মহাদেবপুর উপনগরীতে
০১.
কলকাতা থেকে আটাশ মাইল উত্তরে গঙ্গার পশ্চিম তীরে, লঞ্চঘাট থেকে আধমাইল, জি টি রোড থেকে সিকি মাইল আর রেল স্টেশন থেকে এক মাইল দূরের মহাদেবপুর উপনগরীতে প্রায় চার হাজার লোকের বাস। মহাদেবপুর গড়েছে মহাদেব জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল মিক্স, সংক্ষেপে যাকে বলা হয় এম জে টি এম, তারই প্রতিষ্ঠাতা-মালিক মহাদেবদাস মাধোকিয়া। এই উপনগরীতে আছে দুটো বাজার, ছোট একটা হাসপাতাল, স্কুল, মন্দির, অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরি, পাওয়ার হাউস, খেলার মাঠ, ছোটদের পার্ক, অফিসারদের ক্লাব—যেখানে আছে এক বিঘৎ ঘাস গজিয়ে যাওয়া একটা টেনিস কোর্ট, আর দুটি ক্যারম খেলার বোর্ড। মহাদেবপুর মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানকার অনেক লোকেরই মোটরগাড়ি আছে, দরকার হলে চট করে কলকাতা ঘুরে আসতে পারে।
মহাদেবপুরের পৌরব্যবস্থা এম জে টি এম-এর নিজস্ব। তাদেরই খরচে এবং তদারকিতে এর দেখভাল করা হয়। এজন্য আলাদা একটা বিভাগ আছে এবং তার সর্বোচ্চ কতা হলেন তন্ময় বসুমল্লিক। ইনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, বলিষ্ঠ, দীর্ঘদেহী, চোখা নাক মুখ। দূরপাল্লার সাঁতারে নাম ছিল এবং অর্থনীতির এম এ। কলকাতা পৌরসভায় বছর চারেক চাকরি করে ভারত স্বাধীন হওয়ার দুবছর পরই মহাদেবপুরে আসেন।
তন্ময় যেমন হাসিখুশি, সরল, তেমনই গোঁয়ার প্রকৃতিরও। সাবেকি রীতিনীতি মেনে চলতে অভ্যস্ত এমন পরিবারে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা; তিনি উদার মনের মানুষ, বড় চাকরি করলেও মেলামেশায় কোনও বাছবিচার করেন না। তাঁর স্ত্রী তপতী ইলাহাবাদের মেয়ে। বাবা সেখানকার নামী উকিল ছিলেন। বাড়িতে টেনিস কোর্ট ছিল। ভাইদের সঙ্গে বাড়িতে, পরে কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে টেনিস খেলেছেন। চ্যাম্পিয়ানের তিন-চারটে ট্রফিও পেয়েছিলেন। সাইকেল চালিয়ে বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার সময় একটা খ্যাপা ষাঁড়ের শিং থেকে বাঁচার জন্য তপতী রাস্তার পাশের নালায় সবেগে নেমে যাওয়ায় তাঁর ডান পায়ের গোড়ালির হাড় কয়েক টুকরোয় পরিণত হয়। দুবার অপারেশনের পর পা যৎসামান্য ছোট হয়ে যায় বলে একটু জোরে হাঁটলেই ধরা পড়ে তিনি খোঁড়া।
স্বামী যতটা কালো, তপতী ততটাই ফরসা। ক্লাবে অনেকেই রসিকতা করে ওঁদের পূর্ণিমা-অমাবস্যা বলে ডাকে। শুনে ওঁরা দুজন হাসেন। স্বামীর মতো তপতীও জেদি কিন্তু গোঁয়ার নন। কোনও লক্ষ্য একবার স্থির করে ফেললে যতক্ষণ না তা পূরণ হচ্ছে, হাল ছাড়েন না। গোড়ালি ভাঙার পর বগলে ক্রাচ দিয়ে তাঁকে চলাফেরা করতে হত। বাড়ির সবাই ধরে নেয় আজীবন এইভাবেই তাঁকে চলতে হবে। কিন্তু মনের জোর আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটার জন্য তীব্র আকাঙক্ষা, এই দুইয়ে মিলে তাঁকে এমনই জেদি করে তোলে যে, দিনের পর দিন ব্যায়াম ও মালিশ করে এক বছরের মধ্যেই ক্রাচের ওপর নির্ভরতা থেকে তপতী নিজেকে মুক্ত করে নেন।
এই বসুমল্লিক দম্পতি নিজেরা খেলার চচা এক সময় করেছেন, খেলা ভালবাসেন। এঁদের দুই ছেলে, মৃন্ময় আর চিন্ময়। দুজনেই পড়ে মহাদেবপুরের এম ডি এম স্কুলে, মৃন্ময়ের ক্লাস থ্রি, চিন্ময়ের ক্লাস ওয়ান। আজ ওদের স্কুলের বাৎসরিক স্পোর্টস।
খাওয়ার টেবলে তন্ময় টোস্টে জেলি মাখাতে মাখাতে হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে হাঁক দিলেন, মিনু, চিনু, হারি আপ। ঠিক সাতটায় আমাদের পৌঁছতে হবে। কুইক ব্রেকফাস্ট শেষ করো, আর সময় নেই।
বাবা, আমি রেডি। বলতে বলতে শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল মিনু। নয় বছর বয়স কিন্তু দেখতে দশ-এগারোর মতো। মায়ের মতো অতটা না হলেও, ফরসা, স্বাস্থ্যবান, চটপটে। সাদা হাফপ্যান্টের মধ্যে গোঁজা সাদা গেঞ্জি, সাদা মোজা, সাদা কেডস। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। তন্ময় স্নেহভরে বড় ছেলের দিকে তাকালেন, চোখে ফুটে উঠল তারিফ। এক্কেবারে স্পোর্টসম্যানের মতো দেখাচ্ছে!
বোস। তিনি তাঁর পাশের চেয়ারটা দেখালেন। টোস্ট প্লেটে রেখে সেটা মৃন্ময়ের সামনে এগিয়ে দিয়ে তন্ময় বললেন, আজ কিন্তু একটার বেশি নয়। এর সঙ্গে এক গ্লাস দুধ আর একটা কলা। পেট হালকা থাকলে জোরে দৌড়নো যায়… চিনু কী করছে? চিনু হারি আপ। …দ্যাখো তো দেরি করছে কেন!
তন্ময় জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন টেবলের উলটো দিকে। তপতী মন দিয়ে সেদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াচ্ছেন। কথা না বলে তিনি উঠে গেলেন ছেলেদের ঘরে।
বিব্রত মুখে চিনু তাকাল মায়ের দিকে। বাঁ হাতের মুঠোয় পেটের কাছে প্যান্টটা
কী হল? তপতী ভ্রূ কুঁচকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন। প্যান্ট অমন করে ধরে আছিস কেন?
বোতাম। ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া স্বর চিনুর।
বোতাম!
তপতী প্যান্টধরা চিনুর হাতটা টানতেই সেটা হাঁটুর কাছে নেমে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি সেটা ধরে চিনু টেনে তুলল। আধুলি মাপের একটা সাদা বোতামের ভাঙা অংশ প্যান্টে আটকে রয়েছে।
হাতে আর সময় নেই, ব্রেকফাস্ট করেই বেরোতে হবে, আর এখন কিনা তোর প্যান্টের বোতাম ভাঙা.. ইচ্ছে করছে তোকে একটা…। ডান হাতটা তুলেও তপতী নামিয়ে নিলেন। অসহায় ফ্যালফ্যাল চোখে চিনু তাকিয়ে রয়েছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রং, রুগণ, দুর্বল শরীর। গেঞ্জি পরা না থাকলে ওর কণ্ঠা আর। পাঁজরের হাড় দেখা যেত। পা দুটো সরু, দুটো হাতও তাই। তপতীর চোখের রাগ ধীরে ধীরে মায়ায় ভরে এল। স্কুল থেকে বলে দিয়েছে স্পোর্টসে সাদা প্যান্ট গেঞ্জি পরে যেতে হবে। দ্বিতীয় আর সাদা প্যান্ট নেই। চট করে যে লাগিয়ে দেবেন, ওই মাপের তেমন বোতামও ঘরে নেই। কী করা যায় এখন?
বউদি, বরং একটা সেপটিপিন লাগিয়ে দাও। ঘরের দরজা থেকে রাতদিনের কাজের লোক বেলা পরামর্শ দিল। হাতের চুড়ি থেকে সেফটিপিন খুলে তপতীর। হাতে দিতে দিতে বলল, দাদা তাড়া দিচ্ছে, চেঁচামেচি শুরু করবে।
তপতী আর কথা না বলে হাঁটু গেড়ে বসে কোমরের কাছে প্যান্টটা টেনে ধরে সেফটিপিন লাগিয়ে দিলেন। চিনুর হাত ধরে যখন তিনি খাবার ঘরে এলেন, তন্ময় তখন উৎসাহভরে মিনুকে স্টার্ট নেওয়ার কৌশল দেখানোয় ব্যস্ত। ছোট ছেলের দিকে তাকাবার ফুরসত নেই।
যখন বলবে অন ইওর মার্ক… গেট… সেট… তন্ময় ঘরের মেঝেয় হামা দেওয়ার ভঙ্গিতে, একটা পা সামনে, অন্যটা পিছিয়ে। সামনের পায়ের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে দুহাতের আঙুলে ভর রেখে সামনে ঝুঁকে। কান খাড়া করে রাখবি, এটা খুব দরকারি ব্যাপার,… এই কানটা, বুঝলি? পিস্তল ফায়ারের আওয়াজ শোনামাত্রই…।
বাবা, আমাদের আন্টি বলেছেন হুইসল বাজানো হবে।
অ। একই ব্যাপার, মোটকথা ওই আওয়াজটা শোনার জন্য তুমি কান খাড়া করে রাখবে। যেই হুইল বাজল অমনই তুমি…, তন্ময় মোজাইক করা মেঝেয় পায়ে চাপ দিয়ে স্টার্ট নিতে গিয়ে প্রথম পদক্ষেপটিতেই পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে প্রথমেই তিনি সবার মুখ দেখে নিলেন। কোনও মুখেই হাসির টান পড়েনি। দেখে স্বস্তি বোধ করে বললেন, তা হলে মিনু স্টার্টিং ব্যাপারটা বুঝে গেলে, কেমন। এবার ঝালিয়ে নাও একবার।
মিনু বাবার দেখানো মতোই মেঝেয় হামা দেওয়ার ভঙ্গিতে শরীরটাকে রেখে কানখাড়া করে রইল।
কারেক্ট, নাউ… অন ইওর মার্ক… গেট… সেট… ফররর। তন্ময় মুখেই হুইল বাজালেন। মিনু স্টার্ট নিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
এ কী, পড়ে গেলি কেন? তন্ময় বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন। বারে! তুমি তো এইভাবেই স্টার্ট নিলে। মিনুর ভ্যাবাচাকা মুখ। গলদটা কোথায় হল বুঝতে পারছে না।
খুকখুক হাসির শব্দে তন্ময় মুখ ফেরালেন স্ত্রীর দিকে। জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে বললেন, এতে হাসির কী আছে?
তোমার বলে দেওয়া উচিত ছিল পিছলে পড়াটা স্টার্টিং টেকনিকের মধ্যে পড়ে না। গম্ভীর মুখে কথাটা বলে তিনি ছোট ছেলের চেয়ারটা টেবলের নীচে আর একটু ঠেলে দিলেন। প্যান্টে আঁটা সেফটিপিনটা এখনকার মতো স্বামীর নজরে না। পড়াই ভাল।
গাড়ি বার করছি। তাড়াতাড়ি এসো। তন্ময় দুটো ওয়াটারব টেবল থেকে তুলে বেরিয়ে গেলেন মিনুকে সঙ্গে নিয়ে।
মা, আমি খাব না, খিদে নেই। চিনু করুণ স্বরে বলল।
ওসব বললে হবে না, খেয়ে নাও। বাবা মাখন মাখিয়ে দিয়েছে, একটা অন্তত খাও। কখন ফিরব তার ঠিক নেই, খালি পেটে থাকলে… আচ্ছা দুধটুকু খাও। দুধের গ্লাস ছেলের মুখে তুলে ধরলেন তপতী। পাঁচন গেলার মতো মুখ করে চিনু গ্লাস শেষ করল।
মা, আমিও কি ওইভাবে স্টার্ট নেব?
যেমন খুশি তেমনি ভাবে স্টার্ট নিবি, এটা ওলিম্পিক্স নয়। এবার চল… আমার পেছন পেছন আয়, বাবার নজরে যেন সেফটিপিনটা না পড়ে, তা হলে দক্ষযজ্ঞ বেধে যাবে।
মা, দক্ষযজ্ঞ কী?
পরে বলব।
বাইরে থেকে মোটরের হর্ন শোনা গেল। ওরা দুজন প্রায় ছুটেই বাংলো থেকে বেরোল। একতলা টালির ছাদের বাড়ি। সামনের দিকে ছোট ফুলের বাগান। রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছের সারি এবং একই ধরনের বাংলো রাস্তার দুধারে। সম-পদমর্যাদার লোকেরা এই রাস্তায় বাস করে। পুরনো ভক্সহল গাড়ির সামনে। বসল তন্ময় ও তপতী, পেছনে দুই ছেলে। মোটরগাড়িটা এক সাহেবের কাছ থেকে কেনা।
স্কুলটা মহাদেবপুরের দক্ষিণ প্রান্তে গঙ্গার ধারে। স্কুলের লাগোয়াই, দুটো ফুটবল ম্যাচ একসঙ্গে খেলা যায় এত বড় মাঠ। একধারে শামিয়ানা, চেয়ার, টেল, ফুলদানি, মাইক্রোফোন, স্থূপ করা প্রাইজসামগ্রী, খাবারের বাক্স ইত্যাদি। শামিয়ানার সামনে অভিভাবকদের জন্য কয়েক সারি চেয়ার। রঙিন কাগজের তৈরি শিকল গোটা বারো বাঁশের খুঁটিতে মালার মতো দুলছে। এক আন্টি অবিরাম ঘোষণা করে চলেছেন মাইকে। অনুষ্ঠান সভাপতি এম জে টি এম-এর জেনারেল ম্যানেজার এবং প্রাইজ হাতে তুলে দেবেন প্রধান অতিথি এক প্রাক্তন ফুটবলার, এঁরা দুজন আসবেন স্পোর্টস শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে। সারামাঠে উদ্দীপনা, উৎসাহ, কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব।
বসুমল্লিক দম্পতি দুই ছেলে নিয়ে যখন হাজির হলেন তখন স্পোর্টস শুরু হয়ে গেছে। উঁচু ক্লাসের ছেলেদের ইভেন্টগুলো মাঠের অন্যদিকে পুরুষ শিক্ষকদের তদারকিতে চলছে। তাদের আটশো মিটার দৌড় তখন মাঝপথে। মাঠের মাঝে চুনকাম করা খুরি দশ মিটার অন্তর বসানো ট্র্যাক ঘিরে। গাড়ি থেকে নেমেই চিনু ফিসফিস করে মাকে বলল, ওইখানে আমাদের দৌড়তে হবে?
ওখানে বড় ছেলেদের দৌড় হবে। তুই তো পঞ্চাশ মিটারে দৌড়বি। এদিকে ওই যে লম্বা লম্বা দাগ, ওখানে তোদের দৌড়তে হবে।
ওঁরা গেস্ট লেখা সংরক্ষিত জায়গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সুবেশা, স্থূলকায় এক মহিলা হাতছানি দিয়ে তপতীকে ডাকলেন। মিসেস বসুমল্লিক, আগে ওই টেবলে বসা মিস দাসের কাছে গিয়ে জানিয়ে আসুন আপনার ছেলেরা এসেছে। …কটা ইভেন্টে ওরা নামবে?
অনেক ইভেন্ট। মিনুর তো রানিং ইভেন্টই তিনটে, তা ছাড়া স্যাক রেস, অঙ্ক রেস, জিলিপি রেস, ব্যালান্স রেস… এক মিনিট মিসেস সেন, এসে বলছি। তপতী কথা অসমাপ্ত রেখে মিস দাসের টেবলের দিকে ছুটলেন। সেখানে। বাবা-মায়েদের ভিড়। সবাই হাজিরা জানাবার জন্য ব্যস্ত।
প্রতীক ঘোষ, ক্লাস ফোর, সেকশন এ।
বিশ্বনাথ জানা, ক্লাস ফোর, সেকশন এ।
কিংশুক চ্যাটার্জি..
সুভাষ দত্ত…
মিনিটপাঁচেক পর তপতী সুযোগ পেলেন। নাম, ক্লাস, সেকশন শুনে মিস দাস খাতা দেখে বললেন, মৃন্ময় তো সাতটা ইভেন্টে নাম দিয়েছে আর চিন্ময় চারটেতে। সবকটাতেই ওরা নামবে তো?
নিশ্চয়।
পঁচাত্তর মিটার এখনই শুরু হবে। মৃন্ময়কে রেডি রাখুন। নাম অ্যানাউন্স করলেই স্টার্টিং লাইনে পৌঁছে দেবেন। তারপরই আছে চিন্ময়ের পঞ্চাশ মিটার।
তপতী ফিরে এসে দেখলেন চিনু একা দাঁড়িয়ে।
বাবা, দাদা কোথায়?
ওইদিকে। আঙুল দিয়ে চিনু দেখাল ভিড়ের শেষে মাঠের একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে তন্ময়ের নির্দেশে মৃন্ময় গা-ছাড়ানোর ব্যায়াম করছে।
মা, আমিও কি এখন দাদার মতো করব?
না। অত করার তোর দরকার নেই।
মা, আমার কেমন ঘুমঘুম পাচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছে না দৌড়তে।
ঘুম পাচ্ছে বললে কি এখন চলে? ওই শোন দাদার নাম অ্যানাউন্স হল। দৌড়ে গিয়ে ওদের ডেকে আন।
ডাকতে আর হল না। তন্ময় আর মিনুকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল স্টার্টিং লাইনে হাতে কাগজ কলম আর মাথায় সাদা কাপড়ের ক্যাপ পরা ব্যস্তসমস্ত এক আন্টির দিকে।
মিনু পঁচাত্তর মিটার দৌড়ে শুধু প্রথমই হল না, দ্বিতীয় জনকে প্রায় পনেরো মিটার পেছনে রেখে দিল। দর্শকদের সবার চোখে তারিফ আর মুগ্ধতা। দৌড় শেষ করেই মিনু ছুটে এসে ফিনিশিং লাইনের ধারে দাঁড়ানো মাকে জড়িয়ে ধরল। ছেলের মুখ চুম্বনে ভরিয়ে তপতী তাকালেন স্বামীর দিকে। মিনু কোমর জড়িয়ে ধরেছে বাবার! ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তন্ময়ের মুখে গভীর তৃপ্তির সঙ্গে ফুটে উঠল অহঙ্কার।
যেভাবে স্টার্ট নেওয়াটা শিখিয়েছিলাম তাতে ফার্স্ট না হয়ে কোনও উপায় নেই। টেকনিক… ইটস টেকনিক, বুঝলে!
তার মানে, তোমার স্টার্টিং টেকনিকের জন্যই মিনু ফার্স্ট হল, ওর নিজের কোনও কৃতিত্ব এতে নেই?
থতমত হয়ে তন্ময় বললেন, না, না, সে কী কথা! অবশ্যই মিনু নিজের ক্ষমতায় প্রথম হয়েছে।
তুমি শুধু মিনুকেই টেকনিক শিখিয়েছ, চিনুকে কিন্তু কিছুই শেখাওনি।
ওকে আর কী শেখাব, একদমই বাচ্চা, তা ছাড়া খুবই দুক্লা, ভেরি, ভেরি উইক।
তপতী চুপ করে রইলেন। কথাটা খুবই সত্যি। তাঁর ছোট ছেলে খুবই দুলা। ক্লাস ওয়ানের পঞ্চাশ মিটার দৌড়ের জন্য যখন নাম ডাকা হল, তপতী তখন চিনুকে স্টার্টিং লাইনে পৌঁছে দেওয়ার সময় বললেন, তুমি যেমন পারো তেমনই দৌড়িও, কেমন? এটা ওলিম্পিস নয় যে, গোল্ড মেডেল পেতেই হবে। মজা মনে করো এই দৌড়টাকে। তোমাকে ফাস্ট হতে হবে না।
চিনু কথাগুলোর কী অর্থ করল কে জানে, তবে ঘাড় নাড়ল। স্টার্টিং লাইনে সব প্রতিযোগীই বাচ্চা ছেলে, তার মধ্যে চিনুকে তার রুগ্ণতার জন্য আরও বাচ্চা দেখাচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে সে অসহায়ের মতো বারবার তাকাল মার দিকে। তপতী হাত নাড়লেন।
শুরুর হুইসল বেজে উঠতেই হইহই করে উঠল দর্শকরা, যার অধিকাংশই বাবা-মা। উৎসাহভরে অনেকেই প্রতিযোগীদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে লাগলেন দূরত্ব রেখে। দৌড় শুরু হতেই চিনু দশ মিটার মতো গিয়েই পেটের কাছে প্যান্টটা ধরে দাঁড়িয়ে মার দিকে তাকাল। তপতী হাত নেড়ে ওকে ছুটতে ইশারা করলেন।
চিনু, দাঁড়িয়ে থেকো না, দৌড়ও।
প্যান্ট মুঠোয় ধরে চিনু দৌড় শুরু করল আবার এবং সমাপ্ত করল হাসফাঁস করতে করতে সবার শেষে পৌঁছে। সফল প্রতিযোগীদের মায়েরা ছুটে গেল ছেলেদের কাছে, তাদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। চিনু দৌড় শেষ করে মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তপতী পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে ঝুঁকে কপালে চুমু দিয়ে বললেন, তুমি ফিনিশ করেছ, এতে আমি খুব খুশি হয়েছি।
কাঁধের কাছে জামায় চোখ মুছে চিনু হাসল। সেফটিপিনটা খুলে গেল।
তন্ময় এগিয়ে এসে বললেন, তুই ওভাবে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? তারপরই প্যান্টে আঁটা সেফটিপিনটার দিকে তাঁর নজর পড়ল। এ কী, প্যান্টে ওটা কী?
দোষটা আমারই। লন্ড্রি থেকে কেচে আসার পর লক্ষ করিনি বোতামটা ভেঙে গেছে। বেরোবার তাড়ায় আর সময় পাইনি নতুন বোম লাগাবার, তাই। তপতী অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন। তারপরই গলায় উচ্ছ্বাস এল, কিন্তু চিনু রেসটা কেমন শেষ করল বলো!
ইয়েস, ইয়েস, চিনুর পিঠে হালকা চাপড় দিলেন তন্ময়। শেষ পর্যন্ত দৌড়েছে, রণে ভঙ্গ দেয়নি। এটাই তো চাই। মিনু তোর নেক্সট ইভেন্টের কল দিচ্ছে। এর পর চিনুর কী আছে?
বোধ হয় জিলিপি রেস।
মিনু চল, এটাতেও কিন্তু ফার্স্ট হতে হবে।
ওরা দুজন চলে যেতেই চিনু মায়ের কোমর জড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি আর নামব না… আমার ভাল লাগছে না।
সে কী! জিলিপি রেস কী মজার, তা জানিস? দড়িতে জিলিপি ঝুলিয়ে দেবে, দৌড়ে গিয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে নিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে।
না মা, আমার ভাল লাগছে না। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। চিনু অনুনয়। করল। তপতী ছেলের কপালে হাত রেখে কোঁচকালেন।
তোর গা তো বেশ গরম! জ্বর হয়েছে বোধ হয়। থাক তা হলে, আর দৌড়োদৌড়ি করতে হবে না। আয় বসি।
চিনুকে কোলে নিয়ে তপতী বসলেন একটা চেয়ারে। পেছন থেকে ঝুঁকে মিসেস সেন বললেন, আপনার বড় ছেলেটি খুব ভাল দৌড়েছে।
মুখ ফিরিয়ে তপতী হাসলেন শুধু।
মনে হয় সব কটাতেই ও ফার্স্ট হবে।
তপতী আবার হাসলেন।
আপনার ছোট ছেলের তখন হল কী, দাঁড়িয়ে পড়ল কেন?
প্যান্ট খুলে পড়ছিল। বোতামটা ভেঙে গেছে।
অ অ। আমি ভাবলুম ঘাবড়ে গিয়ে… ওর সঙ্গে যারা দৌড়চ্ছিল তাদের স্বাস্থ্য তো খুবই ভাল।
তপতীর মাথা গরম হয়ে উঠল কথাটা শুনে। ভাল স্বাস্থ্য দেখে চিনু ভয় পেয়ে গেছল, এমন একটা ধারণা হল কী করে এই মহিলার! চিনু মায়ের বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে জড়িয়ে ধরে রয়েছে। তপতী ওর মাথায় গালে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, বাড়ি যাবি? চিনু মাথা নাড়ল।
ছেলেকে নিয়ে তপতী উঠলেন। তন্ময়কে খুঁজে বার করে বললেন, চিনুকে বাড়ি নিয়ে যাব, পৌঁছে দাও। জ্বর জ্বর লাগছে। আমার মনে হয় এখন ওর শুয়ে থাকা দরকার।
আমি এখন যাব কী করে, এই শুরু হতে যাচ্ছে মিনুর ফিফটি মিটারটা। বরং তুমিই গাড়ি নিয়ে চলে যাও, আমরা রায়চৌধুরীর গাড়িতে চলে যাব। তন্ময় গাড়ির চাবি তপতীর হাতে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন।
তপতী গাড়ি চালান, তবে মহাদেবপুরের মধ্যেই। কলকাতা বা অন্য কোথাও যেতে হলে তিনি স্টিয়ারিং ধরেন না। জি টি রোডের ট্র্যাফিককে তিনি ভয় পান। বাড়ি যাওয়ার পথেই ডাক্তার সিনহার কোয়াটার। তপতীর মনে হল চিনুকে একবার ওঁকে দিয়ে দেখিয়ে নেওয়া ভাল।
ডাক্তার কোয়াটারে নেই, কলকাতায় গেছেন সপরিবারে। তপতী ফিরে এসে চিনুকে শুইয়ে দিলেন। থার্মোমিটারে তাপ মাপলেন, প্রায় একশো ডিগ্রি। ছেলেকে জড়িয়ে তিনিও শুয়ে পড়লেন।
রীতিমতো হইহই করে তন্ময় ও মৃন্ময় বাড়িতে ঢুকল।
হিপ হিপ হুররে… থ্রি চিয়ার্স ফর মৃন্ময় বসুমল্লিক… হিপ হিপ… হুরে। তন্ময় বাড়ি কাঁপিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। তপতী প্রায় ছুটেই বসবার ঘরে এলেন। বাবা আর ছেলের হাত ভর্তি কাপ, মোট সাতটা। তার সঙ্গে একটা বাক্সে রুপোর মেডেল, চ্যাম্পিয়ানের পুরস্কার। এ ছাড়াও একটা তোয়ালে, একটা কিট ব্যাগ, একটা ওয়াটার বটুল আর সার্টিফিকেটগুলো।
ওমমা, মিনু তো বিপদে ফেলে দিল! এত কাপ এখন আমি রাখি কোথায়? তপতী ছেলেকে কাছে টেনে নিলেন। মিনুর মুখ লাজুক হয়ে উঠল।
এই তো সবে শুরু। কাপগুলো টেবলে সাজিয়ে রাখতে রাখতে তন্ময় বললেন। এবার থেকে বছর বছর গণ্ডায় গণ্ডায় কাপ-মেডেল আসবে। এগুলো এখন এখানেই থাক, লোকে দেখুক।
দাদা, একটা কাচের আলমারি তৈরি করিয়ে তাতে সাজিয়ে রাখুন। পরামর্শটা দিল বেলা।
সেটা আমিও ভেবেছি। আসার সময় রায়চৌধুরীর বউ তো আজ রাতে মিনুকে নেমন্তন্ন করেছে। পায়েস খাওয়াবে। চিনুকেও পাঠিয়ে দিতে বলেছে।
চিনু যেতে পারবে না, জ্বর প্রায় একশো। তপতী জানালেন।
ডাক্তার দেখাতে হয় তা হলে। তন্ময় ব্যস্ত পায়ে ছেলেদের ঘরের দিকে চলে গেলেন। ঘুমন্ত চিনুর কপালে হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে বললেন, সিন্হাকে কি একবার ডাকব?
ওঁরা সব কলকাতায় গেছেন। তুমি বরং কলকাতায় ফোন করে অপূর্ববাবুর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো। চাইল্ড স্পেশালিস্ট দেখানোই ভাল।
হ্যাঁ দাদা, কলকাতার ডাক্তারই দেখান। চিনুর প্রায়ই জ্বর হয়, রাতে খুকখুক করে কাশেও। বেলা এসব জানে, কেননা রাতে সে ছেলেদের ঘরের মেঝেয় শোয়।
রায়চৌধুরীরা, শুভা এবং রাজেন, বছরখানেক রয়েছে মহাদেবপুরে। মাসছয়েক মাত্র ওদের বিয়ে হয়েছে। ধনী পরিবারের সন্তান। রাজেন টেক্সটাইল এঞ্জিনিয়ার। মা আর বাবা মাঝে মাঝে এসে ছেলের কাছে থাকেন। রাজেন সাউথ ক্লাবে টেনিস খেলত, ক্যালকাটা হার্ডকোর্ট চ্যাম্পিয়ানশিপে দুবার সেমিফাইনালে উঠে প্রেমজিত লাল নামে জুনিয়ার ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ানের কাছে হেরে গেছল। বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ানশিপের কোয়াটার ফাইনালে হেরে যায় আর এক তরুণ জয়দীপ মুখার্জির কাছে। অতঃপর রাজেন বুঝে যায় টেনিসে বড় খেলোয়াড় হওয়ার মতো প্রতিভা তার নেই, অতএব পড়াশুনোয় মন দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। টেনিস ছেড়ে দিলেও রাজেন ক্লাব ছাড়েনি। ছুটির দিনে মোটরে সে কলকাতায় যায় শুভকে নিয়ে। এলগিন রোডে তাকে বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে চলে যায় কাছেই সাউথ ক্লাবে। অল্প খেলা, আচ্ছা বেশি এবং পরদিন সকাল ছটার মধ্যেই মহাদেবপুরে ফিরে কাজে লেগে যাওয়া। এইভাবেই তারা কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে যাচ্ছে।
আজ তারা কলকাতায় যায়নি স্কুলের স্পোর্টস দেখবে বলে। রাজেনের মা পায়েস বেঁধেছেন। বেলার সঙ্গে রাতে মিনু গেল পায়েস খেতে। অবশ্য পায়েসের সঙ্গে লুচি-বেগুনভাজাও ছিল। মিনুকে পৌঁছে দিয়ে বেলা ফিরল একটা বড় বাটি ভর্তি পায়েস নিয়ে।
শুভাদির শাশুড়ি দিলেন। খাওয়ার টেবলে বাটিটা রেখে বেলা জানিয়ে দিল।
কার জন্য দিলেন? তন্ময় প্রশ্নটা করেই চামচেতে খানিকটা পায়েস তুলে মুখে দিল। নলেন গুড় আর গোবিন্দভোগ চাল, ফাস ক্লাস,… কত দিন যে টেস্ট করিনি এই গন্ধটা!
কার জন্য আবার, সবার জন্যই দিয়েছেন। তপতী সতর্ক গলায় বললেন। ফাস ক্লাস শব্দ দুটির আড়ালে কী ইচ্ছা উঁকি দিচ্ছে সেটা অনুমান করতে তাঁর অসুবিধে হয়নি।
এইটুকু জিনিস কী করে সবাইকে দেবে তুমি! তন্ময় যেন একটু বেশি রকম অবাক হলেন, তার থেকে বরং.. কথা শেষ হওয়ার আগেই তপতী হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বেলাকে বললেন, দাদা আজ রাতে কষ্ট করে ওইটুকু পায়েস খেয়েই থাকবেন, ওঁর খাবারটা তুলে রাখো।… মিনুকে ওদের বাড়ি থেকে কখন আনতে যাবে?
আনতে যেতে হবে না। শুভাদির শ্বশুর বললেন, পৌঁছে দেবেন। মিনু তো ওনার সঙ্গে দাবা খেলতে বসে গেছে।
দাবা? স্বামী-স্ত্রী প্রায় একসঙ্গেই অবাক প্রশ্ন তুললেন।
মিনু দাবা খেলতে পারে? তন্ময় স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন।
তপতী বললেন, আমি তো জানি না! কোনও দিন তো খেলতে দেখিনি!
বিস্মিত তন্ময় চেয়ারে বসে পায়েসের বাটিটা টেনে নিয়ে একবার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, একটু চেখে দেখবে নাকি?
কালই আমি নলেনগুড় আর গোবিন্দভোগ চাল আনিয়ে পায়েস করে একা সব খাব। তপতী ঘরে চলে গেলেন, ঝাঁঝালো স্বরে কথাগুলো বলে। থামোমিটারে চিনুর তাপ দেখলেন। একই রকম রয়েছে।
মা আমি কি পায়েস খাব? দুর্বল স্বরে চিনু বলল।
খাবে, তবে আজ নয়। আগে সেরে ওঠো।
যদি ডাক্তারবাবু বারণ করেন?
তা হলে খাবে না। কথাটা বলে তপতী কষ্ট পেলেন। পায়েস খাওয়ার ইচ্ছা কার না হয়! কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য, বিশেষ করে সন্তানের মঙ্গলের জন্য তিনি কঠোর হতে দ্বিধা করবেন না।
যতদিন না ডাক্তারবাবু তোমায় পায়েস খেতে দিচ্ছেন ততদিন আমিও পায়েস খাব না!
কেন তুমি খাবে না?
খাব না এই জন্যই, আমার ছোট্ট চিনু পায়েস খেতে না পেয়ে কষ্ট পাচ্ছে, আমিও সেই কষ্টের ভাগ নেব। তা হলে চিনুর কষ্টটা অনেক কমে যাবে। তাই না?
তপতীর মনে হল চিনুর জ্বরক্লিষ্ট মুখে হালকা একটা হাসি ফুটে উঠল। যাঃ, তুমি বাজে কথা বলছ। এইভাবে কি কষ্ট কমে? তোমার যখন পা ভেঙেছিল তখন তো তুমি বিছানায় শুয়ে থাকতে, তোমার মাও কি বিছানায় শুয়ে থাকত তোমার কষ্টের ভাগ নিতে?
সবার কষ্ট কি একরকমের হয়? তুমি ছোট, তোমার কষ্ট একরকমের, যখন আমার পা ভাঙে তখন তো আমি যথেষ্ট বড়, তাই আলাদা রকমের কষ্ট হত।
কী কষ্ট হত, তোমার?
তপতী একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, খুব ভোরবেলায় উঠে বাগানে গিয়ে দেখতুম ফুলের নতুন কোনও কুঁড়ি ফুটেছে কি না, খালি পায়ে ভিজে ঘাসের ওপর হাঁটতুম, আমায় দেখলে টমি ছুটে এসে আমাকে ঘুরে ঘুরে লাফালাফি করত আর ল্যাজ নাড়ত, আমি তখন ছুটতুম, টমিও ছুটত… বিকেলে টেনিস খেলতুম দাদার সঙ্গে, বাবা তাড়াতাড়ি কোর্ট থেকে ফিরলে আমাদের সঙ্গে খেলতেন। এইসব কিছুই করতে না পারার জন্য কষ্ট হত।
মা, আমি টেনিস খেলব তোমার সঙ্গে। তোমার তো একটা র্যাকেট আলমারিতে তোলা আছে, আমি দেখেছি। ওটা দেবে আমায়?
নিয়ে কী করবি?
বাইরে বাগানে গিয়ে দেয়ালে বল মেরে মেরে খেলব। আমাকে একটা টেনিস বল কিনে দেবে?
দেব। এখন আর কথা নয় চিনু, এবার ঘুমো।
দাদাকে একটা র্যাকেট কিনে দিও, তা হলে দুজনে খেলব।
কিনে দোব… এবার ঘুমো।
আমাদের এখানে টেনিস খেলার মতো জায়গা নেই, সেই ক্লাবে গিয়ে খেলতে হয়। এখানে একটা কোর্ট থাকলে খুব ভাল হত, তাই না?
হাঁ, ভাল হত।
কপালে হাত দিয়ে দেখো, এখন আমার জ্বর নেই। চিনু মায়ের হাতটা তুলে নিয়ে নিজের কপালে রাখল। তপতীর মনে হল, সত্যিই যেন জ্বরটা কম।
রাতে তোর কাশি হয়?
হ্যাঁ।
একদম ঠাণ্ডা লাগাবি না। এবার থেকে সবসময় সোয়েটার পরে থাকবি।
ঘরের দরজা থেকে বেলা বলল, বউদি, দাদার খাবার কি তুলে রাখব, উনি তো পায়েস খাননি।
তপতী তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে খাওয়ার ঘরে এসে দেখলেন বাটিতে পায়েস যেমন ছিল তেমনই রয়েছে। তন্ময় বসার ঘরে বড় সোফায় টানটান শুয়ে। খবরের কাগজ পড়ছেন। তপতী বাটিটা থেকে একটা প্লেটে অর্ধেক পায়েস ঢেলে নিয়ে বেলাকে বললেন, এটা দাদাকে দিয়ে এসো। আর বোলো কাল পায়েস করব সবার জন্য।
বেলা ফিরে আসতেই তপতী বললেন, এই পায়েসটা তুমি খেয়ে নিয়ো।
সে কী বউদি, তুমি খাবে না!
না। চিনু ভাল হোক, ওর সঙ্গে খাব।
এই সময়ই ধুপধাপ পায়ের শব্দ করে মিনু ফিরল, তার সঙ্গে রাজেনের বাবা ব্ৰজেন রায়চৌধুরী। বয়স প্রায় সত্তর। তামাটে রং, লম্বায় ছয়-দুই, ওজন। একশো সত্তর পাউন্ড, মাথাভর্তি ধবধবে ব্যাকব্রাশ করা চুল। চোখে পড়ার মতো হল ওর গোঁফ! খুবই পুষ্ট এবং গোরুর শিঙের মতো ডগা দুটো ওপর দিকে তোলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি মেজর ছিলেন সেনাবাহিনীতে, স্বাধীনতার পর মিলিটারি ছেড়ে এক বিলিতি সওদাগরি অফিসে যোগ দেন। বছর তিনেক আগে বিভাগীয় ম্যানেজারের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। হাতের অফুরন্ত সময় কীভাবে কাটাবেন, ধর্মচর্চায় না গ্রামের বাড়িতে পোলট্রি করে, এই ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে অবশেষে দাবায় মন দেন। এখন তাতেই ডুবে আছেন।
পায়েসের নেমন্তন্ন রাখতে গিয়ে মিনুর চোখ পড়ে বসার ঘরের টেবলে রাখা দাবার ছকের ওপর। কৌতূহলী হয়ে সে খুঁটিগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে। ব্ৰজেন ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে সিগার খেতে খেতে তিনবার পড়া আগাথা ক্রিস্টির একটা গোয়েন্দা বই পড়ছিলেন সময় কাটাবার জন্য আর কিছু না পেয়ে। হঠাৎই তাঁর চোখ পড়ল মিনুর ওপর। তাঁর মনে হল এই বাচ্চা ছেলেটি দাবায় আগ্রহী। একে যদি খেলাটা শিখিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে সারাদিনে গোটা চল্লিশ হাই তোলা থেকে বোধ হয় রেহাই পাওয়া যেতে পারে।
দাবা খেলবে?
হ্যাঁ।
খেলেছ কখনও?
না, তবে খেলতে দেখেছি।
মিনুর সপ্রতিভ উত্তর ব্রজেনের ভাল লাগল। তিনি টেবলে উঠে গিয়ে সাদা খুঁটিগুলো ছকে সাজিয়ে বললেন, এবার তুমি কালো ঘুটিগুলো সাজিয়ে দিতে পারবে?
মিনু সাজানো সাদা ঘুটি দেখে দেখে সাজিয়ে দিল কালো খুঁটি এবং বেশ দ্রুতই।
ঘুঁটিগুলোর নাম জানো?
হ্যাঁ। এটা গজ, এটা ঘোড়া, এটা নৌকো, এটা রাজা।
কোনটের চাল কীরকম তা জানো?
জানি।
ঘোড়ার চাল দেখাও তো।
মিনু আড়াই চাল দেখাল। ব্ৰজেন অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি শিখলে কার কাছে? বাড়িতে কেউ খেলে না কি?
স্কুলে দুজন সার টিফিনের সময় টিচার্স রুমে খেলেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। মিনুর দাঁত ঝলসে উঠল হাসিতে। দেখতে দেখতে খানিকটা শিখে গেছি।
দেখি তো কেমন তুমি শিখেছ! ব্রজেন উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন। যদি একটা খেলার সঙ্গী জোটে। তোমার সাদা খুঁটি, আমার কালো। নাও চাল দাও।
মিনু রাজার সামনের বোড়ে দুঘর এগিয়ে দিল। ব্ৰজেন তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে প্রথম চাল দিলেন। দশ বারো চাল খেলার পর তাঁর মনে হল, ছেলেমানুষি বুদ্ধিতে খেললেও এই বাচ্চা ছেলেটিকে এক মাসের মধ্যে চলনসই প্রতিপক্ষ হওয়ার মতো করে গড়ে তুলতে পারবেন। মিনু তার প্রথম খেলায় হারল পনেরো চালে।
ঘুঁটি সাজাও, এবার আমার সাদা। ব্ৰজেন উত্তেজনা বোধ করছেন। নিভে যাওয়া সিগারটা ধরালেন।
দাবা এখন থাক। ব্রজেনের স্ত্রী তাড়া দিলেন। খেয়ে নিয়ে বরং আবার বোসসা, লুচি ভাজতে শুরু করেছে বউমা।
খাওয়ার সময় ব্ৰজেন মিনুর পিঠে হাত রেখে শুভাকে বললেন, মিনু যে এত তাড়াতাড়ি খেলাটা ধরে ফেলবে, ভাবতেই পারিনি। আমার একটা সমস্যা মিটে গেল বউমা।
মিনু আজ কত প্রাইজ পেয়েছে যদি দেখতেন! আপনার ছেলে বলছিল, ও ন্যাচারাল অ্যাথলিট, যে খেলা ধরবে তাতেই ওপরে উঠবে। হবে নাই বা কেন, বাবা-মা দুজনেই অল্পবিস্তর স্পোর্টসের মধ্যে ছিল, বাবা সাঁতারে, মা টেনিসে। পরিবারের আবহাওয়াও তো অনেক সাহায্য করে ছেলেমেয়েদের।
তোমার এক ভাইকে দেখেছি, কী যেন নাম? ব্ৰজেন জানতে চাইলেন মিনুর দিকে তাকিয়ে।
চিন্ময়, চিনু। … কাকিমা, আমি আর একটা বেগুনভাজা খাব।
ব্ৰজেন তারিফ ভরা স্বরে বললেন, মিনু তো দেখছি ভাল খাইয়েও। বউমা, একটা নয়, দুটো বেগুনভাজা আর লুচি, চলবে তো? মিনু সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল।
চিনু আজ কটা প্রাইজ পেল? ব্রজেন প্রশ্ন করলেন মিনুকে।
একটাও নয়। জ্বর এসে গেল, একটায় নেমে আর নামেনি।
শুভা বলল, বড় রুগণ ছেলেটা, খেলাধুলো ওর দ্বারা হবে না।
খাওয়ার পর ওরা দুজন আবার খেলতে বসল। মিনু প্রতিপক্ষের খুঁটির দিকে হুঁশ না রেখে চাল দিলেই ব্ৰজেন প্রত্যেকবারই তার ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন।
তুমি যে মন্ত্রীটা ওইখানে দিলে কিন্তু লক্ষ করলে না আমার গজ ওই কোণ থেকে এসে একে মেরে দেবে। নাও, চাল ফিরিয়ে নতুন চাল দাও।… আমি কিন্তু আর চাল ফেরত দেব না বলে রাখলাম।
মিনু একবার ঘোড়া দিয়ে একটা বোড়েকে খেতেই ঘোড়ার খালি করে দেওয়া ঘরে ব্রজেন তাঁর মন্ত্রীকে তুলে মিনুর রাজাকে কিস্তি দিলেন। আমি ইচ্ছে করেই বোড়েটাকে তোমার ঘোড়ার মুখে ফেলে দিয়েছিলাম, দেখি তুমি টোপ গেলো কি না। তুমি গিলে ফেললে আর আমারও কিস্তি দেওয়ার রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেল।… ভাববা, সময় নিয়ে প্রত্যেকটা চাল দেওয়ার আগে ভাবো। সবদিক বিবেচনা করো। একদম তাড়াহুড়ো করবে না!
হেরে গিয়ে মিনুর মুখ প্রায় লাল হয়ে উঠল। চোখে হেরে যাওয়ার লজ্জা, সেটা লক্ষ করে ব্রজেন বললেন, খেলা শিখেই কেউ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান বটভিনিকের মতো খেলতে পারে না। তুমি এখন বারবার আমার কাছে হারবে, তারপর এমন একটা সময় আসবে যখন তুমিই আমায় বারবার হারাবে। হারা আর হারানো এই দুইয়ের মাঝে শুধু প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস।
আর এক হাত খেলব। মিনু চোখ নামিয়ে বলল।
আর নয় আর নয়, রাত হয়ে গেছে। শুভা তাড়া দিল। মিনু, বাড়ির সবাই ভাববে, এবার বাড়ি যাও।
খেলুক না বউমা।
না বাবা, দশটা বাজে। ওইটুকু ছেলের এখন শুয়ে পড়ার কথা।
ঠিক আছে, তা হলে কাল আবার আমরা বসব, কেমন? এবার চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
.
০২.
তন্ময়ের বন্ধু অপূর্ব হালদারের চেম্বার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে ধর্মতলা স্ট্রিটে। লন্ডন থেকে ডিগ্রি পাওয়া শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, তন্ময়ের স্কুলের সহপাঠী। চিনুকে দেখাবার জন্য তারিখ ও সময় ঠিক করতে তন্ময় ফোন করেছিল অপূর্বকে। তোর ছেলেকে দেখাবার জন্য আবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগবে নাকি! যেদিন খুশি, রবিবার বাদে সন্ধে ছটা থেকে আটটার মধ্যে চলে আয় চেম্বারে। তন্ময় এই উত্তর পেয়েছিল।
তা হলে আর দেরি করে লাভ নেই, কালই চলল। উদ্বিগ্ন স্বরে বলেছিল তপতী। জ্বরটা রয়েই গেছে। বাড়ছে কমছে, সঙ্গে কাশিটাও, ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না।
সুতরাং পরদিন যাওয়াই ঠিক হল। বিকেল পাঁচটা নাগাদ তারা মহাদেবপুর থেকে রওনা হয়। মিনুকে নিয়ে সামান্য ঝামেলা হল রওনা হওয়ার আগে। সাড়ে তিনটের সময় স্কুল থেকে ফিরেই সে বাড়ির কাছে একটা ছোট মাঠে ফুটবল খেলতে যেত। এখন আর যায় না। এখন যায় ব্ৰজেনদাদুর সঙ্গে দাবা খেলতে। দাবা তাকে রীতিমতো আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বল খেলার বদলে রোজ সে ঘণ্টা তিনেক বসে থাকে দাবার ছকের সামনে, একটা বুড়োমানুষের মতো।
সেদিন যথারীতি সে দাবার ছকের দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিন্তায় মগ্ন। এমন সময় বেলা গিয়ে তাকে ডাকল। মিনু শিগগির এসো, ওরা সবাই রেডি হয়ে গেছে, তুমি গেলেই গাড়িতে উঠবে।
মিনু তখন তার ঘোড়াকে বাঁচাবার জন্য কোথায় সরাবে ভেবে পাচ্ছে না। বেলার কথা শুনে রেগে উঠে সে বলল, আমি যাব না যাও। চিনুকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে তো আমি গিয়ে কী করব? এখন ভাগো।
বেলা ফিরে এসে তন্ময় ও তপতীকে শুনিয়ে দিল মিনুর কথাগুলো। তন্ময় প্রায় লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে তপতী বললেন, তোমায় যেতে হবে না, আমি যাচ্ছি। তপতী দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
মিনু, বাবা অপেক্ষা করছেন। তপতী কথাটা বলে ব্রজেনবাবুর দিকে তাকালেন, আমরা কলকাতা যাব, মিনুও সঙ্গে যাবে। আজ আর ও খেলবে না।
তোমরা যাও না… আবদেরে নাকি সুরে মিনু বলতে শুরু করেছিল।
মিননু। কঠিন চাপা স্বরে তপতী তাকে থামিয়ে দিলেন, উঠে এসো।
মায়ের চোখে ধকধকে আগুন দেখে মিনু উঠে পড়ল।
মায়ের কথা শুনতে হয়। খেলা আজকের মতো অ্যাডজোড় রইল। মিনুর পিঠে হাত রেখে স্নেহভরে ব্রজেনবাবু বললেন, ছকে খুঁটিগুলো যেমন আছে ঠিক তেমনই থাকবে। কাল আবার শুরু হবে, আমি প্রথমে চাল দেব, কেমন? এখন যাও। বাবা-মার অবাধ্য হতে নেই।
তারা অপূর্ব হালদারের চেম্বারে পৌঁছল সওয়া ছটায়। বসার ঘর ভর্তি রোগী আর সঙ্গের লোক। তন্ময় ছাপা স্লিপে নাম লিখে পাঠাল। ডাক্তারকে দেখিয়ে একজন বেরিয়ে আসতেই তাদের ডাক পড়ল। অপূর্ব ছোটখাটো গোলগাল চেহারার মানুষ, চোখে চশমা, মুখে সবসময় হাসি। অনেকদিন পর দেখা হলে যেরকম কথাবার্তা হয় তাদের মধ্যে, তাই হল। বাইরে রোগীরা অপেক্ষা করছে, তাই ডাক্তার কথা বদল করে চিনুর দিকে নজর দিলেন। চোখ, জিভ, বুক, শ্বাস-প্রশ্বাস, গলার ভেতর, পেট ইত্যাদি শরীরের সাধারণ পরীক্ষাগুলো করতে করতে তিনি তপতীর কাছ থেকে চিনুর নিয়মিত জ্বর হওয়া, কাশি হওয়া সম্পর্কে খবর নিয়ে ভুরু কোঁচকালেন।
ছেলেটা বড় রোগা। ওকে কি বড় ছেলেটার মতো স্বাস্থ্যবান করা যায় না? তন্ময় কথাটা বলে মিনুর কাঁধে হাত রাখলেন সস্নেহে।
কেন মোটা করা যাবে না! শরীরের যত্ন নিলে, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলো, ছোটাছুটি করলে, মন প্রফুল্ল থাকলে স্বাস্থ্য ভাল হবেই। তার আগে এখন দেখতে হবে ওর শরীরে অসুখটা কী। অপূর্ব চিনুর মুখের দিকে চোখ রাখলেন। ডাক্তারের মুখে হাসি থাকলেও তপতীর বুক ছমছম করে উঠল। বেচারা চিনু! বসে-যাওয়া চোখমুখ এখন যেন আরও বসে গেছে।
ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে তন্ময়ের হাতে দিয়ে বললেন, বুকটা এক্স-রে করিয়ে নে আর সেইসঙ্গে মানটু টেস্টও।
শুনেই তপতী প্রায় আর্তনাদের মতো স্বরে বললেন, সে কী! এসব তো…। ভয়ে আর বাকি কথাগুলো বললেন না।
এগুলো রুটিন চেক-আপ। টিবি যে হয়েছেই আপনি তা ধরে নিচ্ছেন কেন? তপতীর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে ডাক্তার তাকালেন।কিংবা যদি হয়েই থাকে। তাতেই বা ভয় পাওয়ার কী আছে! টিবির অ্যালার্জি আছে কি না সেটা বোঝার জন্যই মানটু টেস্ট। অন্য অনেক রোগের ব্যাপারেও এই টেস্ট করা হয়। তা ছাড়া এমন এমন সব ওষুধ বেরিয়েছে, কমপ্লিটলি সারিয়ে দেবে। এখন প্রোটিন, ভিটামিন, আয়রন এইসব ওর দরকার। ওষুধগুলো লিখে দিলাম, ঠিকমতো খাওয়াবেন। ডাক্তার খুব সহজ ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে গেলেন। কিন্তু তপতী তাতে আশ্বস্ত বোধ করলেন না। ছোট্ট চিনুর অবোধ সরল মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখ জলে ভরে এল।
তন্ময়, এক্স-রে-টা ভাল জায়গা থেকে করবি। তোদের ওখানে তো মিলের হাসপাতাল আছে, কেমন সেটা?
অফিসারদের জন্য ব্যবস্থা ভালই, তবে লেবারদের জন্য নয়।
এক্স-রে প্লেট আর মানটু টেস্টের রিপোর্ট আমাকে দেখিয়ে যাবি, আর ওষুধগুলো এখনই যাওয়ার পথে কিনে নিয়ে যা, আজ থেকেই খাওয়াতে শুরু কর। লিখে দিয়েছি কখন কতবার খাওয়াতে হবে।
ওরা চেম্বার থেকে যখন বেরিয়ে আসছে ডাক্তার তখন বললেন, তন্ময়, তোর বড় ছেলেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন শরীরের ওজন একটু বেশিই। কত ওজন এখন? বয়স কত হল?
বলতে পারব না, ওজন কখনও করাইনি। বয়স নয় চলছে। জিজ্ঞেস করলি কেন, খারাপ কিছু? তন্ময়কে উৎকণ্ঠিত দেখাল।
বয়সের তুলনায় তো বড়ই দেখাচ্ছে। খারাপ কেন হবে, বেশ ভাল হেথ। তবে এক্সারসাইজ না করলে মোটা হয়ে যেতে পারে। খেলাধুলো করে?
তা করে। স্কুলের স্পোর্টসে সাতটাতে ফার্স্ট হয়েছে।
গুড, ভেরি গুড।
মহাদেবপুরে ফেরার পথে তন্ময় ওষুধগুলো কিনে নিলেন। গাড়ির পেছনের সিটে তপতী দুই ছেলেকে নিয়ে বসে ছিলেন। সারা পথ তারা খুব কমই কথা বলল। একসময় মিনু জিজ্ঞেস করল, মা, টিবি কি একটা অসুখ?
হ্যাঁ।
চিনুর কি টিবি হয়েছে?
তপতী চমকে উঠে চিনুকে জড়িয়ে ধরলেন। না, হয়নি।
পরদিন তপতী মিলের হাসপাতালে চিনুকে নিয়ে গেলেন। তাকে দেখে অল্পবয়সি ডাক্তার সিনহা অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার বউদি, আপনি এখানে! কিছু হয়েছে নাকি? দাদা কোথায়?
কারও কিছু হয়নি। সবাই ভাল আছে, শুধু আমার এই ছোট ছেলেটা ছাড়া। আপনাকে ভাই দুটো কাজ করে দিতে হবে। আপনার দাদার বন্ধু ডাক্তার হালদার কাল চিনুকে পরীক্ষা করে ওর বুকের এক্স-রে আর মানটু টেস্ট করাতে বললেন। তপতী প্রেসক্রিপশনটা বিস্মিত ডাক্তার সিনহার হাতে তুলে দিলেন। সেটা পড়তে পড়তে ডাক্তার বার-দুই চিনুর দিকে তাকালেন। তপতীকে কিছু বলতে গিয়েও বললেন না।
আপনি একটু বসুন, ব্যবস্থা করছি। ঘর থেকে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন এবং ফিরলেন মিনিট পাঁচেক পর। ওকে নিয়ে আসুন। আপনার ভাগ্য ভাল, এক্স-রে মেশিনটা আজ সুস্থ আছে, চারদিন ধরে কাজ করছিল না।
চিনুর বুকের ছবি নেওয়া হল। ডাক্তার ওর বাঁ হাতের পুরো বাহুতে উঁচ ফুটিয়ে ওষুধ ঢুকিয়ে হাতের সেই জায়গাটায় একটা টাকার মাপের বৃত্ত এঁকে দিলেন কালি দিয়ে। বৃত্তের মধ্যে চামড়ার রং বদলায় কি না বা ফুলে ওঠে কি না সেটা তিনদিন লক্ষ করতে হবে। ব্যাপারগুলো চিনু কৌতূহলভরে দেখে গেল।
তিনদিন ধরে তপতী বারবার চিনুর হাতটা নজর করলেন। বৃত্তের মধ্যে চামড়া ক্রমশই গোলাপি হতে শুরু করল, ওখানকার চামড়াটা ফুলেও উঠল। আর সেই সঙ্গে তপতীও মনে মনে ভেঙে পড়লেন। যা ভয় করেছিলেন বোধ হয় সেটাই তবে ঘটেছে। এবার আর নিজে নয়, তন্ময়কে তিনি চিনুর সঙ্গে পাঠালেন, হাসপাতালে। গম্ভীর মুখে আধঘণ্টা পর তন্ময় ফিরলেন ডাক্তার সিন্হার মানটু টেস্ট রিপোর্ট পকেটে নিয়ে।
কী লিখেছে রিপোর্টে? ব্যাকুল তপতী জিজ্ঞেস করলেন।
যা ভয় করেছিলে তাই, পজিটিভ। কালই ওকে নিয়ে অপূর্বর কাছে যাব। দেরি করব না চিকিৎসা শুরু করতে। তন্ময় অধৈর্য কণ্ঠে বললেন।
.
এক্স-রে থেকে চিনুর ফুসফুসে সামান্য একটা স্পট পেয়েছিলেন ডাক্তার হালদার। তন্ময়কে তিনি বলেন, খাওয়ার ওষুধগুলো লিখে দিচ্ছি, ইঞ্জেকশন। ওখানকার ডাক্তারকে দিয়ে দিইয়ে নিবি। তিন মাস পর আবার এক্স-রে করিয়ে আমায় দেখাবি। একদম ভয় পাবি না, ওর যা হয়েছে সেটা প্রায় কিছুই নয়। এ ছাড়াও তিনি চিনুর খাওয়া, থাকা, পোশাক, ঘোরাফেরা ইত্যাদি বিষয়ে কী কী যত্ন নিতে হবে তাও তন্ময়কে বলে দেন।
এর পরই বসুমল্লিক পরিবারে একটা পরিবর্তন এসে গেল। আলো বাতাস রোদ আসে এমন ঘরে চিনুর থাকা দরকার আর সেরকম দক্ষিণ-পুব ভোলা ঘর বাড়িতে একটাই। বসবার ঘর। তপতী বললেন, দরকার নেই আমার বাইরের লোকজন। আসার, তাদের বসাবার জন্য ঘর। চিনু ওই ঘরেই থাকবে। তন্ময় তাতে সায় দিয়ে বলেন, সোফাটোফাগুলো খাওয়ার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি, কেউ এলে ওখানেই বসবে।
পরিবর্তন এল খাওয়ার ব্যাপারেও। শুধু চিনুর জন্যই নয়, মিনুর জন্যও দুধ, মাখন, ছানা, ডিম, ভেজানো ছোলা-মটর। বেড়ে গেল ডাল ও সবুজ শাকপাতা, উঁটা, মাটির নীচে জন্মাননা আনাজ। পেয়ারা, কলা বা মরসুমি ফল। মাছের পরিমাণও বাড়ল। সপ্তাহে তিনদিন চিকেন স্টু।
রোগটা ছোঁয়াচে, আমার মনে হয় আলাদা বাসন থাকা দরকার চিনুর জন্য। তন্ময়ের এই কথায় সায় দিলেন তপতী। সাবধানের মার নেই, বাড়িতে আরও একটা ছেলে রয়েছে। অতঃপর চিনুর জন্য প্লেট, গ্লাস, বাটি ইত্যাদি কেনা হল।
একদিন রাত্রে সকলের খাওয়াদাওয়ার পর চিনুকে ঘুম পাড়িয়ে তন্ময় ও তপতী খাওয়ার ঘরে বসে কথা বলছিলেন।
এবার থেকে জল ফুটিয়ে খাওয়াই উচিত। এখানে ট্যাঙ্কের যে জল, তাতে কত যে ব্যাকটিরিয়া। তপতীর কথাটাকে সমর্থন করলেন তন্ময়। যদিও তিনি মহাদেবপুরের পৌর বিভাগের কর্তা, তবু তিনি জলের পরিশুদ্ধতায় পুরো আস্থা রাখেন না।
আমাদের এখন মনেপ্রাণে ছেলেদের স্বাস্থ্যের কথাটা ভাবতে হবে। কে ভেবেছিল এমন একটা রোগ, যেটা না খেতে পাওয়া, অস্বাস্থ্যকর জায়গায় থাকা লোকেদেরই হয়, সেই রোগ কিনা আমার ছেলের হল! তন্ময়ের গলায় ক্ষোভ আর অসহায় ক্রোধ। কেন হবে চিনুর, কেন, কেন? এবার থেকে একটা রোগকেও আর বাড়িতে ঢুকতে দেব না। সাধ্যে যতটা কুলোয় আমি চেষ্টা করে যাব।
সেজন্য তা হলে খরচ করতে হবে। তপতী দ্বিধাভরে বললেন। সংসারটা তাঁকেই চালাতে হয় এবং সেজন্য নির্ভর করতে হয় স্বামীর বাঁধা বেতনের ওপর।
করব খরচ। ছেলেদুটোই তো আমাদের সবকিছু। ওদের সবল, সুস্থ রাখা, লেখাপড়া শিখিয়ে দশজনের একজন করে তোলা, এজন্য আমার শেষ কপর্দকও খরচ করব। কথাগুলো বলে তন্ময় এমনভাবে তপতীর দিকে তাকালেন, যেন জটিল একটা অঙ্ক কষে ফেলে ফলটা ঠিক হয়েছে কি না জানতে চাইছেন।
এজন্য আমাদের কষ্ট করতে হবে। তপতী শান্তস্বরে বললেন।
হবেই তো। কষ্ট না করলে কি সফল হওয়া যায়? তন্ময় উত্তেজিত হয়ে তালুতে ঘুসি বসালেন।
দেখো, আমার মনে হচ্ছে মিনুর এই দাবা খেলাটা বন্ধ করতে হবে। এটা নেশার মতো ওকে পেয়ে বসেছে। আগে বিকেলে মাঠে খেলতে যেত, এখন যায় না। এইটুকু ছেলের পক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকাটা ভাল নয়।
তা তো নয়ই, কিন্তু করবটা কী? তন্ময়কে অসহায় দেখাল।
কিছু একটা তো করতে হবে। তপতীর স্বরে দৃঢ়তা ফুটে উঠল।
.
প্রতিদিনের মতো মিনু আর চিনুকে নিয়ে তপতী ভোরে বেড়াতে বেরিয়েছেন। রোজই তারা হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে যায়। পিচঢালা রাস্তাটা ফেরিঘাটে শেষ হয়েছে। সেখানে একটা কাঠের বেঞ্চে তারা বসে। ভোরের নির্মল বাতাস নদীর ওপর দিয়ে এসে তাদের শরীরকে তাজা করে তোলে। বুকভরে তারা টাটকা বাতাস জমা করে। ফেরার সময় মিনু দৌড়য়। তখন চিনু বলে, মা, দাদার সঙ্গে আমিও দৌড়ে বাড়ি যাব। তপতী ওকে দৌড়তে দেন না। আগে ডাক্তারবাবু বলুন, তারপর।
কিন্তু আজ চিনু বায়না ধরল, সে দৌড়বেই। কী ভেবে তপতী বললেন, আচ্ছা। কিন্তু জোরে নয়।
.
মিনু লম্বা কদমে জোরেই ছুটতে শুরু করল, তার পেছনে চিনু। ভোরের নির্জন রাস্তায় তখন গাড়ি চলা শুরু হয় না। ওরা নিশ্চিন্তেই ছুটছিল। বড় রাস্তা থেকে বাঁ দিকে বেঁকে ওরা একটা সরু রাস্তায় ঢুকে গেল। তপতী হাঁটার বেগ বাড়ালেন, ছেলেরা তাঁর দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হতেই।
মিনুর অনেক পেছনে চিনু। রাস্তার দুধারে মিলের ব্যারাক। কম মাইনের শ্রমিকরা এখানে থাকে। একতলা টানা লম্বা বাড়িগুলো ছাড়িয়ে কিছুটা ফাঁকা মাঠ, তারপর ডান দিকে ফিরে আবার একটা চওড়া রাস্তা। মিনু ব্যারাকটার শেষপ্রান্তে যখন পৌঁছেছে তখন কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়েই থেমে। পড়ল। চিনু ভয়ে সিঁটিয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আর দুটো কুকুর তাকে কামড়াবার জন্য তেড়ে যাচ্ছে পায়ের গোড়ালি তাক করে।
চিইনউউ। বলে চিৎকার করে মিনু পাগলের মতো ছুটতে শুরু করল ছোট ভাইয়ের দিকে। দাদাকে ছুটে আসতে দেখে চিনু প্রায় চোখ বুজে মিনুর দিকে ছুট দিল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুর দুটো তার পিছু নিল। মিনু যখন জড়িয়ে ধরল ভাইকে,
একটা কুকুর তখন চিনুর কেডসে প্রায় দাঁত ছুঁইয়ে ফেলেছে। চিনুকে পিছনে। ঠেলে দিয়ে মিনু দুহাত মুঠো করে শূন্যে এলোপাথাড়ি ঘুসি চালাতে শুরু করে দিল। কুকুর দুটো আর না এগিয়ে দাঁত বার করে বারবার তেড়ে যেতে লাগল।
সেই সময় ব্যারাক থেকে একটা লোক বেরিয়ে এসে, দুটো তেরিয়া কুকুরের সামনে একটি ছেলেকে ঘুসি চালিয়ে যেতে দেখে কুকুরদুটোকে ধমকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, আর কিছু করবে না, এবার তোমরা যাও। তবে ছুটো না।
মিনু ভাইয়ের কাঁধ একহাতে জড়িয়ে ধরে টানল, ভয় কী রে? আমি থাকতে ভয়ের কিছু নেই। চল, এবার হেঁটে হেঁটে যাই। খানিকটা গিয়ে আবার দৌড়ব।
চিনু থরথর কাঁপছে। ভয়ে ফ্যাকাসে মুখে রক্ত তখনও ফিরে আসেনি। দাদার হাত আঁকড়ে ধরে বলল, কামড়ে আমার মাংস খুবলে নিত, না রে?
অত সোজা যেন, খোবলাব বললেই যেন খোবলানো যায়। টেনে এমন একটা লাথি মারতাম যে, দাঁতগুলো ভেঙে যেত। মিনু লাথি ছুড়ে দেখাল। তাচ্ছিল্যে ঠোঁট বাঁকাল।
দাদা, তুই মাকে বলে দিবি না তো?
বললে কী হয়েছে?
মা তা হলে আমায় আর ছুটতে দেবে না।
তা হলে ছোট আমার সঙ্গে। না ছুটলে অসুখ সারবে না।
ঘটনাটার কথা তপতী জানতে পারেননি। তার বদলে জানতে পারলেন আর একটা কথা। যেভাবেই হোক চিনুর অসুখটার কথা গোপন করা সত্ত্বেও অনেকেই জেনে গেছল। একদিন মিনু স্কুল থেকে ফিরে এসে তপতীকে বলল, জানো মা, সুব্রত আজ আমার ওয়াটারবল থেকে জল খেল না।
কেন? তুই জল দিতে গেছলি কেন?
ও আজ ওয়াটারবটল নিয়ে যেতে ভুলে গেছল। ক্লাসে ওর খুব তেষ্টা পেয়েছিল তাই দিলীপের কাছে জল চাইল। আমি বললুম, আমারটা থেকে খা, ও বলল, তোর ওয়াটারবটল থেকে জল খাব না। তোদের বাড়িতে ক্ষয়রোগের রুগি আছে। তোর জল খেলে আমারও ক্ষয়রোগ হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ক্ষয়রোগ কাকে বলে? ও বলল, ক্ষয়ে ক্ষয়ে ভ্যানিশ হয়ে যায় বলে এর নাম ক্ষয়রোগ। হ্যাঁ মা, সত্যি? চিনু ভ্যানিশ হয়ে যাবে?।
শুনতে শুনতে তপতীর চোখে জল এসে গেল। কথাগুলো নিশ্চয় সুব্রত বাড়িতে শুনেছে বলেই বলেছে। বাড়ির লোকরা কী নিষ্ঠুরের মতো এইরকম কথাবার্তা বলেছে! সুব্রত মজুমদারের মা প্রতিভা খুবই অমায়িক, মিষ্টভাষী, প্রায়ই স্বামীর সঙ্গে অফিসার্স ক্লাবে যান, সেখানে গল্পের আসর বসান। তপতীকে দেখলেই বলেন, এই যে পূর্ণিমা, তোমার অমাবস্যাটি কোথায়?
গরম লোহার শিকের মতো ভ্যানিশ শব্দটা ঢুকে গিয়ে তপতীর মাথাটা গরম করে দিল। একটা জেদ তাঁকে ধীরে ধীরে পেয়ে বসল। তিনি স্থির করলেন আজই ক্লাবে যাবেন এবং চিনুকে সঙ্গে নিয়ে।
সন্ধ্যার পর বসুমল্লিকরা চিনুকে নিয়ে ক্লাবের সামনে ভক্সহল থেকে নামলেন। সঙ্গে ফুটোনো জলে ভরা ওয়াটারবক্স। মিনুকে তাঁরা সঙ্গে আনেননি। ক্লাবের লনে ছোট ছোট টেল ঘিরে চেয়ার। দশ বারোটি দম্পতি এবং তাঁদের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা চেয়ার ভরিয়ে রেখেছে। একটি টেক্ল ঘিরে পাঁচজন মহিলা, তাদের মাঝে প্রতিভা মজুমদার হাত নেড়ে নেড়ে, ভূ নাচিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন, বাকি চারজন মুগ্ধ হয়ে শুনছেন। তপতী আর তন্ময়কে দেখে প্রতিভা আজ আর হাত তুললেন না। ফিসফিস করে অন্যদের কী যেন বললেন। সকলেই মুখ ঘুরিয়ে বসুমল্লিকদের দিকে তাকাল।
লনের মাঝখানে লোহার পোস্টের মাথায় উজ্জ্বল বিদ্যুতের আলো। তার নীচে একটা ফাঁকা টেলে ওঁরা বসলেন। বেয়ারা এল, কিছু খাবে কি না জানতে।
কী আছে আজ? তন্ময় জানতে চাইলেন।
চিকেন পকৌড়া, শিঙাড়া, চানা-মটর।
তন্ময় হাত তুলে বেয়ারাকে থামিয়ে দিলেন। ওসব খাবার চলবে না।
তিন গ্লাস জল দাও আগে, তারপর এক পট চা আর তিনটে কাপ। তপতী ফরমায়েশ দিলেন। তারপর চিনুকে বললেন, যা, দোলনায় চড় গিয়ে।
একধারে দুটি দোলনা, স্লিপ এবং সি-স্য রয়েছে বাচ্চাদের খেলার জন্য। কিছু বাচ্চা খেলছে। দোলনায় দুলছে দুটি মেয়ে। চিনু গিয়ে দোলনার পাশে অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎই প্রতিভাদের টেক্ল থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, শিলু, শিগগির চলে এসো এখানে। কিন্তু শিলু নামের মেয়েটি মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে দুলেই চলল। তার মা উঠে গিয়ে দোলনা থামিয়ে শিলুর গালে চড় কষিয়ে টানতে টানতে নিয়ে এলেন।
খালি দোলনাটায় চিনু উঠতে পারছিল না, তপতী উঠে গিয়ে তাকে বসিয়ে দিয়ে দোল দিতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেক পর ছেলেকে নিয়ে টেলে ফিরে এলেন। বেয়ারা চা ও জল দিয়ে গেছে। একটা গ্লাস থেকে জল ফেলে দিয়ে বাড়ি থেকে আনা জল তাতে ভরে চিনুকে বললেন, একটু জল খা।
চিনু যখন জল খাচ্ছে, তপতী আড়চোখে দেখলেন প্রতিভা তাঁদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তিনটি কাপে তিনি চা ঢাললেন, তবে একটিতে যৎসামান্য। সেটি চিনুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন এক চুমুক, ব্যস। জীবনে চা খায়নি চিনু, সে অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। যা বলছি কর, ঠিক এক চুমুক।
চিনু তাই করল। তপতী আড়চোখে তাকালেন আবার এবং মনে মনে হাসলেন। সেই সময় ক্লাবে ঢুকল রাজেন এবং শুভা। বসুমল্লিকদের দেখতে পেয়ে তাদের টেবলেই ওরা এসে বসল। বেয়ারা এল। কী খাদ্য আছে, জানতে চাইল রাজেন এবং শুনে নিয়ে সে তন্ময়কে বলল, দাদা তা হলে পকৌড়াই আনাই। বউদি, শিঙাড়া চলবে?।
না। হেসে তপতী বললেন, কোনওটাই না।
সে কী! আমি তো আপনাদের খেতে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।
যে খাবার আমার ছেলেদের খেতে দিই না, সে খাবার এখন আমরাও খাচ্ছি না। তন্ময় উত্তর দিলেন। আসলে চিনুর এই অসুখটাই আমাদের সচেতন করে দিয়েছে। আমাদের, মানে ছেলেদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারটা। ওদের ভাল স্বাস্থ্য গড়ে দেওয়ার কাজে আমরা নেমেছি। সেজন্য কিছু বিধিনিষেধ আমরা মানছি। তার মধ্যে রয়েছে এই খাওয়ার ব্যাপারটা। মুখরোচক এইসব খাবার ওদের খেতে দিই না, সেজন্য আমরাও খাই না। তন্ময় হাসতে শুরু করলেন।
দারুণ কাজে নেমেছেন তো। এই বলে রাজেন পাশে দাঁড়ানো বেয়ারাকে বলল, শুধু চা দাও।
কিছু খাবে না তোমরা! তন্ময় বললেন কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হয়ে।
না দাদা। কিছু বিধিনিষেধ আমিও আজ জারি করলাম। যে খাবার আপনারা খাবেন না, সে খাবার…।
রাজেন শেষ করার আগেই তন্ময় হেসে উঠলেন। নিষেধ মেনে শেষ পর্যন্ত চলতে পারবে তো? বাঙালির নোলা বিশ্বাসঘাতকতায় খুব পটু।
আপনাদের একটা কাজের তো পরিচয় পেলাম, এর পর আর কী কাজে নেমেছেন?
নামা হয়নি, তবে নামার জন্য চিন্তা করছি। তপতী বললেন। ওদের কোনও একটা খেলা শেখানোর ব্যবস্থা করা। শুধুমাত্র পুষ্টিকর খাওয়া দিয়েই তো স্বাস্থ্য হয় না, শরীর গড়তে পরিশ্রমেরও দরকার হয়।
আচ্ছা রাজেন, ওদের কোন খেলা শেখানো যায় বলো তো?
তন্ময়ের বলার ভঙ্গিতে বোঝা গেল তিনি এটা নিয়ে চিন্তিত।
এখানে খেলা শেখানো! ভ্রূ কপালে তুলে রাজেন হতাশভাবে মাথা নাড়ল। এখানে মাঠটাঠ আছে, কিন্তু লোকের কোনও উৎসাহ নেই। এই দেখুন না ওই যে টেনিস কোর্টটা, কত বড় বড় ঘাস গজিয়ে গেছে, কেউ খেলে না বলেই তো! সবাই তাস আর ক্যারম খেলে চা-শিঙাড়া খেয়ে বাড়ি চলে যায়। অথচ খেলার জন্য নেট, কিছু পুরনো বল ক্লাবে পড়ে আছে। ঘাস ছাঁটাইয়ের জন্য একটা লন মোয়ারও রয়েছে।
একদিন মিস্টার ভটচাযকে বলেছিলাম, নতুন সেক্রেটারি হলেন, ক্লাবের হালটা একটু ফেরান। শুধু আড্ডা দেওয়া ছাড়াও মেম্বাররা যাতে একটু ছোটাছুটি করে ঘাম ঝরাতে পারে, তার ব্যবস্থা করুন না! উনি বললেন, কী ব্যবস্থা করব বলুন? টেবল টেনিস বোর্ড কেনার জন্য কমিটি মিটিংয়ে প্রপোজাল দিলাম, সবাই। হাঁ হাঁ করে উঠল। বলল, বোর্ড পাতবেন, জায়গা কোথায়? আসলে বোর্ড পাতলে তাস খেলার টেলগুলো তুলে দিতে হবে তো। বললাম, টেনিস কোর্টটাকে ঠিকঠাক করে দেখুন না আবার চালু করা যায় কি না। উনি বললেন, কিসসু হবে না, খেলার লোকই পাওয়া যাবে না। আপনাকে একা একাই খেলতে হবে। ভেবে দেখলাম, মিস্টার ভটচায় বাজে কথা বলেননি। তবে লোকটা খেলা। ভালবাসেন।
রাজেন নিরুৎসাহিত গলায় কথাগুলো বলে চায়ের কাপ নেওয়ার জন্য শুভার দিকে হাত বাড়াল। তপতী মুখ ঘুরিয়ে অন্ধকার টেনিস কোর্টটার দিকে তাকালেন। কিছু একটা তিনি ভাবছেন। প্রতিভাদের টেবলের মহিলারা উঠলেন। বাড়ি যাওয়ার জন্য ছেলেমেয়েদের ডাকাডাকি শুরু হল।
আমি একবার মিস্টার ভটচাযের সঙ্গে দেখা করব। তপতী বললেন।
কেন? তন্ময় জানতে চাইলেন।
যদি কোর্টটাকে আবার জাগিয়ে তোলা যায়। দেখি উনি ক্লাবঘরে আছেন কি না। তপতী চেয়ার থেকে উঠলেন। কয়েক পা যেতেই পড়লেন প্রতিভার সামনে।
তোমার ছোট ছেলের নাকি খুব অসুখ হয়েছে শুনলাম, অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মুখ প্রতিভার। অসুখটা যেন তাঁর নিজের ছেলেরই হয়েছে।
হ্যাঁ।
আহা রে, একেই তো বরাবরের রুগণ, তার ওপর আবার অসুখ, ছেলেটার যে কী কপাল! অসুখটা কী?
টিউবারকুলাসিস, যাকে বলে ক্ষয়রোগ। তপতী ধীর স্বরে বললেন।
ও মা! টিইবিই! ভাল ডাক্তার দেখাচ্ছ তো?
দেখাচ্ছি।
এখন কেমন আছে? মুখ দিয়ে রক্ত উক্ত ওঠে?
ওই তো বসে রয়েছে দেখুন না! এখন চিনু ভোরে ওর দাদার সঙ্গে ছোটে।
না, না, না, ছোটাছুটি করিও না, ফুসফুস ড্যামেজ হলে ধুকতে ধুকতে সারা জীবন কাটাবে, চিরকালের মতো অক্ষম হয়ে যাবে।
আর নয়তো ক্ষয়ে ক্ষয়ে ভ্যানিশ হয়ে যাবে। তপতী হাসতে শুরু করলেন। প্রতিভা সন্দিহান চোখে তপতীর হাসি দেখতে দেখতে গম্ভীর হয়ে গেলেন।
যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে। বলে প্রতিভা হনহনিয়ে এগিয়ে গেলেন।
ক্লাবের অফিসে বসে কমল ভটচায় দুজন মেম্বারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। প্লাইউডের পার্টিশন করা খোপের মতো একটা ঘর। দরজায় পাল্লার বদলে একটা পরদা ঝুলছে। তপতীকে দেখে কমল ভটচায় অবাক হলেন।
আপনি! কী ব্যাপার? বসুন, বসুন।
একটা বিষয়ে একটু কথা বলতে এসেছি। একমাত্র খালি চেয়ারটায় বসে তপতী কোনও ভণিতা না করে বললেন, ক্লাবের টেনিস কোর্টটাতে খেলার ব্যবস্থা করুন। জানি মেম্বারদের খুব একটা উৎসাহ নেই, কিন্তু তাদের ছেলে মেয়েদের ততা থাকতে পারে।
কমল ভটচায আচমকা এমন একটা অনুরোধের সামনে পড়ে ভেবে পেলেন না কী জবাব দেবেন। কিন্তু কিন্তু করে বললেন, এমন একটা প্রস্তাব অবশ্য রাজেন রায়চৌধুরী একবার আমাকে দিয়েছিলেন। উনি তো একসময় কলকাতায় টেনিস খেলতেন, শুনেছি ভালই খেলতেন, তাই হয়তো টেনিস প্রীতিতেই কথাটা তুলেছিলেন। কিন্তু মিসেস বসুমল্লিক, অসুবিধেটা কী জানেন, মেম্বাররা সারাদিন নানান শিফটে মিল আর অফিস করে রিল্যাক্স করার জন্য এখানে আসেন, তাই কেউ আর টেনিস নিয়ে উৎসাহী হন না। তবে আপনি যেটা বললেন, ছেলেমেয়েদের কথাটা, হ্যাঁ, এটা ভেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু করে কে? কোর্টটায় শুধু বড় বড় ঘাসই নয়, বড় বড় গর্তও আছে। খোয়া, নুড়ি ছড়ানো, জমি অসমান। রীতিমতো মেহনত করতে হবে ওটাকে নিয়ে। এদিকে ক্লাবে একজন বেয়ারা, একজন কুক। মালি ছিল, তাকে এই মাসেই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাসের অর্ধেক দিন তার দেখাই পাওয়া যেত না।
আপনার অসুবিধেগুলো আমি বুঝতে পারছি। তপতী নম্র আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন। কিন্তু কেউ যদি দায়িত্বটা নেয় তা হলে কি আপনি সাহায্য করবেন?
নিশ্চয় করব। কিন্তু সাহায্য বলতে কী বোঝাচ্ছেন? আপাতত আমার লোকবল নেই। বেয়ারা কি কুক, মাঠের কাজ করবে না বললে তাদের দিয়ে করাতে পারব না। অর্থবলও তেমন নেই যে, লোক ভাড়া করতে পারব। নামেই অফিসার্স ক্লাব, অর্ধেক মেম্বারই তিন-চার মাসের চাঁদা বাকি ফেলেছেন। তাই নিয়েই তো এঁদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কমল ভটচায় হাত দিয়ে দেখালেন এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা দুজনকে।
লোকজন বা টাকা কিছুই দিতে হবে না, শুধু কোদাল, ঝুড়ি, বালতি, জল এইসব; আর লন-মোয়ারটা দিলেই হবে।
মোয়ারটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে। একটা চাকা আর কী যেন ভেঙেছে।
সে আমি সারিয়ে নেব।… তা হলে আপনি অনুমতি দিচ্ছেন।
অবশ্যই। যদি দায়িত্ব নিয়ে কোর্টটাকে উদ্ধার করতে পারেন তা হলে সত্যিই একটা কাজের কাজ হবে। কিন্তু মিসেস বসুমল্লিক— কমল ভটচায থেমে গলা নামিয়ে বললেন, খেলার জন্য তোক পাবেন তো?
নেটের দুধারে দাঁড়াবার জন্য ইতিমধ্যেই দুজনকে পেয়ে গেছি—আমার বড়। ছেলে আর আমি।
.
০৩.
পরদিন ভোরে ফেরিঘাট থেকে মিনু ও চিনু দৌড় শুরু করার পর তপতী। হাঁটতে শুরু করলেন বাড়ির বদলে ক্লাবের দিকে। উদ্দেশ্য, দিনের আলোয় ভাল করে কোর্টের অবস্থাটা দেখে নেওয়া।
মিনিট কুড়ি পর তিনি পৌঁছলেন। রাত্রে ক্লাবঘরে শশায় বেয়ারা কান্তি। তার দেশ নদিয়া জেলার এক গ্রামে। বাড়িতে বউ, ছেলে মেয়ে আছে। বয়স্ক লোক, মানুষ ভাল। সে তপতীকে চেনে। এত সকালে মেমসায়েবকে ক্লাবে দেখে কান্তি হতভম্ব।
মালি তার জিনিসপত্র কোথায় রাখে কান্তি, আমি একটু দেখব।
ক্লাবঘরের পেছনে একটা ঢাকা জায়গায় মোয়ারটা দেয়ালে ঠেস দেওয়া। একটা চাকা খোলা, তবে ভাঙেনি। ছাঁটাই হওয়া ঘাস যে লোহার ডালাটায় পড়ে, সেটা ঝুলে রয়েছে। ঘাস ছাঁটাই করার একটা ব্লেড ভাঙা। কোদাল একটা আছে। বটে, তার বাঁশের হাতলটা নেই। একটা শাবলও রয়েছে। কোনও ঝুড়ি নেই। টেনিসের নেটটা খুঁজে পাওয়া গেল না।
আপনি কী করবেন এসব দিয়ে? কান্তি তো অবাক!
মাঠ বানাব। ওই টেনিস কোর্টটাকে খেলার যোগ্য করে তুলতে হবে।
আপনি করবেন?
লোক দিয়ে করাতে হবে।
কোর্টের অবস্থা দেখে তপতীর কপালে দু-তিনটে ভাঁজ পড়ল। ঘাস এত লম্বা যে, প্রথমে হেঁসো দিয়ে না কাটলে মোয়ার চালানো যাবে না। জমিতে কয়েকটা জায়গায় মাটি ফেলতে হবে, গর্ত বোজাতে হবে, ঢিপির মতো উঁচু জায়গায় মাটি চাঁছতে হবে আর ভাঙা ইটের টুকরো, কাঁকর বাছতে হবে। এত হবে কিন্তু তাঁকে দমাতে পারল না। প্রথমেই মোয়ারটা সারাতে হবে, একটা কি দুটো মাটি ফেলার ও তোলার ঝুড়ি চাই, কোদালের জন্য হাতলও।
কান্তি, একজন কি দুজন মজুর জোগাড় করতে পারবে? আর একজন ঘেসুড়ে?
তা পারা যাবে।
তোমাকে আমি পরশু বলব।
তপতী যখন বাড়ি ফিরলেন সবাই তখন খাওয়ার টেবলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল।
কেমন দেখলে? তন্ময় জানতে চাইলেন।
যা দেখব ভেবেছিলাম তাই দেখলাম। তবে হয়ে যাবে। তোমার একটু সাহায্য চাই। মোয়ারটা ভাঙাচোরা, ওটাকে সারাতে হবে। তোমার তো অনেক মিস্ত্রি আছে, একজনকে পাঠিয়ে দাও না ওটা ঠিক করে দেবে।
পাঠাব। আর কী দেখলে?
দেখলাম বেশ কিছু টাকা খরচ করতে হবে, মিস্ত্রি লাগাতে হবে।
টাকা! তন্ময় নড়েচড়ে বসলেন। চিনুর চিকিৎসা আর সুষম পুষ্টিকর খাদ্য চালু হয়ে সংসার খরচ যথেষ্ট বেড়ে গেছে। মাইনের টাকা হিসেব করে খরচ করতে হচ্ছে এবং খরচটা করে তপতী। সুতরাং টেনিস কোর্ট সংস্কারের জন্য খরচের টাকা যে তাঁদের পক্ষে দেওয়া কষ্টকর হবে, এটা তপতী জানেন।
টাকা আমাদের খরচ করতে হবে নাকি! ক্লাব দেবে। মেম্বারদের ছেলেমেয়েরাই তো খেলবে। তন্ময় মৃদু স্বরে আপত্তি জানালেন।
মনে রেখো মেম্বারদের ছেলে মেয়েদের মধ্যে আমাদেরও দুটো ছেলে আছে। ওদের মুখ চেয়ে একাজ আমায় করতেই হবে। আমি মেম্বারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলব। তপতীর চোখ জ্বলজ্বলে, কণ্ঠস্বরে আবেগ এবং দৃঢ়তা!
চাঁদা তুলবে! কত করে চাঁদা?
দশ টাকা প্রতি ফ্যামিলি। একবারই শুধু দিতে হবে।
দঅঅশ টাকা! তন্ময়ের চোয়াল ঝুলে পড়ল। জান, এই দশ টাকায় বারো সের চাল পাওয়া যায়, আড়াই মাস খবরের কাগজ কেনা যায়…।
দুটো হরলিক্স কেনা যায়, চার সের সর্ষের তেল কেনা যায়, চার সের পাঁঠার মাংস কেনা যায়… তাতে কী হল? তপতীর চোখে চ্যালেঞ্জ।
এত টাকা কি কেউ বাচ্চার খেলার জন্য দেবে? তন্ময় স্পষ্টতই সন্দেহ প্রকাশ করলেন। প্রাইভেট টিউটর রাখার জন্য টাকা খরচ করতে বললে করবে কিন্তু ছেলে মেয়ের খেলার জন্য…। তন্ময় কথা অসম্পূর্ণ রেখে মাথা নাড়লেন।
এসব হতাশার কথা। আগে সবাইকে বলে তো দেখি।
ঠিক আছে, বলে দেখো। তন্ময়ের মুখ দেখে মনে হল না তিনি হতাশা কাটাতে পেরেছেন।
মিনু-চিনু চুপ করে খেয়ে যাচ্ছিল আর বাবা-মার কথা শুনছিল। এবার মিনু বলল, মা, আমি টেনিস খেলব?
হ্যাঁ।
আর কে খেলবে?
এখানকার সবাই খেলবে।
চিনু ফিসফিস করে বলল, মা আমি?
সোমবার তোমার এক্স-রে করার দিন। কলকাতায় ডাক্তারকাকা সেটা দেখবেন। তারপর তিনি যদি খেলতে বলেন তো খেলবে।
মা, তুমিও খেলবে? আগে তো খেলতে! মিনু বলল।
হ্যাঁ, আমিও খেলব… যদি দরকার পড়ে।
আরে মিসেস বসুমল্লিক! কী ব্যাপার? সুধা ঘোষাল অবাক হয়ে অভ্যর্থনা জানালেন তপতীকে। বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ার টেনে বললেন, বসুন, বসুন। অনেকদিন পর এলেন।
মাস তিনেক প্রায়। ছোট ছেলের অসুখের জন্য কোথাও আর যেতে পারি না। চেয়ারে বসলেন তপতী। সুধা ঘোষালের স্বামী এখানকার চিফ লেবার অফিসার। ওঁদের এক ছেলে সুধেন্দু ক্লাস সেভেন-এ পড়ে।
ছেলে এখন কেমন আছে?
ভাল। অল্প অল্প ছুটছে, কোনও কষ্ট হচ্ছে না।
ভোরে তো দেখি দুই ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে বেরোন, খুব ভাল এটা। আমিও মাঝে মাঝে ভাবি সকালে একটু বেড়াই। কিন্তু মুশকিল কী জানেন, ডান হাঁটুতে একটু বাতের মতো হয়েছে, তা ছাড়া সুধেন্দুকে নিয়ে পড়াতে বসতে হয়। ক্লাস সেভেন থেকে যদি পড়ায় জোর না দেয় তা হলে স্কুল ফাইনালে ভাল। রেজাল্ট করবে কী করে?
স্কুল ফাইনালের তো এখনও অনেক দেরি।
অনেক দেরি! সুধা ঘোষাল আর্তনাদ করে উঠলেন। মাত্র চারটে বছর, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। একে আপনি অনেক দেরি বলছেন?
তপতীর মনে হল, সুধা ঘোষাল এমনভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে, যেন একটা মানুষকে হঠাৎ বনমানুষে রূপান্তরিত হতে দেখলেন। তিনি অপ্রতিভ বোধ করে সুধা ঘোষালকে তুষ্ট করার জন্য বললেন, সুধেন্দু তো পড়াশোনায় খুবই ভাল, অমন ছেলে কটা আর হয়, এবারও তো ফাস্ট হয়ে উঠল।
সেটা তো স্কুলের ফার্স্ট, কিন্তু গোটা বাংলার তো নয়! ওর বাবা এম এসসি-তে ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড হয়েছিল, আমি বি এ-তে ডিস্টিংশন পেয়েছি। সুধেন্দুকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট তো হতেই হবে। ওর বাবা তো বলে, ছেলে বাপকে ছাড়িয়ে না গেলে সে আর ছেলে কীসের? তবে ছেলেও বাপ-মায়ের মন বোঝে, সবসময় পড়ার বই নিয়ে থাকে।
কিন্তু মিসেস ঘোষাল, আপনাদের যেমন ইচ্ছে তেমনি ছেলেরও তো কিছু ইচ্ছে থাকতে পারে।
ছেলের ইচ্ছে! সুধেন্দুর? ওর একটাই ইচ্ছে, বাপ-মার মুখ উজ্জ্বল করা, আই এ এস, কি আই পি এস হয়ে সমাজের একজন হওয়া। সেইভাবেই আমরা ওকে তৈরি করতে চাই।
ওর বয়স এখন কত, তেরো?
হ্যাঁ।
এই বয়সের ছেলেদের তো খেলতে ইচ্ছে করে, আর সেইজন্যই আপনার কাছে আসা। সুধা ঘোষালকে কথা বলার কোনও সুযোগ না দিয়ে তপতী বলে চললেন, ক্লাবে যে টেনিস কোর্টটা পড়ে আছে সেটাকে সংস্কার করে ছেলে মেয়েদের খেলার ব্যবস্থা করতে চাই, সেজন্য কিছু টাকার দরকার, তাই আপনার কাছে এসেছি যদি দশটা টাকা চাঁদা দেন। সুধেন্দুর বিকেলে একটা কিছু খেলা তো দরকার। তপতী শেষ বাক্যটির ওপর ভরসা করলেন। ছেলের খেলার একটা ব্যবস্থা হলে কোন মা আর টাকা না দিয়ে থাকতে পারবেন! কিন্তু ফল হল বিপরীত।
বিকেলে খেলা? …পাঁচটার সময় সুধেন্দুর ইংলিশ টিউটর আসে। এই তো ভেতরের পড়বার ঘরে ও এখন পড়ছে। সকালে আমি পড়াই, বিকেলে টিউটর, অফিস থেকে ফিরে ওর বাবা ওকে নিয়ে বসেন। ওর খেলার সময় কোথায়? আমরা তো ওকে বারবার বলি জীবনে এখনই পড়ার সময়, যা কিছু জ্ঞান এখনই আহরণ করে নাও, খেলার জন্য পরে অনেক সময় পাবে, ঠিক কি না বলুন?
তপতী ঢোঁক গিললেন। বলছিলাম কী, যদি দশটা টাকা চাঁদা—
না, না, না, সুধেন্দুকে পড়া ফেলে খেলতে আমরা পাঠাব না। এই দেখুন আপনাকে চা দেওয়া হল না।
চা খাব না, আমি এখন উঠি। আরও কয়েকজনের কাছে যেতে হবে। তপতী চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন।
.
তপতীদি, আপনি যা করতে চাইছেন সেটা তো খুবই ভাল। ছেলে মেয়েদের সত্যিই এখানে নিয়মিত খেলার কোনও ব্যবস্থা নেই। চন্দ্রিমা দত্ত তাঁর পাঁচ বছরের মেয়ে লঘিমাকে কোলের কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বললেন। আমি তো সেইজন্যই লঘুকে নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়েছি।
খুব ভাল করেছ। তবে ফিজিক্যাল এক্সারসাইজটাও যদি ওই সঙ্গে করে, তা হলে নাচটা আরও ভাল হবে।
তা হয়তো হবে। কিন্তু তপতীদি, টেনিস আর নাচ দুটো চালানো ওর পক্ষে অসম্ভব! বাড়িতে রেগুলার নাচের প্র্যাকটিস, তার সঙ্গে টেনিস, এইটুকু বাচ্চা, দেখছেনই তো শরীরের হাল, নিতে পারবে না।
তপতী বুঝে গেলেন, চন্দ্রিমার কাছ থেকে কিছু পাওয়া যাবে না। নিজের ছেলে মেয়েরা না খেললে তারা চাঁদাও দেবে না। তবু তিনি বললেন, বেশ, লঘু নয় খেলতে পারবে না, কিন্তু অন্য অনেকের ছেলে মেয়ে তো খেলবে, তুমি চাঁদার দশটা টাকা দাও। স্রেফ চ্যারিটি।
উনি তো এখন নেই, বাড়ি আসুন, ওঁকে বলব।
তপতী আর কথা বাড়ালেন না। ধরে নিলেন কিছু পাওয়া যাবে না।
.
সুভাষ সেন অমায়িক, মার্জিত এবং এম জে টি এম-এর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যানেজার। তপতীর কথা মন দিয়ে শুনে চশমার কাচ রুমালে মুছতে মুছতে বললেন, মিসেস বসুমল্লিক আপনার উদ্যোগের সঙ্গে আমি শতকরা একশো ভাগ একমত। কিন্তু মুশকিল একটাই, আর দুমাস পর শঙ্কু শান্তিনিকেতন চলে যাচ্ছে। ওখানে পাঠভবনে পড়বে।
তা হলে তো আর কিছু বলার নেই। তপতী মুখে হাসি টেনে আনলেন। বাংলোর সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছেন, পেছন থেকে ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সুভাষ সেনের হাতে মানিব্যাগ, তাই থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করেছেন। এটা নিয়ে যান।
তপতী বাড়ি ফিরলেন তিরিশ টাকা সংগ্রহ করে। অনিরুদ্ধ আর গৌতমের বাবা-মা খুব উৎসাহিত হয়েই চাঁদা দিয়েছেন। তন্ময় জানালেন কাল সকালে মেশিন শপের একজন যাবে লন-মোয়ারটা নিয়ে আসার জন্য। একদিনেই সম্ভবত সারানো যাবে।
কিন্তু তিরিশ টাকায় কী হবে? তন্ময় প্রশ্ন তুললেন।
বাকিটা আমাদেরই দিতে হবে। তপতী শান্ত স্বরে স্বামীর চোখে চোখ রেখে বললেন। আমাদের ছেলেদের মুখ চেয়েই খরচ করতে হবে। একদিন বলেছিলে, ওদের সুস্থ সবল রাখা, ভাল স্বাস্থ্য গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব বাবা-মার। এজন্য শেষ কপর্দকটুকুও খরচ করবে।
বলেছিলাম।
তা হলে অমন চোখ করে তাকিয়ে আছ কেন?
তাকিয়ে নেই, শুধু ভেবে যাচ্ছি। আমার অফিসের একটা ছেলের বিয়ে, নেমন্তন্ন করেছে। এগারোশো টাকা মাইনে থেকে সংসার খরচ, চিকিৎসা, গাড়ির পেট্রল, মেজ জ্যাঠার বাড়িতেও বিয়ে এই মাসেই। বিয়ের উপহার আর টেনিস কোর্ট ম্যানেজ করব কী করে?
কিছু কিছু খরচ কমিয়ে ম্যানেজ করতে হবে। কমানোর প্রথম ধাপ হোক। গাড়ি আর না চড়া। চিনু স্কুলে যায় না, মিনু হেঁটেই যাতায়াত করতে পারবে, আমি সঙ্গে যাব। তুমিও হেঁটে অফিস যাবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, ভুঁড়ি হয়ে যাচ্ছে তাই হাঁটছি।
পরশু এক্স-রে করিয়ে চিনুকে কলকাতা নিয়ে যেতে হবে। কীসে যাব, ট্রেনে?
মোটরে। এটা ব্যতিক্রম বলেই ধরতে হবে।
পরদিন মিনুকে নিয়ে তপতী বেরোলেন স্কুলে পৌঁছে দিতে। দুজনের মাথায় দুটো ছাতা। মিনু প্রথমে অবাক হয়েছিল হেঁটে স্কুলে যেতে হবে শুনে। তপতী তাকে বুঝিয়ে বললেন, আধ মাইল তো রাস্তা, এর জন্য গাড়িতে চড়ার কী দরকার? তুই তো রোজ এক মাইল হেঁটে ফেরিঘাট যাস আর দৌড়ে ফিরিস। পারবি না স্কুলে হেঁটে যেতে? অক্ষম তো নোস। তোর বাবা দুমাইল হেঁটে স্কুলে যেতেন, দুমাইল হেঁটে ফিরতেন।
এই শেষ কথাটাতেই কাজ হয়ে গেল। মা আমি দৌড়ে স্কুলে যাব? মিনু টগবগ করে উঠল।
না, না, অত বাহাদুরিতে কাজ নেই।
জানো মা, আমাদের স্কুলের অনেক বড় ছেলে সাইকেলে আসে। আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেবে?
দোব, যখন তুমি বড় ছেলে হবে।
মিনুকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তপতী ক্লাবে গেলেন। কান্তির কাছে শুনলেন, সাহেবের পাঠানো একটা লোক সাইকেল রিকশায় তুলে মোয়ারটা নিয়ে গেছে।
কিন্তু কান্তি, ঘাস কাটার ব্যবস্থা তো তাড়াতাড়ি করতে হবে। আর কোদালের হাতলের জন্য একটা বাঁশ কিংবা কাঠের ডাণ্ডা দরকার।
যে লোকটা দুধ আর ডিম দিয়ে যায় তাকে কালই আমি বলে দিয়েছি। ও থাকে এই মাইল দুয়েক দূরে বল্লভপুরে। বলেছিল আজ সকালে পাঠিয়ে দেবে লোক। তা এখনও তো এল না! কান্তিকে বিব্রত দেখাল।
ততক্ষণে একটা কাজ করা যাক। নেট-টা কোথায় আছে দেখো তো।
দেখেছি। সেক্রেটারির আপিস ঘরে যে কাঠের আলমারিটা তার পেছনে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে। বার করব কী! যা ধুলো ঝুল ময়লা, হাত দিতে ঘেন্না করে!
দেখি তো। তপতী একাই দেখতে গেলেন অফিস ঘরে।
তপতী আলমারির পেছনে উঁকি দিয়ে দেখলেন। কান্তি মোটেই বাড়িয়ে বলেনি। তালগোল পাকানো নেটটা যেন ধুলোর ঢিপি। তিনি ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে নেটের খানিকটা আঁকড়ে টেনে বার করলেন। সেই সঙ্গে বেরিয়ে এল তাঁত ছেড়া একটা র্যাকেট, যার হাতলে মুঠো করে ধরার জায়গার কাঠটা ফাটা। এটাও বোধ হয় ক্লাবেরই সম্পত্তি। নেটটাকে ঘর থেকে টানতে টানতে বাইরের লনে এনে ফেললেন। হাঁ হাঁ করে কান্তি ছুটে এল। আপনি কেন, আপনি কেন… আমাকে বললেই তো পারতেন।
কান্তি তুমি একদিকের দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি আর একদিক ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে এটা খুলব।
পুরো নেটটা খুলে তপতী হতবাক! অন্তত সাত-আট জায়গায় জালের সুতো ছিঁড়ে গর্ত হয়ে রয়েছে। সুতো কিনে ছেড়া গর্ত মেরামত করতে হলে যারা জাল বোনে তাদের কাউকে ডাকতে হবে। তার মানে খরচ! কিন্তু তার আগে নেটটাকে
ধুলে হাতই দেওয়া যাবে না। মহাদেবপুরে পানীয় জল সরবরাহ হয় উঁচু ট্যাঙ্ক থেকে। চব্বিশ ঘণ্টাই জল পাওয়া যায়। নেটটাকে তাঁরা দুজন জলের কলের নীচে টেনে এনে কল খুলে দিলেন।
এইভাবে থাকুক ঘণ্টাখানেক। ঝুল কালিটা অন্তত বেরিয়ে যাক।
ইতিমধ্যে ঘাস কাটার লোক এসে গেছে। বৃদ্ধ এক চাষি। তপতী টেনিস কোর্টটা দেখিয়ে তাকে বললেন, এই যে জমিটা এরই ঘাস মুড়োতে হবে, কত নেবে?
চোখমুখ কুঁচকে জমিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলল, পাঁচ টাকা দিতে হবে।
পাঁ-আ-আচ! তপতী যতটা বিস্মিত হওয়া দেখানো সম্ভব দেখালেন। পারব না। ঘণ্টা দুয়েকের কাজ, আর বলছ কিনা পাঁচ টাকা!
ঘণ্টা দুয়েকের কাজ নয় মা, খাটুনি আছে। সাড়ে চার টাকা হলে করব।
শেষ পর্যন্ত রফা হল সাড়ে চার টাকায়। তপতী কিছু পয়সা তো বাঁচালেন। ঘাস কেটে দৃরে নিয়ে গিয়ে ফেলার জন্য ঝুড়ি নেই। কান্তি রান্নাঘরের একটা বালতি এনে দিল। রান্না করে তার নিজের খাওয়ার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়। কান্তি সেইদিকে মন দিল। এরমধ্যেই ক্লাবের ক্যান্টিনের রাঁধুনিও এসে গেছে। সেও তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। কল থেকে তোড়ে নেটের ওপর জল পড়ছে। তপতী শাড়িটা একটু তুলে নেটের ওপর দাঁড়িয়ে লেফ্ট-রাইট শুরু করলেন। গলগল করে কালো জল বেরোতে লাগল। মিনিট দশেক পর তিনি হাঁফিয়ে উঠে থামলেন। এর পর নেটটাকে টেনে আনলেন ক্লাব লনের ওপর, ছড়িয়ে দিলেন শুকোবার জন্য।
মাথায় গামছা জড়িয়ে, খালি গায়ে বৃদ্ধ উবু হয়ে বসে ঘাস নিড়িয়ে চলেছে। কাটা ঘাস বালতিতে রেখে কিছুক্ষণ পরপর বালতিটা খালি করে আসছে দূরে গিয়ে। ছাতা মাথায় তপতী কোর্টের ধারে একটা চেয়ারে বসে। কান্তি এক কাপ চা নিয়ে এল।
এভাবে কতক্ষণ বসে থাকবেন মেমসাব, বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া করবেন না?
করব, ঘাসকাটাটা শেষ হোক আগে। না দেখলে তো যা-তা করে কাটবে। আর শোনো, নেটটা শুকিয়ে গেলে ভাঁজ করে পাকিয়ে তুলে রেখো। জালের মোটা সুতো কিনে এনে বুনে নেব।
আপনি বুনবেন? গঙ্গার ধারে কঘর জেলে থাকে, ওদের বললে তো হয়?
লোক দিয়ে করাতে গেলে তো পয়সা লাগবে। কী আর এমন শক্ত কাজ! আর মাঠের ইট পাথর কাঁকর বাছার জন্য দুটো লোক চাই, জোগাড় করতে পারবে?
সে আর এমন শক্ত কী, আমি এই বুড়োকেই বলে দিচ্ছি। কান্তি কথাগুলো বলে ঘাসকাটা বৃদ্ধের কাছে গেল। দু-চারটে কথা বলে ফিরে এসে জানাল, বুড়ো বলল ও নিজেই করবে, নাতনিকে সঙ্গে আনবে। মাটি চেঁছে দেবে, গত্তে মাটি ফেলবে, দশ টাকা নেবে।
দঅশ! তপতী হতাশ হলেন। এইটুকু কাজ, কোনও খাটুনিই নেই আর বলে কিনা দশ টাকা! দরকার নেই আমার।
দুপুর দুটোর সময় ঘাস কাটা শেষ হল। তপতী কোর্টে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। প্রায় একফুট লম্বা ঘাস চার ইঞ্চিতে নামিয়ে দিয়েছে। এরপর মোয়ার চালিয়ে আরও ছাঁটা হবে।
এ কী! এখানে ঘাস তো একদমই কাটোনি। তপতী দাঁড়িয়ে পড়ে আঙুল দেখালেন।
কাটব কী মা! ওখানটায় তো মাটি উঁচু হয়ে রয়েছে। জমি সমান করতে গেলে তো আপনাকে মাটি তুলতেই হবে, সেইসঙ্গে ঘাসও।
কথাটা সত্যি। মাটি তোলার মতো মাটি ফেলতেও হবে, তারপর সমান করা। সমান করতে তো জল ঢেলে মাটি নরম করে রোলার চালাতে হবে। কিন্তু রোলার কোথায় পাবেন?
মা, আমার মজুরিটা দিয়ে দেন, বৃদ্ধ গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, জমিতে ঢেলা বাছাইয়ের কাজ করাবেন তো কাল আসব।
দশ টাকা দিতে পারব না।
মা, ঘাসকাটার থেকেও এ কাজে খাটুনি বেশি। দেখছেন তো রোদুর কেমন। দুদিন তো লাগবেই।
রোদে পোড়া বৃদ্ধের মুখ আর সারা দেহ দেখে তপতীর মায়া হল। তিনি বললেন, ঠিক আছে, কাল সকাল সকাল এসো।
এবার তপতীর হুঁশ হল এখন তাকে বাড়ি যেতে হবে। বৃদ্ধকে টাকা দিয়ে, কান্তিকে নেটটা গুটিয়ে তুলে রাখতে বলে বাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলেন। পঞ্চাশ গজ হেঁটেই থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে এলেন।
কান্তি, ওই যে ভাঙা র্যাকেটটা দেখলাম ওটা এনে দাও তো। দেখি সারানো যায় কি না।
র্যাকেটটা নিয়ে ছাতা মাথায় বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে তপতীর মনে হল এইমাত্র যেন টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ডের খেলা জিতে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলেন। এর পর আছে তৃতীয় রাউন্ড, চতুর্থ রাউন্ড…। এতক্ষণে তপতী অনুভব করলেন। তাঁর ভীষণ খিদে পেয়েছে।
সন্ধ্যায় তপতী আজকের অভিজ্ঞতা তন্ময়কে জানিয়ে বললেন, এখন দরকার জালের জন্য মোটা সুতো আর জমিটাকে সমান করা। এখানকার বাজারে সুতোটা। যদি না পাওয়া যায় তা হলে কলকাতা থেকে তোমায় কিন্তু আনিয়ে দিতে হবে, সেইসঙ্গে দুটো টেনিস বলও। আর জমি লেভেল করার জন্য তোমাদের একটা রোলার যদি পাঠিয়ে দাও।
দোব। কাল চিনুকে নিয়ে কলকাতা যাব, তোমার যা যা দরকার তার একটা লিস্ট করে ফেলো। যে র্যাকেটটা এনেছ তাতে তাঁত বাঁধাতে কোন দোকানে যেতে হবে সেটাই তো জানি না। তন্ময়ের হঠাৎই এই সময় মনে পড়ে গেল একটা কথা। আচ্ছা, তোমার একটা র্যাকেট মনে হচ্ছে যেন আলমারিতে তোলা আছে দেখেছি!
তপতীকে সচকিত দেখাল। তিনি ভুলেই গেছলেন ওটার কথা। বিয়ের দু বছর পর একবার বাপের বাড়ি থেকে ফেরার সময় তাঁর দাদা র্যাকেটটা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, মিছিমিছি এটা এখানে পড়ে আছে, তুই বরং সঙ্গে নিয়ে যা। যদি খেলার সুযোগ টুযোগ পাস তো দরকারে লাগবে। র্যাকেটটা আলমারির ওপর তাকে জামাকাপড়ের তলায় সেই যে ঢুকেছে গত আট বছরে একবারও আর বেরোয়নি।
তপতী আলমারি খুলে জামাকাপড়ের স্তুপের তলা থেকে র্যাকেটটা বার করলেন। আট বছর আগের অবস্থাতেই রয়েছে। র্যাকেটের গায়ে সোনালি অক্ষরে ডানলপ লেখাটা নতুনের মতোই ঝকঝকে। মুঠোয় ধরতেই অদ্ভুত একটা শিহরণ তিনি বোধ করলেন। তেরো বছর আগে পা ভাঙার পর আর খেলেননি। বাঁ হাতের তালুতে র্যাকেটের মাঝখানের তাঁত দিয়ে তিন-চারবার আঘাত করলেন পুরনো অভ্যাসবশে। এভাবে ঘা দিলে টানটান করে বাঁধা তাঁতে পিং করে আওয়াজ ওঠে। আওয়াজটা শুনতে তাঁর ভাল লাগত। কিন্তু এখন আওয়াজের বদলে তিন-চারটে তাঁত ছিঁড়ে গেল। তিনি অপ্রতিভ হয়ে স্বামীর দিকে। তাকালেন।
ছিঁড়ে তো যাবেই। গোরু কি মোষের নাড়িভুড়ি দিয়ে তৈরি তাঁত এত বছর পরও কি পচবে না? ভালই হল দুটো র্যাকেটই নিয়ে যাব, কিন্তু কোথায় এসব বাঁধায় তা তো জানি না।
তপতী কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললেন, এ ব্যাপারে সেরা লোক রাজেন। ঠাকুরপো। টেনিস খেলেছে, এখনও অভ্যাসটা ছাড়েনি। নিশ্চয় ও জানে কোথায় তাঁত বাঁধানো হয়।
তন্ময় ঘড়ি দেখে বললেন, এখনি চলো।
দুজনের হাতে দুটো র্যাকেট, একটায় তাঁত নেই, রাজেন তো অবাক! কী ব্যাপার দাদা, খেলতে যাচ্ছেন কোথাও?
এই র্যাকেট নিয়ে খেলতে যাওয়া? ঠাট্টা হচ্ছে? তন্ময় চেয়ারে বসলেন। তোমার বউদি তো টেনিস কোর্ট করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। আজ ঘাস। ছাঁটিয়েছে। নেটটা বার করে দেখে তাতে বড় বড়ছিদ্র, হাতি না থোক বেড়াল গলে যেতে পারে। সেটা সারাবার জন্য সুতো আনার হুকুম হয়েছে। উনি নিজে বসে বসে ছিদ্র বন্ধ করবেন। তারপর ইট পাথর বাছাই। পয়সা বাঁচাতে সেটাও বোধ হয় উনি নিজে করবেন। জমি লেভেলিং করার জন্য রোলার টানানোর অডারও হয়েছে।
উরিব্বাস। রাজেন চেয়ারের ওপর উবু হয়ে বসল। করেছেন কী! আপনি তো দেখছি যা ভাবেন তাই করেন।
তা করতেই হয়। এখানে এত শিক্ষিত লোক, সবাই ভাল চাকরিও করেন কিন্তু নিজেদের সন্তানদের জন্য ঠিকভাবে চিন্তা করেন না। আমার সন্দেহ হয় ছেলেমেয়েদের যথার্থই ওঁরা ভালবাসেন কি না। কিন্তু আমার সন্তানদের আমি ভালবাসি অন্যদেরও। বলে তপতী তাঁর চাঁদা তোলার অভিজ্ঞতার কথা রাজেনকে বললেন।
কিন্তু শুধু চাঁদা দিলেই তো টেনিস খেলা যায় না, বউদি নিজের র্যাকেটও থাকা দরকার। বাচ্চার বাবারা কি সেটা কিনে দেবে?… তবে দিক বা না দিক আমি দুটো র্যাকেট ডোনেট করব। ওদের জন্য দরকার হালকা ছোট মাপের র্যাকেট।
তা হলে আমাদের এই দুটোরও ব্যবস্থা করে দাও রাজেন।
রাজেন ক্লাবের র্যাকেটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, এটার যা অবস্থা, উনুনে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। তারপর দ্বিতীয় র্যাকেটটা তুলে ওরে বাবা এটা তো দেখছি ডানলপ! পেলেন কোথায়?
তোমার বউদির…. এক সময় খেলত। ইলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ানও হয়েছিল।
রাজেনের বিস্ফারিত চোখ দুটি তপতীকে লজ্জায় ফেলে দিল। পা নামিয়ে বসে রাজেন সিরিয়াস গলায় বলল, এবার বুঝলাম কেন আপনি টেনিস চালু করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। নিজে খেলাধুলো না করলে কেউ খেলার মর্ম বোঝে না। কথা দিচ্ছি সাধ্যে যতটা কুলোয় আপনাকে আমি সাহায্য করব।
তা হলে কোর্টটা যাতে ভালভাবে তৈরি করা যায় সেই ব্যাপারে পরামর্শ দিন। তপতী সাগ্রহে বললেন।
বউদি, এখানে খেলবে সেইসব বাচ্চা, যারা জীবনে কখনও র্যাকেট ধরেনি। ওদের জন্য উইম্বলডনের কি সাউথ ক্লাবের মতো সারফেস এখনই দরকার নেই। বলটাকে নেটের এপার ওপার করাটাই আগে শিখুক, র্যাকেটের সঙ্গে বলের সম্পর্কটা আগে গড়ে তুলুক, তারপর গ্রাউণ্ড স্ট্রোক শিখবে। নেটে বড় বড় ছ্যাঁদা থাকলেও কিছু আসে-যায় না। আপনি মাঠটাকে সমান করে দিন তারপর আমি মাপজোক করে চুনের দাগ কেটে দেব। সাউথ ক্লাবে পুরনো বল পাওয়া যাবে, এনে দেব। আপনার প্রধান যেটা দরকার সেটা হল খেলার লোক। খেলার জন্য দুজনের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন আর আপনার বড় ছেলে, মোট তিনজন।
চারজন। আমার ছোট ছেলের কথাটা ঠাকুরপো ভুলে যাচ্ছেন। আসলে সবাই চিনুকে ভুলে যায় ওর রুগণ দুর্বল শরীরের জন্য। শরীরটা তৈরি করানোর জন্যও ওকে খেলায় আনব। তপতীর স্বরে ফুটে উঠল প্রত্যয় আর জেদ। একবার যখন ঠিক করে নিয়েছি কী করতে চাই, তখন যত পরিশ্রমই হোক, যত অর্থকষ্টই হোক কাজটা আমরা করবই।
তপতী কথাটা বলে তন্ময়ের দিকে তাকালেন। সায় জানিয়ে তন্ময় মাথা নাড়লেন।
রাজেন অস্ফুটে বলল, অদ্ভুত আপনারা!
.
০৪.
সকালে তপতী মিনুকে পৌঁছে দিয়ে হেডমিস্ট্রেস জয়ন্তী বসুর সঙ্গে দেখা করলেন।
চিন্ময় তো ক্লাস করতে পারছে না, পড়াশুনোয় পিছিয়ে পড়ছে। আমি অবশ্য রোজ সন্ধ্যায় ওকে নিয়ে পড়াতে বসি। তা হলেও যেভাবে লেসগুলো স্কুলে করানো হচ্ছে সেটা ফলো করা দরকার। বাড়িতে আমার পড়ানো আর স্কুলের পড়ানো একই হওয়া উচিত। তাই বলছিলাম কী, আমি যদি ক্লাসে বসে নোট নিই, তা হলে কি আপনার আপত্তি হবে? আপত্তি না থাকলে যদি অনুমতি দেন। তপতী আবেদন জানালেন।
নিশ্চয়, নিশ্চয়, আপত্তি হবে কেন। তবে ক্লাস ওয়ানে এমন কিছু পড়া হয় না যে, আপনাকে নোট নিতে হবে। যাই হোক আপনি চলুন এখন মিসেস বসাক ইংলিশ ক্লাস নিচ্ছেন, আপনাকে ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে আসি। জয়ন্তী বসু চেয়ার ছেড়ে উঠলেন, চিন্ময় এখন আছে কেমন?
ভালই। আজ ডাক্তার ওর এক্স-রে দেখে জানাবেন সেরে উঠেছে কি না।
কমপ্লিটলি সেরে উঠলে ডাক্তারের সার্টিফিকেট দিয়ে ওকে স্কুলে পাঠাবেন। বুঝলেন তো অনেক গার্জিয়ান আবার খুব খুঁতখুঁতে হন। মিসেস বসুমল্লিক আপনার বড় ছেলেটি কিন্তু দারুণ অ্যাথলিট, পড়াশুনাতেও তেমনই ভাল।
বলা ছাড়া তপতী কোনও উত্তর দেননি। খুঁতখুঁতে শব্দটিকে তিনি প্রসন্ন মনে নিতে পারেননি। সংক্রামক বিপজ্জনক রোগ কি শুধু তাঁর ছেলেরই হল? কত তো ছেলেমেয়ে রোগজীবাণু শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সবাইকে যদি পরীক্ষা করা যেত!
পরপর দুটি ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে বসে তিনি পড়া বুঝে নিলেন। তাঁর মনে হল বাড়িতে তিনি চিনুকে যা পড়ান তার থেকে স্কুলের পড়া অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এখানে একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে পড়ায়, তাই গতিটা প্রথম দিকে মন্থরই হয়, এটা তপতী জানেন। এখন তাঁর মনে হচ্ছে, চিনুকে তিনি একটু বেশিই এগিয়ে দিয়েছেন, এটা ভাল না মন্দ হচ্ছে তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না।
ক্লাবের কাছাকাছি এসে দেখলেন, সেই বুড়ো আর একটা বছর দশেকের মেয়ে। কোর্টের এক প্রান্তে উবু হয়ে বসে। তাদের সামনে বালতিটা। কান্তি জানাল, ঘণ্টাখানেক হল ওরা এসে কাজ শুরু করেছে। তপতী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের দেখলেন। দুজনে ইট-পাথর বাছাই করে জড়ো করছে নিজেদের পাশে, পরে মেয়েটি দু হাতে সেগুলো তুলে বালতিতে ফেলছে। বালতি ভরে গেলে বুড়ো ফেলে দিয়ে আসছে কোর্টের অন্তত তিরিশ হাত দূরে।
তপতীর মনে হল, চুপচাপ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকার চেয়ে যদি তিনি নিজেও হাত লাগান তা হলে কাজগুলো এগিয়ে থাকবে, সময়ও বাঁচবে। কী কাজ করা যায়? সুতো থাকলে জালটার ফুটোগুলো বোনার কাজ করতে পারতেন। রাজেন ঠাকুরপো অবশ্য বলেছেন, ফুটোগুলো এখন তেমন অসুবিধে করবে না। কোর্টটার মাঝে উঁচু একটা বাধা তুলে দুভাগ করা, আপাতত এটাই হবে নেটের কাজ। বাচ্চারা এখন প্রচণ্ড জোরে বল হিট করবে না। লন-মোয়ারটা যদি মেরামত করে দিয়ে যেত তা হলে সেটা দিয়ে ঘাস ছাঁটার কাজ শুরু করে দিতে পারতেন। কিন্তু মোয়ারটা এখনও ফেরত আসেনি।
কান্তি থলি হাতে কোথায় যেন বেরোচ্ছিল। তপতীকে দেখে বলল, মেমসাব, কোদালের বাঁশটা খুঁজে পেয়েছি। দোকানে যাচ্ছি। এসে লাগিয়ে দেব।
তপতীর নজরে পড়ল, কোর্টের অসমান জায়গাগুলো। কোদাল দিয়ে তো সমান করে ফেলার কাজটা করা যায়! যেমন ভাবা তেমনই শুরু করে দেওয়া। ভেতরে গিয়ে কোদালটায় বাঁশের হাতল লাগাবার চেষ্টা শুরু করলেন। বাঁশটা একটু সরু, কোদালে লাগালে ঢলঢল করছে। একটা কাঠের গোঁজ দিলে টাইট হবে। তিনি রান্নার জায়গা থেকে চ্যালাকাঠের একটা টুকরো সংগ্রহ করে এনে সেটা কোদালে ঝুঁজলেন হাতলের সঙ্গে। একটা আধলা ইট দিয়ে ঘা মেরে মেরে কাঠটাকে বসালেন। হাতল ধরে কোদালটা নাড়িয়ে পরীক্ষা করলেন, টাইট হয়ে বসেছে কি না। মনে হল এবার ব্যবহার করা যাবে। তাঁর মুখে সাফল্যের হাসি ফুটল।
কোর্টের যে জায়গাটা উঁচু বেশি, তপতী সেটাকেই প্রথম লক্ষ্যবস্তু করলেন। ঘাসের নীচে কয়েকটা ইটের মাথা জেগে রয়েছে। মাটির নীচে ইটের অনেকটাই গাঁথা। তপতী একটু ঝুঁকে কোদালটা খানিকটা তুলে জমিতে ঘা দিতেই ঠক আওয়াজ হল। শক্ত করে আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে, ঠোঁট চেপে মনে মনে। বললেন, দেখাচ্ছি মজা, সবকটাকে তুলব।
প্রথমে তিনি কোদাল দিয়ে ঘাস চেঁছে জমির অনেকটা পরিষ্কার করলেন। গোটাপাঁচেক ইট, ভাঙা ভাঁড় মাটিতে গাঁথা। তপতী আড়চোখে দেখলেন, কাজ ফেলে বুড়ো আর নাতনি তাঁর দিকে তাকিয়ে অবাক চোখে। দেখবেই তো, ওদের ধারণা এসব মেহনতের কাজ শুধু ওরাই পারে … ফুঃ, করে দেখিয়ে দিচ্ছি। মনে মনে কথাগুলো বলে কোদালটা মাথার ওপর তুলে বড় একটা ইটের মাথা লক্ষ্য করে সজোরে কোদাল নামালেন। কোদালটার ধারালো দিকটা শক্ত ইটের ওপর পড়ে ছিটকে এসে তপতীর বাঁ পায়ের গোছের কাছে আঘাত করল জোরে। হাত থেকে কোদালটা পড়ে গেল।
তপতী কয়েক সেকেন্ড বিমূঢ় হয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে শাড়ির প্রান্ত খানিকটা তুলে পায়ের দিকে তাকিয়েই তাঁর মাথা ঘুরে গেল। প্রায় পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হয়ে পায়ের মাংস চেরা আর তার মধ্য থেকে উঁকি দিচ্ছে সাদা হাড়। মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোলেন ক্লাবঘরের দিকে। বৃদ্ধ আর নাতনি তাঁর পায়ের দিকে তাকিয়েই ছুটে এল।
হাসপাতাল যাব। তার আগে এটা ভাল করে বাঁধতে হবে, দেখছ কী রক্ত পড়ছে!
হাসপাতাল তো অনেকটা রাস্তা, যাবেন কী করে মা? বৃদ্ধ বিশাল সমস্যার সামনে পড়ে গেল। এটা বাঁধার কাপড়ই বা এখানে পাব কোথায়?
দাদু, একটা গামছা শুকোচ্ছে।
না, না, না। তপতী আঁতকে উঠলেন। আমার শাড়ির আঁচলটা থেকে বরং ছিঁড়ে বেঁধে নিচ্ছি।
বৃদ্ধ নাতনিকে বলল, খানিকটা ঘাস চিবিয়ে জায়গাটায় চেপে ধর। নাতনি ছুটে গিয়ে এক মুঠো ঘাস ছিঁড়ে মুখে পুরল।
তপতী বারণ করতে গিয়েও করলেন না। তিনি শুনেছেন, এইসব টোটকা চিকিৎসা খুব কাজ দেয়। মেয়েটি চিবোনো ঘাস তাঁর থেঁতলানো কাটা জায়গায় চেপে বসিয়ে দিল। তপতী শাড়িটা ছিড়লেন।
এইসময় দূরে দেখা গেল একটি ছেলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। হ্যান্ডেলে ঝুলছে স্কুলব্যাগ, খুকি, দৌড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে ডাক তো ছেলেটাকে।
বৃদ্ধের নাতনি চিৎকার করতে করতে ছুটল। অ্যাই সাইকেল, অ্যাই সাইকেল…।
ছেলেটি সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। সেই সময় বৃদ্ধ তপতীকে বোঝাচ্ছিল, মা, যার কাজ তারে সাজে, অন্য লোকে লাঠি বাজে। … আপনি কেন মিছিমিছি কোদাল ধরতে গেলেন? আমাদের পয়সা দিতে তো আপনাদের কষ্ট লাগে, দর কষাকষি করে পয়সা কমান। … আমাকে বললে তো পারতেন, আমি করে দিতুম, তা হলে এই কাণ্ডটা ঘটত না।
তা হলে তো আবার টাকা চাইতে। কাপড়ের পটি পায়ে জড়াতে জড়াতে তপতী বললেন।
তা তো চাইতুমই।
আমার পুঁজি তিরিশ টাকা আর আমার চাঁদা দশ টাকা মোট চল্লিশ টাকা, .. তপতীর কথার মধ্যেই ছেলেটি এসে পড়ল।
কী হয়েছে আপনার? মেয়েটা বলল পা নাকি দু-আধখানা হয়ে গেছে! কিশোর ছেলেটির চোখে মুখে উৎকণ্ঠা।
হতে পারত বাবা, কপালজোরে বেঁচে গেছি। আমাকে এখনই হাসপাতাল যেতে হবে। পটিতে একটা গিট দিলেন তপতী। তুমি কি মহাদেব হাই স্কুলে পড়ো?
হ্যাঁ, ক্লাস টেন-এ। আপনি আমার সাইকেলের পেছনে বসবেন? তা হলে আমি সাইকেলটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে যেতুম। … মাসিমা, আপনাকে আমি স্কুলের স্পোর্টসে দেখেছি। আপনার ছেলে তো অনেক প্রাইজ পেল! … সাতটা, তাই না?
হ্যাঁ, মৃন্ময়, ক্লাস থ্রিতে পড়ে। যন্ত্রণা হচ্ছে, তার মধ্যেই তিনি আরাম পেলেন অনেক প্রাইজ পেল শুনে। পড়ায় ফার্স্ট হলে মিনু কি এমন বিখ্যাত হত?
তপতীকে সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে উঠে বসতে সাহায্য করল ছেলেটি এবং বৃদ্ধ। দুজনে সাইকেলের দুদিকের হ্যান্ডেল ধরে সন্তর্পণে হাঁটতে শুরু করল। মিনিট পাঁচেক পরই থলি হাতে কান্তিকে দেখা গেল বাজার থেকে ফিরতে। চোখ কপালে তুলে ঘটনার কথা শুনে কান্তি বৃদ্ধকে বলল, তোমাকে আর হাসপাতাল যেতে হবে না, আমি সাইকেল ধরছি। থলিটা নিয়ে যাও আর গিয়ে কাজে লেগে পড়ো।
সাইকেল এবার ধরল ছেলেটি আর কান্তি। কয়েক গজ এগগাবার পর তপতী ব্যস্ত হয়ে বললেন, থামো, থামো, কান্তি, বুড়োকে জিজ্ঞেস করে এসো তো কোর্টটা সমান করে দিতে কত টাকা নেবে?
কান্তি ছুটে গিয়ে বৃদ্ধকে ধরল এবং সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল। মেমসাব, বলল পাঁচ টাকা, দরাদরি চলবে না।
পাঁ-আ-আচ টাকা! বুড়োটা আমাকে মেরে ফেলবে কান্তি, ফতুর করে দেবে। চার টাকায় হয় না?
মনে তো হল, এক পয়সাও কমাবে না। বলল, মায়ের পা কেটেছে বলে পাঁচ টাকা, নয়তো ছটাকা চাইত।
কিন্তু টাকাটা তো আমার নিজের নয়, চাঁদার টাকা, পাঁচজনের টাকা। আমার তো অধিকার নেই নয়ছয় করে খরচ করার। তপতী করুণ মুখে বললেন।
মেমসাব, আপনার কী অত মাথাব্যথা খরচ বাঁচাবার! আমি বলে আসছি। বুড়োকে, পাঁচ টাকাই পাবে। কথাটা বলেই কান্তি উত্তরের অপেক্ষা না করে বৃদ্ধকে ধরার জন্য দৌড়ল।
ওরা যখন হাসপাতালে পৌঁছেছে, তন্ময় তখন চিনুকে এক্স-রে করিয়ে বেরোচ্ছেন। দ্রুত এমার্জেন্সিতে ভর্তি হলেন তপতী। তাঁর পায়ে আঠারোটা সেলাই হল এবং পর্যবেক্ষণের জন্য রাখা হল একটি কেবিনে।
অতি অবশ্যই আজ চিনুকে নিয়ে কলকাতায় যাবে। তন্ময়কে এই নির্দেশ দিয়ে চোখ বন্ধ করে তপতী ঘোষণা করলেন, না গেলে আমি মরে যাব।
উতলা হচ্ছ কেন, আমি অপূর্বর কাছে আজই যাব। উদ্বিগ্ন তন্ময় নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করলেন তপতীকে।
সুতো আনবে। লন-মোয়ারটা আজ এসে পৌঁছয়নি। কালই যাতে আসে একটু দেখো। মিনুকে যদি পারো স্কুলে পৌঁছে দিয়ো আর বাড়ি এনো, গাড়ি করেই। এটা ব্যতিক্রম বলে ধরতে হবে। … যে বুড়োটা কাজ করছে তাকে টাকা দেওয়া হয়নি। দশটা টাকা এক্ষুনি কান্তির হাতে দিয়ে এসো, বেচারা গরিব মানুষ। আমি দিনকয়েক বোধ হয় হাঁটাচলা করতে পারব না। আজই আমি বাড়ি যাব।
ডাক্তার রাজি হলেন না। আঘাতটা মোটেই হালকা ধরনের নয়। অন্তত তিনদিন তপতীকে পর্যবেক্ষণে থাকতেই হবে। তন্ময়ও ডাক্তারের সঙ্গে একমত। গম্ভীর স্বরে স্ত্রীকে তিনি শুধু বললেন, ডাক্তারবাবুর কথার ওপর আর একটা কথাও নয়। কথা শেষ করেই তিনি কেবিন থেকে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।
তন্ময় কেবিনে আবার ঢুকলেন রাত আটটা নাগাদ, সঙ্গে দুই ছেলে। চোখ-মুখ উদ্ভাসিত, হাতে এক্স-রে প্লেটের খাম, কলকাতা থেকে গাড়ি চালিয়ে সোজা হাসপাতালে এসেছেন। চিনু কিওন্ড … চিনু সেরে গেছে! তন্ময় দু হাত তুলে ঝাঁকালেন।
ধড়মড় করে তপতী খাটে উঠে বসলেন এবং ফ্যালফ্যাল করে চিনুর দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে তাঁর চোখ জলে ভরে উঠল। লাজুক মুখে চিনু মার দিকে এগিয়ে গেল। দু হাতে ছেলেকে বুকে চেপে, চুম্বনে-চুম্বনে, মুখ ভরিয়ে দিয়ে তপতী বললেন, আমাদের একটা দুশ্চিন্তা দূর হল, এবার টেনিস খেলাটা শুরু করতে পারলেই হয়। দু হাত কপালে ঠেকিয়ে তিনি ভগবানকে প্রণাম জানালেন।
গলাখাঁকারি দিয়ে তন্ময় বললেন, এখনও কিন্তু চিনু কমপ্লিটলি সেরে ওঠেনি। লাংয়ের ওপর স্পটটা প্রায় মিলিয়ে এসেছে, সেরে উঠেছেই বলা যায়, তবে ওষুধপত্তর আরও তিন মাস চালিয়ে যেতে বলল অপূর্ব।
তিনটে মাস তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তপতী চিনুর মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন।
কিন্তু তিনটে মাস তপতীর পক্ষে দেখতে দেখতে কাটল না। তাঁর ক্ষতটা তিনদিনের মধ্যেই বিশ্রী দিকে মোড় নিল। পায়ের মাংস, হাড়, স্নায়ু, শিরা, সব মিলিয়ে জখমের জের মারাত্মক হয়ে উঠল। ইঞ্জেকশনে ঝাঁঝরা হলেন, মুঠো মুঠো ওষুধের ট্যাবলেট গিলতে হল এবং বাড়ি ফিরলেন পাঁচ সপ্তাহ পর। তাঁর উঠে দাঁড়াতে সময় লাগল আরও দু সপ্তাহ। ততদিন সংসার চালিয়েছে বেলা। আর দুই ছেলেকে দু হাতে আগলে রেখেছিলেন তন্ময়।
এই সময় প্রায় প্রতিদিনই রাজেন এসে দেখা করে যেত তপতীর সঙ্গে। কোর্ট তৈরি করার দায়িত্ব রাজেন নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে এতদিনে প্রায় শেষ করে এনেছে, তাকে সহযোগিতা করেছে কান্তি। বুড়ো আর তার নাতনি ইট, পাথর, কাঁকর বেছে, জমি সমান করে দেয় মাটি ফেলে। লন-মোয়ার চালিয়ে কান্তি ঘাস হেঁটে এক ইঞ্চি করে দিয়েছে। বহু জায়গায় জমিতে টাক দেখা দেয়, সেইসব জায়গায় নতুন করে ঘাস লাগানো হয়েছে। কোর্ট মেপে দড়ি বেঁধে সেই দড়ি বরাবর চুনগোলা দিয়ে লাইনগুলো টানার কাজও শেষ। নেটের ফুটোগুলো কান্তি লোক ধরে এনে সারিয়ে ফেলেছে। নিয়মিত জল দিয়ে জমি ভেজানো হয়। ক্লাবে যারাই আসে তকতকে সবুজ ঘাসে ঢাকা কোর্টটার দিকে প্রশংসাভরা চোখে তাকায়।
কবে খেলা শুরু হবে রাজেন? তন্ময় একদিন জানতে চাইলেন।
বউদি সেরে উঠলে। উনি প্রথম সার্ভিস করে এই কোর্ট ওপেন করবেন। তার আগে এখানে কোনও খেলা হতে পারে না।
অনিরুদ্ধ আর গৌতম, যাদের বাবা চাঁদা দিয়েছেন, তারা প্রায়ই উঁকি দিয়ে দেখে যায় তাদের তপতী কাকিমাকে। খেলার জন্য তারা অধৈর্য হয়ে পড়েছে। তপতীর র্যাকেটের তাঁত বাঁধিয়ে দিয়ে গেছে রাজেন, সেইসঙ্গে ছোট দুটি নতুন র্যাকেট আর কয়েকটা পুরনো বল।
তপতী সবকিছুই শোনেন বিছানা থেকে। এমনকী, বিকেলে খাওয়ার ঘরের দেওয়ালে লাগা টেনিস বলের শব্দ আর সেইসঙ্গে বেলার শাসানি। জিনিসপত্তর ভাঙলে কিন্তু দুজনের ব্যাট-বল উনুনে দিয়ে দেব।
বেলামাসি, ব্যাট নয় র্যাকেট। মিনুর গলা।
ওই হল।
মিনু দাবা খেলতে আর যায় না। এখন স্কুল থেকে ফিরেই তার নতুন নেশা। র্যাকেট আর বল। আলমারির কাচ ভাঙা। আর দেওয়ালে বলের ছোপ ধরানোর পর এখন সে বাড়ির বাইরে গিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে খেলে। চিনু স্কুলে যাচ্ছে না এখনও। তার কাজ বসে বসে দাদার খেলা দেখা। সে যথেষ্ট জোর দিয়ে মুঠোয়। র্যাকেট ধরতে পারে না, কয়েকবার বল মারার জন্য চালালেই হাত ভার হয়ে যায়।
মা, ফোরহ্যান্ড তো এইভাবে মারে। মিনু শোওয়ার ঘরে একটা কাল্পনিক বলের দিকে র্যাকেট চালাল।
হ্যাঁ, কে শেখাল? বালিশে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে তপতী খাটের ওপর। মিনুর উৎসাহ তাঁকে তাজা করে তুলল।
রাজেনকাকা দেখিয়ে দিয়েছে। … সার্ভিস করা দেখবে মা?
ঘরের মধ্যে সার্ভিস-ফোরহ্যান্ড কিছু নয়। সবকিছু বাড়ির বাইরে।
তুমি কবে সেরে উঠবে মা?
তপতীর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি তাঁকে সেরে উঠতেই হবে। ডাক্তার বলেছেন, দিন সাতেকের মধ্যেই শোওয়ার ঘর থেকে বসার ঘর পর্যন্ত হাঁটার অনুমতি দেবেন।
অবশেষে তিনি এক বিকেলে হাঁটলেন দুই ছেলের কাঁধে হাত রেখে। এক-পা এক-পা করে বসার ঘরে পৌঁছতেই হাততালি দিয়ে উঠল মিনু আর চিনু। দুহাত তুলে তপতী মুঠো ঝাঁকালেন। পেরেছি। কথাটা দুই ছেলের মাথার মধ্যে ঢুকে গেল মায়ের দুই হাত তোলা ছবিটাকে সঙ্গে নিয়ে।
কোর্টের উদ্বোধনের জন্য ঠিক হল রবিবারের বিকেল। তন্ময়, রাজেন আর শুভা শনিবার সন্ধ্যায় ক্লাবে গিয়ে টেল ঘুরে-ঘুরে সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য। অনুরোধ জানাল। নোটিশ বোর্ডেও একটা বিজ্ঞপ্তি শুভা সেঁটে দিল। প্রত্যেকেই তাঁরা আসবেন। প্রতিভা মজুমদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন তপতী সম্পর্কে। দেখাল বটে তপতী! একা মেয়েমানুষ সাহস করে শুরু করেছিল বলেই তো আজ ছেলেমেয়েদের জন্য একটা খেলার ব্যবস্থা হল। তার ওপর ভাবো কী ঝঞ্জাটই না পোয়াতে হল, প্রথমে ছোট ছেলেটা, তারপর নিজে পড়ল বিছানায়। অবশ্য রাজেন আর তন্ময়বাবু যে পরিশ্রম করে শেষ করলেন, সেটাও বলতে হবে।
আর-একজন বললেন, কত খরচ হল বলুন তো? ক্লাব থেকে একটা পয়সাও তো দেওয়া হয়নি!
আচ্ছা, টেনিস তো খেলা হবে, কিন্তু খেলাটা তো শিখতে হবে, নাকি ছেলেমেয়েরা আপনাআপনিই শিখে যাবে?।
তা বটে! মিসেস ঘোষাল তো মোক্ষম প্রশ্ন করেছেন! প্রতিভা ঝুঁকে বসলেন। খেলা শেখাতে তো মাস্টার লাগবে।
মাস্টার নয়, মাস্টার নয়, কোচ লাগবে বলুন। শুধরে দিলেন চন্দ্রিমা দত্ত।
ওই হল। তা বাপু কোচ কোথেকে আসবে? তাকে তো পয়সা দিতে হবে।
কেন, মিসেস বসুমল্লিক নিজেই কোচিং করবেন। শুনেছি তো একসময় খেলতেন-টেলতেন, অনেক কাপ-মেডেলও পেয়েছেন।
আরে রাখো তো তোমার কাপ-মেডেল, অমন কাপ-মেডেল অনেকের ঘরেই পাবে। প্রতিভা চাপা ধমক দিলেন। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে সেটা কি লক্ষ করেছ? বিয়ের আগে একটা পা ভেঙেছিল, এবার আর-একটা পা-ও গেছে। ও শেখাবে খেলা!
প্রতিভাদি, কাল আসছেন তো?
কাল তো রোববার। কখন লোকজন এসে পড়ে তার কি ঠিক আছে?
যা বলেছেন। আমাকেও কাল দিদির বাড়ি যেতে হবে। মিসেস ঘোষাল হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
পরদিন বিকেল পাঁচটায় ভক্সহল থেকে ওঁরা নামলেন ক্লাবের সামনে। তন্ময়ের হাত ধরে তপতী গাড়ির বাইরে পা রেখেই টলে পড়েছিলেন। মিনু তাড়াতাড়ি মায়ের হাত চেপে ধরল।
আমি ঠিক আছি মিনু … হাত ছেড়ে দে।
রাজেন এগিয়ে এল, সঙ্গে শুভা। কোর্টের ধারে একটা টেবল। তাতে রাখা হয়েছে দুটো র্যাকেট আর দুটো বল। চেয়ারে বসে আছেন ছ-সাতজন। নেট খাটানো রয়েছে। চুনের দাগ দুপুরে টানা হয়েছে। শুভা হাত ধরে এনে তপতীকে টেবলের পেছনে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলল, বউদি আপনার র্যাকেট কই?
গাড়িতে আছে।
তপতী আজই প্রথম দেখলেন তাঁর বহু কাঙ্ক্ষিত টেনিস কোর্টটিকে। তাঁর মুখ প্রসন্নতায় ভরে উঠল। গৌতম, অনিরুদ্ধর হাফশার্ট, শর্টস, মোজা, কেডস মিনুর মতোই সাদা। ওদের বাবা ও মায়েরাও এসেছেন। কিন্তু কোর্টের ধারেকাছে কোনও লোক নেই, শুধু কান্তি ছাড়া।
আজ আমাদের টেনিস কোর্টের উদ্বোধন হবে। রাজেন এবার টেবলের ধারে দাঁড়িয়ে স্বরটা একটু উঁচু করে বলল, বক্তৃতা শোনাতে গেলে যত শ্রোতার দরকার হয়, তত লোক এখানে নেই। সুতরাং বেশি কথা বলব না। ছোটদের নিয়মিত খেলা দরকার, তারা খেলতে চায়। এই সত্যি কথাটা আমরা, বড়রা, বুঝতে চাই না। কিন্তু ছোটরা নিজেরা খেলার ব্যবস্থা করতে পারে না, পারার কথাও নয়। সংগঠন না থাকলে খেলা যায় না, আর এইটুকু-টুকু ছেলেমেয়ের পক্ষে একটা সংগঠন গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। এটা গড়ে দেয় বড়রা।
এখানে ছোটদের খেলাধুলার কোনও ব্যবস্থা নেই, এই অভাবটা লক্ষ করেই শ্ৰীমতী তপতী বসুমল্লিক প্রথম উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসেন। কাজ শুরুও করেন, কিন্তু একটা দুর্ঘটনায় তাঁকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়তে হয়। তিনি যে-কাজ শুরু করেছিলেন, অবশেষে আমরা তাকে সম্পূর্ণ করতে পেরেছি। আমি বিশেষ করে ধন্যবাদ দেব গৌতম আর অনিরুদ্ধর অভিভাবকদের। তাঁরা তাঁদের ছেলেদের খেলার জন্য এখানে পাঠিয়ে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। আর ধন্যবাদ জানাব অফিসার্স ক্লাবের কর্মী কান্তি সাঁতরাকে। সে তদারক না করলে এই কোর্ট তৈরি হয়ে উঠতে পারত না। যাই হোক, বেশি কথা বলব না বলেও বলে ফেললাম। এবার অনুরোধ করব বউদি আপনি কোর্টে এসে প্রথম সার্ভিসটা করুন।
তপতী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই কান্তি ছুটে এল সাত-আটটা জবাফুলে গড়া একটা স্তবক নিয়ে। মেমসাব, আপনার জন্য।
স্তবকটা হাতে নিয়ে টেবলে রাখলেন। গাড়ি থেকে তন্ময় তপতীর ডানলপ র্যাকেটটা নিয়ে এসেছেন, সেটা স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিলেন।
ঠাকুরপো, সার্ভিস তো করব, রিসিভ করবে কে?
কেন, আমি!… র্যাকেট তো আমিও এনেছি, শুভা, দাও তো।
বল হাতে তপতী দাঁড়ালেন বেস লাইনে। তাঁর পায়ে নতুন কেস। বাঁ পায়ের পাতা লাইনের বাইরে রেখে বাঁ হাতের মুঠোয় বলটা চেপে ধরে সামনে তাকালেন এবং তাকিয়েই ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁর মনে হচ্ছে নেটটা অনেক দূরে। জীবনে তিনি টেনিস কখনও খেলেননি। সার্ভ করে বলটাকে নেটের ওপারে তিনি কখনওই পাঠাতে পারবেন না। সবাই কত আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু ওদের মুখগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে, পা কাঁপছে। খুব অন্যায় করতে চলেছেন বলে তাঁর মনে হল। এভাবে লোক হাসাতে কেন তিনি রাজি হলেন?
মা, তপতী চমকে পেছনে তাকালেন। গুটিগুটি চিনু কখন যেন তাঁর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে তার রুণ দুটি হাতের মুঠি তুলে ঝাঁকাল, মা, পেরেছি বলো।
বাঁ হাত সামনে বাড়িয়ে তিনি বলটা শূন্যে ছুড়লেন। হাতটা আকাশমুখখা সোজা হল। বল থেকে চোখ সরালেন না। র্যাকেট ধরা ডান হাতটা পেছনে। টানলেন। শিরদাঁড়া, পিঠ পেছনে বাঁকল। তারপর সামনের দিকে একটা ধাক্কায় র্যাকেটটা আছড়ে পড়ল নেমে আসা বলের ওপর।
সবাইকে অবাক করে বলটা নেটের মাথা ঘেঁষে ওপারে গিয়ে পড়ল। রাজেন বলটা রিটার্ন করার জন্য দুপা এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল। তপতী মুখ থুবড়ে পড়ে গেছেন, পায়ে জোর না থাকায়।
মা পেরেছ, দেখো।