটু অস্বস্তিতে পড়ল। এত বড় ডাক্তারের কাছে সামান্য একটা পেরেক-ফোটা দেখাতে আসা, তার মনে হল যেন একশো কাগজের একটা বান্ডিল নিয়ে যাওয়ার জন্য গোটা বনগাঁ লোকাল ভাড়া নেওয়ার মতোই।
সাত-আটজন রোগী অপেক্ষা করছে। তাকে বসিয়ে রেখে টোলুদা ডাক্তারের ঘরে ঢুকে গেলেন। মিনিট-তিনেক পর বেরিয়ে এসে বললেন, আয়।
ডাক্তার টোলুবাবুর বয়সিই। গৌরবর্ণ, সৌম্যকান্তি, লম্বা চওড়া। কাগজে কিছু লিখছেন, পাশে কম্পাউন্ডার দাঁড়িয়ে।
হাঁদু, এই হচ্ছে আমার কলিগ নারান হালদার। চট করে ওর গোড়ালিটা একটু দেখে দে।
ডাক্তার দু-তিনটে প্রশ্ন করলেন, গোড়ালির ক্ষতটা ভ্রূ কুঁচকে কুড়ি-পঁচিশ সেকেন্ড দেখলেন। একটা স্লিপে ঘস ঘস করে লিখে সেটা নারানের হাতে দিয়ে বললেন, ইঞ্জেকশনটা আনুন, এক্ষুনি দিতে হবে। তারপর কম্পাউন্ডারকে বললেন, ইঞ্জেকশনটা দিয়ে, ড্রেস করে দাও।
সিরিয়াস কিছু কি? টোলুবাবু উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন। ডাক্তারবাবু উত্তর না দিয়ে তাঁর নাম ছাপা প্যাডে লিখতে শুরু করলেন।
নাম? বয়স?
নারান বলল।
আর একদিন দেরি করলে, ব্যাপারটা সিরিয়াসই হয়ে পড়ত। খাবার জন্য আর লাগাবার জন্য ওষুধ দিচ্ছি।
টোলুবাবু নারানের হাত থেকে স্লিপটা প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে বললেন, আমি কিনে আনছি।
কম্পাউন্ডার বলল, আপনি পাশের ঘরে আসুন।
মিনিট কুড়ি পর ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল ওরা। নারান গোড়ালি তুলে হাঁটছে। ইঞ্জেকশন কেনার টাকা আর কম্পাউন্ডারের ফি টোলুবাবুই দিয়েছেন, তাই সে কৃতজ্ঞতার ভারে বিব্রত।
ওভাবে হাঁটছিস কেন, পায়ের পাতা ফেলে হাঁট।
একটু লাগছে…ব্যান্ডেজটাও নোংরা হবে না।
দাঁড়া এখানে।
টোলুবাবু ওষুধের দোকানটায় ঢুকে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন হাতে ওষুধ, ব্যান্ডেজ আর তুলো নিয়ে।
ধর এগুলো। ডাক্তারবাবু যেভাবে খেতে, লাগাতে বলে দিলেন, ঠিক ঠিক সেগুলো করবি।
নারান শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
দাঁড়িয়ে রইলি কেন, ট্রেন ধরবি তো?
ওরা আবার হাঁটতে শুরু করল। বউবাজার স্ট্রিট যেখানে শেয়ালদায় পড়েছে সেখানে পৌঁছে টোলুবাবু বললেন, বাঁ দিকে চল, দরকার আছে।
কোলেবাজারের পরই একটা জুতোর দোকান। নারানকে ইশারায় দোকানে ঢুকতে বলে টোলুবাবু ভিতরে ঢুকে গেলেন।
কেডস দিন তো, আমার নয় ওর পায়ের। নতুন সাদা কেডস পায়ে নারান যখন দোকান থেকে বেরিয়ে এল তখন তার আর গুছিয়ে কথা বলার মতো অবস্থা নয়। টোলুবাবুর দুটো হাত ধরে সে কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলে ফেলল, আমি মন থেকে বলছি মোহনবাগান সামনের বছর লিগ পাবে, আপনি দেখবেন আমার কথা মিথ্যে হবে না।
আরে পাগল ছাড় ওসব কথা, এখন পায়ের কথা ভাব। এই দুটো পায়ের ওপর ভর দিয়ে তুই দাঁড়িয়ে তোর সংসার, বউ-মেয়ে দাঁড়িয়ে। এখন কি লিগ-শিল্ডের মতো সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানো যায়?…তুই এত পরিশ্রমী, তোকে দেখেও যে আনন্দ হয়!..এখন আমি লিগ জেতার মতোই সুখ পাচ্ছি রে। এবার যা, টুক টুক। করে হেঁটে স্টেশনে চলে যা।
বিভ্রান্ত নারানকে দাঁড় করিয়ে রেখে টোলুবাবু চলে গেলেন। ট্রেনে কয়েকবাব সে ভাবল, পরিশ্রম কী এমন জিনিস যে দেখে আনন্দ হয়? তার মাথায় ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছে না। তবে মহামায়াকে সে সবসময় সংসারের কাজ করতে দেখে, দেখে কেমন যেন এক ধরনের তৃপ্তি সে পায়। টোলুবাবু কি এটার কথাই বললেন? নিজেকে অপচয় না করে ব্যবহার করা এটা তো একটা গুণই! সবারই ইচ্ছে হয় নিজের গুণপনা দেখাতে। নারানের মনে হল, সে যা করে সেটা লোককে দেখাবার মতো কিছু নয়। এমন কিছু একটা করা দরকার যা দেখে সবাই বলবে—হ্যাঁ নারান হালদার একটা লোক বটে!
কিন্তু তার মতো গরিব মানুষ কী আর করে দেখাতে পারে? নারান নিজেকে প্রশ্নটা করে কোনও উত্তর পেল না।
পরদিন সকালে সে ধান্যকুড়িয়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া কাগজের বান্ডিলটা নিল। কৌতূহল ভরে খেলার পাতাটা খুলে তিন কলাম হেডিংয়ের দিকে তাকিয়েই তার হৃৎপিণ্ড মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
এমিল জ্যাটোপেকের ওলিম্পিক ইতিহাস নতুন অধ্যায় রচনা ৫০০০ মিটার, ১০,০০০ মিটার ও ম্যারাথন দৌড়ে বিজয়ীর সম্মান লাভ
তার হাতের কাগজটা থরথর কেঁপে উঠল। গোগ্রাসে খবরের বাকিটা তার চোখ গিলতে শুরু করল। একবার, দুবার, তিনবার সে পড়ল। তারপর সে কাগজের বান্ডিল নিয়ে হরিহর ভট্টাচার্যের দোকানের দিকে ব্যস্ত পায়ে এগোল। পায়ের ব্যথাটা এখন সে একদম টেরই পাচ্ছে না।
ম্যারাথন যে ছাব্বিশ মাইল তিনশো পঁচাশি গজ এটা সে জানে। মাণ্টাবাবুই তাকে বলেছিলেন। সে রোজ সাইকেল চালায় আটাশ মাইল। থেমে থেমে, কিন্তু নাইট ডিউটি দিয়ে রাত জাগার পর, খালি পেটে। তা হলেও, নারানের মনে হল, কষ্টটা যে কী ধরনের সেটা সে বোঝে, তবে দুজনের পরিশ্রমের মধ্যে তুলনা করাটা ঠিক হবে না।
বত্রিশটা দেশের ছেষট্টি জন দৌড়েছে। সোজা কথা! এতগুলো লোকের সঙ্গে লড়ে প্রথম হওয়ার জন্য জ্যাটোপেকের একটা লক্ষ্য ছিল। তার কী লক্ষ্য? সাইকেলে প্যাডেল করতে করতে নারান দু-তিনবার ভাবল বড় কোনও লক্ষ্য নিয়ে কি সে সাইকেলটা চালাচ্ছে? কাগজ বিলি করাটাকে বড় ধরনের একটা লক্ষ্য হিসাবে কি ধরা যায়?
সাত দিনের মধ্যে তিনটে দূরপাল্লার কম্পিটিশন জেতা, তিনটেতেই ওলিম্পিক রেকর্ড করে! নারানের মনে হল, লোকটা অসুর। একাজ করাটা কোনও দেবতার কর্ম নয়। ভবিষ্যতে আর কেউ সাত দিনের মধ্যে এই তিনটে সোনা জিততে যে পারবে না, নারান এটা সম্পর্কে নিশ্চিত। মানুষের শরীরের ক্ষমতার সীমা যে কত দূর পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, তার তো কোনও ঠিক-ঠিকানাই আর রইল না! তবুও তার মনে হচ্ছে, জ্যাটোপেক যে সীমায় নিজেকে টেনে নিয়ে গেছে, সেটাই বোধ হয় শেষ সীমা। লোকটা ম্যারাথন দৌড়ল কিনা এই প্রথমবার! কেউ বিশ্বাস করবে? নারান অবাক হয়ে থেকেই রঘুরামপুর, তুবুড়িয়া হয়ে ঝাউডাঙায় পৌঁছল।
ছেলেটা প্রতিদিনের মতোই রাস্তায় অপেক্ষা করছে।
কে জ্যাটোপেক বলেছিলে না?…রোজই তো কত রেকর্ড হচ্ছে?..দ্যাখো, পড়ো!
ছেলেটির হাতে কাগজটা দিয়ে নারান দাঁড়িয়ে রইল। লক্ষ করতে লাগল ওর মুখভাব। মনে কোনওরকম দাগ কাটছে কি না সে বুঝতে পারছে না।
এসব রেকর্ড ভেঙে যাবে। ছেলেটি সাদামাটা স্বরে বলল।
ভাঙবেই তো। ভাঙার জন্যই তো রেকর্ড! কিন্তু সাত দিনের মধ্যে এই রকম তিনটে কম্পিটিশন জেতা?…এ রেকর্ড কি ভাঙতে পারবে কেউ?
ছেলেটির উত্তর শোনার জন্য সে আর অপেক্ষা করল না। বাড়িতে ফিরে প্রতিদিনের কাজ, ঘাস কাটা, গোরুদের খেতে দেওয়া ইত্যাদি সেরে সে ভাত খেতে বসল। ল্যাঠা মাছের ঝোল পাতে পড়তেই সে অবাক হয়ে মহামায়ার দিকে তাকাল।
নয়ন সাঁতরাদের পুকুর থেকে ধরেছে। মহামায়ার স্বরে চাপা গর্ব।
নয়ন! ওইটুকু মেয়ে ধরতে পারল?
ওইটুকু কী? এই শ্রাবণেই তো সাত পেরোল। টিউকল থেকে কত কলসি জল আনে জানো? উঠোনের ওদিকে জঙ্গলটা তো ওই পরিষ্কার করেছে।
শুনে ভাল লাগল নারানের। মেয়েটা কাজের হয়েছে। নামতাটা চটপট মুখস্থ করতে পারে। হাতের লেখাটা খুব পরিষ্কার নয়, তবে হয়ে যাবে।
গরমেন নাকি রেশন দোকান থেকে পনেরো টাকা মণে চাল দেবে? মহামায়া জিজ্ঞেস করল।
অফিসে তাই তো শুনলাম, কিন্তু এই গ্রামে রেশন দোকান কোথায় যে চাল দেবে?
দোকান হলে বাঁচা যায়, চালের যা দাম বাড়ছে দিন দিন।
বাড়বে, আরও বাড়বে। লোক বাড়ছে আর চালের দাম বাড়াবে না? শেয়ালদা স্টেশনের অবস্থাটা যদি দেখতে। রোজ রিফিউজি আসছে। প্ল্যাটফর্মে, স্টেশনের ভিতরে, বাইরে আর হাঁটা যায় না। কী দুর্গন্ধ! দুহাজার, আড়াই হাজার লোক। আমরা তো সেই তুলনায় স্বর্গে বাস করছি।
খাওয়ার পর সে চাটাইয়ে শরীর এলিয়ে দিল। তারপরই কথাটা হঠাৎ মনে পড়ায় মুখটা পাশে ফিরিয়ে বলল, তোমায় সেদিন লোকটার কথা যে বললাম না, সেই জ্যাটোপেক গো!
মহামায়া খেতে বসছে। ভাতের গ্রাস মুখে ঢুকিয়ে বলল, হু, ওর বউ বর্শা ছোড়ে।
জ্যাটোপেক ম্যারাথনেও জিতেছে। নারান কনুইয়ে ভর রেখে শরীরটা তুলল।
অ।…গরম জলে পা ধোবে কখন, বেরোবার আগে?…জিতেছে তো কী হয়েছে…রাতে খাবার ওষুধটা রুটির সঙ্গেই রেখে দোব না পকেটে আলাদা নেবে?
জবাব না দিয়ে নারান শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে অপেক্ষা করতে লাগল অ্যালার্ম। কখন বাজবে।
.
০৩.
নারানের দিন কাটতে লাগল একই ভাবে। অফিসে নাইট ডিউটি দিয়েই চলেছে। সকালেও কাগজ বিলি করে বাড়ি ফেরে আঠাশ মাইল সাইকেল চালিয়ে। এই কাজে তার ছুটি নেই। হরিহর ভট্টাচার্য তার মানে তিরিশ টাকা থেকে পরের বছরই ষাট টাকা করে দিয়েছে। দুটো গোরু মরে গেছে। সে আর নতুন গোরু কেনেনি। দুধের ব্যবসা আর করবে না, এতে লোকসানই হচ্ছে। নতুন একটা ঘর তোলার জন্য মাটি কোপানো হচ্ছে। আর তাদের একটি ছেলে হয়েছে। এখন তার বয়স তিন। নাম রেখেছে অবনী। মহামায়া আবার সন্তানসম্ভবা।
টোলুবাবুকে নারান বলেছিল, সামনের বছর মোহনবাগান লিগ পাবে। কিন্তু পায়নি। তিপান্ন সালে লিগ পরিত্যক্ত হয়। তারপরের বছর লিগ-গোল্ড জিতে মোহনবাগান প্রথম ডাবল লাভ করে। নারান গভীর শান্তি পেয়েছিল।
হেলসিঙ্কি অলিম্পিকসের পর ইতিমধ্যে প্রায় চার বছর কেটে গেছে। ১৯৫৬, জানুয়ারির মাঝমাঝি, খেলার বিভাগে রবিবাবু, মাল্টাবাবুর মধ্যে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ তার কানে এল জ্যাটাপেক নামটা। টেলিপ্রিন্টার রোল থেকে ছিঁড়ে রাখা খেলার খবরগুলো চিফ সাব-এডিটরের টেবলে আলাদা একটা স্পাইকে গাঁথা থাকে। স্পাইক থেকে কপিগুলো তুলে নিয়ে সে খেলার টেবলে এনে রাখল।
অ্যালেনবরা কোর্সে দৌড়বে কি না বলতে পারব না, তবে মোহনবাগান স্পোর্টসে যে নামবে, এটা পাক্কা।
মান্টা খোঁজ নাও তা হলে! আর কোথাও দৌড়বে কি না, সেটা তো পাবলিককে জানানো উচিত! খবরের জন্য একটু হাঁটাহাটি করো।
নারান আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, রবিবাবু, কে দৌড়বে?
জ্যাটোপেক।…এমিল জ্যাটোপেক। সেই যে হেলসিঙ্কি ওলিম্পিকে।..
তা জানি, কিন্তু কলকাতায়? নারান অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
হ্যাঁ কলকাতায়, মাণ্টাবাবু গম্ভীর হয়ে গেলেন। কেন কলকাতা কি দৌড়বার মতো একটা জায়গা নয়?
তা নয়, তবে কিনা অতবড় একটা মানুষ,..কার সঙ্গে দৌড়বে?
হাতি, ঘোড়া, উটের সঙ্গে…আবার কার সঙ্গে! বিরক্ত মাণ্টাবাবু কপি টেনে নিলেন। হাঁটাহাটি করতে বলায় উনি চটেছে।
হেলথ মিনিস্টার রাজকুমারী অমৃত কাউর খেলাধুলোর উন্নতির জন্য যে স্কিম করেছেন, তাতে পৃথিবীর নামী নামী অ্যাথলিটদের আনা হবে। ভারতের নানান জায়গায় গিয়ে তারা, দৌড় দেখাবে, বক্তৃতা দেবে, ট্রেনিং দেবে। জাটোপেক এসেছে সেইজন্যই। ওর বউও এসেছে। রবিবাবু অল্পকথায় নারানকে বুঝিয়ে দিলেন।
আমি ওকে দেখব। তার মুখ থেকে প্রথমেই এই কথাটা বেরিয়ে এল। তারপর বলল, কবে, কোথায় দৌড়বে আমাকে একদিন আগে বলে দেবেন? আমাকে বাড়ি থেকে আসতে হবে তো, সেইমতো ট্রেনে উঠব। আমাদের সিঙ্গেল লাইন, ট্রেন বড় লেট করে। কখন দৌড়বে জানা থাকলে সুবিধে হয়।
বলে দেব। তা ছাড়া কাগজেও তো খবর থাকবে।
শনিবার ২১ জানুয়ারি সারা পশ্চিম বাংলায় হরতাল ডাকা হয়েছে। ভাষার ভিত্তিতে সীমানা পুনর্গঠনের দাবি উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকার সেই দাবি মানছে না। তাই ভোর ছটা থেকে বিকলে চারটে পর্যন্ত হরতাল। নারানের ভয় হল। ওইদিনই তো জব্বলপুর থেকে ট্রেনে জ্যাটোপেকদের কলকাতায় আসার কথা!
অনাদিবাবু, ট্রেন তো বন্ধ থাকবে, তা হলে ওরা তো পথেই আটকে থাকবে!
শনিবার সেইজন্যই ওরা কলকাতায় আসছে না, রবিবার আসবে। এই তো মাল্টাদা খবর লিখে রেখে গেছেন। কপিটা প্রেসে দিয়ে এসো।
প্রেসে দিতে যাবার সময় নারান সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে লেখাটা পড়ে নিল। মোহনবাগান স্পোর্টসের খবরের মাঝখানে রয়েছে: আগামী ২৩ জানুয়ারি দ্বিতীয় ও শেষ দিবসে বিশ্ববিখ্যাত দূরপাল্লার দৌড়বীর এমিল জ্যাটোপেক ও মহিলা স্পোর্টসে ডানা জ্যাটোপেক অংশ গ্রহণ করিবেন।
২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিন। নারান ক্যালেন্ডারে দেখল দিনটা সোমবার। শনিবার হরতালের দিন কাগজ ছেপে বেরোবে বটে, কিন্তু ট্রেন বন্ধ থাকায় সে কাগজ নিয়ে যেতে পারবে না। কাগজের ভ্যান দমদম পর্যন্ত যাবে। কিন্তু তাতে তার কোনও সুবিধে নেই। ওখান থেকে ধান্যকুড়িয়া ৩০ মাইল। শুক্রবার রাতে ডিউটি করে অফিসেই থেকে গিয়ে একদম শনিবার রাতের ডিউটি সেরে সে বাড়ি ফিরবে।
সোমবার বিকেল চারটেয়, তাই তো? এই নিয়ে নারান শনিবার অন্তত চারবার জিজ্ঞেস করল, অনাদি আর টোলুবাবুকে।
হ্যাঁ, বাবা হ্যাঁ, চারটেয় মোহনবাগান মাঠে। মাঠটা চিনিস তো? টোলুবাবু পিটপিট করে তাকালেন।
তা চিনি, একবার ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে গেছলাম। দুজনের একই মাঠ তো?
হুঁ। টোলুবাবু বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন, জ্যাটোপেক মোহনবাগান মাঠে দৌড়বে।
সোমবার সকালে কাগজ বিলি করে নারান, অন্যদিনের থেকে আজ বেশি ব্যস্ত হয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। ধান্যকুড়িয়া থেকে যখন মাইল চারেক দূরে তখন একটা গোরুর গাড়িকে পাশ কাটিয়ে এগোতে গিয়ে সাইকেলের চাকা গর্তে পড়ে গেল। সাইকেলটা টালমাটাল হয়ে গোরুর গাড়িতে ধাক্কা মারল, আর নারান ছিটকে রাস্তার ধারে পড়ল। চটপট সে উঠে দাঁড়াল আর শিউরে উঠে দেখল, সাইকেলের পিছনের চাকার উপর গোরুর গাড়ির চাকা উঠে গেছে।
নারান চোখ বুজল। একটা চল্লিশের ট্রেন ধরে শেয়ালদায়, তারপর মোহনবাগান। মাঠে যাওয়া। এটাই সে ঠিক করে রেখেছে। সব ভেস্তে গেল! এই দুর্ঘটনার জন্য গোরুর গাড়ির কোনও দোষ নেই। গর্তটা গাড়োয়ান তৈরি করে রাখেনি যে ঝগড়া করবে।
সাইকেলের চাকার যা অবস্থা, তাতে তো আর চালাতে পারবেন না! যাবেন। কোথায়? মাঝবয়সী গাড়োয়ান সহানুভূতি ভরে জানতে চাইল।
ধান্যকুড়িয়া…তুমি যাবে কোথায়?
জবরগঞ্জ। ধান্যকুড়িয়া পথেই পড়বে, উঠে পড়েন।
সাইকেলের চাকা আর মাডগার্ড দুমড়ে গেছে। কয়েকটা স্পোক ভেঙেছে। সেটাকে গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে দিয়ে নারানও উঠে বসল। গাড়িতে আটটা চালের বস্তা।
আমার কিন্তু কোনও দোষ নেই। আপনিই পড়লেন চাকার সামনে।
আরে আমি কি বলেছি তুমি দোষী? বরাতে ছিল তাই ঘটে গেল।…একটু জোরে চালাও, ট্রেন ধরতে হবে।
রুণ দুটো বলদ, পাচনের বাড়ি খেয়ে আর গাড়োয়ানের গালি শুনে দৌড়বার চেষ্টা করল। আধমাইল দৌড় দিয়েই হাঁফিয়ে আবার মন্থর হয়ে গেল, গাড়োয়ান আবার নির্দয়ভাবে পাচনটা দিয়ে এমন পেটাতে শুরু করল যে দেখে নারানের মায়া হল।
থাক আর মেরো না। তুমি হরিহর ভটচাযের বইয়ের দোকান চেনো?
না।
যাকে বলবে দেখিয়ে দেবে। সেখানে এই সাইকেলটা নামিয়ে দিয়ে। বোলো নারান হালদার এটা পাঠিয়ে দিয়েছে, আজই যেন সারিয়ে রাখা হয়। কী করে এমনটা হল সেটা তুমিই বলে দিয়ো…গাড়ি এভাবে চললে ট্রেনটা পাব না। আমি এই মাঠের মধ্য দিয়ে হিজলতলা হয়ে শটকাটে স্টেশনে যাব।
চলন্ত গোরুর গাড়ি থেকে নারান লাফ দিয়ে রাস্তায়, তারপর রাস্তা থেকে মাঠে নামল।
যা বললাম পারবে তো? ছুটতে শুরু করে নারান চেঁচিয়ে বলল, হরিহর ভটচাজের দোকান…সারিয়ে রাখতে বলো…আমার নাম নারান।
এর পরই তার মনপ্রাণ নিবদ্ধ হল একটা চল্লিশের ট্রেনে। এখন কটা বাজে? ঠিক সময়ে স্টেশনে সে পৌঁছতে পারবে তো! একটা, না পৌনে একটা? এখান থেকে কতক্ষণ লাগবে স্টেশনে পৌঁছতে? সময় সম্পর্কে কোনও ধারণা করতে না পেরে নারান, নিরাপদ হবার জন্য সেরা পন্থাটিই বেছে নিল। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল।
মসৃণ ঘাসের ট্র্যাকে জ্যাটোপেকের পাঁচ হাজার মিটার দৌড় দেখার জন্য নারান আলের উপর দিয়ে, চষা জমি মাড়িয়ে, ভাঙাচোরা রাস্তায় ঠোক্কর খেয়ে প্রায় হাজার মিটার পথ অতিক্রম করে যখন স্টেশনে পৌঁছল শেয়ালদা লোকালের গার্ড তখন। হুইসল বাজিয়ে সবুজ পতাকা নাড়ছে।
ট্রেনে উঠে নারান বিজয়ীর মতো হাসল বেঞ্চে বসে থাকা একটি বাচ্চা ছেলের দিকে তাকিয়ে। ছেলেটিও হাসল কিছু না বুঝেই। পাশের লোকের হাতে ঘড়ি দেখে নারান জানতে চাইল, কটা বাজে?
পৌনে দুটো।
ট্রেন পাঁচ মিনিট লেট!
মনে মনে সে হিসেব করতে শুরু করল, তিনটে পনেরোয় যদি শেয়ালদা পৌঁছয় তা হলে ট্রামে উঠে ধর্মতলা যেতে দশ মিনিট। আচ্ছা ধরা যাক, বারো মিনিট। তা হলে তিনটে সাতাশ…ধরা যাক, সাড়ে তিনটে! ওখান থেকে হেঁটে মাঠে পৌঁছতে পনেরো মিনিট..ধরা যাক বিশ মিনিটই। তা হলেও হাতে থাকবে দশ মিনিট।
নিশ্চিন্ত হয়ে নারান পিছনের কাঠের দেয়ালে হেলান দিল। এতক্ষণ যে উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা তাকে টানটান করে রেখেছিল সেটা ঝপ করে আলগা হয়ে গেল। সে ক্লান্ত বোধ করতে লাগল। এইবার সে বুঝতে পারল তার খিদে পেয়েছে। পেটটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠছে, আর সেই সঙ্গে বমির ইচ্ছে গলার দিকে উঠে আসছে।
সে ঢোঁক গিলল। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঠোঁট চাটল। একদম শুকনো। জলতেষ্টা পাচ্ছে। কিন্তু ট্রেনে জল কোথায়? লোকাল ট্রেনে এসব থাকে না। কারও কাছে কি একটু জল পাওয়া যাবে? সে এধার-ওধার তাকাল। দূরপাল্লার ট্রেনে যাত্রীরা জল নিয়ে ওঠে, লোকালে কে জল বয়ে নিয়ে যাবে।
এখন তার মনে হচ্ছে, বোধ হয় সে মরে যাবে। চোখের উপর ভেসে উঠল মোহনবাগান মাঠ। গ্যালারি উপচে পড়া ভিড়। জ্যাটোপেক… জ্যাটোপেক…জ্যাটোপেক চিকার গ্যালারি থেকে গড়িয়ে নামছে। আর জ্যাটোপেক দৌড়ে চলেছে, হাত তুলে মাঝে মাঝে দর্শকদের উদ্দেশে নাড়ছে।…মরে গেলে সে আর ওকে দেখতে পাবে না।
নারানের চোখে জল এসে গেল। আর তখনই কর্কশ শব্দ করে ট্রেনটা, দু-তিনটে ঝাঁকুনি দিল।
কী ব্যাপার? সামনের লোকটিকে সে প্রশ্ন করল ভীত চোখে তাকিয়ে।
কী জানি! এর আগেও একবার ওরকম করেছিল।
লোকটার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গেই ট্রেনও দাঁড়িয়ে পড়ল। সবাই কারণ জানার জন্য জানলা আর দরজা থেকে মুখ বাড়াল। হঠাৎ মাঝপথে থেমে যাওয়ায় কেউ কেউ ভয় পেল। ডাকাত পড়বে না তো?
দিনের বেলায় ডাকাত কোথায়? একজন বলল। দেখুন এঞ্জিনের হয়তো কয়লা ফুরিয়ে গেছে!
অনেকে ট্রেন থেকে নেমে কারণ জানতে গেল ড্রাইভারের কাছে। নানান পাশের লোকের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, সাত মিনিট গেল।
হাতুড়ি মারার শব্দ হচ্ছে। বাইরে থেকে একটা গলা ভেসে এল, ব্রেক আটকে গেছে। হাতুড়ি মেরে খোলার চেষ্টা করছে।
এত দিন ধরে সে ট্রেনে যাতায়াত করছে, এক দিনও ব্রেক আটকাবার ঘটনা ঘটেনি। আর ঠিক আজকেই! নারান ঘড়ির দিকে তাকাল। এগারো মিনিট নষ্ট হল এখানে দাঁড়িয়ে, সে চোখ বন্ধ করল। খিদে আর তেষ্টা ধীরে ধীরে মরে আসছে। শরীরটা অসাড় লাগছে।
ট্রেনের সিটি দেবার শব্দে সে চোখ খুলল। যারা ট্রেন থেকে নেমেছিল, তাড়াহুড়ো করে তারা উঠছে। একটু পরেই ট্রেন চলতে শুরু করল। মন্থর গতিতে, এমন সাবধানে চলেছে যেন সামনেই কোথাও লাইনের ফিশপ্লেট খোলা রয়েছে। এভাবে চললে কতক্ষণে শেয়ালদায় পৌঁছবে? কতক্ষণে সে মাঠের গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে চিৎকার করবে—জ্যাটোপেক…জ্যাটোপেক…।
শেয়ালদা পর্যন্ত ট্রেনটা টিকিয়ে টিকিয়ে এল। নারান প্ল্যাটফর্মের ঘড়িতে দেখল, পৌনে চারটে। আর পনেরো মিনিট পর শুরু হবে দৌড়। ভিড় ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে লোক সরিয়ে সে ছুটল ট্রাম স্টপের দিকে।
নেতাজির জন্মদিন। রাস্তায় আজ তোক বেশি। জাতীয় পতাকা, নেতাজির ছবি আর ব্যান্ড বাজিয়ে শোভাযাত্রা বেরিয়েছে, গন্তব্য বোধ হয় শ্রদ্ধানন্দ পার্ক। দু দিকেই সার সার সবুজ রঙের ট্রাম দাঁড়িয়ে পড়েছে, সেই সঙ্গে বাসও। ট্রামে বসে নারান স্টেশনের মাথায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের কিল বসিয়ে হতাশ স্বরে নিজেকেই বলল, ভাগ্য!…কেন যে ভূতে তাড়া করল!
থেমে থেমে ট্রাম মৌলালি পৌঁছল, ধর্মতলা স্ট্রিট দিয়ে যদিও বা জোরে চলল, আবার আটকে গেল ওয়েলিংটন পার্কের মোড়ে। সভা হবে, তাই শোভাযাত্রা আসছে। হঠাৎ নারানের রোখ চেপে গেল! জ্যাটোপেকের দৌড় সে দেখবেই। এখান থেকে মোহনবাগান মাঠটা কতদূরই বা, সে ছুটেই যাবে।
ট্রাম থেকে নেমে সে ভিড়ের মধ্যে কখনও হনহনিয়ে হেঁটে, কখনও রাস্তায় নেমে দৌড়ে ছুটে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে থমকে দোকানের ঘড়িতে সময় দেখে নিচ্ছে।
…চারটে…চারটে তিন…চারটে সাত…চারটে দশ। এসপ্লানেড, কার্জন পার্ক, তারপর ভবানীপুর মাঠ। নারানের ফুসফুস আর বাতাস টানতে পারছে না। রেড রোড পার হয়ে মহামেডান তাঁবুর কাছে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁ করে শ্বাস নিতে নিতে চোখে অন্ধকার দেখল। শরীর টলছে। সেই সময় সে শুনল প্রবল এক সমবেত হর্ষধ্বনি আর হাততালি।
নারান ধীরে ধীরে বসে পড়ল, নিশ্চয় দৌড় শেষ হয়ে গেল। দেখা হল না…দেখা হল না…। মাথা নাড়তে নাড়তে সে ঘাসে শুয়ে পড়ল।
বিশ্ববিখ্যাত অ্যাথলিট, ওলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন এমিল জ্যাটোপেক, আপনারা দেখলেন, তিনি প্রথম হলেন। তাঁর সময় হয়েছে পনেরো মিনিট আঠারো সেকেন্ড। দ্বিতীয় হয়েছেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সুনীল বসু। তাঁর সময় হয়েছে: সতেরো মিনিট সতেরো দশমিক… লাউডস্পিকারে ভেসে আসছে ঘোষকের গলা। নারানের চোখের পাতা বুজে এল।
তার চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে নামল।